বিশ্বাসে আগুন
বিশ্বাসে আগুন
মোমিনুল হক আরাফাত
ছেলেটা এক সময় ভাল থাকলেও তো বর্তমান অবস্থা দেখে ঘৃণা জন্মে যায়। দেখতে চান ছেলেটি কে? পাহাড়ি নিরজন গ্রাম তেমন লোকালয় নাই। ঘন ছায়া বিশিষ্ট ছোট্ট একটি বাড়ি। বর্তমানে এই বাড়িতে বাস করে জয়। তার নিজ গ্রাম তো এই পাহাড়ি মনোরম গ্রামে নয়। কেন সে এই গ্রামে বাস করতেছে? সে কি প্রকৃতিকে ভালবেসে এই গ্রামে বাস করতেছে? না অন্য কারণ?
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আগমন গঠল। জয়, রুম থেকে বেরিয়ে এপির রুমে গিয়ে উপস্থিত। জয়, দরজায় আঘাত করার সাথে সাথে এপি, এসে দরজা খুলে দিল। এপির রুমে এপি ছাড়া তো কেউ ছিল না। জয়, বিছনার উপর গিয়ে মাথাটা নিচু করে বসে আছে। এপি, এসে উপস্থিত। এপি, জয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চায়ল। তবে বলতে পারে নাই। যাই হোক! স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে, এপি মোটেও খারাপ ছিল না। জয়ের সাথে তার পরিচয়টা শুরু এভাবে-
জয়ঃ নেশা করার জন্য প্রায় সময় এপিদের বাসায় আসত। আর ইচ্ছা মত মদ পান করত। যদি বাসায় ফিরে আসার শক্তি থাকত তবে বাসায় চলে আসত। না হয় এপির বাসায় পড়ে থাকত। এক সময় এপির বাবাও পরকালে চলে যায়। তখন জয়, এপিকে তার গৃহে এনে আশ্রয় দিল। এখন এপি, প্রতিদিন জয়কে মদ বানিয়ে দে। আর জয়, ইচ্ছা মত মদ খেয়ে পড়ে থাকে। তবে কখনো এপির দিকে খারপ নজরে তাকায় নি ।
জয় এপির দিকে একটু তাকাল আজ। এতদিন ধরে দু জন একি সাথে বাস করতেছে অথচ জয়ের বুকে এক বারও সাহস হল না এপির দিকে তাকানোর। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, জয় অনেক আগে বিশ্বাস হারিয়ে এই নিরজন পরিবেশে বাস করতেছে। জয়ের বিশ্বাসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল “তুলি”।
তুলি সে কে আবার?
তার কারণে জয়ের এই নিরজন পরিবেশে আসা। জয়, এপিকে খোঁজতে এই পরিবেশে আসে নাই। জয়, তুলিকে হারণোর যন্ত্রণাটা ভুলার জন্য এই জন মানবহীন পরিবেশে বাস করতেছে। স্বজনদের কথা হয়তো ভুলেও গেছে।
এপি জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কী শরীর খারাপ? জয়, মাথাটা নেড়ে বুঝিয়ে দিল শরীর ভাল আছে। এপি বলল, জয়? অনেক দিন ধরে একটা কথা বলতে চেয়েও বলতে পারতেছি না।
জয়ঃ কী কথা?
এপিঃ চুপ করে রইল। জয়ও আর জানতে চায়ল না। কারো সম্পর্কে কোন কিছু জানার আগ্রহটা বুকের ভিতর অনেক আগে মরে গেছে জয়ের। জয়, এপিকে বলল, অল্প করে মদ আনতে।
এপিঃ জয়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে, বাসার ছাদের উপর উঠে চেয়ারটাতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
জয়ঃ বুঝতে পারল আজও আর মদ খাওয়া হবে না। আজও এপির মন খারাপ। তার মনে কী চায় কে জানে?
জয়ঃ এপির রুম থেকে উঠে, নিজে রুমে গিয়ে বসে রইল। এপি অল্পক্ষণ পর রুমে ফিরে এসে জয়কে দেখতে না পেয়ে জয়ের রুমে গিয়ে দরজায় আঘাত করল। আজ কী হল? জয়, নিজেও জানে না। দু জন এত দিন ধরে একি সাথে বাস করতেছে। তবে কখনো এপি, জয়ের রুমে আসে নাই। আজ কী হল রে আবার?
জয়ঃ ব্যস্ত হয়ে উঠে হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে দিল।
এপিঃ জয়ের বিছনাই বসে পড়ল। জয়, হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এপি খুব ভাল করে জানত। জয় লাজ্জুক স্বভাবের।
এপিঃ জয়কে বলল, আমি কী এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম?
জয়ঃ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল না! না!
এপিঃ তাহলে এই শীতের মধ্যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঠান্ডায় বরফ জমে যা’বে তো?
জয়ঃ এই কথা শুনে এপির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, আমার সামনে রবি থাকতে আমি কী আবার ঠান্ডায় জমে যাব?
এপিঃ এত রাতে রবি কোথায় থেকে আসবে? জয় বলল, এইতো বিছনার উপর তো রবি উদিত হল। এপির বুঝতে দেরি হল না যে কথাটা এপিকে বলছে। এপি তারা-তারি উঠে দাঁড়াল। জয় বলল, আরে ভয় পাচ্ছ না’কি? ভয়ের কী আছে? রবির কাছে তো কেউ যেতে পারে না। যদি কেউ যেতে চায় সে তো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
এপিঃ আরে না আমি এত নিষ্ঠুর না। আমি রবি হলে শুধু আলো দিয়ে যেতাম কাউকে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে হত না।
জয়ঃ আচ্ছা তুমি যে কী একটা কথা বলেতে চেয়েছিলে?
এপিঃ হ্যাঁ- আচ্ছা দেখ-তো আকাশটা কত সুন্দর? জয় বলল, অনেক সুন্দর তবে তোমার মত না।
এপিঃ জয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, জয় আসলে যেটা সত্যি তুমি নষ্ট হয়ে গেছ।
জয়ঃ কথাটার কোন প্রতিবাদ না করে হারিকেনটা নিভিয়ে দিল।
এপিঃ ভয়ে কাতর হয়ে রইল। অল্পক্ষণ পর এপি আলো জ্বালিয়ে দেখতে পেল, জয় রুমে নাই।
এপিঃ মুখে হাতটা দিয়ে বসে রইল। অল্পক্ষণ পর রুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল। জয়, বারান্দায় বসে আছে। এপি, জয়ের পাশে এসে বলল, আরে হারিকেন বন্ধ করে দিয়ে এইখানে চলে আসলে কেন? জয় বলল, আমি তো নষ্ট হয়ে গেছি। তাই আমার চেহারাটা না দেখ মত হারিকেনটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
এপিঃ জয় তুমি কী আমার কথায় কষ্ট পেয়েছ? জয় বলল, কষ্ট পাওয়ার কী আছে? তুমি তো মিথ্যা কিছু বলো নাই আসলে আমি তো নষ্ট হয়েছি বহু আগে। এপি বলল, আমি তো এই রকম বলি নাই। আসলে তুমি অনেক ভাল তবে তোমার ভিতর মায়া মমতাটা নষ্ট হয়ে গেছে বলতে চেয়েছিলাম।
জয়ঃ হঠাৎ এই কথা কেন মনে হল?
এপি বলল, বেশ কিছু দিন ধরে তোমার সাথে বাস করতেছি তবে তোমার মাঝে মায়া মমতা বলতে কিছু দেখি নাই।
জয়ঃ আমি কী কখনো তোমাকে অবহেলা করছি?
এপিঃ একটু হেসে বলল, আরে আমার কথা কেন আসবে এইখানে? আামি বা তোমার কে? আমি তো এইটাই বলতেছি তোমার মুখে কখনো শুনি নাই তোমার স্বজনদের কথা। আচ্ছা না হয় “তুলি” তোমার সাথে ছলনা করেছিল। স্বজনদের কী অপরাধ ছিল? তাদের কেন অবহেলা করবে?
