এই শহরের ছন্নছাড়া ভালবাসা
অনেক কড়া রোদ। গা থেকে ঘামের স্রোত বইছে, হয়তো দূর্গন্ধ ও আসছে। না আসার কারণ নেই, পাঞ্জাবিটা আজ ৪ দিন যাবত পড়ে আছি। আমি যে মেসে থাকি সেখানে গত ২ সপ্তাহ ধরে পানি বেশি দেয়না বাড়িওয়ালা অনেক অযুহাতে ২ দিন আগে গোসলটা আলহামদুলিল্লাহ করে নিয়েছি। কিন্তু সমস্যা বাধল কাপড় ধোয়া নিয়ে। আজ এক গাট্টি কাপড় এক দুসম্পর্কের ফুপুর বাসায় দিয়ে এসেছি। ফুপু উনার বাড়ির কাজের লোক দিয়ে ধুইয়ে রাখবেন। সেদিন ময়লা নীল টি -শার্টটা পড়ে মতিঝিলে ঘুরছিলাম! উদ্দেশ্য? না উদ্দেশ্য ছিল না এমনি একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম।
বিকালের দিকে ব্যস্ততার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে মতিঝিল, পাখিদের মত এই শহরের মানুষ গুলোও নীড়ে ফেরার তাড়া নিয়ে হাঁপিয়ে দাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে বাসের গেটে ঝুলে থাকে। ইশ মানুষের পাখা নেই পাখিদের মতো! নইলে এমন বাদুড় ঝুলা ঝুলতে হত না। ফুস করে এক উড়ায় নীড়ে।
এক টঙের দোকানে রঙ চা খেতে খেতে এই সব ভাবছিলাম। হঠাৎ এক বয়স্ক মহিলা এক পিচ্চিকে পাঠাল আমাকে ডাকতে। গেলাম ওর সাথে। গিয়ে দেখি ফুপু রিক্সায় বসে আছে। বাজারের দুইটা ব্যাগ ভর্তি কাঁচাবাজার। একটা ব্যাগের ভিতরে লাল টকটকে টমেটো উকি মারছে। খাওয়ার ইচ্ছে জাগল, সাথে সাথে ব্যাগ খুলে একটা টমেটো খাওয়া শুরু করলাম।
-তিয়াস, এখানে কি?
-ফুপু, চা খাচ্ছিলাম।
-তা ত দেখলাম ই। তোর না এই সময় অফিসে থেকে ফিরে বাসায় থাকার কথা। আমি খাওয়া থামিয়ে এদিকে ওদিকে তাকালাম! না দৌড় দিব না। ফুপু কথাগুলো এমন ভাবে বলছেন যে কয়েকজন পথচারী তা দেখার জন্য ঘাড় বাঁকিয়ে দাড়িয়ে গেছে। একজন ত চায়ের কাপ নিয়ে এসে
-আর এই ময়লা টিশার্ট পড়ে আছিস কেন?
-ফুপু, মেসে পানির খুবই অভাব। গোসল ই করতে পারিনা ঠিকভাবে, কাপড় ধোয়া ত আকাশ কুসুম কল্পনা।
-ঐ মেস তাইলে ছাড়িসনা কেন?
