www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভাল থেকো

-
কয়েকদিন ধরেই খুব অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে নাসিম । রাতে ঘুম হচ্ছে না । লেখাপড়ায়ও মনোযোগ দিতে পারছে না । শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টে চতুর্থ পর্বের ছাত্র নাসিম । বরাবরই ভাল ছাত্র ও । সারা ইন্সটিটিউটে এক নামে ওকে চেনে সবাই ।
কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের আখি নামের একটি মেয়েকে ভালবাসে নাসিম । দু’বছর আগে যখন ও ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয় তখনই আখিকে ভালো লাগে ওর । খুব একটা রূপবতী বলা যাবে না ওকে । কিন্তু ওর মধ্যে কি যেন একটা আছে যা বরাবরই আকর্ষন করে নাসিমকে । আধুনিক যুগের অন্যসব মেয়েদের মত আধুনিক নয় আখি । প্রসাধনী ব্যবহার করে রূপসৌন্দর্য বাড়ানোর কোন প্রচেষ্টা নেই । পোশাক-আশাকেও বেশ ভদ্র মেয়েটি । প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলে না ।
চোখ দুটি বড় সুন্দর আখির । নাসিমের সাথে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে । নাসিমের তখন মনে হয়েছে ইস এমনিভাবে যদি সারাজীবন ওর চোখে চোখ রাখতে পারতো । কিন্তু মেয়েটি চোখ ফেরানোর আগে হয়তো নাসিমেরই চোখ সরে যায় ।
মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলে না নাসিম । মেয়েরাই অনেকসময় গায়ে পড়ে ওর সাথে কথা বলতে আসে । নাসিম নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে দু’একটা কথা বলে ।
এই দু’বছর নাসিমের চিন্তা-চেতনা-স্বপ্ন সবকিছু জুড়ে ছিল শুধু আখি । এমন এক দিন নেই যেদিন ও শোবার আগে আখিকে নিয়ে স্বপ্ন আঁকেনি । বাস্তবে না হোক কল্পনায় প্রতিদিন ওর সাথে কথা হয় নাসিমের । নাসিম জানেনা এই স্বপ্নগুলো কোনদিন আলোর দেখা পাবে কিনা । কিন্তু আখিকে ছাড়া এ জীবন শূন্য মনে হয় ।
আখিকে কখনো কখনো মনের কথা খুলে বলতে ইচ্ছে হয়েছে ওর । কিন্তু প্রতিবারই পরাজিত হয়েছে ও । কিসের যেন একটা ভয় ওর মনের মধ্যে । আখি যদি ওকে ফিরিয়ে দেয় , তবে নাসিম কি নিয়ে বাচবে ? এতদিনের মনে আঁকা স্বপ্নগুলো যে মিছে হয়ে যাবে ।
কিন্তু আজ কয়েকদিন ধরে কি যে হয়েছে ওর ।কিছুতেই মন বসছে না । সামনে মিডটার্ম । এখন এমন হলে পরিক্ষা খুব খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক । কারও চোখে ধরা না পরলেও মায়ের চোখে ঠিকই ধরা পড়ে যায় । কয়েকদিন আগে যখন ও মেস থেকে বাড়ি যায় মা জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে কি হয়েছে তোর ?’
‘কই মা কিছু হয়নি তো ।’
‘তবে সারাক্ষন কি নিয়ে ভাবিস এত ? পড়ালেখাও করছিস না ঠিকমত । দিনে দিনে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস । অসুখ-টসুখ করেনি তো আবার ?’
