www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শেষ খেয়া

রাত তখন অনেক। Intercom Telephone-এ রিং হচ্ছিল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বিমলেন্দু ও সুতপা দুজনই শোনেনি। যখন রিং শুনে সুতপা ফোন তুলতে এলো, তখন ফোনটা কেটে গেছে। “এত রাতে কারই বা ফোন এলো? কতবার বলেছি, একটা কর্ডলেস নিয়ে নাও, তা নেবার সময় আর হয়না। বলি, ছেলেপুলে সব বিদেশে থাকে। তাদের যখন দিন, আমাদের তখন রাত। কখন কি খবর আসে?…….” সুতপা নিজের মনে বিরবির করতে করতে বাথরুমে ঢুকলো। ওদিকে বিমলেন্দু বিছানায় শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করল, “কার ফোন এলো এত রাতে? কি বললো?” সুতপার কোন উত্তর না পেয়ে বিমলেন্দু বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। এমন সময় বাইরে লিফ্ট থামা ও দরজা খোলার আওয়াজ হল। এত রাতে খবর না দিয়ে আসার মত তো কেউ নেই। ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।
“কে, এত রাতে?” ভয় মিশ্রিত গলায় বিমলেন্দু জিজ্ঞেস করল।
“স্যর, আমি সিকিউরিটি গার্ড। অভয়”। বাইরে থেকে উত্তর এলো। বিমলেন্দু দরজা খুলে অবাক। “অনিমেষ, তুমি? এত রাতে কোথা থেকে? তাছাড়া….তুমি একাই বা কেন? এস, ভেতরে এস। “অভয়, তুমি ব্যাগটা ভেতরে দিয়ে দাও”।
“ঠিক আছে স্যর”! – অভয় ব্যাগটা ভেতরে রেখে, “গুডনাইট স্যর” বলে চলে গেলে বিমলেন্দু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললো, “তারপর সব খবর ভালো তো, অনিমেষ”?
“হ্যাঁ, কাকু। আপনারা কেমন আছেন?... এইভাবে এতরাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি।“ অনিমেষ অত্যন্ত কুণ্ঠিত ও উদ্বিঘ্ন কন্ঠে বলল। “আসলে আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি তালা বন্দ। সিকিউরিটি গার্ড কিছু বলতে পারল না। পরশু রাতেই ফোনে আমার কথা হ’য়েছে বাবা-মার সাথে। আমার নিউইয়র্ক থেকে রওনা দেবার আগে। তারা জানেন আমি আসছি, অথচ তারা বাড়ীতে নেই। এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। আপনারা কি কিছু জানেন?”। অনিমেষ আশা ও নিরাশার দ্বন্দ নিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় বিমলেন্দুর চোখে চোখ রাখল।

এদিকে বিমলেন্দু একটা অদ্ভূত পরিস্থিতিতে পড়ল। কি উত্তর দেবে বা দেওয়া উচিত ভেবে ঠিক করতে পারছে না। সিদ্ধার্থ কতটা জানিয়েছে, কতটাই বা গোপন রেখেছে বিমলেন্দু তা জানে না। একটু ভাববার সময় পাওয়ার জন্য বলল, “অনিমেয তুমি বস, আমি তোমার কাকিমাকে ডেকে আনি। তুমি বরং হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ্ হয়ে নাও। চাইলে চানও করতে পার। গিজার অন করে দিচ্ছি”।
“না না, কাকিমাকে আর ঘুম থেকে তুলতে হবে না”। অনিমেষ কুন্ঠিত স্বরে বলে উঠল।
“সে আমার আগেই জেগেছে”। বলতে বলতে অনিমেষের কথা শেষ হবার আগেই বিমলেন্দু ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল। যেতে যেতে এ সি ও ফ্যন দুটোই চালিয়ে দিল। বাথরুমে গিজারও অন করে দিল। অনিমেষের মনে তখন হাজার রকম দুশ্চিন্তা, কি হ’ল, কি হ’তে পারে, আমায় জানাল না কেন, ফোনও লগছেনা। ল্যান্ড লাইন, মোবাইল সবই কি একসাথে খারাপ হ’য়ে গেল?....অনিমেষ সোফাতে গা এলিয়ে চোখ বন্দ করে ভাবতে থাকল, যদি কাকুরাও কিছু বলতে না পারে? অবশ্য সবকিছু শুনেও কাকুকে অতটা উদ্বিঘ্ন দেখাল না। তার মানে এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। খানিকটা চিন্তা ঝেরে ফেলে অনিমেষ তার ব্যাগ খুলে টাওয়েল, টয়লেট্রি-কিট, ও স্লিপিং ড্রেস বের করে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

ভিতরের ঘরে বিমলেন্দু আর সুতপা খুব নিচু স্বরে কিছু কথোপকথনে ব্যস্ত। তাদের চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায় যে তারাও কম উদ্বিঘ্ন নয়। অবশ্য তাদের উদ্বিঘ্নতার কারন ভিন্ন। এই পরিস্থিতি যে একদিন আসবে সে কথা বিমলেন্দু সিদ্ধার্থকে একাধিকবার বলেছে। প্রতিবার সিদ্ধার্থ সংস্কৃত পাঠ্য পুস্তকে পড়া সেই ‘ধীবর ও মৎস” গল্পের প্রত্যুতপন্নমতি নামক একটি মাছের কথা - “যঃ পলায়তি সঃ জীবতি” বলে হেসে উড়িয়ে দিত।

‘এই সুযোগে বিমলেন্দু ও সুতপা মোটামুটি ঠিক করে ফেলল কিভাবে ওরা পুরো ব্যাপারটা সামলাবে। ঠিক যা বলার বিমলেন্দুই বলবে, সুতপা শুধু মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করলে হাঁ বা না দিয়ে সামলে নেবে। এখন সব কিছু সামলাতে হবে আমাদেরকেই। তার আগে ছেলেটার কিছু খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা কর’ – বিমলেন্দু সুতপাকে রান্নাঘরে দিকে যেতে ইসারা করল।

অনিমেষ খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সুতপা প্লেটে বাটার স্যান্ডউইচ আর ওমলেট নিয়ে এলো। “এটুকু খেয়ে রাতটা কাটাও, আমি কফি নিয়ে আসছি।
“কাকিমা, আমি প্লেনেই যা ডিনার করেছি তাতে আর কিছু খাবার দরকার নেই। বরং বাব-মা র খবরটা পেলে একটু নিশ্চিন্ত হ’য়ে ঘুমোতে পারতাম”।–অনিমেষ কাকিমার কাছ থেকে কিছু জানার আশায় বুক বাধছিল।
সূতপা কিছু বলার আগেই বিমলেন্দু এসে পড়ল।
“ওসব নিয়ে আর ভাবতে হ’বে না। আমি বুঝেছি কি হয়েছে। পরে সকালে সব বলব’খন। তুমি চিন্তা ক’রোনা। হয়ত কোথাও কাছাকাছি কোন বন্ধুর বাড়ী গিয়ে দেরি হয়ে গেছে ব’লে ফেরে নি। আমি খবর যোগার করে নিচ্ছি। তুমি খাবারটা খেয়ে রেস্ট ক’রো। অনেক লম্বা জার্নি ক’রে এসেছ।” বিমলেন্দুর স্বরে আস্বস্থ হবার ঈঙ্গিত এবং এই মুহুর্তে অনিমেষও আস্বস্থ হতেই চায়।


পরদিন সকালে বিমলেন্দু ও সুতপা দু’জনই দেরীতে ঘুম থেকে উঠলো। ততক্ষনে অনিমেষে একেবারে তৈরী। বাবা মা’র খবর চাই। সারারাত না ঘুমিয়ে সে আকাশ পাতাল ভেবেছে। যদিও সে ভাবনায় লাভ কিছু হয়নি। কিন্তু. বাবা-মা’ই শুধু সন্তানের জন্য উদ্বিঘ্ন থাকে, এমনটা সত্যি নয়। সন্তানেরও বাবা-মা’র জন্য চিন্তা থাকে। অনিমেষের মানসিক স্থিতি দেখলে সে কথা স্পষ্ট বোঝা যায়।

বিমলেন্দু ও সুতপাও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তৈরী হয়ে নিল। দেখলেই বোঝা যায় যে এই প্রস্তুতি কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। বুঝতে পারলেও কৌতুহল চেপেই থাকলো অনিমেষে। সুতপা রান্নাঘরে জলখাবার তৈরীর কাজে লেগে পড়লে বিমলেন্দু অনিমেষের সামনে এসে বসলো। রাতে ঘুম ঠিক হয়েছে কিনা এবং অন্য কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা জাতীয় সৌজন্য-বার্তা বিনিময়ের পর বিমলেন্দুই প্রথম প্রসঙ্গ উত্থাপন করলো।
“আচ্ছা অনিমেষ, তোমার বাবা-মা’র সাথে তোমার কবে কথা হয়েছে”?
-“গত পরশু দিন”।
-“ওরা জানতো তুমি আসছো”?
-“হ্যাঁ কাকু। অবশ্যই জানতেন। এয়ার পোর্ট থেকে আর ফোন করিনি কারন ইন্ডিয়ায় তখন রাত। তবে যখন কথা হয়েছিল তখন এয়ার পোর্টে আসবেন বলে জিদ ধরেছিলেন। বলছিলেন বেশি রাত হলে নাকি ট্যক্সি পেতে অসুবিধা হবে। আমিই রাগারাগি করে নিরস্ত করেছিলাম”।

-“হুঁ”। মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে শেষ মুহুর্তে। তা না হলে, সে অবশ্যই ফ্ল্যাটে চলে আসত। আমাকে ফোন তো ওর করা উচিত ছিল। বিমলেন্দুকে চুপ করে থাকতে দেখে অনিমেষ উদ্বিঘ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কাকু, ব্যপারটা একটু খুলে বলুন তো। কোন কিছু সিরিয়াস নয় তো”?
-“না না, সিরিয়াস কিছু নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। কথায় বলে না ম্যন প্রপোজেস এ্যন্ড গড ডিসপোজেস। এটা তো একদিন না একদিন প্রকাশ হোতই”। বিমলেন্দু অনিমেষের দিকে সরাসরি দৃস্টি রেখে কথাগুলি বলছিল। অনিমেষের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করাটাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। অনিমেষ আর ধৈর্য ধরতে পারছিল না। “কাকু, প্লিজ। পরিস্কার করে বলুন। কী প্রকাশ হোত। আমার টেন্সন বাড়ছে”।
-“অনিমেষ, তোমার মা-বাবা আর এই ফ্ল্যাটে থাকেন না”।
“এই ফ্ল্যাটে থাকেন না? তাহ’লে, কোথায় থাকেন”? অনিমেষ আাকাশ থেকে পড়ার মত অবাক বিস্ময়ে বিমলেন্দুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। একটা অদ্ভূত অপরাধ বোধ তাকে ভীষনভাবে বিব্রত করল। সে কি বলবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। যারা আমাদেরকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করানোর জন্য সারা জীবন নানা ভাবে ক্রিচ্ছ্রসাধন করেছেন, যারা সব রকম আনন্দ আতিশয্য বর্জন করে জীবন কাটিয়েছেন, তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সে সংবাদ তাদের সুযোগ্য পুত্ররা কেউ রাখে না? এর চেয়ে লজ্জার কথা আর কি হ’তে পারে? অথচ প্রতি সপ্তাহে ফোনে মা-বাবার সাথে কথা হয়। ছোট ভাই অখিলেশের সাথেও কথা হয়। সেও নিশ্চয়ই জানে না। জানলে অবশ্যই বলত। অনিমেষের মনে নানা প্রশ্নের ঝড় বইছিল।এই সময়ে যে গভীর বেদনা অনুভব করছিল অনিমেষ, সেটা ভাষা দিয়ে ব্যক্ত করা যায় না। হৃদয় দিয়েই অনুভব করা সম্ভব।

অখিলেশ অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। অনিমেষ আমেরিকায় থাকে। সিদ্ধার্থ আর সুনন্দা থাকে ইন্ডিয়ায়। বছরে একবার পৃথিবী পরিক্রমা করে আসে ওরা। বিমলেন্দু অনিমেষের মানসিক স্থিতি বুঝতে পেরে আর দেরি না করে ব্যপারটা প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। ভাবল, এটাই সঠিক সময়। বিমলেন্দু বলতে লাগল।

“তোমরা তো জান যে তোমার বাবা-সিদ্ধার্থ আমার বাল্যবন্ধু। আমরা স্কুল ও কলেজে একসাথে পড়েছি। পরে চাকরী সূত্রে ও নিজ নিজ কর্মব্যস্ততায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হ’য়ে গেছিল। রিটায়ারমেন্টের পরে আমাদের আবার অদ্ভূত ভাবে দেখা হ’য়ে যায়। সেইথেকে আমরা আবার পুরনো বন্ধুত্বকে পুনরোজ্জিবীত রেখেছি। সপ্তাহে একদিন আমরা একসাথে কাটাতাম। তাই ওর প্রপোজাল শোনার পর আমি শুধু অবাকই হই নি। হতাশ ও বিমর্ষ হয়েছিলাম প্রথমটায়। পরে সব দেখে, শুনে ও বুঝে ভাবি ওরা ঠিকই করেছে। আমরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরন করার কথা ভাবছি। এটা বর্তমান যুগে একটা সম্মানজনক ও সুচিন্তিত ব্যাবস্থা শেষ জীবন অতিবাহিত করার। শুধুমাত্র ভাবপ্রবনতার অথবা লোকলজ্জার বশবর্তি হয়ে সবার জীবনে দুশ্চিন্তা ও কষ্ট ডেকে আনার কোনও যৌক্তিকতা নেই”।- বিমলেন্দু একনাগারে বলে চলেছিল।

অনিমেষও খুব একাগ্রতার সঙ্গে শুনছে, কিন্তু বুঝতে পারছেনা যে এই ভূমিকার পরে বিমলেন্দু কিসের পেটারা খুলতে চলেছে। অন্ততপক্ষে বাব-মা’র কাছ থেকে সেরকম কোন ঈঙ্গিত সে আগে পায় নি। বিমলেন্দু আবার শুরু করল। ভাবল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নেয়া ভাল।

“তোমরা বহু দূর দেশে থাক। তোমাদের সব খবর দেয়া হয় না। সিদ্ধার্থ-সুনন্দা একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকত। ওদের স্বাস্থও খুব একটা ভাল থাকে না। স্বল্পভাসি সিদ্ধার্থ ব্যক্তিগত বিষয়ে বিশেষ কিছু বলত না। হাসি ঠাট্টাকরে দিন কাটাতে চাইত। কিন্তু যা হয়, বন্ধুর অভাব এই বয়সে। ও বলতো, “জানিস বিমল, বহু কষ্ট করে জীবনটাকে একটা প্রতিষ্ঠালব্ধ জায়গায় নিয়ে এসেছিলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল মনে। এখন মনে হয়, হয়ত বা ভূলই করেছিলাম”। আমি বলতাম, “ধূৎ পাগল! তা কেন হবে? ভাব তো একবার, যে গ্রাম্য পরিবেশ থেকে টেনে নিজেদেরকে সমাজের একটা সম্মানিত ও গ্রহনযোগ্য স্তরে প্রতিস্ঠিত করেছি। সেটা তো নিঃসন্দেহে একটা এ্যাচিভমেন্ট। তাই নয় কি”?

সিদ্ধার্থ বলেছিল, “মানতাম বিমল, যদি কেউ আমাদের জীবনের শেষ পাঁচ-দশটা বছর পার করে দেবার দায়িত্ব নেবার মত থাকত”। সিদ্ধার্থের মনের গভীরে যে ব্যাথা লুকিয়ে আছে, সেই ব্যাথা হাজার হাজার পিতামাতার মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। বিমলেন্দুরাও তাদেরই দলে।
আমি বলেছিলম, “তুই এ কথা বলছিস কেন, সিধু? তোর অনিমেষ আর অখিলেশ তো হীরের টুকরো ছেলে। তারা বিদ্বান, কীর্তিমান, লব্ধপ্রতিষ্ঠ, বিনয়ী – তারা থাকতে তোর এত চিন্তা অহেতুক।”?

সিদ্ধার্থ কিছুক্ষন চুপ করে থাকল। হয়তো ভাবছিল কী বলবে। কী বলা উচিত, কী বলা উচিত নয়। কারন সাংসারিক ব্যপার এটা। তাছাড়া এরকম সেন্সিটিভ এবং এমোশনাল ইস্যু সবার সাথে শেয়ার করা যায় কিনা, সে সম্মন্ধে আমারও একটু দ্বিধা ও সংশয় ছিল। তাই আমিও আর দ্বিতীয় বার জানতে চাইতাম না। “তোর কাছে বলতে দ্বিধা নেই”। লম্বা এক দীর্ঘশ্বাসের পর সিদ্ধার্থ বলেছিল, “নারে না, সে কথা নয়। তারা তো সবসময় কাছে কাছে রাখতেই চায়। কিন্তু আমাদেরই বিধি বামে। আমরাই চাই না তাদেরকে বিপদে ফেলতে। যে দেশে সব কাজ নিজেকে করতে হয়, যে দেশে তাদেরকে সকাল থেকে রাত্রি অবধি তটস্থ থাকতে হয়, যাদের উইক-এন্ড গুলোও নানা ভাবে নানা কাজে পরিপূর্ণ, তারা তাদের ব্যধিগ্রস্ত অথর্ব অসহায় বাবা মা’কে দেখা-সেবা করার সময় কোথায় পাবে? যাদের নিজেদের হেল্থ চেক আপের সময় নেই, তাদেরকে আমরা কতবার বলব ‘আমাদের শরীরটা খারাপ লাগছে আমাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। শুধু তাই নয়, সে দেশে চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে আমাদের কুন্ঠাবোধ আমাদের বাধ্য করে সে দেশ থেকে চলে আসতে। সেটাও অসহজ এবং অস্বস্তিকর। আমাদের বিগত দিনের অভিজ্ঞতা এটাই ভাবতে প্রভাবিত করে ‘মরতে হয় তো নিজের দেশে’।

ততক্ষনে সুতপা জলখাবার টেবিলে এনে রাখল। বলল, “ঠান্ডা হ’বার আগে খেয়ে নাও। আমি কফি নিয়ে আসছি”।
বিমলেন্দু সোফা ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে অনিমেষকে ডাকলো, “অনিমেষ, এস। ইন্ডিয়ান ব্রেকফাস্ট কর”।

কফি খেতে খেতে বিমলেন্দু সিদ্ধার্থ-সুনন্দা’র অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে লিপ্ত হ’লো। “বছর দেড়েক আগে সিদ্ধার্থ আর সুনন্দা অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা ঘুরে এসে ভারত ভ্রমনে বেরিয়েছিল। প্রায় এক দেড় মাস ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে এসে সিদ্ধার্থ এক ইউনিক প্রস্তাব রেখেছিল আমার কাছে”।
অনিমেষ বিমলেন্দুর সব কথা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছে। হ্যাঁ বা না বলার মত কোন বিষয় এতক্ষন সে পাই নি। এবারে কিন্তু একটা জিজ্ঞাসার প্রসঙ্গ পেয়ে গেল। “কিসের প্রস্তাব, কাকু’?
“বাণপ্রস্থ” বিমলেন্দু বললো। আর কিছু বলার আগেই দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। “এক্সকিউজ মি”। বিমলেন্দু উঠে গেল দরজার দিকে। খুব নিচু স্বরে কারও সাথে তার কথাবার্তা হ’ল। ভেতরের দিকে সুতপার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “সুতপা, তুমি কি তৈরী”?
ভেতর ঘর থেকে উত্তর এল, “হ্যাঁ, পাঁচ মিনিট”।
অনিমেষের কৌতুহল নিবৃত্ত হ’ল না। তার মনে প্রশ্ন যাই থাক না কেন, এতক্ষনে সে একটা ব্যাপার বুঝে গেছিল যে তার মা ও বাবা যেখানেই থাকুন না কেন, তারা কোন বিপদের মধ্যে নেই। এবারে সে মনকে শক্ত রেখে ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করল। কারন এখন তার বুঝতে কোন অসুবিধা নেই যে বিমলেন্দু কোথাও যাবার যোগার করছেন।

আধঘন্টার মধ্যে তারা সবাই বেরিয়ে পড়ল। বিমলেন্দু স্কর্পিও ডাকিয়ে নিয়েছে যাতে করে ফেরার সময় আরও দু’জন লোক নিয়ে আসতে কোন অসুবিধা না হয়। বের হতে হতে এগারটা বেজে গেল। যাওয়ার পথে চারটে প্যাকেট লান্চ টেক এওয়ে কাউন্টার থেকে নেয়া হল। শহর থেকে বেরিয়ে গেলে ভাল রেষ্টুরেন্ট আর পাওয়া যাবে না।
বিমলেন্দু সিদ্ধার্থর “বাণপ্রস্থ” গ্রহনের কথা শুরু করল। “ভারত ভ্রমন থেকে ফেরার পর সিদ্ধার্থর প্রধান কাজ ছিল বাণপ্রস্থ আশ্রমের খোঁজ করা। সারাদিন নেট সার্ফিং আর সেগুলওর ডিটেল্স ট্যাবুলেট করা। আমাকে অনেকগুলো ওল্ড এজ হোম, ও এসিস্টেড লিভিং রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স এর খবর যোগার করে দেখিয়েছিল। সে এসে বলত, ‘আজ লাইফ এ্যট সিক্সটি’ দেখলাম, আজ দেখলাম ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’, আবার কোনদিন বলত ‘লিভ উইথ ডিগনিটি’।আমি জিজ্ঞেস করতাম, “তুই যে এসব খুঁজছিস, অনিমেষ বা অখিলেশ জানে”? সে বলত “মাথা খারাপ, ওরা জানলে কখনই সম্মতি দেবে না”।
-“কিন্তু একদিন না একদিন জানতে তো পারবেই। তখন”?
-“সে বহু দেরিতে জানবে। ওরা যখন দেশে আসবে, আমরা ফ্ল্যাটে চলে আসব। জানবে কি করে”?

ছ’মাস আগে সিদ্ধার্থ একটা Brochure নিয়ে এসে বলল, “This is final.” সে খুব এক্সাইটেড ছিল। সুনন্দার অতটা উচ্ছাস দেখি নি। তবে আমি জিজ্ঞেস করেছি তার মতামত কী। সে দুঃখের সাথে উত্তর দিয়েছিল, ‘বিমলদা, এর চেয়ে আর ভাল ব্যাবস্থা কী হতে পারে? এটা সবার জন্য উইন-উইন প্রপোজিসন’। একটু থেমে আবার বলেছিল. ‘এই দেখ না, ঠিকমত চলতে পারি না, হাঁটুতে ব্যাথা, কোমরে ব্যথা, কাজের লোক চাই, রান্নার লোক চাই, তাও তাদের মর্জির উপর নির্ভর করতে হয়। ইচ্ছে হল তো এল, ইচ্ছে হল তো এল না। আজ এই ডাক্তার, তো কাল ঐ ডাক্তার। কে নিয়ে যাবে বল? যতদিন আপনার বন্ধু সুস্থ আছে, চলছে। তার যদি কিছু হয় আমি কি পারব সব সামলাতে? তার চেয়ে এই ভাল নয় কি? টাকা দিয়ে দাও, নিশ্চিন্ত। সব কিছু তারাই করবে’। ‘এটাই আমাদের বিধির বিধান – our destny’ বিমলদা”। সুনন্দার গলা ধরে এসেছিল। সমস্ত ব্যাপারটায় একটা প্রচ্ছন্ন বেদনা যে বিদ্যমান সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
“সত্যি কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই। এই অসহায় অবস্থার অনুভূতি আমারও আছে এবং আমিও যে একদিন সিদ্ধার্থর পদাঙ্ক অনুসরন করব তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি”। বিমলেন্দু তার নিজের মন্তব্য প্রকাশ করল। পাছে তার মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এক প্রজন্ম আর এক প্রজন্মের উন্নাসিকতাকে কী চোখে দেখছে সেটা অনিমেষের সামনে প্রকট হয়ে উঠে এবং অনিমেষকে বিব্রত করে, বিমলেন্দু না থেমে বলতেই থাকল।

“সিদ্ধার্থর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার আগে আমিও ওর সাথে ‘Life at Sixty’ নামক বানপ্রস্থ আশ্রম দেখতে গেছিলাম। সুনন্দা ও সুতপাও ছিল সেই ওয়াক থ্রু পরিদর্শনে। আমাদের সবারই ভাল লেগেছিল এই প্রোফেশনাল ব্যবস্থাপনায়। We were impressed at First Sight. তবু ‘হ্যাঁ’ বলার আগে সিদ্ধার্থকে আবারও বিবেচনা করে দেখতে বলেছিলাম। উত্তরে সে বলেছিল, “অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর ভাবলে কোন সিদ্ধান্ত নিতেই পারব না। আর তাছাড়া, যদি সেখানে আমরা মানিয়ে নিতে না পারি, ফিরে আসার সব পথই তো খোলা থাকছে”।
-“তা ঠিক”। তারপরেই আমরা সেখানে গেছিলাম। শহর থেকে দু আড়াই ঘন্টার পথ। একেবারে গ্রাম্য পরিবেশে, পাঁচ-ছ একর জমি নিয়ে এই আশ্রম। ওরা একে আশ্রম বলে না। বলে এসিস্টেড লিভিং রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স।

গাড়ী চলছিল। রাস্তার দু ধারে ধানের ক্ষেত। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা এবং সেই রাস্তায় ধান শুকোচ্ছে। ছাগল, গরু, হাঁস, মুরগী, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে সবাই রাস্তাটা তাদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে। তাদের বাঁচিয়ে গাড়ী বেশী স্পীডে চলতে পারছিল না। বেলা প্রায় একটা। একটা ভাল জায়গা দেখে গাড়ী দাড় করিয়ে তারা লান্চ সেরে নিল। গাড়ী ছুটতে শুরু করলে বিমলেন্দু তার যা বলার সেটা শেষ করার জন্য আবার বলতে লাগল। সুতপা কিন্তু কোন কথাই বলে নি। অনিমেষও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষন ছেলে। সে ব্যপারটার অনেকটাই বুঝে গেছে। তবূ শুনছে আর ভাবছে তার বাবা-মা জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নিলেন। যারা কি না কোন কিছুই তাদের না জানিয়ে করেন না। বিশেষ করে রিটায়ারমেন্টের পরে। তাই আজ তার অজান্তে বাবা-মা’র এই সিদ্ধান্তে সে খুব বিচলিত। বিমলেন্দু বলে চলেছে, “ওদের এই এসিস্টেড লিভিং রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স-এ সব ব্যবস্থাই আছে এবং সেগুলো প্রফেশনালী ম্যানেজড। একটি দুই শয্যা বিশিষ্ট শোবার ঘর, একটি হলঘর বা লিভিং রুম, একটি কিচেনেট কাম প্যান্ট্রি, টয়লেট ও ব্যলকনি নিয়ে এক একটি ইউনিট।আধুনিক ভাষায় কন্ডোমনিয়াম। দুজন করে থাকার ব্যাবস্থা। হয় দম্পতি অথবা ব্যাচেলর / স্পিনস্টার। ঘর পরিস্কার করা, বিছানা ঝারা বা তৈরি করা, কাপড় চোপড় কাচা ধোওয়া এবং টুকি টাকি নিত্য নৈমিত্তিক সমস্ত কাজ তাদের লোকেরা করবে। এছাড়া যাদের শারিরীক কারণে সেবা ও সাহায্যের প্রয়োজন তাদের জন্য আয়া বা নার্সের ব্যাবস্থাও করা হবে। এমনিতে প্রতিদিন এলোপ্যাথি, হমিওপ্যাথি ডাক্তারের বসার ব্যাবস্থাও আছে। সপ্তাহে একদিন করে বিভিন্ন স্পেসালিস্ট ডাক্তার আসবেন। এর পরেও যদি কারও অন্য ডাক্তার দেখানর প্রয়োজন হয়, সেখানেও নিয়ে যাবার গাড়ী ও লোকের ব্যাবস্থা আছে। 24X7 একটা এ্যম্বুলেন্স কমপ্লেক্সেই থাকে। অতিরিক্ত ইমারজেন্সিতে পার্শবর্তি হেল্থ সেন্টার বা হসপিটালের সাথেও একটা বন্দোবস্ত আছে। এছাড়া রইল Vallet Services ব্যাঙ্ক, বাজার, বাস, ট্রেন ধরা জাতিয় অনেক প্রয়োজনই মানুষের থাকে। সেগুলোর জন্যও রিজনেবল ব্যাবস্থা করা হয়। মন্দির আছে যেখানে সকাল সন্ধে্য লোকে আধ্মাত্বিক সঙ্গ ও সাধনায় নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে পারে। টি ভি রুম, রিক্রিয়েশন রুম, যোগাসন ও ধ্যান কক্ষ এবং লাইব্রেরী সবই আছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় যেটা, স্বাস্থসম্মত পুষ্টিকর খাবার ব্যাবস্থা। ডায়েটিশিয়ানের তদারকিতে দিনে চার বারের যথাযত ব্যাবস্থা থাকবে। সকালে ব্রেকফার্স্ট, দুপুরে লান্চ, বিকেলে স্ন্যাক্স, ও রাত্রে ডিনার – এগুলো সবার জন্য কমন কিচেনে রান্না হবে এবং সবাই ডাইনিং হলে খাবার খাবে। মোটের উপর জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যাবস্থা সেখানে আছে। সুস্থ ও সক্ষম আবাসিকরা নিজের কেয়ার নিজে নেবে আর অন্যরা সব কিছুতেই এ্যাসিস্ট্যান্স পাবেন। তার জন্য অবশ্য তাদের কিছু অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। তাতে কারও কোন আপত্তিও নেই। কারন বাইরে থেকে এই সার্ভিস টাকা খরচ করে পাওয়া গেলেও কোয়ালিটি থাকে না এবং বয়স্ক লোকেদের জন্য নিরাপদ নয়। অথর্ব লোকেরা অসহায় হয়েই জীবন কাটায় তাদের দয়ায়। ন্যুনতম সম্মানটুকুও তারা সবসময়পায় না”। বিমলেন্দু একটু থামল।
“আমরা রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করি, বুঝতে পারি আমাদেরকে অনেকে সমাজের তথা দেশের বোঝা ভাবে, নানারকম মন্তব্য করে, অথচ এটা ভাবে না যে তাদের বাড়ীতেও বয়স্ক মা-বাবা, দাদু-ঠাকমা আছে এবং রাস্তায় চলেন, বাসে ট্রেনে যাতায়াত করেন। সেদিক থেকে এটা মুক্ত। এইখানে সবাই বয়স্ক, একই পথের যাত্রি। এখানে এক জনের চেহারা দেখে আর একজন হাসবে না। এখানে স্ট্যাটাস সচেতনতার কোন অবকাশ নেই। এখানে কোন কিছুতেই কোনরকম বিভিন্নতা নেই। এখানে “আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজ্যে”।

