www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভয়ঙ্কর রাত

এক টানা গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে অরণ্য । বাঙ্গালী আইরিশ, বয়স বিশ কি একুশ, পেশায় ক্রিকেটার , ডাবলিন কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবে খেলে । জাতীয় দলে ঢুকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আজকে ও ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য কর্ক যাচ্ছে । বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যার পথে, তার উপর আকাশের মেঘগুলো কাঠ কয়লার মত রঙ ধারণ করে আছে অনেক ক্ষণ ধরে, যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে ।
‘‘উফ এত দূর আগে জানলে সকাল সকাল ঘর থেকে বের হতাম ।’’ কথা গুলো যেন নিজেকে নিজেই শোনাল অরণ্য । রাস্তা অচেনা তাই ন্যাভিগেটরের সাহায্য নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে অরণ্য কে । আইরিশ আবহাওয়ার কোন ভরসা নেই এই বৃষ্টি এই রোদ । আয়ারল্যান্ডের আবহাওয়ার মতই রহস্যময় আয়ারল্যান্ডের রাস্তা ঘাট । কোথাও ঘন জঙ্গল আবার কোথাও লোকালয় । ঘন পাইন আর ওক গাছে ঘেরা রাস্তার দু পাশ । সাড়ি সাড়ি ওক আর পাইন গাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে এক জন আর এক জনের সাথে গা ঘেঁষে । দু পাশে ঘন জঙ্গলের জন্য আরও বেশি অন্ধকরাচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ। আকাশে ধূসর মেঘের আর ওক ও পাইনের জঙ্গলের সংমিশ্রণে গাঁ ছম ছম করা একটা পরিবেশর সৃষ্টি হয়েছে । জায়গাটা এত নিরব, মানুষ জনতো দূরে থাক রাস্তায় একটা গাড়ীও নজরে পরছে না অরণ্যের । হঠাৎ মেঘের বাঁধ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এতো জোরে বৃষ্টি পরছে,অরণ্যের কাছে মনে হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা গাড়ীর উইনশিল্ড ভেঙ্গে ফেলবে।বৃষ্টির জন্য গাড়ীর এক হাত সামনেও কিছু দেখা যাচ্ছেনা । তাই খুব সতর্কতার সাথে গাড়ী চালাচ্ছে অরণ্য । ন্যাভিগেটরের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে বিরক্তিকর ভাবে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ লক্ষ্য করলো ন্যাভিগেটর থেকে কনো সাড়া শব্দ আসছে না । আরচোখে ন্যাভিগেটরের দিকে তাকাল অরণ্য।
‘‘কি হল আবার এই বোকা যন্ত্রটার?’’ ভ্রুকটি করে বলল অরণ্য ।‘‘ এখন আমি যাই কি ভাবে?’’ গাড়ীর গতি কিছুটা কমিয়ে অরণ্য এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো, রোড ইন্ডিকেটর সাইন বোর্ড দেখার জন্য।
‘‘ঘুম থেকে উঠে যে আজ কার চেহারা দেখেছি ।’’ হতাশার বহির প্রকাশ করে বলল অরণ্য । এতক্ষণ অরণ্য লক্ষ্য করেনি ,গাড়ী কখন যে পীচ ঢালা পথ ছেড়ে জঙ্গলের কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে এনেছে । রাস্তা হারিয়ে গাড়ী এদিক সেদিক করতে করতে সন্ধ্যা নেমে রাত হবার জোগার । শুনশান রাস্তা , লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছেনা,যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ । মাঝে মাঝে দূর থেকে নেকড়ের মায়া ডাক ভেসে আসচ্ছে । চলন্ত গাড়ীর ভিতরে বাইরের এত দূরের কোন শব্দ কানে আসার কথা নয়, অরণ্য একটু ভয় পেল। নেকড়ে প্রাণীটার প্রতি ওর কেনে যেন একটু ফোবিয়া টাইপ এলার্জী আছে। কোন খেয়ালে বা কোন ধেনে ‘ও, পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের এই কাঁচা রাস্তা ধরলো তা কিছুতেই মনে করতে পারছে না । বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশে মেঘের জটলা বেঁধেই আছে ,কাল কাল মেঘগুলো যেন অশুভ কোন কিছু ডেকে নিয়ে আসছে । পূর্ণিমার রাত,তাই মেঘের যাতায়ত স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছে। কিন্তু অরণ্যের ও দিকে কোন খেয়াল নেই। অরণ্য প্রাণপনে রাস্তা খুঁজে যাচ্ছে এদিক সেদিক গাড়ী ছুটিয়ে। হঠাৎ গাড়ী মৃদু প্রতিবাদ করে দুটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ।
