www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ধোঁয়াশা

ধোঁয়াশা এমন একটি ছেলের গল্প যে নিজেকে সকল লোভ লালসার একধাপ উর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে নিজের লড়াইকে সেচ্ছায় আমন্ত্রণ দিয়েছে্। যাকে কোন কষ্ট কোন আঘাত কোন বাঁধায় থামিয়ে রাখতে পারেনি। যে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও একটু ভালো বন্ধুত্বের পূজারী হতে গিয়ে অনেকের চোখে আজ খারাপ। কিন্তু ঐযে বিধাতার অদৃশ্য শক্তি তার পরিহাস করার ক্ষমতা আছে কার। জীবনের সব গল্পকে নেহায়েতই গল্প মনে করে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে ধোঁয়াশা আজ বাস্তর গল্পের স্বচিত্র প্রমাণ।



পর্ব -১

অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে এইদানিং কালে খুব কষ্ট দিচ্ছে। নিজেকে কখনো কখনো মানসিক প্রতিবন্ধী মনে হচ্ছে। অনেক অসহায়ত্ব আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমিও তো সমাজের বাকী দশজনের মতো একজন। আমারও ইচ্ছেগুলো স্বপ্নগুলো অন্যদের মতো নষ্ট হয়। তবুও কেন সবার কাছে নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছে।

অনেক সুখ, অনেক টাকা, অনেক সম্মান কোনটা চাইতে গিয়ে আজ আমার এমন পরিণতি। জীবনটাকে কষ্টের মাধ্যমে উপভোগ করতে গিয়ে হয়তো আজ আমি এত সুখী। লোভ লালসা কার না জন্মলগ্ন থেকে নিজের সাথে একটু একটু করে বেড়ে ওঠেনা। কিন্তু নিজেকে লোভী লালসে প্রমাণ করতেই হবে তাতো আর নয়।

অনেক পথ পেরোনোর পরেও আরো পথ পেরোনোর একমাত্র উপায় ছিল স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্বকে আবিষ্কার করা। হাজারো বাঁধাকে অতিক্রম করাই ছিল একমাত্র মাধ্যম। একটা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেকে রোজ এনার্জিটিক করে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোটাই ছিল আমার একমাত্র কাজ। "যা কালকে করবো, তা আজকে করবো, আর যা আজকে করবো তা এখনই করে শেষ করতে হবে" -এই মূলমন্ত্রই ছিল আমার একমাত্র স্বান্তনা।

আজকে আমি যা তার জন্য অন্যকেউ দায়ী নয়। পারলাম না তো টাকার পিছনে নিজেকে এলিয়ে দিতে। অনেক অপশন থেকেও আমি এমন। নিয়তিকে দোষ দেওয়ার মত ক্ষমতাও আমার জন্মায়নি। সবমিলিয়ে বিভীষিকাময় জীবন নিয়ে টেনেহিঁচড়ে একটু একটু করে নিজেকে শেষ করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। কিন্তু আমি তো আমি। এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নয়। ভাল সময়তো সবাই অতিবাহিত করতে পারে কিন্তু খারাপ সময়গুলোকে সামলে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই আসল মানুষের পরিচয়।

সে যাই হোক, কথা বলতে থাকলে অযথা কথা বাড়তেই থাকবে। ঘোর কাটার চেয়ে আরো বেশি গভীরে হারিয়ে যেতে মন চাইবে। তখন কথার ভীড়ে নিজেকে আবিষ্কার করা অসাধ্য হয়ে পড়বে। শেষে নিয়তি নিয়তি করে কেঁদে লাভ কি? যদি সময় থাকতে সাধন করা না হয়। রোজগেরে জীবনে পুরনো ভাবুকরাই এখন অচল প্রায়, সেখানে আমি এক অচল যুক্ত হয়ে অচল সমাজের কলঙ্ক বাড়াতে চাইনা।

সকাল থেকে রাত, জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবিনি কখনো। তার পড়েও কখন যে নিজের অগোচরে এগত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। অনেক কিছু ভাবনার তালিকায় ছিল আবার অনেক কিছু বাদ পড়েছে সেচ্চায়। এখনো এলোমেলো সময় কাটছে আমার। এখনো বেপরোয়া স্বপ্ন দেখা। ক্লান্তিহীন নির্ঘুম পথ এখনো রাত বিলেতে হারিয়ে যাচ্ছে চেনা পথগুলোর ভীড়ে। বেলা শেষে অভিশপ্ত মনে হয়।

শুরুটা ভাল হয়নি বলে যে শেষটাও খারাপ কাটবে এমন কথার ভিত্তি নেই। চেষ্টা ছিল আছে চলবে এতে কোন সন্দেহ নেই। পুরনো মানুষগুলো যে নতুনদের সমারোহে হারিয়ে যাবে এটাও নিশ্চিত। কারণ জীবনের যাত্রা পথে কেউ বেশিদিন সাথী হতে পারে না। স্বার্থপরতাই জীবন অথবা জীবনের আরেকটা নাম স্বার্থপরতা।

এখন উপায় দুইটা- "হয় শুরু থেকে শুরু করতে হবে না হয় শেষ থেকে শুরু করতে হবে"। কে কার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে? যেহেতু সাধারণ মানুষ গুলোর মধ্যে আমিও একজন, তাই আমাকেও জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতো নিজের মত করে। কে কি বলল তা ভাববার মত সরল শক্তি নিজের অগোচরেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। এতে আর নতুন কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা আমার। তবে গল্পের শেষটা এখানে নয়। তার চেয়ে বড় সত্য, এখন আমি আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শুরুটা তাই নতুন করে করার বিকল্প খুঁজতে পারলামনা। পরিণতি যাই হোক, নিজের চেয়ে অন্যের ভালোটা আমাকে বুঝে নিতে হবে এটাই সংকল্প।



পর্ব -২

বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুরু থেকে শুরু করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে দেখে দুচোখের জল ধরে রাখতে পারছে না পরিবারের অন্য সকলে। বার বার তার সুনামে পঞ্চমুখ হয়েও কোন একটা সঠিক পথ উপহার দিতে পারেনি কেউ। ভাগ্যের পরিহাসে জর্জরিত কঙ্কালসার মাঝামাঝি উচ্চতায় রোগা মতন দেখতে অভিষেককে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষাও নেই আমার। আমি সবসময় তার সাথে থেকেও তাকে তার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারছিনা। সত্যি বলতে এখন আমি আমাকেও ঘৃণা করি। লজ্জা লাগে নিজেকে তার সহচর বলতে।

তারপরেও ভোরের ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো চুলের আড়ালে শুকনো মুখটা দেখতে ভালোই লাগে তার। আর দশটা ঘুম জাগা মানুষের মত ঘুম থেকে উঠে সেও নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যের সেবায়। দিন গড়িয়ে যায়, বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে, সমস্ত আলো নিভিয়ে আসে অন্ধকার রাত্রি। এভাবে কঙ্কালসার শরীরটাও ক্লান্তিতে অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে ঢলে পড়ে নরম বিছানার কোলে। এটাই একমাত্র জীবন তার আর সাথে আমারও। কারণ একটাই, অভি ছাড়া আমি যে অস্তিত্বহীন ছায়া।

ক্যারিয়ারমুখি লোকগুলোকে আর যাই হোক কোন কষ্ট, কোন আঘাত, কোন বাঁধা দিয়ে থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তার হাজারো বাস্তব প্রমাণের মধ্যে অভি একজন। রোজগেরে নয়টা পাঁচটাও অভিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। আর তাই হয়তো নিজেকে ফ্রিল্যান্সার অভি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এতো লড়াই করতে হচ্ছে তাকে। তবে কোনো দিক থেকে খারাপ নেই সে এটাই শান্তির বাণী।