-হেহেহে
-হাসছিস কেন? আর দাত ও ত মনে হয় ব্রাশ করিসনা। হলুদ হয়ে আছে।
-আরে না দাত ব্রাশ প্রতিদিন করি। আসলে সন্ধ্যা হইতেছে ত সূর্যের আলো সাদা দাতে পড়ায় হলুদ মনে হচ্ছে।
ফুপু আমার কথায় হেসে দিলেন। ১৭ বছরের মেয়েরা যেভাবে মুখে হাত রেখে নিজেদের হাসি সামলে রাখার চেষ্টা করে ৪৮ বছরের ফুপু সেটা করল। পার্থক্য এই উনি ১৭ বছরের মেয়েদের মতো সেজে গুজে নেই। হাসির কারণ ও জানিনা। আমার প্রায় অপ্রয়োজনীয় যত কথা আছে তাতেই তিনি হাসেন।
-শোন, তোর না ধোয়া, অপরিষ্কার কাপড় গুলা বাসায় দিয়ে যাহ, রাতে আয়! পোলাও রাধব। সাথে দেশি মুরগির ঝাঁল তরকারি। তোর ফুপা বগুড়ার দই আনছেন! রাতে আসিস।
-আচ্ছা। বলে ফুপুকে বিদায় দিয়ে মতিঝিল থেকে বাসায় আসি আর কাপড় গুলো দেই আজ একসপ্তাহ পর। ঐ খাবার ত পেটে যায়নি তবে ডিম ভাজা দিয়ে আর খাটি ঘি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম।
আজ একটু মন ভাল। ছেলেদের মন ভাল থাকার প্রধান কারণ গুলোর একটা হল, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকা। টাকা পকেটে থাকলে কিছু ভেবে চিন্তে কিনতে ইচ্ছে করেনা। যেমন আমি হাতে গোলাপ নিয়ে ঘুরছি, কেন জানি গোলাপ গুলো কিনতে মন চাইল। কিনে ফেললাম। ১ টা বা দুইটা না ৭ টা রক্ত রাঙা গোলাপের ছোটখাটো তোড়া হাতে। পকেটে ৫০০ টাকা ছিল, ১৪০ টাকার ফুল! ১০ টাকার বাদাম আর ২০০ টাকা মেসের সেলিম কে দিয়েছি। হাতে ১০০ টাকার নোট। আজ মেঘের কথা খুব মনে পড়ছে, ফুল গুলো মেঘকে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে ওদের বাসায় আমার যাওয়া বারণ। হয়তো আমাকে দেখে মেঘ অবাক হবে। হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা ও আছে ৩ বছর পরে দেখা, কিন্তু মেঘ যে অবাক হয়েছে তা কখনোই আমার চোখে পড়েনি। ও সব কিছুই বাস্তবতার মাপকাঠিতে রেখে কথা বলে , যেন "আরে এমনটাই ত ঘটার কথা " এই টাইপের ব্যপার। একদিন হয়েছে কি আমি একটা যাদু শিখেছি আর তা মেঘকে দেখাতে ওর বাসায় রাত ২ টায় পৌছেছি, আমি যাদুটা শিখেই বেরিয়ে গেছি ঘড়ি দেখা হয়নি।
ওদের বাসার সামনে গিয়ে ওর রুমের জানালা দিয়ে ডাকলাম "মেঘ, ঘুমাচ্ছ?" এক ডাকের বেশী দেয়া লাগলো না ও মেইন গেইট খুলে বাইরে চলে এল।
-তিয়াস ভাইয়া! আপনি, আসুন আসুন।
-না ভিতরে যাবো না, তোকে একটা যাদু দেখাব বলে আসছি।
-যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরায় রাত ২ টায় যাদু দেখাতে আসছেন? আচ্ছা দেখান।
-কি বলিস ২ টা বাজে। যাই হোক এসেই গেছি যখন শোন, যাদুটা হচ্ছে আমি এই কফি খাওয়ার গ্লাসটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেব। ইন্টারেস্টিং না?
-হুম।
- তুই ধান্ধা খেয়ে যাবি।
-ধান্ধা মানে কি?
-মানে টাশকি খাবি।
-ও, হুম....আচ্ছা টাশকি মানে যেন কি? আমি দেখলাম মেঘের আমার যাদু থেকে কথার প্যাচে বেশি আগ্রহ! তাছাড়া ঘুম ঘুম ভাব সাথে হাই তুলতে তুলতে কথা বলছে। ওর রুমের আলোয় মেঘের চেহারা ভালোই বুঝা যাচ্ছে! বিকেলে কাজল দিয়েছে হয়তো চোখে, বা পাশের চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। আনমনে ইতস্ততভাবে আমার হাতটা ঐ লেপ্টে যাওয়া কাজল ঠিক করে দিতে বাড়ালাম আবার হাত গুটিয়ে নিলাম! হালকা হাতের স্পর্শ পাওয়ায় মেঘ চমকে উঠল হয়তো।
-কাজল ঠিক করার অধিকার আপনার আছে, অধিকার আমি আপনাকে অনেক আগেই দিয়েছি তিয়াস ভাই।
আমার দিকে তাকিয়ে রইল মেঘ। আমি পুরনো ভঙ্গিমায় বললাম, -মেঘ, যা ঘুমিয়ে পর অনেক রাত হইছে এতো রাতে আমাদের কেউ দেখলে সমস্যা হবে। কথা গুলো বলেই উত্তরের আশা না করে -আসবেন আবার, নিজের খালাকে দেখে যেয়েন। মেঘ জোরে বলল। হ্যা মেঘ আমার মার বান্ধবীর মেয়ে। মেঘকে আর যাদুটা দেখানো হল না। পকেটে হাতিয়ে দেখি গ্লাসটা মেঘের হাতেই রেখে এসেছি নেয়া হয়নি। মেঘের অনেক গুলো ভাল গুনের মাঝে একটি হল, ও কাউকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করেনা। নিখাদ মমতা তার পথশিশুদের জন্য। বড়লোক বাবার অনেক টাকা এদের জন্য মেঘ ব্যয় করেছে। আজকালকার মেয়েদের মত ওতোটা সেজে গুজে থাকেনা, ঢঙ্গ করে বা আহ্লাদ করে ন্যাকামী করতে পারেনা। তাই বলে ও সুন্দরী নয় বা আধুনিক নয় তার মানে নেই। ওর ভয়েস এতটাই সুন্দর যার প্রশংসা শুরু কিভাবে করব তা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হবে। মায়াময় চেহারা, ঠোঁটের ডান দিকে একটা তিল ওকে আরও মোহনীয় করেছে আর কাজল চোখে ওকে দেখলে বুকে যেন কিঞ্চিৎ ব্যথা লাগে। সৃষ্টি কর্তার অপূর্ব সৃজন।
মেঘদের বাসায় ঢুকলাম। খালাজান আমার হাতে ফুল দেখে বিস্মিত হলেন, উনার ভুরু কুঁচকে ফেলেছেন। সোফায় গিয়ে বসলাম। খালা ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করছেন। এমন সময়ে মেঘ ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখে থেমে গেল। ওর হাতে শপিং ব্যাগ। হয়তো মার্কেট থেকে এসেছে। ওর ঢোকার কিছুক্ষন পর একটি ছেলে ঢুকল রুমে। ইয়াং বয়স, ইন করা শার্ট। বলতে গেলে পরিপাটি। মেঘের নতুন এক রূপ দেখলাম, খুব সেজেছে ও।
-তিয়াস ভাই, কখন এলেন?
-এইতো ....
-এ হচ্ছে শিমুল, আমার হবু বড়। মেঘ ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল। আমি চুপচাপ দেখতে লাগলাম। খুব বেশি চঞ্চল হয়েছে মেঘ সাথে বড়বড় একটা ভাব। খালাম্মা থাকতে বললেন, কথা আছে। আমাকে সন্ধ্যায় ছাদে নিয়ে গেলেন এবং কিছু কথা বললেন। দেখলাম মেঘ ও ফলো করছে আমাকে। রাতে ও আমাকে ডাকল! খেয়ে দেয়ে বসে রইলাম ওর বারান্দায়। ১৫ মিনিট পর মেঘ ঢুকল রুমে।
-দেখেন ত হাতের মেহেদী টা গাঢ় হইছে না?
-হুম। মেঘ আমার পাশে এসে চেয়ারে বসল।
-কোথায় ছিলেন ৩বছর?
-চা খাব নিয়ে আয়।
-আগে জবাব দিন আমায়
-কিসের জবাব।
-পালিয়ে ছিলেন আমার থেকে এতদিন তাইনা?
-যদি বলি হ্যাঁ।
-কখনোই কি আমার জন্য এতটুকু ভাললাগা বা ভালবাসা অনুভব হয়নি?
-নাহ, এগুলো শুধুই আবেগ।
-আপনি এই কথাটা ৩ বছর আগে বললে হয়তো এটাই ভাবতাম, এটা আবেগ কিন্তু আমি এখন বুঝি কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালবাসা। আপনার প্রতি কেবল ভালোবাসা ই ছিল, আছে।
-২ দিন পর তোর বিয়ে।
-একবার বলুন ভালবাসি, এই বিয়ের তোয়াক্কা না করে চলে আসব।
মেঘ আমার হাত ধরল। আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম। একটু ঘাড় ফিরিয়ে দেখি খালা দরযায় দাড়িয়ে আছেন, ইশারায় ডাকলেন আমায়। মেঘের চোখ ছলছল করছে, হাত দিয়ে মুছে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে দাড়ালাম।
-বলুন। মেঘ বলল।
-আসছি ....
খালা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
-৩ বছর আগে এই কারনে তোমাকে বাসায় আসতে মানা করেছিলাম তাও আজ তুমি এলে তাছাড়া প্রায় সময় মেঘের ভার্সিটিতে ও তোমাকে মেঘের আশেপাশে দেখা গেছে। তুমি চাইছো কি? মেঘের বিয়েটা ভেঙে যাক?
-আসলে ....না খালা।
-তোমার পায়ে পড়ি বাবা তুমি চলে যাও এইবাড়ি থেকে।
খালা পায়ে ধরতে উদ্যত হলেন আমি সরে গেলাম।
-খালা, আমি মেঘকে প্রচন্ড ভালবাসি।
-আবার এসব বলছ। তুমি আজ এখনই চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে। একজন মা হিসেবে তোমার কাছে আকুল আবেদন তিয়াস।
আমি বসে আছি শাহাবাগে, মনটা খুব খারাপ। মেঘকে না বলেই চলে এসেছি, গোলাপের তোড়াটাও দেয়া হয়নি। বলেছিলাম খালাকে শেষবারের মত দেখা করে ওকে ফুলগুলো দিয়ে যাই, খালা বারণ করলেন। নিজেকে আজ পরাজিত যোদ্ধা মনে হচ্ছে।
বৃষ্টি হচ্ছে, প্রচন্ড বৃষ্টি। মেঘের কথা মনে হচ্ছে। কখনো ওকে ভালবাসি বলতে না পারার নিরব কষ্টগুলো বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে যেন আরও বেড়ে গেল। একটা ব্যাপার বুঝলাম, ভালবাসা মধ্যবিত্তদের জন্য নয়, নয় আমার মতো মাস্টার্স শেষ করা বেকারদের জন্য।
ভাল চাকরি পেতে মেধা লাগেনা এই শহরে, লাগে টাকা, তাহলে দেখা যায় সুখের স্বপ্ন। বাসা বাধা যায় ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে। আমার কাছে টাকা নেই তাই মেঘ আজ অন্যের।
দেহটাই শুধু ভিজছে, মন টা শুকনো আজও। না পাওয়ার গ্লানি নিয়ে বেচেঁ থাকব শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। হয়তো মেঘ ও ভুলে যাবে একদিন এই তিয়াসকে কিন্তু প্রতিবারই হারিয়ে যাওয়া মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে আমার চোখে।
হাতে থাকা ফুলের তোড়াটা ছুড়ে মারলাম রাজপথে, দুমড়ে পিষিয়ে দিল গোলাপ গুলো একটা প্রাইভেট গাড়ির চাকা। আসলে ফুল নয় রাস্তায় পিষে গেল আমার ছন্নছাড়া ভালবাসাটা।
বিকালের দিকে ব্যস্ততার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে মতিঝিল, পাখিদের মত এই শহরের মানুষ গুলোও নীড়ে ফেরার তাড়া নিয়ে হাঁপিয়ে দাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে বাসের গেটে ঝুলে থাকে। ইশ মানুষের পাখা নেই পাখিদের মতো! নইলে এমন বাদুড় ঝুলা ঝুলতে হত না। ফুস করে এক উড়ায় নীড়ে।
এক টঙের দোকানে রঙ চা খেতে খেতে এই সব ভাবছিলাম। হঠাৎ এক বয়স্ক মহিলা এক পিচ্চিকে পাঠাল আমাকে ডাকতে। গেলাম ওর সাথে। গিয়ে দেখি ফুপু রিক্সায় বসে আছে। বাজারের দুইটা ব্যাগ ভর্তি কাঁচাবাজার। একটা ব্যাগের ভিতরে লাল টকটকে টমেটো উকি মারছে। খাওয়ার ইচ্ছে জাগল, সাথে সাথে ব্যাগ খুলে একটা টমেটো খাওয়া শুরু করলাম।
-তিয়াস, এখানে কি?
-ফুপু, চা খাচ্ছিলাম।
-তা ত দেখলাম ই। তোর না এই সময় অফিসে থেকে ফিরে বাসায় থাকার কথা। আমি খাওয়া থামিয়ে এদিকে ওদিকে তাকালাম! না দৌড় দিব না। ফুপু কথাগুলো এমন ভাবে বলছেন যে কয়েকজন পথচারী তা দেখার জন্য ঘাড় বাঁকিয়ে দাড়িয়ে গেছে। একজন ত চায়ের কাপ নিয়ে এসে
-আর এই ময়লা টিশার্ট পড়ে আছিস কেন?
-ফুপু, মেসে পানির খুবই অভাব। গোসল ই করতে পারিনা ঠিকভাবে, কাপড় ধোয়া ত আকাশ কুসুম কল্পনা।
-ঐ মেস তাইলে ছাড়িসনা কেন?
-হেহেহে
-হাসছিস কেন? আর দাত ও ত মনে হয় ব্রাশ করিসনা। হলুদ হয়ে আছে।
-আরে না দাত ব্রাশ প্রতিদিন করি। আসলে সন্ধ্যা হইতেছে ত সূর্যের আলো সাদা দাতে পড়ায় হলুদ মনে হচ্ছে।
ফুপু আমার কথায় হেসে দিলেন। ১৭ বছরের মেয়েরা যেভাবে মুখে হাত রেখে নিজেদের হাসি সামলে রাখার চেষ্টা করে ৪৮ বছরের ফুপু সেটা করল। পার্থক্য এই উনি ১৭ বছরের মেয়েদের মতো সেজে গুজে নেই। হাসির কারণ ও জানিনা। আমার প্রায় অপ্রয়োজনীয় যত কথা আছে তাতেই তিনি হাসেন।
-শোন, তোর না ধোয়া, অপরিষ্কার কাপড় গুলা বাসায় দিয়ে যাহ, রাতে আয়! পোলাও রাধব। সাথে দেশি মুরগির ঝাঁল তরকারি। তোর ফুপা বগুড়ার দই আনছেন! রাতে আসিস।
-আচ্ছা। বলে ফুপুকে বিদায় দিয়ে মতিঝিল থেকে বাসায় আসি আর কাপড় গুলো দেই আজ একসপ্তাহ পর। ঐ খাবার ত পেটে যায়নি তবে ডিম ভাজা দিয়ে আর খাটি ঘি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম।
আজ একটু মন ভাল। ছেলেদের মন ভাল থাকার প্রধান কারণ গুলোর একটা হল, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকা। টাকা পকেটে থাকলে কিছু ভেবে চিন্তে কিনতে ইচ্ছে করেনা। যেমন আমি হাতে গোলাপ নিয়ে ঘুরছি, কেন জানি গোলাপ গুলো কিনতে মন চাইল। কিনে ফেললাম। ১ টা বা দুইটা না ৭ টা রক্ত রাঙা গোলাপের ছোটখাটো তোড়া হাতে। পকেটে ৫০০ টাকা ছিল, ১৪০ টাকার ফুল! ১০ টাকার বাদাম আর ২০০ টাকা মেসের সেলিম কে দিয়েছি। হাতে ১০০ টাকার নোট। আজ মেঘের কথা খুব মনে পড়ছে, ফুল গুলো মেঘকে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে ওদের বাসায় আমার যাওয়া বারণ। হয়তো আমাকে দেখে মেঘ অবাক হবে। হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা ও আছে ৩ বছর পরে দেখা, কিন্তু মেঘ যে অবাক হয়েছে তা কখনোই আমার চোখে পড়েনি। ও সব কিছুই বাস্তবতার মাপকাঠিতে রেখে কথা বলে , যেন "আরে এমনটাই ত ঘটার কথা " এই টাইপের ব্যপার। একদিন হয়েছে কি আমি একটা যাদু শিখেছি আর তা মেঘকে দেখাতে ওর বাসায় রাত ২ টায় পৌছেছি, আমি যাদুটা শিখেই বেরিয়ে গেছি ঘড়ি দেখা হয়নি।
ওদের বাসার সামনে গিয়ে ওর রুমের জানালা দিয়ে ডাকলাম "মেঘ, ঘুমাচ্ছ?" এক ডাকের বেশী দেয়া লাগলো না ও মেইন গেইট খুলে বাইরে চলে এল।
-তিয়াস ভাইয়া! আপনি, আসুন আসুন।
-না ভিতরে যাবো না, তোকে একটা যাদু দেখাব বলে আসছি।
-যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরায় রাত ২ টায় যাদু দেখাতে আসছেন? আচ্ছা দেখান।
-কি বলিস ২ টা বাজে। যাই হোক এসেই গেছি যখন শোন, যাদুটা হচ্ছে আমি এই কফি খাওয়ার গ্লাসটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেব। ইন্টারেস্টিং না?
-হুম।
- তুই ধান্ধা খেয়ে যাবি।
-ধান্ধা মানে কি?
