www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সালাতে কুরআন তেলাওয়াত আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন ও আলেম সমাজে বিভক্তি

সালাত ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। সকল ইবাদতের মধ্যমণি হচ্ছে সালাত। সালাত বেহেশতের চাবি। সালাত মানুষকে সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। সালাত মোমিনের জন্য মেরাজ স্বরূপ। মোমিন ব্যক্তির সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে কথোপকথন হয়। আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে সালাত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন “হে ইমানদারগণ তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈরযশীলদের সাথে আছেন।” মহানবী (সঃ) যে কোন কঠিন সমস্যায় পড়লে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন আর আ্ল্লাহর সাহায্য নিয়ে যে কোন সমস্যার সমাধান করতেন। পবিত্র কুরআনে সালাত কায়েম করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সালাত কিভাবে পড়তে হবে বা কায়েম করতে হবে তার ব্যাখ্যা আছে বলে আমার জানা নেই। রাসূল (সঃ) যেভাবে সালাত আদায় করেছেন সেভাবে সালাত আদায় করার নির্দেশ আছে। রাসূল (সঃ) বলেছেন “আমাকে যেভাবে সালাত পড়তে দেখ সেভাবে সালাত পড়।” তাই সালাত পড়ার পদ্ধতি রাসূল (সঃ) এর নিকট থেকেই জানতে হবে। তবে সালাত পড়ার পদ্ধতির ব্যাখ্যা কুরআনে না থাকলেও সালাতে কুরআন তেলাওয়াত কিভাবে করতে হবে সে বিষয়ে আল্লাহপাক পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন। সেই নির্দেশ প্রতিপালন না করে সালাত আদায় করলে সেই সালাত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বর্তমান মুসলিম সমাজে আল্লাহর সেই নির্দেশ লঙ্ঘিত হওয়ার কারণে আলেম সমাজে মতানৈক্য ও বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার ধারণা।
আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তুকে শিরোনামে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ে ভাগ করা যায়: ১। সালাতে কুরআন তেলাওয়াতে আল্লাহর নির্দেশ; ২। আল্লাহর সেই নির্দেশ লঙ্ঘন; এবং ৩। আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনের কারণে আলেম সমাজে মতানৈক্য ও বিভক্তি।

সালাতে কুরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ:
পবিত্র কুরআনের সূরা হিজরের ৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, “আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি।”
এই বার বার পঠিতব্য সাতটি আয়াত বলতে সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠকে নির্দেশ করেছেন। কেননা সালাতের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হয়।“রাসূল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করেনি তার নামযই হয়নি।”(মুসলিম শরীফ হাদীস নং ৭৭১)। ৭৭২ ও ৭৭৩ নং হাদীসের বক্তব্যও একই। “আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন নামায পড়ল কিন্তু তাতে ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পাঠ করল না তার এ নামায ক্রুটিপূর্ণ ও অপূর্ণাঙ্গ। এ কথাটি তিনি তিন বার বলেছেন।”(মুসলিম শরীফ হাদীস নং ৭৭৬)
অতএব সালাতে সূরা ফাতিহা অবশ্যই পড়তে হবে। সূরা ফাতিহার সাথে প্রথম দুই রাকাতে অন্য সূরা পড়ারও হাদীস রয়েছে। সালাতে এই সূরা পাঠ করার পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহ কুরআন শরীফে সুস্পষ্ঠ নির্দেশনা দিয়েছেন।