‘না মা কিছু হয়নি । তুমি মিছে চিন্তা করোনা তো ।’
নাসিমের নিজের কাছেও মনে হয় তার প্রচন্ড অসুখ করেছে । তবে সেটা শারীরিক নয় মানসিক । আখিকে কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ওর মনের ভেতরটা সারাক্ষন ছটফট করতে থাকে ।
লুকিয়ে লুকিয়ে আখিকে বহুবার দেখেছে নাসিম । আখি হয়তো ওর বান্ধবীদের নিয়ে ওপাশের দোতলা বিল্ডিংটার রেলিং ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে । নাসিম এপাশের পাঁচতলা বিল্ডিং এর চারতলা থেকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে । বন্ধুরা হয়তো বলছে , ‘নাসিম চল লাইব্রেরীতে যাই । পত্রিকাটা দেখে আসি ।’
কিন্তু ওরা কি জানে নাসিমের মন পড়ে রয়েছে দোতলার রেলিংয়ে । লাইব্রেরীতে যাবে না কেন নাসিম ? নিশ্চয়ই যাবে । যখন আখি লাইব্রেরীতে থাকবে । পত্রিকা পড়ার ভান করে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখবে নাসিম । আর বিরবির করে বলবে , ‘সত্যিই খুব সুন্দর তুমি । আমি তোমাকে চাই আখি ।’
নাসিমের সাথে তৌহিদ আর মুরাদ একই রুমে থাকে । তৌহিদ টেলিকমিউনিকেশন আর মুরাদ ইলেকট্রনিক্সের ছাত্র । অবসরে ওদের সাথে গল্প করে , দাবা খেলে সময় কাটে । কখনো কখনো পাশের রুমের সারোয়ার আর শামীমও চলে আসে । সারোয়ার তুখোড় দাবারু । কেউ ওর সাথে পেরে ওঠে না । নাসিম একদিনই ওর সাথে জিতেছিল । তবে সারোয়ারের সেদিন কেন যেন খেলায় মোটেই মনোযোগ ছিল না । সারোয়ার আর শামীম দুজনেই কম্পিউটার টেকনোলজীতে পড়ে । শামীমের ব্রেইন নিতান্তই কম ।কোন একটা সাধারন ব্যাপারও খুব সহজে বুঝতে পারে না । কিন্তু অধ্যবসায় আছে ছেলেটার । গভীর রাতে আমাদের যখন একঘুম হয়ে যায় তখনও শামীমের পড়ার গুনগুন শব্দ শোনা যায় । খুবই সহজ-সরল মানুষ ও । কঠোর পরিশ্রমের ফলে দেখা যায় অনেক ভাল ছাত্র অপেক্ষাও পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে ।
সারোয়ারের চেহারায় কেমন জানি একটা মায়ামায়া ভাব আছে । বিশেষ করে ওর চোখ দুটিকে খুবই ভালো লাগে নাসিমের । ওর মুখে একগাল হাসি লেগেই থাকে । কোনদিন ওকে জিজ্ঞেস করেনি নাসিম কিন্তু চালচলনে বোঝা যায় ওর আর্থিক অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয় । নাসিম যেখানে মাসে মাসে নতুন নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে সেখানে সারোয়ারকে বছরে দুটোর বেশি শার্ট পড়তে দেখা যায়নি । জুতোজোড়াও বহুবার সেলানো । বিকেলের দিকে দুজন ছাত্র পড়ায় সারোয়ার । সেই সাথে বাড়ি থেকে পাঠানো কিছু টাকা দিয়ে হয়তো অতি কষ্টে খরচাপাতি চলে । এই সারোয়ারই যে নাসিমকে হারিয়ে দেবে তাই বা কে জানত ? সারোয়ারের কথা থাক ।
নিজের মনের কথা আখিকে না বলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না নাসিম । কিন্তু তেমন সুযোগ হয়ে উঠে না । সবার সামনে তো আর এসব কথা বলা যায় না । অন্য কেউ পারলেও নাসিম পারবে না ।
অবশেষে একদিন ওকে একা পেয়ে গেল নাসিম । মাঠে ছেলেরা ভলিবল খেলছিল । তিনতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সেদিক চেয়ে ছিল আখি । নাসিম, মাহবুব স্যারের চেম্বার থেকে ফিরছিল । আখিকে দেখে ওর পাশে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ায় । আখি ঘুরে তাকায় ওর দিকে ।
‘খেলা দেখছেন ?’
‘হ্যা নাসিম ভাই । আপনি কেমন আছেন ?’
‘তা আছি একরকম ভালই । খুব ভাল আর থাকতে পারলাম কই ?’
‘কেন কি হয়েছে ?’
‘আখি……… ।’
‘কি কিছু বলবেন ?’
‘আখি……… ।’
‘আখি আখি করছেন কেন ? কিছু বলতে চাইলে……… ।’
‘হ্যা আখি….. ’ আবার থেমে যায় নাসিম , ‘আজ আমি তোমাকে খুব কঠিন একটা কথা বলব । কিন্তু কিভাবে যে বলি…..।’
চমকে উঠে আখি । ঠোট দুটি কেঁপে ওঠে ওর । পরক্ষনেই একটু হেসে বলে , ‘ কি এমন কথা বলে ফেলুন ।’
‘আমি আআমি তোমাকে ভালবাসি আখি ।’
‘এ আপনি কি বলছেন । আমি তো আপনাকে ভালমানুষ হিসেবেই জানতাম । ছিঃ ছিঃ আপনি এত নীচ ।’ আখির কন্ঠ আস্তে আস্তে কর্কশ হয়ে ওঠে । ওর চোখমুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ।
‘কেন আখি । কি হয়েছে ?’
‘রাবিশ ।’ বলে চলে যায় আখি । ওর চলার পথের দিকে চেয়ে নিজেকে বড় ছোট মনে হয় নাসিমের । ইচ্ছে হয় তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতে । তুমি আমাকে নীচ বললে আখি । কেন ? কি করেছি আমি ? নিজের ভাললাগার কথা বলাটা কি অপরাধ ?
নাসিম ভাবে, আখি আমাকে প্রত্যাখ্যান করল । তবে কি আখি অন্য কাউকে ভালবাসে ? ভাবতে গিয়ে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে নাসিমের । না আখি তুমি অন্য কাউকে ভালবাসতে পার না । তুমি শুধুই আমার । তুমি শুধুই আমাকে ভালবাসবে । শুধুই আমাকে । অন্য কাউকে নয় । নাসিমের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে । নিজের ওপর প্রচন্ড অভিমান হয় ।
‘কে আমি ? কি আছে আমার ? কোন যোগ্যতায় আমি আখির মত একটি মেয়েকে ভালবাসতে চেয়েছি?’
নিজেকে বড় অযোগ্য আর নিঃসঙ্গ মনে হয় নাসিমের ।
‘জানো আখি তোমার জন্য আমি কত মেয়ের ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছি । আর তুমি কিনা……? আমি পরাজিত । পরাজিত ।’
দু’দিন নাসিম ইন্সটিটিউটে গেলনা । শুধু ভাবতে লাগল সেই ছলনাময়ীর কথা , যে ভেংগে দিল নাসিমের বুকের মাঝে দুবছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটি ভালবাসা । নাসিম ওর ভালবাসার অপমৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা ।
দু’দিন শুধু বিছানায় শুয়ে ছটফট করল নাসিম । আর রাতের বেলা বাইরে বেড়িয়ে শুধু আকাশের দিকে চেয়ে বিরবির করে কি বলতে লাগল । মুরাদ আর তৌহিদ জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে নাসিম কলেজে যাচ্ছিস না কেন? ’
‘এমনিই ভাল লাগছে না ।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছিস ?’
‘না সেরকম কিছু হয়নি ।’
তৃতীয় দিন নাসিম ইন্সটিটিউটে গেল । ওর কেন জানি মনে হয়েছে যত অপমানই আখি ওকে করুক না কেন একদিন আখি নিশ্চয়ই ওর হবে ।’
রেলিং ধরে বিষন্ন মনে একা একা দাড়িয়ে ছিল নাসিম । এমন সময় আখি এল । নাসিম ভাবল এবার নিশ্চয়ই আখি নাসিমের ভালবাসাকে গ্রহন করবে ।
‘নাসিম ভাই ।’ আখির ডাকে নাসিম কোন সাড়া দিল না ।
আখি আবার ডাকল, ’নাসিম ভাই ।’
‘কিছু বলবে আখি ।’
‘হ্যা নাসিম ভাই । আসলে সেদিনের ওই ব্যাপারটার জন্য আমি খুবই দুঃখিত । আমাকে ক্ষমা করে দিন নাসিম ভাই ।গত দুদিন আমি খুবই অনুতাপে ভুগেছি । আপনাকে কত খুঁজেও পেলাম না । আসলে সেদিন কি যে হয়ে গেল । আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি ।’
নাসিম কোন কথা বলল না ।
আখি আবার বলল ,‘আসলে নাসিম ভাই আপনি খুবই ভাল । কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই । আমি যে অন্য একজনকে ভালবাসি ।’
নাসিমের কান ঝা ঝা করতে লাগল । এটা কি বলছে আখি । সে অন্য কাউকে ভালবাসে । না না এ হতে পারেনা । ক্ষীণস্বরে নাসিম বলল, ‘কাকে ?’
‘সারোয়ারকে । সারোয়ারকে আমি ভালোবাসি ।’
নাসিমের বুকের ভিতরটা হঠাৎ যেন ঝাঁকি দিয়ে উঠল । তারপর দ্রুত সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল ,‘সেকি আমি জানিনা আখি ? আসলে কি হয়েছে জানো সারোয়ার তো আমার ভালো বন্ধু । ওর প্রতি তোমার ভালবাসার গভীরতা পরীক্ষা করার জন্যই………… ।’
‘সত্যি নাসিম ভাই ?’
‘আরে সত্যি মানে পুরোপুরি সত্যি । সেদিনই তোমাকে বলতাম , কিন্তু তুমি ওভাবে রেগে চলে যাবে তাইবা কে বুঝতে পেরেছিল ? সারোয়ার সত্যিই ভাগ্যবান ।’
‘স্যরি নাসিম ভাই । আসলে না বুঝে…………।’
‘ না না ঠিক আছে । আমি কিছু মনে করিনি । আসলে সারোয়ারের প্রতি তোমার ভালবাসার টান দেখে মুগ্ধই হয়েছি ।’
‘ওকে এখন যাই । স্যার ক্লাসে যাবে ।’
আখি চলে যাবার পর নাসিম ভাবে সারোয়ারের কথা । সারোয়ার, তুই আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিলি । না না আমি তোকে ছাড়বনা । কিছুতেই ছাড়বনা । আমার ভালবাসা কেড়ে নিয়ে তোকে সুখে থাকতে দিব না ।
থার্ড পিরিয়ড পর নাসিম দেখল দোতলার সেই ছাদের ওপর সারোয়ার আর আখি দাঁড়িয়ে আছে । নাসিম ভাবল, ওদের দুজনকে তো খুব মানিয়েছে । ‘থাক । তোরা সুখি হ ’ । সারোয়ারের প্রতি নাসিমের আর কোন রাগ রইল না । কি হবে এমন পবিত্র একটা প্রেমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ?’
সারোয়ারকে আখির জীবন থেকে কোনভাবে সরাতে পারলেও কি ও নাসিমকে গ্রহন করবে ? নিশ্চয়ই না । নাসিম আখির মনে কোন কষ্ট দিতে চায় না । ও শুধু আখিকে সুখী দেখতে চায় । ভালবাসার মানুষটি যদি পৃথিবীতে সুখী হয় তবে নাসিমের চেয়ে আর সুখী কে হবে ? না সারোয়ার আমি তোর প্রতিদ্বন্দ্বী নই, বন্ধু । আমার প্রিয়া তোকে ভালবাসে , আমাকেও যে তোকে ভালবাসতে হবে । হ্যা সারোয়ার আমি তোকে ভালবাসি । তুই আখিকে সুখে রাখিস । আমি প্রয়োজনে জীবন দিয়ে তোদের সাহায্য করব । নাসিমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল ।
ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে ফাইনাল পরীক্ষা । পূর্ণোদ্যমে পড়াশোনা শুরু করল নাসিম । সারোয়ারের দিকে খুব ভালভাবে নজর রাখছে ও । কয়েকদিন ধরে নক্ষ্য করল সারোয়ার ঠিকমত পড়াশোনা করছে না । সারাক্ষণ কি নিয়ে যেন ভাবে । নাসিম জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে সারোয়ার কি হয়েছে তোর ?’
‘কই কিছু হয়নি তো ।’
‘আমাকে লুকোস না সারোয়ার । আখির সাথে কিছু হয়নি তো ?’
‘আখি ! কোন আখি ?’
‘আহ ন্যাকামি করিস না তো । কজন আখিকে চিনিস তুই ?’
‘তুই তাহলে জানিস নাসিম । না আখির সাথে কিছুই হয়নি ।’
‘তাহলে ?’
‘এবার বুঝি আমার পরীক্ষা দেয়া আর হল না ।’
‘কেন ? পরীক্ষা দিবি না কেন ?’
‘ কাল ফি দেয়ার শেষ দিন এখন পর্যন্ত টাকার জোগাড় হয়নি ।’
‘ ও এই কথা ? আগে বলিসনি কেন ? এই নাসিম কি তোর পর ? ভাবিস না এত , আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে নিস ।’
‘না নাসিম, সে আমি পারব না । ’
‘চুপ একটা থাপ্পড় দেব । কেন নিবি না তোর কি মনে হয় আমি তোকে করূণা করছি ? মোটেই না । কিন্তু মানুষের বিপদে মানুষই তো এগিয়ে আসে ।’
‘কিন্তু……………।’
‘কোন কিন্তু নয় । একবার ভেবে দেখ আখির কথা । আখির জন্য হলেও তো তোকে পারতে হবে । আচ্ছা তোর যখন এতই ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে তবে তোর যখন অনেক টাকা হবে তখন ফিরিয়ে দিস ।’
‘অনেক টাকা হবে মানে ?’
‘বারে অনেক টাকা হবে না ? তুই হবি ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, তোর বউ হবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার । তখন তো তোর টাকা রাখারই জায়গা হবে না । আমরা বন্ধু-বান্ধব দু’একজন না খেলে তো তুই টাকার সমুদ্রে হাবুডুবুই খাবি ।’
‘দূর তাই কি হয় নাকি ?’
‘আর কথা বাড়াসনে ভাই । তুই পরীক্ষা দিবি আমি শুধু এটা দেখতে চাই ।’
নাসিমের নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হল । সে কেন সারোয়ারের খোঁজখবর নেয়নি । আর দু’দিন পরে হলে তো ও পরীক্ষাই দিতে পারত না ।
পরীক্ষার পর প্রায় সবাই মেস ছেড়ে বাড়ি চলে গেল । ইন্সটিটিউট খোলার পরপরই পিকনিকের আয়োজন চলতে লাগল । ঠিক হল সবাই মিলে কক্সবাজারে যাবে । এসব ব্যাপারে আবার নাসিমের উৎসাহ সবসময়ই বেশি থাকে ।
চাঁদা সংগ্রহ, বাস জোগাড় ইত্যাদি কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাসিম । সমুদ্র সৈকতে গিয়ে কে কি করবে তা নিয়ে প্ল্যানের শেষ নেই । খুবই ব্যস্ত থাকার কারনে নাসিম সারোয়ারের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল । সামান্য ভাবলেই বুঝতে পারত যে বই কেনার টাকাই জোগাড় করতে পারেনা সে কিভাবে পিকনিকে যাবে ? পিকনিকের দু’দিন আগে হঠাৎ ওর মনে পড়ায় সারোয়ারকে জিজ্ঞেস করল, ‘কক্সবাজার যাচ্ছিস তো ?’
সারোয়ার কোন কথা বলল না ।
নাসিম বুঝতে পারল ও যাবে না ।
‘যাবিনা তাহলে ? কেন আখি কি যাবেনা ?’
‘হ্যা ও যাবে বলছিল । চাঁদাও দিয়েছিল । কিন্তু আমি না যাওয়াতে নাকি যাবেনা ।’
‘কাজটা ঠিক হবে না সারোয়ার । এমন সুযোগ বারবার আসে না । আখিকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়াবি আর মনের কথা খুলে বলবি । খুবই রোমাঞ্চের ব্যাপার তাই না ।’ আখি মেয়েটাও কি কষ্ট পাবে না ? সৈকতে গিয়ে তোরা কি করবি সব পরিকল্পনা হয়তো মনের মাঝে একে ফেলেছিল । এখন ওকে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হবে ? তুই যা সারোয়ার । সব ব্যবস্থা আমি করব ।
‘রক্ষে কর নাসিম । আমার জন্য অনেক করেছিস আর কেন ?’
‘তোর জন্য কিছু করতে পারলে তো খুশিই হতাম । তা আর করতে পারলাম কই ।’ নাসিম বিরবির করে বলল ।
‘কিছু বলছিস ?’
‘বলছি কেন যাবি না তুই । একদিনই তো বলেছি যখন অনেক টাকা হবে তখন দিবি । এত কেপ্পন তুই ? ভবিষ্যতে টাকা ক্ষয়ের কথা ভাবছিস ।’
‘দূর কি যে বলিস ।’
‘তবে আর কোন আপত্তি নয় ।’
‘তোর সাথে কথা বলে পারা যায় না । কিন্তু চাইলেই কি যেতে পারব সিট তো পূর্ণ হয়ে গেছে ।’
নাসিমের মনে হল, আরে তাই তো । কয়েকজন তো সিটের অভাবে যেতেই পারল না । কিন্তু সারোয়ারকে যে নেবার ব্যবস্থা করতেই হবে । বলল, ‘ সিট খালি নেই ঠিক । কিন্তু আমার যাওয়া হচ্ছে না । আমার এক কাজিন , আজই ওর বিয়ের কথা ছিল । কিন্তু কি যে হল হঠাৎ করেই দু’দিন পিছিয়ে গেল । ঠিক যেদিন পিকনিক সেদিনই । আমাকে ওখানে থাকতে হবে । আমি তো আজই বাড়ি চলে যাচ্ছি । আমার বদলে তুই যাস ।’
সারোয়ার বুঝে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন লুকোচুরি আছে । কিন্তু বুঝতে পারেনা ওর জন্য এত করে নাসিমের কি লাভ ?
পিকনিকের কয়েকদিন পরের কথা । কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল নাসিম । সারোয়ারের ঘরে উকি মেরে বলল , ‘কিরে সারোয়ার কলেজে যাবি না ? এখনো শুয়ে কেন ?
‘নারে যাবনা । শরীরটা বিশেষ ভাল না ।’ সারোয়ার কোঁকাতে কোঁকাতে বলল ।
নাসিম ঘরে ঢুকে ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখল প্রচন্ড জ্বর ।
‘জ্বরে যে গা পুরে যাচ্ছে । এখনই ডাক্তার দেখাতে হবে ।’
সারোয়ার কোঁকাতেই বলল , ‘দরকার নেই । এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে । তুই কলেজে যা ।’
নাসিম ওর কোন কথাই শুনল না । তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসল । ওষুধ কিনে আনল । আর সারাক্ষণ ওর সেবা করতে লাগল । রাত জেগে কপালে জলপট্টি দিল ।
তৃতীয় দিন সারোয়ারের জ্বর কিছুটা কমল । ওর শিয়রের পাশে বসে ছিল নাসিম । হঠাৎ ওর একটা হাত ধরে ফেলল সারোয়ার, ‘তুই আমার জন্য এত করছিস কেন ?’
‘কই কি এমন করলাম ?’
‘কলেজের বেতন দিলি, বই কিনে দিলি, নিজে পিকনিকে না গিয়ে আমাকে যেতে দিলি, আর রাত জেগে সেবা করে গেলি আমার । কেন ? কেন এত করিস তুই আমার জন্য ।’
নাসিম মনে মনে বলল, ‘কারন আমি যে তোকে ভালবাসি ।’
“যে আমার প্রিয়ার প্রিয় সে আমার মহাপ্রিয়”
মুখে বলল, ‘ তুই যে আমার বন্ধু । বন্ধুর জন্য যদি এতটুকুই না করতে তবে আর কিসের বন্ধু ।’
‘কিন্তু আমি কি কখনো তোর জন্য এতটুকু করতে পারব ? তোর কাছে যে আমি ঋনী হয়ে রইলাম ।’
‘একে ঋন বলছিস কেন ? বন্ধুর জন্য বন্ধু অনেক কিছুই করতে পারে । শুধু এটুকু কেন তোর জন্য যে আমি আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি ।’ শেষের কথাগুলো এমনভাবে বলল যে সারোয়ার তার কিছুই বুঝল না ।
নাসিমের হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, ‘তুই বড় ভাল রে নাসিম ।’ বলতে বলতে সারোয়ারের দুগাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল ।
উপরে যে কাহিনীটা বললাম তা হয়তো পুরোটাই কাল্পনিক । কিন্তু আমাদের সবার প্রেমের আদর্শ কি নাসিমের মত হওয়া উচিত না ? সেই তো প্রকৃত প্রেমিক যে প্রতিদানের আশা না করে শুধু ভালবেসে যায় । সে ভালবাসা কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করে ত্যাগের মাধ্যমে ভালবাসার প্রকৃত অর্থটা খুঁজে বেড়ায় ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৫৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০৯/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • বেশ ভালো। যেন এক হৃদয় ছুয়ে যায় এমন প্রেমের গল্প। ভালো। তবে আপনার চরিত্র কোনটা?
    • ১৩/০৯/২০১৪
      ধন্যবাদ ।
      আমার কোন চরিত্র নেই আমি চরিত্রহীন । হা হা হা ।
  • ভাল লাগল বেশ সুন্দর হয়েছে।
    • ১২/০৯/২০১৪
      ধন্যবাদ ।
      শুভকামনা আপনাকে ।
 
Quantcast