ভূত (রহস্যময় বাড়ির)গল্প---
(প্রথম পর্ব )
ভূতের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে। ছোট বড় সবাই ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসি। প্রিয় পাঠক আপনাদের সামনে এমন একটি ভূতের বাড়ির গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যে বাড়িতে ভূতেরা বাস করে। গল্পটি খুবই ভয়ংকর। তাহলে শুনুন।
আমাকে একজন একটি ভূতের ভিডিও what's up করলেন এবং বললেন সেটি দেখার জন্য ।প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কিসের ভিডিও।দেখব দেখব বলে প্রথমে নানান ঝামেলায় ভিডিওটি দেখা হয়নি।পরে যখন দেখলাম কিছুটা অবাক হয়েছি ভূতদের কান্ড দেখে।ভিডিওটি ছিল লন্ডনের কোন এক শহরের সি সি টিভিতে ধারণকৃত।
ভিডিওটি দেখে মনে পড়ে গেল আমাদের গ্রামের বাড়ির কথা। আমাদের গ্রামের বাড়িটির একটি ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে।এটি বৃটিশ ভারতের সময়কার একজন প্রভাবশালী জমিদারদের বাড়ি।জমিদারদের অনেক নাম-ডাক ছিল।প্রবীন মুরববীদের কাছ থেকে শুনেছি বাড়ির জমিদার তার নিজের জায়গার উপর দিয়ে থানা শহরে ( বালাগন্জ শহরে )ঘোড়া দৌড়ে যেতে পারতেন ।কারণ বালাগঞ্জ শহরে নাকি তার অনেক সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। গ্রামের নাম ধনপুর (বড় বাড়ি)। আর বাড়ি থেকে থানা(বালাগঞ্জ )শহরের দূরত্ব হবে আনুমানিক সাত আট মাইল।জমিদার খুবই প্রভাবশালী ছিলেন।থানার অনেক প্রভাবশালী জমিদার নাকি তার সম্পদ এবং সামাজিক কর্মের কাছে হার মেনে ছিলেন।
বাড়ির জমিদারের নাম ছিল ভারত সরকার।যেমনি তার নাম তেমনি তাঁর দামও ছিল।এলাকার সবার কাছে আমাদের বড় বাড়িটি আজও ভারত সরকারের বাড়ি নামে পরিচিত।বিশ কেদার জায়গা নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বাড়ির জমিদার ভারত সরকার। বাড়িটি আজও পুরনো আমলের অনেক অসাধারণ ঐতিহ্য বহন করে আছে।
জমিদার গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ির মূল ভূখণ্ডের ভিতরেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আজও সেই স্কুল ঘরটি বাড়িতে বিদ্যমান আছে।পরিবর্তিতে আমার বাবা চাচারা স্কুলটিকে বাড়ির মালিকানাধীন আরেকটি জায়গায় স্থানান্তরিত করেন।
এখন আসা যাক ভূতের গল্পে।একাত্তর সালের যুদ্ধের পূর্ব সময়ে হিন্দু জমিদারের বাড়িটি কিনেছিলেন আমার লন্ডন প্রবাসী দাদা মরহুম সিকন্দর আলী।
জমিদারের ছেলে পৈলন বাবু আমার দাদার কাছে বাড়িটি বিক্রি করার প্রস্তাব করেন। দাদার সাথে পৈলন বাবুর খুবই বন্ধুত্ব
ছিল। পৈলান বাবুরা সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমাবেন। তাই বাড়িটি বিক্রি করা খুবই প্রয়োজন। পৈলান বাবুর প্রস্তাবে আমার দাদা বাড়িটি ক্রয় করতে রাজি হলেন। দাদার ও বাড়িটি পছন্দ হয়েছে। তাই তিনি পৈলান বাবুর কাছ থেকে বাড়িটি খরিদ করলেন। কিন্তু বাড়ির দালান গুলো ছিল সেই বৃটিশ আমলের রাজকীয় দালান গুলোর মতো ।বড় বড় ইট পাথর ও চুন চুরকি দিয়ে নির্মিত। বাড়িটি আজও তাঁর সেই পুরাতন আমলের রাজকীয় দালান গুলো নিয়ে মূল অবয়বে দাড়িয়ে আছে।সময়ের প্রয়োজনে কিছু সংস্কার করা হয়েছে মাত্র।
( দ্বিতীয় পর্ব )
আমাদের বড় বাড়িটির অনেক গল্প শুনেছি আমাদের দাদীদের কাছ থেকে।দাদীরা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী।আমাদের বাবা চাচা সহ আমাদের বাস ছিল একান্নবর্তি পরিবারে।
আমার দাদা বাড়িটি ক্রয় করার পর প্রথমে বাড়িতে নিয়ে আসেন দাদী সহ পরিবারের সবাইকে, এর কিছু দিন পর আমার দাদার আরেক ছোট ভাই বসবাসের জন্য বড় বাড়িতে আসেন।বাড়িটি এত বড় যে মানুষ জন না থাকলে এক ঘর থেকে আরেক ঘরের খবর বলা খুবই অসম্ভব।
দাদীদের মুখ থেকে শোনা গল্প।বাড়িটিতে বসবাসের প্রথম দিকে ভূত,পেতনীদের উপদ্রব এত বেশি ছিল যে কোন সুস্থ মানুষ ভূত,পেতনীদের খেলা দেখে ও শুনে অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
বাড়ির পিছনের বড় পুকুরে রিতিমত রাতের বেলা নৌকা বাইচের মত ঢোল,করতালের আওয়াজ শুনতে পেতেন।পুকুর পাড়ের শিমুল তলায় লাইটের আলো দেখা যেত।তেমনি ভাবে ঘরের টিনের চালে হাঁটা চলার শব্দ এবং ঘরের পিছনের শফরী গাছ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যেত।
কিন্তু সবার ধারণা ছিল সব ভূত পেতনীদের বাস ছিল আমাদের বাড়ির সেই পুরাতন স্কুল ঘর এবং কাছারি ঘর(মান্ডব ঘর) যেখানে গ্রামের বিচার আচারের বৈঠক বসত। সেখানে হিন্দু জমিদারের দেবতার ঘর ছিল।ঘরটি নানান রঙের দেবতার কারুকার্যে সাজানো গোছানো ছিল । মান্ডব ঘরে পুজা হত।
শুধু ভূত পেতনীদের বাস নয়,তাদের সাথে বাড়ির বড় জঙ্গল গুলোতে ছোট বড় সাপ ও নানান রকমের অদ্ভুত জীব জন্তুর বাস ছিল।এখন ও সেই ভূত, পেতেনী ও বড় বড় সাপ,বিচছুদের উৎপাত দেখা যায়।কিন্তু ওরা বাড়ির কার ও কোন ক্ষতি করে না,আবার সহজে চোখের সামনে ধরাও পড়ে না।গ্রামের অনেকের কাছে থেকে আমরা ও শুনেছি ।অমুক ,তমুক চাচা, দাদা, ভাই দেখেছেন।
(তৃতীয় পর্ব )
গ্রামের অনেকের কাছ থেকে শুনেছি আমাদের বাড়িতে ছোট বড় অনেক সাপ আছে।বাড়ির পিছনের পুকুরে অনেক ছোট বড় নানান প্রজাতির মাছ দেখা যায়।কিন্ত কোন দিন মাছ মারা এবং খাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এমনকি পুকুরের পানি কোন দিন শুকায়ে যেতে দেখা যায়নি।একদা পুকুর খননের জন্য পুকুরে পানির কল বসানো হল।উদ্দেশ্য পুকুর খনন করা এবং মাছ ধরা।যথারীতি পানির কলের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের জন্য দু-তিন দিন কল অবিরত চলছে কিন্তু পুকুরের পানি শুকানো সম্ভব হচ্ছে না, একটু শুকিয়ে আবার পানি ভর্তি পুকুর।এদিকে পুকুরে মাছের ও কোন দেখা নাই।যেখানে পুকুর ভর্তি মাছ ছিল।পুকুর পানি শুন্য করা ও মাছ ধরা সব চেষ্টাই বিফল। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়ির সব চাচারা মিলে বিকল্প চিন্তা করতে লাগালেন । সেটা কি ছিল আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি বাড়ি জানতে চেষ্টা করিনি।
আমাদের বাড়িতে লোকাল মসজিদ,মাদ্রাসা,স্কুলের অনেক ছাএ শিক্ষক লজিং থাকতেন বাড়িতে কাজের লোক ও সব সময় দু-চার জন থাকতেন ।
সবার ঘুমানোর জন্য পূর্বের ঘর বা কাছারি ঘর বরাদ্দ ছিল।ভাগ্য ভাল হলে কেউ কেউ অনেক দিন থাকতেন।আবার অনেকে ছয় মাসের মধ্যে লজিং অন্যত্র বদলি করতেন।তবে দু-তিন জন একত্রে থাকলে কোন সমস্যা নাই।একা অপবিত্র অবস্থায় থাকলে সমস্যা ছিল।
একদা বাড়িতে লজিং নিয়ে আসলেন লোকাল মাদার বাজার রুপালী ব্যাংকের ম্যানেজার বাবলা সাহেব।উনি খুবই সাহসী ছিলেন।উনি ছিলেন সিলেটের সাবেক মেয়র বদরুদ্দিন কামরান সাহেবের আপন চাচাতো ভাই।অত্যন্ত ভদ্র,সাহসী ও বিনয়ী স্বভাবের লোক ।আমার দাদী উনাকে খুবই পছন্দ করতেন।বাড়ির মুরববী হিসাবে যে কোন কাজে দাদীকে জিজ্ঞাস করা বা পরামর্শ নেওয়া হত।এক কথায় দাদী যা বলতেন সবাই তা সম্পন্ন করতে সচেষ্ট থাকতেন ।
দাদী ম্যানেজার সাহেবের পরিচয় জেনে সবাইকে বললেন উনার থাকার জায়গা ঢংঙি ঘরে না করে অন্য কোন ঘরে করার জন্য।কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের পছন্দ টংঙি ঘর।কারণ টংঙি ঘর অনেক বড় ও খোলা মেলা আলো বাতাসে ভরপুর ।
দাদী এবং বাড়ির কেউ কিছু বললেন না সবাই শুধু মিঠিমিঠি হাসলেন।মাস খানেক পর এই টংঙি ঘর সম্পর্কে ম্যানেজার সাহেবের একটা ভাল ধারনা জন্মে গেছে ।
ভাবটা হলো"ছেড়েদে মা কেঁদে বাঁচি"কাউকে কিছু না বলে উনি শুধু দাদী কে বুঝিয়ে বললেন,এই ভাবে মাঝে মধ্যে গভীর রাতে বা কারা যেন ঘরের ভিতর বাজনা বাজায়? কিন্তু কাউকে দেখা যায় না।এটা আমরা ও বাড়ির লোকজন অনেক বার ঘরের বাহির থেকে শুনেছি,কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি।
দাদী বুঝে গেলেন এবং অন্য ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।বাড়ির অন্যরাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নানান কায়দায় ম্যানেজার সাহেবের সাথে মসকরা করতে লাগলেন।কর্মস্থলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন মনে হয় দীর্ঘ পাঁচ বছর খানেক।এর পরের বছর ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে আসেন।বর্তমানে লন্ডনে পরিবারের সাথে বসবাস করছেন।আরো মজার অনেক কাকতালীয় ঘটনা রয়েছে ।
(চতুর্থ পর্ব )
