www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিষকাঁটা

হঠাৎই ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। আকাশে খুব বেশি মেঘ ছিল তা বলা যাবেনা, কিছুক্ষণ আগেও বৃষ্টি আসবে এরকম কিছু মনে হয়নি কিন্তু বৃষ্টি নামল। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে নিজেকে বেশ উদাস উদাস মনে হতে লাগলো। প্রায় সাত আট বছর পর গ্রামে এলাম। গ্রাম বলতে মামার বাড়ি। আগে এটা ছিল নানার বাড়ি। নানা নানী কেউ না থাকায় এটা এখন মামার বাড়ি। আমার মায়ের কিছু জমি জমা থাকলেও মামারা এব্যাপারে কিছু বলতে চান না। আমি অবশ্য জমি জমার ব্যাপারে গ্রামে আসিনি, এসেছি অনেকটা শিকড়ের টানে। বেশ কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল একবার এখানটায় আসি, তাই অনেক চেষ্টা ও সময় বের করে চলে এলাম। ব্যক্তিগত জীবনে কয়েকটা চাকরি ছেড়ে বর্তমানে একটি টিভি চ্যানেলের রিপোটারের কাজ করছি। স্ত্রী পুত্রদের রেখে একাই চলে এসেছি গ্রামে দু'টো দিন থাকবো বলে। গ্রামের পরিবেশ বলতে শহুরে মানুষদের মতো এখানে খুব একটা ব্যস্ততার প্রতিযোগিতা থাকে না। ক্ষেতে খামারে কাজ সেরে অবসর সময় চায়ের দোকানেই কাটিয়ে দেয়। এই চায়ের দোকানেই কথা হয় অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতিসহ দেশ ভাবনা। আমারও চায়ের তেষ্টা পেয়ে বসে, তাই চলে আসি। দোকানের এক কোনায় বসে দু’একটা গোলগোল­া (মিষ্টির মতো গোল আটা দিয়ে বানানো পিঠা) খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেই। বৃষ্টির খবর আমি রাখতে পারিনি বলে বৃষ্টি নামলো। আর রেখেই বা কি; গ্রামে এসেছি অলস সময় কাটাবো বলে, সেখানে বৃষ্টি আসলেই বা কি এসে যায়? এই বাজার থেকে মামা বাড়ি নিকটেই প্রায়। নানা এই এলাকার একজন প্রভাবশালী লোক ছিলেন। বাজারের উপরে যে হাইস্কুলটা আছে সেটা নানাই তার জমিতে তৈরি করে গেছেন। আশে পাশের দু এক গ্রামের মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন। এই গ্রামের পূর্বে স্রোতসিনী ব্রহ্মপুত্র নদী বীর দর্পে ছুটে চলছে। আমার অনেক বন্ধুও ছিল এই গ্রামে। যদিও এখন তাদের চেহারা আর তেমন একটা মনে করতে পারিনা। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছেই গ্রামের ক্ষেত খামাড় গাছপালা যেন আনন্দে আত্মহারা। ধানক্ষেতগুলো বাতাসে নুয়ে পড়ছে। পথের ধারে বিষকাটালীর গাছগুলো অনেকদিন পর যেন হা করে বৃষ্টির জল খাচ্ছিল। বাতাসের ঝাপটায় মাঝে মধ্যে আমাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছিল। দোকানের লোকটি এসে জানালাটা বন্ধ করতে চেয়েছিল আমি দেইনি। গ্রামে বৃষ্টি দেখা মানে সুন্দর একটি মুহুর্ত উপভোগ করা। বহুদূর পর্যন্ত ক্ষেত, দু’চারজন কৃষক বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করছে। কয়েকটা ল্যাংটা বালক হৈ হৈ করে ক্ষেতের মাঝে ছুটে বেড়াচ্ছে।
- বাপজান আপনাকে একটু বিরক্ত করি।
লোকটির কথা আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি। আবারও বলতেই আমি বাহির থেকে চোখ ফিড়িয়ে লোকটির দিকে তাঁকালাম। বেশ বয়স্ক একটি হাড় জিড় জিড়ে লোক। গায়ে কোকড়ানো একটা পাঞ্জাবি। মুখে সফেদ সাদা দাড়ি। আমি লোকটিকে বললাম -জি বসুন। আমাকে কিছু বললেন?
- জি বাবা। আপনাকেই বলছিলাম।
- বেশ বলুন?