আড়াইটা নাগাদ গাড়ী পৌঁছাল লাইফ এ্যাট সিক্সটির গেটে। গেটের রেজিস্টারে এন্ট্রি করে তাদের গাড়ী লাল মোরাম বিছান রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল। সামনেই সার্কুলার আইল্যান্ড। সবুজ ঘাসে ঢাকা ল্যান্ড স্কেপিং। মাঝে ছোট ফোয়ারা। তার চার পাশে ফ্লাওয়ার বেড। নানা রংএর সিজন ফ্লাওয়ার আইল্যান্ড-এর শোভা বর্দ্ধন করেছে। সেটা পেরিয়ে সোজা রাস্তা গিয়ে থেমেছে একটা চার তলা বিল্ডিং এর সামনে। রাস্তার দু পাশে সুন্দর ও সমানভাবে ছাঁটা সবুজ হেজ। হেজের পর টাইলস বসান ওয়াক ওয়ে। মর্নিং ইভিনিং ওয়াকারদের জন্য। ওয়াক ওয়ের পরে আছে বসার জন্য সিমেন্ট বাধান বেন্চ। তার পেছনে রয়েছে সবুজ শাক-সব্জির বাগান। অদ্ভূত সুন্দর পরিবেশ।

অনিমেষ এই সৌন্দর্য দেখছিল বটে, কিন্তু তার মন ছিল অন্যখানে। সে ভাবছিল এতবড় একটা সিদ্ধান্ত বাবা-মা আমাকে না জানিয়ে কেন নিলেন। আমরা সত্যি কি সত্যি পাষন্ড? তাহলে আমরা ক্ষমার অযোগ্য। ‘যাদের স্বার্থত্যাগের জন্য আমরা আজ কর্মজগতে ও সমাজে উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছি, যারা অতন্দ্র প্রহরীর মত পাহারা দিয়ে সমাজের অশুভ শক্তি থেকে বাঁচিয়ে দু হাতে আগলে আমাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন, যাদের কৃচ্ছ্রসাধন আমাদের পাথেয় জুগিয়েছে, সেই বাবা-মাকে আমরা কাছে রাখতে পারলাম না। জন্মের পর পঁচিশ বছর যারা বুক পেতে আগলে আমাদের জীবনকে যুগোপযোগি পথে এগিয়ে দিলেন, আর আমরা এত অধম যে বাবা-মা’র জীবনের শেষ খেয়ার পাঁচ-দশ বছরের দায়িত্ব নিতে পারি না’? কী লাভ এত বিদ্যার, এত ডিগ্রীর, এত বড় বড় পদমর্যাদার’? অনিমেষ এক বুক গ্লানি নিয়ে যখন নিজের অন্তরাত্মার সাথে যুঝছে সেই সময় তাদের গাড়ীটা এসে দাড়াল চারতলা বিল্ডিংএর পোর্টিকোয়।

সিদ্ধার্থ বার কয়েক ঘর আর লাউন্জ করে শেষটায় লাউন্জে বসে সবার জন্য প্রতিক্ষা করছিল। গাড়ীর আওয়াজ শুনে সে এগিয়ে এল। বিমলেন্দুর সাথে চোখে চোখে যেন কথা হ’ল। সিদ্ধার্থ অনিমেষের দিকে এগিয়ে “অনি” বলে বুকে জরিয়ে ধরলে অনিমেষ “বাবা” বলে কেঁদে ফেলল। “চল, ওপরে চল। বিমল, সুতপা এস”। লিফ্টে করে সবাই তিন তলায় উঠে ডানদিকে করিডোর সোজা হাটতে লাগল। কর্ণারের এ্যাপার্টমেন্টটা সিদ্ধার্থদের। দরজা খোলাই ছিল। বিছানায় পা ছড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে সুনন্দা বসে আছে। পায়ের গোড়ালিতে ক্রেপ ব্যন্ডেজ বাধা। ঘরে ঢুকেই অনিমেষ মা বলে মাকে জরিয়ে ধরল। মা’ও খোকা বলে কপালে চুমু খেল। “কেমন আছ খোকা”? মায়ের সব সময়ের প্রশ্ন আমার খোকা কেমন আছে। নাড়ী কেটে বিচ্ছিন্ম করা হয় সত্য. কিন্তু মা সেই বিচ্ছেদ কোনদিনও মেনে নিতে পারে না। সন্তানেরা সেই নাড়ীর টান ভূলে যেতে পারে, কিন্তু মা পারে না। কারণ মা ন’মাস ধরে নিজের জঠোরে যে ভাবে লালন পালন করে, যে জটিলতা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করে, তার খবর জানলেও প্রকৃত অনুভূতি সন্তানের থাকে না। তাই তারা ভূলে যেতেও পারে।
যতক্ষন মা আর ছেলের মানসিক ভাবাবেশ ও মান অভিমানের পরব চলছিল ততক্ষনে বিমলেন্দু আর সিদ্ধার্থ তাদের সৌহার্দ বিনিময় সেরে নিয়েছে। বিমলেন্দু জানিয়েও দিয়েছে যে অনিমেষকে অনেকটাই অবগত করা হয়েছে। সবাই ভাবের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল।
“মা, তোমার পায়ে ব্যান্ডেজ কেন”?-অনিমেষের প্রথম প্রশ্ন।
“বাথরুমে পা পিছলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম কিন্তু গোড়ালীতে যে লাগল, আর হাটতে পারছি না। ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেধে দিয়েছে বটে তবে বলেছে এক্স রে না করলে বোঝা যাবে না”।
-“তাহলে দেরী কেন”?
-“কাল সকাল বেলাতেই ঘটেছে। আসলে তাড়াহুড়ো করছিলাম বাড়ী যাব বলে। তোমার আসার আগে ঘরদোর পরিস্কার করব বলে। তখনই ঘটল এটা। দু দিন বরফ লাগিয়ে দেখতে বলেছে, যদি না কমে তাহলে এক্স রে করতে হবে”।
এবারে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, “বাবা, এতবড় একটা পদক্ষেপ নিলে, আমাকে জানালে না? আমরা তো মরে যাই নি। আমাদের মনে কতবড় আঘাৎ লাগতে পারে সেটা কি তোমরা এক বারও ভাব নি”?
সিদ্ধার্থ অপরাধির মত বলল, “তোমাদের জানালে কি তোমরা মত দিতে”?
“না, কখনই মত দিতাম না। কিন্তু তোমরা তো জান, তোমাদের নিয়ে যাবার জন্য আমি ইতিপূর্বেই এ্যাকশন নিয়েছি”।
“হ্যাঁ জানি, সেটা হোক তো আগে। ততদিনে এই ব্যবস্থাটাও দেখে নিই। তোমাদের ওখানে গিয়ে যদি থাকতে না পারি অথবা অন্য কোন অসুবিধার সম্মুখিন হতে হয়, তখন এ রকম সার্ভিস দেয় এমন সেট আপ পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম আমাদের দেশে”।
“ফোন কর নি। ফোন ধর নি, মানে লাগে নি, এ অবস্থায় আমাদের কী দশা হয় বল তো”?-অভিযোগের সুর ঝংকৃত হল অনিমেষের কথায়।
“আমরা সত্যি দুঃখিত সেই কারনে” সিদ্ধার্থ অনিমেষকে বোঝানোর চেষ্টা করল। “আসলে পরশু দিন সকালে আমরা ফ্ল্যাটে যাবার জন্য গাড়ী ডেকেছিলাম আর গাড়ী এসে যখন হর্ণ দিল, তোমার মা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাথরুমে পা মচকে চিৎকার করে উঠল, আমি সেই সময় মোবইলে ড্রাইভারকে কিছু বলতে বলতে বাথরুমে ছুটে গেলাম। সেই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়ে তোমার মাকে সামলাতে সামলাতে মোবাইলটা কমোডে পড়ে গেল। ব্যস, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে তোমার মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থায় লেগে পড়লাম। ডাক্তার এলেন, ব্যান্ডেজ করে দিলেন। হাটাচলা করতে বারন করলেন এক্স রে না করা পর্যন্ত। কী করতাম বল? এটাই তো আমাদের অসহায়ত্ব”।
-মা’র ফোনটা কি হল?-অনিমেষ জানতে চাইল।
“সেটা তো মাস খানেক আগে অটো রিক্সায়, না কোথায় ফেলে এলো। আর একটা নেওয়া এখনও হয়ে উঠে নি।
“বাঃ, সুন্দর গল্প। মা, এবার ওঠো, তৈরী হয়ে নাও। বাবা, কী কী নিতে হবে, নিয়ে নাও। ফ্ল্যাটে গিয়ে একজন অর্থোপেডিক সার্জেনকে দেখাতে হবে”। এবারে অনিমেষের কথায় আদেশের সুর।
“ঐ দেখ না, ওদিকে, ব্যাগ তো গোছানই আছে। আমরা যাবার জন্য কাল থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু ডাক্তার না ছাড়লে এখানকার নিয়ম অনুযায়ী আমাদের যাওয়া উচিত হবে না। এরাই তো আমাদের ভাল মন্দে’র দায়ীত্ব নিয়েছে, বাবা”। এবারে সুনন্দা বলল।
“তাহলে, এখন উপায়”? অনিমেষে জানতে চাইল।
“এখন তো মানা করবে না। তুমি এসেছ যে। বাড়ীর কেউ বা আত্মীয় স্বজন এসে অসুস্থদের নিয়ে গেলে এরা কোন আপত্তি করবে কেন”? সিদ্ধার্থ নিয়মের ব্যতিক্রমটা খুলে বলল।

এইভাবে নানা কথায় ঘন্টা দুই কেটে গেল। এর মধ্যে সিদ্ধার্থ তাদের কিচেনেটে কফি বানাল। বিস্কুট আর কফি খেয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। তার আগে অবশ্য অনিমেষেকে অফিসে গিয়ে ছোট্ট একটা ডিক্লেয়ারেশন দিতে হ’ল ‘মা’য়ের চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যাচ্ছি নিজ দায়ীত্বে’।

গাড়ীতে যেতে যেতে অনিমেষের বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে হল সিদ্ধার্থ ও সুনন্দাকে। তার কারন, অনিমেষে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ফোন করে। তারা কেমন আছে জানার জন্য। অর্থনৈতীক কোন সমস্যাও নেই। না বলতেই অনিমেষে বাবা মা’র নামে টাকা পাঠায়। তাদের প্রয়োজন আছে কি নেই দেখে না। অনিমেষে জানতে চাইল কেন তারা এই বাণপ্রস্থ আসার সিদ্ধান্ত নিল।
সিদ্ধার্থ বলল, “মাঝে আমার পার্কিনসন রোগটা এত বেড়েছিল যে কোন জিনিষ হাতে ধরে রাখতে পারতাম না। নিউরো সার্জেনকে দেখিয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করালাম। এখন অনেকটা ভাল আছি। তবে কতদিন ভাল থাকব কেউ বলতে পারে না। আমার বেশী কিছু হলে তোমার মা’র পক্ষে সামলান অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেউ কি চায় নিজের লোকেদের ছেড়ে থাকতে? এখানে যারা আছে তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। দাপটের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছে। আর এখন? বার্ধক্যের বোঝা বইতে পারছে না, তাই এখানে আশ্রয় নিয়েছে”।
“তারা কি সবাই খুশী”?
“মনের ভেতরে কার কী হচ্ছে বলতে পারব না। তবে ওপরে সবাই আনন্দেই আছে”।
“তোমাদের কেমন লাগছে”? সরাসরি প্রশ্ন অনিমেষের।
“আমরা তো মাত্র ছ’মাস হল এসেছি। এখনও খারাপ লাগার মত কিছু ঘটে নি। আফটার অল, এই ‘লাইফ এ্যট সিক্সটি’ গড়ে তুলেছে কিছু ফিলানথ্রপিস্ট ও একটি এন জি ও। সিনিয়র সিটিজেনদের শেষ খেয়াটা সুন্দর ভাবে এবং স্বাস্থকর পরিবেশে পার করে দেয়াই এর মিশন। নো লস নো প্রফিট বেসিসে এই সার্ভিস দেয়ার প্রকল্প। আর এদের ভিশন হল একটা ‘লাইফ এ্যাট সিক্সটি’ দেখে যেন আরও অনেক ‘লাইফ এ্যাট সিক্সটি’ বা অনুরূপ আবাসন গড়ে উঠে সেই ক্যম্পেন করা। সরকারকেও এই সারভিস দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছে। তা যাই হোক, বয়স্ক নাগরিকদের সুস্থ থাকার জন্য সব রকম ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। সবাইকে নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলার শপথ নিয়েই এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছে এবং তাদের জীবনের শেষ দিন অবধি সেবা দেবার দায়ীত্ব নিয়েছে এই সংস্থা। যদিও একেবারে অচল হয়েও যদি কেউ বেচে থাকে, তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য তার আপন জনদের বলা হয়। কিন্তু সেটা যে কোন কারনে সম্ভব না হ’লে এখানেই রাখা হয়। এখানেই পার করা হবে তার শেষ খেয়া”।
এখানার সার্ভিসের দীর্ঘ বিবরন দিয়ে সিদ্ধার্থ থামল। সবাই চুপ করে শুনছিল। কেউ কোন কথা বলেনি। হয়তো ভাবছিল সত্যি কি এমন সুন্দর সার্ভিস আমাদের দেশে পাওয়া যায়? আর পাওয়া গেলেও কতদিন কোয়ালিটি মেইনটেন করবে বলা খুব শক্ত।