একদা বাড়িতে কাজে আসলেন নবীগঞ্জের বাবুল ভাই।পড়ালেখা জানা অত্যন্ত ভদ্র ও শিক্ষিত ভাল পরিবারের সন্তান ছিলেন বাবুল ভাই।কোন এক কারণে বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে আমাদের বাড়িতে কাজের জন্য আসলেন।আমার আব্বা কিভাবে বাবুল ভাই কে পেলেন সেটা জানিনা।বাবুল ভাই আমাদের মাঝে মধ্যে লেখা পড়ায় সাহায্য করতেন।অনেক বছর আমাদের বাড়িতে ছিলেন।আমরা তাকে বড় ভাই হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করতাম।আমার আব্বাকে মামা আর আম্মাকে মামী ডাকতেন।বাড়ির সবার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক বজায় ছিল।পরবর্তী সময়ে আব্বার পরামর্শে পাশের গ্রামে বিয়ে করে সংসারী জীবন শুরু করেন।
অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী বাবুল ভাই থাকতেন টংঙি ঘরে।সেখানে দুটি খাট ছিল।এক খাটে বাবুল ভাই আরেক খাটে আরেক হুজুর থাকতেন।টংঙি ঘরে দু-তিন জন একত্রে থাকলে কোন সমস্যা নাই।একা থাকলে যত সমস্যা।ঈদের ছুটিতে হুজুর তার নিজ বাড়িতে চলে গেছেন। সপ্তাহ খানেক পর আসবেন।
বাবুল ভাই একা ঘুমাতে লাগলেন।হঠাৎ একদিন দেখা গেল বাবুল ভাই বেলা করে ঘুমাচেছন ।সকাল গড়িয়ে দুপুর চলে আসছে তবু ও ঘুমাচেছন।অনেক ডাকা-ডাকির পর ও বাবুল ভাইর কোন সাড়া শব্দ নেই।সবাই চিন্তায় পড়ে গেলেন।শেষ পর্যন্ত ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে দেখা গেল বাবুল ভাই অচেতন হয়ে পড়ে আছেন।নাক মুখ থেকে শুধু সাদা ফেনা বের হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত হুজুর কবিরাজ ডাকা হলো।হুজুর বললেন বাবুল ভাইকে ভূত ধরেছে।বাড়ির সবাই বলছেন স্কুল ঘরের লেঙড়া ভূতে ধরছে।হুজুর ঝাড় ফুক,তাবিজ কবজ দিয়ে লাঠিপেটা করে ভূত তাড়ালেন।
অনেকক্ষণ পর ভূত ছেড়ে গেলে বাবুল ভাই সুস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন উনার কি হয়েছে?সবাই হাসাহাসি করতে লাগলেন।হুজুর তাবিজ কবজ করে ঘরে পানি পড়া দিয়ে চলে গেলেন।এভাবে বাবুল ভাইর মতো আরো অনেকেই ভূতে ধরেছে।কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে বাড়ির কাউকে কোন দিন ভূতে ধরেছে বলে দেখিনি বা শুনিনি ।
(পঋম পর্ব )-
বাড়িতে থাকার রুমের অভাব নেই। ছোট বড় সব মিলিয়ে পনেরো /ষোলোটি হবে ।মানুষের তুলনায় রুমের সংখ্যা ছিল অধিক ।
ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকেই পূর্ব ঘরের (পূর্বের ঘর) লাইনের একটি রুমে ঘুমাতাম। একদা মাগরিবের নামাজের পর নিজের রুমে পড়ার টেবিল বসে পড়ালেখা করছি, হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম ।প্রথমে মনে হল ছোট কোন ভাই, বোন কাঁদছে । পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিলাম ।কিছুক্ষণ পর আবার একটু ভিন্ন রকমের কান্নার শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগল ।বিকট কান্নার শব্দ, বলে কাউকে বুঝানো সম্ভব নয় । জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিতেই দেখা গেল বাড়ির ভিতরের উঠোন ভর্তি মানুষজন হৈচৈ করছেন ।যে যার মতন কথাবার্তা বলছেন । এদিকে ,ঐদিকে গেছে ।এক চাচাত ভাইকে জিজ্ঞাস করলাম, সে বলল পেতনী বড় ঘরের টিনের চালের উপর অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে কেঁদেছে ।
উঠোনে সবাই জড়ো হওয়ায় ভূত পেতনী পিছনের শফরী গাছে চলে গেছে । উঠোনের এক কোণে থেকে ইটের চুরকী (ছোট একখন্ড ইটের টুকরো ) নিয়ে আমি আর আমার চাচাতো ভাই শাহিন পিছনের শফরী গাছে গিয়ে মারলাম এক ঢিল। ঢিল ছুঁড়ার সাথে সাথেই পেতনী কান্নাসহ উধাও ।আর এদিকে মুরববীদের বকাঝকা শুনতে শুনতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি ।নানান জনের নানান ভয়ের কথা ।
আরেক রাতে কাজের লোকদের সাথে আমি এবং হাকিম ভাই আলো শিকারে (মাছ শিকার ) বের হলাম।
চারিদিকে তৈতৈ পানি আর ঘন অন্ধকার। মাছ শিকার বেশি সুবিধাজনক নয়।তাই রাতের মধ্যেভাগে বাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।যথারীতি সবাইকে ফেলে আমি আর হাকিম ভাই বাড়ি চলে আসছিলাম ।
বড় পুকুরের পাড় ঘেঁষা ছিল বাড়িতে ঢোকার বড় রাস্তা। পুকুর ঘেঁষা বাড়ির প্রবেশ মুখে পা দিতেই শুনা গেল পুকুরে পানির শব্দ । শব্দটা আসছে পুকুরের ঘাট থেকে ।হাকিম ভাই বলছেন মনে হয় বড় মাছ হবে।কিন্তু টর্চ লাইটের আলোতে শুধু আস্তে ধীরে পানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।মনে হল কেউ একজন হাত মুখ ধৈত করছেন ।