সূরা বনীইসরাইলের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, "বলো, তোমরা মহান আল্লাহ নামে ডাকো বা রহমান নামে ডাকো, যে নামেই ডাকোনা কেন সবই ভালো, কেননা সকল সুন্দর নামইতো তাঁর। তোমার সালাতে স্বর খুব উচ্চ করো না আর নিঃশব্দেও পড়ো না, এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করো।”
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাসূল (সঃ)কে সালাতে খুব উচ্চ স্বরে অথবা নিঃশব্দে কুরআন তেলাওয়াত করতে নিষেধ করেছেন। স্বাভাবিক সাবলীল ও শ্রুতিমধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াতের আদেশ করেছেন।
এই আয়াতটি নাযিলের পটভূমি সম্পর্কে তাফসীর ইবনে কাসীরের ৪৪৫ পৃষ্ঠার শেষ দুই প্যারা ও ৪৪৬ পৃষ্টার ২ ও ৩ নং প্যারায় বলা হয়েছে যে, “একজন মুশরিক রাসূল (সঃ)কে সিজদারত অবস্থায় “ইয়া রাহীমু” “ইয়া রাহমানু” বলতে শুনে বলে ওঠে: “এই একত্ববাদীকে দেখো, দুই খোদাকে ডাকছে।” ঐ সময় এই আয়াত নাযিল হয়।
এরপর মহান আল্লাহ বলেন: নামাযে স্বর খুব উচ্চও করো না এবং খুব ক্ষীণও করো না। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূল (সঃ) মক্কায় গোপনীয়ভাবে ছিলেন। যখন তিনি সাহাবীদেরকে নামায পড়াতেন এবং তাতে উচ্চ শব্দে কিরাত পড়তেন তখন মুশরিকরা কুরআনকে, আল্লাহকে এবং রাসূল (সঃ)কে গালি দিতো। তাই উচ্চ শব্দে কিরাত পড়তে নিষেধ করলেন। এরপর বললেনঃ এতো ক্ষীণ স্বরেও পড়ো না যে, তোমার সাথীরাও শুনতে পায় না। বরং এ দুয়ের মধ্য পথ অবলম্বন কর। অতঃপর যখন তিনি হিজরত করে মদিনায় আসলেন, তখন এই বিপদ কেটে গেল। তখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই কিরাত পাঠের অধিকার থাকলো।
যেখানে কুরআন পাঠ করা হতো সেখান থেকে মুশরিকরা পালিয়ে যেতো। কেউ শুনবার ইচ্ছা করলে লুকিয়ে ও নিজেকে বাঁচিয়ে শুনে নিত। কিন্তু মুশরিকরা জানতে পারলে তাকে কঠিন শাস্তি দিতো। এখন খুব জোরে পড়লে মুশরিকদের গালির ভয় এবং খুবই আস্তে পড়লে যারা লুকিয়ে শুনতে চায় তারা বঞ্চিত থেকে যায়। তাই মধ্যপথ অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়। মোট কথা, নামাযে কিরাত পাঠের ব্যাপারে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।
বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) নামাযে কিরাত খুব ক্ষীণস্বরে পাঠ করতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “আমি আমার প্রতিপালকের সাথে সলা-পরামর্শ করে থাকি। তিনি আমার প্রয়োজনের খবর রাখেন।” তখন তাঁকে বলা হয়ঃ “এটা খুব উত্তম।” আর হযরত উমার (রাঃ) নামাযে কিরাত উচ্চ স্বরে পড়তেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ “আমি শয়তানকে তাড়াই ও ঘুমন্তকে জাগ্রত করি।” তাঁকেও বলা হলোঃ “এটা খুব ভালো।” কিন্তু যখন এই আয়াতটি নাযিল হলো তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) স্বর কিছু উঁচু করেন এবং হযরত উমার (রাঃ) স্বর কিছু ক্ষীণ করেন।”
এ থেকে বোঝা যায় রাসূল (সঃ) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সালাতে স্বাভাবিক শব্দ করে কিরাত পাঠ করতেন এবং সাহাবারাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। এমনকি সিজদার তাসবীহও এমন শব্দে পড়তেন যা মুশরিকরাও শুনতে পেত। এটাও প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াতের সালাত কিংবা ব্যক্তিগত সালাতে কিরাত পাঠের নির্দেশ একই।
এরপর পবিত্র কুরআনের সূরা আরাফের ২০৪ নম্বর আয়াতে জামায়াতে ফরজ সালাতে কুরআন পাঠ সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,“আর যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাকো যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়।”
এই আয়াতটিতে জামায়াতে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, ইমাম সাহেব শব্দ করে কিরাত পাঠ করবেন আর মুক্তদিগণ চুপ করে শুনবেন। এতে তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। এই আয়াতটি নাযিলের পটভূমি সম্পর্কে তাফসীর ইবনে কাসীরের ৪৮৯ পৃষ্ঠার প্রথম প্যারায় বলা হয়েছে যে, “এই নীরবতা অবলম্বনের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ফরয নামাযের ব্যাপারে বা ঐ সময়, যখন ইমাম উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করেন।
হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ “অনুসরনের জন্যই ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং যখন সে তাকবীর পাঠ করে, আর সে যখন কিরাত পাঠ করে তখন তোমরা নীরব হয়ে যাও।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “আমরা নামাযের মধ্যে একে অপরকে সালামু আলাইকা বলতাম। এজন্য এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সঃ) সশব্দ নামায শেষ করে বলেন: তোমাদের মধ্যে কেউ নিজেও কি আমার সাথে সাথে পড়ছিল? তখন এক লোক বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল আমি পড়ছিলাম। তখন রাসূল (সঃ) বলেন: আমার কি হয়েছে যে, আমি মানুষকে আমার সাথে সাথে কুরআন পড়তে দেখছি? তখন থেকে মানুষ সশব্দ নামাযে ইমামের পিছনে কিরাত পড়া থেকে বিরত থাকে”
এই আয়াতটির আরও একটি শিক্ষা হচ্ছে যে, সালাত কিংবা সালাতের বাইরে যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন মনোযোগসহকারে শ্রবণ করলে আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। সালাতের বাইরে কারো যদি জরুরি প্রয়োজনে ব্যস্ততার কারণে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণের সুযোগ না থাকে তাহলে সে আল্লাহর রহমত লাভ থেকে বঞ্চিত হবে মাত্র, এতে তার গুনাহ হবে না। কিন্তু মুশরিকদের মতো কেউ যদি এমন কোন কাজ করে যে, নিজেও শুনবে না, অন্যকেও শুনতে দেবে না তাহলে তার গুনাহ হবে।
সূরা আরাফের ২০৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ করতে থাক স্বীয় পালনকর্তাকে আপন মনে ক্রন্দনরত ও ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং এমন স্বরে যা চিৎকার করে বলা অপেক্ষা কম; সকালে ও সন্ধ্যায়। আর বেখবর থেকো না।”
মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড ৭৮২, ৭৮৩, ৭৮৪ নং হাদীসের বক্তব্য একই। ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল (সঃ) আমাদেরকে যোহর অথবা আসরের নামায পড়ালেন। নামায শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আমার পিছনে সূরা ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা’ পাঠ করেছে? এক ব্যক্তি বলল, আমি। এর মাধ্যমে কল্যাণই কামনা করেছিলাম। তিনি বললেন, আমি অবগত হয়েছি যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছ থেকে কুরআন ছিনিয়ে নিচ্ছে।
বুখারী শরীফের ৭৪০ নং হাদীসে আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সঃ) যুহরের প্রথম দু’রাকাতে সূরা ফাতিহা ও দুটি সূরা পড়তেন এবং শেষ দু’রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন এবং তিনি কোন কোন আয়াত আমাদের শোনাতেন, আর তিনি প্রথম রাকাতে যতটুকু দীর্ঘ করতেন দ্বিতীয় রাকাতে ততটুকু দীর্ঘ করতেন না। এরূপ করতেন আসরে ও ফজরের সালাতেও।
বুখারী শরীফের ৭৪২ নং হাদীসে বলা হয়েছে-আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সঃ) যুহর ও আসরের সালাতে প্রথম দু’রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে আরেকটি সূরা পড়তেন। কখনো কোন কোন আয়াত আমাদের শুনিয়ে পড়তেন এবং তিনি প্রথম রাকাতে কিরাত দীর্ঘ করতেন।
পবিত্র কুরআনের সূরা তওবার ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, "আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিবে। এটি এজন্য যে, এরা জ্ঞান রাখে না।”
এই আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, রাসূল (সঃ) ফরজ সালাত বাদে সব রকম নফল বা সুন্নাত সালাত গৃহে পড়তেন এবং দীর্ঘ সময় তিনি সালাতে কাটাতেন। আর এই সালাতে কিংবা সালাতের বাইরে পাঠকৃত কুরআন যাতে মুশরিকরাও শুনতে পারে সেজন্য তাকে আশ্রয় দেবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
উপরোক্ত কুরআন ও হদীসের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (সঃ) আল্লাহর নির্দেশ মেনে সকল সালাতে শব্দ করে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এমনকি জোহর ও আসরের সালাতেও। সাহাবারাও সেভাবে সালাত পড়তেন যেভাবে রাসূল (সঃ) পড়েছেন। মোট কথা সালাতে শব্দ করে কুরআন তেলাওয়াত করা আল্লাহর নির্দেশ। সে নির্দেশ যে রাসূল (সঃ) পালন করেছেন তার প্রমাণও উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে পাওয়া য়ায়।

আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন:
আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুন্নাত বা নফল সালাত নিজে নিজে একা পড়ার সময় নিঃশব্দে কেরাত পড়া হয়। জামায়াতে ফরজ সালাত আদায়কালে ইমাম প্রথম দুই রাকাতে শব্দ করে কিরাত পড়েন। পরের রাকাতে নিঃশব্দে পড়েন। আবার যোহর ও আসরের সালাতে সব রাকাতে ইমাম নিঃশব্দে কিরাত পড়েন।সালাতে সশব্দে কিরাত পড়ার আল্লাহর যে নির্দেশ তা মানাতো সব সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আল্লাহ তো বলেননি যোহর বা আসর সালাত নিঃশব্দে পড়বে বা অন্য সালাতে প্রথম দুই রাকাতে শব্দ করে পড়বে এবং পরের রাকাতে নিঃশব্দে পড়বে। যদি অন্য কোনো আয়াতে বলে থাকেন তবে কোন আয়াতে বলেছেন তা আমার জানা নেই। বর্তমান মুসলিম সমাজে বিশেষকরে বাংলাদেশে বেশির ভাগ মুসলমান সালাতে কুরআন তেলাওয়াতের যে পদ্ধতি অনুসরণ করে তা আল্লাহর নির্দেশের লঙঘন নয় কি? এটা আলেম সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন।

আলেম সমাজে বিভক্তি:
সালাতে কুরআন তেলাওয়াত নিয়ে আলেম সমাজে সবচেয়ে বেশি বিভক্তি ও মতানৈক্য লক্ষ্য করা যায় সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কিত বিষয়ে। ইমাম আবু হানিফার মত অনুযায়ী মুক্তাদীগণ কোন অবস্থায়ই ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না। সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তাদীগণ ইমামের পাঠ মনোযোগসহকারে শুনবে। তাঁর মতটি বিতর্কের উর্ধ্বে থাকত যদি সূরা বনীইসরাইলের ১১০ আয়াতের নির্দেশ মতো ইমাম সব রাকাতে শব্দ করে কিরাত পাঠ করতেন। প্রশ্ন ওঠেছে ইমাম যখন নিঃশব্দে পড়েন তখন মুক্তাদী ইমামের কেরাত শুনতে পায় না। এই অবস্থায় মুক্তাদীগণ কী করবে?
এ ক্ষেত্রে ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের মত হলো ইমামের ফাতিহা পাঠ মুক্তাদী শুনতে পেলে তারা ফাতিহা পাঠ করবে না। অন্যথায় তাদেরকেও ফাতিহা পাঠ করতে হবে। এই মতেরও বিরোধী মত রয়েছে এই অজুহাতে যে, ইমাম যখন নিঃশব্দে পড়েন তখন মুক্তাদী নিজে ফাতিহা পাঠ করবে ঠিক আছে তবে ইমাম যদি মুক্তাদির আগে পড়ে শেষ করে রুকুতে চলে যায় আর মুক্তাদীর ফাতিহা পড়া শেষ না হয় তাহলে মুক্তাদী ফাতিহা শেষ না করেই ইমামের অনুরণ করবে নাকি ফাতিহা পাঠ শেষ করবে। যদি মুক্তাদী ফাতিহা শেষ করতে করতে ইমাম সেজদায় চলে যায় তাহলে কি তার জামায়াতে নামাজের সওয়াব পাবে? আর যদি ফাতিহা শেষ না করেই ইমামকে অনুসরণ করে তাহলে ফাতিহা পাঠের এই মত কতটা যুক্তিযুক্ত?
ইমাম শাফেয়ীর মতে মুক্তাদীগণ সর্বাবস্থায় অনুচ্চ স্বরে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। এতে করে সেই একই অবস্থা হবে। দেখা যাবে ইমাম সেজদায় চলে গেছে আর মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পাঠ করছে। তাছাড়া সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতের নির্দেশ (চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনা) সরাসরি অমান্য করা হয়ে যায়। এ হলো মাযহাবী আলেমদের মতপার্থক্য।
যদি সূরা বনীইসরাইলের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ইমাম সব সালাতে সব রাকাতে শব্দ করে কিরাত পড়তেন আর আরাফের ২০৪ নং আয়াতের নির্দেশ অনুসারে মোক্তাদীগণ চুপ করে শুনতেন তাহলে এত মতভেদের সৃষ্টি হতো না আর আল্লাহর নির্দেশও সঠিকভাবে প্রতিপালন হতো বলে আমি মনে করি। চার মাযহাবের এই চার ইমামের ব্যক্তিগত আমল আখলাক তাকওয়া জ্ঞান মেধা ইত্যাদি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কারো কোন দ্বিমত নেই। মতভেদ শুধু তাদের মতাদর্শে।
শুধু মাযহাবী আলেমই নয় আরো হরেক রকমের আলেম আছে যারা একজনের মতের বিরুদ্ধে আরেকজন মত প্রকাশ করেন। হাদীসের বিরুদ্ধে হাদীস দাঁড় করান। যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন। একজন বলেন আমার মত সঠিক, অন্যজন বলেন আমারটা সঠিক। একে অপরকে ভর্সৎসনা করেন এই বলে যে, ও তো শিয়া, সে তো সুন্নী, সে আশারী, সে মাতরুদী, সে ওহাবী, সে সালাফি, সে খারিজি, সে মোতাজিলা, সে এজিদী, সে আহলে হাদীস, সে আহলে সুন্নাত, সে আহলে বাইয়াত, সে মাযহাবী, সে দেওবন্দী, সে তাবলীগি, সে সুফি, সে ভান্ডারী, সে কুতুববাগী, সে দেওয়ান বাগী, সে ফুরফুরী, সে সুরেশ্বরী, সে আটরশি সে ওহাবী ইত্যাদি। আর একে অপরকে কাফের বাটপার বলে গালিগালাজ তো আছেই।
এদের মধ্যে কারো না কারো মত অবশ্যই সঠিক। তবে কে সঠিক তা নির্ণয় করতে না পেরে এরূপ হরেক রকমের আলেমের খপ্পরে পড়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মাথায় চক্কর দেয়। দিশা না পেয়ে অনেকেই নামাজই পড়ে না।
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটি এমন যে, নামাযে এক আলেম সূরা ফাতিহার শেষে “অলাদ দয়াল্লিন” বলে লম্বা টান দেয়। তার মতে এটিই সঠিক। আরেক আলেম “অলায যয়াল্লিন” বলে টান দেয়। তার মতে এটিই সঠিক। মুক্তাদী বুঝতে পারে না কারটি সঠিক। তাই সে বলে আমি দয়াল্লিনেও নাই, যয়াল্লিনেও নাই। ভুল পড়ে জাহান্নামে যেতে চাই না। তাই নামাজই পড়ি না।

উপসংহার:
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জেনেছি এবং বুঝেছি এতে মনে হয়েছে সালাতে কুরআন তেলাওয়াতে আল্লাহর যে নির্দেশ তা যদি কুরআনের অন্য কোথাও কোনো আয়াত দ্বারা রহিত করা না হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম আল্লাহর আদেশের লঙ্ঘন।
সালাতে কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়ে উল্লিখিত আয়াতে কুরআনের নির্দেশ এবং রাসুলের হাদিস অনুসরণ করে কিরাত পড়া হলে একদিকে আল্লাহর আদেশ পরিপূর্ণভাবে পালন হতো, অন্যদিকে আলেমদের মতপার্থক্যের অবসান হতো বলে আমি মনে করি। আলেম সমাজের এই বিভক্তি শুধু সালাতে কুরআন পাঠের বিষয়েই নয়, ইসলামের আরো অনেক মৌলিক বিষয়ে তাদের মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আর এই বিভক্তির কারণেই সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে মুসলমানগণ আজ ইহুদি নাসারা মুশরিকদের হাতে মার খাচ্ছে। নিজেরা নিজেরা বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের এই বিভক্তি কবে দূর হবে আর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে আল্লাহই ভাল জানেন। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম। আল্লাহ আমাদের হায়াত বর্ধিত করে দেন আর সঠিক পন্থায় সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভু্ক্ত করে দেন। আমিন।

মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
সহকারী বিতর্ক সম্পাদক
জাতীয় সংসদ সচিবালয়
ঢাকা।
তারিখ: ৬-৪-২০১৬ খ্রিঃ (১৭-৩-২০২০ সম্পাদিত)
(তথ্য সূত্র: তাফসীর ইবনে কাসীর, সহীহ বুখারী শরীফ, সহীহ মুসলিম শরীফ ইসলামী ফাউন্ডেশন অনুদিত)
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১৬২৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/১২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সোলাইমান ১৩/১২/২০১৬
    অনেক ভাল লিখছেন কবি।
  • লেখাটি পরে আরও একবার পড়তে হবে।
 
Quantcast