মুক্ত হতে হবে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে
বিশুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা একটি সমাজকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলতে পারে। সমাজে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতিচর্চা বিষয় দু’টির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। যদি সেই সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং উৎসবগুলো নির্মল আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক হয়, যদি সেগুলো দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। আমাদের সমাজেও সে ধরনের সংস্কৃতিচর্চা গ্রাম-গঞ্জে-শহরে সুদূর অতীতকাল থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু আজকাল শহরাঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ থাকলেও, গ্রামাঞ্চলে তা খুবই সীমিত হয়ে পড়ছে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ শিল্প-সংস্কৃতি অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এবং বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। জনগণের নীতি-নৈতিকতার উপর এর প্রভাবও ছিলো যথেষ্ট। গ্রামীণ পুঁথি পাঠ, জারী-সারী গান, পালা গান, কবি গান, ধর্মীয় সংগীতের আসর এবং যাত্রাপালা ও নাট্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের যে ভিত্তি রচিত হতো আজ তা আর হচ্ছে না। হিতোপদেশসমৃদ্ধ সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখন বিরলপ্রায়। যাত্রাপালার ‘বিবেক’-এর দর্শনই হয়ে উঠতো যেন সমস্ত শ্রোতা-দর্শকের দর্শন ও বিবেক। যার দ্বারা তাদের বাস্তব জীবন-যাপন ও সামাজিক সংস্কৃতি প্রভাবিত হতো। এদেশের লোক সংগীত, লোক গাথা, লোক নৃত্য অত্যন্ত উঁচুমানের, যা বিশ্বসভায় সমাদৃত। যার অন্তর্গত দর্শন হলো- মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সত্য ও ন্যায়, ঈশ্বর বন্দনা, মানব প্রেম এবং দেশ প্রেম। এ দেশের শহুরে সংস্কৃতিচর্চাও নাগরিকদের জাতীয়তাবোধ, অধিকার সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা, মননশীলতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখে এসেছে। সংগীত ও গণসংগীতের আসর, কবিতার আসর, নৃত্য, নাটক ও পথ নাটক, চলচ্চিত্র ও ছবি অংকন এ জাতিকে পথ দেখিয়েছে- বায়ান্নতে, একাত্তরে, নব্বইয়ে এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। এ জাতির চরম সংকট ও অবিস্মরণের দিনগুলোতে সংস্কৃতিচর্চার প্রভাব কতটুকু শক্তি ও গতিশীলতার সৃষ্টি করেছে তা আন্দোলনকারী ও প্রতিপক্ষ উভয়েই ভালভাবে অবহিত আছে। অবহিত আছে পুরো জাতি। গ্রামেই হোক কিংবা শহরেই হোক, বই পাঠের যে সুঅভ্যাস ও সংস্কৃতি আমাদের দেশে ছিলো, তা আজ আর নেই। এখন উপহার হিসেবে বই আর কদর পায় না। সমাজ ধীরে ধীরে ক্রমর্ধমান হারে ভোগবাদী হয়ে উঠছে, বইয়ের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য। মন ও মনন বিকাশের প্রতিযোগিতার পরিবর্তে আমরা আজ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছি অর্থ ও ভোগ-বিলাসের মোহে। সংস্কৃতিচর্চার অনুষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই মোহ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কৃতিচর্চার মূল উদ্দেশ্য ও সুফল থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে। রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য এবং লালন-হাসনের সংগীত ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এ উর্বর পলিমাটির দেশটিতে বিশুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে নিশ্চয়ই আলোকিত মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব। এর জন্য দরকার দেশীয় সংস্কৃতিচর্চার লালন ও বিকাশ এবং অপসংস্কৃতি ও অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির অপসারণ। পাশ্চাত্য ও অন্যান্য বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের সেই সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৪/০৩/২০১৭
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৩/০৩/২০১৭কথা সত্য। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে।
তারপর দেশেপ্রেমে উজ্জিবীত হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে প্রয়োজনে বেঁচে থাকার লড়াই ও করা যেতে পারে।
ধন্যবাদ