কালা মৌলভী (গল্প)
এক গ্রামে ছিল এক লোভী ও হিংস্র লোক। লোকটির নাম কালা। নাম যেমন কালা তেমনি গায়ের রং ও ছিল তাঁর কালা।গায়ে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় সব সময় টুপি পড়তো।গ্রামের লোকজন তাকে কালা মৌলভী বলে ডাকতো। কারণ কালা কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিত। কিন্তু তাঁর নিজের মধ্যে ধর্মের কোন লেশমাত্র ছিল না। ধর্ম -কর্ম তেমন একটা পালন করতো না। শুধু ধর্মের লেবাস পরে মানুষকে ধোঁকা দিত।গ্রামের সহজ সরল নিরীহ লোকদের সবসময় ধর্মের ভালো মন্দের ভয় দেখিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাই তো। গ্রামের লোকজন কালাকে ভয় পেত। কালা ছিল লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। গায়ে ছিল শক্তি সাহস।কালা গায়ের জোরে যা খুশি তাই করে বেড়াত। মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতো না সে।একটু- আধটু ঝামেলা হলেই মানুষকে মারধোর করে আনন্দ পেত।অল্পতেই রেগে যেত।হর- হামেশা মানুষকে গাল মন্দ করা ছিল তাঁর স্বভাবের একটি অংশ।
কালার ছিল এক ছেলে এক মেয়ে।ছেলের নাম ধলা আর মেয়ের নাম কমলা। ছেলে ধলা ছিল ভয়ংকর রকমের দুষ্ট।পড়ালেখা তেমন করেনি।কোন রকমে সেভেন এইট পর্যন্ত উঠেছে। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হয় "সব জান্তা সমশের" আগা থেকে ঘুরি সব কিছু সে জানে।প্রেম পাগল ধলা সময়ে অসময়ে গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েদের জ্বালাতন করে বেড়াতো। নষ্ট প্রেমের ফাঁদে ফেলে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করছে ধলা।চুরি ,বদমাইশি, মদ ও গাঁজা খাওয়ায় বেশ উস্তাদ ছিল।
ছেলের জন্য অনেক সময় কালাকে গ্রামের মানুষের সাথে ঝগড়া বিবাদে জড়াতে হয়েছে।
মেয়ে কমলা ছিল বেশ সুন্দরী এবং ভালো। সব সময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। অত্যন্ত সহজ সরল। বাবা ভাইকে তেমন পছন্দ করতো না সে। বাবা ভাইয়ের সমাজবিরোধী কাজের জন্য প্রায়ই স্কুলের বান্ধবীদের কাছে লজ্জায় পড়তো। লজ্জায় মাথা নত করে স্কুলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। প্রায়ই বাবা ভাইয়ের সাথে রাগারাগি করে কান্নাকাটি করতো সে।
মেয়ে মানুষ কি আর করা। কোমল হৃদয়ের অধিকারী কমলা একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কমলার বাবা ও ভাই কমলাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন।কিন্তু কোথাও কমলাকে খোঁজে পাওয়া যায়নি।কমলা ও আর কোনদিন বাড়িতে ফিরে আসেনি।পরিবারের সবার ধারণা কমলা হারিয়ে গেছে।
কালার স্বভাব ছিল দুষ্ট কুকুরের মতো সবসময় ঘেউঘেউ করা। লোকেরা তাকে কালা কুত্তা বলেও ডাকতো।অল্পতেই রেগে গিয়ে মানুষকে চড় থাপ্পড় মেরে দিত।ছোট বড় কোন বাছ বিচার ছিল না।লোকটির চিন্তা ধারায় ছিল মানুষের ক্ষতি করা।তাই সব সময় গ্রামের নিরীহ মানুষদের ক্ষতির করার লক্ষ্যে নানান রকমের জাল বিছিয়ে রাখতো।সব সময় ফন্দি ফিকির করতো। গ্রামের লোকজন তাঁর কুট কৌশলে অতিষ্ঠ ছিলেন।
লোকটি ছিল ভীষণ রকমের পেটুক-স্বভাবের।এক কথায় খাই খাই স্বভাবের। কাউকে ছাড় দেওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না।হালাল হারামের তোয়াক্কা করতো না। যা পেত তাই খেতে পছন্দ করতো।সুদ, ঘুষ থেকে নিয়ে সব রকমের বাজে কাজের উস্তাদ ছিল কালা।
গ্রামের সবার ঘরে ঘরে মাকড়সার মতো জাল বুনেতো সে। কিন্তু পোড়া কপাল! কোন সম্মান ছিল না তাঁর। গ্রামের লোকজন ভয়ে তাকে সামনে সালাম দিত আর পেছনে মুলা দিত।সুযোগ পেলে মানুষ তাঁর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়তো।
লোকটি পছন্ড লোভী হওয়ায় গ্রামের লোকজন তাকে এক ঘরে করে রাখে। বিয়ে সাদী বা শিরনি সালাতে তাঁকে দাওয়াত দিতে চাই তো না।যদি কোন ধরনের ভেজাল বাজিয়ে দেয়।
দিবে কীভাবে? মানুষ যে তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। সন্ধ্যা হলেই তার কুট চাল বেড়ে যেত। রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষকে কান মন্ত্র দিয়ে মজা লুটতো। সুযোগ পেলেই লোকজনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়া ছিল তাঁর বড় গুন। কালা সব সময় মানুষের সাথে ঝগড়া বিবাদে লেগেই থাকতো।
এক সময় গ্রামের লোকজন বুঝতে পেরে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে।বিশেষ করে গ্রামের যুব সমাজ। গ্রামের যুবক ছেলেরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়ে। কালা বুঝতে পেরে তাঁর কৌশল পাল্টে কিছু দিনের জন্য ঘরে বসে থাকে।ঘর থেকে বাহিরে তেমন একটা বেরোত না।বিপদ টের পেয়ে কালা সিদ্ধান্ত নিল,এই গ্রাম ছেড়ে ভালো দেখে অন্য একটা গ্রামে চলে যাবে।
সেটাই করল সে। কালা চলে গেল অন্য একটি গ্রামে। সেই গ্রামের লোকজন ছিল খুবই সহজ সরল।লেখা পড়া কম জানা। কালা পড়ালেখা জানতো।তাই কালা খুবই সহজেই সে গ্রামের নেতা বনে যায়।
এবার কালা নিজ ছেলে ধলার সহযোগিতায় নিজের নামে সেই গ্রামে একটি বাহিনী গড়ে তুলল। বাহিনীর নাম দিল কালা বাহিনী। পুরো গ্রামকে দখলে নিতে তাঁর বাহিনীকে নিয়ে একটি জাল বুনল কালা। গ্রামের নিরীহ লোকদের জায়গা জমি দখলের জাল। প্রথমদিকে অনেক নিরীহ মানুষ পোকা মাঁকড়ের মতো ধরা পড়ল তাঁর জালে।ষড়যন্ত্র করে গ্রামের নিরীহ গরিব লোকদের জায়গা জমি দখলে নিল।মানুষের সম্পাদ পেটভরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। নাক ডেকে ঘুমাল। কী মজা...!
সেই সুখ বেশিদিন সয়নি কালার। বছর খানেক পরেই ছদ্মবেশী কালার আসল চেহারা গ্রামবাসীর সামনে ধরা পড়লো। গ্রামের লোকজন বিষাক্ত সাপের মতো কালার দিকে ফুঁসতে লাগলো।গ্রামবাসী যে কোন সময় তাকে ছোবল দিতে পারে।কালার প্রাণ হুমকির মুখে পড়ল।সে যাত্রায় কোনোরকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল কালা।
কয়েক মাস পর গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আবার গ্রামে ফিরে এলো।
"কুকুরের লেজ বারো বছর চোঙার ভিতরে ভরে রাখলে যেমন সোজা হয় না" তেমনি কালা ও তাঁর কুকর্ম ছাড়েনি।কথায় আছে ।"চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী "।
