মেছো ভূত
সলিম শেখের বাড়ি বনগ্রামের উত্তর দিকে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ফজলা মিয়ার ইটা ভাটা। সিজেনে দিন রাত ইটভাটার চিমনি দিয়ে ধোয়া উড়তে থাকে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, নয় বছরের এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে সে বসবাস করে। সলিম শেখ শহরে একটা দোকানে কাজ করে। কাজ শেষে প্রতিদিন প্রায় রাত দশটা এগারোটায় বাড়ি ফেরে। বাড়ি থেকে শহর প্রায় দশ বার কিলো দূরে, প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে সে যাতায়ত করে। রাত করে বাড়ি ফেরায় বউ সব সময় চিন্তায় থাকে, দিনকাল ভালোনা এতো রাত করে বাড়ি ফিরে। এই গ্রামের আরও দুজন শহরে কাজ করে বলে প্রতিদিন তাদের সঙ্গে রাতে বাড়ি ফিরে। আজকাল পথে কত ধরণের ভয় থাকে, ভূতের চেয়ে বড় ভয় মানুষকে। মানুষের মায়া দয়া নাই বললেই চলে, বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ শোনা যায় মানুষ মেরে সব কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। সাইকেল চালাতে চালাতে অন্ধকারে হঠাৎ কোন কালমুর্তি দেখলেই মনে হয় এই বুঝি সাইকেল থামিয়ে জবাই করে সব কিছু নিয়ে যাবে। প্রয়োজনের তাগিদে ওসব আমুলক চিন্তা বাদ দিয়েই পথ চলতে হয়। বর্তমানে বর্ষাকালের মাঝামাঝি সময়। বিকেলে একচোট বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা ঘাট এখনো কাদা হয়ে আছে। শহর থেকে অর্ধেকটা পথ ডির্স্টিকবোর্ডের পাকারাস্ত। এই পথটুকু আসতে তেমন কষ্ট হয় না, কিন্তু ওদের বাড়ি যেতে হলে কুমাড়পাড়া থেকে ডির্স্টিকবোর্ডের রাস্তা ছেড়ে কাচা রাস্তায় নামতে হয়। এই কাচারাস্তা ধরে কিলো তিনেক গেলেই বাড়ি। বিকালে বৃষ্টি হলেও আকাশ এখনো কাল মেঘে ঢাকা। থেকে থেকে দূরে কোথাও বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। মহাজনকে বলে আটটার দিকে সলিম বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। শহরের শেষ প্রান্তে ওদের গ্রামের দিকে যে পথটি শহরে এসে মিলিত হয়েছে, সেখানেই একে অন্যের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে। এই রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে সময় কাটিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে তবে রওনা দেয়া হয়। আজ এই কাদেরের চায়ের দোকানে এসে শোনে মাসুদ আধ ঘন্টা হলো ওর এক ভাইয়ের মটর সাইকেলে চড়ে গেছে। তাহলে আজ আর কারো অপেক্ষা করে শুধু শুধু রাত করার দরকার নেই, কেননা আজ আবার উত্তমটা আসেনি। ওর বাড়িতে কি সব উৎসব চলছে। সলিম এক কাপ চা খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে থাকলো। শহরের কৃতিম আলো শেষ হতেই পৃথিবীর সব অন্ধকার যেন ঝুপ করে পড়ল। সাইকেল চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়ল। সে প্যান্টের পকেট হাতড়ে গ্যাস লাইটটা বের করল। এই গ্যাস লাইট কোম্পানীদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, কেননা এই গ্যাস লাইটের সঙ্গে বাতি জুড়ে দিয়ে জনগণের দারুণ সুবিধে করে দিয়েছে। এক হাতে গ্যাস লাইট জ্বালিয়ে পথ চলতে থাকলো। পথে কিছু দূরের জন্য একজন লোক পেল ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে। গল্পে গল্পে অনেকটা পথ সেই লোকের সঙ্গে সে চলে এলো। অই লোকটা অন্যদিকে চলে যেতেই আবার নিঃশব্দ গ্রাম তাকে গিলে ফেলল। পথে হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, না জানি কখন চাকুর ফলা এসে শরিরে বিঁধে যায়।
ডিস্ট্রিকবোর্ডের রাস্তা ছেড়ে সে এখন নিজ গ্রামের কাছা কাছি চলে এসেছে। রাস্তার বামে দু'চোখ জুড়ে শুধু ধানক্ষেত আর ডানে নদীর একটা ছোট শাখা কিছু দূর দিয়ে বয়ে চলেছে। এই নদীতে বেশ মাছ পাওয়া যায়। এই শাখা নদীটি থেকে আবার একটি বড় খালের মতো জায়গায় এসে মিশেছে। এটাকে গ্রামে লোকেরা বলে মাষানের কুড়া। অনেকে বলে এইখানে নাকি মাষান থাকে, তাই এটার নাম মাষানের কুড়া। সলিম সাইকেলে যেতে যেতে হঠাৎই লক্ষ করল এই মাষানের কুড়াতে যেন আজ মাছেদের হৈ হুল্লুর বেধে গেছে। বড় বড় মাছেরা দাপা দাপি করছে। দৃশ্যটা দেখে সলিম অবাক হলো, এতো মাছ! সে তারা তারি বাড়ি গিয়ে একটু মুখে দিয়ে পাশের বাড়ির মাসুদকে ডেকে তুলল।
সলিম- শোন দেরি করিস না, তারাতারি জালটা নিয়া বের হ। মাষানের কুড়াত যে মাছ দেখছি তা ধরবার পাইলে গুটি ফিট।
মাসুদ - কিন্তু অটে প্রায় মানুষ ভয় পায় জানেন না?
সলিম- ধুর! তুই এলাও ভূতের ভয় পাইস। চার দিকে কারেন্টের কত আলো, এই আলোর মধ্যে ভূতেরা এখনও আছে?
প্রথমে মাসুদ মাছ ধরতে যেতে না চাইলেও পড়ে কি ভেবে বেড়িয়ে পড়ল। মাসুদ সম্পর্কে হয় সলিম শেখের ভাইস্ত। সুঠাম দেহের অধিকারী মাসুদ এবার বিএ পরীক্ষা দিবে। মনটা সরল আর অনেকটা ভিতু স্বভাবের হওয়ায় সলিম শেখ মাসুদকে খুব পছন্দ করে। দিন বদলেছে, তাই আগের মতো এখন হ্যাচাক লাইটের পরিবর্তে এখন চার্জর লাইট নিয়ে তারা দুজন মাষান কুড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আকাশে চাঁদ থাকলেও ভাষমান কালো মেঘের কারণে প্রায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দুজনে কাঁচা রাস্তা ছেড়ে জমির আল ধরে কুড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাষান কুড়ার উপরে দৈত্যের মতো বিশাল একটা পাইকুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার রাতে