ড্রাইভার খুব সাবধানে গাড়ী চালাচ্ছিল যাতে সুনন্দার মচকান পায়ে ঝটকা না লাগে। সুনন্দা মাঝের সিটে পা ছরিয়ে বসেছে। সুতপা তার পাশে তাকে সাপর্ট দিয়ে বসেছে। সামনের সিটে সিদ্ধার্থ-সুনন্দার দুটো বড় সাইজের ব্যগ রাখা হয়েছে। বিমলেন্দু, সিদ্ধার্থ ও অনিমেষ পেছনের সিটে বসেছে। সিদ্ধার্থ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, “অনি, আমি অন ট্রায়াল এখানে এসেছি। যে কোন সময় এখান থেকে চলে যাওয়া যেতে পারা যাবে। অবশ্য এখানে আসার ওয়েট লিস্টও বেশ বড়। আমরা একা পারছিলাম না সব কিছু ম্যানেজ করতে। টাকা খরচ করেও ভাল এবং বিশ্বস্ত লোক পাওয়া যায় না আজকাল। এখানে সে সবের কোন চিন্তা নেই”।
“বুঝলাম, বাবা। কিন্তু, আমরা তো তোমাদের নিয়ে যাওয়ার সব ব্যাবস্থাই করে ফেলেছি। গ্রীন কার্ড পেয়ে গেলেই নিয়ে যাব”। অনিমেষ জানাল। সিদ্ধার্থ ও সুতপা সেটা আগেই জানত। ওরা ওখানে গিয়ে কতদিন থাকতে পারবে সেটাই তারা জানে না। সেটা তাদের চিন্তা। স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। এবারে অনিমেষ মাকে প্রশ্ন করল, “মা, তুমি বল তোমার কী ইচ্ছা। তুমি আমার কাছে থাকতে চাও, না কি এই বৃদ্ধ আশ্রমেই থাকতে চাও”?
“আমি মেয়ে মানুষ। আমাদের ইচ্ছার কোন দাম আছে না কি? বিয়ের আগে বাবা দাদার ইচ্ছায় চলেছি, বিয়ের পর স্বামী পুত্র যেমন চাইবে তেমন চলব”। সুনন্দার কথায় নারীত্বের ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ পেল।
“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না, মা। বাবা যে জীবন যাপনের বিবরন দিলেন, তা তোমার কেমন লাগে”? অনিমেষ মাকে আবার প্রশ্ন করল। ও জানতে চায় বাবা-মা কতটা সুখ পাচ্ছেন এখানে।
“দেখ বাবা, সব মা-বাবা চায় সন্তানের কোলে মাথা রেখে বৈতরনী পার হতে, কিন্তু ক’জনের ভাগ্যে তা জোটে”? সুনন্দা সংসারের সত্যটি অনিমেষের সামনে তুলে ধরল। আরও বলল, “তোমার বাবা তো এই ব্যবস্থাটা অন ট্রায়াল নিয়েছে। আমরা এখনও পুরোপুরি এদের সব সার্ভিসের কোয়ালিটি চেক করার সুযোগ পাই নি। যখন তোমার ব্যবস্থা রেডি হয়ে যাবে, তখন সবাই মিলে ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আপাতত আমাদের এটা প্রয়োজন ছিল”। সুনন্দার কথায় কোন ছলনা বা প্যাঁচ ছিল না।

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ওদের গাড়ী শহরে ঢুকে গেল। এতক্ষনে বিমলেন্দুর গলার আওয়াজ শোনা গেল। ড্রাইভারকে বলল, “যে রেস্টুরেন্ট থেকে সকালে লান্চ প্যাকেট নেয়া হয়েছিল সেখানে গাড়ী থামাবে”। সুতপা সুনন্দাকে বলল, “রাতটা আমাদের ফ্ল্যটেই থাকো। তোমাদের ফ্ল্যট তো ধূলোয় ভর্তি থাকবে। প্রায় দেড় দুমাস তো আসনি। ঝারাঝারিও হয়নি”

তাই হল। প্যকেট ডিনার, বিরিয়ানী আর কসা মাংস দিয়ে হল। রাতটা সবাই বিমলেন্দুর ফ্ল্যাটে কাটাবে। সবাই খুব ক্লান্ত ছিল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।

তারপরের ঘটনাক্রম খুব সংক্ষিপ্ত, এবং ব্যস্ততার মধ্যে সম্পন্ন হল। অনিমেষের সাতদিন ছুটি মা-বাবার কাজে কাজে কেটে গেল। মা’কে ভাল ডাক্তার দেখান হয়েছে। এক্স রে তে কোন ফ্র্যকচার পাওয়া যায় নি। লিগামেন্ট ছিঁড়েছে। সেটা ক্রেপ ব্যন্ডেজ বেধে এবং যতটা সম্ভব রেস্ট নিয়ে সারাতে হবে। অনিমেষ মা ও বাবার জন্য দুটো স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছে। বাবার সাথে গিয়ে ব্যঙ্ক ও পোস্ট অফিসের কাজগুলো সেরেছে। বাজার করেছে। আর বাকী সময় ঘরে মাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করেছে। এসবে ও একেবারে সিদ্ধহস্ত, কারন আমেরিকায় স্ত্রী-পুরুষের কাজের ভেদাভেদ নেই। সবাইকে সব কাজ করতে হয়।

দিন হুর হুর করে কাটছিল। এর মাঝে কয়েক জন বন্ধু বান্ধবীরা এসেছে অনিমেষের সাথে দেখা করতে। একদিন বিমলেন্দু-সুতপাও এসে সারা দিন ছিল। খুব হৈ চৈ করে কাটল। এবারে অনিমেষের যাবার সময় হয়ে এল। এখান থেকে ও যাবে সিঙ্গাপুর। সেখানে একটা সেমিনার এ্যটেন্ড করবে। সেখান থেকে যাবে সিডনি। সেখানেও বিজনেস মিটিং আছে। উঠবে অখিলেশের কাছে। সেখান থেকে যাবে নিউ ইয়র্ক। সিদ্ধার্থ বৌমার জন্য শাড়ী ও নাতির জন্য জিনসের প্যান্ট, টি সার্ট, ও একটা বাইনাকুলার কিনে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ তারা দেখত আর হাজার প্রশ্ন করত সে দাদুকে। তাই দাদু বলেছিল “এর পরে যখন আসব, তোমার জন্য বাইনাকুলার নিয়ে আসব”।
ছ’বছরের দাদুভাই গলা জরিয়ে ধরে বলেছিল, “দাদু, প্রমিস”?
দাদু বলেছিল, “প্রমিস”।

আবার কবে যাব, যেতে পারব কি পারব না, কেউ বলতে পারে না। তাই অনিমেষ যখন এসেছে দাদুর প্রমিসটা রক্ষা পেয়ে যাক। এইসব ভেবেই সিদ্ধার্থ এসব কিনে নিয়ে এল। অনিমেষের যাবার দিন এসে গেল। সিদ্ধার্থ সুনন্দা এয়ারপোর্টে সী-অফ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে অনিমেষে তাদেরকে বেশ বকে দিল। বলল, “তোমাদের ব্যগ গুছিয়ে নাও। দুপুরে গাড়ীর জন্য বলে দিচ্ছি। তোমাদেরকে আশ্রমে ছেড়ে আমি এয়ারপোর্টে চলে যাব। আমার ফ্লাইট রাত দশটায়”।
ছেলে বড় হয়ে গেলে তার অধিকার জন্মায় বাবা-মা’কে সশ্রদ্ধ শাসন করার, পরামর্শ দেবার, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবার। তাই হল। সুনন্দা’র পা অনেটা ভাল। তারা সবাই সকাল সকাল রেডি হয়ে নিল। সুতপা দুপুরে ওদের খেতে বলেছে। সেখানে ঝটপট খাওয়া সেরে অনিমেষ বাবা-মা’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সারা দিনের জন্য গাড়ী ডেকে নিয়েছে। সেই গাড়ীতেই অনিমেষ ফিরবে এবং সোজা এয়ারপোর্টে যাবে।

অনিমেষ আমেরিকায় ফিরে গেছে। সিঙ্গাপুর সিডনি ও নিউ ইয়র্ক থেকে বার বার ফোন করে বাবা-মা’র খবর নিয়েছে। সিদ্ধার্থ’রা আরও তৎপড়তার সাথে আশ্রমের প্রতি নিজেদেরকে সমর্পিত করেছে। তার কারন, ওদের মনে যে সংশয় ও দ্বিধা ছিল ছেলেদের নিয়ে, সেটা তো দূর হয়ে গেছে। এর জন্য অবশ্য বিমলেন্দু অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল। তাছাড়া ভগবানের হাত তো ছিলই সংকট মোচনে। না হলে সুনন্দার পা মচকাবে কেন? যদি এই অঘটন না ঘটত, তাহলে এই ব্যবস্থা ছেলেদের কাছে গোপনই থাকত আর সিদ্ধার্থ’রা এই বুঝি ওরা জেনে যাবে সংশয় নিয়ে দিন কাটাত। সেই জন্য কথায় বলে, “ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্য”।

তিন মাস কেটে গেছে অনিমেষ যাবার পর। বিকেল বেলা টি স্ন্যক্স খেয়ে ওয়াক ওয়ের ধারে একটা বেন্চে বসেছিল সিদ্ধার্থ ও সুনন্দা। ওরা ঐ সময়টায় রোজ ওখানে বসে। পুরণো স্মৃতি রোমন্থন করে। তারা পুরনো দিনের কথা, ছোট ছোট আনন্দ মুহুর্তের স্মৃতি, নানা স্মৃতিবিজরিত মিলন অনুষ্ঠানের কথা ভাবে আর দুজনে পরস্পরকে মনে করিয়ে দেয়। এইভাবে তাদের দিনগুলি হাসি-কান্নায় কেটে যাচ্ছিল। তাতে আনন্দ যেমন আছে, দুঃখও তেমনি আছে। সেটা তারা জানে। আবাসনের সবার সাথে তাদের আলাপ ও ঘনিস্টতা হয়ে গেছে। এই বাণপ্রস্থ আশ্রম তাদের ভালই লাগছে। সবাই সবার সাথে পূর্ণ সহযোগীতা ও সহমর্মিতার সাথে মেলামেশা করে। সবাই একই পথের যাত্রী। কার খেয়ার মাঝি কখন আসে তার জন্য আনন্দ আসরে প্রতীক্ষা। সংসারের মায়ার টান ক্রমেই কমে আসছে।

আবাসনের সবাই জানে ঐ দম্পতি বিকেলে ওখানেই থাকে। রিসেপ্সনের দিক থেকে একটি ছেলে ওদের দিকেই আসছে। তার হাতে একটি বড় এনভেলপ। “এটা আপনাদের” বলে ছেলেটি এনভেলপটি সিদ্ধার্থ’র হাতে দিল। সেটা নিতে গিয়ে সিদ্ধার্থ’র হাতটা কেঁপে উঠল অজানা আশংকায়। আমেরিকা থেকে ডি এইচ এল কোরিয়ার সার্ভিস মারফৎ অনিমেষ পাঠিয়েছে। সিদ্ধার্থ ও সুনন্দা একে অপরের দিকে চেয়ে কিছু বোঝবার চেষ্টা করল। “খুলেই দেখ না, কী আছে”। সুনন্দা শান্ত কন্ঠে সিদ্ধার্থকে বলল। সিদ্ধার্থ জানে কী আছে। তবু কিছু না বলে এনভেলপটি খুলে ফেলল। তাতে দুটো জেরক্স করা প্রিন্টেড ডকুমেন্ট যেটা আমেরিকার সিটিজেনশিপ পাওয়ার আগের ধাপ – গ্রীন কার্ড। যেটা পাওয়ার পাঁচ বছর পর আমেরিকার পার্মানেন্ট সিটিজেনশিপ পাওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্য একটা শর্ত হ’চ্ছে এই পাঁচ বছরের মধ্যে ন্যূনতম আড়াই বছর তাদেরকে আমেরিকায় বসবাস করতে হবে। সেটা এক নাগারে না হয়ে একাধিক বার হলেও চলবে। সঙ্গে অনিমেষের হাতে লেখা চিঠিও আছে। চিঠিটা খুলে সিদ্ধার্থ পড়তে লাগল।
“শ্রীচরণেষু,
মা ও বাবা! গ্রীন কার্ডের কপি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে আমরা তোমাদের ব্যাপারে উদাসীন নই। তোমাদের জন্য আমাদের অনেক চিন্তা হয়। লাইফ স্টাইলের পার্থক্য থাকার কারনে তোমরা এখনে এসে খানিকটা অসুবিধা অনুভব কর। থাকতে থাকতে অভ্যেস হ’য়ে গেলে আর খারাপ লাগবে না, আশা করি। তোমরা আসবার দিন ঠিক করলে আমি তোমাদের আনবার ব্যাবস্থা করব। অপরাধ করে থাকলে ক্ষমা করিও। তোমরা আমার প্রণাম নিও।
তোমাদের অনি”।

এর আগে ফোনে অনিমেষ এই কথাগুলোই বলেছে। সিদ্ধার্থ ও সুনন্দা গ্রীন কার্ডের কপি দুটো আর অনিমেষের চিঠিটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। তাদের অজ্ঞাতসারে দুজনের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুধারা। এই অশ্রুধারা গড়ানোর পেছনে কী লুকিয়ে আছে- আনন্দ না বেদনা, সে কথা একমাত্র তারাই বলতে পারে। একদিকে তাদের জন্য নিজের সন্তানের আন্তরিক আকুলতা দেখে আনন্দ, অন্যদিকে নিজের দেশ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজন, আশ্রমের আপন সতীর্থজন এবং সর্ব্বোপরি নিজেদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছেড়ে দূর দেশে যাওয়ার বেদনা। বিশাল মানসিক দ্বন্দ – Emotional Conflict তাদের মনের আকাশে কালো মেঘের মত নেমে এলো।

সূরয দিগন্তের কোলে ঢলে পড়েছে। তার সিঁদুরে কিরণ ছটায় রাঙা আকাশ ঝলমলে হয়ে উঠেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখীরা তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনন্দ কলোরবে মত্ত হয়ে ফিরছে। দূরে মেঠোপথে গোচারণ সেরে রাখালেরা তাদের গৃহপালিতদের নিয়ে ঘরে ফিরছে। তাদের মধ্যে কেউ বাঁশীতে মেঠো সুরও তুলেছে। পশুদের মধ্যেও ঘরে ফেরার উন্মাদনা বোঝা যায়। সারা দিনের কাজ সেরে সবাই নিজ নিজ ঘরে ফিরছে। সবার মনে যে মিলনের উচ্ছাস জাগে সেটা তাদের কথা, তাদের হাসি, তাদের স্ফুর্তি দেখলে বা শুনলেই বোঝা যায়। সিদ্ধার্থ ও সুনন্দা উঠে দাঁড়াল। সিদ্ধার্থ সুনন্দা’র হাতটা ধরে বললো, “চলো ঘরে যাই”।
যেতে যেতে দূর থেকে ভেসে আসা ভাটিয়ালী গানের কলি শুনতে পেল,
“আপন-পর জানলাম না রে, জীবন ভর এই সংসারে।
খেয়ার মাঝি কোথায় গেলে, পার করে দাও এই অভাগারে”।

_____________________________
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৫২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/১১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast