শেষ বিকালের ফুল
একবার আকাশের দিকে আর একবার শহরের ব্যস্ততম রাস্তার দিকে তাকালো। নীল আকাশের বুকে একখন্ড কাল মেঘ জমে আছে ঠিক যেমন রাস্তার মধ্যে রিকসা গাড়ীর লম্বা জ্যাম লেগেছে। শুভ কাকরাইল থেকে সোজা রমনা পার্কের ভিতর দিয়ে শাহবাগে উঠবে, এই পথটা বাসের চেয়ে হেঁটে যাওয়াটাই ভাল। কেননা যে হারে আজকাল রাস্তায় জ্যাম লাগে তাতে বাসে বসে গরমে সিদ্ধ হওয়ার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই ভাল। তা ছাড়া টাকাটাও বাচে। শুভ একটা পত্রিকা অফিসে প্রফরিডারের চাকুরি করে। চাকুরি করে যে ক’টি টাকা পায় তাতে মেসে দিতে শেষ হয়, তাই কষ্ট করে হলেও এই পথটা হেঁটেই যাতায়াত করে। রাস্তায় ট্রাফিক বাতিগুলোর দিকে তাকালো। এই কাজটি সে প্রতিদিন করে সেটা হচ্ছে একবার ট্রাফিক সিগনালের বাতিগুলোর দিকে তাঁকাবে এবং আর একবার রাস্তয় ছুটে চলা গাড়িগুলোর দিকে তাঁকাবে। প্রায় সময় যে জিনিসটা দেখতে পায় তা হচ্ছে সিগনাল বাতিটায় যখন লাল আলো জ্বলে তখন গাড়িগুলো ছুটতে থাকে আর যখন নীল আলো জ্বালা থাকে তখন দাঁড়িয়ে থাকে। পাশেই ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে আর রাস্তার ধারে কিছু গাড়ি দাড় করিয়ে উৎকোচ আদায় করে। আজও সেই একই দৃশ্য দেখল। শুভ দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে রমনা পার্কের ভিতর ঢুকল সেই সাথে বৃষ্টিটা যেন ঝড়ে পড়ার জন্য অনেক্ষন থেকেই উন্মুখ ছিল তাই বৃষ্টিও পড়তে লাগল। শুভ দৌড়ে পার্কের তৈরী বড় ইট পাথরের ছাতাটির নিচে এসে দাঁড়াল। এই মুহুর্তে পার্ক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করল, পার্কে বৃষ্টির হাত থেকে বাচাঁর জন্য এরকম একটি ব্যবস্থা রাখার জন্য। শুভ ছাড়াও সেখানে মোটামুটি একটি সুন্দর মেয়ে ও একটি রোগাটাইপ ছেলে বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে বসে আছে। ছেলেটির কি কথায় যেন মেয়েটি হেসে গড়িয়ে পড়ছে ছেলেটির গায়ে। ছেলেটি শুভর সামনেই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, দৃশ্যটি দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তাই আমি মুখ ঘুড়িয়ে বাগানের দিকে তাঁকালাম। বকুল ফুলের গাছগুলির মাথায় বৃষ্টি পরছে আর পাতাগুলির রং বদলাচ্ছে। বৃষ্টি মাথায় অনেকে ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। কবিরা যুগে যুগে তাদের লিখুনিতে গ্রামের বৃষ্টির কথাই উল্লেখ করেছে। গ্রামের বৃষ্টির সাথে শহরের বৃষ্টির বিস্তর তফাৎ গ্রামের দৃশ্য এখানে দেখা যায় না। গ্রামে বৃষ্টি নামলে কি অপরূপ দৃশ্য সৃষ্টি হয় শহরে তা হয় না। সবুজ ধানের ডগায় বৃষ্টি যখন তার পেখম তুলে নাচে তখন মনে হয় আ-হা আমার এই বাংলাদেশে এরকম দৃশ্য বড়ই অপরূপ। কয়েকটা টোকাই শিশু বৃষ্টির পানিতে বেশ মজা করে নেচে গেয়ে ভিজছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে আসতেই আমি পথে নেমে পরি। ছেলে মেয়ে দুটি তখনো জড়াজড়ি করে বসে আছে, মেয়েটি আবারো জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগল। এর পর সপ্তাহখানেক ও পথে আর যাওয়া হয়নি, বেতন পেয়ে ক’টাদিন বাসেই যাতায়ত করেছে। আজ চনমনে রোদ, রোদে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ক্লান্তি এসে ভর করে। রমনা পার্কের ভিতর ঢুকে শুভ খুঁজতে লাগল একটু ছায়া। বেশিভাগ ছায়ার নিচেই ছেলে মেয়েরা বসে তাঁদের প্রেমের সাতকাহণ করছে। খুঁজতে খুঁজতে ভাগ্যগুনে একটি বেঞ্চ ফাঁকা পেয়ে সেখানে আলস্যে গাটাকে ছেড়ে দেয়। সম্ভবত কিছুটা ঝিমুনি এসেছিল“আপনিকি একা?’’ রিনি ঝিনি নারীর কন্ঠ আমার অচেতন মনকে জাগিয়ে তোলে। চোখ খূলে যাকে দেখলাম সে আসলেই একটি সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটিকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে; অবশেষে মনে করতে পারলাম, এই মেয়েটিতো সেদিনের সেই মেয়েটি! বৃষ্টির দিন সে ঐ ছাতার নিচে বসে একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল। আজ মেয়েটিকে আরো সুন্দরী লাগছে। হালকা গোলাপী একটি জামায় হাতের কাজ করা, কপাল জুড়ে একটি কাল টিপ মেয়েটিকে আরো বেশি আকর্ষণ করতে বাধ্য করে। আমি কিছু বলছিনা দেখে মেয়েটি আবারও বললো “আপনি একা? আপনার কি কোন সঙ্গীর প্রয়োজন আছে? আমি বোকার মত মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে বললাম “ঠিক বুঝলাম না’’। মেয়েটি আমার কথায় যেন খুব মজা পেল, একচোট হেসে বলল“না বোঝার মতো কি কিছু বলেছি” আমি আরো বোকা হয়ে গেলাম“ সত্যি আপনার কথাটি আমি বুঝতে পারছি না।’’ মেয়েটি আমার কথা শুনে আর একবার হেসে বলল “সত্যি কি আপনি আমার কথা বোঝেন নি, নাকি ভান করছেন?’’ “সত্যি বুঝিনি’ মেয়েটি একটু আমার কাছে সরে এসে বলল“এই পার্কে বেশিরভাগ মানুষ আসে তাদের প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে এবং কিছু মানুষ আসে তা উপভোগ করার জন্য আর কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ আসে সঙ্গ পাওয়ার জন্য’’। আমি মেয়েটির কথায় অবাক হলাম, মেয়েটির কথায় বোঝা যায় মেয়েটি অবশ্যই শিক্ষিত, তা না হলে এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারত না। আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আমার পাশে বসে পড়ল। আমি জায়গা করে দিয়ে একটু দুরত্ত বজায় রাখলাম। মেয়েটি আবার হেসে বলল“দুঃখিত আপনার অনুমতি ছাড়াই বসে পড়লাম, আপনার পাশে না বসলে আমাকে অবশ্য অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। আসলে আজ আমার মনটা ভাল নেই। আমি মেয়েটির কথায় আস্তে আস্তে মনে হয় জ্ঞান ফিড়ে পেলাম বললাম “তাহলে সেদিন তোমাকে যে ছেলেটির সঙ্গে দেখেছিলাম সে তবে তোমার বন্ধু বা প্রেমিক নয়? ’’ মেয়েটি আবারও হাসতে লাগল, এ হাসি যেন তার আর থামবে না। হাসতে হাসতে বলল “আপনাকে দেখলে বোকা বোকা মনে হয় কিন্তু আপনি আসলে যে বোকা সেটা কথার মধ্যে প্রকাশ করলেন। আমাদের কি বন্ধু থাকতে পারে?’’ আমি ওকে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরিশেষে বললাম “এইযে তুমি আমার পাশে বসেছ আমিতো তোমাকে আমর সঙ্গী করে চাইনি। আমার কথায় মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বলল“ সে জন্যই তো বসলাম। আসলে আজ আমার মোনটা খুব খারাপ, ঠিক আছে তবে উঠি বলে মেয়েটি দাঁড়িয়ে পরল। মেয়েটির কথায় এমন কিছু ছিল যা আমার অস্তিত্বে আঘাত হেনেছিল তাই মেয়েটির চলে যাওয়া কেন জানি মানতে পারছিলাম না; সঙ্গে সঙ্গে বললাম“ না আসলে আমি তোমাকে কথাটি ওভাবে বলতে চাইনি। তুমি বরং বস, তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় গল্প করে কাটালাম, এতে তোমার যেটা পাওনা সেটা না হয় তোমাকে দিব।’’ মেয়েটি আমার মুখের দিকে তাকাল কিছু বলল না। আমি মেয়েটিকে বললাম তোমার নাম কি? মেয়েটি উচ্চারণ করল “বকুল’’। “আচ্ছা বকুল তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি কোন ভাল ঘরের এবং শিক্ষত কিন্তু তারপরেও কেন এ পথ বেছে নিলে?’’ আমার কথায় ভিষন বিরক্ত হল সেটা তার কথা থেকেই প্রকাশ পেল “সে কথা শুনে আপনার লাভ কি? অন্য কথা থাকলে বলেন না হলে আমি চলে যাই’’। “আরে রাগ করছ যে?’’ “রাগ করব না, কেন এসব কথা শুনতে চান বলেনতো। অন্যেরা তো শুনতে চায়না সবাই চায় আমাদের শরীরে কোথায় কোন সম্পদ লুকিয়ে আছে তা হাতরে বেড় করতে’’। আমার কিছুটা রাগ হলো “দেখ বকুল তুমি যদি এ পথে না আসতে তবে এমনটি হত না।’’ বকুল বেশ শ্লেষ করে বলল “আপনারা সব পুরুষই এক। আপনারা শুধু পারেন মেয়েদের দোষটা খুঁজে বেড় করতে, আর আপনারা সব ধোয়া তুলশি পাতা। আপনি কি জানেন আমার এ পথে আসার জন্য আপনার মতো একজন পুরুষই দায়ী? আর সেই পুরুষটা যদি আমার স্বামী হয় তবে কি অবাক হবেন?’’ আমি হোঁচোট খেলাম“তুমি বিবাহিতা?’’ বকুল নীরবে মাথা নত করে বলল “হ্যা, আমি বিবাহিতা. আমার একটা চার বছরের ছেলে আছে। সেই ছেলেটির মুখের দিকে তাঁকিয়ে আমাকে এ পথে নামতে হয়েছে’’। “কিন্তু তোমার স্বামী?’’ বকুল মৃদু হেসে বলল “স্বামী যদি তার ভূমিকা পালন করত তবে কি আজ আমাকে এ পথে নামতে হয়? সে নেশা করে, কাজ কাম তেমন একটা করেনা। নেশার টাকার জন্য আমাকে মারধোর করে খারাপ কাজ করার জন্য। কি করব বলেন মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছি, ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে কোথাও কাজও করতে পারি না। ক্ষুধা আর সমস্যা চারপাশ থেকে জাপটে ধরে থাকে। এই যেমন আজ আমার ছেলেটির খুব জ্বর কিন্তু তারপরেও ওকে রেখে এলাম, টাকার তো দরকার” আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটি একশত টাকার নোট বেড় করে বকুলের হাতে দিলাম“ বকুল আসলে এই পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষেই অসহায়, এখন আমাদেরকে হারলে চলবে না আমাদেরকে সামনের দিকে এগুতেই হবে আদায় করে নিতে হবে আমাদের অধিকার। আমাকে যদি তোমার বন্ধু করো তবে নিজেকে মনে হবে এক অসহায়ের বন্ধু আরেক অসহায়।’’ বকুল কিছুক্ষন টাকার দিকে তাকিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল“ আজ টাকাটা আমার খুব প্রয়োজন কিন্তু কিছু কিছু মুহুর্ত আছে যেগুলো টাকা দিয়ে কেনা যায়না। আমার কাছে এই সময়টা অনেক মূল্যবান, কেননা আপনাকে একজন অন্য পুরুষ মনে হয়েছে তাছাড়া আপনিইতো বললেন বন্ধু, বন্ধুর কাছে টাকা নেয়াটা ঠিকনা’’ বলে বকুল বাগানের মধ্যে দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। বাগানের সবগুলি আলো জলে উঠেছে সেই আলোয় বাগানটাকে আর চেনা যাচ্ছেনা। এখনো অনেক ছেলে মেয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে শুধু বকুলকে বাগানের কোথাও দেখতে পেলাম না। এর পরে রোজই ঐ পথে যাতায়ত করতাম কিন্তু বকুলের দেখা আর পাইনি। হয়তো বকুল আছে আমাদের মাঝে। হয়তোবা সংগ্রামের মাঝ পথে হঠাৎ হেরে গেছে সে খবর আমার জানা নেই।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।