-মানে টাশকি খাবি।
-ও, হুম....আচ্ছা টাশকি মানে যেন কি? আমি দেখলাম মেঘের আমার যাদু থেকে কথার প্যাচে বেশি আগ্রহ! তাছাড়া ঘুম ঘুম ভাব সাথে হাই তুলতে তুলতে কথা বলছে। ওর রুমের আলোয় মেঘের চেহারা ভালোই বুঝা যাচ্ছে! বিকেলে কাজল দিয়েছে হয়তো চোখে, বা পাশের চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। আনমনে ইতস্ততভাবে আমার হাতটা ঐ লেপ্টে যাওয়া কাজল ঠিক করে দিতে বাড়ালাম আবার হাত গুটিয়ে নিলাম! হালকা হাতের স্পর্শ পাওয়ায় মেঘ চমকে উঠল হয়তো।
-কাজল ঠিক করার অধিকার আপনার আছে, অধিকার আমি আপনাকে অনেক আগেই দিয়েছি তিয়াস ভাই।
আমার দিকে তাকিয়ে রইল মেঘ। আমি পুরনো ভঙ্গিমায় বললাম, -মেঘ, যা ঘুমিয়ে পর অনেক রাত হইছে এতো রাতে আমাদের কেউ দেখলে সমস্যা হবে। কথা গুলো বলেই উত্তরের আশা না করে -আসবেন আবার, নিজের খালাকে দেখে যেয়েন। মেঘ জোরে বলল। হ্যা মেঘ আমার মার বান্ধবীর মেয়ে। মেঘকে আর যাদুটা দেখানো হল না। পকেটে হাতিয়ে দেখি গ্লাসটা মেঘের হাতেই রেখে এসেছি নেয়া হয়নি। মেঘের অনেক গুলো ভাল গুনের মাঝে একটি হল, ও কাউকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করেনা। নিখাদ মমতা তার পথশিশুদের জন্য। বড়লোক বাবার অনেক টাকা এদের জন্য মেঘ ব্যয় করেছে। আজকালকার মেয়েদের মত ওতোটা সেজে গুজে থাকেনা, ঢঙ্গ করে বা আহ্লাদ করে ন্যাকামী করতে পারেনা। তাই বলে ও সুন্দরী নয় বা আধুনিক নয় তার মানে নেই। ওর ভয়েস এতটাই সুন্দর যার প্রশংসা শুরু কিভাবে করব তা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হবে। মায়াময় চেহারা, ঠোঁটের ডান দিকে একটা তিল ওকে আরও মোহনীয় করেছে আর কাজল চোখে ওকে দেখলে বুকে যেন কিঞ্চিৎ ব্যথা লাগে। সৃষ্টি কর্তার অপূর্ব সৃজন।
মেঘদের বাসায় ঢুকলাম। খালাজান আমার হাতে ফুল দেখে বিস্মিত হলেন, উনার ভুরু কুঁচকে ফেলেছেন। সোফায় গিয়ে বসলাম। খালা ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করছেন। এমন সময়ে মেঘ ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখে থেমে গেল। ওর হাতে শপিং ব্যাগ। হয়তো মার্কেট থেকে এসেছে। ওর ঢোকার কিছুক্ষন পর একটি ছেলে ঢুকল রুমে। ইয়াং বয়স, ইন করা শার্ট। বলতে গেলে পরিপাটি। মেঘের নতুন এক রূপ দেখলাম, খুব সেজেছে ও।
-তিয়াস ভাই, কখন এলেন?
-এইতো ....
-এ হচ্ছে শিমুল, আমার হবু বড়। মেঘ ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল। আমি চুপচাপ দেখতে লাগলাম। খুব বেশি চঞ্চল হয়েছে মেঘ সাথে বড়বড় একটা ভাব। খালাম্মা থাকতে বললেন, কথা আছে। আমাকে সন্ধ্যায় ছাদে নিয়ে গেলেন এবং কিছু কথা বললেন। দেখলাম মেঘ ও ফলো করছে আমাকে। রাতে ও আমাকে ডাকল! খেয়ে দেয়ে বসে রইলাম ওর বারান্দায়। ১৫ মিনিট পর মেঘ ঢুকল রুমে।
-দেখেন ত হাতের মেহেদী টা গাঢ় হইছে না?
-হুম। মেঘ আমার পাশে এসে চেয়ারে বসল।
-কোথায় ছিলেন ৩বছর?
-চা খাব নিয়ে আয়।
-আগে জবাব দিন আমায়
-কিসের জবাব।
-পালিয়ে ছিলেন আমার থেকে এতদিন তাইনা?
-যদি বলি হ্যাঁ।
-কখনোই কি আমার জন্য এতটুকু ভাললাগা বা ভালবাসা অনুভব হয়নি?
-নাহ, এগুলো শুধুই আবেগ।
-আপনি এই কথাটা ৩ বছর আগে বললে হয়তো এটাই ভাবতাম, এটা আবেগ কিন্তু আমি এখন বুঝি কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালবাসা। আপনার প্রতি কেবল ভালোবাসা ই ছিল, আছে।
-২ দিন পর তোর বিয়ে।
-একবার বলুন ভালবাসি, এই বিয়ের তোয়াক্কা না করে চলে আসব।
মেঘ আমার হাত ধরল। আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম। একটু ঘাড় ফিরিয়ে দেখি খালা দরযায় দাড়িয়ে আছেন, ইশারায় ডাকলেন আমায়। মেঘের চোখ ছলছল করছে, হাত দিয়ে মুছে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে দাড়ালাম।
-বলুন। মেঘ বলল।
-আসছি ....
খালা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
-৩ বছর আগে এই কারনে তোমাকে বাসায় আসতে মানা করেছিলাম তাও আজ তুমি এলে তাছাড়া প্রায় সময় মেঘের ভার্সিটিতে ও তোমাকে মেঘের আশেপাশে দেখা গেছে। তুমি চাইছো কি? মেঘের বিয়েটা ভেঙে যাক?
-আসলে ....না খালা।
-তোমার পায়ে পড়ি বাবা তুমি চলে যাও এইবাড়ি থেকে।
খালা পায়ে ধরতে উদ্যত হলেন আমি সরে গেলাম।
-খালা, আমি মেঘকে প্রচন্ড ভালবাসি।
-আবার এসব বলছ। তুমি আজ এখনই চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে। একজন মা হিসেবে তোমার কাছে আকুল আবেদন তিয়াস।
আমি বসে আছি শাহাবাগে, মনটা খুব খারাপ। মেঘকে না বলেই চলে এসেছি, গোলাপের তোড়াটাও দেয়া হয়নি। বলেছিলাম খালাকে শেষবারের মত দেখা করে ওকে ফুলগুলো দিয়ে যাই, খালা বারণ করলেন। নিজেকে আজ পরাজিত যোদ্ধা মনে হচ্ছে।
বৃষ্টি হচ্ছে, প্রচন্ড বৃষ্টি। মেঘের কথা মনে হচ্ছে। কখনো ওকে ভালবাসি বলতে না পারার নিরব কষ্টগুলো বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে যেন আরও বেড়ে গেল। একটা ব্যাপার বুঝলাম, ভালবাসা মধ্যবিত্তদের জন্য নয়, নয় আমার মতো মাস্টার্স শেষ করা বেকারদের জন্য।
ভাল চাকরি পেতে মেধা লাগেনা এই শহরে, লাগে টাকা, তাহলে দেখা যায় সুখের স্বপ্ন। বাসা বাধা যায় ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে। আমার কাছে টাকা নেই তাই মেঘ আজ অন্যের।
দেহটাই শুধু ভিজছে, মন টা শুকনো আজও। না পাওয়ার গ্লানি নিয়ে বেচেঁ থাকব শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। হয়তো মেঘ ও ভুলে যাবে একদিন এই তিয়াসকে কিন্তু প্রতিবারই হারিয়ে যাওয়া মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে আমার চোখে।
হাতে থাকা ফুলের তোড়াটা ছুড়ে মারলাম রাজপথে, দুমড়ে পিষিয়ে দিল গোলাপ গুলো একটা প্রাইভেট গাড়ির চাকা। আসলে ফুল নয় রাস্তায় পিষে গেল আমার ছন্নছাড়া ভালবাসাটা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Rafi ২৩/১২/২০১৪Awesome (Y)
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ২২/১২/২০১৪বাহ চমৎকার। এতটা ভালো লেগেছে যে প্রিয়তে রেখে দিলাম।
-
নাবিক ২২/১২/২০১৪সুন্দর গল্প। শুভেচ্ছা