‘‘দুতরি ছাই। …. গাড়ীটার আবার কি হল ? ’’ এই বলে গাড়ী থেকে নেমে এদিক সেদিক চেয়ে গাড়ীর হুড খোলার জন্য গাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আর সে সময় কোথাথেকে যেন একটা নেকড়ে ডেকে উঠল রক্ত হিম করা সুরে । অরণ্যের গাঁয়ের সব গুলো লোম দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা হাতে গাড়ীর হুড উঠাল আর ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক তাকাতে থাকলো । গাড়ীর হুড খুলে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে গাড়ী থেমে যাওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল ।
ইঞ্জিনের হিট দেখে গাড়ীর রেডিয়টর চেক করে দেখল সাখানে কুলেন্ট শেষ , তাই ইঞ্জিন গরম হয়ে গাড়ী বন্ধ হয়ে গেছে ।
“হু এই হল ঘটনা। এখন পানি লাগবে , পানি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ।” বিজ্ঞের মত কথাগুল বলে গেল অরণ্য । গাড়ীর হুড নামিয়ে দিয়ে এদিক সেদিক তাকাল , এদিক সেদিক তাকাতেই ওর চোখে পরলো একটা আলো । আলো লক্ষ করে এগিয়ে যেতে থাকল। কিছুখন হাঁটার পর ও পৌছে গেল আলোর উৎসের দিকে । আলোর উৎসটা দরজার দুই পাশে লাগানো দুইটা মশাল, অরণ্য একটু অবাক হল,কিন্তু খুশি হল এই ভেবে একটা বাড়ি পাওয়া গেল, অরণ্য দির্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ যাক বাবা বাচাঁ গেল, একটা বাড়ি পাওয়া গেল ।’’ ও আর কাল বিলম্ব না করে দরজায় টোকা দিল । দরজায় এক টোকা পরতে না পরতে সাথে সাথে দরজাটা ভিতর থেকে খুলে দিয়ে এক জন সতের কি আঠার বছরের অপুরুপা সুন্দরী মেয়ে, অরণ্য কে জিজ্ঞাস করল “কি চাই?” অরণ্য বেশি জোরেও দরজায় টোকা দায়নি, আর সাথে সাথেই দরজা খুলে এক জন সুন্দরী মেয়ে বলছে ‘কি চাই, এতে ও খানিকটা চমকেও গেল ? মনে হচ্ছে মেয়েটি জানত যে অরণ্য আসবে, যেন ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। অরণ্য কে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দাখে মেয়েটা আবারো প্রশ্ন করল, “কি চাই, কোন সমস্যা?”
“ ইয়ে মানে আমার গাড়ীর ইঞ্জিনটা গরম হয়ে গেছেতো, তাই একটু পানি দরকার।”
“ ওহ, ওকে ভিতরে আস, ভিতরে এসে পানি নিয়ে যাও ।”
“ ইয়ে ... মানে ... ধন্যবাদ ।”
অরণ্য একটা হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকল, আর তখনি অরণ্যের মনে হোল খুব কাছ থেকে যেন অনেক গুল নেকড়ে ডেকে উঠল এক সাথে। অরণ্য ভয়ে তারাতারি ঘরে ঢুকে পরল। মেয়েটা একটু মুচকি হেসে দরজাটা বন্ধ করে দিল । অরণ্য ঘরে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল, বিশাল বড় একটা লিভিং রুমে ও দাঁড়িয়ে আছে ওর মনে হচ্ছে কোন রাজ দরবার। অন্ধকারে ও খায়াল করেনি যে বাড়িটায় ও ঢুকেছে সেটা আসলে একটা ছোট খাটো ক্যাসেলের মত বড় । অরণ্য চারদিক দেখছে আর ভাবছে এইটা কি কোন ক্যাসেল? অন্য ক্যাসেল গুলতো এরকম না ,ঐ গুলোর সদর দরজা দিয়ে ঢুকার পর লম্বা করিডোর পেরিয়ে যেতে হয় দরবার হলে । কিন্তু এইটার দরজা দিয়ে ঢুকার পরই লিভিং রুম , তাও আবার পরিপাটি করে সাজানো সেকেলে সব আসবাবপত্র দিয়ে !
“তুমি যা ভাবছো আসলে সেটা তানা। এইটা কোন ক্যাসেল না। এইটা ক্যাসেল টাইপ একটা বাড়ী, সবাই এই ভুল করে হাহা হাহা হাহা।’’ অরণ্যের চিন্তাগুলোকে যেন ছিন্তাই করে নিয়ে কথাগুল বলল মেয়েটি । অরণ্য ওর কথা শুনে হা হয়ে গেল । পরিস্থিতি হালকা করার জন্য মেয়েটি একটু হেসে বলল “ আমি ইভলিন ... ইভলিন ও কারনার ’’ মেয়েটি হাত বারিয়ে দিল অরণ্যের দিকে, অরণ্য নিজের নামটা বলে হাত মিলাল । অরণ্য আর এক দফা ধাক্কা খেল ইভলিনের সাথে হাত মিলিয়ে, মেয়েটার হাত বরফের মত ঠান্ডা । আবার ও ইভলিন ওকে অবাক করে একগাল হেসে বলল ,“আমার হাত ঠান্ডা কারণ আমি একটু আগে সিঙ্কে কিছু প্লেট ধুয়েছিলাম ... হাহাহ হাহা হা” মেয়েটার হাসি অরণ্যের কাছে কেমন যেন মায়াবী মনে হল।
“ তুমি সোজা গিয়ে ডানে যাও , ঐ খানে একটা বাথরুম আছে ঐ বাথরুম থেকে তুমি তোমার প্রয়োজন মত পানি নিয়ে যাও ।”
“ধন্যবাদ আপনাকে” এ বলে অরণ্য ইতস্ত ভাবে লিভিং রুম থেকে বের হয়ে মেয়েটার দেখানো পথে বাথরুমের দিকে গেল। অরণ্য বাথরুমে গিয়ে দেখল, যাকে কমন বাথরুম ভেবেছিল সেটা আসলে একটা বিশাল হাম্মাম খানা , কেউ মনে হয় জানত যে অরণ্য এই বাথরুমে আসবে তাই ওর জন্য আগের থেকেই একটা বালতিতে পানি ভরে রাখা হয়েছে । অরণ্য বালতিটা নিয়ে ফিরে আসলো লিভিং রুমে । এসে দেখে ইভলিন নেই । অরণ্য ভাবল মেয়েটা মনে হয় ভিতরে গেছে । ও অপেক্ষা করতে থাকল ইভলিনের জন্য , কিন্তু ইভলিনের আসার কোন নাম গন্ধ নেই । অনেক সময় পাড় হয়ার পর অরণ্য গলা বারিয়ে তিন, চার বার ডাক দিল, ‘ইভলিন ...ইভলিন করে ।’ কিন্তু ইভলিনের আসার কোন নাম গন্ধ নেই । অরণ্য এদিক সেদিক তাকিয়ে সব কিছু খুটিঁইয়ে খুটিঁইয়ে দেখতে লাগলো, লিভিং রুমটা পরিপাটি করে সাজানো, সারা ঘড়ে মোম বাতি জ্বালানো,মনে হয় এই বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। ইভলিনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আবারো ইভলিন কে ডাকতে থাকল অরণ্য । ইভলিনকে ডাকতে ডাকতে ওর চোখ পরলো ফ্লোরে দিকে। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত পরে আছে । আঁতকে উঠল অরণ্য, রক্ত দেখে মাথায় বিভিন্ন চিন্তা আসতে লাগলো । ফ্লোরে রক্ত কিভাবে আসল? হঠাৎ ওর নজর গেল ওর হাতে থাকা বালতিটার দিকে । যা দেখল তাতে আতঙ্কে ওর চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হবার উপক্রম । স্ব জোড়ে না...বলে চিৎকার করে হাতের বালতিটা ছুরে ফেলে দিল ফ্লোরে। ফ্লোরে যে রক্ত পরে আছে সেগুল ওর হাতের বালতি থেকেই পড়েছে। তাজা রক্ত ভর্তি বালতিটি ফ্লোরে পরে গড়াতে লাগল । ওর চিৎকার শুনে ইভলিন অনেকটা হাওয়ার থেকেই উদয় হল।
“ আরে কি হল চেঁচাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?’’
“ র...র...রক্ত ... ’’ ভীত গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলল অরণ্য ।
“ রক্ত... কোথায় রক্ত?’’
“ ঐ যে ফ্লোরে” অরণ্য হাত দিয়ে বালতিটার দিকে দেখিয়ে বলল ।
“ কোথায় রক্ত ? তুমিতো পানি দিয়ে আমার ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়েছ ।’’
অরণ্য ফ্লোরের দিকে তাকাল , তাকিয়ে দেখল সেখানে বালতি পরে আছে আর আশপাশ পানি দিয়ে ভেঁজা ।
“ কি...কি...ন্তু আমি রক্ত দেখেছি ঐযে ফ্লোরে আর এই বালতিতেই ছিল রক্ত ।”
“ তোমার মনের ভুল হবে।’’ একটু থেমে মেয়েটা আবার বলল, “ পানিতো সব ফেলে দিলে যাও আবার নিয়ে আস, তোমার গাড়ীতে লাগবে না?”
ওর কথা শুনে অরণ্যের ভয় কিছুটা কমে আসল । ফ্লোরে পরে থাকা বালতিটা তুলে নিয়ে আবারো রওনা হল বাথরুমের দিকে । ধীর পায়ে লম্বা করিডোর পেরিয়ে পৌছে গেল সেই রাজকীয় বাথরুমে । বাথরুমে ঢুকে অরণ্য চার পাশ তাকাল, বাথরুমে কোন কল নেই, কোন শাওয়ারও নেই । এদিক সেদিক চেয়ে ওর নজড় গেল বিশাল বাথটবটার দিকে, গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঢাকা পুরো বাথটব, তার চার পাশে জ্বলছে রং বে রঙ্গের মোমবাতি । অরণ্য বাথটবের ঝুকে গোলাপের পাপড়ি গুল সরিয়ে বালতিটা চুবিয়ে দিল, বালতিটা তুলে আনতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, ঘাড়ের সবগুল পশম দাঁড়িয়ে গেল, ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আমসত্তা হয়ে গেল । এক বালতি রক্ত তুলে এনেছে বাথটব থেকে । পুরো বাথটব রক্তে ভরা, গোলাপের পাপড়ির জন্য রক্ত দেখা যায়নি । অরণ্য চিৎকার দিয়ে বালতিটা ফেলে জোড়ে একটা দৌড় দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেল । দৌড়াতে দৌড়াতে ও লিভিং রুমে চলে আসল । এসে যা দেখলো তাতে ওর চোখ কপালে উঠার জোগাড় । ওর মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল শিহরণ বয়ে গেল, পাগলের মত ও এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো আর ছুটাছুটি করতে থাকল। ও যে লিভিং রুমে এসেছে সে রুমে কোন দরজা জানালা নেই । পুরো লিভিং রুম পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা । কিন্তু একটু আগে এই খানে দরজা জানালা ছিল অরণ্য যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে সেখানে এখন পাথরের দেয়াল।
“ ইভলিন ...ইভলিন তুমি কোথায় ?” আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অরণ্য ইভলিন কে ডাকতে থাকল ।
কিন্তু ইভলিনের কোন সাড়া শব্দ নাই । এক ঝাটকায় লিভিং রুম থেকে বের হয়ে অরণ্য বাথরুমে যাবার করিডোর ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকল । অরণ্যের কাছে এটা কোন বাড়ি মনে হল না,ওর কাছে মনে হল এইটা গোলক ধাঁধাঁ, সব কিছুই কেমন যেন রহস্যময় অন্যরকম, যে করিডোর ধরে ও এসেছে সেই করিডোরেই বার বার ফিরে আসছে , যেন গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেছে । করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বিষয় লক্ষ্য করল অরণ্য , করিডোরের দু পাশেই সাড়ি সাড়ি দরজা, আর দরজার ভিতর থেকে গোংগানোর শব্দ, মনে হয় কেউ ব্যাথ্যায় কাৎরাচ্ছে । আগে এই দরজাগুল নজরে আসেনি । গোঙ্গানির শব্দপেয়ে আরো ভয় পেয়ে গেল, ভয়ের সাথে যুক্ত হল কৌতূহল । ওর খুব দেখার ইচ্ছে হচ্ছে দরজার ওপাশে কে বা কারা আছে । ও দজার‍য় ধাক্কা দিল, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । মৃদু স্বরে কয়েক বার ডাক দিল অরণ্য , “ কেউ কি আছেন ভিতর ...হ্যাল ... কেউ কি আছেন?” ওর ডাক শুনে ভিতরের গোঙ্গানির শব্দ থেমে গেল । আরো কয়েক বার ডাক দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল অরণ্য , করিডোরটার শেষ প্রান্তে একটা দরজা খোলা দেখে অরণ্য ঐ দরজাটার দিকে গেল । রুমের সামনে আসতেই ওর কানে আসল কারা যেন ভিতরে কথা বলছে । ও আস্তে করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভিতরে উকি দিল । ভিতরে ইভলিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সাথে যান কথা বলছে
“ এত অস্তির হচ্ছো কেন?” ইভলিন বলল ওর সামনে থাকা একটা ছায়া মূর্তি কে ।
“ অস্তির হবনা … আমার রূপ যে চলে যাচ্ছে । তার সাথে পেয়েছে ক্ষুধ । কত দিন খাই না ।’’
“ আমার চেহারাও তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । ছেলেটা বধ হয় কিছুটা টের পেয়ে গেছে ।”
অরণ্য এতখন লক্ষ্য করেনি যে ইভলিনের সতের বছরের চেহারাটা এক ধক্কায় ত্রিশ বছরের নারীর মত হয়ে গেছে । মসৃণ গালের চামড়া গুলো অমসৃণ হয়ে গেছে, গলার স্বর কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে । চোখের নিচে কালি জমে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে কাল হয়ে আছে ।
“ ছেলেটা যদি টের পেয়ে যায় তো ওকে এখনো রেখে দিয়েছ কেন?” ছায়া মূর্তিটা বলল ।
“ এখনো যে সময় হয়নি, তুমি জানন , সময় হলেই ওর রক্ত দিয়ে আমি গোসুল করে ওর হৃদপৃন্ড টা খাব ।” ইভলিন বলল পৈশাচিক হাসি হেসে । অরণ্যের হাত ওর অজান্তেই ওর বুকের বাম পাশে চলে গেল । ইভলিন কার সাথে কথা বলছে এইটা দেখার জন্য অরণ্য একটু উকি মারতে গিয়ে শরীরের ভার্সাম্য হারিয়ে পরে গেল দরজার পাল্লা হেলে ঘড়ের ভিতরে । ওকে দেখে ইভলিন একটুও অবাক না হয়ে বলল “ পরে গেলে? ব্যাথ্যা পাওনি তো?”
অরণ্য লক্ষ্য করল ইভলিন দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে সেখানে কোন ছায়া মূর্তি নেই,কিন্তু আয়নায় ইভলিনের কোন প্রতিবিম্ব নেই। ভয়ে অরণ্যের মূর্ছা যাওয়ার মত অবস্থা ।ওর দিকে লোলুভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভলিন । ওর চোখ দুটো চকচক করছে, বহু দিনের ক্ষুধার্থ বাঘ যেমন তার শিকাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি ইভলিন তাকিয়ে আছে অরণ্যের দিকে। অরণ্য দেখছে কি ভাবে এত সুন্দর একটা চেহারা পিশাচে পরিণত হচ্ছে । ইভলিনের চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ধীর ধীরে , চুলগুলো যেন শাজাহানের মত সাদা হয়ে গেল চোখের পলকেই । হাত গুল সরু হয়ে যেতে লাগলো , নখগুল বড় হয়ে বাঁকিয়ে গেল । চোখের সামনে সতের বছরের একটা অপরূপা মেয়ে হাজার বছরের এক ডাইনিতে পরিণত হতে দেখে অরণ্যের হাত পা সব জমে গেল, এত দিন এই সব শুধু সিনেমাতেই দেখতো আজ ওর চোখের সামনেই হচ্ছে ।
“ তোমার সময় এসে গেছে, তুমি সব জেনে গেছ , তোমার মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে । হাহাহাহহাহাহাহহাহ ...” খড়খড়ে কন্ঠে বলল ইভলিন ।