গাছটির দিকে তাকালে অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তখন মাষান কুড়ার পানিকে মনে হয় জমে থাকা কালো রক্তের মতো। বিলের কাছা কাছি আসতেই হঠাৎ আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল। মাষান কুড়ার স্বচ্ছ পানিতে বড় বড় মাছদের কালো কালো পিঠ আর রূপালী আশের ঝলকানি দেখে সলিম শেখ মাসুদের হাত টেনে ধরে,
সলিম- ঐ দেখ কত বড় বড় মাছ! ধরতে পারলে কালকে কমপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা বেচাঁ যাবে। শব্দ না করে আস্তে আস্তে যেতে হবে।
মাসুদ এতো মাছ দেখে বোবা হয়ে গেছে। সে সলিম শেখের কথা মন দিয়ে শুনলো। কথামতো দুইজন দুই পাশ থেকে মুঠজাল ফেলল। জাল টেনে টেনে দুইজন আবার একত্র হয়ে জাল টেনে তুলল। জালে টান পড়তেই মাছেরা যেন জাল ছিড়ে বেরিয়ে যাবে সে রকম তান্ডব শুরু করল। সেলিম শেখ চিৎকার করে বলল- পায়ের গোড়ালী শক্ত করি মাটির মধ্যে গাঁথি জাল টানতে থাক। সাবধান জাল ছাড়ি দিস না, হাতটা শক্ত করি ধরি রাখ।
মাসুদ সেভাবেই জালটাকে নিজের হাতের মধ্যে রেখে টানতে লাগল। জাল যখন উপরে তুলল তখন জালে এই বড় বড় বেশ কয়েকটা মাছ। এই মাছ পাতিলে রাখা যাবেনা, লাফ দিয়ে পালাবে তাই সে মাছের কানসাকার ভিতর দিয়ে জমিতে পড়ে থাকা খড় দিয়ে রশি বানিয়ে বেধে পাতিলে রাখলো। পাতিলটা রেখে আর একবার জাল ফেলে পাতিলের কাছে ফিরে এসে দেখে কোন মাছ নেই শুধু খড়ের আশগুলো পড়ে আছে। মাসুদ চিৎকার করে বলে- চাচা, হাড়ির মধ্যে মাছতো নাই।
সলিম - কি কইস তুই!
মাসুদ- হ চাচা, হাড়ি ফাঁকা।
সলিম - মনে হয় সব মাছ লাফদিয়া চলিগেছে, এক কাজ কর হাড়িটা সাথে নিয়া আয়। তাড়াতাড়ি জাল টান, আর কেউ আসার আগে আমাদের মাছ ধরা শেষ করতে হবে।
মাসুদ আর সলিম শেখ আবারও জাল টানতে থাকে। জালে টান পড়তেই বেশ বড়সরো একটা মাছ জালের মধ্যে দাপাদাপি করতে লাগল, মনে হয় জালটা এখনি ছিড়ে ফেলবে ।
সলিম - ভাইস্তা জালটা শক্ত করি ধর, মাছ যেন বের হবার না পারে। এবার মনে হয় বড় মাছটাই ফানছে।
মাসুদের শরীরের শক্তি দিয়ে জালটা শক্ত করে ধরে টেনে তুলতে থাকে। মাছটাকে দেখা যাচ্ছে মনে হয় রুই মাছ।
মাসুদ- চাচা ধইরেন, এই মাছের খুব শক্তি।
সলিম - ঠিক আছে, আমি আছি।
জালটা ডাঙায় তুলতে মাছেরা লাফা লাফি করতে লাগল। আরি বাপরে, এত্তো বড় মাছ! চাচা আপনি হাড়িটা শক্ত করে ধরে থাকেন আমি মাছগুলো ঢালছি। বলে মাসুদ বেশ কিছু মাছ বড় হাড়িটার মধ্যে ঢেলে দিলো।
মাসুদ- চাচা আপনি এখানে থাকেন আমি জাল ফেলছি, না হয় আবার দেখা যাবে হাড়ি থেকে মাছ গায়েব হয়ে গেছে।
সলিম -আচ্ছা তুই যা, আমি আছি।
মাসুদ জাল নিয়ে যায়। দুই তিনবার জাল ফেলতেই হাড়ি প্রায় ভর্তি হয়েগেল।