জয় আর কখনো এভাবে এপির দিকে তাকায় নি, আজ প্রথম। এপি, চুপ হয়ে গেল। জয় বলল, আমার তো স্বজন বলতে কেউ এই পৃথিবীতে নাই। যদি কেউ থাকত, তাদেরকে অবহেলা করতাম না। আমার জন্মের সময় মা পরকালে চলে যাই। বাবা আরেকটি বিয়ে করে অনক সুখে দিন কাঁটাতে লাগল তখন আমার বয়স ৬/৭। আমার সৎ মা বলত আমার জন্য না’কি পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এতদিন পর আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি শুধু-শুধু মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছি যেমন- তোমাকেও।
এপিঃ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, না জয়! তোমার জন্য আমার কোন কষ্ট হয় না। শুধু এইটুকু কষ্ট হয়, তুমি মানুষের জগত থেকে অনেক দূরে সরে গেছ। নেশার রঙ্গিন মায়ায় তুমি ভিবুর হয়ে আছ। তুমি বুঝতে চাচ্ছ না এই পৃথিবীটা কত সুন্দর। তাই ভাবলাম আমি বাসা থেকে চলে যাব।
জয়ঃ তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নাই। মেয়ে মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় খোঁজবে? পৃথিবীর মানুষেরা সবাই এক না। এই জগতে এমনও অনেক আছে মানুষ রূপি অমানুষ। তাই আমি নিজে ঠিক করে নিয়েছি আমি বাসা থেকে চলে যাব।
এপিঃ আচ্ছা কাউকে যেতে হবে না। আমার একটি শর্ত মানলে আমি আর তুমি এই বাসাতেই থাকব।
জয়ঃ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী শর্ত?
এপিঃ আজ থেকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।
জয়ঃ না! তা কী করে সম্ভব? আজ থেকে কী ভাবে মদ খাওয়া ছেড়ে দিব? আমি তো দু-এক দিন আগ থেকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তুমি তো দু-এক দিন ধরে মদ তৈরি করো নাই।
এপির মখু উজ্জল হয়ে গেলে। এপি অতি আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলল, সত্যি তুমি আর মদ খাবে না?
জয়ঃ এপির নীল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ঐ দুটি নীল চোখ সাক্ষী রেখে বললাম আমি আর কখনো মদ খাব না।
এপিঃ তারপর? জয় বলল, তারপর আবার কী?
এপিঃ তোমার কাহিনী কী শেষ হয়ে গেছে? এখনো তো তুলির কোন কথায় বলা হয় নি।
জয়ঃ শুরো করল, তারপর আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসি। আমাকে এক ভদ্র লোক আশ্রয় দিয়েছিল তাঁকে আমি বাবা বলে জানতাম। তাঁর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। সে একা বাস করত। সে আমাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলে ছিল। আর তুলি আমাকে অমানুষে পরিণত করছে। তুলির বাসা ঢাকা নারায়নগঞ্জে ছিল, এইটুকু জানা ছিল। এর বেশি কোন পরিচয় আর দেয় নি। সে জীবনের প্রথম বার কঙবাজারে ভ্রমনে এসেছিল । দুঃখের সাথে বলতে হয় যাদের সাথে তার ভ্রমনে আসা তারা ভুল বশত ঢাকা চলে যাই। আর তুলি কঙবাজার একা থেকে যায়। সন্ধ্যা শুরুতে বিপদ এসে তার ধারে কড়া নাড়ায়। হাইযাক তার টাকা কড়ি সব ছিনিয়ে নিল। একটি মেয়ে কী ভাবে নিজের চরিত্র বাঁচাবে? ধর্ষিত এই সমাজে? তার ভাগ্য ভাল আর আমার ভাগ্যটা খারাপ ছিল। আমার কাছে তার চলা ছল দেখে সন্দেহ হয়ে ছিল। প্রায় তিন ঘন্টা আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছিলাম। সে একটি চেয়ারে বসা ছিল। আর এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। দেখে মনে হল কোন কিছু গোপন করে যাচ্ছে।
তখন রাত প্রায় ১১টা আমি তার কাছে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে সে চমকে উঠে। তাকে বললাম আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। আমি এক জন সাধারণ মানুষ, আর আমি লেখা লেখি করি। তাই মানুষের মনের ভাষা বুঝাটা আমার পক্ষে খুব সহজে সম্ভব হয়। অনেক ক্ষণ ধরে আপনাকে লক্ষ্য করে মনে হল আপনি কোন বিপদে পড়ছেন।
তার কাছ থেকে সব কথা শুনে তাকে আমার বাড়া করা হোটেলে নিয়ে আসলাম । আরো দুঃখের সাথে বলতে হয়। তখন মানুষের এত ভিড় ছিল যে, একটি ছিট ও খালি ছিল না। তাকে আমার রুমে রেখে আমি সারা রাতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিলাম মশাদের জন্য। আর কঙবাজারের মশারা খুব অভদ্র তারা সারা রাত ইচ্ছা মত বিরক্ত করে গেল। সারা রাতটা আমার ছাদের উপর কাটাতে হল। সকালে উঠে, তাকে নিয়ে আমি ঢাকায় রওনা হলাম। তাকে গোলশান দুই এ পৌছে দিলাম। তার ঠিকানে জানতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলাম। সে কোন ঠিকানা দিল না। শুধু একটি ফেসবুক আই ডি দিয়েছিলে। অনেক দিন তার সাথে ফেসবুকে কথা হয়ে ছিল। অনেক বার চেয়েছিলাম ফোন নাম্বার। তবে সে কোন নাম্বার দিতে রাজি ছিল না। সে বলেছিল সে না’কি আমাকে অনেক অনেক ভালবাসে। হঠাৎ কী হল নিজেও জানি না। শুধু এই মেসেজটা পাঠিয়ে ছিল, জয়, আমি কখনো তোমাকে ভাল বাসতে পারব না। আমি তোমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে ঘর করিও। আর তোমার যখন মেয়ে সন্তান জন্ম নিবে তখন এই নাম দুইটি রাখিও মিথিলা হক ও মেহেজাবিন আরাফাত। আমি তাদের মাঝে বেঁচে থাকব। আমি তাকে বলেছিলাম আমার কেনো ছেলে সন্তান হবে না। তাই সে মেয়ের নাম দিয়েছিল।
এপিঃ জয় কেন সে এই রকম করবে?
জয়ঃ তা কী করে জানি? আমি তাকে কখনো কোন মিথ্যা কথা বলিনাই। শুধু মাত্র একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম। এপি ব্যস্ত হয়ে জিঞ্জাস করল কী সে মিথ্যা কথা?
জয়ঃ আমি বলেছিলাম আমি অতি দরিদ্র । আমি পরিশ্রম করে আয় রোজগার করে দু বেলা খাবার জোগায়। আর তাকেও দু বেলা খাওয়াবার ক্ষমতা আছে। তবে বিলাশীতা করানোর মত টাকা আমার নাই। আসলে আমি তো তেমন মিথ্যা ও বলিনাই। ঘাড়ি বাড়ি এসব থাকলেও তো আমি ব্যবহার করতেছি না। আমি তো সাধারণ মানুষের জীবনেটা উপভোগ করতেছি আসেলে অনেক সুখ আছে দরিদ্রদের জীবনে।
এপিঃ হাই! আরেকটি স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে তুমি।
জয়ঃ কার স্বপ্ন ভাঙ্গলাম আবার?
এপিঃ আমার স্বপ্নটা, আমি তো তোমাকে অনাত জেনেও ভালবেসে ছিলাম। আমি তো ঘাড়ি বাড়ি এসব কিছু চায় নি। এখন তো আর আমাকে বিশ্বাস হবে না। ভাববে ঘাড়ি বাড়িকে ভালবেসেছি।
জয়ঃ মন খারাপ করার কিছুই নাই। আমার ধন-সম্পদ সব অনাত আশ্রমে অনেক আগে দিয়ে দিছি। শুধু মাত্র এইটুকু সম্পদ রাখলাম যা দ্বারা দু বেলা দু মোটা খাওয়া হয়। ছোট্ট একটি সংসার চলানোর সম্পদ রেখেছি।
এপিঃ তাহলে আর দেরি না এখন নয় বেঁধে নি।
মোমিনুল হক আরাফাত
ছেলেটা এক সময় ভাল থাকলেও তো বর্তমান অবস্থা দেখে ঘৃণা জন্মে যায়। দেখতে চান ছেলেটি কে? পাহাড়ি নিরজন গ্রাম তেমন লোকালয় নাই। ঘন ছায়া বিশিষ্ট ছোট্ট একটি বাড়ি। বর্তমানে এই বাড়িতে বাস করে জয়। তার নিজ গ্রাম তো এই পাহাড়ি মনোরম গ্রামে নয়। কেন সে এই গ্রামে বাস করতেছে? সে কি প্রকৃতিকে ভালবেসে এই গ্রামে বাস করতেছে? না অন্য কারণ?
