রমজানে তারাবীহ সত্য জানুন বিভ্রান্তি পরিহার করুন ঐক্যের সমাজ গড়ুন
রমজানে তারাবীহ: সত্য জানুন বিভ্রান্তি পরিহার করুন ঐক্যের সমাজ গড়ুন
প্রতিবছর রমজান মাস এলেই টিভি, সভা, ওয়াজ মাহফিল, আলোচনা অনুষ্ঠানে তারাবীর নামাজ নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। একদল আলেম বলেন তারাবী ৮ রাকাত, আরেক দল আলেম বলেন তারাবী ২০ রাকাত। আবার জামাতে পড়া বা একা একা পড়া নিয়েও কম বিতর্ক হয় না। এই বিতর্ক হাতাহাতি রক্তারক্তি পর্যন্ত গড়ায়। এই বিতর্কের আসল রহস্য কি আসুন জানার চেষ্টা করি।
তারাবীহ কী ও কিভাবে আসল: আরবী শব্দ তারাবীহ যার অর্থ বিশ্রাম। রাতের সালাত দীর্ঘ সময় ধরে দুই রাকাত করে করে বিশ্রাম নিয়ে পড়া হয় বলে এর নাম হয়েছে তারাবীহ। আসলে তারাবীহর সালাত বলে কোন সালাত নেই। কিয়ামুল লাইল বা রাতের সালাত রমজান মাসে এশার পরে যে সালাত পড়া হয় তার নাম দেয়া হয়েছে তারাবীহ। তারাবীহ একটি নফল এবাদত। এটি না করলে কোন গুণাহ হবে না কিংবা রোজার কোন ক্ষতি হবে না। তবে রমজান মাসের একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমান বলে রাসূল (সঃ) সাহাবাদেরকে রমজানে ফরজের পাশাপাশি বেশি করে নফল এবাদত করার উৎসাহ দিয়েছেন।
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রমজান মাসে গভীর রাতে বের হয়ে মসজিদে নামাজ আদায় করেন, কিছু সংখ্যক সাহাবী সেদিন উনার পিছনে নামাজ আদায় করলেন। সকালে ঐ সাহাবীরা অন্যান্য লোকদের সাথে তা আলোচনা করায় পরের রাতে অধিক সংখ্যায় সমবেত হন। নবীজির সাথে ওরা নামায আদায় করে। সকালে এ বিষয়ে তারা আলাপ আলোচনা করে। ফলে তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লী সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং নবীজির সাথে নামাজ আদায় করে। চতুর্থ রাতে এত বেশী পরিমাণ মুসল্লী আগমন করলো যে মসজিদে স্থান সংকুলান হলো না, কিন্তু ঐ রাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আর বের না হয়ে একেবারে ফজরের সালাতে আসলেন এবং নামাজ শেষে লোকদের দিকে ফিরে বললেন, শোন! তোমাদের গতরাতের অবস্থা আমার অজানা ছিল না, কিন্তু এই নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবার আশংকা করছিলাম। তাই বের হইনি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাত পর্যন্ত এই তারাবীর নামাজ এভাবেই থেকে যায়।
বুখারী- Vol 3, Book 32 No. 230
আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত কালে ও উমর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রথম ভাগে ও তারাবীর নামায বর্তমান সময়ের মতো সম্মিলিতভাবে পড়া হতো না।
আবদুর রহমান ইবন আবদ আল-ক্কারী (রাঃ) বলেন, আমি রমযানের এক রাতে উমর (রাঃ) এর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পাই যে, লোকেরা ছোট ছোট জামাতে পৃথক পৃথক ভাবে তারাবীর নামায আদায় করছে। উমর (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি যে, এই লোকদের যদি আমি একজন ক্কারীর (ঈমামের) পিছনে একত্রিত করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এর পিছনে সকলকে একত্রিত করে দিলেন।
বুখারী Vol Book 32 No. 22
কাজেই এ থেকে বুঝা যায় যে বর্তমান সময়ে যেভাবে তারাবিহ্ নামাজ্ মসজিদে আদায় করা হয় তা হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত কাল হতে চালু হয়েছিল।
তারাবীহ সম্পর্কে ৮ রাকাতের পক্ষে হাদীস:
আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, রমজানে রাসুল (সাঃ) এর নামাজ কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল (সাঃ) রমজানে ও অন্যান্য মাসে বিতিরসহ এগার আকাতের বেশি পড়তেন না। (বুখরী শরীফ হাঃ নং ১১৪৭)।
ইয়াহইয়া ইবনে আবু সালামা (রঃ) বলেন আমি রাসুল (সঃ) এর রাত্রীকালীন নামাজ সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল(সঃ) রাত্রে তের রাকআত নামাজ আদায় করতেন । প্রথমে আট রাকাত পড়তেন, এর পর বিতির পড়তেন, তার পর দুই রাকত নামাজ বসে আদায় করতেন । (মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৪)।
কাসেম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রাসুল (সাঃ) রাত্রিতে দশ রাকাত নামাজ, এক রাকাত বিতির, ও ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সহ মোট ১৩ রাকাত পড়তেন। (মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৭)।
এক ব্যাক্তি মহানবীর কাছে জিজ্ঞাসা করলো, কিয়ামুল লাইল কিভাবে পড়বো ? তিনি বললেন, এটা ২ রাকাত করে পড়া উচিত। যেমন ২ রাকাত, তারপর ২ রাকাত, তারপর ২ রাকাত এবং সূর্য যখন উদিত হবার সময় হয়ে আসবে, তখন ১ রাকাত। বুখারী-সালাত-৪৭২
হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসুল (সঃ)-এর রমযানের তারাবি নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ(সঃ) রমযান মাসে যখন কিয়ামুল লাইল বা তারাবীর নামাজ আদায় করতেন, তখন ১১ রাকাত আদায় করতেন এবং এর বেশী করতেন না। অন্য মাসে ৮ রাকাআত কিয়ামুল লাইল এবং ৩ রাকাত বিতরের নামাজ আদায় করতেন। বুখারী-তাহাজ্জুদ-১১৪৭
তারাবীহ সম্পর্কে ২০ রাকাতের পক্ষে হাদীস:
সায়ের ইবনে ইয়াজিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন সাহাবাগন উমর (রাঃ) এর খেলাফত কালে রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। (বাইহাকী শরীফ-খঃ ২/৪৯৬ হাঃ নং ৪৬১৭)
ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ- হযরত উমর (রাঃ) এর যুগে সাহাবারা বিতিরসহ তেইশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন । (মুয়াত্তা মালেক খঃ ১পৃঃ ১১৫)
আতা ইবনে আবী রাবাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি সাহাবাদেরকে বিতির সহ তেইশ রাকাত তারাবী পড়তে দেখেছি মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা – ৫/২২৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে সময় আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুস্ সুন্নাহ, তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল ইল্ম। ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীছটি হাসান সহীহ। মুসনাদে আহমাদ, (৪/১২৬), মাজমুওয়ায়ে ফাতাওয়া (১০/৩৫৪।)
উপরের হাদিস মতে আমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দিলে এবং তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর জীবনীতে না পাওয়া গেলে খুলাফায়ে রাশেদা অর্থাৎ ৪ খলিফাকে অনুসরন করতে বলা হয়েছে।
আল্লাহ আইন দিয়েছেন কুরআন। কুরআন হলো সংবিধান বা মূল আইন। সেই আইনের বাস্তবায়ন ও ব্যাখ্যার জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও অর্পণ করেছেন। কুরআন হাদীসের কোন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি বা মতপার্থক্য দেখা দিলে কিভাবে সমাধান করতে হবে তা আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৮৩ নম্বর আয়াতে বলে দিয়েছেন এবং যার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে তাকে ক্ষমতা অর্পণ করেছেন।
"যখন তাদের নিকট শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরাজয় বা ভয়ের কোন সংবাদ আসে তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। অথচ যদি তারা তা রাসূলের কাছে কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনতো, তবে তাদের মধ্য থেকে তথ্যানুসন্ধানীগণ প্রকৃত তথ্য জেনে নিতো। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তাহলে তোমাদের অল্প ক'জন ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে ৷" (৪:৮৩)
এই আয়াতে দুজনকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। একজন হলেন রাসূল। অন্যজন হলেন ‘উলিল আমর’। ‘উলিল আমর’ এর ব্যখ্যা করা হয়েছে দুটি। একটি হলো যারা ক্ষমতার অধিকারী বা শাসক, অন্যটি হলো মুসতাহীদ বা গবেষক।
শাসকদের প্রণীত বিধি মানার দুটি শর্ত। একটি হলো (ক) এটি ইসলামের অন্য কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীত হবে না; (খ) এটি জনস্বর্থের পরিপন্থী হবে না।
মুসতাহীদগণের প্রণীত বিধির ক্ষেত্রে সবার গবেষণার ফল এক রকম নাও হতে পারে তবুও তা মানার ক্ষেত্রে কোন শর্ত নাই।
রাসূলের অবর্তমানে হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামলে শাসক হিসেবে তিনি তারাবীর যে বিধান প্রনয়ন করেছেন তা উক্ত আয়াতের আলোকে মানা কোন অবস্থাতেই দোষের কিছু নয় কিংবা বিদাত নয়। কেননা রাসূল (সঃ) রমজানে সাহাবাদের নিয়ে তারাবী তথা কিয়ামুল লাইল আদায় করেছেন তার পক্ষে সমর্থন উপরে বর্ণিত হাদীস থেকে পাওয়া যায়। আবার তিনি ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকায় এই আমল একেবারে ছেড়ে দেননি, নিজে নিজে ঘরে আমল করেছেন আবার রাকাতের সংখ্যা নিয়ে যে বিভ্রান্তি তার সমর্থনেও হাদীস হলো রাতের সালাত ২+২+২+.....করে যত খুশি ফজর পর্যন্ত পড়া যায়। ফজর উদয় হবার সম্ভাবনা থাকলে ১ রাকাত বিতর পড়া যায়। হযরত উমর (রাঃ) এর দ্বারা নির্ধারিত ২০ রাকাত এই হাদীসের সাথেও সাংঘর্ষিক নয়। আবার জনস্বার্থের পরিপন্থীও নয়। অন্যান্য হাদীস থেকে (বিতর সহ) ১১, ১৩ ১৯, ২৩, ৩৯ রাকাতেরও হাদীস আছে। তাবেয়ীনরা রমযানের রাতে ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করতেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, তারা ৩৬ রাকাত আদায় করতেন। নবী করিম (সঃ) ২+২+২+... এভাবে আদায় করতে বলেছেন। মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা-পৃষ্ঠা-১৫৬,১৬৬।
যারা হযরত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ৮ রাকাতের পক্ষে দলিল দেখান তারা ভালো করেই জানেন যে, হযরত উমর (রাঃ) যখন জামাতে ২০ রাকাতের বিধান চালু করেন তখনও হযরত আয়েশা (রাঃ) জীবিত ছিলেন। যদি এটি রাসূলের সুন্নাহ পরিপন্থী কিংবা জনস্বার্থের পরিপন্থী হতো তাহলে তিনি এর বিরোধিতা করতেন। এমনকি অন্যান্য সাহাবারাও এর বিরোধিতা করতেন। কিন্তু কেউ তা করেননি। বরং ২০ রাকাতের আমল করেছেন। যদি শাসক উমরের ভয়ে কেউ বিরোধিতা না করে থাকে তবে তার পরে দুইজন খোলাফায়ে রাশেদা হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনামলে হযরত উমরের বিধান সুন্নাহ পরিপন্থী হলে বাতিল করে দিতেন। কিন্তু তাদের শাসন আমলে তা বাতিল না করে তারা এই ২০ রাকাতের উপরই আমল করেছেন।
তাদের পরবর্তী যুগে চার মাযহাবের ইমামদের আমলে তাদের মধ্যে ইসলামের নানা বিধানের বিষয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। কিন্তু ২০ রাকাত তারবীহ বিষয়ে চার ইমামই একমত পোষণ করে এর উপর আমল করেছেন।
অতএব ১৪০০ বছর আগেই তারাবীর বিতর্কের সমাধান হয়ে গেছে। নতুন করে যারা এখন বিতর্ক করেন এবং বিদাত বলে হযরত উমর (রাঃ) দ্বারা প্রচলিত ২০ রাকাতের বিরোধিতা করেন তারা কুরআনের সূরা নিসার ৮৩ নম্বর আয়াতের বিরোধিতা করেন। আর যারা এটিকে বিদাত বিদাত বলে মুখে ফেনা তুলেন তারাও কমবেশি বিদাতে ডুবে রয়েছেন। তাদের বিভ্রান্ত ছড়ানো বক্তব্যগুলো প্রচারের জন্য মোবাইল, সিডি, টিভি, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক ব্যবহার করছেন। রাসূল কি এগুলো ব্যবহার করেছিলেন? এটা কি বিদাত নয়? মসজিদে আযান দেয়া, সালাতে কুরআন তেলাওয়াত করা, ওয়াজমাহফিলে, সভা সেমিনারে যে মাইকের ব্যবহার করছেন তা কি বিদাত নয়? কোন দলিলের ভিত্তিতে এগুলো ধর্মের কাজে ব্যবহার করছেন? কোন দলিলের ভিত্তিতে সরকারের নির্দেশ মেনে চলছেন? সবকিছুর দলিল সূরা নিসার ৮৩ আয়াতে প্রদত্ত ক্ষমতায় ইসতিহাদ তথা গবেষণার দলিল।
রমজানের একটি নফল এবাদত অন্য মাসের একটি ফরজ এবাদতের সমান। তাই মানুষ উৎসাহিত হয়ে রমজান মাসে বেশি বেশি এবাদত করে। যে যত বেশি পারে করুক। তাছাড়া রমজানে রয়েছে মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। যে রাতের এবাদত হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষা উত্তম। তাই কদর পাওয়ার আশায় কেউ সারা রাত সালাত পড়লে তাতে ক্ষতি কি? তাছাড়া তারাবীহ নফল এবাদত হওয়ার কারণে যার কাছে যেটি উত্তম মনে হয় সেভাবে পালন করার অপশন রয়েছে। এ নিয়ে যারা বিবাদ করেন তাদের পিছনে চক্রান্তকারী ইন্ধনদাতা রয়েছে।
আমাদের দেশে রমজান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে জামাতের সাথে তারাবীর সালাত পড়া হয়। অনেকেই যারা ফরজ সালাত পড়ে না তারাও তারাবীর সালাত অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পড়ে। রোজার শুরুতে মসজিদগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মসজিদের ভিতরে বাহিরে বারান্দায় সিঁড়িতে মুসল্লীদের জায়গা হয় না। এই দৃশ্য দেখে অনেকের গায়ে আগুন লাগে। শরীরে জ্বালা ধরে। কেননা তাদের দীর্ঘদিনের চক্রান্ত, কিভাবে মসজিদগুলো মুসল্লী শূন্য করা যায়। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম এবং সালাতের মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করে দ্বীনের পথে ফিরে আসুক, মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্ব বন্ধুত্ব ঐক্য বজায় থাকুক এটা তারা চায় না। তাই রমজানে জিন শয়তান বন্ধি থাকলেও মানব শয়তান ফন্দি আঁটে কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। তাই তারাবীহ সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার হীন উদ্দেশ্যে বুঝে শুনে পরিকল্পিত উপায়ে তারা এই জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত হয় যা ফেতনা সৃষ্টির শামিল। আর ফেতনা হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। ফেতনা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি করতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সফল।
তবে আমাদের দেশে যেভাবে তারাবীহ পড়া হয় তাতে তারাবীহর আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয় কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যত দ্রুত তেলাওয়াত ও রুকু সেজদা করা হয় তাতে তারাবীহ এর সঠিক হক আদায় হয় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তাছাড়া একটি হাদীস রয়েছে যে, প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ পার হলে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বান্দাকে আহবান করতে থাকেন তার কি অভাব আছে তা যেন বান্দা চেয়ে নেয়। আমাদের সমাজে রাতের এক তৃতীয়াংশ পার হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে তারাবীহ শেষ করা হয়। আল্লাহ যখন বান্দাকে ডাকেন বান্দা তখন ঘুমে মগ্ন। আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে বান্দা যাতে আল্লাহর সাহায্য ও সান্নিধ্য লাভে বঞ্চিত হয় এই চক্রান্তে তাড়াহুড়ার তারাবীর প্রচলন কিনা তা ভাববার বিষয়।
বিষয়টিকে সংক্ষেপে কবিতার ভাষায় এভাবে বলা যায়-
তারাবীহর দ্বন্দ্ব করো বন্ধ
রমজান এলেই তারাবীহ নিয়ে
প্রচার হতে দেখি দুটি ভিন্ন মত
এক দল বলে আমারটা সহীহ
ওদেরটা বাতিল পথ।
উভয় দলের আছে যুক্তি
হাদীস কালাম বড় পাক্কা
কেউ কাহারে নাহি ছাড়ে
থেকে থেকে মারে ধাক্কা।
ধাক্কার চোটে অক্কা গেলে
ক্ষতি নেই কারো তাতে
আলেমে আলেমে ধাক্কাধাক্কি দেখে
শয়তান হাসে বত্রিশ দাঁতে।
ইহুদি নাসারা হাসে মিটিমিটি
ভাইয়ে ভাইয়ে লাগায়ে বিবাদ
জঙ্গি উপাধিতে রঙ্গ করে
ইসলামের ঘাড়ে চাপায় অপবাদ।
রমজানের একটি নফল এবাদত
অন্য মাসে ফরজের সমান
বিবাদ বাড়িয়ে করো না তোমরা
নবী, সাহাবার অপমান।
তারাবীহর সালাত নফল এবাদত
আটে আর বিশে কেন দ্বন্দ্ব
মুসলিম তুমি করো এবাদত যত পারো
ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ করো বন্ধ।
অতএব মুসলিম ভাই ও বোনেরা তারাবীহ নিয়ে আর ঝগড়া নয়। সত্য জানুন বিভ্রান্তি পরিহার করুন। রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে সিরাতাল মুসতাকীমের পথে চলুন। মুসলমানের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে ইহুদী নাসারাদের চক্রান্ত প্রতিহত করুন।
আল্লাহ আমাদের সকল এবাদত কবুল করুন। আমীন।
মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
বিতর্ক সহ-সম্পাদক
জাতীয় সংসদ সচিবালয়
ঢাকা।
প্রতিবছর রমজান মাস এলেই টিভি, সভা, ওয়াজ মাহফিল, আলোচনা অনুষ্ঠানে তারাবীর নামাজ নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। একদল আলেম বলেন তারাবী ৮ রাকাত, আরেক দল আলেম বলেন তারাবী ২০ রাকাত। আবার জামাতে পড়া বা একা একা পড়া নিয়েও কম বিতর্ক হয় না। এই বিতর্ক হাতাহাতি রক্তারক্তি পর্যন্ত গড়ায়। এই বিতর্কের আসল রহস্য কি আসুন জানার চেষ্টা করি।
তারাবীহ কী ও কিভাবে আসল: আরবী শব্দ তারাবীহ যার অর্থ বিশ্রাম। রাতের সালাত দীর্ঘ সময় ধরে দুই রাকাত করে করে বিশ্রাম নিয়ে পড়া হয় বলে এর নাম হয়েছে তারাবীহ। আসলে তারাবীহর সালাত বলে কোন সালাত নেই। কিয়ামুল লাইল বা রাতের সালাত রমজান মাসে এশার পরে যে সালাত পড়া হয় তার নাম দেয়া হয়েছে তারাবীহ। তারাবীহ একটি নফল এবাদত। এটি না করলে কোন গুণাহ হবে না কিংবা রোজার কোন ক্ষতি হবে না। তবে রমজান মাসের একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমান বলে রাসূল (সঃ) সাহাবাদেরকে রমজানে ফরজের পাশাপাশি বেশি করে নফল এবাদত করার উৎসাহ দিয়েছেন।
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রমজান মাসে গভীর রাতে বের হয়ে মসজিদে নামাজ আদায় করেন, কিছু সংখ্যক সাহাবী সেদিন উনার পিছনে নামাজ আদায় করলেন। সকালে ঐ সাহাবীরা অন্যান্য লোকদের সাথে তা আলোচনা করায় পরের রাতে অধিক সংখ্যায় সমবেত হন। নবীজির সাথে ওরা নামায আদায় করে। সকালে এ বিষয়ে তারা আলাপ আলোচনা করে। ফলে তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লী সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং নবীজির সাথে নামাজ আদায় করে। চতুর্থ রাতে এত বেশী পরিমাণ মুসল্লী আগমন করলো যে মসজিদে স্থান সংকুলান হলো না, কিন্তু ঐ রাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আর বের না হয়ে একেবারে ফজরের সালাতে আসলেন এবং নামাজ শেষে লোকদের দিকে ফিরে বললেন, শোন! তোমাদের গতরাতের অবস্থা আমার অজানা ছিল না, কিন্তু এই নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবার আশংকা করছিলাম। তাই বের হইনি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাত পর্যন্ত এই তারাবীর নামাজ এভাবেই থেকে যায়।
বুখারী- Vol 3, Book 32 No. 230
আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত কালে ও উমর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রথম ভাগে ও তারাবীর নামায বর্তমান সময়ের মতো সম্মিলিতভাবে পড়া হতো না।
আবদুর রহমান ইবন আবদ আল-ক্কারী (রাঃ) বলেন, আমি রমযানের এক রাতে উমর (রাঃ) এর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পাই যে, লোকেরা ছোট ছোট জামাতে পৃথক পৃথক ভাবে তারাবীর নামায আদায় করছে। উমর (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি যে, এই লোকদের যদি আমি একজন ক্কারীর (ঈমামের) পিছনে একত্রিত করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এর পিছনে সকলকে একত্রিত করে দিলেন।
বুখারী Vol Book 32 No. 22
কাজেই এ থেকে বুঝা যায় যে বর্তমান সময়ে যেভাবে তারাবিহ্ নামাজ্ মসজিদে আদায় করা হয় তা হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত কাল হতে চালু হয়েছিল।
তারাবীহ সম্পর্কে ৮ রাকাতের পক্ষে হাদীস:
আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, রমজানে রাসুল (সাঃ) এর নামাজ কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল (সাঃ) রমজানে ও অন্যান্য মাসে বিতিরসহ এগার আকাতের বেশি পড়তেন না। (বুখরী শরীফ হাঃ নং ১১৪৭)।
ইয়াহইয়া ইবনে আবু সালামা (রঃ) বলেন আমি রাসুল (সঃ) এর রাত্রীকালীন নামাজ সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল(সঃ) রাত্রে তের রাকআত নামাজ আদায় করতেন । প্রথমে আট রাকাত পড়তেন, এর পর বিতির পড়তেন, তার পর দুই রাকত নামাজ বসে আদায় করতেন । (মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৪)।
কাসেম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রাসুল (সাঃ) রাত্রিতে দশ রাকাত নামাজ, এক রাকাত বিতির, ও ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সহ মোট ১৩ রাকাত পড়তেন। (মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৭)।
এক ব্যাক্তি মহানবীর কাছে জিজ্ঞাসা করলো, কিয়ামুল লাইল কিভাবে পড়বো ? তিনি বললেন, এটা ২ রাকাত করে পড়া উচিত। যেমন ২ রাকাত, তারপর ২ রাকাত, তারপর ২ রাকাত এবং সূর্য যখন উদিত হবার সময় হয়ে আসবে, তখন ১ রাকাত। বুখারী-সালাত-৪৭২
হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসুল (সঃ)-এর রমযানের তারাবি নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ(সঃ) রমযান মাসে যখন কিয়ামুল লাইল বা তারাবীর নামাজ আদায় করতেন, তখন ১১ রাকাত আদায় করতেন এবং এর বেশী করতেন না। অন্য মাসে ৮ রাকাআত কিয়ামুল লাইল এবং ৩ রাকাত বিতরের নামাজ আদায় করতেন। বুখারী-তাহাজ্জুদ-১১৪৭
তারাবীহ সম্পর্কে ২০ রাকাতের পক্ষে হাদীস:
সায়ের ইবনে ইয়াজিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন সাহাবাগন উমর (রাঃ) এর খেলাফত কালে রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। (বাইহাকী শরীফ-খঃ ২/৪৯৬ হাঃ নং ৪৬১৭)
ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ- হযরত উমর (রাঃ) এর যুগে সাহাবারা বিতিরসহ তেইশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন । (মুয়াত্তা মালেক খঃ ১পৃঃ ১১৫)
আতা ইবনে আবী রাবাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি সাহাবাদেরকে বিতির সহ তেইশ রাকাত তারাবী পড়তে দেখেছি মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা – ৫/২২৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে সময় আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুস্ সুন্নাহ, তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল ইল্ম। ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীছটি হাসান সহীহ। মুসনাদে আহমাদ, (৪/১২৬), মাজমুওয়ায়ে ফাতাওয়া (১০/৩৫৪।)
উপরের হাদিস মতে আমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দিলে এবং তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর জীবনীতে না পাওয়া গেলে খুলাফায়ে রাশেদা অর্থাৎ ৪ খলিফাকে অনুসরন করতে বলা হয়েছে।
আল্লাহ আইন দিয়েছেন কুরআন। কুরআন হলো সংবিধান বা মূল আইন। সেই আইনের বাস্তবায়ন ও ব্যাখ্যার জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও অর্পণ করেছেন। কুরআন হাদীসের কোন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি বা মতপার্থক্য দেখা দিলে কিভাবে সমাধান করতে হবে তা আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৮৩ নম্বর আয়াতে বলে দিয়েছেন এবং যার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে তাকে ক্ষমতা অর্পণ করেছেন।
"যখন তাদের নিকট শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরাজয় বা ভয়ের কোন সংবাদ আসে তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। অথচ যদি তারা তা রাসূলের কাছে কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনতো, তবে তাদের মধ্য থেকে তথ্যানুসন্ধানীগণ প্রকৃত তথ্য জেনে নিতো। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তাহলে তোমাদের অল্প ক'জন ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে ৷" (৪:৮৩)
এই আয়াতে দুজনকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। একজন হলেন রাসূল। অন্যজন হলেন ‘উলিল আমর’। ‘উলিল আমর’ এর ব্যখ্যা করা হয়েছে দুটি। একটি হলো যারা ক্ষমতার অধিকারী বা শাসক, অন্যটি হলো মুসতাহীদ বা গবেষক।
শাসকদের প্রণীত বিধি মানার দুটি শর্ত। একটি হলো (ক) এটি ইসলামের অন্য কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীত হবে না; (খ) এটি জনস্বর্থের পরিপন্থী হবে না।
মুসতাহীদগণের প্রণীত বিধির ক্ষেত্রে সবার গবেষণার ফল এক রকম নাও হতে পারে তবুও তা মানার ক্ষেত্রে কোন শর্ত নাই।
রাসূলের অবর্তমানে হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামলে শাসক হিসেবে তিনি তারাবীর যে বিধান প্রনয়ন করেছেন তা উক্ত আয়াতের আলোকে মানা কোন অবস্থাতেই দোষের কিছু নয় কিংবা বিদাত নয়। কেননা রাসূল (সঃ) রমজানে সাহাবাদের নিয়ে তারাবী তথা কিয়ামুল লাইল আদায় করেছেন তার পক্ষে সমর্থন উপরে বর্ণিত হাদীস থেকে পাওয়া যায়। আবার তিনি ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকায় এই আমল একেবারে ছেড়ে দেননি, নিজে নিজে ঘরে আমল করেছেন আবার রাকাতের সংখ্যা নিয়ে যে বিভ্রান্তি তার সমর্থনেও হাদীস হলো রাতের সালাত ২+২+২+.....করে যত খুশি ফজর পর্যন্ত পড়া যায়। ফজর উদয় হবার সম্ভাবনা থাকলে ১ রাকাত বিতর পড়া যায়। হযরত উমর (রাঃ) এর দ্বারা নির্ধারিত ২০ রাকাত এই হাদীসের সাথেও সাংঘর্ষিক নয়। আবার জনস্বার্থের পরিপন্থীও নয়। অন্যান্য হাদীস থেকে (বিতর সহ) ১১, ১৩ ১৯, ২৩, ৩৯ রাকাতেরও হাদীস আছে। তাবেয়ীনরা রমযানের রাতে ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করতেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, তারা ৩৬ রাকাত আদায় করতেন। নবী করিম (সঃ) ২+২+২+... এভাবে আদায় করতে বলেছেন। মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা-পৃষ্ঠা-১৫৬,১৬৬।
যারা হযরত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ৮ রাকাতের পক্ষে দলিল দেখান তারা ভালো করেই জানেন যে, হযরত উমর (রাঃ) যখন জামাতে ২০ রাকাতের বিধান চালু করেন তখনও হযরত আয়েশা (রাঃ) জীবিত ছিলেন। যদি এটি রাসূলের সুন্নাহ পরিপন্থী কিংবা জনস্বার্থের পরিপন্থী হতো তাহলে তিনি এর বিরোধিতা করতেন। এমনকি অন্যান্য সাহাবারাও এর বিরোধিতা করতেন। কিন্তু কেউ তা করেননি। বরং ২০ রাকাতের আমল করেছেন। যদি শাসক উমরের ভয়ে কেউ বিরোধিতা না করে থাকে তবে তার পরে দুইজন খোলাফায়ে রাশেদা হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনামলে হযরত উমরের বিধান সুন্নাহ পরিপন্থী হলে বাতিল করে দিতেন। কিন্তু তাদের শাসন আমলে তা বাতিল না করে তারা এই ২০ রাকাতের উপরই আমল করেছেন।
তাদের পরবর্তী যুগে চার মাযহাবের ইমামদের আমলে তাদের মধ্যে ইসলামের নানা বিধানের বিষয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। কিন্তু ২০ রাকাত তারবীহ বিষয়ে চার ইমামই একমত পোষণ করে এর উপর আমল করেছেন।
অতএব ১৪০০ বছর আগেই তারাবীর বিতর্কের সমাধান হয়ে গেছে। নতুন করে যারা এখন বিতর্ক করেন এবং বিদাত বলে হযরত উমর (রাঃ) দ্বারা প্রচলিত ২০ রাকাতের বিরোধিতা করেন তারা কুরআনের সূরা নিসার ৮৩ নম্বর আয়াতের বিরোধিতা করেন। আর যারা এটিকে বিদাত বিদাত বলে মুখে ফেনা তুলেন তারাও কমবেশি বিদাতে ডুবে রয়েছেন। তাদের বিভ্রান্ত ছড়ানো বক্তব্যগুলো প্রচারের জন্য মোবাইল, সিডি, টিভি, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক ব্যবহার করছেন। রাসূল কি এগুলো ব্যবহার করেছিলেন? এটা কি বিদাত নয়? মসজিদে আযান দেয়া, সালাতে কুরআন তেলাওয়াত করা, ওয়াজমাহফিলে, সভা সেমিনারে যে মাইকের ব্যবহার করছেন তা কি বিদাত নয়? কোন দলিলের ভিত্তিতে এগুলো ধর্মের কাজে ব্যবহার করছেন? কোন দলিলের ভিত্তিতে সরকারের নির্দেশ মেনে চলছেন? সবকিছুর দলিল সূরা নিসার ৮৩ আয়াতে প্রদত্ত ক্ষমতায় ইসতিহাদ তথা গবেষণার দলিল।
রমজানের একটি নফল এবাদত অন্য মাসের একটি ফরজ এবাদতের সমান। তাই মানুষ উৎসাহিত হয়ে রমজান মাসে বেশি বেশি এবাদত করে। যে যত বেশি পারে করুক। তাছাড়া রমজানে রয়েছে মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। যে রাতের এবাদত হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষা উত্তম। তাই কদর পাওয়ার আশায় কেউ সারা রাত সালাত পড়লে তাতে ক্ষতি কি? তাছাড়া তারাবীহ নফল এবাদত হওয়ার কারণে যার কাছে যেটি উত্তম মনে হয় সেভাবে পালন করার অপশন রয়েছে। এ নিয়ে যারা বিবাদ করেন তাদের পিছনে চক্রান্তকারী ইন্ধনদাতা রয়েছে।