সলিম - ভাইস্তা, যা পাইছি অনেক পাইছি এবার চল।
মাসুদ- চাচা এটাই শেষ খ্যাও দিয়া উঠি। আর একটা বড় মাছ আমার চোখে পড়ছে, ওটাকে ধরতে পারলে মনে হয় আর লাগবে না।
সলিম - ঠিক আছে, বেশি দূর যাসনা।
মাসুদ জালটা নিয়ে পানির মধ্যে আস্তে আস্তে হাটতে থাকে। পানিতে অনেকক্ষণ ঘোড়া ঘুড়ি করে হঠাৎই চোখে পড়ল মাছটাকে। এর আগেও দু বার ধরতে পারেনি। মনে হয় বোয়াল মাছ হবে। পিঠটা বেশ চওড়া, কমপক্ষে এক মানুষ সমানতো হবেই। চাঁদের আলো মাষানের কুড়ার পানিতে পড়ে চকচক করছে। মাসুদ আস্তে আস্তে মাছটাকে লক্ষ করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মাছটা যেন আয়েত্তের মধ্যেই আসেনা। মাসুদ যেতে যেতে বুড়া বটগাছটার কাছে চলে আসে, এখানে পানিও ক্রমশ গলা সমান হয়ে গেছে। কিন্তু মাছটা আরো এগিয়ে যাচ্ছে। মাসুদ হয়তো আরও কিছু দূর যেতো কিন্তু হঠাৎই যেন হুশ ফিরে পায়, দ্রæত ভাবে সে কোথায় যাচ্ছে? সামনেই তো গভির খাদ। ওখানে যেই গেছে এই পর্যন্ত সেই বেঁচে ফিরতে পারেনি। এই ভাবনা ভাবতেই যেন মাছটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আর এক মুহুর্ত দেরি না করে সে পিছন দিকে ফিরতে লাগল কিন্তু মনে হলো কে যেন তার পা ধরে ফেলেছে। নিজেকে প্রাণপন ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আরও যেন শক্ত করে চেপে ধরেছে তার পা, এবার মনে হলো তার পা ধরে বেশি পানির দিকে টানতে লাগল। মাসুদ এবার যেন একটু ভয় পেয়েগেল, সে জোড়ে সলিম শেখকে ডাকতে লাগল। কিন্তু একি! তার কণ্ঠও যেন রুদ্ধ হয়েগেছে, মুখ দিয়ে চিৎকার বের হচ্ছে না। পানিতে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে সে নিজেকে বলতে থাকে যেভাবেই হোক এখান থেকে মুক্ত হতে হবে, তাই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মাসুদের বিশ্বাস ফিরে পেতেই যেন মনের জোড় বেড়ে গেল, সে জালটা হাত থেকে ছাড়িয়ে ডুব দিয়ে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে সাতরে ডাঙায় উঠে এলো। ডাঙায় উঠে কিছুটা জিড়িয়ে দৌঁর দিল যেখানে সলিম শেখ বসে আছে সেখানে। কাছা কাছি আসতে মাসুদ থমকে দাঁড়ালো, চাচার সাথে ওটা কে? মনে হচ্ছে হাড়ি খুলে কাচা মাছ খাচ্ছে। মাসুদ চিৎকার দিয়ে বলে- চাচা তোমার সাথে ওটা কে। সলিম শেখ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পেছন ফিরে দেখে একটা কুতকুতে কালো মতোন হাড়ির মাছ সাবার করছে। হঠাৎই সলিম শেখ দেশলাই জ্বালাতেই ভূতটা হাওয়ার মিলিয়ে যায়।
সলিম - তুই ঐদিক থেকে কিভাবে আসলি? আমি তো দেখলাম তুই আমার পাশে বসে কথা বলছিস।
মাসুদ- কি কও চাচা! আমি তো অল্পের জন্য বাচি গেছি।
সলিম - মানে তোর কি হয়েছিল?
