দেশপ্রেম
দেশপ্রেম শব্দটি নিয়ে সকলকে ভাবতে হবে, বুঝতে চেষ্টা করতে হবে আসলেই দেশপ্রেম বলতে কোন বিশেষ ভাবনা আমাদের মনে কাজ করে কিনা? রক্তস্রোতে আবহমান সময়ের দায়ভারেই কী দেশপ্রেম থাকে? নাকি পথ চলতে হঠাৎ কোনো সুরে সচকিত হয়ে পা আটকে যায় মাটিতে, সারা শরীর উন্মুখ হয়ে উঠে দেশের ভাবনায় - সেটাই কী দেশপ্রেম? ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যখন শুনতে পাই এ ক্রিসমাসে পশ্চিমের কোনো এক নেতা প্রিয় স্বদেশের সব ঋণের সুদ মওকুফ করেছেন, তখন মনে মনে তাকে যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি সেটাই কী দেশ প্রেম? এমনি নানা উপলব্দিতে মানুষ যখন দেশপ্রেম বুঝার চেষ্টায় মাতে তখন তাদের ভাবনায় নতুন চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে সাদা কালোয় নির্মিত একটি পুরনো ইংরেজি ছবি। ওয়েলসের পটভূমিকার ঐ সিনেমাটির গল্পের সারাংশ এ ধরণের। গল্পের সময়কাল বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। তখন ওয়েলসের বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতে কোনটি পাহাড়, কোনটি পর্বত, কোনটি টিলা, কোনটি উইয়ের ঢিবি তার ভৌগলিক জরিপ চলছিল। একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন সার্ভেয়ার এসবের উচ্চতা জেনে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি সার্ভে বইতে এন্ট্রি করবেন। তারা গেছেন ওয়েলসের এক গ্রামে। সে গ্রামের পাশে ধ্যান গম্ভীর যে উঁচু জায়গা তা পাহাড় না পর্বত তা জানতে। এক হাজার ফুট হলে হবে পর্বত, আর কম হলে পাহাড়। তবে ঐ গ্রামের সবার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের গ্রামের পাশে যে উঁচু দেয়াল অতন্দ্র প্রহরীর মতো বছরের পর বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো সে অবশ্যই পর্বত, পাহাড় নয়। হিল নয় মাউনটেন। সার্ভে শেষে হলো। গম্ভীর মুখে সার্ভেয়ার এসে বলে, সরি। এটি একটি পাহাড়। পর্বত নয়। কারণ এর উচ্চতা মাত্র নয়শ ষাট ফুট। পর্বত নয়? মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রাম মানুষ। এ লজ্জা তারা কোথায় রাখবে? সব গ্রামবাসী একত্রিত হলো এ অপবাদ খন্ডন করার জন্য। তারা ঠিক করল সবাই মিলে পাহাড়ের উপর মাটি ফেলে চল্লিশ ফুটের ঘাটতি পূরণ করবে এ দুই সার্ভেয়ার বিদায় হওয়ার আগেই। প্রথমে মাটি কেটে সেই মাটি ব্যাগে, বালতিতে, কাঁধে, পিঠে, হাতে নিয়ে রওনা দিল গ্রামের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা, ছেলেমেয়ে, বালকবালিকা - সবাই শুরু করল অভিযান। আর বিদায়ী ইঞ্জিনিয়ার আর সার্ভেয়ারকে আটকে রাখতে কাজে লাগল যাবতীয় ফন্দিফিকির। তরুণ ইঞ্জিনিয়ারকে ভোলাতে গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে সেবাদাঁসি করা হলো। আর বয়স্ক সার্ভেয়ারকে ভোলাতে গ্যালন গ্যালন মদ। বিগড়ে দেয়া হলো তাদের গাড়ি, গ্রামের মেকানিক জানিয়ে দিল বলল তিনদিনের আগে এ গাড়ি ঠিক হবে না। ফলে বয়স্ক সার্ভেয়ার বিভোর মদের নেশায় আর ইঞ্জিনিয়ার মেয়েতে। অন্যদিকে পুরো গ্রামবাসী লেগে গেছে মাটি ফেলার কাজে। গ্রামের ধর্ম যাজকের বয়স আশির উপর। মাটি ফেলতে ফেলতে তিনি মারা গেলেন। তাকে কবর দেওয়া হলো পাহাড়ে। এরপরও কি শান্তি আছে? ঝুম বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল সদ্য ফেলা মাটি। বৃষ্টিতে ত্রিপল মাথায় দাঁড়িয়ে রইল একগ্রাম মানুষ, অপেক্ষা করতে লাগল প্রসন্ন আলোভরা দিনের জন্য - তারপর আবার নতুন উদ্যমে মাটি ফেলা। যাত্রার আগে সার্ভেয়ার আর ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রামের সবাই ধরল আর একবার পাহাড় মাপতে। তারা প্রথমে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই সুন্দরীর ধিক্কারে চৈতন্য হলো তাদের - দেখতে পাচ্ছ না সারা গ্রাম দিনরাত খেটে কী করছে? আর তোমরা কষ্ট করে আর একবার মাপতে পারছ না? আবার পাহাড়টিকে মাপলো তারা, তারপর ঘোষণা - আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি এর উচ্চতা এখন এক হাজার পাঁচ ফুট। আনন্দে খান খান হলো একগ্রাম মানুষ। গ্রামের মান রক্ষা পেয়েছে। ‘এ মাউনটেন নট এ হিল।’ আসলে সেটাই দেশপ্রেমের যথার্থ সংজ্ঞা। যখন একটি পাহাড়কে পর্বত করতে জীবন বাজি রাখে সবাই। মৃত্যু যেখানে কোনো ঘটনাই নয়। আছে কি আমাদের ভেতরে এমনি কোনো দেশপ্রেম? নদীতে চর পড়ছে, দেশ ভরে উঠছে দূষণে ও দূষিত আবহাওয়ায়, নদী হয়ে উঠছে খাল, খাল হচ্ছে অন্তর্হিত, বিরাণ খামার, শূন্য বাগান, গাছ নিধন হতে হতে শালবন হয়ে উঠছে খোলা মাঠ। চলে গেছে অনেক নদী। যাবে আরও। এতে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ওয়েলসের একগ্রাম মানুষের মতো যদি থাকে দেশপ্রেম তাহলে রক্ষা পায় দেশ, সুন্দর ও শ্রীময়তায় ভরে উঠে অঞ্চল। দেশপ্রেমের গভীর বেদনাতেই দেশ হয় উর্বর, আবাদী, শ্যামল ও শোভন। সেটাই কী ‘দেশপ্রেমের’ উদাহরণ নয়? আপনার কী মনে হয়?
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কালপুরুষ ৩১/০৩/২০১৭
-
আলীমুশ্বান সাইমুন ৩০/০৩/২০১৭nice
রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা