নিশির ডাক
‘দাদি প্লিজ আমাদের একটা কিচ্ছা শুনাও প্লিজ আমরা কিচ্ছা শুনবো।’ ফায়সাল ওর দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলল । ফায়সালের সাথে সাথে সুমা, রনি, দানিয়াল, কবির সহ সবাই এক সাথে ওদের দাদিকে ছেকে ধরলো গল্প শোনানোর জন্য। সবাই এক সাথে কোরাসে বলতে লাগলো,
‘ দাদি কিচ্ছা শুনবো ভুতের কিচ্ছা ।’ আজ বহু দিন পর গ্রামের বাড়িতে ঈদের ছুটিতে সব চাচাতো , ফুফাতো ভাই বোনেরা একত্রিত হয়েছে । বরাবরের মতো সবাই ওদের দাদি কে ছেকে ধরেছে গল্প শোনানোর জন্য। দাদি সবাইকে শান্ত করতে বলল, ‘ আহারে আগেতো আমরে ছাড়বি , আয় উঠানে আয় , ঐ খানে মাদুর বিছানো আছে ঐ খানে বইয়া তগো আজ কিচ্ছা শুনাবো । কিসের কিচ্ছা শুনবি?’
‘ ভু…তে…র…।’ এক সুরে সবাই চিৎকার করে বলল ।
‘ আচ্ছা শোন তা হলে। এইটা আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা , ‘তোদের দাদা তখন যুবক তোদের দাদার ছিল মাছ ধরার খুব শখ। বর্ষা কালে প্রতি রাইতেই তোদের দাদা মাছ ধরতে যাইতো। তোর দাদুর চার জন ভাল বন্ধু ছিল তাদেরও মাছ ধরার খুব শখ ছিল । সেই রাইতটা ছিল অমাবস্যার রাইত। সেদিন রাইতে তারা মাছ ধরার জন্য ঠিক করলো। সবাই সবাইরে বইলা রাখলো, রাতে যে আগে বাইর হইবো সে যেন সবাইকে ডাক দিয়া লইয়া যায় । তখন আমার নতুন নতুন বিয়া হইছে । তোদের দাদা আমায় আগের থাইকাই কইয়া রাখছিল তিনারা আজ মাছ ধরতে যাইবো রাসুর বিলে । রাসুর বিলটা বালানা , আমি বারণ করলাম , সে হাইসা উড়াইয়া দিল । গ্রেরাম দেশ সইন্ধা হইতেই না হইতেই আন্ধার নাইমা আসে । তোদের দাদা তারাতারি নাকে মুখে চাইরডা খাইয়া অপেক্ষা করতে লাগলো তিনার বন্ধুগো লাইগা । সেদিন সইন্ধা থেকেই গুড়ি গুড়ি মেঘ পরতাছিল, আসমান বারবার ডাকতাছিল......।’
“ আইজ যাইয়া কাজ নাই মেঘ বৃষ্টির দিন । কি করবেন আইজ জাইয়া?”
“ বউ মেঘলা দিনে মাছ পাওন যায় বেশি বুঝলা। দেওয়ার ডাকে কৈ মাছ গুলান বিল থেইকা পাড়ে উইঠা আহে ।’’ এই বইলা তিনি অপেক্ষা করতে লাগলো তিনার বন্ধুগো লাইগা।
“ বউ আমারে একটা পান দাও পান চিবাই ।” আমি তিনারে পান বানিয়া দিইয়া তিনার পা ভর দিতে লাগলাম । সেই সময়ই তিনার সবচাইতে ভাল বন্ধু শুক্কুর ভাই বাহির থাইকা তিনার নাম ধইরা ডাক দিল, “ ও রহিম ভাই ... রহিম ভাই মাছ ধরতে যাইবা না ? মাছ ধরতে?” আইজ শুক্কুর ভাইয়ের গলা কেমন যেন ঠেকল আমার কাছে । কিন্তু তিনারে বলতে সাহস পাইলাম না ।
তিনি ভিতর থাইকা হাক দিয়া কইলো, “ আইতাছি শুক্কুর খারাও।”
“ বউ মায়েরে কইস আমি গেলাম হ্যাঁ । ফিরতে রাইত বেশি হইব যদি ডর লাগে তো ফুলবানুরে লইয়া ঘুমাইয়া থাকিস ।” লোকটা এই কথা কইয়া তিনার জাল, ছিপ আর মাছ রাখার খইল নিয়া ঘর থেইকা বের হইয়া গেল । আমি আম্মার কাছে গিয়া তিনার চইলা যাইবার কথা যানাইলাম। ফুলবানুরে নিয়া আমারগো ঘরে আইসা হারিকেনটা ছোট কইরা বিছানায় গিয়া শুইয়া পরলাম। চক্ষু দুইখান সবে লাইগা আসছিল মনে হই ঐ সময় শুক্কুর ভাইয়ের গলা শুইনা আমার ঘুম ভাইঙ্গা গেল।
“ ঐ রহিম ভাই কোই তুমি , মাছ ধরতে যাইবা না আইজ? তারা তারি বাহিরে আহ। বেবাকেরে ডাকতে হইব। কত ক্ষণ ধইরা তমারে ডাকতাছি।”
আমি শুক্কুর ভাইয়ের ডাক শুইনা ঘড়ের ভিতর থাইকাই কইলাম, “ হেয় না কিছু ক্ষণ আগে আপনার লগে জলা টাল নিয়া ঘর থাইকা বের হইয়া গেল? ”
“ কি কন ভাবি সাব , আমি তো এই মাত্র আইলাম আমার ঘর থাইকা।”
আমি তারা তারি দরজা খুইলা হারিকেন বারাইয়া শুক্কুর ভাইরে দেখলাম সে জাল, ছিপ, খোল আর লন্ঠন বাতি নিয়া দারাইয়া আছে । আমি চিল্লাইয়া ফুলবানুরে ঘুম থাইকা ডাইকা তুল্লাম । ফুল বানু ঘুম থাইকা উইঠা ঘুম কাতুরে কন্ঠে আমরে কইকলো, ‘ ভাবি কি হইসে এত রাইতে কেন ঘুম থাইকা জাগাইলা, আর বাইরে কেডা?’
“ বাইরে শুক্কুর ভাই, কিন্তু কিছু ক্ষণ আগেই তো তোর ভাই শুক্কুর ভাইয়ের লগে মাছ মারবার লাইগা ঘর থাইকা বের হইয়া গেল।”
“ কি কন ভাবি ... হায় হায় ভাই জানরে কি নিশিতে পাইলো নাকি। মা ওই মা কোই তুই ...হায় হায় ভাই জানরে নিশিতে ধরসে...।” ফুলবানু বিলাপ করতে করতে ভিতরের ঘরে চইলা গেল।
“ ভাবি কি হইসে কনতো আমারে। ভাই কোই?” শুক্কুর ভাই কইলো আমারে।
“ হেয়তো আপনার সা থেই গেছে কিছুক্ষণ আগে । আমিতো বুঝতে পারতাসিনা ...।’’ আমার কণ্ঠ কান্নায় জড়াইয়া আসলো। আমি ডরে আস্থির হইয়া গেলাম। আমার হাত পা অবশ হইয়া আসতে লাগলো। ভিতর থেকে আমার শাশুড়ি বিলাপ করতে করতে বের হইয়া আসলো ফুল বানুর সাথে ।
“ কি হইসে আমার পোলার কি হইসে...?’’
“ ভাই জানরে নিশিতে লইয়া গেছে মা।” ফুল বানু কানতে কানতে কইলো। ঘটনা সবার কাছে খুইলা বলার পর সাবাই আস্থির হইয়া গেল। শুক্কুর ভাই তামাম গ্রামের মানুষ জন রে ডাইকা তুল্ল। সবাই লণ্ঠন জ্বালাইয়া হাতে বাঁশ লইয়া তিনর খোঁজে বের হইল। আমিও তিনাদের সাথে বের হইয়া গেলাম।,
‘ কি করো আশরাফের মা উঠানে বইসা নাতিন গো লইয়া।’ দাদার গলার শব্দ পেয়ে ফায়সাল, সুমা, দানিয়াল সহ দাদি গল্পের থেকে বের হয়ে আসলো।
‘ ওরা আমরে ছেইকা ধরছে কিচ্ছা শুনবো, তাই কিচ্ছা শুনাইতাসি । আপনার কিচ্ছা ঐ যে আপনারে যে নিশিতে নিয়া গাছিল ঐটা।’
‘ কোন পর্যন্ত শুনাইছো আশরাফের মা? আমিও আইতাসি খারাও। গঞ্জে গেছিলাম পাঞ্জাবিটা খুইলা আসি ।’ দাদা কিছু ক্ষণের মধ্যে পাঞ্জাবি বদল করে ফায়সাল, সুমাদের সাথে যোগ দিল ।
‘ আমি ওগো ঐ পর্যন্ত শুনাইছি আমরা আপনার খোঁজে বাইর হইলাম । বাকিটা আপনি কন। ’
‘শোন তাহলে……।’ এইবার দাদা গল্প বলা শুরু করলো।
আমি ঘর থাইকা ছিপ, জাল, খোল নিয়া বাইর হইলাম।
“ বউ ঘরে খিল দে ।’’ বাইরে আইসা দেখলাম শুক্কুর দাঁড়াইয়া আছে কিন্তু তার হাতে কোন ছিপ, জাল, খোল দেখলাম না। তার হাতে লন্ঠনও নাই। আমি লণ্ঠন লইয়া তার কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। তখনো গুড়িগুড়ি মেঘ পরতাছিল।
“ কিরে শুক্কুর তোর লণ্ঠন কোই এত অন্ধকারে কেমনে আইলি?’’
“ ভুইলা গেছি। এইবার লও হাঁটা ধর।” শুক্কুর কেমন যেন নাকা সুরে কথা গুলা কইলো।
“ বাকি সাবাইরে ডাকবি না?”
“ ওরা আইজ কেউ আইব না । গেছিলাম ওগো ডাকবার।”
তার পর আমরা আর কোন কথা না বইলা দুইজন হাঁটা ধরলাম ঘাটে বাঁধা আমগো মাছ মারার ডিঙ্গার কাছে। আজ কেন জানি গাঁটা ছম ছম করতে লাগলো। শুক্কুরে আমি ছোট বেলা থাইকাই চিনি। ও আমার বয়সে ছোট হইলেও আমরা বন্ধুর লাহান । আজ ও খুবই চুপচাপ, এমনিতে তো অনেক কথা কয় । কথা কইতে কইতে আমাগো মাথা খারাপ কইরা দেয়। ওরে এত চুপ চাপ থাকতে দাইখা আমি কইলাম, “ কিরে কি হইসেরে শুক্কুইরা কি হইসেরে তোর। আইজ এত চুপ চাপ কেনরে?”
শুক্কুর কোন উত্তর দিল না । আমি ভাবমার ওর বউয়ের লগে ঝগড়া কইরা আইসে। থাক ওরে আর ঘাটানোর দরকার নাই। ঘাটের কাছে আইসা আমার প্রসাব ধরল, আমি শুক্কুরে কইলাম ‘শুক্কুর আমার প্রসাব ধরসে তুই একটু খাড়া আমি প্রসাব কইরা আহি।’
‘ সময় নাই প্রসাব করণ যাইব না।’ হঠাৎ শুক্কুরের গলা কেমন যেন হইয়া গেল। শুক্কুর এক প্রকার আমারে টাইনাই ডিঙ্গায় উঠাইল। এক মিনিট দেরি না কইরা ডিঙ্গাটা পানিতে ভাসাইয়া দিল। আমি কোন মতে ডিঙ্গা থাইকা পইড়া যাইতে যাইতে নিজেরে বাচাইয়া নিলাম।
‘ কিরে কি হইসে তোর শুক্কুইরা আইজ তুই এমন করতাস কেন?’ আমি শুক্কুরের আচারণে ভয় পাইয়া কইলাম । শুক্কুর কোন জবাব দিলনা । শুক্কুর চুপ চাপ ডিঙ্গা বাইতে লাগলো। আমি শুক্কুরের কোন কিছুই বুঝতে পারতাসি না ওর কি হইসে। শুক্কুর বাতাসের লাহান ডিঙ্গাটা বাইতে লাগলো। আইজ ওর শরীরে এত শক্তি কইথাইকা আইলো আমি বুঝতে পারলাম না । মনে হইতাসে ডিঙ্গাটায় একটা মটর লাগানো হইসে। ‘‘ কিরে শুক্কুর কি হইসেরে তোর?’’ শুক্কুর কোন কথা না কইয়া আরও জোড়ে ডিঙ্গাটা বাইতে লাগলো। ঘাট থাইকা কত দূরে আসছি এইটা দেখার জন্য ঘেটিটা ঘুরাইয়া ঘাটের দিকে তাকাইলাম। ঘাটের দিকে তাকাইয়া দেখলাম অনেক গুলা মানুষ দাঁড়াইয়া রইসে হাতে লণ্ঠন লইয়া। ঘাট থেইকা কয়েক জন আমার নাম ধইরা ডাকা ডাকি করতাসে। আমি শুক্কুরের দিকে তাকাইলাম ,
‘‘ কিরে শুক্কুর কি হইসেরে ঐ খানে?’’ শুক্কুর কোন কথা না কইয়া ডিঙ্গাটা আরও জড়ে বাইতে লাগলো। আমি আবার তাকাইলাম ঘাটের দিকে। কয়েক জন ঘটে লাগানো অন্য ডিঙ্গাগুলায় চইরা ডিঙ্গা ভাসাইয়া দিল। আর বিরামহীন আমরে ডাকতে থাকলো। ঐ গলার মধ্যে এক জনার গলা আম্র অনেক পরিচিত, আরে অইটাতো শুক্কুরের গলা। ঐটা যদি শুকুরের গলার আওয়াজ হয় তো আমার সামনে যা বইসা রইসে হেয় কেডা? আমি ডরে ডরে তাকাওলাম শুক্কুরের দিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কইলাম , ‘‘তুই শুক্কুর না ...ত তু...ই কেডা?’’
আমরে অবাক কইরা দিয়া শুক্কুর কইল মে মানিষের কণ্ঠে, ‘‘ আমরে চিনবার পারলানা রহিম ভাই... আমি শুক্কুর...। হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ.........।”
শুক্কুরের আকার আকৃতি কেমন যেন হইয়া গেল। ও আবারো আমরে কইল, ‘‘ ও রহিম ভাই আমি শুক্কুর হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ... । আমি তোমার বন্ধু মানুষ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ......।’’ শুক্কুর আমার গলা টিপা ধরতে আসতেছিল দুই হাত দিয়া।
ডরে আমার হাত পা বরফের লাহান জইমা গেল, আমি কি করুম বুইঝা পাইতাসিনা । আমি চোখ বন্ধ কইরা কলমা পড়া শুরু কইরা দিলাম। শুক্কুর তখনো হাসতাছিল ঐ কানি সুরে। আমি আর কোন কিছু না ভাইবা দিলাম পানিতে লাফ । লাফাইয়া পরার সময় আমার পা লাইগা লন্ঠটা পইরা গেল । আমি লাফাইয়া পিরাই সাঁতরাইতে লাগলাম জান পরাণ দিয়া। এর মধ্যে অন্য ডিঙ্গা গুলা আম্র কাছে চইলা আসলো। ঐ ডিঙ্গায় শুক্কুরে দেখলাম আমার দুকে হাত বারাইয়া দিসে। আমি আবারো ডরাইয়া গেলাম। শুক্কুর কইলো , ‘‘ রহিম ভাই আমি শুক্কুর আর কোন বিপদ নাই।’’ শুক্কুরের লগে জব্বার, করিম , সহ গ্রামের বেবাকেই আছিল। ওরা আমরে টাইনা অগো ডিঙ্গায় উঠাইলো । ততোক্ষণে পুরা বিলটা আলো দিয়া ভইরা গেছিল। আমার ডিঙ্গাট জ্বল তাছিল আমার লন্ঠনের আগুল লাইগা। শুক্কুর আমরে জড়াইয়া ধইড়া কইলো, ‘‘ রহিম ভাই তুমি ঠিক আছোতো? ভাই তোমারে নিশিতে পাইছিল । তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেনাই তো?’’
আমি আর কোন কথা কইতে পারলাম না । ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম । হেই রাইতেই আমার আইলো অনেক জ্বর । হের পর থাইকা আমি আর কোন দিনও কেই আমরে তিন বার না ডাক দিলে ঘর থাইকা বাইর হইনা। কারণ নিশি দুই বারের বেশি ডাক দিতে পারে না।
‘হইছে নাতিনরা যাও আইজ ঘুমাইতে । আজ অনেক রাইত হইসে । দাদি আর দাদা দুজন এক সাথে বলল।
‘আর একটা দাদি প্লিজ আর একটা শুনাও প্লিজ...।’ সাবাই এক সাথে বলল।
‘ আজ আর না কাল আবার শুনাবো আইজ অনেক রাত হইসে। যাও দাদু ভাইরা ঘুমাইতে যাও।’ ছেলে মেয়ে রা মন খারাপ করে ঘরে চলে গেল। কিন্তু ফায়সালের প্রকৃতির ডাক পাওয়ায় ও সবাইকে বলল, ‘ তোরা যা আমি আসছি।’ ফায়সাল ঘরের দরজার সামনেই প্রকৃতির ডাক (ছোট) সেরে ঘরে যাচ্ছিল আর তখন কে যান ফায়সালের নাম ধরে ডাক দিল দু’ বার , ‘ফায়সাল এই ফায়সাল’ কণ্ঠটা ওর অনেক পরিচিত মনে হল । ও পিছনে ফিরে তাকাল দেখলো কেউ নেই। কেউ নেই দেখে ঘরের একটা দৌড় দিল। ও মনে মনে ভাবল দাদার নিশির ডাকের কাহিনী মিথ্যা নয় যা ঘটেছিল সবই সত্যি ছিল।
‘ দাদি কিচ্ছা শুনবো ভুতের কিচ্ছা ।’ আজ বহু দিন পর গ্রামের বাড়িতে ঈদের ছুটিতে সব চাচাতো , ফুফাতো ভাই বোনেরা একত্রিত হয়েছে । বরাবরের মতো সবাই ওদের দাদি কে ছেকে ধরেছে গল্প শোনানোর জন্য। দাদি সবাইকে শান্ত করতে বলল, ‘ আহারে আগেতো আমরে ছাড়বি , আয় উঠানে আয় , ঐ খানে মাদুর বিছানো আছে ঐ খানে বইয়া তগো আজ কিচ্ছা শুনাবো । কিসের কিচ্ছা শুনবি?’
‘ ভু…তে…র…।’ এক সুরে সবাই চিৎকার করে বলল ।
‘ আচ্ছা শোন তা হলে। এইটা আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা , ‘তোদের দাদা তখন যুবক তোদের দাদার ছিল মাছ ধরার খুব শখ। বর্ষা কালে প্রতি রাইতেই তোদের দাদা মাছ ধরতে যাইতো। তোর দাদুর চার জন ভাল বন্ধু ছিল তাদেরও মাছ ধরার খুব শখ ছিল । সেই রাইতটা ছিল অমাবস্যার রাইত। সেদিন রাইতে তারা মাছ ধরার জন্য ঠিক করলো। সবাই সবাইরে বইলা রাখলো, রাতে যে আগে বাইর হইবো সে যেন সবাইকে ডাক দিয়া লইয়া যায় । তখন আমার নতুন নতুন বিয়া হইছে । তোদের দাদা আমায় আগের থাইকাই কইয়া রাখছিল তিনারা আজ মাছ ধরতে যাইবো রাসুর বিলে । রাসুর বিলটা বালানা , আমি বারণ করলাম , সে হাইসা উড়াইয়া দিল । গ্রেরাম দেশ সইন্ধা হইতেই না হইতেই আন্ধার নাইমা আসে । তোদের দাদা তারাতারি নাকে মুখে চাইরডা খাইয়া অপেক্ষা করতে লাগলো তিনার বন্ধুগো লাইগা । সেদিন সইন্ধা থেকেই গুড়ি গুড়ি মেঘ পরতাছিল, আসমান বারবার ডাকতাছিল......।’
“ আইজ যাইয়া কাজ নাই মেঘ বৃষ্টির দিন । কি করবেন আইজ জাইয়া?”
“ বউ মেঘলা দিনে মাছ পাওন যায় বেশি বুঝলা। দেওয়ার ডাকে কৈ মাছ গুলান বিল থেইকা পাড়ে উইঠা আহে ।’’ এই বইলা তিনি অপেক্ষা করতে লাগলো তিনার বন্ধুগো লাইগা।
“ বউ আমারে একটা পান দাও পান চিবাই ।” আমি তিনারে পান বানিয়া দিইয়া তিনার পা ভর দিতে লাগলাম । সেই সময়ই তিনার সবচাইতে ভাল বন্ধু শুক্কুর ভাই বাহির থাইকা তিনার নাম ধইরা ডাক দিল, “ ও রহিম ভাই ... রহিম ভাই মাছ ধরতে যাইবা না ? মাছ ধরতে?” আইজ শুক্কুর ভাইয়ের গলা কেমন যেন ঠেকল আমার কাছে । কিন্তু তিনারে বলতে সাহস পাইলাম না ।
তিনি ভিতর থাইকা হাক দিয়া কইলো, “ আইতাছি শুক্কুর খারাও।”
“ বউ মায়েরে কইস আমি গেলাম হ্যাঁ । ফিরতে রাইত বেশি হইব যদি ডর লাগে তো ফুলবানুরে লইয়া ঘুমাইয়া থাকিস ।” লোকটা এই কথা কইয়া তিনার জাল, ছিপ আর মাছ রাখার খইল নিয়া ঘর থেইকা বের হইয়া গেল । আমি আম্মার কাছে গিয়া তিনার চইলা যাইবার কথা যানাইলাম। ফুলবানুরে নিয়া আমারগো ঘরে আইসা হারিকেনটা ছোট কইরা বিছানায় গিয়া শুইয়া পরলাম। চক্ষু দুইখান সবে লাইগা আসছিল মনে হই ঐ সময় শুক্কুর ভাইয়ের গলা শুইনা আমার ঘুম ভাইঙ্গা গেল।
“ ঐ রহিম ভাই কোই তুমি , মাছ ধরতে যাইবা না আইজ? তারা তারি বাহিরে আহ। বেবাকেরে ডাকতে হইব। কত ক্ষণ ধইরা তমারে ডাকতাছি।”
আমি শুক্কুর ভাইয়ের ডাক শুইনা ঘড়ের ভিতর থাইকাই কইলাম, “ হেয় না কিছু ক্ষণ আগে আপনার লগে জলা টাল নিয়া ঘর থাইকা বের হইয়া গেল? ”
“ কি কন ভাবি সাব , আমি তো এই মাত্র আইলাম আমার ঘর থাইকা।”
আমি তারা তারি দরজা খুইলা হারিকেন বারাইয়া শুক্কুর ভাইরে দেখলাম সে জাল, ছিপ, খোল আর লন্ঠন বাতি নিয়া দারাইয়া আছে । আমি চিল্লাইয়া ফুলবানুরে ঘুম থাইকা ডাইকা তুল্লাম । ফুল বানু ঘুম থাইকা উইঠা ঘুম কাতুরে কন্ঠে আমরে কইকলো, ‘ ভাবি কি হইসে এত রাইতে কেন ঘুম থাইকা জাগাইলা, আর বাইরে কেডা?’
“ বাইরে শুক্কুর ভাই, কিন্তু কিছু ক্ষণ আগেই তো তোর ভাই শুক্কুর ভাইয়ের লগে মাছ মারবার লাইগা ঘর থাইকা বের হইয়া গেল।”
“ কি কন ভাবি ... হায় হায় ভাই জানরে কি নিশিতে পাইলো নাকি। মা ওই মা কোই তুই ...হায় হায় ভাই জানরে নিশিতে ধরসে...।” ফুলবানু বিলাপ করতে করতে ভিতরের ঘরে চইলা গেল।
“ ভাবি কি হইসে কনতো আমারে। ভাই কোই?” শুক্কুর ভাই কইলো আমারে।
“ হেয়তো আপনার সা থেই গেছে কিছুক্ষণ আগে । আমিতো বুঝতে পারতাসিনা ...।’’ আমার কণ্ঠ কান্নায় জড়াইয়া আসলো। আমি ডরে আস্থির হইয়া গেলাম। আমার হাত পা অবশ হইয়া আসতে লাগলো। ভিতর থেকে আমার শাশুড়ি বিলাপ করতে করতে বের হইয়া আসলো ফুল বানুর সাথে ।
“ কি হইসে আমার পোলার কি হইসে...?’’
“ ভাই জানরে নিশিতে লইয়া গেছে মা।” ফুল বানু কানতে কানতে কইলো। ঘটনা সবার কাছে খুইলা বলার পর সাবাই আস্থির হইয়া গেল। শুক্কুর ভাই তামাম গ্রামের মানুষ জন রে ডাইকা তুল্ল। সবাই লণ্ঠন জ্বালাইয়া হাতে বাঁশ লইয়া তিনর খোঁজে বের হইল। আমিও তিনাদের সাথে বের হইয়া গেলাম।,
‘ কি করো আশরাফের মা উঠানে বইসা নাতিন গো লইয়া।’ দাদার গলার শব্দ পেয়ে ফায়সাল, সুমা, দানিয়াল সহ দাদি গল্পের থেকে বের হয়ে আসলো।
‘ ওরা আমরে ছেইকা ধরছে কিচ্ছা শুনবো, তাই কিচ্ছা শুনাইতাসি । আপনার কিচ্ছা ঐ যে আপনারে যে নিশিতে নিয়া গাছিল ঐটা।’
‘ কোন পর্যন্ত শুনাইছো আশরাফের মা? আমিও আইতাসি খারাও। গঞ্জে গেছিলাম পাঞ্জাবিটা খুইলা আসি ।’ দাদা কিছু ক্ষণের মধ্যে পাঞ্জাবি বদল করে ফায়সাল, সুমাদের সাথে যোগ দিল ।
‘ আমি ওগো ঐ পর্যন্ত শুনাইছি আমরা আপনার খোঁজে বাইর হইলাম । বাকিটা আপনি কন। ’
‘শোন তাহলে……।’ এইবার দাদা গল্প বলা শুরু করলো।
আমি ঘর থাইকা ছিপ, জাল, খোল নিয়া বাইর হইলাম।
“ বউ ঘরে খিল দে ।’’ বাইরে আইসা দেখলাম শুক্কুর দাঁড়াইয়া আছে কিন্তু তার হাতে কোন ছিপ, জাল, খোল দেখলাম না। তার হাতে লন্ঠনও নাই। আমি লণ্ঠন লইয়া তার কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। তখনো গুড়িগুড়ি মেঘ পরতাছিল।
“ কিরে শুক্কুর তোর লণ্ঠন কোই এত অন্ধকারে কেমনে আইলি?’’
“ ভুইলা গেছি। এইবার লও হাঁটা ধর।” শুক্কুর কেমন যেন নাকা সুরে কথা গুলা কইলো।
“ বাকি সাবাইরে ডাকবি না?”
“ ওরা আইজ কেউ আইব না । গেছিলাম ওগো ডাকবার।”
তার পর আমরা আর কোন কথা না বইলা দুইজন হাঁটা ধরলাম ঘাটে বাঁধা আমগো মাছ মারার ডিঙ্গার কাছে। আজ কেন জানি গাঁটা ছম ছম করতে লাগলো। শুক্কুরে আমি ছোট বেলা থাইকাই চিনি। ও আমার বয়সে ছোট হইলেও আমরা বন্ধুর লাহান । আজ ও খুবই চুপচাপ, এমনিতে তো অনেক কথা কয় । কথা কইতে কইতে আমাগো মাথা খারাপ কইরা দেয়। ওরে এত চুপ চাপ থাকতে দাইখা আমি কইলাম, “ কিরে কি হইসেরে শুক্কুইরা কি হইসেরে তোর। আইজ এত চুপ চাপ কেনরে?”
শুক্কুর কোন উত্তর দিল না । আমি ভাবমার ওর বউয়ের লগে ঝগড়া কইরা আইসে। থাক ওরে আর ঘাটানোর দরকার নাই। ঘাটের কাছে আইসা আমার প্রসাব ধরল, আমি শুক্কুরে কইলাম ‘শুক্কুর আমার প্রসাব ধরসে তুই একটু খাড়া আমি প্রসাব কইরা আহি।’
‘ সময় নাই প্রসাব করণ যাইব না।’ হঠাৎ শুক্কুরের গলা কেমন যেন হইয়া গেল। শুক্কুর এক প্রকার আমারে টাইনাই ডিঙ্গায় উঠাইল। এক মিনিট দেরি না কইরা ডিঙ্গাটা পানিতে ভাসাইয়া দিল। আমি কোন মতে ডিঙ্গা থাইকা পইড়া যাইতে যাইতে নিজেরে বাচাইয়া নিলাম।
‘ কিরে কি হইসে তোর শুক্কুইরা আইজ তুই এমন করতাস কেন?’ আমি শুক্কুরের আচারণে ভয় পাইয়া কইলাম । শুক্কুর কোন জবাব দিলনা । শুক্কুর চুপ চাপ ডিঙ্গা বাইতে লাগলো। আমি শুক্কুরের কোন কিছুই বুঝতে পারতাসি না ওর কি হইসে। শুক্কুর বাতাসের লাহান ডিঙ্গাটা বাইতে লাগলো। আইজ ওর শরীরে এত শক্তি কইথাইকা আইলো আমি বুঝতে পারলাম না । মনে হইতাসে ডিঙ্গাটায় একটা মটর লাগানো হইসে। ‘‘ কিরে শুক্কুর কি হইসেরে তোর?’’ শুক্কুর কোন কথা না কইয়া আরও জোড়ে ডিঙ্গাটা বাইতে লাগলো। ঘাট থাইকা কত দূরে আসছি এইটা দেখার জন্য ঘেটিটা ঘুরাইয়া ঘাটের দিকে তাকাইলাম। ঘাটের দিকে তাকাইয়া দেখলাম অনেক গুলা মানুষ দাঁড়াইয়া রইসে হাতে লণ্ঠন লইয়া। ঘাট থেইকা কয়েক জন আমার নাম ধইরা ডাকা ডাকি করতাসে। আমি শুক্কুরের দিকে তাকাইলাম ,
‘‘ কিরে শুক্কুর কি হইসেরে ঐ খানে?’’ শুক্কুর কোন কথা না কইয়া ডিঙ্গাটা আরও জড়ে বাইতে লাগলো। আমি আবার তাকাইলাম ঘাটের দিকে। কয়েক জন ঘটে লাগানো অন্য ডিঙ্গাগুলায় চইরা ডিঙ্গা ভাসাইয়া দিল। আর বিরামহীন আমরে ডাকতে থাকলো। ঐ গলার মধ্যে এক জনার গলা আম্র অনেক পরিচিত, আরে অইটাতো শুক্কুরের গলা। ঐটা যদি শুকুরের গলার আওয়াজ হয় তো আমার সামনে যা বইসা রইসে হেয় কেডা? আমি ডরে ডরে তাকাওলাম শুক্কুরের দিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কইলাম , ‘‘তুই শুক্কুর না ...ত তু...ই কেডা?’’
আমরে অবাক কইরা দিয়া শুক্কুর কইল মে মানিষের কণ্ঠে, ‘‘ আমরে চিনবার পারলানা রহিম ভাই... আমি শুক্কুর...। হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ.........।”
শুক্কুরের আকার আকৃতি কেমন যেন হইয়া গেল। ও আবারো আমরে কইল, ‘‘ ও রহিম ভাই আমি শুক্কুর হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ... । আমি তোমার বন্ধু মানুষ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ......।’’ শুক্কুর আমার গলা টিপা ধরতে আসতেছিল দুই হাত দিয়া।
ডরে আমার হাত পা বরফের লাহান জইমা গেল, আমি কি করুম বুইঝা পাইতাসিনা । আমি চোখ বন্ধ কইরা কলমা পড়া শুরু কইরা দিলাম। শুক্কুর তখনো হাসতাছিল ঐ কানি সুরে। আমি আর কোন কিছু না ভাইবা দিলাম পানিতে লাফ । লাফাইয়া পরার সময় আমার পা লাইগা লন্ঠটা পইরা গেল । আমি লাফাইয়া পিরাই সাঁতরাইতে লাগলাম জান পরাণ দিয়া। এর মধ্যে অন্য ডিঙ্গা গুলা আম্র কাছে চইলা আসলো। ঐ ডিঙ্গায় শুক্কুরে দেখলাম আমার দুকে হাত বারাইয়া দিসে। আমি আবারো ডরাইয়া গেলাম। শুক্কুর কইলো , ‘‘ রহিম ভাই আমি শুক্কুর আর কোন বিপদ নাই।’’ শুক্কুরের লগে জব্বার, করিম , সহ গ্রামের বেবাকেই আছিল। ওরা আমরে টাইনা অগো ডিঙ্গায় উঠাইলো । ততোক্ষণে পুরা বিলটা আলো দিয়া ভইরা গেছিল। আমার ডিঙ্গাট জ্বল তাছিল আমার লন্ঠনের আগুল লাইগা। শুক্কুর আমরে জড়াইয়া ধইড়া কইলো, ‘‘ রহিম ভাই তুমি ঠিক আছোতো? ভাই তোমারে নিশিতে পাইছিল । তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেনাই তো?’’
আমি আর কোন কথা কইতে পারলাম না । ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম । হেই রাইতেই আমার আইলো অনেক জ্বর । হের পর থাইকা আমি আর কোন দিনও কেই আমরে তিন বার না ডাক দিলে ঘর থাইকা বাইর হইনা। কারণ নিশি দুই বারের বেশি ডাক দিতে পারে না।
‘হইছে নাতিনরা যাও আইজ ঘুমাইতে । আজ অনেক রাইত হইসে । দাদি আর দাদা দুজন এক সাথে বলল।
‘আর একটা দাদি প্লিজ আর একটা শুনাও প্লিজ...।’ সাবাই এক সাথে বলল।
‘ আজ আর না কাল আবার শুনাবো আইজ অনেক রাত হইসে। যাও দাদু ভাইরা ঘুমাইতে যাও।’ ছেলে মেয়ে রা মন খারাপ করে ঘরে চলে গেল। কিন্তু ফায়সালের প্রকৃতির ডাক পাওয়ায় ও সবাইকে বলল, ‘ তোরা যা আমি আসছি।’ ফায়সাল ঘরের দরজার সামনেই প্রকৃতির ডাক (ছোট) সেরে ঘরে যাচ্ছিল আর তখন কে যান ফায়সালের নাম ধরে ডাক দিল দু’ বার , ‘ফায়সাল এই ফায়সাল’ কণ্ঠটা ওর অনেক পরিচিত মনে হল । ও পিছনে ফিরে তাকাল দেখলো কেউ নেই। কেউ নেই দেখে ঘরের একটা দৌড় দিল। ও মনে মনে ভাবল দাদার নিশির ডাকের কাহিনী মিথ্যা নয় যা ঘটেছিল সবই সত্যি ছিল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ১৮/০৯/২০১৪সবাই ভুত নিয়ে ব্যাস্ত। ভয় পেয়ে যাই।
-
অ ১৬/০৯/২০১৪অনেক ভালো লাগল ।
এরকম গল্প দাদা দাদীর কাছে কত শুনেছি । সত্যিই ভয়ঙ্কর ।