মাসুদ- একটা মাছের পিছন পিছন যেতে যেতে পাকের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। যেই হুশ হলো অমনি দেখলাম কে যেন আমার পা টানি ধরেছে। কোন রকম ধ্বস্তা ধস্তি করে বাঁচি আসছি।
সলিম - অনেক হইছে চল আর এখানে থাকার দরকার নাই।
যে ক’টা মাছ ছিলো তাই নিয়ে ওরা ফিরে আসে।
ডিস্ট্রিকবোর্ডের রাস্তা ছেড়ে সে এখন নিজ গ্রামের কাছা কাছি চলে এসেছে। রাস্তার বামে দু'চোখ জুড়ে শুধু ধানক্ষেত আর ডানে নদীর একটা ছোট শাখা কিছু দূর দিয়ে বয়ে চলেছে। এই নদীতে বেশ মাছ পাওয়া যায়। এই শাখা নদীটি থেকে আবার একটি বড় খালের মতো জায়গায় এসে মিশেছে। এটাকে গ্রামে লোকেরা বলে মাষানের কুড়া। অনেকে বলে এইখানে নাকি মাষান থাকে, তাই এটার নাম মাষানের কুড়া। সলিম সাইকেলে যেতে যেতে হঠাৎই লক্ষ করল এই মাষানের কুড়াতে যেন আজ মাছেদের হৈ হুল্লুর বেধে গেছে। বড় বড় মাছেরা দাপা দাপি করছে। দৃশ্যটা দেখে সলিম অবাক হলো, এতো মাছ! সে তারা তারি বাড়ি গিয়ে একটু মুখে দিয়ে পাশের বাড়ির মাসুদকে ডেকে তুলল।
সলিম- শোন দেরি করিস না, তারাতারি জালটা নিয়া বের হ। মাষানের কুড়াত যে মাছ দেখছি তা ধরবার পাইলে গুটি ফিট।
মাসুদ - কিন্তু অটে প্রায় মানুষ ভয় পায় জানেন না?
সলিম- ধুর! তুই এলাও ভূতের ভয় পাইস। চার দিকে কারেন্টের কত আলো, এই আলোর মধ্যে ভূতেরা এখনও আছে?
প্রথমে মাসুদ মাছ ধরতে যেতে না চাইলেও পড়ে কি ভেবে বেড়িয়ে পড়ল। মাসুদ সম্পর্কে হয় সলিম শেখের ভাইস্ত। সুঠাম দেহের অধিকারী মাসুদ এবার বিএ পরীক্ষা দিবে। মনটা সরল আর অনেকটা ভিতু স্বভাবের হওয়ায় সলিম শেখ মাসুদকে খুব পছন্দ করে। দিন বদলেছে, তাই আগের মতো এখন হ্যাচাক লাইটের পরিবর্তে এখন চার্জর লাইট নিয়ে তারা দুজন মাষান কুড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আকাশে চাঁদ থাকলেও ভাষমান কালো মেঘের কারণে প্রায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দুজনে কাঁচা রাস্তা ছেড়ে জমির আল ধরে কুড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাষান কুড়ার উপরে দৈত্যের মতো বিশাল একটা পাইকুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার রাতে গাছটির দিকে তাকালে অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তখন মাষান কুড়ার পানিকে মনে হয় জমে থাকা কালো রক্তের মতো। বিলের কাছা কাছি আসতেই হঠাৎ আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল। মাষান কুড়ার স্বচ্ছ পানিতে বড় বড় মাছদের কালো কালো পিঠ আর রূপালী আশের ঝলকানি দেখে সলিম শেখ মাসুদের হাত টেনে ধরে,
সলিম- ঐ দেখ কত বড় বড় মাছ! ধরতে পারলে কালকে কমপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা বেচাঁ যাবে। শব্দ না করে আস্তে আস্তে যেতে হবে।
মাসুদ এতো মাছ দেখে বোবা হয়ে গেছে। সে সলিম শেখের কথা মন দিয়ে শুনলো। কথামতো দুইজন দুই পাশ থেকে মুঠজাল ফেলল। জাল টেনে টেনে দুইজন আবার একত্র হয়ে জাল টেনে তুলল। জালে টান পড়তেই মাছেরা যেন জাল ছিড়ে বেরিয়ে যাবে সে রকম তান্ডব শুরু করল। সেলিম শেখ চিৎকার করে বলল- পায়ের গোড়ালী শক্ত করি মাটির মধ্যে গাঁথি জাল টানতে থাক। সাবধান জাল ছাড়ি দিস না, হাতটা শক্ত করি ধরি রাখ।
মাসুদ সেভাবেই জালটাকে নিজের হাতের মধ্যে রেখে টানতে লাগল। জাল যখন উপরে তুলল তখন জালে এই বড় বড় বেশ কয়েকটা মাছ। এই মাছ পাতিলে রাখা যাবেনা, লাফ দিয়ে পালাবে তাই সে মাছের কানসাকার ভিতর দিয়ে জমিতে পড়ে থাকা খড় দিয়ে রশি বানিয়ে বেধে পাতিলে রাখলো। পাতিলটা রেখে আর একবার জাল ফেলে পাতিলের কাছে ফিরে এসে দেখে কোন মাছ নেই শুধু খড়ের আশগুলো পড়ে আছে। মাসুদ চিৎকার করে বলে- চাচা, হাড়ির মধ্যে মাছতো নাই।
সলিম - কি কইস তুই!
মাসুদ- হ চাচা, হাড়ি ফাঁকা।
সলিম - মনে হয় সব মাছ লাফদিয়া চলিগেছে, এক কাজ কর হাড়িটা সাথে নিয়া আয়। তাড়াতাড়ি জাল টান, আর কেউ আসার আগে আমাদের মাছ ধরা শেষ করতে হবে।
মাসুদ আর সলিম শেখ আবারও জাল টানতে থাকে। জালে টান পড়তেই বেশ বড়সরো একটা মাছ জালের মধ্যে দাপাদাপি করতে লাগল, মনে হয় জালটা এখনি ছিড়ে ফেলবে ।
সলিম - ভাইস্তা জালটা শক্ত করি ধর, মাছ যেন বের হবার না পারে। এবার মনে হয় বড় মাছটাই ফানছে।
মাসুদের শরীরের শক্তি দিয়ে জালটা শক্ত করে ধরে টেনে তুলতে থাকে। মাছটাকে দেখা যাচ্ছে মনে হয় রুই মাছ।
মাসুদ- চাচা ধইরেন, এই মাছের খুব শক্তি।
সলিম - ঠিক আছে, আমি আছি।
জালটা ডাঙায় তুলতে মাছেরা লাফা লাফি করতে লাগল। আরি বাপরে, এত্তো বড় মাছ! চাচা আপনি হাড়িটা শক্ত করে ধরে থাকেন আমি মাছগুলো ঢালছি। বলে মাসুদ বেশ কিছু মাছ বড় হাড়িটার মধ্যে ঢেলে দিলো।
মাসুদ- চাচা আপনি এখানে থাকেন আমি জাল ফেলছি, না হয় আবার দেখা যাবে হাড়ি থেকে মাছ গায়েব হয়ে গেছে।
সলিম -আচ্ছা তুই যা, আমি আছি।
মাসুদ জাল নিয়ে যায়। দুই তিনবার জাল ফেলতেই হাড়ি প্রায় ভর্তি হয়েগেল।
সলিম - ভাইস্তা, যা পাইছি অনেক পাইছি এবার চল।
মাসুদ- চাচা এটাই শেষ খ্যাও দিয়া উঠি। আর একটা বড় মাছ আমার চোখে পড়ছে, ওটাকে ধরতে পারলে মনে হয় আর লাগবে না।
সলিম - ঠিক আছে, বেশি দূর যাসনা।
মাসুদ জালটা নিয়ে পানির মধ্যে আস্তে আস্তে হাটতে থাকে। পানিতে অনেকক্ষণ ঘোড়া ঘুড়ি করে হঠাৎই চোখে পড়ল মাছটাকে। এর আগেও দু বার ধরতে পারেনি। মনে হয় বোয়াল মাছ হবে। পিঠটা বেশ চওড়া, কমপক্ষে এক মানুষ সমানতো হবেই। চাঁদের আলো মাষানের কুড়ার পানিতে পড়ে চকচক করছে। মাসুদ আস্তে আস্তে মাছটাকে লক্ষ করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মাছটা যেন আয়েত্তের মধ্যেই আসেনা। মাসুদ যেতে যেতে বুড়া বটগাছটার কাছে চলে আসে, এখানে পানিও ক্রমশ গলা সমান হয়ে গেছে। কিন্তু মাছটা আরো এগিয়ে যাচ্ছে। মাসুদ হয়তো আরও কিছু দূর যেতো কিন্তু হঠাৎই যেন হুশ ফিরে পায়, দ্রæত ভাবে সে কোথায় যাচ্ছে? সামনেই তো গভির খাদ। ওখানে যেই গেছে এই পর্যন্ত সেই বেঁচে ফিরতে পারেনি। এই ভাবনা ভাবতেই যেন মাছটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আর এক মুহুর্ত দেরি না করে সে পিছন দিকে ফিরতে লাগল কিন্তু মনে হলো কে যেন তার পা ধরে ফেলেছে। নিজেকে প্রাণপন ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আরও যেন শক্ত করে চেপে ধরেছে তার পা, এবার মনে হলো তার পা ধরে বেশি পানির দিকে টানতে লাগল। মাসুদ এবার যেন একটু ভয় পেয়েগেল, সে জোড়ে সলিম শেখকে ডাকতে লাগল। কিন্তু একি! তার কণ্ঠও যেন রুদ্ধ হয়েগেছে, মুখ দিয়ে চিৎকার বের হচ্ছে না। পানিতে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে সে নিজেকে বলতে থাকে যেভাবেই হোক এখান থেকে মুক্ত হতে হবে, তাই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মাসুদের বিশ্বাস ফিরে পেতেই যেন মনের জোড় বেড়ে গেল, সে জালটা হাত থেকে ছাড়িয়ে ডুব দিয়ে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে সাতরে ডাঙায় উঠে এলো। ডাঙায় উঠে কিছুটা জিড়িয়ে দৌঁর দিল যেখানে সলিম শেখ বসে আছে সেখানে। কাছা কাছি আসতে মাসুদ থমকে দাঁড়ালো, চাচার সাথে ওটা কে? মনে হচ্ছে হাড়ি খুলে কাচা মাছ খাচ্ছে। মাসুদ চিৎকার দিয়ে বলে- চাচা তোমার সাথে ওটা কে। সলিম শেখ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পেছন ফিরে দেখে একটা কুতকুতে কালো মতোন হাড়ির মাছ সাবার করছে। হঠাৎই সলিম শেখ দেশলাই জ্বালাতেই ভূতটা হাওয়ার মিলিয়ে যায়।
সলিম - তুই ঐদিক থেকে কিভাবে আসলি? আমি তো দেখলাম তুই আমার পাশে বসে কথা বলছিস।
মাসুদ- কি কও চাচা! আমি তো অল্পের জন্য বাচি গেছি।
সলিম - মানে তোর কি হয়েছিল?
মাসুদ- একটা মাছের পিছন পিছন যেতে যেতে পাকের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। যেই হুশ হলো অমনি দেখলাম কে যেন আমার পা টানি ধরেছে। কোন রকম ধ্বস্তা ধস্তি করে বাঁচি আসছি।
সলিম - অনেক হইছে চল আর এখানে থাকার দরকার নাই।
যে ক’টা মাছ ছিলো তাই নিয়ে ওরা ফিরে আসে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শুভজিৎ বিশ্বাস ১৮/০৩/২০২২চমৎকার
-
Md. Rayhan Kazi ১৩/০৩/২০২২অনন্য সাধারণ
-
এস. কে. সুবল চন্দ্র মামাহাত্ম্য ১১/০৩/২০২২অসাধারণ লেখেন। শুভকামনা রইল।
-
ফয়জুল মহী ০৯/০৩/২০২২চমৎকার
মুগ্ধ হলাম পাঠে। -
আব্দুর রহমান আনসারী ০৯/০৩/২০২২চমৎকার লেখনী। অনুপম ভাব ও ভাবনা।