অরণ্য আর কাল বিলম্ব না করে কোন মতে ফ্লোর থেকে উঠে করিডোর ধরে দৌড় দিল, অরণ্য ওদের ক্রিকেট দলে সবচাইতে দ্রুত দৌড়াতে পারে,তাই চোখের নিমিষেই অরণ্য দৌড় দিয়ে করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল । ও যখন করিডোর পার হচ্ছিল তখন করিডোরের দুই পাশের দরজাগুল খুলে যেতে শুরু করলো একা একাই,আর ভিতর থেকে ইভলিনের মতই কত গুল পিশাচ বের হয়ে অরণ্যের দিকে আসতে লাগলো । অরণ্য ওদের দেখে আরো জোড়ে দৌড়াতে লাগল, একের পর এক করিডোর পেরিয়ে ও সেই লিভিং রুমে চলে আসলো । আর সেই পিশাচ গুলো গোংগাতে গোংগাতে অরণ্যের পিছে পিছে আসতে লাগলো । অরণ্য লিভিং রুমে এসে থমকে দাঁড়াল কারণ সেখান থেকে বের হয়ার কোন রাস্তা নেই । পুর লিভিং রুম পাথর দিয়ে ঘেরা,কোথাও এক বিন্দু ফাঁকা জায়গা নেই যেখান দিয়ে অরণ্য বের হতে পারবে। অরণ্য পুরপুরি ফেঁসে গেছে ।এত বড় লিভিং রুমটাকে অরণ্যের খুব ছোট মনে হচ্ছে , পুরো লিভিং রুমে ইভলিন, ইভলিনের মা,দুই বোন আর ইভলিনের খালা দাঁড়িয়ে আছে । পাঁচ জোড়া লাল টকটকে চোখ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আছে । ওদের মুখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে লালা ঝরছে আর মুখ দিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করছে, মনে হচ্ছে কোন মন্ত্র আওড়াচ্ছে । ওরা একে একে অরণ্যের সামনে এসে দাঁড়াল, অরণ্য ওদের ভয়ানক রূপ দেখে এক পা এক পা করে পিছাতে থাকে, এই ভাবে পিছাতে পিছাতে ওর ফেলে যাওয়া মায়াবী পানি রূপি রক্তে পা পিছলে পরে গেল ফ্লোরে । আর ডাইনি গুল এক পা এক পা করে অরণ্যের দিকে আসতে লাগলো । অরণ্য ভয়ে আমসত্তা হয়ে গেল,ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। অরণ্য এই ভাবে মরতে চায় না , ও মনে মনে সুরা পড়ার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু একটা সুরাও ওর মনে পরছে না এই মূহুর্তে। ও নিজেকে হাতের সাহায্যে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ক্রলিং করে । দেয়ালের পাশে মোমবাতি জ্বলছে আর সেই আলোতে ডাইনিগুলোর ছায়া দেখা যাচ্ছে না শুধু ডাইনি গুলকে দেখা যাচ্ছে ধীর পায়ে অরণ্যের দিকে আসছে । অরণ্য কি করবে ভেবে পাচ্ছে না । হঠাৎ অরণ্য লক্ষ্য করলো পাথরের শক্ত দেয়াল ভেদ করে চাঁদের আলো এসে পরেছে ওর পায়ের কাছে । অরণ্য মনে মনে ভাবল, ‘ দেয়াল ভেদ করে চাঁদের আলো আসছে তাহলে নিশ্চয় ঐ খানে কোন রাস্তা আছে , আর আলো দেখেতো মনে হচ্ছে কোন জানালা দিয়ে আসছে ।’ অরণ্য সাত পাঁচ না ভেবে কোন মত উঠে দাঁড়াল আর আল্লাহর নাম নিয়ে চাঁদের আলো বরাবর একটা দৌড় দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার মত করে দুই হাত সামনের দিকে বারিয়ে ড্রাইভ দিল দেয়ালে। ও ভেবেছিল শক্ত কিছুর সাথে ও বাড়ি খাবে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সেরকম কিছুই ঘটলনা, ও বিনা বাঁধায় একটা ঝোপের উপর পরে গেল। অরণ্য ঝোপ থেকে উঠেই দিল একটা দৌড় , অন্ধকারে আন্তাজ লাগিয়ে অরণ্য দৌড়াতে থাকল, দৌড়াতে দৌড়াতে ও হোঁচট খেয়ে পরে জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একবার পিছনে ফিরে দেখল বাড়িটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে । অরণ্য যখন ড্রাইভ দিয়ে দেয়াল ভেদ করছিল তখন ওর পা লেগে মোমবাতি পরে যায় সোফার উপরে, আর তাতেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে যায় পুর বাড়িতে ।
**

রাত পেরিয়ে সকাল, সারা রাত অরণ্য অজ্ঞান হয়ে পরেছিল ঝোপ ঝাড়ের ধারে । সকালে দুজন স্থানীয় বয়স্ক লোক ওকে ঝোপের ধারে পরে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের বাড়িতে । অরণ্যের জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করল একটা অজানা ঘড়ে অপরিচিত জায়গায় বিছানায় শুয়ে আছে । ও উঠে বসল, ওকে উঠে বসতে দেখে স্থানীয় লোক দুটো ওর কাছে আসলো ।
“ তুমি কে বাবা? কি হয়েছিল?”
“ আমি অরণ্য , ...... এ বলে অরণ্য গত রাতের সব কাহিনী খুলে বলল তাদের কাছে।
“ হু... । গত দেড়শ বছরের মধ্যে তুমিই প্রথম মানুষ যে কিনা ঐ বাড়ি থেকে বেঁচে বের হয়েছ।’’ একটু থেমে আবার ও বলতে শুরু করলো বয়স্ক লোকটি, “ আমার বাপ দাদাদের আমলের কথা, এই গ্রামে তখন কাল যাদুর প্রকোপ দেখা দিয়েছেল, কারা যেন গোপনে ডাকিনী চর্চা করত । হঠাৎ করে গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চা আর যুবতি ছেলে মেয়েরা উধাও হয়ে যেতে থাকল, সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে গেল, সন্ধ্যা না হতেই সবাই ঘরে ঢুকে দরজা জানালায় খিল দিত ।’’ বয়স্ক লোকটা বলতে থাকল আর অরণ্য মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো ।
“ হঠাৎ গ্রামের এক জন দেখল, ঐ জঙ্গলে যে বড় বাড়িটা আছে ঐ বাড়ির আস পাশে নেকড়ের ভীর আর নেকড়েগুল কি যেন খাচ্ছে, নেকড়ে গুল যাবার পর ও কাছে গিয়ে দেখে যে নেকড়ে গুল লাশ খাছিল । ও গ্রামে এসে সবাইকে জানাল, গ্রামবাসিরা গ্রামের মাতবরের আপেক্ষায় রইল, মাতবর আসতে আসতে রাত হয়ে গেল , আর রাতে মাতবর সব শুনার পর ঠিক হল যে সবাই দল বেঁধে যাবে জঙ্গলে। জঙ্গলে এসে দেখল বাড়ির বাইরে লাশ পরে আছে। সবাই দল বেঁধে হাতে মশাল নিয়ে ঐ বাড়িটা ঘিরে ফেল্ল আর কয়েক জন দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকল আর গিয়ে যা দেখল তাতে ওরা বমি করতে করতে ঐ বাড়ি থেকে বের হল । ওরা এসে বলল ঐ বাড়িতে যারা আছে ওরা মানুষ না ওরা ডাইনি, ওরা রক্ত দিয়ে গোসুল করছে আর এক জন রক্ত মাখা কি যেন খাচ্ছে। ওদের দেখে তেরে এসেছিল , তার পর সবাই মিলে ভিতরে গিয়ে ডাইনি গুলকে বের করে এনে শূলে চড়িয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ওদের ঐ বাড়িতেই আগুনে পুড়ে মারে। ওরা পাঁচ জন ছিল ।’’
“ তার পর?” অরণ্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাস করল ।
“ সেই রাত টা ছিল পূর্ণিমা রাত, এর পর থেকে প্রতি পূর্ণিমা রাতে ওরা ফিরে আসে আর কাউকে পেলে ওর রক্ত দিয়ে গোসুল করে । প্রতি পূর্ণিমা রাতেই আমরা ঐ খানে কাওর না কাওর লাশ পাই , তুমিই প্রথম যে কিনা বাঁচে বের হলে ঐ বাড়িতে ওদের হাত থেকে।”
অরণ্য কে গ্রাম্বাসিরা ওর গাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিল, অরণ্য ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সোজা ডাবলিনের দিকে রওনা হল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোন দিনও এ মুখো হবে না । দূর থেকে একবার শুধু ঐ বাড়িটার দিকে তাকাল , তাকাতেই কেমন যেন ভয়ের একটা শিহরণ জেগে উঠল । মনে হল কে যেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ও আর কাল বিলম্ব না করে গাড়ির গতি বারিয়ে দিল । আর আল্লাহ কে ওর নতুন জীবনের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে থাকল ।
****
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮২১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/১২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ভালো লাগলো।
  • খুব ভাল লাগলো ।
  • অভিষেক মিত্র ০৭/১২/২০১৫
    বেশ লাগল
 
Quantcast