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আগমন গঠল। জয়, রুম থেকে বেরিয়ে এপির রুমে গিয়ে উপস্থিত। জয়, দরজায় আঘাত করার সাথে সাথে এপি, এসে দরজা খুলে দিল। এপির রুমে এপি ছাড়া তো কেউ ছিল না। জয়, বিছনার উপর গিয়ে মাথাটা নিচু করে বসে আছে। এপি, এসে উপস্থিত। এপি, জয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চায়ল। তবে বলতে পারে নাই। যাই হোক! স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে, এপি মোটেও খারাপ ছিল না। জয়ের সাথে তার পরিচয়টা শুরু এভাবে-
জয়ঃ নেশা করার জন্য প্রায় সময় এপিদের বাসায় আসত। আর ইচ্ছা মত মদ পান করত। যদি বাসায় ফিরে আসার শক্তি থাকত তবে বাসায় চলে আসত। না হয় এপির বাসায় পড়ে থাকত। এক সময় এপির বাবাও পরকালে চলে যায়। তখন জয়, এপিকে তার গৃহে এনে আশ্রয় দিল। এখন এপি, প্রতিদিন জয়কে মদ বানিয়ে দে। আর জয়, ইচ্ছা মত মদ খেয়ে পড়ে থাকে। তবে কখনো এপির দিকে খারপ নজরে তাকায় নি ।
জয় এপির দিকে একটু তাকাল আজ। এতদিন ধরে দু জন একি সাথে বাস করতেছে অথচ জয়ের বুকে এক বারও সাহস হল না এপির দিকে তাকানোর। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, জয় অনেক আগে বিশ্বাস হারিয়ে এই নিরজন পরিবেশে বাস করতেছে। জয়ের বিশ্বাসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল “তুলি”।
তুলি সে কে আবার?
তার কারণে জয়ের এই নিরজন পরিবেশে আসা। জয়, এপিকে খোঁজতে এই পরিবেশে আসে নাই। জয়, তুলিকে হারণোর যন্ত্রণাটা ভুলার জন্য এই জন মানবহীন পরিবেশে বাস করতেছে। স্বজনদের কথা হয়তো ভুলেও গেছে।
এপি জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কী শরীর খারাপ? জয়, মাথাটা নেড়ে বুঝিয়ে দিল শরীর ভাল আছে। এপি বলল, জয়? অনেক দিন ধরে একটা কথা বলতে চেয়েও বলতে পারতেছি না।
জয়ঃ কী কথা?
এপিঃ চুপ করে রইল। জয়ও আর জানতে চায়ল না। কারো সম্পর্কে কোন কিছু জানার আগ্রহটা বুকের ভিতর অনেক আগে মরে গেছে জয়ের। জয়, এপিকে বলল, অল্প করে মদ আনতে।
এপিঃ জয়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে, বাসার ছাদের উপর উঠে চেয়ারটাতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
জয়ঃ বুঝতে পারল আজও আর মদ খাওয়া হবে না। আজও এপির মন খারাপ। তার মনে কী চায় কে জানে?
জয়ঃ এপির রুম থেকে উঠে, নিজে রুমে গিয়ে বসে রইল। এপি অল্পক্ষণ পর রুমে ফিরে এসে জয়কে দেখতে না পেয়ে জয়ের রুমে গিয়ে দরজায় আঘাত করল। আজ কী হল? জয়, নিজেও জানে না। দু জন এত দিন ধরে একি সাথে বাস করতেছে। তবে কখনো এপি, জয়ের রুমে আসে নাই। আজ কী হল রে আবার?
জয়ঃ ব্যস্ত হয়ে উঠে হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে দিল।
এপিঃ জয়ের বিছনাই বসে পড়ল। জয়, হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এপি খুব ভাল করে জানত। জয় লাজ্জুক স্বভাবের।
এপিঃ জয়কে বলল, আমি কী এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম?
জয়ঃ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল না! না!
এপিঃ তাহলে এই শীতের মধ্যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঠান্ডায় বরফ জমে যা’বে তো?
জয়ঃ এই কথা শুনে এপির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, আমার সামনে রবি থাকতে আমি কী আবার ঠান্ডায় জমে যাব?
এপিঃ এত রাতে রবি কোথায় থেকে আসবে? জয় বলল, এইতো বিছনার উপর তো রবি উদিত হল। এপির বুঝতে দেরি হল না যে কথাটা এপিকে বলছে। এপি তারা-তারি উঠে দাঁড়াল। জয় বলল, আরে ভয় পাচ্ছ না’কি? ভয়ের কী আছে? রবির কাছে তো কেউ যেতে পারে না। যদি কেউ যেতে চায় সে তো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
এপিঃ আরে না আমি এত নিষ্ঠুর না। আমি রবি হলে শুধু আলো দিয়ে যেতাম কাউকে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে হত না।
জয়ঃ আচ্ছা তুমি যে কী একটা কথা বলেতে চেয়েছিলে?
এপিঃ হ্যাঁ- আচ্ছা দেখ-তো আকাশটা কত সুন্দর? জয় বলল, অনেক সুন্দর তবে তোমার মত না।
এপিঃ জয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, জয় আসলে যেটা সত্যি তুমি নষ্ট হয়ে গেছ।
জয়ঃ কথাটার কোন প্রতিবাদ না করে হারিকেনটা নিভিয়ে দিল।
এপিঃ ভয়ে কাতর হয়ে রইল। অল্পক্ষণ পর এপি আলো জ্বালিয়ে দেখতে পেল, জয় রুমে নাই।
এপিঃ মুখে হাতটা দিয়ে বসে রইল। অল্পক্ষণ পর রুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল। জয়, বারান্দায় বসে আছে। এপি, জয়ের পাশে এসে বলল, আরে হারিকেন বন্ধ করে দিয়ে এইখানে চলে আসলে কেন? জয় বলল, আমি তো নষ্ট হয়ে গেছি। তাই আমার চেহারাটা না দেখ মত হারিকেনটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
এপিঃ জয় তুমি কী আমার কথায় কষ্ট পেয়েছ? জয় বলল, কষ্ট পাওয়ার কী আছে? তুমি তো মিথ্যা কিছু বলো নাই আসলে আমি তো নষ্ট হয়েছি বহু আগে। এপি বলল, আমি তো এই রকম বলি নাই। আসলে তুমি অনেক ভাল তবে তোমার ভিতর মায়া মমতাটা নষ্ট হয়ে গেছে বলতে চেয়েছিলাম।
জয়ঃ হঠাৎ এই কথা কেন মনে হল?
এপি বলল, বেশ কিছু দিন ধরে তোমার সাথে বাস করতেছি তবে তোমার মাঝে মায়া মমতা বলতে কিছু দেখি নাই।
জয়ঃ আমি কী কখনো তোমাকে অবহেলা করছি?
এপিঃ একটু হেসে বলল, আরে আমার কথা কেন আসবে এইখানে? আামি বা তোমার কে? আমি তো এইটাই বলতেছি তোমার মুখে কখনো শুনি নাই তোমার স্বজনদের কথা। আচ্ছা না হয় “তুলি” তোমার সাথে ছলনা করেছিল। স্বজনদের কী অপরাধ ছিল? তাদের কেন অবহেলা করবে?
জয় আর কখনো এভাবে এপির দিকে তাকায় নি, আজ প্রথম। এপি, চুপ হয়ে গেল। জয় বলল, আমার তো স্বজন বলতে কেউ এই পৃথিবীতে নাই। যদি কেউ থাকত, তাদেরকে অবহেলা করতাম না। আমার জন্মের সময় মা পরকালে চলে যাই। বাবা আরেকটি বিয়ে করে অনক সুখে দিন কাঁটাতে লাগল তখন আমার বয়স ৬/৭। আমার সৎ মা বলত আমার জন্য না’কি পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এতদিন পর আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি শুধু-শুধু মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছি যেমন- তোমাকেও।
এপিঃ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, না জয়! তোমার জন্য আমার কোন কষ্ট হয় না। শুধু এইটুকু কষ্ট হয়, তুমি মানুষের জগত থেকে অনেক দূরে সরে গেছ। নেশার রঙ্গিন মায়ায় তুমি ভিবুর হয়ে আছ। তুমি বুঝতে চাচ্ছ না এই পৃথিবীটা কত সুন্দর। তাই ভাবলাম আমি বাসা থেকে চলে যাব।
জয়ঃ তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নাই। মেয়ে মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় খোঁজবে? পৃথিবীর মানুষেরা সবাই এক না। এই জগতে এমনও অনেক আছে মানুষ রূপি অমানুষ। তাই আমি নিজে ঠিক করে নিয়েছি আমি বাসা থেকে চলে যাব।
এপিঃ আচ্ছা কাউকে যেতে হবে না। আমার একটি শর্ত মানলে আমি আর তুমি এই বাসাতেই থাকব।
জয়ঃ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী শর্ত?
এপিঃ আজ থেকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।
জয়ঃ না! তা কী করে সম্ভব? আজ থেকে কী ভাবে মদ খাওয়া ছেড়ে দিব? আমি তো দু-এক দিন আগ থেকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তুমি তো দু-এক দিন ধরে মদ তৈরি করো নাই।
এপির মখু উজ্জল হয়ে গেলে। এপি অতি আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলল, সত্যি তুমি আর মদ খাবে না?
জয়ঃ এপির নীল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ঐ দুটি নীল চোখ সাক্ষী রেখে বললাম আমি আর কখনো মদ খাব না।
এপিঃ তারপর? জয় বলল, তারপর আবার কী?
এপিঃ তোমার কাহিনী কী শেষ হয়ে গেছে? এখনো তো তুলির কোন কথায় বলা হয় নি।
জয়ঃ শুরো করল, তারপর আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসি। আমাকে এক ভদ্র লোক আশ্রয় দিয়েছিল তাঁকে আমি বাবা বলে জানতাম। তাঁর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। সে একা বাস করত। সে আমাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলে ছিল। আর তুলি আমাকে অমানুষে পরিণত করছে। তুলির বাসা ঢাকা নারায়নগঞ্জে ছিল, এইটুকু জানা ছিল। এর বেশি কোন পরিচয় আর দেয় নি। সে জীবনের প্রথম বার কঙবাজারে ভ্রমনে এসেছিল । দুঃখের সাথে বলতে হয় যাদের সাথে তার ভ্রমনে আসা তারা ভুল বশত ঢাকা চলে যাই। আর তুলি কঙবাজার একা থেকে যায়। সন্ধ্যা শুরুতে বিপদ এসে তার ধারে কড়া নাড়ায়। হাইযাক তার টাকা কড়ি সব ছিনিয়ে নিল। একটি মেয়ে কী ভাবে নিজের চরিত্র বাঁচাবে? ধর্ষিত এই সমাজে? তার ভাগ্য ভাল আর আমার ভাগ্যটা খারাপ ছিল। আমার কাছে তার চলা ছল দেখে সন্দেহ হয়ে ছিল। প্রায় তিন ঘন্টা আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছিলাম। সে একটি চেয়ারে বসা ছিল। আর এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। দেখে মনে হল কোন কিছু গোপন করে যাচ্ছে।
তখন রাত প্রায় ১১টা আমি তার কাছে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে সে চমকে উঠে। তাকে বললাম আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। আমি এক জন সাধারণ মানুষ, আর আমি লেখা লেখি করি। তাই মানুষের মনের ভাষা বুঝাটা আমার পক্ষে খুব সহজে সম্ভব হয়। অনেক ক্ষণ ধরে আপনাকে লক্ষ্য করে মনে হল আপনি কোন বিপদে পড়ছেন।
তার কাছ থেকে সব কথা শুনে তাকে আমার বাড়া করা হোটেলে নিয়ে আসলাম । আরো দুঃখের সাথে বলতে হয়। তখন মানুষের এত ভিড় ছিল যে, একটি ছিট ও খালি ছিল না। তাকে আমার রুমে রেখে আমি সারা রাতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিলাম মশাদের জন্য। আর কঙবাজারের মশারা খুব অভদ্র তারা সারা রাত ইচ্ছা মত বিরক্ত করে গেল। সারা রাতটা আমার ছাদের উপর কাটাতে হল। সকালে উঠে, তাকে নিয়ে আমি ঢাকায় রওনা হলাম। তাকে গোলশান দুই এ পৌছে দিলাম। তার ঠিকানে জানতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলাম। সে কোন ঠিকানা দিল না। শুধু একটি ফেসবুক আই ডি দিয়েছিলে। অনেক দিন তার সাথে ফেসবুকে কথা হয়ে ছিল। অনেক বার চেয়েছিলাম ফোন নাম্বার। তবে সে কোন নাম্বার দিতে রাজি ছিল না। সে বলেছিল সে না’কি আমাকে অনেক অনেক ভালবাসে। হঠাৎ কী হল নিজেও জানি না। শুধু এই মেসেজটা পাঠিয়ে ছিল, জয়, আমি কখনো তোমাকে ভাল বাসতে পারব না। আমি তোমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে ঘর করিও। আর তোমার যখন মেয়ে সন্তান জন্ম নিবে তখন এই নাম দুইটি রাখিও মিথিলা হক ও মেহেজাবিন আরাফাত। আমি তাদের মাঝে বেঁচে থাকব। আমি তাকে বলেছিলাম আমার কেনো ছেলে সন্তান হবে না। তাই সে মেয়ের নাম দিয়েছিল।
এপিঃ জয় কেন সে এই রকম করবে?
জয়ঃ তা কী করে জানি? আমি তাকে কখনো কোন মিথ্যা কথা বলিনাই। শুধু মাত্র একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম। এপি ব্যস্ত হয়ে জিঞ্জাস করল কী সে মিথ্যা কথা?
জয়ঃ আমি বলেছিলাম আমি অতি দরিদ্র । আমি পরিশ্রম করে আয় রোজগার করে দু বেলা খাবার জোগায়। আর তাকেও দু বেলা খাওয়াবার ক্ষমতা আছে। তবে বিলাশীতা করানোর মত টাকা আমার নাই। আসলে আমি তো তেমন মিথ্যা ও বলিনাই। ঘাড়ি বাড়ি এসব থাকলেও তো আমি ব্যবহার করতেছি না। আমি তো সাধারণ মানুষের জীবনেটা উপভোগ করতেছি আসেলে অনেক সুখ আছে দরিদ্রদের জীবনে।
এপিঃ হাই! আরেকটি স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে তুমি।
জয়ঃ কার স্বপ্ন ভাঙ্গলাম আবার?
এপিঃ আমার স্বপ্নটা, আমি তো তোমাকে অনাত জেনেও ভালবেসে ছিলাম। আমি তো ঘাড়ি বাড়ি এসব কিছু চায় নি। এখন তো আর আমাকে বিশ্বাস হবে না। ভাববে ঘাড়ি বাড়িকে ভালবেসেছি।
জয়ঃ মন খারাপ করার কিছুই নাই। আমার ধন-সম্পদ সব অনাত আশ্রমে অনেক আগে দিয়ে দিছি। শুধু মাত্র এইটুকু সম্পদ রাখলাম যা দ্বারা দু বেলা দু মোটা খাওয়া হয়। ছোট্ট একটি সংসার চলানোর সম্পদ রেখেছি।
এপিঃ তাহলে আর দেরি না এখন নয় বেঁধে নি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।