এভাবে বছর খানেক গত হলো। হঠাৎ কলা জাল বুনল একটি স্কুলকে নিয়ে।স্কুলের প্রধান শিক্ষককে হাত করে স্কুল পরিচালনা কমিটিতে ঢুকে গেল। রাতারাতি কালা নিজেকে শিক্ষানুরাগী বানিয়ে নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে করতে লাগল। লোকজনের কাছে ভালো হওয়ার চেষ্টা করে। তার দোষ,ত্রুটি আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তবে খুব বেশি সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। গ্রামের লোকজন তাঁর ভণ্ডামি বুঝতে পারে।সুযোগ পেলে মানুষ তাকে ঘৃণা করে। "মানুষ তাকে সামনে আলু দেয়-আর পিছনে গালি দেয়"। কী যে কষ্ট কালার! কালা সবই বুঝতে পারে।এবং সুযোগের সন্ধান করতে থাকে। সুযোগ সন্ধানী কালার এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ।
একদিন রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল কালার।ভীষণ খিদে পেয়েছে তার।ঘরে বাজার সওদা নেই।বউয়ের ঘ্যান ঘ্যান। হাতে টাকা পয়সাও নেই।কালা পাঞ্জাবীর পকেটে তাকাল।একটি পয়সাও নেই। এখন তো খিদের চোটে ঘুমও আসবে না। কী করি!’?বিড়বিড় করে বলল কালা।
সে মন খারাপ করে বসে রইল। কীসের যেন শব্দ ভেসে এলো কানে! ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল।
শব্দটা পাশের বাড়ি থেকে আসছে। কিস্তু এত রাতে এটা কীসের শব্দ? পাশের বাড়িতে বিয়ের উৎসব হচ্ছে নাকি? কিন্তু তাকে তো কেউ দাওয়াত দেয়নি। মনে মনে কালা ক্ষেপে গেল। কি এমন অপরাধ করেছে সে?
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল।মনে মনে বলল,
‘যাই, গিয়ে দেখে আসি।’
তারপর সে পাশের বাড়ির দিকে হেঁটে গেল।গিয়ে দেখল, বিরাট আয়োজন! দুটো মেয়ে- পায়ে নুপুর, কোমরে বিছা বেঁধে নৃত্য করছে। তিন চারটে লোক তবলা বাজাচ্ছে। দর্শকসারিতে বসে হৈ-হুল্লোড় করছেন গ্রামের লোকজন।কেবল সে ব্যতীত।সবার অগোচরে কালা ঘরের ভিতরে ঢুকে বাড়ির মালিকের জায়গা- জমির দলিলপত্র খুঁজতে লাগল।পেয়েও গেল। সাথে কিছু সোনা দানা ও মূল্যবান কাগজপত্র পেয়ে চুরি করে নিয়ে আসল।
চুরি করা দলিল পত্রে কালা তাঁর নাম বসিয়ে দেয়। বছর খানেক পর কালা তার সাঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পাশের বাড়ির লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে বাড়িটি দখলে নেয়। কালা দোলনা চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে গা হেলিয়ে আশ পাশের বাড়ি দখলের ফন্দি আটতে থাকে। সম্পদের লোভে পড়ে সমাজের ভালো মন্দের কথা বেমালুম ভুলেই গেল সে।ভাবতে ভাবতে বারান্দার চেয়ারে কালা ঘুমিয়ে পড়ে, টেরই পেল না।কখন যে গভীর ঘুমে চলে গেছে।
ঠিক সকালবেলায় ঘুম ভাঙল তার। হাই তুলতে তুলতে আকাশের দিকে তাকায়।দেখল আকাশটা আজ তার কাছে রঙিন লাগছে। আকাশে যেন নতুন রংধনুর উদয় হয়েছে। কালা ভাবে গ্রামের বোকা লোকজন কেউ কিছু বলছে না।মনে হয় লোকজন ভয় পেয়েছে।
মনে মনে ভাবল, বাহ্। বেশ ভালোই হলো। কেউ কিছু বলছে না। তাঁর বুদ্ধির কাছে গ্রামবাসী কুপোকাত ।
খুশির পাশাপাশি কিছুটা আফসোসও হলো তার। বিড়বিড় করে বলল,
‘আরেকটি বাড়ি যদি দখলে নেওয়া যেত। পাশের বাড়িকে নিয়েও জাল বুনতে লাগলো।
এভাবে ষড়যন্ত্র করে কালা পুরো গ্রাম তার দখলে নিয়ে নিলো।পুরো গ্রাম দখলে নিয়ে কালা খুশিতে আত্মহারা।
খুশির পাশাপাশি পাশের গ্রাম দখলে তার আফসোস হলো।
মনে মনে ভাবল, আরেকটু হলেই তো ভালোই হতো।
ধীরে ধীরে লোভ বাড়তে থাকল কালার। সে পরিকল্পনা করল, পাশের গ্রামের একটি বিশাল বাড়ি দখলে নিবে।
সে বাড়িটি তাঁর পূর্ব থেকেই পছন্দ।
তাই কালা রাতের অন্ধকারে নিজ বাড়িতে তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বৈঠক করে ফন্দি আটে।
এদিকে,খবরটি চলে গেল পাশের গ্রামের লোকজনের কাছে।পাশের গ্রামের লোকজন নড়েচড়ে বসলেন। তাঁরা চিন্তা করে বের করলেন কিভাবে দখলবাজ কালার হাত থেকে তাদের গ্রামকে বাচানো যায়।
গ্রামবাসী মিটিং ডেকে সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন। এলাকার লোকজন সিদ্ধান্ত নিলেন, কালাকে শাস্তি দেবেন। যে ভাবেই হোক দখলবাজ কালার হাত থেকে গ্রামের নিরীহ মানুষদের রক্ষা করতে হবে।
একদা কালার জ্বর, সর্দি ও কাশী দেখা দিল। শরীরে পছন্ড জ্বর। অসুস্থ শরীরে কালা ক্লান্ত হয়ে পড়ল।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে দেখল,তার ঘর ভর্তি টাকা পয়সা। অসংখ্য জায়গা জমির মালিক হয়ে পড়েছে। গাপুসগুপুস করে রসগোল্লা খাচ্ছে । পেটে জায়গা নেই । স্বপ্নের ভেতর ভাবল, ইশ! পেটটা কেন আরও বড় হলো না!
কালার মুখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। স্বপ্ন দেখে কালার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকালে ফুরফুরে মেজাজে কালা ছেলে ধলার সাথে পরামর্শ করে ফন্দি আটে।
আর এদিকে আশ পাশের এলাকার মানুষজন শাস্তি হিসেবে কালাকে এলাকা থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করলেন।
সে খবর পেয়ে কালা সঙ্গী সাথীদের সাথে পরামর্শ করে কিভাবে মোকাবিলা করবে। কিন্তু সঙ্গী সাথীরা বিপদ টের পেয়ে ছিটকে পড়ে। কালা একা হয়ে পড়ে। মহা চিন্তায় পড়ে কালা।নানান ফন্দি আটতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত অসুস্থ কালা হঠাৎ হার্ট এটাকেই মারা যায়। আর নিরীহ গ্রামবাসী তাদের সম্পদ ফিরে পায়।
--------
লেখক
আলম সরওয়ার
কবি ও গল্পকার
যুক্তরাজ্য
কালার ছিল এক ছেলে এক মেয়ে।ছেলের নাম ধলা আর মেয়ের নাম কমলা। ছেলে ধলা ছিল ভয়ংকর রকমের দুষ্ট।পড়ালেখা তেমন করেনি।কোন রকমে সেভেন এইট পর্যন্ত উঠেছে। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হয় "সব জান্তা সমশের" আগা থেকে ঘুরি সব কিছু সে জানে।প্রেম পাগল ধলা সময়ে অসময়ে গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েদের জ্বালাতন করে বেড়াতো। নষ্ট প্রেমের ফাঁদে ফেলে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করছে ধলা।চুরি ,বদমাইশি, মদ ও গাঁজা খাওয়ায় বেশ উস্তাদ ছিল।
ছেলের জন্য অনেক সময় কালাকে গ্রামের মানুষের সাথে ঝগড়া বিবাদে জড়াতে হয়েছে।
মেয়ে কমলা ছিল বেশ সুন্দরী এবং ভালো। সব সময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। অত্যন্ত সহজ সরল। বাবা ভাইকে তেমন পছন্দ করতো না সে। বাবা ভাইয়ের সমাজবিরোধী কাজের জন্য প্রায়ই স্কুলের বান্ধবীদের কাছে লজ্জায় পড়তো। লজ্জায় মাথা নত করে স্কুলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। প্রায়ই বাবা ভাইয়ের সাথে রাগারাগি করে কান্নাকাটি করতো সে।
