ফিরে আসা
টুনটুনির বাবা মিলন ঢাকার গাজীপুরে গার্মেন্টসে অপারেটরের কাজ করে। টুনটুনিরা দুই বোন। টুনটুনি এবার আছিয়া খাতুন হাইস্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। ছোট বোনটির নাম বাবলি। সে সবে অ আ ক খ পড়ে। কুলাঘাটের উত্তর পাড়ায় টুনটুনিদের বাড়ি। টুনটুনি রোজ ধরলা নদী ঘেষে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যায়। টুনটুনির মা শেফালী সুযোগ পেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে স্কুলে যায়। বেশিরভাগ সময় টুনটুনি একাই পাড়ার অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করে। বাড়িতে বাবা না থাকলেও ওর দাদী তাকে বেশ আদর করে। বাড়িতে একটা মোবাইল আছে, সেই মোবাইলে টুনটুনির বাবা রোজ ফোন দিয়ে একবার করে খোঁজ খবর নেয়। টাকা পয়সা মোবাইলেই পাঠিয়ে দেয়, মা সে টাকা বাজারের দোকান থেকে উঠিয়ে আনে।
শেফালী বাড়ির উঠনে সিদ্ধ ধানগুলো শুকাতে দিয়েছে। বর্ষা আসছে ঘরে কিছু থাক না থাক অন্তত চাউল থাকা দরকার। চাউল থাকলে অন্তত ভাতটা মুখে চড়বে। টুনটুনির দাদী আমগাছটার নিচে বসে কাঁথা সেলাই করছে। এমন সময় পাশের বাড়ির রহিমের বৌ ফুলমতি এলো।
ফুলমতি : খালাম্মা এই কাথা কি তোমার নাত জামাইরে দিবা নাকি?
অমিচান পান চিবুতে চিবুতে বলে: মোর নাত জামাই নিয়া তোর চিন্তা ক্যান? তুইকি বিয়াইয়ের গলাধরি শুইতবার চাইস নাকি?
ফুলমতি : তোমার সাথে কথা কওন দায়।
শেফালী ধানগুলো পা দিয়ে পান হাতে করে নিয়ে ফুলমতিকে দেয়।
শেফালী : কি হইছে রে বু?
ফুলমতি : কি আর হইবে? খবর খুব একটা ভাল না।
শেফালী : ক্যান কি হইল আবার?
ফুলমতি : বু তোর ভাই রাইতোত কবার নাকছে কি নাকি একটা ভাইরাস আইসবার নাগছে। নানান দেশেত নাকি মানুষ মইরবার নাগছে।
শেফালী চমকে ওঠে : কি কবার নাগছিস?
ফুলমতি : হ বু।
অমিচান : আরে থো তো উয়ার কতা। ছাগলটা রোজ ম্যা ম্যা করে।
ফুলমতি : না খালা, মুই মিছা কথা কবার নাগছোং না। স্কুল কলেজ বন্ধ হবার নাগছে। আল্লাহ জানে কি যে হইবে বু।
শেফালী : টিভিত খবরত কি কবার নাগছে?
ফুলমতি : কায় জানে, বাজারোত যায় দেখা নাগবে।
এমন সময় টুনটুনি দৌঁড়ে আসবে।
টুনটুনি : মা, মা।
শেফালী চমকে ওঠে। ক্যারে কি হইছে?
টুনটুনি : মা ইস্কুল বন্ধ দিয়া দিছে।
শেফালী : ক্যান কি হইছে?
টুনটুনি : তা বলতে পারছি না। তবে শুনলাম কি অসুখে নাকি মানুষ মরতেছে। ঢাকায় ইস্কুলে ছাত্র অসুস্থ হয়ে গেছে।
শেফালী টুনটুনিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমু খেয়ে বলে তোর কোনটে যাওয়ার দরকার নাই।
ফুলমতি : থাক বু পরে আসিম, দেখি বাবলুটা বাড়িত আসলো কি না।
ক্রমশ পরিস্থিতি খারাপ হতে লাগলো। প্রতিদিন এর ওর মুখে মানুষ মরার খবর শুনে শেফালীর অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। টুনটুনির বাবার সাথে কথা হয় খুব কম। ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। শেফালী টুনটুনির বাবাকে বাড়ি আসার জন্য বলে। কিন্তু তার এক কথা সামনে রমজান মাস ঈদ আসতেছে এখন বাড়ি কি ভাবে যায়। তাছাড়া বছরের এই সময়টা শিপমেন্ট থাকায় কাজের চাঁপও বেশি থাকে। শেফালী হঠাৎ একদিন শোনে ঢাকার সব কল কারখানা বন্ধ দিয়েছে। ঢাকা থেকে কেউ বাহিরে যেতে পারছে না। চিন্তায় সে রাতে ঠিক মতো ঘুমায় না। বেতন বোনাস সব বন্ধ। টুনটুনির দাদীর একদিন খুব পেটে ব্যাথা আর বমি। শেফালী দিশেহারা হয়ে যায় কি করবে? ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকান পাঠ বন্ধ। সে বাজারের ওষুধের দোকান থেকে ওষধ এনে খাইয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। গ্রামের ডাক্তার বলে দিয়েছে তাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু শহরে অটো রিক্সা খুব কম যাওয়া আসা করে। যেগুলোও যায় অসুস্থ্য মানুষের কথা শুনলে আরও যেতে চায় না। বুড়ি ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে। সলিম মিয়ার ভ্যানে করে শহরের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখে বলে দিয়েছে লিভারের সমস্যা, অপারেশন করতে হবে। কিন্তু এখন অপারেশন সম্ভব নয়। কেননা সার্জারির ডাক্তার আসতো অন্য জেলা থেকে তারা এখন আর আসছে না, তাই ব্যাথার ওষুধ দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে। রোজ রাত হলে ব্যাথাটা আরও বেশি হয় অমিচান চিৎকার করতে থাকে। নিরুপায় শেফালী কি করবে বুঝতে পারেনা।
টুনটুনির মনটা ভালনা। অনেকদিন স্কুল বন্ধ। রমজান মাস এসে গেছে আর কয়েকদিন পর ঈদ কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে না। তার বাবাও ঢাকা থেকে আসবে কি না ঠিক নেই। মন খারাপ হলেই সে পুকুর পাড়ে বসে হাঁসদের মাছদের সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে নামাযও পড়ে আল্লাহর কাছে বলে আল্লাহ সব কিছু ঠিক করে দাও, আমার বাবাকে আমার কাছে এনে দাও। টুনটুনির এই দোয়া হয়তো আল্লাহ কবুল করেন। একদিন সকালবেলা ওর বাবার গলা শুনে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। বাবা এসেছে, বাবা এসেছে। সে টুনটুনিকে চুপ থাকতে বলে, কেউ যেন না যানে আমি এসেছি।
শেফালী অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। একি হাল হয়েছে তার।
মিলন : বউ অনেক কষ্ট করে বাড়ি এসেছি। অটো, রিক্সা, পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে। মেসে দুই মাস বসে খেয়ে টাকা পয়সা সব শেষ হয়েছে। মেস ভাড়া, নিজের খাবার খরচ এসব সে কোথা থেকে দিবে তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে দশদিনে বাড়ি ফিরল। পরশু ঈদ আগেই শেফালী ও মায়ের জন্য একটা কাপড় আর মেয়ে দুটোর জন্য জামা কিনেছিলো। জামা পেয়ে টুনটুনি খুশি হলেও শেফালী খুশি নয়। তার ভেতরটা ধুক ধুক করতে থাকে কখন যেন পুলিশ আসে। গোসল করে অনাহারি মানুষটা খেতে বসেছে এমন সময় পুলিশের গাড়ি এসে পুরো বাড়ি ঘিড়ে ফেলল। ক্ষুধার্থ মানুষটার ভাত প্লেটেই পড়ে থাকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসোলেশনে আর পুরো এলাকাটা হোমকোয়ারেন্ট করে রাখে।
টুনটুনি বাবার দেওয়া জামাটা বুকে চেঁপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
শেফালী বাড়ির উঠনে সিদ্ধ ধানগুলো শুকাতে দিয়েছে। বর্ষা আসছে ঘরে কিছু থাক না থাক অন্তত চাউল থাকা দরকার। চাউল থাকলে অন্তত ভাতটা মুখে চড়বে। টুনটুনির দাদী আমগাছটার নিচে বসে কাঁথা সেলাই করছে। এমন সময় পাশের বাড়ির রহিমের বৌ ফুলমতি এলো।
ফুলমতি : খালাম্মা এই কাথা কি তোমার নাত জামাইরে দিবা নাকি?
অমিচান পান চিবুতে চিবুতে বলে: মোর নাত জামাই নিয়া তোর চিন্তা ক্যান? তুইকি বিয়াইয়ের গলাধরি শুইতবার চাইস নাকি?
ফুলমতি : তোমার সাথে কথা কওন দায়।
শেফালী ধানগুলো পা দিয়ে পান হাতে করে নিয়ে ফুলমতিকে দেয়।
শেফালী : কি হইছে রে বু?
ফুলমতি : কি আর হইবে? খবর খুব একটা ভাল না।
শেফালী : ক্যান কি হইল আবার?
ফুলমতি : বু তোর ভাই রাইতোত কবার নাকছে কি নাকি একটা ভাইরাস আইসবার নাগছে। নানান দেশেত নাকি মানুষ মইরবার নাগছে।
শেফালী চমকে ওঠে : কি কবার নাগছিস?
ফুলমতি : হ বু।
অমিচান : আরে থো তো উয়ার কতা। ছাগলটা রোজ ম্যা ম্যা করে।
ফুলমতি : না খালা, মুই মিছা কথা কবার নাগছোং না। স্কুল কলেজ বন্ধ হবার নাগছে। আল্লাহ জানে কি যে হইবে বু।
শেফালী : টিভিত খবরত কি কবার নাগছে?
ফুলমতি : কায় জানে, বাজারোত যায় দেখা নাগবে।
এমন সময় টুনটুনি দৌঁড়ে আসবে।
টুনটুনি : মা, মা।
শেফালী চমকে ওঠে। ক্যারে কি হইছে?
টুনটুনি : মা ইস্কুল বন্ধ দিয়া দিছে।
শেফালী : ক্যান কি হইছে?
টুনটুনি : তা বলতে পারছি না। তবে শুনলাম কি অসুখে নাকি মানুষ মরতেছে। ঢাকায় ইস্কুলে ছাত্র অসুস্থ হয়ে গেছে।
শেফালী টুনটুনিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমু খেয়ে বলে তোর কোনটে যাওয়ার দরকার নাই।
ফুলমতি : থাক বু পরে আসিম, দেখি বাবলুটা বাড়িত আসলো কি না।
ক্রমশ পরিস্থিতি খারাপ হতে লাগলো। প্রতিদিন এর ওর মুখে মানুষ মরার খবর শুনে শেফালীর অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। টুনটুনির বাবার সাথে কথা হয় খুব কম। ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। শেফালী টুনটুনির বাবাকে বাড়ি আসার জন্য বলে। কিন্তু তার এক কথা সামনে রমজান মাস ঈদ আসতেছে এখন বাড়ি কি ভাবে যায়। তাছাড়া বছরের এই সময়টা শিপমেন্ট থাকায় কাজের চাঁপও বেশি থাকে। শেফালী হঠাৎ একদিন শোনে ঢাকার সব কল কারখানা বন্ধ দিয়েছে। ঢাকা থেকে কেউ বাহিরে যেতে পারছে না। চিন্তায় সে রাতে ঠিক মতো ঘুমায় না। বেতন বোনাস সব বন্ধ। টুনটুনির দাদীর একদিন খুব পেটে ব্যাথা আর বমি। শেফালী দিশেহারা হয়ে যায় কি করবে? ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকান পাঠ বন্ধ। সে বাজারের ওষুধের দোকান থেকে ওষধ এনে খাইয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। গ্রামের ডাক্তার বলে দিয়েছে তাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু শহরে অটো রিক্সা খুব কম যাওয়া আসা করে। যেগুলোও যায় অসুস্থ্য মানুষের কথা শুনলে আরও যেতে চায় না। বুড়ি ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে। সলিম মিয়ার ভ্যানে করে শহরের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখে বলে দিয়েছে লিভারের সমস্যা, অপারেশন করতে হবে। কিন্তু এখন অপারেশন সম্ভব নয়। কেননা সার্জারির ডাক্তার আসতো অন্য জেলা থেকে তারা এখন আর আসছে না, তাই ব্যাথার ওষুধ দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে। রোজ রাত হলে ব্যাথাটা আরও বেশি হয় অমিচান চিৎকার করতে থাকে। নিরুপায় শেফালী কি করবে বুঝতে পারেনা।
টুনটুনির মনটা ভালনা। অনেকদিন স্কুল বন্ধ। রমজান মাস এসে গেছে আর কয়েকদিন পর ঈদ কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে না। তার বাবাও ঢাকা থেকে আসবে কি না ঠিক নেই। মন খারাপ হলেই সে পুকুর পাড়ে বসে হাঁসদের মাছদের সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে নামাযও পড়ে আল্লাহর কাছে বলে আল্লাহ সব কিছু ঠিক করে দাও, আমার বাবাকে আমার কাছে এনে দাও। টুনটুনির এই দোয়া হয়তো আল্লাহ কবুল করেন। একদিন সকালবেলা ওর বাবার গলা শুনে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। বাবা এসেছে, বাবা এসেছে। সে টুনটুনিকে চুপ থাকতে বলে, কেউ যেন না যানে আমি এসেছি।
শেফালী অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। একি হাল হয়েছে তার।
মিলন : বউ অনেক কষ্ট করে বাড়ি এসেছি। অটো, রিক্সা, পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে। মেসে দুই মাস বসে খেয়ে টাকা পয়সা সব শেষ হয়েছে। মেস ভাড়া, নিজের খাবার খরচ এসব সে কোথা থেকে দিবে তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে দশদিনে বাড়ি ফিরল। পরশু ঈদ আগেই শেফালী ও মায়ের জন্য একটা কাপড় আর মেয়ে দুটোর জন্য জামা কিনেছিলো। জামা পেয়ে টুনটুনি খুশি হলেও শেফালী খুশি নয়। তার ভেতরটা ধুক ধুক করতে থাকে কখন যেন পুলিশ আসে। গোসল করে অনাহারি মানুষটা খেতে বসেছে এমন সময় পুলিশের গাড়ি এসে পুরো বাড়ি ঘিড়ে ফেলল। ক্ষুধার্থ মানুষটার ভাত প্লেটেই পড়ে থাকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসোলেশনে আর পুরো এলাকাটা হোমকোয়ারেন্ট করে রাখে।
টুনটুনি বাবার দেওয়া জামাটা বুকে চেঁপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শুভজিৎ বিশ্বাস ১৯/০২/২০২২অসাধারণ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১০/০২/২০২২সুখপাঠ্য। ভালো।
-
ফয়জুল মহী ০৮/০২/২০২২অসাধারণ ,
-
সাদ্দাম হোসেন পবন ০৮/০২/২০২২সুন্দর
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ০৭/০২/২০২২নির্মম এক চিত্র এঁকেছেন।