- না, মানে বাবা আপনাকে নতুন দেখতেছি।
- ও, আমি কছিম উদ্দিনের নাতী।
লোকটা বিস্ময়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো।
- আপনি কি চা খাবেন?
- না বাজান, চা আমি এখন খাবো না। আপনারা তাহলে লালমনিরহাট শহরে থাকেন?
- জি।
- শুনছি আপনি টেলিভিশনের সাংবাদিক।
- জি আমি টেলিভিশনের সাংবাদিক।
- যা হোক আপনাকে পেয়েছি ভালই হয়েছে। আমার পরিচয় দিলে চিনবেন না।
দূর থেকে একজন দাড়িওয়ালা লোক আমার দিকে তাঁকিয়ে ছিল, সে এবার উঠে এসে বলল - কেন চিনবে না মামা, পলাশ আপনার আত্মিয় চিনবে না কেন।
লোকটার মুখে আমার নাম শুনে আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটা বুঝতে পেরেছে আমি তাকে চিনতে পারিনি। লোকটাই বলল আমি বাসেদ, আপনার সাথে ছোটবেলায় কত খেলছি।
আমি হেসে বললাম- কেন চিনতে পারবো না। বসো চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে।
বাসেদ- আর কথা! সব কথাই যেন আজকাল হারায় গেছে।
পলাশ- কেন, কিসের এতো হতাশা?
বাসেদ- সে থাক, ইনি আপনার মামা হবেন। বলে লোকটাকে দেখিয়ে দিল।
পলাশ- জি মামা, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
লোকটি একটু হেসে বলল- কি করবা বাজান, আমাকে একটা দরখাস্ত লেখে দিলে খুব খুশি হবো।
পলাশ- বেশ লিখে দিচ্ছি।
লোকটার সঙ্গে থাকা পলিথিনের ব্যাগটা খুলে এক তা সাদা কাগজ বের করে দিয়ে বললেন- বাজান, আমার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করার জন্য জেলা কমান্ডারের কাছে যোগাযোগ করেছিলাম সে আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চায়। আমার টাকা থাকলে কি আর আমার এই অবস্থা হয়। আপনি বলতে পারবেন না, এই যে এরা বা আপনার মামাও জানে মুক্তিযুদ্ধের সময় কতো অত্যাচার আমি সহ্য করেছি। যুদ্ধও করেছি, তখন তো এতো কিছুু বুঝি নাই, তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নামও ওঠে নাই। খুব একটা দরকারও ছিলো না, কিন্তু আমার এতো বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়েগুলো অল্প কিছু পড়া লেখা করলেও কোন চাকরি বাকরি পায়নি। শেষ বয়সে আমিও খুব অর্থ কষ্টে আছি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা নামটা একটা সম্মানের ও গর্বের। আমার এখনো গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়, এই বাজার থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাঁচদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে কতো যে নির্যাতন করেছে সে কথা এখন মুখেও বলতে পারবো না। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করে অনেক সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে কিন্তু আমরা দৌড় ঝাপ করতে পারিনা বলে আমাদের কিছু হয় না। ছোট জামাই বিএ পাশ করে বাড়িতে হাল চাষ করে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাকে নিয়ে কটু কথা বলে। যুদ্ধ না করেও যদি অনেকে মুক্তিযোদ্ধারা সার্টিফিকেট পায়, ভাতা পায় তবে নির্যাতন স্বয়ে যুদ্ধ করেও আমার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠবে না।
পলাশ- আপনি কোথায় আবেদন পাঠাবেন?
- আমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবো। দেখি কিছু হয় কি না।
পলাশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল- আমাদের স্বাধীনতা আর মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করেছেন, নিজের রক্তে সূচিত করেছেন স্বাধীন স্বার্বভৌমত্ব। আপনাকে নিযে আমি আর একটা যুদ্ধ করবো।
বৃদ্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাঁকায়।
পলাশ- এ যুদ্ধ হবে আপনার পাওনা ফিরিয়ে দেবার যুদ্ধ।
আকাশ পরিস্কার হতে শুরু করেছে। পলাশ সঙ্গে থাকা ক্যামেরাটা অন করে বৃদ্ধের ভাঁজপড়া মুখের দিকে ক্যামেরার লেন্স ঠিক করে সংবাদে লাইভ কাস্টিং করতে থাকে। কিছুক্ষণ আগের থম থমে মেঘলা আকাশ রোদে রোদে ভরে গেছে। ক্যামেরায় চলতে থাকে বৃদ্ধের চোখের জলে দাবী আদায়ের আকুতি।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০২/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast