ওদেরও ইচ্ছে করে
ওদেরও ইচ্ছে করে.......
-- শুভদীপ চক্রবর্তী
_________________________________
একদল শ্যামবর্ণ কিশোর প্রতিদিনই ফুল বিক্রি করে ক্ষুদিরাম বসু রোডে। রেড লাইটে একখানা গাড়িই হোক বা একশো, নিয়মিত প্রতিটি জানালায় আঙুলের টোকা নিশ্চিত, যেমন নিশ্চিত সূর্যোদয়। জানালায় খটখট শব্দটা একই হলেও মুখগুলোর বিন্যাস সমবায় ঘটে। তবে চেনা মুখের পুনরাবৃত্তিও হয় মাঝেমধ্যে।
আমার গাড়ির বাতায়নে একটি ছেলে অনেকদিন এসেছে; তাই মুখটা অনেকাংশেই পরিচিত এখন। বাড়িতে ঠাকুরঘরের সঠিক অবস্থানটা আমার আজও জানা নেই তেমনভাবে। না, আমি কর্মসূত্রে বাড়িতেই থাকি - মানে বেকার। তবে ভগবানের কাছে আবদারটা খুব কম। তাই তাঁর ঘরে যাওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি তেমনভাবে। হয়তো প্রশ্ন উঠবে বেকারের গাড়ি কি করে হয়? বলে রাখি গাড়িটি বাবার - এখনও অবধি বাবাই বাহক। সে যাই হোক, আমার মতো মানুষের তাই ফুলের মালার প্রতি আগ্রহটা বেজায় কম।
দু একবার কিনেছিলাম মালা - ছেলেটার আনন্দ দেখবো বলে। দশ টাকা হাতে পেতেই ছেলেটির মুখের ঐ হাসিটা ছিল দেখবার মতো। কয়েকবার হয়তো অজ্ঞাতেই অবহেলাও করেছিলাম, তবে ঝড়- বৃষ্টির আবহবিকারে সেই স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ।
ছেলেটি একবার বিনামূল্যে গোলাপ বিলিয়েছিল সব গাড়িতে। জানালার কাচটা নামিয়ে জিজ্ঞাসার আগেই সে বলেছিল, " বোনের জন্মদিন।" ইতিপূর্বে কেউ ভালবেসে আমাকে গোলাপ দিয়েছে কিনা তা মনে করতেই ছেলেটি হারিয়ে যায় ভিড়ে। বহু চেষ্টায় খুঁজে বের করে একটা ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। আজও বুঝে উঠতে পারিনি ছেলেটি সটান পা ছুঁয়ে প্রণাম কেন করেছিল ,তবে সেই লোকের ভিড়ে লজ্জিত হয়েছিলাম খুব।
তারপর সেরকমভাবে বাড়ি থেকে বেরনো হয়নি; না না কাজের চাপে নয়, শরীরটা খারাপ ছিল বেশ কিছুদিন। আমার মতো মানুষকে প্রতিবার খবরের কাগজটাই একমাত্র স্মরণ করায় যে পুজো চলে এসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শহরের সাজগোজ দেখতে বেরিয়েছিলাম সেদিন। লাইটিং গুলোর চমক বাড়লেও ঐতিহ্য আর তেমনটি নেই। যথারীতি চোখ যায় সেই ছেলেগুলোর দিকে। পরিচিত সেই ছেলেটি আমার গাড়ির নম্বর চিনে রেখেছিল কিনা ঠিক জানি না, তবে সে আবার আমার কাছেই আসে। জানালায় আঘাতের পূর্বে আমি নিজেই কাচ নামাই। নতুন জামাকাপড় বলতে ছেলেটার যে কিচ্ছু নেই সেটা বুঝতে দেরি হবে না কারোরই। খানিক আবেগপ্রবণ হয়েই গাড়ি থেকে নামি। অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে। দারিদ্র ছেলেগুলোর খুশি কেড়ে নিতে পারেনি। তার পাশের বছর চারেকের বাচ্চাটি নিশ্চিতভাবেই তার ভাই, দুজনের মুখে ভীষণ মিল। মালা কেনার ইচ্ছে সেদিনও ছিল না তেমন, কিনিও নি; তবে মায়াবী মুখগুলো বাধ্য করেছিল পকেট থেকে একশো টাকার একটি নোট বের করে দিতে। হ্যাঁ, একশো টাকা অনেক কম জানি- তবে বেকারের কাছে তা দুর্মূল্য।
টাকাটা নেওয়ার সময় ছেলেটির ভাই হঠাৎ সামনেটা কাগজে মোড়া দুগ্গা মায়ের একটি মূর্তি দেখে দাদাকে প্রশ্ন করে - " দাদা আমরা ঠাকুর দেখবো না?"
ছেলেটি জবাব খুঁজে না পেয়ে মূর্তিটির আঢাকা পশ্চাদদেশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, " দেখ ভাই ... মূর্তির পেছোনে শিল্পী রঙ করতে ভুলে গেছে, দেখ দেখ পেছোনে শাড়িও পরায়নি, মাটি বেরিয়ে আছে, দেখবি এমন ঠাকুর?"
শিশুমনের সরলতায় জবাব আসে , " এ মা!... এ কেমন দুগ্গা দাদা? সবাই যে বলে দুগ্গা নাকি সবার মা! কই আমাদের মা তো এমন ছিল না; মায়ের তো সারা গায়ে শাড়ি থাকতো, রঙিন শাড়ি...না না দাদা, দেখবো না এমন ঠাকুর।"
মনে মনে ছেলেটি হয়তো হাজারবার ধন্যবাদ জানিয়েছিল শিল্পীর কৃপণতাকে। চোখের জল বেরোয়নি বটে, তবে বিস্মিত হয়েছিলাম খুব। ছেলেগুলো একটু দূরে যেতেই গাড়িতে উঠে engine চালু করি। গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আরও গভীর হয়ে ওঠে আমার মনের এক অজানা স্তব্ধতা। Accelerator এ পা পড়তেই এগোতে থাকে গাড়িখানা। wing mirror এ তাকিয়েই দেখতে থাকি ক্রমশ দূর হতে থাকা ছেলেগুলোর বেহিসেবি খেলা; বোঝার চেষ্টা করি তাদের একগুচ্ছ অনিশ্চিত ভাষা। কয়েক সেকেন্ড পরেই রাস্তার বাঁকে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরে, অদৃশ্য হয় নাম না জানা সেই ছেলের দল।
-- শুভদীপ চক্রবর্তী
_________________________________
একদল শ্যামবর্ণ কিশোর প্রতিদিনই ফুল বিক্রি করে ক্ষুদিরাম বসু রোডে। রেড লাইটে একখানা গাড়িই হোক বা একশো, নিয়মিত প্রতিটি জানালায় আঙুলের টোকা নিশ্চিত, যেমন নিশ্চিত সূর্যোদয়। জানালায় খটখট শব্দটা একই হলেও মুখগুলোর বিন্যাস সমবায় ঘটে। তবে চেনা মুখের পুনরাবৃত্তিও হয় মাঝেমধ্যে।
আমার গাড়ির বাতায়নে একটি ছেলে অনেকদিন এসেছে; তাই মুখটা অনেকাংশেই পরিচিত এখন। বাড়িতে ঠাকুরঘরের সঠিক অবস্থানটা আমার আজও জানা নেই তেমনভাবে। না, আমি কর্মসূত্রে বাড়িতেই থাকি - মানে বেকার। তবে ভগবানের কাছে আবদারটা খুব কম। তাই তাঁর ঘরে যাওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি তেমনভাবে। হয়তো প্রশ্ন উঠবে বেকারের গাড়ি কি করে হয়? বলে রাখি গাড়িটি বাবার - এখনও অবধি বাবাই বাহক। সে যাই হোক, আমার মতো মানুষের তাই ফুলের মালার প্রতি আগ্রহটা বেজায় কম।
দু একবার কিনেছিলাম মালা - ছেলেটার আনন্দ দেখবো বলে। দশ টাকা হাতে পেতেই ছেলেটির মুখের ঐ হাসিটা ছিল দেখবার মতো। কয়েকবার হয়তো অজ্ঞাতেই অবহেলাও করেছিলাম, তবে ঝড়- বৃষ্টির আবহবিকারে সেই স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ।
ছেলেটি একবার বিনামূল্যে গোলাপ বিলিয়েছিল সব গাড়িতে। জানালার কাচটা নামিয়ে জিজ্ঞাসার আগেই সে বলেছিল, " বোনের জন্মদিন।" ইতিপূর্বে কেউ ভালবেসে আমাকে গোলাপ দিয়েছে কিনা তা মনে করতেই ছেলেটি হারিয়ে যায় ভিড়ে। বহু চেষ্টায় খুঁজে বের করে একটা ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। আজও বুঝে উঠতে পারিনি ছেলেটি সটান পা ছুঁয়ে প্রণাম কেন করেছিল ,তবে সেই লোকের ভিড়ে লজ্জিত হয়েছিলাম খুব।