আমরা ও পুকুর ঘাটে গিয়ে ঘাটে বাধানো হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসলাম ।ঘাটে কাউকে দেখা গেল না পানির শব্দ ছাড়া। অনেকক্ষণ পর শুনাগেল টংঙি ঘরের টিনের চালে হাঁটা চলার শব্দ । আমরা নিরবে বসে রইলাম ।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ও পুকুরের পানিতে হাত মুখ ধৈত করে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
এর কিছু দিন পর বাড়ির টংঙি ঘর থেকে এক রাতে সবার অগোচরে দশ পনেরো কাটার মত ধান চুরি হয়ে গেল। কেউ টেরই পেলেন না।
(ষষ্ঠ পর্ব)--------
এর কিছু দিন পর বাড়ির টংঙি ঘর থেকে দশ মনের মত ভেজা শুকনো ধান চুরি হয়ে গেল।বষার মৌসুম ।চারদিকে তৈতৈ পানি ।বুরো ধান কাটা হয়েছে ।শুকানোর জন্য টংঙি ঘরের মেঝেতে ছিটিয়ে রাখা হয় ।রাতের অন্ধকারে চোরের হাত দিয়ে ঘরের দশ মন ধান উধাও ।চোরের অনেক সাহসী ভূমিকা দেখে সবাই হতবাক ।বাড়ির ইতিহাসে এই বাড়ি থেকে কোন দিন একটি কানা-খড়ি চুরি হয়নি । ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে আছে, কিন্তু ধান উধাও ।সবার সন্ধেহ হল বাড়ির কাজের লোক হান্নান মিয়ার উপর ।হান্নান মিয়া স্বীকার করেছেন না ।তিনি নিজেকে নিষ্পাপ দাবি করছেন ।তাই আব্বা চোর খোঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন ।যেমন চিন্তা তেমনই কাজের জন্য ভাল মোল্লা কবিরাজ খোঁজতে লাগলেন ।পেয়ে ও গেলেন একজন নামীদামি মুন্সী কবিরাজ। উনি গল্লা চালান দিয়ে চোর বের করবেন । যথা সময়ে বাড়ি ভর্তি গ্রামের লোকজনের উপস্থিতিতে মুন্সী কবিরাজ গল্লা চালান দিলেন । জীবনে এই প্রথম গল্লা চালান দেখলাম । একজন তুলারাশির জাতক ব্যক্তির হাতে একটি মাঝারি আকারের বেতের লাঠির মত দুই হাত লম্বা লাঠি দেওয়া হয় । মুন্সী কবিরাজ কি যেন মনে মনে পড়লেন আর তুলারাশির জাতক লোকটির হাতে লাঠিটি আস্তে ধীরে ঘুরতে লাগল । ঘুরতে ঘুরতে একসময় লাঠি হাতে লোকটি সমস্ত বাড়ি দৌড়াতে লাগলেন । কবিরাজ গল্লা চালান দিয়ে অনেক রকমের খেলা দেখাতে লাগলেন । শেষ গল্লা চালানে ঘোষণা করা হলো এখন চোর বাড়ি ভর্তি মানুষজনের মধ্যে আছে কিনা দেখা হবে । তাই যথারীতি লাঠির খেলা শুরু হল এবং দুই- তিন শতাধিক মানুষের মধ্যে গল্লা চোর খোঁজে পেল । দুই তিনবার গল্লা চালান দেওয়া হল ।প্রতিবার গল্লা খোঁজে পেল একই ব্যক্তিকে এবং বেধড়ক লাঠিপেটা করল ।গল্লা চোর হিসাবে খোঁজে পেল আমাদের বাড়ির কাজের লোক হান্নান মিয়া কে? শেষ পর্যন্ত হান্নান মিয়াকে ঘরের ছাদের উপর এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা হল যাতে গল্লা খুঁজে না পায় ।কিন্তু বৃথা চেষ্টা, গল্লা সেই অজানা অকলপনীয় জায়গায় গিয়ে হান্নান মিয়াকে খুঁজে বের করে বেধড়ক পিটিয়ে হসপিটাল উপযোগী করে দিল ।শেষ পর্যন্ত হান্নান মিয়া তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন ।এর কিছু দিন পর তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ এই হান্নান মিয়াও তার ভাইয়েরা সহ তিনি নিজে দীর্ঘ পাঁচ বছর খানেক আমাদের বাড়িতে কাজ করেছেন ।সবাই তাকে বিশ্বাস করতেন । ধান গুলো চুরি হয়েছিল সেই কথিত ভূতের ঘর থেকে ।
প্রাচীন বৃটিশ আমলের জমিদারের বাড়ি হিসাবে ঘরের দেওয়াল এবং ছাঁদ গুলো ছিল নানান কারুকার্যে সাদৃশ্য । অসাধারণ সৌন্দর্যে রিয়েল বাঘের আকৃতিতে দুই তিনটি পিতলের বাঘ ছিল ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি পড়ার জন্য । বৃষ্টি হলে এই বাঘের মুখ দিয়ে পানি পড়তে দেখা যেত । বাঘের মুখ দিয়ে পানি পড়ার শব্দ অসাধারণ লাগত । পরবর্তীতে দুশত বছরের পুরনো ঘর গুলোকে সংস্কারের জন্য অনেক পরিবর্তন সাধিত করতে হয়েছে । ঘরের ছাঁদ গুলো যখন সংস্কারের জন্য ভাঙার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন শ্রমিকদের অনেক কষ্ট সাধণ করতে হয়েছে । কারণ ছাদ গুলো ছিল পাথরের শিল পাঠা (মরিচ পিসার পাটা) এবং পাথরের পোতাইল (পাটার পুতাইল) ধারা আবৃত্ত। প্রায় দুই, তিন শতাধিক পাটা পুতাইল পাওয়া যায়।যা আজও আমাদের বাড়িতে এবং গ্রামের ও আত্মীয় স্বজন অনেকের ঘরে মরিচ ঘষার কাজে ব্যবহার হচ্ছে । (চলবে)
ভূতের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে। ছোট বড় সবাই ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসি। প্রিয় পাঠক আপনাদের সামনে এমন একটি ভূতের বাড়ির গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যে বাড়িতে ভূতেরা বাস করে। গল্পটি খুবই ভয়ংকর। তাহলে শুনুন।
আমাকে একজন একটি ভূতের ভিডিও what's up করলেন এবং বললেন সেটি দেখার জন্য ।প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কিসের ভিডিও।দেখব দেখব বলে প্রথমে নানান ঝামেলায় ভিডিওটি দেখা হয়নি।পরে যখন দেখলাম কিছুটা অবাক হয়েছি ভূতদের কান্ড দেখে।ভিডিওটি ছিল লন্ডনের কোন এক শহরের সি সি টিভিতে ধারণকৃত।
ভিডিওটি দেখে মনে পড়ে গেল আমাদের গ্রামের বাড়ির কথা। আমাদের গ্রামের বাড়িটির একটি ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে।এটি বৃটিশ ভারতের সময়কার একজন প্রভাবশালী জমিদারদের বাড়ি।জমিদারদের অনেক নাম-ডাক ছিল।প্রবীন মুরববীদের কাছ থেকে শুনেছি বাড়ির জমিদার তার নিজের জায়গার উপর দিয়ে থানা শহরে ( বালাগন্জ শহরে )ঘোড়া দৌড়ে যেতে পারতেন ।কারণ বালাগঞ্জ শহরে নাকি তার অনেক সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। গ্রামের নাম ধনপুর (বড় বাড়ি)। আর বাড়ি থেকে থানা(বালাগঞ্জ )শহরের দূরত্ব হবে আনুমানিক সাত আট মাইল।জমিদার খুবই প্রভাবশালী ছিলেন।থানার অনেক প্রভাবশালী জমিদার নাকি তার সম্পদ এবং সামাজিক কর্মের কাছে হার মেনে ছিলেন।
বাড়ির জমিদারের নাম ছিল ভারত সরকার।যেমনি তার নাম তেমনি তাঁর দামও ছিল।এলাকার সবার কাছে আমাদের বড় বাড়িটি আজও ভারত সরকারের বাড়ি নামে পরিচিত।বিশ কেদার জায়গা নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বাড়ির জমিদার ভারত সরকার। বাড়িটি আজও পুরনো আমলের অনেক অসাধারণ ঐতিহ্য বহন করে আছে।
জমিদার গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ির মূল ভূখণ্ডের ভিতরেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আজও সেই স্কুল ঘরটি বাড়িতে বিদ্যমান আছে।পরিবর্তিতে আমার বাবা চাচারা স্কুলটিকে বাড়ির মালিকানাধীন আরেকটি জায়গায় স্থানান্তরিত করেন।
এখন আসা যাক ভূতের গল্পে।একাত্তর সালের যুদ্ধের পূর্ব সময়ে হিন্দু জমিদারের বাড়িটি কিনেছিলেন আমার লন্ডন প্রবাসী দাদা মরহুম সিকন্দর আলী।
জমিদারের ছেলে পৈলন বাবু আমার দাদার কাছে বাড়িটি বিক্রি করার প্রস্তাব করেন। দাদার সাথে পৈলন বাবুর খুবই বন্ধুত্ব
ছিল। পৈলান বাবুরা সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমাবেন। তাই বাড়িটি বিক্রি করা খুবই প্রয়োজন। পৈলান বাবুর প্রস্তাবে আমার দাদা বাড়িটি ক্রয় করতে রাজি হলেন। দাদার ও বাড়িটি পছন্দ হয়েছে। তাই তিনি পৈলান বাবুর কাছ থেকে বাড়িটি খরিদ করলেন। কিন্তু বাড়ির দালান গুলো ছিল সেই বৃটিশ আমলের রাজকীয় দালান গুলোর মতো ।বড় বড় ইট পাথর ও চুন চুরকি দিয়ে নির্মিত। বাড়িটি আজও তাঁর সেই পুরাতন আমলের রাজকীয় দালান গুলো নিয়ে মূল অবয়বে দাড়িয়ে আছে।সময়ের প্রয়োজনে কিছু সংস্কার করা হয়েছে মাত্র।
( দ্বিতীয় পর্ব )
আমাদের বড় বাড়িটির অনেক গল্প শুনেছি আমাদের দাদীদের কাছ থেকে।দাদীরা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী।আমাদের বাবা চাচা সহ আমাদের বাস ছিল একান্নবর্তি পরিবারে।
আমার দাদা বাড়িটি ক্রয় করার পর প্রথমে বাড়িতে নিয়ে আসেন দাদী সহ পরিবারের সবাইকে, এর কিছু দিন পর আমার দাদার আরেক ছোট ভাই বসবাসের জন্য বড় বাড়িতে আসেন।বাড়িটি এত বড় যে মানুষ জন না থাকলে এক ঘর থেকে আরেক ঘরের খবর বলা খুবই অসম্ভব।
দাদীদের মুখ থেকে শোনা গল্প।বাড়িটিতে বসবাসের প্রথম দিকে ভূত,পেতনীদের উপদ্রব এত বেশি ছিল যে কোন সুস্থ মানুষ ভূত,পেতনীদের খেলা দেখে ও শুনে অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
বাড়ির পিছনের বড় পুকুরে রিতিমত রাতের বেলা নৌকা বাইচের মত ঢোল,করতালের আওয়াজ শুনতে পেতেন।পুকুর পাড়ের শিমুল তলায় লাইটের আলো দেখা যেত।তেমনি ভাবে ঘরের টিনের চালে হাঁটা চলার শব্দ এবং ঘরের পিছনের শফরী গাছ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যেত।
কিন্তু সবার ধারণা ছিল সব ভূত পেতনীদের বাস ছিল আমাদের বাড়ির সেই পুরাতন স্কুল ঘর এবং কাছারি ঘর(মান্ডব ঘর) যেখানে গ্রামের বিচার আচারের বৈঠক বসত। সেখানে হিন্দু জমিদারের দেবতার ঘর ছিল।ঘরটি নানান রঙের দেবতার কারুকার্যে সাজানো গোছানো ছিল । মান্ডব ঘরে পুজা হত।
শুধু ভূত পেতনীদের বাস নয়,তাদের সাথে বাড়ির বড় জঙ্গল গুলোতে ছোট বড় সাপ ও নানান রকমের অদ্ভুত জীব জন্তুর বাস ছিল।এখন ও সেই ভূত, পেতেনী ও বড় বড় সাপ,বিচছুদের উৎপাত দেখা যায়।কিন্তু ওরা বাড়ির কার ও কোন ক্ষতি করে না,আবার সহজে চোখের সামনে ধরাও পড়ে না।গ্রামের অনেকের কাছে থেকে আমরা ও শুনেছি ।অমুক ,তমুক চাচা, দাদা, ভাই দেখেছেন।
(তৃতীয় পর্ব )
গ্রামের অনেকের কাছ থেকে শুনেছি আমাদের বাড়িতে ছোট বড় অনেক সাপ আছে।বাড়ির পিছনের পুকুরে অনেক ছোট বড় নানান প্রজাতির মাছ দেখা যায়।কিন্ত কোন দিন মাছ মারা এবং খাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এমনকি পুকুরের পানি কোন দিন শুকায়ে যেতে দেখা যায়নি।একদা পুকুর খননের জন্য পুকুরে পানির কল বসানো হল।উদ্দেশ্য পুকুর খনন করা এবং মাছ ধরা।যথারীতি পানির কলের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের জন্য দু-তিন দিন কল অবিরত চলছে কিন্তু পুকুরের পানি শুকানো সম্ভব হচ্ছে না, একটু শুকিয়ে আবার পানি ভর্তি পুকুর।এদিকে পুকুরে মাছের ও কোন দেখা নাই।যেখানে পুকুর ভর্তি মাছ ছিল।পুকুর পানি শুন্য করা ও মাছ ধরা সব চেষ্টাই বিফল। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়ির সব চাচারা মিলে বিকল্প চিন্তা করতে লাগালেন । সেটা কি ছিল আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি বাড়ি জানতে চেষ্টা করিনি।
আমাদের বাড়িতে লোকাল মসজিদ,মাদ্রাসা,স্কুলের অনেক ছাএ শিক্ষক লজিং থাকতেন বাড়িতে কাজের লোক ও সব সময় দু-চার জন থাকতেন ।
সবার ঘুমানোর জন্য পূর্বের ঘর বা কাছারি ঘর বরাদ্দ ছিল।ভাগ্য ভাল হলে কেউ কেউ অনেক দিন থাকতেন।আবার অনেকে ছয় মাসের মধ্যে লজিং অন্যত্র বদলি করতেন।তবে দু-তিন জন একত্রে থাকলে কোন সমস্যা নাই।একা অপবিত্র অবস্থায় থাকলে সমস্যা ছিল।
একদা বাড়িতে লজিং নিয়ে আসলেন লোকাল মাদার বাজার রুপালী ব্যাংকের ম্যানেজার বাবলা সাহেব।উনি খুবই সাহসী ছিলেন।উনি ছিলেন সিলেটের সাবেক মেয়র বদরুদ্দিন কামরান সাহেবের আপন চাচাতো ভাই।অত্যন্ত ভদ্র,সাহসী ও বিনয়ী স্বভাবের লোক ।আমার দাদী উনাকে খুবই পছন্দ করতেন।বাড়ির মুরববী হিসাবে যে কোন কাজে দাদীকে জিজ্ঞাস করা বা পরামর্শ নেওয়া হত।এক কথায় দাদী যা বলতেন সবাই তা সম্পন্ন করতে সচেষ্ট থাকতেন ।
দাদী ম্যানেজার সাহেবের পরিচয় জেনে সবাইকে বললেন উনার থাকার জায়গা ঢংঙি ঘরে না করে অন্য কোন ঘরে করার জন্য।কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের পছন্দ টংঙি ঘর।কারণ টংঙি ঘর অনেক বড় ও খোলা মেলা আলো বাতাসে ভরপুর ।
দাদী এবং বাড়ির কেউ কিছু বললেন না সবাই শুধু মিঠিমিঠি হাসলেন।মাস খানেক পর এই টংঙি ঘর সম্পর্কে ম্যানেজার সাহেবের একটা ভাল ধারনা জন্মে গেছে ।
ভাবটা হলো"ছেড়েদে মা কেঁদে বাঁচি"কাউকে কিছু না বলে উনি শুধু দাদী কে বুঝিয়ে বললেন,এই ভাবে মাঝে মধ্যে গভীর রাতে বা কারা যেন ঘরের ভিতর বাজনা বাজায়? কিন্তু কাউকে দেখা যায় না।এটা আমরা ও বাড়ির লোকজন অনেক বার ঘরের বাহির থেকে শুনেছি,কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি।
দাদী বুঝে গেলেন এবং অন্য ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।বাড়ির অন্যরাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নানান কায়দায় ম্যানেজার সাহেবের সাথে মসকরা করতে লাগলেন।কর্মস্থলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন মনে হয় দীর্ঘ পাঁচ বছর খানেক।এর পরের বছর ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে আসেন।বর্তমানে লন্ডনে পরিবারের সাথে বসবাস করছেন।আরো মজার অনেক কাকতালীয় ঘটনা রয়েছে ।
(চতুর্থ পর্ব )
একদা বাড়িতে কাজে আসলেন নবীগঞ্জের বাবুল ভাই।পড়ালেখা জানা অত্যন্ত ভদ্র ও শিক্ষিত ভাল পরিবারের সন্তান ছিলেন বাবুল ভাই।কোন এক কারণে বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে আমাদের বাড়িতে কাজের জন্য আসলেন।আমার আব্বা কিভাবে বাবুল ভাই কে পেলেন সেটা জানিনা।বাবুল ভাই আমাদের মাঝে মধ্যে লেখা পড়ায় সাহায্য করতেন।অনেক বছর আমাদের বাড়িতে ছিলেন।আমরা তাকে বড় ভাই হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করতাম।আমার আব্বাকে মামা আর আম্মাকে মামী ডাকতেন।বাড়ির সবার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক বজায় ছিল।পরবর্তী সময়ে আব্বার পরামর্শে পাশের গ্রামে বিয়ে করে সংসারী জীবন শুরু করেন।
অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী বাবুল ভাই থাকতেন টংঙি ঘরে।সেখানে দুটি খাট ছিল।এক খাটে বাবুল ভাই আরেক খাটে আরেক হুজুর থাকতেন।টংঙি ঘরে দু-তিন জন একত্রে থাকলে কোন সমস্যা নাই।একা থাকলে যত সমস্যা।ঈদের ছুটিতে হুজুর তার নিজ বাড়িতে চলে গেছেন। সপ্তাহ খানেক পর আসবেন।
বাবুল ভাই একা ঘুমাতে লাগলেন।হঠাৎ একদিন দেখা গেল বাবুল ভাই বেলা করে ঘুমাচেছন ।সকাল গড়িয়ে দুপুর চলে আসছে তবু ও ঘুমাচেছন।অনেক ডাকা-ডাকির পর ও বাবুল ভাইর কোন সাড়া শব্দ নেই।সবাই চিন্তায় পড়ে গেলেন।শেষ পর্যন্ত ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে দেখা গেল বাবুল ভাই অচেতন হয়ে পড়ে আছেন।নাক মুখ থেকে শুধু সাদা ফেনা বের হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত হুজুর কবিরাজ ডাকা হলো।হুজুর বললেন বাবুল ভাইকে ভূত ধরেছে।বাড়ির সবাই বলছেন স্কুল ঘরের লেঙড়া ভূতে ধরছে।হুজুর ঝাড় ফুক,তাবিজ কবজ দিয়ে লাঠিপেটা করে ভূত তাড়ালেন।
অনেকক্ষণ পর ভূত ছেড়ে গেলে বাবুল ভাই সুস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন উনার কি হয়েছে?সবাই হাসাহাসি করতে লাগলেন।হুজুর তাবিজ কবজ করে ঘরে পানি পড়া দিয়ে চলে গেলেন।এভাবে বাবুল ভাইর মতো আরো অনেকেই ভূতে ধরেছে।কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে বাড়ির কাউকে কোন দিন ভূতে ধরেছে বলে দেখিনি বা শুনিনি ।
(পঋম পর্ব )-
বাড়িতে থাকার রুমের অভাব নেই। ছোট বড় সব মিলিয়ে পনেরো /ষোলোটি হবে ।মানুষের তুলনায় রুমের সংখ্যা ছিল অধিক ।
ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকেই পূর্ব ঘরের (পূর্বের ঘর) লাইনের একটি রুমে ঘুমাতাম। একদা মাগরিবের নামাজের পর নিজের রুমে পড়ার টেবিল বসে পড়ালেখা করছি, হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম ।প্রথমে মনে হল ছোট কোন ভাই, বোন কাঁদছে । পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিলাম ।কিছুক্ষণ পর আবার একটু ভিন্ন রকমের কান্নার শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগল ।বিকট কান্নার শব্দ, বলে কাউকে বুঝানো সম্ভব নয় । জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিতেই দেখা গেল বাড়ির ভিতরের উঠোন ভর্তি মানুষজন হৈচৈ করছেন ।যে যার মতন কথাবার্তা বলছেন । এদিকে ,ঐদিকে গেছে ।এক চাচাত ভাইকে জিজ্ঞাস করলাম, সে বলল পেতনী বড় ঘরের টিনের চালের উপর অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে কেঁদেছে ।
উঠোনে সবাই জড়ো হওয়ায় ভূত পেতনী পিছনের শফরী গাছে চলে গেছে । উঠোনের এক কোণে থেকে ইটের চুরকী (ছোট একখন্ড ইটের টুকরো ) নিয়ে আমি আর আমার চাচাতো ভাই শাহিন পিছনের শফরী গাছে গিয়ে মারলাম এক ঢিল। ঢিল ছুঁড়ার সাথে সাথেই পেতনী কান্নাসহ উধাও ।আর এদিকে মুরববীদের বকাঝকা শুনতে শুনতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি ।নানান জনের নানান ভয়ের কথা ।
আরেক রাতে কাজের লোকদের সাথে আমি এবং হাকিম ভাই আলো শিকারে (মাছ শিকার ) বের হলাম।
চারিদিকে তৈতৈ পানি আর ঘন অন্ধকার। মাছ শিকার বেশি সুবিধাজনক নয়।তাই রাতের মধ্যেভাগে বাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।যথারীতি সবাইকে ফেলে আমি আর হাকিম ভাই বাড়ি চলে আসছিলাম ।
বড় পুকুরের পাড় ঘেঁষা ছিল বাড়িতে ঢোকার বড় রাস্তা। পুকুর ঘেঁষা বাড়ির প্রবেশ মুখে পা দিতেই শুনা গেল পুকুরে পানির শব্দ । শব্দটা আসছে পুকুরের ঘাট থেকে ।হাকিম ভাই বলছেন মনে হয় বড় মাছ হবে।কিন্তু টর্চ লাইটের আলোতে শুধু আস্তে ধীরে পানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।মনে হল কেউ একজন হাত মুখ ধৈত করছেন ।
আমরা ও পুকুর ঘাটে গিয়ে ঘাটে বাধানো হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসলাম ।ঘাটে কাউকে দেখা গেল না পানির শব্দ ছাড়া। অনেকক্ষণ পর শুনাগেল টংঙি ঘরের টিনের চালে হাঁটা চলার শব্দ । আমরা নিরবে বসে রইলাম ।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ও পুকুরের পানিতে হাত মুখ ধৈত করে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
এর কিছু দিন পর বাড়ির টংঙি ঘর থেকে এক রাতে সবার অগোচরে দশ পনেরো কাটার মত ধান চুরি হয়ে গেল। কেউ টেরই পেলেন না।
(ষষ্ঠ পর্ব)--------
এর কিছু দিন পর বাড়ির টংঙি ঘর থেকে দশ মনের মত ভেজা শুকনো ধান চুরি হয়ে গেল।বষার মৌসুম ।চারদিকে তৈতৈ পানি ।বুরো ধান কাটা হয়েছে ।শুকানোর জন্য টংঙি ঘরের মেঝেতে ছিটিয়ে রাখা হয় ।রাতের অন্ধকারে চোরের হাত দিয়ে ঘরের দশ মন ধান উধাও ।চোরের অনেক সাহসী ভূমিকা দেখে সবাই হতবাক ।বাড়ির ইতিহাসে এই বাড়ি থেকে কোন দিন একটি কানা-খড়ি চুরি হয়নি । ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে আছে, কিন্তু ধান উধাও ।সবার সন্ধেহ হল বাড়ির কাজের লোক হান্নান মিয়ার উপর ।হান্নান মিয়া স্বীকার করেছেন না ।তিনি নিজেকে নিষ্পাপ দাবি করছেন ।তাই আব্বা চোর খোঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন ।যেমন চিন্তা তেমনই কাজের জন্য ভাল মোল্লা কবিরাজ খোঁজতে লাগলেন ।পেয়ে ও গেলেন একজন নামীদামি মুন্সী কবিরাজ। উনি গল্লা চালান দিয়ে চোর বের করবেন । যথা সময়ে বাড়ি ভর্তি গ্রামের লোকজনের উপস্থিতিতে মুন্সী কবিরাজ গল্লা চালান দিলেন । জীবনে এই প্রথম গল্লা চালান দেখলাম । একজন তুলারাশির জাতক ব্যক্তির হাতে একটি মাঝারি আকারের বেতের লাঠির মত দুই হাত লম্বা লাঠি দেওয়া হয় । মুন্সী কবিরাজ কি যেন মনে মনে পড়লেন আর তুলারাশির জাতক লোকটির হাতে লাঠিটি আস্তে ধীরে ঘুরতে লাগল । ঘুরতে ঘুরতে একসময় লাঠি হাতে লোকটি সমস্ত বাড়ি দৌড়াতে লাগলেন । কবিরাজ গল্লা চালান দিয়ে অনেক রকমের খেলা দেখাতে লাগলেন । শেষ গল্লা চালানে ঘোষণা করা হলো এখন চোর বাড়ি ভর্তি মানুষজনের মধ্যে আছে কিনা দেখা হবে । তাই যথারীতি লাঠির খেলা শুরু হল এবং দুই- তিন শতাধিক মানুষের মধ্যে গল্লা চোর খোঁজে পেল । দুই তিনবার গল্লা চালান দেওয়া হল ।প্রতিবার গল্লা খোঁজে পেল একই ব্যক্তিকে এবং বেধড়ক লাঠিপেটা করল ।গল্লা চোর হিসাবে খোঁজে পেল আমাদের বাড়ির কাজের লোক হান্নান মিয়া কে? শেষ পর্যন্ত হান্নান মিয়াকে ঘরের ছাদের উপর এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা হল যাতে গল্লা খুঁজে না পায় ।কিন্তু বৃথা চেষ্টা, গল্লা সেই অজানা অকলপনীয় জায়গায় গিয়ে হান্নান মিয়াকে খুঁজে বের করে বেধড়ক পিটিয়ে হসপিটাল উপযোগী করে দিল ।শেষ পর্যন্ত হান্নান মিয়া তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন ।এর কিছু দিন পর তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ এই হান্নান মিয়াও তার ভাইয়েরা সহ তিনি নিজে দীর্ঘ পাঁচ বছর খানেক আমাদের বাড়িতে কাজ করেছেন ।সবাই তাকে বিশ্বাস করতেন । ধান গুলো চুরি হয়েছিল সেই কথিত ভূতের ঘর থেকে ।
প্রাচীন বৃটিশ আমলের জমিদারের বাড়ি হিসাবে ঘরের দেওয়াল এবং ছাঁদ গুলো ছিল নানান কারুকার্যে সাদৃশ্য । অসাধারণ সৌন্দর্যে রিয়েল বাঘের আকৃতিতে দুই তিনটি পিতলের বাঘ ছিল ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি পড়ার জন্য । বৃষ্টি হলে এই বাঘের মুখ দিয়ে পানি পড়তে দেখা যেত । বাঘের মুখ দিয়ে পানি পড়ার শব্দ অসাধারণ লাগত । পরবর্তীতে দুশত বছরের পুরনো ঘর গুলোকে সংস্কারের জন্য অনেক পরিবর্তন সাধিত করতে হয়েছে । ঘরের ছাঁদ গুলো যখন সংস্কারের জন্য ভাঙার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন শ্রমিকদের অনেক কষ্ট সাধণ করতে হয়েছে । কারণ ছাদ গুলো ছিল পাথরের শিল পাঠা (মরিচ পিসার পাটা) এবং পাথরের পোতাইল (পাটার পুতাইল) ধারা আবৃত্ত। প্রায় দুই, তিন শতাধিক পাটা পুতাইল পাওয়া যায়।যা আজও আমাদের বাড়িতে এবং গ্রামের ও আত্মীয় স্বজন অনেকের ঘরে মরিচ ঘষার কাজে ব্যবহার হচ্ছে । (চলবে)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শিবশঙ্কর ০৬/০১/২০১৮সুন্দর । শুভেচ্ছা রইল ।
-
ন্যান্সি দেওয়ান ২৫/১২/২০১৭Nice.
-
একনিষ্ঠ অনুগত ২৪/১২/২০১৭চলুক, দেখাযাক কাহীনি কতটা জমে উঠে।।