বিদেশী ষড়যন্ত্রই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আদালতের রায়েও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা উঠে আসেনি। আদালতের রায়ে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে সমগ্র সেনাবাহিনী জড়িত ছিল না। জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর চাকরিরত ও চাকরিচ্যুৎ ১০-১২ জন মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ২টি ইউনিট এই বর্বরতায় অংশ নেয়। অন্যদিকে, এদেশীয় মূল চক্রান্তকারী বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক সরকার ও সরকারের বাইরে গুটিকয়েক মন্ত্রী এবং আমলা বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের মদদ দেয়। আর স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্র তাদের এদেশীয় দোসররাই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতারই শুধু বিরোধিতা করেনি, স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে বিশ্ব মানচিত্রে টিকে থাকতে না পারে তারও চক্রান্ত করেছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের ভুট্টো যে বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল এর প্রমাণ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রবল প্রতাপশালী দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ এ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের প্রতি তার (কিসিঞ্জার) ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুর বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর - বাংলাদেশ দি আনফিনিশড রেভুলিউশন, লরেন্স লিফসুলজ (পৃষ্ঠা-১৩৬-১৩৮)। ১৯৭৯ সালে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পেছনে সিআইএ’র হাত ছিল এবং মার্কিন সরকারের উচিত এটি তদন্ত করে দেখা। মুজিব হত্যায় সিআইএ সংশ্লিষ্টতার মার্কিন দলিলপত্রই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। ১৯৭২ সাল থেকে ফারুক নিয়মিতভাবে মার্কিন মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। এমনকি ১৯৭৪ সালে তিনি মার্কিনীদের কাছে সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা পেশ করেন। ১৯৯৩ সালে মার্কিন শিক্ষাবিদ ও লেখক স্টেনলি উলপার্ট তার জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান বইয়ে লিখেছেন, পঁচাত্তরের ২২ মার্চ মিসরের আসওয়ান সফররত কিসিঞ্জারের কাছে একটি টেলিগ্রাম যায়। তার শিরোনাম সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান। এর দুইদিন আগে ২০ মার্চ ফারুক রহমান জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার নীরব সমর্থন থাকলেও মূল ভূমিকা পালন করে পাকিস্তান তথা তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে আটক বঙ্গবন্ধুকে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারে দ্বিতীয়বারের মতো খুব সম্ভব ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান জীবন্ত কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে। তখন ভুট্টো খবর পেয়ে লাহোর থেকে রাওয়ালপিন্ডি ছুটে গিয়ে ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করে এবং বলে, তাকে পাকিস্তানের মাটিতে নয়, তার দেশেই তার লোক দিয়েই কবর দেয়া হবে। আপনি কেন এই দায় নিজে এবং পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপাতে চান? ৯৩ হাজার সেনা ও তাদের পরিবার-পরিজন মিলে লক্ষাধিক ভারতের কারাগারে বন্দী আছে। মুজিবকে হত্যা করলে বাঙালীরা তাদের ছেড়ে দেবে না। তারপর ১৯৭৩ সালে ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর দাওয়াত পেয়ে বিশাল লটবহর নিয়ে ঢাকা সফরে আসে এবং এই সফরসঙ্গীর অধিকাংশই ছিল আইএসআইয়ের লোক। আমাদের গোয়েন্দারা সফররত লোকজনের সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। আমাদের দেশের গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ ও দল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাকশাল চালু হওয়া অর্থাৎ বাকশালের ভালমন্দ যাচাই হওয়ার পূর্বেই বাকশালকে ‘সুন্দরবনের বাঘ’ বুঝিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। তারা দাবি করে বাকশাল গঠন করার কারণেই নাকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। অথচ ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তখন তো বাকশাল ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট করাচী থেকে প্রকাশিত দৈনিক ডন পত্রিকায় রিপোর্টে প্রকাশিত হয়, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর এদিন সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডির সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে তাদের ঢাকা মিশন সফলে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মূলত দুটি চক্র কাজ করেছিল, একটি খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বেসামরিক রাজনৈতিক চক্র ও অন্যটি সামরিক। যেসব সামরিক ব্যক্তি মুজিব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল ১৯৭৫-এর মার্চে কিংবা এপ্রিলের মধ্যে তাদের মোশতাকের মূল পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়। মোশতাক চক্রের অন্যতম কুশীলব মাহবুব আলম চাষী দীর্ঘদিন ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী মোশতাকের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। যার ফলে মোশতাকের সঙ্গে মার্কিন কূটনীতিক ও একাডেমিক সহকর্মীদের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের সম্যক ধারণা ছিল। এটি এখন সময়ের দাবী একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের মুখোশ জনগণের কাছে তুলে ধরা হোক।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
খায়রুল আহসান ২৩/১০/২০২১আপনার লেখায় অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম। আপনার দাবীর সাথে একমত।
-
আলমগীর কাইজার ২৯/০৯/২০১৭অসাধারণ লেখা
-
আবুল খায়ের ২৬/০৯/২০১৭সত্য কথা ।।
-
আবু সাইদ লিপু ২৬/০৯/২০১৭তথ্যবহুল
-
এস এম আলমগীর হোসেন ১৮/০৯/২০১৭অসাধারন। অনেক কিছু জানতে পারলাম
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১২/০৯/২০১৭সত্য কথা।