আমাদের দেশে রমজান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে জামাতের সাথে তারাবীর সালাত পড়া হয়। অনেকেই যারা ফরজ সালাত পড়ে না তারাও তারাবীর সালাত অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পড়ে। রোজার শুরুতে মসজিদগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মসজিদের ভিতরে বাহিরে বারান্দায় সিঁড়িতে মুসল্লীদের জায়গা হয় না। এই দৃশ্য দেখে অনেকের গায়ে আগুন লাগে। শরীরে জ্বালা ধরে। কেননা তাদের দীর্ঘদিনের চক্রান্ত, কিভাবে মসজিদগুলো মুসল্লী শূন্য করা যায়। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম এবং সালাতের মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করে দ্বীনের পথে ফিরে আসুক, মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্ব বন্ধুত্ব ঐক্য বজায় থাকুক এটা তারা চায় না। তাই রমজানে জিন শয়তান বন্ধি থাকলেও মানব শয়তান ফন্দি আঁটে কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। তাই তারাবীহ সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার হীন উদ্দেশ্যে বুঝে শুনে পরিকল্পিত উপায়ে তারা এই জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত হয় যা ফেতনা সৃষ্টির শামিল। আর ফেতনা হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। ফেতনা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি করতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সফল।
তবে আমাদের দেশে যেভাবে তারাবীহ পড়া হয় তাতে তারাবীহর আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয় কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যত দ্রুত তেলাওয়াত ও রুকু সেজদা করা হয় তাতে তারাবীহ এর সঠিক হক আদায় হয় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তাছাড়া একটি হাদীস রয়েছে যে, প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ পার হলে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বান্দাকে আহবান করতে থাকেন তার কি অভাব আছে তা যেন বান্দা চেয়ে নেয়। আমাদের সমাজে রাতের এক তৃতীয়াংশ পার হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে তারাবীহ শেষ করা হয়। আল্লাহ যখন বান্দাকে ডাকেন বান্দা তখন ঘুমে মগ্ন। আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে বান্দা যাতে আল্লাহর সাহায্য ও সান্নিধ্য লাভে বঞ্চিত হয় এই চক্রান্তে তাড়াহুড়ার তারাবীর প্রচলন কিনা তা ভাববার বিষয়।
বিষয়টিকে সংক্ষেপে কবিতার ভাষায় এভাবে বলা যায়-
তারাবীহর দ্বন্দ্ব করো বন্ধ
রমজান এলেই তারাবীহ নিয়ে
প্রচার হতে দেখি দুটি ভিন্ন মত
এক দল বলে আমারটা সহীহ
ওদেরটা বাতিল পথ।
উভয় দলের আছে যুক্তি
হাদীস কালাম বড় পাক্কা
কেউ কাহারে নাহি ছাড়ে
থেকে থেকে মারে ধাক্কা।
ধাক্কার চোটে অক্কা গেলে
ক্ষতি নেই কারো তাতে
আলেমে আলেমে ধাক্কাধাক্কি দেখে
শয়তান হাসে বত্রিশ দাঁতে।
ইহুদি নাসারা হাসে মিটিমিটি
ভাইয়ে ভাইয়ে লাগায়ে বিবাদ
জঙ্গি উপাধিতে রঙ্গ করে
ইসলামের ঘাড়ে চাপায় অপবাদ।
রমজানের একটি নফল এবাদত
অন্য মাসে ফরজের সমান
বিবাদ বাড়িয়ে করো না তোমরা
নবী, সাহাবার অপমান।
তারাবীহর সালাত নফল এবাদত
আটে আর বিশে কেন দ্বন্দ্ব
মুসলিম তুমি করো এবাদত যত পারো
ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ করো বন্ধ।
অতএব মুসলিম ভাই ও বোনেরা তারাবীহ নিয়ে আর ঝগড়া নয়। সত্য জানুন বিভ্রান্তি পরিহার করুন। রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে সিরাতাল মুসতাকীমের পথে চলুন। মুসলমানের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে ইহুদী নাসারাদের চক্রান্ত প্রতিহত করুন।
আল্লাহ আমাদের সকল এবাদত কবুল করুন। আমীন।
মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
বিতর্ক সহ-সম্পাদক
জাতীয় সংসদ সচিবালয়
ঢাকা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সামিয়া ১০/০১/২০১৮অনেক কিছু জানলাম অত্যন্ত উপকারী পোস্ট ।।
-
এম,এ,মতিন ০৭/০৬/২০১৭বেশ মনোযোগ সহকারে লেখাটি পড়লাম।তারাবীহ নামাজের সম্পর্কযুক্ত হাদিস এবং কোর আনের আঙ্গিকে বেশ পরিষ্কার হলাম।আপনার প্রতি রইল শ্রদ্ধাপরিপূর্ণ ভালোবাসা।
লেখাটি কপি করে যত বেশি শেয়ার পোস্ট জরুরী মনে করছি। -
সাইয়িদ রফিকুল হক ২৮/০৫/২০১৭ভালো লিখেছেন। পড়ি আর না পড়ি তারাবিহ আসলে ২০ রাকায়াত। ভণ্ডগুলো এ নিয়ে অহেতুক মিথ্যাচার করে থাকে।
-
আব্দুল হক ২৮/০৫/২০১৭বেশ কষ্ট করে লিখেছেন। ধন্যবাদ!