www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সালিশ

রিজু আগুনটা উস্কে দেয়। নাহ! আগুন আর তেমন নেই। নিভতে নিভতে প্রায় ছাই হয়ে এসেছে। দাদিটার জন্য খুব সমস্যা, এই ঠান্ডায় টিকবে কি না বলা মুশকিল। কেননা যেহারে ঠান্ডা পড়েছে তাতে মনে হয়না এ যাত্রায় বেঁচে যাবে?
- ও ভাই কোটে গেলু? একনা আগুন জ্বালি দে না ভাই।
- দাদী, আগুনটা নিভি গেছে একনা দেরি করো মুই আগুন জ্বালবার নাগছং।
- তোর বাপ কোটে গেছে ভাই?
- আব্বা কর্ণপুর গেইছে।
- ক্যা রে অত্তি কি কামোত গেছে?
- রোকেয়া বুর জন্য বিয়ার সম্বন্ধ আনিছিল কামাল ভাই, তার সাথে গেছে।
- ওরে ভাই অকেয়ার পাত্তর ঠিক হইল? তা মোক এ্যাকনা কেউ কইলোও না। আর কি কইবে! মুই কি আর আগের মতো আছোং যে মোক কইবে। তা হউক বিয়া হইলে ভাল। তা হ্যারে ভাই পাত্তর কি করে?
- মুই কি অতো কিছুর খবর জানোং? যা শুনলোং তাই তোক কনু।
- তা ভাই, এই যে এতো শীত পড়িল কায়ো কোনো কম্বল-টম্বল দেয়নারে ভাই? এই ছিড়া খেতা দিয়া ঠান্ডাতো যায়না ভাই।
- হামারগুলাক কায় দেয়?
- ক্যারে সরকার কি অতোটাই পাষান হইলো যে, এতো ঠান্ডাতো কোন কম্বল দিবার চায়না।
- দাদি, সরকারতো ঠিকই দেয় কিন্তু নেতারা সেগুলা যাদের আছে তামাকে বেশি করি দেয়, হামারগুলাক কি চোখে পরে।
- তুই একবার মজনু মেম্বারোক আইসবার কইসতো, মুই একখান কম্বলের কথা কনু হয়।
- ঠিক আছে কইম এ্যালা, মুই এখন যাইম অনেক কাম আছে।
- তোর আবার কাম কিরে?
- আছে দাদি, থাক পরে এ্যালা আসিম।
রিজু দাদির ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে মা কলপাড়ে মাছ কাটছে। রিজুকে দেখে বলে- ক্যারে তুই সারাদিন ঘরোত কি করিস ক তো?
- কই? দাদি ঠান্ডাত চিল­াচ্ছে তাই একটু আগুন জ্বালি দিলাম।
-সন্ধ্যা হয়া আসিল, তোর বাপটা সেই বিয়ানে বাইর হইছে এখনো ফিরার নাম নাই। ক্যারাসিন তেলের বোতালটা নিয়া বাজার যা, এক পোয়া তেল, এক কেজি লবন আর তোর নজরুল চাচাক যায়া কইস মার পায়ের বিষটা কমে নাই একনা ভাল অসুধ দেয় যেন।
যখন তখন রিজুর বাজারে যেতে ইচ্ছা করে না। সে এখন বড় হচ্ছে এই আধা পোয়া এক পোয়া তেল নিয়ে আসতে তার সম্মানে বাঁধে। তাই মুখটা কালো করে ক্যারাসিন তেলের বোতলটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
-তারা তারি আসিস ন্যাম্পোত একনা তেলো নাই।
বাড়ি থেকে বাজার খুব একটা দূর তাও নয়, এই মাত্র হাফ কিলো। বাজারে জেনারেটর দিয়ে লাইট, ফ্যান আর চায়ের দোকানে কালার টিভি চলে। রিজু চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে টিভি দেখে। গরম জিলাপির গন্ধটা হঠাৎ করে রিজু পেটের মধ্যে ঢুকে ঘোরপাক করতে থাকে। সে পকেটে হাত দেয় নাহ! কোন টাকা পয়সা নাই যে, একটু কিনে খাবে। রিজু দোকান থেকে বের হয়ে আসে। হঠাৎ কে যেন কাঁধে হাত দিয়ে বলে কি রিজু ভাল আছো? রিজু মাথা ঘুড়ে দেখে সাজু ভাই। সাজু ভাইয়ের বাজারে একটা কসমেটিক্সের দোকান আছে। কিন্তু ছেলেটাকে কেন জানি রিজুর ভাল লাগে না, কিছু খারাপ ছেলের সঙ্গে ওঠা বসা। সে কয়েকদিন দেখেছে ওর বোন রোকেয়ার সঙ্গে বেশ হেসে হেসে কথা বলতে। রিজুর এসব মোটেও সহ্য হয় না।
- জি আপনে ভাল আছেন।
- হ্যা আছি, আসো গরম জিলাপি খাই।
- না না, আমি খামু না।
- ক্যান খাবানা, আসো। বলে রিজুর হাত ধরে টেনে সেই চায়ের দোকানে নিয়ে এলো। লজ্জা লাগলেও সে বেশ কয়েকটা জিলাপি খেলো। জিলাপি খাওয়া হলে সাজু একটা খাম রিজুর পকেটে দিয়ে বলল, এটা একবারে বাড়িতে যেয়ে তোমার বুবুর হাতে দিবা, ঠিক আছে।
রিজু এ্যাতোক্ষণে বুঝলো কি কারণে তাকে এই জিলাপী খাওয়ালো। কিন্তু এখন কিছুই করার উপায় নাই।
-কইরে ভাই ঘরত একনা বাতি দিয়া যা। রিজুর দাদি বিছানা থেকে চিৎকার করতে থাকে।
- ক্যা মা তোমরা অদোন করি চিল্লাবার নাগছেন? ঘরোত কোন তেল নাই, ইজু আইনবার গেছে আসলে ন্যাম্পো দিয়া যাইম এ্যালা।
- কি করিম কও, ঘরটা কবরের মতোন আন্ধার হইছে যে।
- দুই দিন পরতো কবরতেই যাবার নাংগছেন এলা থাকি সহ্য করেন, মোর যত জ্বালা চেংরাটা কখন গেইলো এ্যালাও আইসার খবর নাই। ওকেয়া কোটে তুই।
- মুই ঘরত।
- তুইও ঘরত কি করিস এ্যত্তি কত কাম পরি আছে, আর তুই ঘর শুতি শুতি স্বপ্ন দেখিস। জমিদারের বেটি এত্তি আয়।
- কি ব্যাপার বাড়ি সুদ্ধা এ্যাতো অন্ধকার ক্যান। রিজুর বাবা এসে চুলার পারে বসে দুটা শিন্টা দিয়ে চুলায় ফু দিতে থাকে।
- রিজু এ্যালা সিন বাজার গেইছে এলাও আসবার নাগছে না। এই যে আসিল নবাবজাদা। ক্যারে এ্যাতো দেরি হইল ক্যান।
- চাচা দোকানোত না থাকিলে মুই কি করিম।
- কোন চাচার কথা কবার নাগছিস বাবা। রিজুর বাবা শিন্টার আলোয় রিজুর দিকে তাকায়।
- নজরুল চাচা।
- ক্যা, কার আবার কি হইল?
- না এই যে মোর ঠ্যাঙ্গের বিষটা সাইরবার নাগছে না। তাই একনা অসুধ আইনবার কছুনু। আচ্ছা যা অসুধগুলা ঘরোত রাখ।
- শোন, ছেলেটা মোর বড়ই পছন্দ হইছে। ওমার বাড়ির অবস্থাও খারাপ না, তাই মুই কয়া আসছং সামনের মাসে একটা পাকা পাকি করি থুম।
- যাইক ভাল হইছে, চেংরি মানুষ বেশি দিন ঘরত থোয়া মুশকিল কখন কায় কি কয়, কি থাকি কি হয়।
- হ, ঠিক কছিস।
রিজু ঘরে ঢুকে রোকেয়ার কাছে এসে বসে।
- কিরে বুবু তোর সাথে সাজু ভাইয়ের কি?
রোকেয়া অল্প আধারে রিজুর মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলে ক্যারে, কি হইছে।
- না কিছু না, বলে পকেট থেকে প্যাকেটা বের করে দিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। রোকেয়া বাতিটা জ্বালিয়ে পড়তে বসে। সে এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ঘরে আর কেউ না থাকায় সে প্যাকেটা খোলে, দেখে একটা লিপিস্টিক, একটা টিপের পাতা আর দুটা ইন্ডিয়ার নায়িকার ছবি। মেয়েগুলো বেহায়ার মতো পাতলা জামা পড়ে আছে, এই ছবি বাড়ির কেউ দেখলে পিঠে চামড়া থাকবে না। ওর সঙ্গে ছোট্ট একটা কাগজে লেখা, আমার ভালবাসার রোকেয়া তুমি এই নায়িকার চেয়েও সুন্দর, তোমার চোখ দুটো সুন্দর, কাল টিফিনের আগে আমার দোকানের পিছনে চলে আসবে, কথা আছে।-ইতি তোমার। রোকেয়ার শরীরটা শিউরে ওঠে কি যেন কারণে। পড়া লেখায় মন বসে না, কেমন যেন মনটা ছটফট করতে থাকে। কালকের দিনটা যে কখন আসবে। রোকেয়া বোঝেনা। রোকেয়া জানে সে তেমন একটা সুন্দর না কিন্তু তারপরেও কেন যে সাজু ভাই ওর পিছে লাগল জানে না।
রাতে মেম্বার এলো। রিজুর দাদি মেম্বারকে একটা কম্বলের কথা বলল। মেম্বার আশাও দিলো, সামনের বার কম্বল এলে তাকে একটা কম্বল দেবে।
পরের দিন দুপুরের দিকে বাজারে হঠাৎ সোরগোল হতে লাগল। খবরটা আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই জানতে পারলো। স্কুল মাঠে প্রচুর লোক জমা হয়েছে। কেউ বিষয়টা নিয়ে বেশ রসালোভাবে গল্প করছে, কেউবা এর শক্ত বিচার চাচ্ছে। ঘটনাটা প্রথম দেখে স্কুলের দপ্তরি। সে হেড স্যারের জন্য চা আনতে এসেছিল এমন সময় দেখে সাজু রোকেয়াকে তার দোকানের পিছনে নিয়ে যায়। এরপর দপ্তরি বিষয়টি স্কুলে যেয়ে হেডস্যারকে জানালে সবাই স্কুল থেকে এসে দোকান ঘেড়াও করে হাতে নাতে দু’জনকে ধরে স্কুল রুমে বন্ধ করে রাখে। রোকেয়া লজ্জা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘটনাটি যেন অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রভাব না ফেলে সে জন্য চার প্রিয়ডে হেড স্যার স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। ছুটির পরে মেম্বার চেয়ারম্যানসহ গ্রামের গণ্যমান্য লোকজন শালিসে বসে। রোকেয়ার বাবা সবার কাছে আর্জি জানায় যেহেতু সে রোকেয়ার বিয়ে ঠিক করেছিল, কিন্তু আর তাকে কে বিয়ে করবে? তাই সাজু রোকেয়াকে বিয়ে করে নিলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এদিকে সাজু ও তার অভিভাবকরা বিয়ে করতে অস্বিকার করে, ফলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। লোকজনের মধ্যে একরকম হৈ-চৈ শুরু হয়। অনেকে বলে রোকেয়াদের তুলনায় সাজুর আত্বিয়-স্বজন টাকাওয়ালা হওয়ায় রোকেয়ার জন্য শক্ত বিচার পাওয়া কঠিন। চেয়ারম্যান সব শুনে বলে-শোন মজিদ মামলা মোকদ্দোমা করে আর কি হবে? শুধু যে সাজু একা দোষি তা তো নয়, এখানে তোমার মেয়েরও দোষ আছে; তাই শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ কি? তার চেয়ে বরং একটা ফয়সালা করে দেই যাতে মেয়েটাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে পারো।
লজ্জা অপমানে রোকেয়ার বাবার মুখে কোন কথা আসে না। তারপরও বলে, আপনারা গ্রামের মাথা। আপনারা যা বলবেন তাই মেনে নিতে হবে।
চেয়ারম্যান আরও দুজনকে নিয়ে জুরি বোর্ড করে সিদ্ধান্ত নেয় সাজুর এরকম কাজের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে আর এই টাকায় রোকেয়ার বিয়ে দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাজুর পরিবার জরিমানা স্বরূপ পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়ারম্যানের কাছে দিয়ে দেয়। চেয়ারম্যান তার বক্তবে বলে, যা হবার হয়েছে এগুলো নিয়ে আর কোন কথা যেন না হয়। সমস্যার সিদ্ধান্ত হয়েছে তোমরা এখন যে যার মতো চলে যাও।
সকলে বিদায় হলে চেয়ারম্যান মেম্বার ও কয়েকজন মিলে রোকেয়ার বাবার হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেয়। রোকেয়ার বাবা বোবার মতো টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রোকেয়ার বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেম্বার বলে, কি ব্যাপার মজিদ তুমি এখনও দাড়ায় আছো?
- না, মানে বিচারে তো পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলো রোকেয়াকে যেন বিয়ে দিতে পারি।
-হ্যা, ঠিক আছে।
- কিন্তু আমাকে...।
- ও শোন যারা এই শালিস করে দিলো তাদেরকে কিছু দিতে হবেনা! তাছাড়া আমরা না থাকলেতো এটাও পাইতা না ।
- আমার মেয়ের ইজ্জতের দাম এই দশ হাজার টাকা।
- দোষতো তোমার মেয়ের, সে... থাক আর কথা বলে কাজ নেই তুমি এটা নিয়া এখন যাও।
মজিদের মাথা ঘামতে থাকে, চোখ দুটো জ্বলতে থাকে। সে এই টাকা নিয়ে কি করবে? গাঁ খাটিয়ে সে সংসার চালায়। কষ্ট করে পয়সা উপার্জন করার শান্তি আর কি হয়। আর এই টাকা নিয়ে সে সারা জীবন মানুষের কাছে ছোট হয়ে রবে। ভাগ্যে যা ছিল তা তো হয়েই গেছে শুধু শুধু আর এই টাকা সে কেন গ্রহণ করবে। সে টাকাটা মেম্বারের হাতে দিয়ে রোকেয়ার হাতটা ধরে বাড়ির দিকে যেতে থাকে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৮৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/০৩/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast