বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির মহানায়কের প্রতি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব ইতিহাসের এক কলঙ্কময়, নৃশংস ও কঠিন শোকের দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের শাহাদাতবরণের দিন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জনগণ যখন বঙ্গবন্ধুদের মতো তরুণ নেতাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করত যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে। খাদ্যভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্দী করা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচী। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নেই। এসব বিষয় বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পিতাকে বলতেন পিতার জবাব ছিল ‘আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। বঙ্গবন্ধু বাবাকে বলতেন ‘আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া চলতে পারে না। দেশের মাটি ও মানুষকে হৃদয়ের গভীরে ধারণের মহান নেতার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে প্রকৃত অর্থেই বিরল। জীবনে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার উৎকর্ষতা অর্জন-লগ্ন থেকে আত্মত্যাগের মহিমান্বিত যে ধারাবাহিক পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু নিজেকে ঋদ্ধ করেছিলেন, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তার যথার্থ স্বাক্ষর বঙ্গবন্ধুকে আজ বিশ্বদরবারে ‘চিরঞ্জীব’ মর্যদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন এবং বিশাল রক্তক্ষয়ী ফসল, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষা ও একে অর্থবহ করে তোলা অধিকতর কষ্টকর। বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন এবং রাজনৈতিক জীবন প্রবাহের মূলেই ছিল লোভ, হিংসা ও অহঙ্কারকে নিধন করে সততা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রজ্বলন ঘটিয়ে মেহনতী মানুষের হৃদয় জয় করা এবং সামগ্রিক অর্থে একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সকলের জন্য সুখী ও কল্যাণকর জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। অশ্রুসজল নয়নে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মযজ্ঞের বিশাল প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের ক্যানভাস বিশ্লেষণে নিজেকে নিবেদন করতে হবে। বাঙালী জাতির আত্মপ্রত্যয়, অধিকার আদায় এবং সকল ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন সংগ্রাম ও বাঙালীর বিরুদ্ধে সামরিক, বেসামরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানাবিধ ষড়যন্ত্রের করুণ পটভূমি এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, উর্বর চিন্তা চেতনা, নিখাদ দেশপ্রেম ও বাংলার মাটি এবং মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তাঁর মহান আত্মত্যাগে ভাস্বর হয়ে আছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর মাধ্যমে মহান মুক্তি যুদ্ধের রোডম্যাপ রচনা করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এ রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর এই ঐতিহাসিক বক্তব্যকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করেছেন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জীবনের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়ে। ইতিহাসের স্রোত যে বিকল্প কোন অপকৌশলে শাসক-শক্তির ইচ্ছের অনুকূলে প্রবাহিত করা যায় না অথবা ইতিহাস যে কারও ক্রীতদাস নয়, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ইতিহাসে বারবারই সেই অমোঘ সত্যই প্রতিষ্ঠিত। দুঃখজনক হলেও সত্য ‘ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। বস্তুতপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘকাল ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন দাপটে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর ধর্মান্ধ ও পাকিস্তান প্রীতির প্রতি তাদের আগ্রহ ও আনুগত্যের বিপরীতে জাতিকে বিশেষ করে জাতির তরুণপ্রজন্ম ও শিশু-কিশোরদের অবগত করার লক্ষ্যেই স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অসাধারণ সফল চিত্রের বিষয়সমূহ বার বার উচ্চারণ এবং উপস্থাপন করা অতীব প্রয়োজন। আসুন আজকের এই শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ এবং তাঁর ত্যাগের মহিমাকে বেশী বেশী করে স্মরণ করি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোনালিসা ১৮/০৮/২০১৭ভাল
-
মোনালিসা ১৮/০৮/২০১৭খুব ভাল
-
আব্দুল হক ১৪/০৮/২০১৭আপনি সুন্দর লিখা ও!
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৩/০৮/২০১৭আমাদের জনক। আমাদের অহংকার।
-
ধ্রুবক ১৩/০৮/২০১৭খুব ভালো লেখা। বাংলাভাষার কাছে ঋন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আজীবন থাকবে।