মেয়ে মানুষ কি আর করা। কোমল হৃদয়ের অধিকারী কমলা একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কমলার বাবা ও ভাই কমলাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন।কিন্তু কোথাও কমলাকে খোঁজে পাওয়া যায়নি।কমলা ও আর কোনদিন বাড়িতে ফিরে আসেনি।পরিবারের সবার ধারণা কমলা হারিয়ে গেছে।
কালার স্বভাব ছিল দুষ্ট কুকুরের মতো সবসময় ঘেউঘেউ করা। লোকেরা তাকে কালা কুত্তা বলেও ডাকতো।অল্পতেই রেগে গিয়ে মানুষকে চড় থাপ্পড় মেরে দিত।ছোট বড় কোন বাছ বিচার ছিল না।লোকটির চিন্তা ধারায় ছিল মানুষের ক্ষতি করা।তাই সব সময় গ্রামের নিরীহ মানুষদের ক্ষতির করার লক্ষ্যে নানান রকমের জাল বিছিয়ে রাখতো।সব সময় ফন্দি ফিকির করতো। গ্রামের লোকজন তাঁর কুট কৌশলে অতিষ্ঠ ছিলেন।
লোকটি ছিল ভীষণ রকমের পেটুক-স্বভাবের।এক কথায় খাই খাই স্বভাবের। কাউকে ছাড় দেওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না।হালাল হারামের তোয়াক্কা করতো না। যা পেত তাই খেতে পছন্দ করতো।সুদ, ঘুষ থেকে নিয়ে সব রকমের বাজে কাজের উস্তাদ ছিল কালা।
গ্রামের সবার ঘরে ঘরে মাকড়সার মতো জাল বুনেতো সে। কিন্তু পোড়া কপাল! কোন সম্মান ছিল না তাঁর। গ্রামের লোকজন ভয়ে তাকে সামনে সালাম দিত আর পেছনে মুলা দিত।সুযোগ পেলে মানুষ তাঁর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়তো।
লোকটি পছন্ড লোভী হওয়ায় গ্রামের লোকজন তাকে এক ঘরে করে রাখে। বিয়ে সাদী বা শিরনি সালাতে তাঁকে দাওয়াত দিতে চাই তো না।যদি কোন ধরনের ভেজাল বাজিয়ে দেয়।
দিবে কীভাবে? মানুষ যে তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। সন্ধ্যা হলেই তার কুট চাল বেড়ে যেত। রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষকে কান মন্ত্র দিয়ে মজা লুটতো। সুযোগ পেলেই লোকজনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়া ছিল তাঁর বড় গুন। কালা সব সময় মানুষের সাথে ঝগড়া বিবাদে লেগেই থাকতো।
এক সময় গ্রামের লোকজন বুঝতে পেরে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে।বিশেষ করে গ্রামের যুব সমাজ। গ্রামের যুবক ছেলেরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়ে। কালা বুঝতে পেরে তাঁর কৌশল পাল্টে কিছু দিনের জন্য ঘরে বসে থাকে।ঘর থেকে বাহিরে তেমন একটা বেরোত না।বিপদ টের পেয়ে কালা সিদ্ধান্ত নিল,এই গ্রাম ছেড়ে ভালো দেখে অন্য একটা গ্রামে চলে যাবে।
সেটাই করল সে। কালা চলে গেল অন্য একটি গ্রামে। সেই গ্রামের লোকজন ছিল খুবই সহজ সরল।লেখা পড়া কম জানা। কালা পড়ালেখা জানতো।তাই কালা খুবই সহজেই সে গ্রামের নেতা বনে যায়।
এবার কালা নিজ ছেলে ধলার সহযোগিতায় নিজের নামে সেই গ্রামে একটি বাহিনী গড়ে তুলল। বাহিনীর নাম দিল কালা বাহিনী। পুরো গ্রামকে দখলে নিতে তাঁর বাহিনীকে নিয়ে একটি জাল বুনল কালা। গ্রামের নিরীহ লোকদের জায়গা জমি দখলের জাল। প্রথমদিকে অনেক নিরীহ মানুষ পোকা মাঁকড়ের মতো ধরা পড়ল তাঁর জালে।ষড়যন্ত্র করে গ্রামের নিরীহ গরিব লোকদের জায়গা জমি দখলে নিল।মানুষের সম্পাদ পেটভরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। নাক ডেকে ঘুমাল। কী মজা...!
সেই সুখ বেশিদিন সয়নি কালার। বছর খানেক পরেই ছদ্মবেশী কালার আসল চেহারা গ্রামবাসীর সামনে ধরা পড়লো। গ্রামের লোকজন বিষাক্ত সাপের মতো কালার দিকে ফুঁসতে লাগলো।গ্রামবাসী যে কোন সময় তাকে ছোবল দিতে পারে।কালার প্রাণ হুমকির মুখে পড়ল।সে যাত্রায় কোনোরকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল কালা।
কয়েক মাস পর গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আবার গ্রামে ফিরে এলো।
"কুকুরের লেজ বারো বছর চোঙার ভিতরে ভরে রাখলে যেমন সোজা হয় না" তেমনি কালা ও তাঁর কুকর্ম ছাড়েনি।কথায় আছে ।"চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী "।
এভাবে বছর খানেক গত হলো। হঠাৎ কলা জাল বুনল একটি স্কুলকে নিয়ে।স্কুলের প্রধান শিক্ষককে হাত করে স্কুল পরিচালনা কমিটিতে ঢুকে গেল। রাতারাতি কালা নিজেকে শিক্ষানুরাগী বানিয়ে নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে করতে লাগল। লোকজনের কাছে ভালো হওয়ার চেষ্টা করে। তার দোষ,ত্রুটি আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তবে খুব বেশি সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। গ্রামের লোকজন তাঁর ভণ্ডামি বুঝতে পারে।সুযোগ পেলে মানুষ তাকে ঘৃণা করে। "মানুষ তাকে সামনে আলু দেয়-আর পিছনে গালি দেয়"। কী যে কষ্ট কালার! কালা সবই বুঝতে পারে।এবং সুযোগের সন্ধান করতে থাকে। সুযোগ সন্ধানী কালার এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ।
একদিন রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল কালার।ভীষণ খিদে পেয়েছে তার।ঘরে বাজার সওদা নেই।বউয়ের ঘ্যান ঘ্যান। হাতে টাকা পয়সাও নেই।কালা পাঞ্জাবীর পকেটে তাকাল।একটি পয়সাও নেই। এখন তো খিদের চোটে ঘুমও আসবে না। কী করি!’?বিড়বিড় করে বলল কালা।
সে মন খারাপ করে বসে রইল। কীসের যেন শব্দ ভেসে এলো কানে! ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল।
শব্দটা পাশের বাড়ি থেকে আসছে। কিস্তু এত রাতে এটা কীসের শব্দ? পাশের বাড়িতে বিয়ের উৎসব হচ্ছে নাকি? কিন্তু তাকে তো কেউ দাওয়াত দেয়নি। মনে মনে কালা ক্ষেপে গেল। কি এমন অপরাধ করেছে সে?
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল।মনে মনে বলল,
‘যাই, গিয়ে দেখে আসি।’
তারপর সে পাশের বাড়ির দিকে হেঁটে গেল।গিয়ে দেখল, বিরাট আয়োজন! দুটো মেয়ে- পায়ে নুপুর, কোমরে বিছা বেঁধে নৃত্য করছে। তিন চারটে লোক তবলা বাজাচ্ছে। দর্শকসারিতে বসে হৈ-হুল্লোড় করছেন গ্রামের লোকজন।কেবল সে ব্যতীত।সবার অগোচরে কালা ঘরের ভিতরে ঢুকে বাড়ির মালিকের জায়গা- জমির দলিলপত্র খুঁজতে লাগল।পেয়েও গেল। সাথে কিছু সোনা দানা ও মূল্যবান কাগজপত্র পেয়ে চুরি করে নিয়ে আসল।
চুরি করা দলিল পত্রে কালা তাঁর নাম বসিয়ে দেয়। বছর খানেক পর কালা তার সাঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পাশের বাড়ির লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে বাড়িটি দখলে নেয়। কালা দোলনা চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে গা হেলিয়ে আশ পাশের বাড়ি দখলের ফন্দি আটতে থাকে। সম্পদের লোভে পড়ে সমাজের ভালো মন্দের কথা বেমালুম ভুলেই গেল সে।ভাবতে ভাবতে বারান্দার চেয়ারে কালা ঘুমিয়ে পড়ে, টেরই পেল না।কখন যে গভীর ঘুমে চলে গেছে।
ঠিক সকালবেলায় ঘুম ভাঙল তার। হাই তুলতে তুলতে আকাশের দিকে তাকায়।দেখল আকাশটা আজ তার কাছে রঙিন লাগছে। আকাশে যেন নতুন রংধনুর উদয় হয়েছে। কালা ভাবে গ্রামের বোকা লোকজন কেউ কিছু বলছে না।মনে হয় লোকজন ভয় পেয়েছে।
মনে মনে ভাবল, বাহ্। বেশ ভালোই হলো। কেউ কিছু বলছে না। তাঁর বুদ্ধির কাছে গ্রামবাসী কুপোকাত ।
খুশির পাশাপাশি কিছুটা আফসোসও হলো তার। বিড়বিড় করে বলল,
‘আরেকটি বাড়ি যদি দখলে নেওয়া যেত। পাশের বাড়িকে নিয়েও জাল বুনতে লাগলো।
এভাবে ষড়যন্ত্র করে কালা পুরো গ্রাম তার দখলে নিয়ে নিলো।পুরো গ্রাম দখলে নিয়ে কালা খুশিতে আত্মহারা।
খুশির পাশাপাশি পাশের গ্রাম দখলে তার আফসোস হলো।
মনে মনে ভাবল, আরেকটু হলেই তো ভালোই হতো।
ধীরে ধীরে লোভ বাড়তে থাকল কালার। সে পরিকল্পনা করল, পাশের গ্রামের একটি বিশাল বাড়ি দখলে নিবে।
সে বাড়িটি তাঁর পূর্ব থেকেই পছন্দ।
তাই কালা রাতের অন্ধকারে নিজ বাড়িতে তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বৈঠক করে ফন্দি আটে।
এদিকে,খবরটি চলে গেল পাশের গ্রামের লোকজনের কাছে।পাশের গ্রামের লোকজন নড়েচড়ে বসলেন। তাঁরা চিন্তা করে বের করলেন কিভাবে দখলবাজ কালার হাত থেকে তাদের গ্রামকে বাচানো যায়।
গ্রামবাসী মিটিং ডেকে সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন। এলাকার লোকজন সিদ্ধান্ত নিলেন, কালাকে শাস্তি দেবেন। যে ভাবেই হোক দখলবাজ কালার হাত থেকে গ্রামের নিরীহ মানুষদের রক্ষা করতে হবে।
একদা কালার জ্বর, সর্দি ও কাশী দেখা দিল। শরীরে পছন্ড জ্বর। অসুস্থ শরীরে কালা ক্লান্ত হয়ে পড়ল।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে দেখল,তার ঘর ভর্তি টাকা পয়সা। অসংখ্য জায়গা জমির মালিক হয়ে পড়েছে। গাপুসগুপুস করে রসগোল্লা খাচ্ছে । পেটে জায়গা নেই । স্বপ্নের ভেতর ভাবল, ইশ! পেটটা কেন আরও বড় হলো না!
কালার মুখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। স্বপ্ন দেখে কালার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকালে ফুরফুরে মেজাজে কালা ছেলে ধলার সাথে পরামর্শ করে ফন্দি আটে।
আর এদিকে আশ পাশের এলাকার মানুষজন শাস্তি হিসেবে কালাকে এলাকা থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করলেন।
সে খবর পেয়ে কালা সঙ্গী সাথীদের সাথে পরামর্শ করে কিভাবে মোকাবিলা করবে। কিন্তু সঙ্গী সাথীরা বিপদ টের পেয়ে ছিটকে পড়ে। কালা একা হয়ে পড়ে। মহা চিন্তায় পড়ে কালা।নানান ফন্দি আটতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত অসুস্থ কালা হঠাৎ হার্ট এটাকেই মারা যায়। আর নিরীহ গ্রামবাসী তাদের সম্পদ ফিরে পায়।
--------
লেখক
আলম সরওয়ার
কবি ও গল্পকার
যুক্তরাজ্য
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ০২/১১/২০২০সমুজ্জ্বল লেখা।
-
পি পি আলী আকবর ০২/১১/২০২০ভালো
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০২/১১/২০২০চমৎকার