একটা সাধারণ মানুষের জীবনে প্রাপ্তি তখনই আসে যখন সে নিজের চেয়ে বেশি অন্য দশজনের মনে বিরাজমান হয়। সহজ বাংলায় যাকে বলে পরিচিতি লাভ করা। লাখো মানুষের ভীড়ে পরিচিত নাম অভি না হলেও কিন্তু শত মানুষের মুখে এই নামটার যথার্থ চর্চা রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারো মুখে অভি দাদা আবার কারো মুখে অভি ভাই আবার কেউ বলে অভি স্যার। নামের আগে সম্বোধন যায় হোকনা কেন মানুষটার ভূমিকা কিন্তু একই আছে।

অনেকগুলো দোষের মধ্যে কিছু দোষ অভির মোক্ষম। যা তাকে কিছু কিছু মানুষের হৃদয়ে এত বিরক্তিকর বা সুপারস্টার বানিয়েছে। দোষ নাম্বার এক- ছোট থেকে মিথ্যা না বলা। দোষ নাম্বার দুই- অন্য কেউ মিথ্যা বললে সহ্য না করা। দোষ নাম্বার তিন- মিথ্যা অপবাদ মেনে না নেওয়া। দোষ নাম্বার চার- দিয়ে ফেলা প্রতিশ্রুতিকে জীবন দিয়ে হলেও পূরণ করা। কি দোষ হতো মিথ্যে বললে? কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে? এতটা ভাল সাজতে গিয়ে যে কষ্টগুলো মাথা পেতে নিতে হচ্ছে তার শেষ কোথায়? তবুও কে শোনে কার কথা। আসলে এতটা দোষ এতটা অহংকার একটা মানুষের থাকা উচিত অন্তত আমি মনে করি। সে যাই হোক, বিশ্বাস করার মত হাজারো গুণ অভির মধ্যে ছিল আছে থাকবে এটাই চিরন্তন।

বন্ধু মহলে অভির আনাগোনা তেমন একটা ছিলনা সেই স্কুল জীবন থেকে। মেয়েদের জন্যেও তেমন একটা যে বিশেষ সময় নষ্ট করেছে তাও কিন্তু নয়। তাহলে কিভাবে কাটতো একাকীত্বময় দিনের বেশিরভাগটা? শুনতেই মনে হবে এই মহাবিশ্বের একমাত্র ফ্যাকাশে মানুষ অভি। কিন্তু অভি এমন একটা নাম যাকে সাধারণ মানুষের সাধারণ চিন্তায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যার সাথে এতটা কাল থেকেও বুঝতে পারলাম না সে কি চায়, কি চায় তার সত্তা।

বাবা মার ঘরে ভাই বোনের মধ্যে অভি বড়। বোনটাও এখন আর ছোট নেই। বাবাও এখন অবসর জীবনের স্বাদ গ্রহণে ব্যস্ত। সবমিলিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পরিবার। এইদিকে আবার অভির বিবাহিত জীবনেরও চার বছর অতিবাহিত হয়ে পাঁচ বছরে পা পরেছে। ছোট্ট একটা পরীও আছে তার। এককথায় পরিপূর্ণ দায়িত্ব অভির মাথায়।



পর্ব -৩

সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে মানুষ টাকা নামক কাগজের কাছে অসহায় ছিল আছে থাকবে। আর তারই ফলস্বরূপ মানুষ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনে ব্যস্ত থাকে সকাল থেকে রাত অবধি। এর ব্যতিক্রম নয় অভিও। সবাই যখন একই জিনিসের জন্যে ছুটে তখন ঐ জিনিসটার দাম বাড়তে থাকে এতে আর নতুন কি। ঠিক তেমনি কিছু সোনার হরিণ ছেড়ে স্বেচ্ছায় টাকা উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে ব্যবসাকে।

জীবনের শুরুটা যেকোনো মানুষের জন্য তেমন একটা সুখকর হয়না তা কমবেশি সমস্ত বাস্তববাদী মানুষরাই জানেন। ঠিক তেমনি অনেক ঘাত প্রতিঘাত ফেলে অবশেষে একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে অভি। একটা সময় যার আদর-কদর তার আত্মীয় পরিজন, ভাই বন্ধুমহলে ছিলনা তারাও আজ একটু একটু করে জানতে শিখেছে বুঝতে শিখেছে। নাহয় অভি একটু বেশিই স্বপ্ন দেখে নতুন কিছু করে দেখানোর। এটা নিশ্চয় অপরাধ নয়। কিন্তু সহযোগিতা নামক যে শব্দটা বলে অভিধানে রয়েছে তা কোন একটা মানুষ থেকে আজ অবধি অভি পায়নি। আমিও তেমন একটা যে সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম বা পারছি তাও না।

একজন ব্যবসায়ী মনের গভীরতার বাইরেও একজন নরম মনের মানুষ অভি। এখনো পথের ধারে শুয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর জন্য চলতি পথে পা থামিয়ে খাবার দিতে ভুলে না সে। মাঝে মাঝে রাতবিরেতে শীতকাতুরে মানুষগুলোকে উষ্ণ কাপড়ে শরীর ঢেকে আসতে পিছপা হয়না সে। আমার মনে আছে সেই দিনের কথা। যখন চারজন মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া খাবার না নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছিল তখন অভি ওয়েটারকে ডেকে খাবারগুলো প্যাক করে দিতে বলায় রূমা বারবার উচ্চস্বরে বলছিল- কিরে অভি এই খাবারগুলো শুধু শুধু প্যাকেট করে কোথায় নিয়ে যাবে। এত খাওয়ার পরেও বুঝি আরো খেতে মন চাইছে? সবাইকে অবাক করে রেস্টুরেন্টের একটু দূরে বসে থাকা ছোট্ট বাচ্চা কোলে এক মহিলাকে খাবারের প্যাকেটটা তুলে দিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলো অভি।

রূমা। সম্পর্কে অভির বান্ধবী। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় অভির প্রেমিকা। আসলে অভি নয় রূমাই অভিকে ভালবাসতো। একরোখা খুঁতখুঁতে ছোটখাটো দেখতে মেয়েটা অভিকে খুব ভালবাসলেও তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা ছিল অন্যরকম মেজাজের। আসলে কিছু মানুষের সমস্যা তার সাথেই ছোট থেকে বেড়ে ওঠে। তেমনই একটি সমস্যা ছিল সন্দেহ। আবার কথায় কথায় জেদ দেখানো ছিল রূমার ভালোবাসা। আর হয়তো তাই এড়িয়ে চলতে গিয়ে জীবনের চূড়ান্ত শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল অভি।

কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠায় কল রিসিভ করলে বয়স্ক এক মহিলার কন্ঠে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে অভি। এমন কিছু কখনো কোন স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ স্বপ্নতেও ভাবেনা ভাবতে পারেনা। তাও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে অভি কথা চালিয়ে গেল ভদ্র মহিলার সাথে। এখানেই কথার শেষ নয়। সবে শুরু। অনেক কষ্টে অচেতন নিস্তেজ নির্বাক শরীরটাকে সবাই ধরাধরি করে মেডিকেল আনার পরেও যখন ভালো কোন ট্রিটমেন্ট পাচ্ছিলনা তখন অভি নিজ দায়িত্বে তার পরিচিত মহলের আশ্রয়ে সুস্থ করে তুলল রূমাকে। তখন ঐ ভদ্র মহিলার কর্কস রাগান্বিত কন্ঠস্বরও বদলে গেল আদরের সুরে।

ঘটনার সব সত্যতা যাচাই বাছাই করতে গিয়ে রূমার মা অর্থাৎ ঐ ভদ্র মহিলাসহ পরিবারের সবাই গল্পের আসল নায়ক অভির কাছে পরোক্ষভাবে ক্ষমা চাইলেও অভি এখনো নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা যে, কেউ তাকে এতটা ভালবেসে নিজের পরিবারের দেওয়া জীবনসঙ্গী মেনে না নিতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। নিয়তির পরিহাসে গল্পের নায়িকা আজ সুখের সংসারে দুই মেয়ে ও স্বামী নিয়ে ব্যস্ত। এখন আর দেখা হয়না তার সাথে। কথাও শেষবারের মত কবে হয়েছিল তাও মনে নেই এখন। তবে রূমা ভাল আছে সুখে আছে এটাই সান্ত্বনা।



পর্ব -৪

মাঝে মাঝে গল্প লেখার শখ আছে তার। কখনো কখনো আবার কবিতাও আপন মনে লিখে ফেলে সে। যদিও প্রচার তেমন একটা নেই তার। বলতে গেলে সে নিজেই নিজেকে সবার সম্মুখে উন্মোচন করেনি আবার করতেও পারেনি। তবে এদানিংকালে গানটাই তার বহুল আলোচিত টপিকসের একটি। এক দুইজন করে অনেকেই এখন তার গানের ভক্ত। গিটারের ছয় তারের বাইরেও তার হাতের ছোঁয়ায় সাবলীল সুর তোলে কিবোর্ড, তবলা আর বাঁশি। কিন্তু তবুও কখনো কখনো তার হৃদয়বীনা কষ্টের সুর বাজিয়ে অতীত মনে করিয়ে দেয়।

মনে করিয়ে দেয় সংসার পরিবার এইসব কিছুর বাইরেও একটা জগৎ আছে। আছে নিজের ইচ্ছে পূরণের অদম্য ইচ্ছা। কিন্তু নিজেকে যখন অন্যের ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ার করা হয় তখন বাঁধে নানান জটিলতা। সৃষ্টি হয় নিত্যনতুন দ্বিধাদ্বন্দ্ব। আগেও প্রমাণিত হয়েছিল যে, নিজের অজান্তে অজানা ভালোবাসা বিপদ ডেকে এনেছিল অভির জীবনে। অনেক বুঝিয়েও যখন রূমাকে বুঝানো গেলনা তখনই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল অভিকে। রূমার একতরফা ভালোবাসার কাছে হার মেনেছিল অভির বন্ধুত্বতা।

দিন যেমন থেমে থাকে না বছর তেমন কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। মাঝের কিছুটা সময় এলোমেলো কাটলেও কোন এক অজানা ক্ষণে নতুন করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এলো রূপা। ওর আগমনটাও ছিল অদ্ভুত। একটু খোলাসা করে না বললে বুঝানো যাবে না।

বন্ধুত্বের শুরুটা ছিল মিসকল দিয়ে। তারপর শুরু হলো অচেনা নাম্বার থেকে কথা বলা। কথার টপিকসটাও ছিল অদ্ভুত। কে আপনি? কাকে চাইছেন? বিরক্তিকর কন্ঠে জবাব দিল অভি। বারবার মিসকল দিচ্ছেন। আবার কলবেক করলেও কোন কথা বলছেন না। এ কেমন ম্যানার আপনার। অপমানের পর অপমান করে অবশেষে একটা কোমল কন্ঠ শুনতে পেয়ে থামলো অভি। তো বলেন কে আপনি? বারবার মিসকল দেওয়ার কারণ কি? আর তার চেয়ে বড় কথা আমার নাম্বার কোথায় পেলেন? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো অভি। আমি অচেনা পাখি তাই আমাকে চিনবেন না। মায়াবী কন্ঠে জবাব দিলো রূপা। আমি চেনা পাখিদের খোঁজ রাখতে পারিনা আবার অচেনা পাখির খোঁজে নিজের চেনা পথ হারাবো নাকি। প্রতিউত্তরে অভি।

এইভাবে বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে মান অপমানের গল্প। অতঃপর উন্মোচন হলো রূপা আর অভির অদৃশ্য বন্ধুত্বের রহস্য। ঘনিষ্ঠতা একটু একটু করে আরো গভীর হলেও অভি আর তার সুপ্রসন্ন ভাগ্য বেশিদিন ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না। তবে এইবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটলেও একেবারে যে কিছুই না ঘটিয়ে ইতিহাস করেছিল তা কিন্তু নয়। কথায় বলে সুখ মানুষের বেশিদিন টিকে না। ঠিক তেমনই হয়তো অভি আর রূপার ভালো বন্ধুত্ব তিন চার মাসের বেশি টিকলো না কারণ রূপার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আসলে সমস্যাটা বিয়ে ঠিক হওয়াতে ছিল না। সমস্যাটা ছিল বিয়েটা তার দূরের কোনো এক গ্রামে হওয়াটা।

তবে যাই হোক, বন্ধুত্বের একটা লিমিট থাকে বলে সেই লিমিট থেকে অভি রূপাকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে নতুন জীবনে এগিয়ে দিল। এই মহাবিশ্বের প্রতিটা মানুষ কমবেশি সময়ে অসময়ে মিথ্যা কথার আশ্রয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এতে আর নতুন কি। রূপাও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই মিথ্যা বলে সে। তাও কিন্তু অভির সাথে মিথ্যা বলে পাত্তা এবং পার কোনটাই পেত না রূপা।

যাক সেসব কথা। আজ তাকে তার স্বামী ছেলে নিয়ে সুখী দেখে আনন্দে তৃপ্তি খুঁজে পায় অভি। নিজের অগোচরে রূপার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে একাকীত্বা ভুলে রূপাকে কবিতার ছন্দে ও গানের সুরে চিরস্মরনীয় করে রেখেছে অভি।



পর্ব -৫

এখন যে যার মত সংসার নিয়ে ব্যস্ত আর অভি ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। সবসময় কিছু না কিছু করে দেখানোর প্রত্যয়ে তার রাতের ঘুম দিনের ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবুও রাতদিন এক করে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে একটু কিছু করে দেখাতে মরিয়া অভি।

সেই থেকে এই অবধি একেবারে যে কিছুই করে উঠতে পারেনি তাও কিন্তু নয়। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও অভির অন্যরকম পরিচয় আছে। নাট্যদলের সাথে মঞ্চ নাটক করা থেকে কারাতে প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করা। তাছাড়া একটুআধটু গল্প কবিতা লেখাও তার শখের তালিকায় সবার উপরে। গান লিখছি লিখছি করেও তার গানের তালিকায় শততম যুক্ত হল। অবাক হলেও সত্য যে, তার গানগুলোতেও আমি তাকে খুঁজে পায়। তার গল্প কবিতায় খুঁজে পায় তার না বলা যন্ত্রণা।

অনেক ইচ্ছে ছিল ছোট্ট একটা হোম স্টুডিও দেওয়ার। নিজের প্রোডাকশন থেকে শর্ট ফিল্ম বারকরার। একেরপর এক নিজের অপরিচিত গানগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরার। নিজের অচেনা গল্পগুলোকে পান্ডুলিপিতে বেঁধে রাখার। কিন্তু কই আর কি পান্তা ভাতে ঘি। তবুও স্বপ্ন দেখার অবসান হয়নি, কাব্য লেখার খোরাক মেটেনি, এগিয়ে চলার পথ ভুলেনি অভি।

আমি ব্যস্ত আছি ভালো আছি, তোদের শহরে।

আমি মরিনি আজও বেঁচে আছি, তোদের নগরে।।

শুধু ক্লান্ত আছি, মনের ঘরে।

অপেক্ষায় আছি যাবো ওপারে।।

নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার গান মাঝে মাঝেই গায় অভি। আসলে সান্ত্বনা বললে ভুল বলা হবে। কথাটা হবে অভি তার বেঁচে থাকার শক্তি খুঁজে পায় গানগুলোর মাঝে। তাইতো সে গেয়ে চলে নিরলস কন্ঠে।

তোমরা জানো আছি ভালো,

এক বুক ভালোবাসাতে।

ক্ষতি নেই ভেবে নিতে,

ঠোঁটের কোণে চাপা হাসিতে।

তোমরা জানো আমি সুখী,

না পাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়াতে।

হয়তো দেখোনি কখনো,

সাগরের জলে গা ভাসাতে।

শুধু আমি কোথাও খুঁজে পাইনি আমাকে।।

শুধু ক্লান্ত আছি, মনের ঘরে।

অপেক্ষায় আছি যাবো ওপারে।।

কাজের ফাঁকে বছর গড়িয়ে যেতে টেরই পাওয়া যায় না। তবুও মাঝে মাঝে হাই হ্যালো হলেও রূপাকে না দেখার কষ্টটা ঠিকই ছিল। অন্ততঃ রূমার চেয়ে হাজার গুণ ভালো রূপা। কোন স্পেশাল গিফট নেই, নেই কোনো থাকা না থাকার কমিটমেন্ট। যদিও রূপাও একবার রূমার মত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার নাটক করে অভিকে মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত করেছিল। তবে সেই সব ছিল ক্ষণিকের।



পর্ব -৬

নতুনের স্বাদ কে না ভালোবাসে। অবাক লাগে অভির জীবন কাহিনী ভাবলে। একটা সময় যে ছেলে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলাতো দূর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না তার এখন একেরপর এক শুভাকাঙ্ক্ষী এসে হাজির হচ্ছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে চায় আবার কেউ চায় ভালোবাসতে। কেউ কেউ আবার টাইমপাস।

যদি সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে সূচনার সাথে পারিবারিকভাবে বিয়েটা হতে পারে অভির। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, অভি আর তার সুপ্রসন্ন ভাগ্য কেউ কারো বন্ধু নয়। সবেমাত্র ভাব বিনিময় হল সূচনার সাথে তাও ফেইসবুকে। মাঝে মধ্যে একটুআধটু দেখা করতে যাওয়া। ভালো মন্দ খাওয়া আর জমিয়ে অজানা জগতের আড্ডা দেওয়া। এককথায় বলা চলে লিমিটেড এডিশনের প্রেম।

কিছু কিছু পরিবারের ছেলে মেয়েরা অশান্তি অবসাদের সংজ্ঞা পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। তাতে কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আবার কেউ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জীবন নামক ট্রেক থেকে ঝড়ে যায়। এমনই কিছু একটা চাপা যন্ত্রণা সূচনাকে নিজের মধ্যে নিজেকে শেষ করে ফেলেছিল। এক দেড় মাসের মাথায় এতটা টেলিপ্যাথি কোনো যুগল জোরায় কাজ করেনা যদি না তারা এক ছাদের নিচে সময় কাটায়। অভি আর সূচনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কথায় কথায় কল ড্রপ করা, টানা দুই চার দিন কোনো যোগাযোগ না করা এই ছিল সূচনার প্রেমের প্রোটোকল।

হঠাৎ একদিন সূচনার নাম্বার থেকে অচেনা এক ভারি কন্ঠস্বর অভিকে রীতিমতো চমকে দিল। সে নিজেকে সামলে পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই অপমানের বোলি তার সুস্থ মস্তিষ্ককে অসুস্থ করে তুলল। কলটা ছিল সূচনার মায়ের। তিনি যেমন ইতোপূর্বে কখনো অভিকে দেখেননি ঠিক তেমনি অভিও উনার সান্নিধ্য পায়নি। তাও তিনি একজন মমতাময়ী মা হয়ে উনার সন্তানের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে অন্য কোনো মায়ের সন্তানকে একতরফা কথা শুনিয়ে গেলেন। অভি কথাগুলো শুনছিল আর কথাগুলোর অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। পরে সাব্যস্ত হল দেখা করার।

পরিচিত মহলের বাইরে কোনো এক মন্দিরের নাচখানায় মাঝামাঝি উচ্চতার থ্রি পিস পড়ুয়া ভদ্রমহিলা দেখা করতে এলো অভির সাথে। মুখে তাঁর বিষাদের চিহ্ন। মোবাইল হাতে আরো একবার নিশ্চিত করার জন্যে অভিকে সামনে থেকে কল দিতে দিতে খুব রাগান্বিত চোখে দেখছিলেন তিনি। অবশেষে শুরু হল উনার ভয়ভীতিকর আলাপ। কেন কি কোথায় কখন কিভাবে ব্লা ব্লা ব্লা। অভির ছোটবেলার শিক্ষা বড়দের সম্মান করা আজ কাজে এলো। সে অসীম ধৈর্য্য পরীক্ষায় অবশেষে উর্ত্তীণ হওয়ার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করল সূচনার মায়ের সম্মুখে। সে তার মোবাইল এর মেসেজটা পড়ে শুনালেন উনাকে। "আমি মা বাবার অশান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। তাদের ঝগড়াঝাঁটিতে আর এক মুহূর্ত নিজের অবসাদময় শরীরটাকে ধরে রাখতে পারছিনা। পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি চিরনিদ্রায় যাচ্ছি।"

তারপর আর কি! উনি উনার ভুল বুঝতে বাধ্য হলেন এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমাও চাইলেন না বুঝে এটা ওটা বলার জন্য। আসলে সূচনাকে মেডিকেল থেকে ওয়াশ করিয়ে আনার পর থেকে সে শুধু তোমার নাম নিয়ে পাগলামি করছিল। কিছুতে তাকে বুঝানো যাচ্ছিলনা। চোখের জল মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন সূচনার মা। কি করবো, কি করলে ভালো হবে না বুঝতে পেরে তোমাকে এটা ওটা বলে ফেলেছি। ইস্ যদি তোমার মত আমার মেয়েটা একটু মায়ের দুঃখ বুঝতো তাহলে আজকে এই দিন দেখতে হতো না। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ যেন আমার মেয়েটাকে তুমিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে।

সবকিছুর একটা শেষ থাকে। কিন্তু বাস্তবে তার রেশ থেকেই যায়। সূচনার মাকে দেওয়া কথা রাখতে গিয়ে আজকে সূচনার চোখে একজন খারাপ ভালোবাসার দৃষ্টান্ত হল অভি। তবে ভালো মন্দে জীবন। তাই তাদের বন্ধুত্ব মাঝের কিছু বছর অদৃশ্য থাকলেও বর্তমানে আবার বিদ্যমান। অন্ততঃ খুব কাছে থেকে না পাওয়ার সান্ত্বনায় সামনে থেকে কথা আর দেখাতো হচ্ছে।



পর্ব -৭

প্রকৃত অর্থে প্রেম তখনই আসে যখন আবেগ জন্মায়। আর আবেগ কখনো বাস্তবতার সাথে লড়াই করা মানুষের জন্মায় না বলে বাস্তববাদী মানুষগুলোর প্রেমের ডিকশনারিতে বিরল কোনো দৃষ্টান্ত রাখার সৌভাগ্য লাভ হয়নি। কিন্তু তারাও ভালোবাসাতে জানে। তাদেরও মন নামক মৌলিক দিক রয়েছে। শুধু তফাৎ একটাই, কারো প্রেম প্রকাশিত হয় আর কারো প্রেম লুকায়িত থাকে।