তারপর সেরকমভাবে বাড়ি থেকে বেরনো হয়নি; না না কাজের চাপে নয়, শরীরটা খারাপ ছিল বেশ কিছুদিন। আমার মতো মানুষকে প্রতিবার খবরের কাগজটাই একমাত্র স্মরণ করায় যে পুজো চলে এসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শহরের সাজগোজ দেখতে বেরিয়েছিলাম সেদিন। লাইটিং গুলোর চমক বাড়লেও ঐতিহ্য আর তেমনটি নেই। যথারীতি চোখ যায় সেই ছেলেগুলোর দিকে। পরিচিত সেই ছেলেটি আমার গাড়ির নম্বর চিনে রেখেছিল কিনা ঠিক জানি না, তবে সে আবার আমার কাছেই আসে। জানালায় আঘাতের পূর্বে আমি নিজেই কাচ নামাই। নতুন জামাকাপড় বলতে ছেলেটার যে কিচ্ছু নেই সেটা বুঝতে দেরি হবে না কারোরই। খানিক আবেগপ্রবণ হয়েই গাড়ি থেকে নামি। অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে। দারিদ্র ছেলেগুলোর খুশি কেড়ে নিতে পারেনি। তার পাশের বছর চারেকের বাচ্চাটি নিশ্চিতভাবেই তার ভাই, দুজনের মুখে ভীষণ মিল। মালা কেনার ইচ্ছে সেদিনও ছিল না তেমন, কিনিও নি; তবে মায়াবী মুখগুলো বাধ্য করেছিল পকেট থেকে একশো টাকার একটি নোট বের করে দিতে। হ্যাঁ, একশো টাকা অনেক কম জানি- তবে বেকারের কাছে তা দুর্মূল্য।
টাকাটা নেওয়ার সময় ছেলেটির ভাই হঠাৎ সামনেটা কাগজে মোড়া দুগ্গা মায়ের একটি মূর্তি দেখে দাদাকে প্রশ্ন করে - " দাদা আমরা ঠাকুর দেখবো না?"
ছেলেটি জবাব খুঁজে না পেয়ে মূর্তিটির আঢাকা পশ্চাদদেশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, " দেখ ভাই ... মূর্তির পেছোনে শিল্পী রঙ করতে ভুলে গেছে, দেখ দেখ পেছোনে শাড়িও পরায়নি, মাটি বেরিয়ে আছে, দেখবি এমন ঠাকুর?"
শিশুমনের সরলতায় জবাব আসে , " এ মা!... এ কেমন দুগ্গা দাদা? সবাই যে বলে দুগ্গা নাকি সবার মা! কই আমাদের মা তো এমন ছিল না; মায়ের তো সারা গায়ে শাড়ি থাকতো, রঙিন শাড়ি...না না দাদা, দেখবো না এমন ঠাকুর।"
মনে মনে ছেলেটি হয়তো হাজারবার ধন্যবাদ জানিয়েছিল শিল্পীর কৃপণতাকে। চোখের জল বেরোয়নি বটে, তবে বিস্মিত হয়েছিলাম খুব। ছেলেগুলো একটু দূরে যেতেই গাড়িতে উঠে engine চালু করি। গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আরও গভীর হয়ে ওঠে আমার মনের এক অজানা স্তব্ধতা। Accelerator এ পা পড়তেই এগোতে থাকে গাড়িখানা। wing mirror এ তাকিয়েই দেখতে থাকি ক্রমশ দূর হতে থাকা ছেলেগুলোর বেহিসেবি খেলা; বোঝার চেষ্টা করি তাদের একগুচ্ছ অনিশ্চিত ভাষা। কয়েক সেকেন্ড পরেই রাস্তার বাঁকে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরে, অদৃশ্য হয় নাম না জানা সেই ছেলের দল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কালাম হাবিব১ ২২/১০/২০১৮বেশ হয়েছে!
-
আখলাক হুসাইন ১৫/১০/২০১৮ভালো লাগল!
-
আনন্দ চ্যাটার্জী ১৪/১০/২০১৮দারুন বন্ধু
-
সোহরাব রিপন ১৩/১০/২০১৮সুন্দর