জীবনের পঁচিশটা বছর যে ছেলেটা প্রেম মানে মায়ের হাত ধরে পূজো দেখতে যাওয়াকে বুঝতো বা বাবার হাতে হাত রেখে শপিং এ যাওয়াকে বুঝতো সেই ছেলের জীবনে যে হঠাৎ এতো প্রেমের বর্ষন হবে আমিও ভাবতে পারিনি। মাঝে মাঝে অভিকে দেখলে আমার নিজেরই হিংসে হয়। আবার ভাগ্যবান অনুভব করি তার সহচর সহযোদ্ধা হতে পেরে। সূচনার সাঙ্গে দূরত্ব বাঁড়ার সাথে সাথে অভির জীবনে নেমে আসে আমুল পরিবর্তন। পরিবর্তনের কথা নাহয় অন্য একসময় বলা যাবে কিন্তু দেখতে দেখতে অভি এখন ত্রিশের কোঠা অতিক্রম করেছে। ব্যবসা গানবাজনা কোচিং নিয়ে ব্যস্ততার সময়গুলো অন্য দশ সাধারণ মানুষের মতোই কাটছিল। কিন্তু সফটওয়্যার রিলেটেড ক্লায়েন্ট লাকি আবার অন্য দশ ক্লায়েন্টের চেয়ে ভিন্ন ট্রেকে এসে হাজির হলো অভির জীবনে।

মাঝ বয়সী মাঝামাঝি উচ্চতার মেয়ে লাকি। শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ কম ছিল বলে হয়তো একটু বেশিই স্বাস্থ্যবান সে। যদিও সে গল্গের ছলে অভিকে ছাব্বিশ সাতাশ বছরের বলেছিল কিন্তু তার জীবন বৃত্তান্ত অনুযায়ী বয়স ছিল সায়ত্রিশ। তাও কেন যেন সে বিয়ের পিঁড়িতে বসার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি এখনো। বাবা ছাড়া পরিবারের বড় মেয়ে বা বড় ছেলেদের কমবেশি একই বর্তমান অতিবাহিত করতে হয় এতে আর সন্দেহ কি। অবাক হলেও সত্য যে, তার ছোট বোনের ছেলে মেয়েরাও আজ স্কুলে পড়ছে।

মানুষ তার চাহিদার বাইরে পেতে ভালবাসে কিন্তু ভাগ্যের বাইরে এক চুলও বাড়তি পেয়েছে এমন কথার স্বাক্ষী ইতিহাসে নেই। তাও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে না। লাকিও স্বপ্ন দেখতো একজনকে নিয়ে। আজ নাকি সেও তার পরিবারের ইচ্ছেতে অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে। আর তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে মাঝে মধ্যে ব্লাড প্রেসার লো করে কষ্ট পাচ্ছে লাকি। এই বুঝি ভালোবাসা এই বুঝি বিশ্বাস।

ভাবতে অবাক লাগে কোনো একটা সময় অভিকেও নিজের চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতো। অথচ অভি তার যথাযথ মুল্য দিতে পারেনি বলে অভিও আজ সেই সব দিনের কথা মনে করে কষ্ট পায়। আমার কেন জানি মনে হয় পৃথিবীর সব নারীর কষ্ট এক। হবেও না কেন? তারা যে বাস্তবতার অনেক উপরে উঠে আবেগ থেকেই একতরফা স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। কিন্তু বাস্তবে যে আবেগ হার মানতে বাধ্য বিবেকের কাছে এটা যতদিনে বুঝতে শুরু করে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়।

লাকির সাথে অভির প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক না হলেও কেন যেন লাকি অভিকে দেখলে আবেগে বশীভূত হয়ে পড়ে। তার চোখে অভির চেহারার অন্যরকম বিবরণ ফুটে ওঠে বারংবার। নিয়মিত নামাজ কালাম পড়ুয়া মেয়ে লাকি প্রতিবার নামাজের শেষে নাকি অভির জন্যেও দোয়া পড়ে। সামনে এলে নানান অজুহাতে অভিকে স্পর্শ করতে চায় লাকি। উদ্দেশ্য বেশি কিছু নয়, শুধু অভিকে একটু আদর করতে পারলে সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। কিন্তু এটা সম্ভব নয় বলে অভি সব বুঝেও না বুঝার ভান করে দূরত্ব বজায় রেখে সফটওয়্যারের কাজে ব্যস্ত রাখে নিজেকে।

মানুষ নিজের অজান্তে হোক বা জেনে শুনেই হোক লোভ করবে করে এসেছে এটাই বাস্তবতা। শুধু কেউ লোভ সামলাতে পারে আবার কেউ লোভে গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবনের ট্রেক থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু মানুষ তার পরিবারের রক্তকে কলঙ্কিত করতে পারেনা বলে হাজার টাকার মধ্যে এক টাকাও কুড়িয়ে নেইনা। অর্থাৎ কোন লালসায় তাদের নিয়তকে বদলাতে পারেনি পারেনা। ঠিক তেমনই একটা ছেলে অভি। আসলে এত বকবক করার একটাই উদ্দেশ্য, লাকি অভিকে এমন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে যা অন্য পুরুষ কি করবে জানা না থাকলেও কিন্তু অভি তা অকপটে এড়িয়ে গেল সেচ্ছায়।

ভাইয়া আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আপনাকে দেখলে মনে হয় অন্য রকম একটা জ্যোতি আপনার চেহারাতে ভেষে ওঠে আমাকে আপনার কাছে টেনে নিয়ে আসে। হাতে হাত রেখে নেশালো চোখে অভির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে লাকি। একবার যদি আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। যদি পারতাম মন প্রাণ দিয়ে আদর করতে। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। একদিকে পরিবেশ অন্যদিকে পুরুষ মানুষের শরীর কোনটাই যেন নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না।

সবসময় ফোনালাপ বা দেখা কোনটাই হতোনা তাদের। তাও যতটুকু কাজের কারণে সামনে আসা হতো তাতেই এতটা পাগলামি। একদিকে দেখা নাহতে শুরু করলে মাসও পেরিয়ে যায় আবার দেখা হলে ঘন্টা কাটিয়ে যায় লাকি। তবে একটা কথা না বলে পারছিনা আমি। উপরে মালিক সত্য নিচে মানুষ। মালিকের ইচ্ছে ইশারা ছাড়া মানুষের কি ক্ষমতা আছে কিছু করে দেখানোর। কারো সাথে কথা বলা তো দূর নিজের নিঃশ্বাসকেও নিজের বলে দাবি করতে পারবেনা।



পর্ব -৮

গান নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অভি। শ্রোতারাও তার গানগুলো নিয়ে কৌতুহলী। মাঝে মধ্যে দুই একটা স্টেজ শো থাকলেও তার আসল শ্রোতা হলো তার ছাত্র-ছাত্রীরা। ও! একটা তো কথা বলাই হয়নি আমার। অভি শুধুমাত্র একজন ফ্রিল্যান্সারই নয়, সে একজন শিক্ষকও বটে।

জীবনে চলার পথে তিন ধরনের শিক্ষক আমরা দেখতে পাই। একঃ পেশাদার শিক্ষক। যারা শিক্ষাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেছেন। দুইঃ অপেশাদার শিক্ষক। যারা অন্য পেশায় থেকে শিক্ষকতা করেন। তিনঃ ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক। যারা পেশাদার অপেশাদার শিক্ষক না হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে চলতে ফিরতে উপদেশ দিয়ে থাকেন আর নিজেকে জ্ঞানের মহাপন্ডিত ভাবেন।

অভিও কিন্তু একজন অপেশাদার শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় অতিবাহিত করছে। ছাত্র-ছাত্রী মহলে সে এখন একজন আইডল শিক্ষক। তার বিশেষ কারণও ছিল। ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও একজন লোক উদ্যোক্তা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা এবং মিউজিক, লেখালেখি থেকে শুরু করে নাটক আরও অনেক কিছুতে তার পরিচিতি প্রসার করা। অর্থাৎ থেমে থাকা বা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো অভির অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল বলে সে অন্য দশজনের চেয়ে অনেকটা আলাদা। মাঝের কিছুটা সময় কলেজে পড়ানোর অভিজ্ঞতাও তার ঝুলিতে আছে। কিন্তু অবাক কথার মত একটা বিষয় লক্ষণীয়, আজ অবধি কোনটাই তার পাকাপোক্ত ক্যারিয়ার হয়নি। থেমে না থাকার প্রত্যয় যার মগজে সে কখনো এক পথের পথিক হতে পারেনা। এই কথাটা শুধুমাত্র অভির ক্ষেত্রে নয়, সকল দুরন্ত যাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

তবে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও মন নামক কঠিন পদার্থ ঠিকই তার ভালো মন্দ জানান দেয়। সবকিছু এড়িয়ে চলা গেলেও মনের রোগকে হার মানানো এত সহজ নয়। কারো করো আবার মদ সিগারেট হলো মনের রোগ তাড়ানোর একমাত্র উপায়। এইদিক থেকে অভিকে আবার বেকডেটেড বলা চলে। না সে কষ্টের চাপে সিগারেট টানতে শিখলো,‌ না সে দুঃখে পড়ে মদ খেতে শিখলো। এত ভালো মানুষের অবস্থান এই বর্তমান সমাজে কোথায়? তারপরেও অভি তো অভি।

আজ অবধি কমবেশি কষ্টগুলো অভি তার ভাই বন্ধু পরিচিত মহল থেকেই পেয়ে এসেছে। আঘাত পেয়েছে বিশ্বাস করে। চোখের জল ঝরিয়েছে ভালো চাইতে গিয়ে। বিনা প্রয়োজনে যে ছেলেটা ঘরের বাইরে এক বিন্দুও সময় কাটায় না, যার খেলার সাথী একাকীত্বের সাথী গিটার ল্যাপটপ আর মোবাইল। যে নিষ্প্রয়োজনে উচ্চস্বরে কথাও বলেনা তার প্রতিটা কাজের শেষ হলো চোখের জল। এ কেমন বিধাতার পরিহাস!!!

আজ তার গানগুলো গল্প শোনায় তার গভীরতার। সুরগুলো তার মূর্ছিত হয় এলোমেলো ছন্দে। গিটারের তারগুলো কম্পিত হয় ক্লান্ত হাতের তরঙ্গে। গলায় সুর আটকায় চোখের জলে।

(ও) মন ভালো নেই, ভালো নেই এবেলা।

মন কি যে চায়, জানেনা সারাবেলা।।

বোঝেনা কবে পাবে, সুখেরই ঠিকানা।।

মন ভালো নেই, ভালো নেই।



ভোরের আলো দেখে, মন উদাসীন।

কাঁদে নিরিবিলি, তুমি জানো কি।।

কত কি হারানোর, ভয় আর কাটে না।।

মন ভালো নেই, ভালো নেই।



জ্যোৎস্নার আলো দেখে, হলো খেলা ঘর।

দূর আকাশে ঐ, তারারা ধূসর।।

তবুও কেন মন, শান্ত হয়না।।

মন ভালো নেই, ভালো নেই।


পর্ব -৯

যেখানেই যাক না কেন অভি কমবেশি সবার মন জয় করে এসেছে এতে আর নতুন কি। আবার তাদের মাঝেও কেউ কেউ আছে যারা এইসব সহ্য করতে পারে না। আসলে কোন কিছুই অভিকে থামিয়ে রাখতে পারার নয় বলে বিধাতাও সময়ে অসময়ে নিত্যনতুন বন্ধু এনে মিলিয়ে দেয়।

একটা লম্বা সময়ের পরে নতুন রূপে এসে হাজির হয়েছে সানতা। শুধু সানতা বললে ভুল হবে। সানজানাও ছিল একসাথে। তবে সবাই যে একই মন মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেনা তার প্রমাণ স্বরূপ সানতা নিজেকে যতটা দেখাতে চেয়েছিল ততটা সে বাস্তবে ছিলনা বা হতে পারেনি বলে সে নিজেই পাশ কেটে গেছে অভির কাছ থেকে। তবে ঐ যে বিধাতার ইসারা তাই সানজানা কেমন যেন অভির প্রতিরূপ হয়ে হাজির হলো অভির সম্মুখে। আবার নতুন করে শুরু হলো বন্ধুত্ব। নতুন পথচলা।

একটা ছেলে আর একটা মেয়ের বন্ধুত্বকে সমাজ পরিবার কখনো ভালো চোখে দেখেনি। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এটাই চিরন্তন সত্য হয়ে এসেছে। অভি আর সানজানার ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। দিন যত যাচ্ছিল তাদের বন্ধুত্বও তত গভীর হচ্ছিলো। সুখ দুঃখ হাঁসি কান্না শেয়ার করায় ছিল তাদের আসল কাজ। একজন আরেকজনের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে দৃষ্টান্ত হতে গিয়ে নিজের নিয়তির কাছে দোষী হয়ে গেল অভি। কোনো বাড়তি কমিটমেন্ট নয়, নয় কোনো বাড়তি অজুহাত। আসল কথা একটাই, হাজারটা স্বার্থপর বন্ধুর চেয়ে নিঃস্বার্থ ভালো বন্ধু একটাই যথেষ্ট।

মোটামোটি উচ্চতার গোলগাল মতন দেখতে মেয়ে সানজানা। দুরন্ত চঞ্চল হাস্যোজ্জ্বল মুখটা তার অনেক মায়াবী। কথায় কথায় দুষ্টুমি যার চোখে মুখে। এককথায় অভির নারী প্রতিরূপ হলো সানজানা। মা বাবা আর তিন বোনের সংসারে সানজানা বড় বলে তার দায়িত্ব কর্তব্যও বেশি। সবাই ওকে বিশ্বাস যেমন করে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সত্যি বলতে একটা মানুষকে ভালবাসতে যা যা গুণ থাকা দরকার তার সবটাই সানজানার আছে হয়তো সে সবার আদরের টুকরো।

অভি সানজানাকে পড়ার জন্যে দুষ্টু মিষ্টি শাসন করলেও সবসময় উৎসাহ দিতো জীবনে কিছু করে দেখানোর। একটা ভালো রেজাল্ট সবসময় সবকিছু প্রমাণ করতে পারেনা বলে পড়ালেখার পাশাপাশি অন্য দশরকম হাত বিদ্যায় পারদর্শী হতে চিৎকার করতো অভি। একদিকে ঘরের কমবেশি কাজ, দাদা দাদীর সেবা তার উপর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সানজানা ঠিকই সয়ম খুঁজে নিতো তার ভালো বন্ধু অভির জন্য। একটুআধটু ফেইসবুকে ম্যাসেজ করা আর পড়তে আসলে ফাঁকফোকরে গল্প করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।

নভেম্বরের ষোলোতে তার বার্থডে নিয়ে কৌতুহলী অভি একটা গান উপহার দিলো তাকে। আয়োজনটা ছিল খুব সাধারণ কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশটা ছিল অনেক বড়। হয়তো জীবনের পথ পরিক্রমায় এইরকম বার্থডে সেলিব্রেশন আর দ্বিতীয়বার হবেনা। তার যথাযথ কারণও আছে। তাই বর্তমানটাকে স্মরণীয় করে রাখতে অভির ছোট্ট প্রয়াস।

তোকে সাত জন্ম থেকে পাওয়া।

হাজার পরীর ভিড়ে, একটি পরী খুঁজে,

নিজের কাছে এনে বন্ধু হওয়া।

তোর মুখেরি হাসি খুঁজে যাওয়া।

না বলা দুষ্টুমিতে, নিজেরই অজান্তে,

দুঃখ ভুলে সুখ দেওয়া নেওয়া।

তোর স্বপ্ন হোক রঙিন,

তুই ছুটে চল দিশাহীন।।

আজ নেই মানা তোর জন্মদিন।।



(ও) যেমন আছিস তেমন থাকিস,

কোন কিছুতে বদলে যাসনা।

যেখানে থাকিস ভালো রাখিস,

নতুনের ভিড়ে ভুলিসনা।

তোর স্বপ্ন হোক রঙিন,

তুই ছুটে চল দিশাহীন।।

আজ নেই মানা তোর জন্মদিন।।



(ও) আসলে আসুক যত বাঁধা,

কোন কিছুতে থামিসনা।

এই গানের মাঝে খুঁজে পাবি,

হারানো স্মৃতির ঠিকানা।

তোর স্বপ্ন হোক রঙিন,

তুই ছুটে চল দিশাহীন।।

আজ নেই মানা তোর জন্মদিন।।

গানটা চুপচাপ মন দিয়ে শুনছিল আর মোবাইলে রেকর্ড করছিল সানজানা। এইরকম উপহার তার আঠারো বছরের সেরা উপহার ছিল যা সে ভবিষ্যতে আর পাবে কিনা জানা না থাকলেও অতীতে যে কখনো পায়নি এটা নিশ্চিত। অভিও তার একত্রিশ বছর জীবনে এই প্রথমবারের মতো কারো বার্থডে নিয়ে ডেডিকেটেড গান লিখল। সহজ বাংলায় নিঃস্বার্থ প্রেম, নিঃস্বার্থ স্নেহ, নিঃস্বার্থ মমতা।



পর্ব -১০

এভাবে চলতে থাকা নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের প্রেম পৃথিবীর বুকে অমর ছিল অমর থাকবে। হাজারো কুদৃষ্টি বিধাতার বন্ধনগুলোকে পৃথক করতে পারেনি পারবেও না। এখানে প্রেম মানে পরকিয়া নয়। এখানে প্রেম মানে লোক দেখানো বিয়ে নয়। এখানে প্রেম মানে একতরফা তুমি আমার আমি তোমার নয়। এখানে প্রেম মানে ভালো ক্যারিয়ার করার উৎসাহ। এখানে প্রেম মানে জীবনে কিছু করে দেখানোর প্রত্যয়। এখানে প্রেম মানে হাজার যোযন দূর থেকেও সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করা।

সানতার মত নিঝুমও নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে হয়তো একটু বেশিই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিল অভির সাথে। ও হ্যাঁ, ছিপছিপে শুকনো মতন দেখতে মেয়েটার নাম নিঝুম। সম্পর্কে অভির অন্য এক ছাত্রী। আসলে একজন পেশাদার বা অপেশাদার শিক্ষকের খুব কাছের বন্ধু হল তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের মাঝে আবার কেউ কেউ থাকে যারা একটু বেশিই আপন হয়ে পড়ে। নিঝুমও সেসব ছাত্রীদের একজন যারা অভির জীবনে ভালো বন্ধু ভালো শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে এসেছে।

একটু বেশিই মিশুকে মেয়ে নিঝুম। তবে স্থান কাল পাত্র ভেদে কখন কোথায় কি কথা বলা উচিত না ভেবেই বলে ফেলতে গিয়ে কমবেশি সবার হাঁসির পাত্রী হয়ে পড়ে সে। বন্ধুদের সাথে দুরন্তপনা আড্ডা ঘুরে বেড়ানো এসব ছিল তার ডিকশনারিতে প্রথম দিকের সিলেবাস। একটু নিজের মধ্যে থাকতে ভালবাসা, খামখেয়ালি থাকা, দৌড় ঝাঁপ ইত্যাদি ছিল নিঝুমের নিত্যনৈমিত্তিক কাজগুলোর একটি।

তার সাথে অভির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শুরুটা ছিল মিথ্যা কথার আশ্রয় দিয়ে। তাও কথায় কথায় এমন কিছু প্রসঙ্গে নিঝুমের মতামত যা কিছু দিনের মধ্যে তাকেই মিথ্যুক বানিয়ে দিল। যাইহোক সব মানুষের নিজস্ব কিছু প্রতিক্রিয়া থাকে যা তাকে অন্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা করে তোলে। আবার কিছু মানুষ এমনও হয় যারা অন্যের সাথে নিজেকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনে।

চ্যালেঞ্জ একটাই, সামনের জনের চেয়েও বেশি করে দেখানো। তবে এইসমস্ত চ্যালেঞ্জ বেশি কাজে লাগে ক্যারিয়ার মুখি মানুষগুলোর ক্ষেত্রে। বন্ধুত্ব বা প্রেম হাসিল করার ক্ষেত্রে নয়। তবে যাইহোক না কেন সানজানা আর নিঝুম অভির সমসাময়িক বন্ধু হলেও অনেক তফাৎ ছিল তাদের মাধ্যে।

বাবা হীন দুই বোনের মধ্যে নিঝুম বড় হলেও বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব তার কোনো অংশে কম ছিল না। তার প্রেমিক পুরুষ থাকা স্বত্বেও সে নিত্যনতুন বন্ধুত্বে বিশ্বাসী ছিল বলে অভিও তার নতুন বন্ধুর তালিকায় যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সবাই কি আর সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নিতে হবে কথা আছে? তার প্রেমিকের এলার্জি ছিল অভি আর নিঝুমের নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বে। শুধুমাত্র নিজের মধ্যে এলার্জিটা সীমাবদ্ধ ছিলনা তার। যেমনে তেমনে অভি অবধি গড়িয়ে এসেছিল বলে অভিও এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল নিঝুমের সাথে। তবে কিছু কথা না বললে কি হয়। প্রতিবার বন্ধুত্বের মাস পূর্ণ হওয়াতে রজনীগন্ধা গোলাপ আর চকোলেট একমাত্র নিঝুম থেকেই আসতো। অভি কোন কারণে অসুস্থ থাকলে সবার আগে এই মেয়েটাই ছুটে আসতো দেখতে। কিন্তু সানজানার মতো আর কোনো বন্ধু ছিলনা যার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতির মনিকোঠায় বন্ধী করে রাখা যেত। এককথায় একজন ভালো হলে অন্যজন বেশিভালো।



পর্ব -১১

পৃথিবীর নিয়মের বাইরে কেউ কি আর ছুটতে পেরেছিল। অভি হোক বা অন্যকেউ এই নিয়মের বাইরে ছিলনা। হঠাৎ একটা অপরিচিত কন্ঠে গিটার শিখতে চেয়ে অভির সাথে দেখা করার সময় চেয়ে নিলো শ্যামল বরণ লম্বা শুকনো দেখতে মেয়েটা। নাম তার তাহমিনা। তার খুব ইচ্ছে সে অন্য দশ মেয়ের মতো গিটার বাজিয়ে নিজে গান গায়বে। কিন্তু ঐ যে বললাম, পৃথিবীর নিয়মের বাইরে কেউ চলতে পারেনি। এখানেও তার বিপরীত ছিলনা।

কিন্তু লড়াই নামক একটি দৃশ্যমান শক্তি আছে যা মানুষকে করে নিতে হয়। বিনা লড়াইয়ে একটা বাচ্চাও জন্ম নিতে পারে না। তবে কেউ কেউ পরিবারের উপর এতো দুর্বল থাকে যে তার পক্ষে সম্ভব হয়না স্বয়ং পরিবারের সাথে লড়াই করে কিছু আদায় করা। তখন বলার মত অবশিষ্ট থাকে ভাগ্য বা নিয়তি বা অদৃষ্ট খারাপ অথবা কপালে সুখ নেই ইত্যাদি।

পৃথিবীতে দুইজন সুখী ব্যক্তি দৃশ্যমান। একঃ যিনি পরিশ্রম করে সুখ সঞ্চয় করেন। দুইঃ যিনি বিনা পরিশ্রমে পৈত্রিক বা বৈবাহিক সূত্রে সুখ পেয়ে থাকেন। অভি ছিল সেসব ব্যক্তিদের একজন যারা পরিশ্রমের স্বাদ গ্রহণে অভ্যস্ত। তাই কেউ যখন হাজারো কষ্টের মাঝেও কিছু শিখতে চাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে অভির কাছে আসে তখন যেভাবে হোক অভি তার স্বপ্ন পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা বজায় রাখে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে অভি যেখানে টাকা নামক কোনো কাগজ বাঁধা হতে পারেনি।

তিন বোন এক ভাইয়ের সংসারে তাহমিনা সবার ছোট হলেও পারিবারিক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে তার অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ হয়নি হয়না এমনকি হবেও না। তবে কোন বাঁধায় বাঁধা নয় যদি মনের জোর থাকে অটুট। বিধাতাও তাকে সাহায্য করেন যে চেষ্টা করে। হয়তো অনেক কিছুই গোপন থেকে যাবে তাই বলে কি চেষ্টা করে দেখা দোষের? তার উপর আজকে অনেক বছর নানান শারীরিক জটিলতায় কষ্ট পাওয়া মেয়েটা মুখ ফুটে কারো কাছে নিজের কষ্টের কথা না বললেও কি কারো বিবেকের চোখ থেকে তার স্পষ্ট কষ্টগুলো দেখা যায় না!!! ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় না তার না বলা যন্ত্রণা গুলো!!! এরই নাম মনুষ্যত্ব, এরই নাম ভালোবাসা।

সবসময় কি আর একহাতে তালি বাজে। কোথাও না কোথাও তাহমিনারও গাফিলতি আছে। সেও সমান তালে খোদার দৃষ্টিতে দোষী। নাহয় অবাঞ্ছিত খরচ বা অযৌক্তিক চলাফেরা করে নিজের অসুস্থতাকে আমন্ত্রণ দেওয়ার কি যুক্তিকতা আছে। তার চেয়েও বেশি কষ্টে থাকা মানুষগুলো একটু সুস্থ থাকার জন্যে একটু বেঁচে থাকার জন্যে কতনা লড়াই করছে। আর সে?

মাঝে মাঝে তার মুখে অন্য একজনের গল্প শুনতে শুনতে অভি রীতিমতো তাকে দেখার জন্যে ব্যাকুল। নামটা নাইবা বললাম। কিন্তু সম্পর্কে তিনি তাহমিনার স্যার হোন। স্যার এই বলতেন স্যার সেই বলতেন স্যার এমন স্যার তেমন এসব নিত্যদিনের গল্প ছিল তাহমিনার ডিকশনারিতে। বলতে গেলে অভি অন্য দশজনের মতো নয় বলে তাকে অন্য দশজনের সাথে তুলনা করে নিজেকে বোকার পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

দিন যত এগোতে থাকলো তাহমিনাও গিটারের ছয় তার থেকে অনেক দূরে সরে এলো। এখন অভির সাথে গল্প হয় বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে। দেখা হয় বন্ধুত্বের খাতিরে। ঝগড়া আর ভাব বিনিময়ও বাঁধা ছিলনা এখানে। অনেক বুঝানোর পরেও যখন তাকে দূরে রাখা যায়নি হয়তো এটাই ছিল বিধাতার অদৃশ্য ইশারা। সব কিছু সৃষ্টির আগে থেকে নির্ধারন করা থাকে বলে কারো সাধ্য সেই সেইসব থেকে পালিয়ে বেড়াবে।



পর্ব -১২

পরিসমাপ্তীতে জীবনের ইতি থাকলেও তার গল্পের ইতি নেই। নদীর স্রোতের মতো উঁচু নিচু ঢেউ একটা জীবনকে পরিচালনা করে এসেছে আগামীতেও করবে এতে আর নতুন কিছুই অবশিষ্ট নেই। কল্পনা আর বাস্তবতা একে অপরকে দোষারোপ করবে এটাও মিথ্যে নয়। তবে অভির ছুটে চলা এখানে শেষ নয়। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার ইচ্ছাশক্তি তাকে এখনো কষ্ট দিয়ে বেড়ায়। মনের মতো বন্ধু সে একমাত্র সানজানাকে ভেবে এসেছে এবং এটাই সঠিক।

কিন্তু ঐযে সুখ আর অভির কপাল কেউ কারো ভালো সহচর হতে পারেনি তাই সানজানাও তার জীবনের অসীম পথে পাড়ি জমাবে এটাও ভুল কিছু নয়। সেও অন্যদের মতো নতুনের ভিড়ে অভি নামক পুরোনো মাঝ বয়সী পুরুষকে ভুলে যাবে। কোনো একদিন হঠাৎ গল্পের ছলে অভি টপিকস হয়ে বেঁচে থাকবে সানজানার হৃদয়ে। আসলে কথাগুলোর ভবিষ্যত নেই কিন্তু অভি হারিয়ে যাবে এটাও যে নেহায়েতই ভুল নয়।

অনেক এলোমেলো পাওয়ার মাঝে ঐ সুখ থাকেনা যা পাওয়ার মত অল্প পাওয়াতে থাকে। খোদার দরবারে শুকরিয়া সবসময় ছিল আছে থাকবে। একত্রিশ বছর জীবনে খোদা অনেক কিছুই দিয়েছেন যা কাগজে কলমে লিখে বা মুখে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। তাও একাকীত্বের মুহূর্তগুলোতে সেইসব ভালো মানুষগুলোর স্মৃতিচারণ সত্যি অতীতকে তরতাজা করে দিয়ে যায়। আর আমিও সেই সৌভাগ্যবান সহচর সহযোদ্ধা ছায়া বন্ধু যে সবকিছুর স্বাক্ষী হতে পেরেছি।

আজ আমি ধন্য অভির মতো একজন ভালো মানুষের সাথে থাকতে পেরে। তবে কষ্ট একটাই, পৃথিবীর মানুষ তাকেই ভালোবেসে বুকে টেনে নেয় যে লোভ করতে পারে। তাকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সাজায় যে কিনা সততা ভুলে যেতে পারে। তাই অভির মতো হাজারো লাখো স্বার্থহীন লোভহীন লোকের কষ্টের শেষ নেই, ব্যাথার শেষ নেই। তারা স্বপ্ন বুনে অন্যের জন্য। তারা ব্যস্ত থাকে অন্যকে নিয়ে।

তবে অন্য কোন দিন অন্য কোন গল্পে অভির জীবনের অন্য কোন অধ্যায় নিয়ে আরো কিছু বলব যা তার নাবলা কথাগুলোর অবসান করবে। হয়তো তার জীবন পরিবর্তনে আমারও একটু অবদান থাকবে। হয়তো কোনো একদিন অভির জীবনের ধোঁয়াশারও অবসান হবে।



সমাপ্তি
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩১৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০৬/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast