ভ্রমন বিলাস
ভ্রমন বিলাস
মোঃ রায়হান কাজী
বেশ কয়েকদিন ধরে মনটা আনচান আনচান করতে ছিলো। কিন্তু তা ঠিক কি কারণে হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ইদানিং রাত হলে কেন জানি ঘুম কম হয়? মনে হয় মাথায় কোনো এক টেনশন ভর করেছে।
এরিমধ্য মিজান ভাই আমাকে কল করলো। তারপর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হলো। এর ফাঁকে তিনি তাদের এলাকায় যাওয়া জন্য দীর্ঘদিন যাবত আমন্ত্রণ করতে ছিলো।
মিজান ভাইয়ের বিষয়ে বলতে উনার সাথে আমার প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্ক। তার সাথে এই সম্পর্ক গড়ে উঠে লেখালেখির মাধ্যমে। কারণ তিনি একাধারে একজন কবি, সাহিত্যেক একিসাথে গজল গেয়ে থাকেন। তো সেদিক দিয়ে বলতে গেলে উনার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
এরমাঝে আমার আবার টিভির বেশ কিছু প্রোগ্রাম হাতে ছিলো। তো এর জন্য আমাদের টিমের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ছিলো আমার উপর৷ সপ্তাহখানেক পর ছিলো আমাদের ঈদুল আজহার প্রোগ্রাম। তাই এগুলো নিয়েও ব্যস্ত ছিলাম। যাইহোক যতোই ব্যস্ত থাকি না কেন আমার কোনো এক কারণে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছিলো না৷ আর ডিপ্রেশনে ভোগাতে ছিলাম।
সে দিন সন্ধ্যায় মিজান ভাইকে ফোন করে বললাম তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিষয়ে। উনি কথা শোনে অনেক আনন্দিত হয়েছেন। একিসাথে বিস্মৃত হয়েছেন। কারণ আদোও আমি সত্যি যাবো কিনা ওনার বাড়ি। যা নিয়ে তিনি বেশ দিদাদ্বন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন। তো উনি আমাকে বললেন আপনি যদি আসেন আমি খুব খুশি হবো। সিদ্ধান্তটা সন্ধ্যায় যার কারণে তিনি আমাকে রাত বারোটা নাগাদ আবারও কল করলেন কখন রওনা হবো যানার জন্য। আমি উনাকে জানিয়ে দিলাম খুব সকালে রওনা হবো।
আপনাদেরকে বলা হয়নি এখনো মিজান ভাইয়ের বাসা সম্পর্কে উনার গ্রামের বাড়ি ছিলো হালুয়াঘাট জেলায় ময়মনসিংহ বিভাগে। যেহেতু খুব সকালে রওনা দিবো তাই তড়িঘড়ি করে কিছু জামা-কাপড় সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঝটপট ব্যাগ ঘুছিয়ে রাখি। মোবাইলে এ্যালাম দিলাম যাতে করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে সমস্যা না হয়। সে রাতেও অনেক চেষ্টা করলাম ঘুমানোর জন্য ঘুম কোনো ভাবেই আসছিলো না। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেলে। তাই নিজে থেকে মোবাইলে এ্যালাম বন্ধ করে একটু ফ্রেশ হয়ে। রুমমেটকে বলে তাড়াতাড়ি করে ছুটলাম মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের দিকে৷ সেখান থেকে হালুয়াঘাটের বাসে চেপে বসি ভ্রমন বিলাসী হয়ে। খুব একটা দেরি হলো না বাস ছাড়তে।
বাস ছাড়ার খানিকক্ষণ পরে বাসের জানালা দিয়ে লক্ষ করলাম টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। এমনিতে ঢাকা থেকে চৌরাস্তা অবধি প্রচুর জ্যাম থাকে। সকাল সকাল রওনা হওয়াতে রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিলো না। আধা ঘন্টার মধ্যে তাই চৌরাস্তা পৌঁছে গেলাম। তারপর বাস ছুটে চললো ময়মনসিংহের অভিমুখে। সকাল আটটা বিশ মিনিট নাগাদ ময়মনসিংহ পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে মিজান ভাইকে ফোন বললাম হালুয়াঘাট কোথায় নামতে হবে? উনি ধারা বাজার নামার কথা বললো। বাসের হ্যালপারকে ডেকে বললাম মামা আমাকে ধারা বাজার নামিয়ে দিও। এভাবে দেখতে দেখতে নয়টা বাইশে আমাকে ধারা বাজার নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে মিজান ভাই আমাকে রিসিভ করে তার বাসায় নিয়ে যায়।
বাসায় যাওয়ার পর একটু ফ্রেশ হয়ে ওনার বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসে। তাই একটু ঘুমিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ উঠে হালকা নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়ি হালুয়াঘাট ঘুরে দেখার উদ্দেশ্য। তার জন্য মিজান ভাই তার পরিচিত একজনকে কল করে তার নাম ছিলো সুফিয়ান। সুফিয়ান ভাই বাইক নিয়ে ধারা বাজার আসে। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ঘুরে বেড়ানোর।
বাইকে রওনা দেওয়ার পর ছুটে চলা হালুয়াঘাট শহরের দিকে। সেখান থেকে আমরা আবারও ছুটি চলি শেরপুর নালিতাবাড়ীর অভিমুখে। উদ্দেশ্য ছিলো মধুটিলা ইকোপার্কে যাওয়া। যাওয়ার পথে সুফিয়ান ভাই প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে যায় গোবরাকুড়া স্থলবন্দরের দিকে।
গোবরাকুড়া কড়ইতলী স্থলবন্দর যাওয়া পথে দেখতে পেলাম কয়লার চালান করা বিভিন্ন ইজারাদারদের কয়লা মজুদ করে রাখা হয়েছে। অনেকটা স্টলয়ের মতো করে। মূলত এই কয়লাগুলো ভারত থেকে এনে তা সংরক্ষণ করেছে।
তারপর আবারও ছুটে চলা। পথে সীমান্ত ঘেরা একটা নদী দেখলাম। নদীর নামটা অজানা। নদীতে টায়ারের টিউব দেওয়া। সুফিয়ান ভাই বললো, যখন নদীতে পানি বাড়ে। তখন টিউবগুলো ফোলানো হয়। এসব দেখার জন্য নাকি এখানে অনেক লোকজন আসে।
সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে চলতে চলতে ভারতের পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য উপভোগ করি। একপর্যায়ে দেখতে পেলাম নকুগাঁও স্থলবন্দর কাছাকাছি ভারতীয় ট্রাকে করে পাথরের চালান আসতে। সেই পাথর আবার মেশিন দিয়ে ভাঙানো হচ্ছে। নকুগাঁও স্থলবন্দর সীমান্তে বিজিবির সাথে কথা বললাম সীমান্তের ওপারে যাওয়া বিষয়ে। উনারা আমাদের ভিতরে না যাওয়া জন্য বললেন।
নকুগাঁও থেকে আবারও ছুটে চলা। এবারের গন্তব্য ছিলো মধুটিলা ইকোপার্ক। সেখান থেকে উঁচুনিচু পাহাড় তার সাথে সেগুন, শাল আর বাহারি গাছের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে করতে পৌঁছালাম মধুটিলা ইকোপার্কে। সেখানে একটা দোকানে খানিকটা নাস্তা করি। ইকোপার্কের গেট থেকে তিনজন সাথে বাইক পার্কিং করার জন্য টিকেটের মূল্য রাখে একশো টাকা। উল্লেখ্য টিকেটের মূল্য জনপ্রতি বিশ টাকা।
একটু বলেরাখি মধুটিলা ইকোপার্কের অবস্থান শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায়। পোড়াগাঁওয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারিভাবে মধুটিলা ইকোপার্কের অবস্থান। মধুটিলা ইকোপার্কে ভিতরে ডুকতেই দুপাশে সাড়িসাড়ি শোভাবর্ধনকারী বিড়ল প্রজাতির গাছের মধ্যে সেগুন, মহামূল্যবান শাল গাছের বেশি দেখা মিলে। সেই সাথে বিশ একরের ঔষধি বৃক্ষের বনায়ন ঘুরে দেখি। ইকোপার্কটিতে রয়েছে রেস্টহাউজ, বাসগৃহ, আকর্ষনীয় রাইড, স্টার ব্রীজ, কেন্টিন, মিনিচিড়িয়াখানা সেই সাথে পাহাড়ি টিলা, ঝাউবন এবং ওয়াচ টাওয়ার।
মধুটিলা ইকোপার্কের মেইন পটক দিয়ে প্রবেশের সময় চোখে পড়ল দুইটা ঘোড়া। সেগুলো পাশকাটিয়ে পৌঁছালাম স্টার ব্রীজে। সেখানকার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার ছিলো। মাঝখানে লেক দু'ধারে পাহাড় আর সবুজ বনায়ন। তারপর বেশকিছু পাহাড় দেখতে পায়। তারমধ্যে প্রতিটা পাহাড়ে উঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিলো । সেখান একটি পাহাড়ে চড়ি। পাহাড়ের আশেপাশের মূল সৌন্দর্য উপভোগ করে কিছু ছবি তুলে নেমে পড়ি। টিলা থেকে নামার পর পথে জামরুল গাছে পাকা জামরুল দেখতে পায়। যা দেখে সুফিয়ান ভাই জামরুল গাছ থেকে তা পাড়া শুরু করে। পরবর্তীতে সেগুলো আমরা কিছু খায়৷ হঠাৎ দেখি মিজান ভাই আমাদের সাথে নেই। তাকে খুঁজতেই দেখতে পেলাম, তিনি লজ্জাবতী গাছের সাথে খেলছেন। তো তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কি করছেন? উনি আমাকে লজ্জাবতী গাছের আশ্চর্যকর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখালেন। যা আমি আগে কখনো দেখিনি এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে দিলে তা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। এই গাছের পাতা অনেকটা তেঁতুল গাছের পাতার মতো আর ছোট আকৃতির। তারপর সুফিয়ান ভাই আমাদেরকে নিয়ে গেল ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। ওয়াচ টাওয়ারের উঠার জন্য জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ছিলো ১০ টাকা করে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ইকোপার্কের সবুজ অরুণ্য, পাহাড়ি টিলা সাথে লেকের জলরাশি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের রূপরেখা মনে দোলা দেয়।
ইকোপার্ক থেকে আসার পথে সুফিয়ান ভাই আমাদের একটা নদীর কাছে নিয়ে যায়। তো যাওয়ার পথে পাহাড়ি মেঠোপথ আর সেগুন আর শাল বৃক্ষের সৌন্দর্য মেবাইলে ভিডিও ধারণ করতেছিলাম। এমন সময় একজন ব্যক্ত তেড়ে এসে বললো মোবাইলের ক্যামেরা বন্ধ করার জন্য। হঠাৎ করে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পড়ে খেয়াল করে দেখলাম নদী থেকে অবৈধভাবে তারা সিলেকশন বালু আর পাথর তুলছে। আমি মেবাইলের ক্যামেরা বন্ধ করে তাদের আসস্ত করলাম। আমি আপনাদের ভিডিও করতেছিনা। তাদেরকে বুজিয়ে বললাম ঘুরতে আসার বিষয়ে। তারপর কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে নদীর রূপ উপভোগ করি।
এই পাশটাকে অনেকে গজনী নামে অবহিত করে সেখান থেকে বের হয়ে রওনা হয় হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্য অথাৎ মিজান ভাইয়ের বাড়িতে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে রাস্তার দু'পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আসার সময় মিজান ভাইয়ের এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। উনার সাথে একটা চা'য়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার এক ফাঁকে জনৈক ব্যক্তি হাতির আক্রমনের কথা বললেন। তো আমি বললাম, পথে কোনো হাতি দেখলাম হাতি কোথায় থেকে আসে? তখন জনৈক ব্যক্তি আমাকে বললো, হাতি ভারতের পাহাড় থেকে আসে। এই হাতি খুবি আক্রমনাত্মক এই বলে তিনি তার মোবাইলে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক হাতির পাড়ায় পিস্ত হওয়া একটা লোকের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখায়। যা দেখে আমার গা শিউরে ওঠে। এই বলে উনি আমাদেরকে দুর্ঘটনা যেখানে ঘটেছিলো সেখানে নিয়ে যাওয়া জন্য বলে। আমরা আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সাথে খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছায়। পৌঁছানোর পর ঐ জায়গাটার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যায়। খানিক মুহূর্ত পড়ে হাতির কথা একজন বলতেই সেই লোমহর্ষক ঘটনার কথা মনে পড়ে। বাইক থেকে নামতেই হাতির পায়ের বিশাল চাপ দেখতে পায়। একি সাথে একটা খেয়ে ফেলা কলাবাগান দেখায় জনৈক ব্যক্তি। তারপর পাশেয় দেখলাম মোটা তার দেওয়া। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের তার। উত্তরে তারা আমাকে বললো, এটা হচ্ছে জেনারেটরের তার। সন্ধ্যার পরে জেনারেটর চালানো হয়। কারণ হাতির আক্রমণ বেশিরভাগ সময় সন্ধ্যা কিংবা রাতের দিকে ঘটে। আর জেনারেটরের তারের কাছে আসলে হাতি কারেন্টের শর্ক খেলে তারা দূরে সরে যায়। তাই জেনারেটরের ব্যবস্তা করে রাখা। তাছাড়া কিছু দিন পরপর এখানকার লোকজন হাতির আক্রমণের শিকার হয়। তারপর হাতির পা'য়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে একটা বাড়িতে আসি। সেখান দেখলাম তাদের টিনের ঘর ভাঙ্গার অবস্থা। একজন মহিলাকে উঠানে দেখে বললাম, এটা কি হাতির আক্রমণ? প্রতি উত্তরে বললেন, এই ঘরে নয়মুন ধান আছিলো। হাতি সুর ডুকাইয়া সব খাইয়া লাইছে। এই কথাবার্তা শুনতে শুনতে চোখ পড়লো খানিকটা দূরে একটা টিনের ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে হাতির ধ্বংসাত্মক আক্রমণের আরো ভালো বর্ণনা পায়। নতুন টিনের ঘরের ছিন্নভিন্ন অবস্থা দেখে মনে মনে মনে বলতে লাগলাম, সত্যিই সৌন্দর্য সবসময় ভয়ংকর হয়।
তারপর হালুয়াঘাট এসে মিজান ভইয়ের বাড়িতে হাতমুখ ধোঁয়ে রাতের খাবার সম্পূর্ণ করি। সেই রাতে আমার বেশ ভালো ঘুম হয়। তারপরদিন সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠি।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়। সকালের নাস্তা সম্পূর্ণ করি। মিজান ভাই সুফিয়ান ভাইকে কল দিয়ে আসার জন্য বলে। সুফিয়ান প্রায় বারটা বাজে আসে। তো ঐদিন আমাদের গন্তব্য ছিলো গারো পাহাড় আর বিরিশিরি।
এরমধ্যে আপনাদের একটু বলে রাখা দরকার আমরা এতোক্ষণ যে মধুটিলা ইকোপার্ক এবং গজনীর কথা বলতে ছিলাম এগুলো মূলত গারো পাহাড়ের অংশবিশেষ। গারো পাহাড় বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বিস্তৃত একটি পর্বতশ্রেণী। গারো পাহাড় মূলত পূর্ব গারো পাহাড়, পশ্চিম গারো পাহাড় এবং দক্ষিণ গারো পাহার এই তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলাসমূহ গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলসমূহ এই পাহাড়ের পাদদেশীয় পালিজ সমৃদ্ধ। গারো পাহাড়ের উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমে রয়েছে আসাম এবং পূর্বে মেঘালয়ে খাসিয়া পাহাড়।
যাইহোক আমরা গারো পাহার আর নদীর বেষ্টিত অপরূপ সৌন্দর্যের বেলাভূমি দিয়ে বাইকে করে হালুয়াঘাট থেকে নেত্রকোনার অভিমুখে যাত্রা করি। যাওয়ার পথে মনের মধ্যে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ জুড়ে যে বিস্তৃত ফসলি ভূমি অবাধে গরু-ছাগলের বিচরণ সাথে কিছু ছোট ছোট পাহাড় থাকলেও মনে হচ্ছিল সব সৌন্দর্য বুঝি ভারতের অংশে পুঞ্জিভূত রয়েছে। দূরের সেই স্পর্শ না করা পাহাড়ি মেঠোপথে না যেতে পাড়ার আক্ষেপ আমাকে পোড়াচ্ছিল। এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম একটা নদীর তীরে। সেখান বাঁধ সাধলো খেয়াঘাটে খেয়া পারাপারের জন্য কোনো ব্যবস্তা না থাকা। যার কারণে স্থানীয় লোকের কাছ থেকে জানতে পারলাম দুই কিলোমিটার দূরে নদী পার হওয়ার জন্য একটা ঘাটের কথা বললো। সেই অনুযায়ী আমরা বাইকে চেপে বসলাম। আর চলতে শুরু করলাম খেয়াঘাটের সম্মুখে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম সুবিস্তীর্ণ বাঁশ দিয়ে গড়া সেতু। সেই সেতু পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পড়ি নেত্রকোনা উপজেলায়।
মনোমুগ্ধকর অপার সৌন্দর্যে হাতছানি তার সাথে গারো পাহাড় আর নদীর বিস্তৃত জলরাশীর মাঝ দিয়ে ছুটে চলছিলাম সেগুন, শাল প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দুর্গাপুর উপজেলায়। সেখানে গিয়ে এক গারোর দোকানে কিছুক্ষণ দুপুরের খাবার শেষ করে স্থানীয় একটা পাহাড়ে উঠি। পাহাড় থেকে নেমে আনসার ক্যাম্প পাশ দিয়ে চলে যায় স্বচ্ছপানি আর ধু ধু বালুচর দিয়ে বিস্তৃত সোমেশ্বরী নদীর কিনারায়। নদীর অববাহিকায় গিয়ে শীতল জলরাশিতে পা' রাখতেই মনে মুগ্ধতার দোলা লাগে। নদীর অন্য পাশে মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেষে দূর থেকে দেখতে পেলাম কোনো কিছু উত্তোলন করার মেশিনের মতো। সত্যি বলতে দূর থেকে এটা অস্পষ্ট ছিলো। পরে জানতে পারি ঐখানে কয়লা তুলা হচ্ছে। তা দেখার জন্য নদী পারি দিতে হবে।
এরপরে আমরা যাত্রা করি সেই খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে। বেশ ভালো একটা দূরত্ব পারি দিয়ে খেয়াঘাটে পৌঁছি। সেখান থেকে নদী পার হয়ে সবুজ পাহাড়ের পথ দিয়ে পৌঁছায় কয়লার খনির কাছে। সময় কম থাকার কারনে সেখান থেকে দ্রুত চলে আছি দুর্গাপুর বিরিশিরি পাহাড়ে। বিরিশিরি মূল আকর্ষণ হচ্ছে বিজয়পুর চিনামাটির খনি। এর বুক চিরে বয়ে গেছে সবুজ ও নীলছে স্বচ্ছ পানির হৃদ। যা দেখার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। নানা কর্মব্যস্তার পাশ কাটিয়ে এসে অবশেষে কিছুটা হলে শান্তির পরশ বুকে শিহরণ জাগালো। আমরা সবাই কিছুক্ষণ থেকে চারদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘুরেঘুরে উপভোগ করি।
বিরিশিরি থেকে হালুয়াঘাট ফেরার পথে দেখতে পেলাম সাদা মাটির পাহাড়। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে এবং দেখে জানতে পারি এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহ করা হয়। যা কিনা আমাদের কাছে চায়না ক্লে নামে পরিচিত। চায়না ক্লে সংগ্রহ করার কারণে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট গভীর জলাধার। যার ফলস্বরূপ পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধারগুলো তৈরি হয়েছে। এগুলো দেখতে খুবই চমৎকার।
সব সৌন্দর্য পিছনে ফেলে যখন ফেরার উদ্দেশ্য রওনা হয়। তখন খানিকটা পথ পারি দিয়ে রাস্তা দিয়ে আসার সময় একটা বাড়িতে খাঁচার ভিতর শিকল দিয়ে আটকিয়ে শূকর পালন করতে দেখলাম। পরিশেষে হালুয়াঘাট সদরে এসে মহাখালী উদ্দেশ্য রওনা হয় মিজান ভাই ও সুফিয়ান ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাসে চেপে বসি। সত্যি বলতে এই যাত্রা আমার মনে দীর্ঘদিন ধরে অক্ষত থাকবে গারো পাহাড়, সোমেশ্বরী নদী আর বিরিশিরির সৌন্দর্যের মুগ্ধতার কারণে।
মোঃ রায়হান কাজী
বেশ কয়েকদিন ধরে মনটা আনচান আনচান করতে ছিলো। কিন্তু তা ঠিক কি কারণে হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ইদানিং রাত হলে কেন জানি ঘুম কম হয়? মনে হয় মাথায় কোনো এক টেনশন ভর করেছে।
এরিমধ্য মিজান ভাই আমাকে কল করলো। তারপর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হলো। এর ফাঁকে তিনি তাদের এলাকায় যাওয়া জন্য দীর্ঘদিন যাবত আমন্ত্রণ করতে ছিলো।
মিজান ভাইয়ের বিষয়ে বলতে উনার সাথে আমার প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্ক। তার সাথে এই সম্পর্ক গড়ে উঠে লেখালেখির মাধ্যমে। কারণ তিনি একাধারে একজন কবি, সাহিত্যেক একিসাথে গজল গেয়ে থাকেন। তো সেদিক দিয়ে বলতে গেলে উনার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
এরমাঝে আমার আবার টিভির বেশ কিছু প্রোগ্রাম হাতে ছিলো। তো এর জন্য আমাদের টিমের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ছিলো আমার উপর৷ সপ্তাহখানেক পর ছিলো আমাদের ঈদুল আজহার প্রোগ্রাম। তাই এগুলো নিয়েও ব্যস্ত ছিলাম। যাইহোক যতোই ব্যস্ত থাকি না কেন আমার কোনো এক কারণে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছিলো না৷ আর ডিপ্রেশনে ভোগাতে ছিলাম।
সে দিন সন্ধ্যায় মিজান ভাইকে ফোন করে বললাম তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিষয়ে। উনি কথা শোনে অনেক আনন্দিত হয়েছেন। একিসাথে বিস্মৃত হয়েছেন। কারণ আদোও আমি সত্যি যাবো কিনা ওনার বাড়ি। যা নিয়ে তিনি বেশ দিদাদ্বন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন। তো উনি আমাকে বললেন আপনি যদি আসেন আমি খুব খুশি হবো। সিদ্ধান্তটা সন্ধ্যায় যার কারণে তিনি আমাকে রাত বারোটা নাগাদ আবারও কল করলেন কখন রওনা হবো যানার জন্য। আমি উনাকে জানিয়ে দিলাম খুব সকালে রওনা হবো।
আপনাদেরকে বলা হয়নি এখনো মিজান ভাইয়ের বাসা সম্পর্কে উনার গ্রামের বাড়ি ছিলো হালুয়াঘাট জেলায় ময়মনসিংহ বিভাগে। যেহেতু খুব সকালে রওনা দিবো তাই তড়িঘড়ি করে কিছু জামা-কাপড় সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঝটপট ব্যাগ ঘুছিয়ে রাখি। মোবাইলে এ্যালাম দিলাম যাতে করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে সমস্যা না হয়। সে রাতেও অনেক চেষ্টা করলাম ঘুমানোর জন্য ঘুম কোনো ভাবেই আসছিলো না। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেলে। তাই নিজে থেকে মোবাইলে এ্যালাম বন্ধ করে একটু ফ্রেশ হয়ে। রুমমেটকে বলে তাড়াতাড়ি করে ছুটলাম মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের দিকে৷ সেখান থেকে হালুয়াঘাটের বাসে চেপে বসি ভ্রমন বিলাসী হয়ে। খুব একটা দেরি হলো না বাস ছাড়তে।
বাস ছাড়ার খানিকক্ষণ পরে বাসের জানালা দিয়ে লক্ষ করলাম টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। এমনিতে ঢাকা থেকে চৌরাস্তা অবধি প্রচুর জ্যাম থাকে। সকাল সকাল রওনা হওয়াতে রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিলো না। আধা ঘন্টার মধ্যে তাই চৌরাস্তা পৌঁছে গেলাম। তারপর বাস ছুটে চললো ময়মনসিংহের অভিমুখে। সকাল আটটা বিশ মিনিট নাগাদ ময়মনসিংহ পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে মিজান ভাইকে ফোন বললাম হালুয়াঘাট কোথায় নামতে হবে? উনি ধারা বাজার নামার কথা বললো। বাসের হ্যালপারকে ডেকে বললাম মামা আমাকে ধারা বাজার নামিয়ে দিও। এভাবে দেখতে দেখতে নয়টা বাইশে আমাকে ধারা বাজার নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে মিজান ভাই আমাকে রিসিভ করে তার বাসায় নিয়ে যায়।
বাসায় যাওয়ার পর একটু ফ্রেশ হয়ে ওনার বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসে। তাই একটু ঘুমিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ উঠে হালকা নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়ি হালুয়াঘাট ঘুরে দেখার উদ্দেশ্য। তার জন্য মিজান ভাই তার পরিচিত একজনকে কল করে তার নাম ছিলো সুফিয়ান। সুফিয়ান ভাই বাইক নিয়ে ধারা বাজার আসে। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ঘুরে বেড়ানোর।
বাইকে রওনা দেওয়ার পর ছুটে চলা হালুয়াঘাট শহরের দিকে। সেখান থেকে আমরা আবারও ছুটি চলি শেরপুর নালিতাবাড়ীর অভিমুখে। উদ্দেশ্য ছিলো মধুটিলা ইকোপার্কে যাওয়া। যাওয়ার পথে সুফিয়ান ভাই প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে যায় গোবরাকুড়া স্থলবন্দরের দিকে।
গোবরাকুড়া কড়ইতলী স্থলবন্দর যাওয়া পথে দেখতে পেলাম কয়লার চালান করা বিভিন্ন ইজারাদারদের কয়লা মজুদ করে রাখা হয়েছে। অনেকটা স্টলয়ের মতো করে। মূলত এই কয়লাগুলো ভারত থেকে এনে তা সংরক্ষণ করেছে।
তারপর আবারও ছুটে চলা। পথে সীমান্ত ঘেরা একটা নদী দেখলাম। নদীর নামটা অজানা। নদীতে টায়ারের টিউব দেওয়া। সুফিয়ান ভাই বললো, যখন নদীতে পানি বাড়ে। তখন টিউবগুলো ফোলানো হয়। এসব দেখার জন্য নাকি এখানে অনেক লোকজন আসে।
সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে চলতে চলতে ভারতের পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য উপভোগ করি। একপর্যায়ে দেখতে পেলাম নকুগাঁও স্থলবন্দর কাছাকাছি ভারতীয় ট্রাকে করে পাথরের চালান আসতে। সেই পাথর আবার মেশিন দিয়ে ভাঙানো হচ্ছে। নকুগাঁও স্থলবন্দর সীমান্তে বিজিবির সাথে কথা বললাম সীমান্তের ওপারে যাওয়া বিষয়ে। উনারা আমাদের ভিতরে না যাওয়া জন্য বললেন।
নকুগাঁও থেকে আবারও ছুটে চলা। এবারের গন্তব্য ছিলো মধুটিলা ইকোপার্ক। সেখান থেকে উঁচুনিচু পাহাড় তার সাথে সেগুন, শাল আর বাহারি গাছের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে করতে পৌঁছালাম মধুটিলা ইকোপার্কে। সেখানে একটা দোকানে খানিকটা নাস্তা করি। ইকোপার্কের গেট থেকে তিনজন সাথে বাইক পার্কিং করার জন্য টিকেটের মূল্য রাখে একশো টাকা। উল্লেখ্য টিকেটের মূল্য জনপ্রতি বিশ টাকা।
একটু বলেরাখি মধুটিলা ইকোপার্কের অবস্থান শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায়। পোড়াগাঁওয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারিভাবে মধুটিলা ইকোপার্কের অবস্থান। মধুটিলা ইকোপার্কে ভিতরে ডুকতেই দুপাশে সাড়িসাড়ি শোভাবর্ধনকারী বিড়ল প্রজাতির গাছের মধ্যে সেগুন, মহামূল্যবান শাল গাছের বেশি দেখা মিলে। সেই সাথে বিশ একরের ঔষধি বৃক্ষের বনায়ন ঘুরে দেখি। ইকোপার্কটিতে রয়েছে রেস্টহাউজ, বাসগৃহ, আকর্ষনীয় রাইড, স্টার ব্রীজ, কেন্টিন, মিনিচিড়িয়াখানা সেই সাথে পাহাড়ি টিলা, ঝাউবন এবং ওয়াচ টাওয়ার।
মধুটিলা ইকোপার্কের মেইন পটক দিয়ে প্রবেশের সময় চোখে পড়ল দুইটা ঘোড়া। সেগুলো পাশকাটিয়ে পৌঁছালাম স্টার ব্রীজে। সেখানকার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার ছিলো। মাঝখানে লেক দু'ধারে পাহাড় আর সবুজ বনায়ন। তারপর বেশকিছু পাহাড় দেখতে পায়। তারমধ্যে প্রতিটা পাহাড়ে উঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিলো । সেখান একটি পাহাড়ে চড়ি। পাহাড়ের আশেপাশের মূল সৌন্দর্য উপভোগ করে কিছু ছবি তুলে নেমে পড়ি। টিলা থেকে নামার পর পথে জামরুল গাছে পাকা জামরুল দেখতে পায়। যা দেখে সুফিয়ান ভাই জামরুল গাছ থেকে তা পাড়া শুরু করে। পরবর্তীতে সেগুলো আমরা কিছু খায়৷ হঠাৎ দেখি মিজান ভাই আমাদের সাথে নেই। তাকে খুঁজতেই দেখতে পেলাম, তিনি লজ্জাবতী গাছের সাথে খেলছেন। তো তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কি করছেন? উনি আমাকে লজ্জাবতী গাছের আশ্চর্যকর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখালেন। যা আমি আগে কখনো দেখিনি এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে দিলে তা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। এই গাছের পাতা অনেকটা তেঁতুল গাছের পাতার মতো আর ছোট আকৃতির। তারপর সুফিয়ান ভাই আমাদেরকে নিয়ে গেল ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। ওয়াচ টাওয়ারের উঠার জন্য জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ছিলো ১০ টাকা করে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ইকোপার্কের সবুজ অরুণ্য, পাহাড়ি টিলা সাথে লেকের জলরাশি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের রূপরেখা মনে দোলা দেয়।
ইকোপার্ক থেকে আসার পথে সুফিয়ান ভাই আমাদের একটা নদীর কাছে নিয়ে যায়। তো যাওয়ার পথে পাহাড়ি মেঠোপথ আর সেগুন আর শাল বৃক্ষের সৌন্দর্য মেবাইলে ভিডিও ধারণ করতেছিলাম। এমন সময় একজন ব্যক্ত তেড়ে এসে বললো মোবাইলের ক্যামেরা বন্ধ করার জন্য। হঠাৎ করে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পড়ে খেয়াল করে দেখলাম নদী থেকে অবৈধভাবে তারা সিলেকশন বালু আর পাথর তুলছে। আমি মেবাইলের ক্যামেরা বন্ধ করে তাদের আসস্ত করলাম। আমি আপনাদের ভিডিও করতেছিনা। তাদেরকে বুজিয়ে বললাম ঘুরতে আসার বিষয়ে। তারপর কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে নদীর রূপ উপভোগ করি।
এই পাশটাকে অনেকে গজনী নামে অবহিত করে সেখান থেকে বের হয়ে রওনা হয় হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্য অথাৎ মিজান ভাইয়ের বাড়িতে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে রাস্তার দু'পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আসার সময় মিজান ভাইয়ের এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। উনার সাথে একটা চা'য়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার এক ফাঁকে জনৈক ব্যক্তি হাতির আক্রমনের কথা বললেন। তো আমি বললাম, পথে কোনো হাতি দেখলাম হাতি কোথায় থেকে আসে? তখন জনৈক ব্যক্তি আমাকে বললো, হাতি ভারতের পাহাড় থেকে আসে। এই হাতি খুবি আক্রমনাত্মক এই বলে তিনি তার মোবাইলে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক হাতির পাড়ায় পিস্ত হওয়া একটা লোকের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখায়। যা দেখে আমার গা শিউরে ওঠে। এই বলে উনি আমাদেরকে দুর্ঘটনা যেখানে ঘটেছিলো সেখানে নিয়ে যাওয়া জন্য বলে। আমরা আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সাথে খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছায়। পৌঁছানোর পর ঐ জায়গাটার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যায়। খানিক মুহূর্ত পড়ে হাতির কথা একজন বলতেই সেই লোমহর্ষক ঘটনার কথা মনে পড়ে। বাইক থেকে নামতেই হাতির পায়ের বিশাল চাপ দেখতে পায়। একি সাথে একটা খেয়ে ফেলা কলাবাগান দেখায় জনৈক ব্যক্তি। তারপর পাশেয় দেখলাম মোটা তার দেওয়া। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের তার। উত্তরে তারা আমাকে বললো, এটা হচ্ছে জেনারেটরের তার। সন্ধ্যার পরে জেনারেটর চালানো হয়। কারণ হাতির আক্রমণ বেশিরভাগ সময় সন্ধ্যা কিংবা রাতের দিকে ঘটে। আর জেনারেটরের তারের কাছে আসলে হাতি কারেন্টের শর্ক খেলে তারা দূরে সরে যায়। তাই জেনারেটরের ব্যবস্তা করে রাখা। তাছাড়া কিছু দিন পরপর এখানকার লোকজন হাতির আক্রমণের শিকার হয়। তারপর হাতির পা'য়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে একটা বাড়িতে আসি। সেখান দেখলাম তাদের টিনের ঘর ভাঙ্গার অবস্থা। একজন মহিলাকে উঠানে দেখে বললাম, এটা কি হাতির আক্রমণ? প্রতি উত্তরে বললেন, এই ঘরে নয়মুন ধান আছিলো। হাতি সুর ডুকাইয়া সব খাইয়া লাইছে। এই কথাবার্তা শুনতে শুনতে চোখ পড়লো খানিকটা দূরে একটা টিনের ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে হাতির ধ্বংসাত্মক আক্রমণের আরো ভালো বর্ণনা পায়। নতুন টিনের ঘরের ছিন্নভিন্ন অবস্থা দেখে মনে মনে মনে বলতে লাগলাম, সত্যিই সৌন্দর্য সবসময় ভয়ংকর হয়।
তারপর হালুয়াঘাট এসে মিজান ভইয়ের বাড়িতে হাতমুখ ধোঁয়ে রাতের খাবার সম্পূর্ণ করি। সেই রাতে আমার বেশ ভালো ঘুম হয়। তারপরদিন সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠি।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়। সকালের নাস্তা সম্পূর্ণ করি। মিজান ভাই সুফিয়ান ভাইকে কল দিয়ে আসার জন্য বলে। সুফিয়ান প্রায় বারটা বাজে আসে। তো ঐদিন আমাদের গন্তব্য ছিলো গারো পাহাড় আর বিরিশিরি।
এরমধ্যে আপনাদের একটু বলে রাখা দরকার আমরা এতোক্ষণ যে মধুটিলা ইকোপার্ক এবং গজনীর কথা বলতে ছিলাম এগুলো মূলত গারো পাহাড়ের অংশবিশেষ। গারো পাহাড় বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বিস্তৃত একটি পর্বতশ্রেণী। গারো পাহাড় মূলত পূর্ব গারো পাহাড়, পশ্চিম গারো পাহাড় এবং দক্ষিণ গারো পাহার এই তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলাসমূহ গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলসমূহ এই পাহাড়ের পাদদেশীয় পালিজ সমৃদ্ধ। গারো পাহাড়ের উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমে রয়েছে আসাম এবং পূর্বে মেঘালয়ে খাসিয়া পাহাড়।
যাইহোক আমরা গারো পাহার আর নদীর বেষ্টিত অপরূপ সৌন্দর্যের বেলাভূমি দিয়ে বাইকে করে হালুয়াঘাট থেকে নেত্রকোনার অভিমুখে যাত্রা করি। যাওয়ার পথে মনের মধ্যে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ জুড়ে যে বিস্তৃত ফসলি ভূমি অবাধে গরু-ছাগলের বিচরণ সাথে কিছু ছোট ছোট পাহাড় থাকলেও মনে হচ্ছিল সব সৌন্দর্য বুঝি ভারতের অংশে পুঞ্জিভূত রয়েছে। দূরের সেই স্পর্শ না করা পাহাড়ি মেঠোপথে না যেতে পাড়ার আক্ষেপ আমাকে পোড়াচ্ছিল। এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম একটা নদীর তীরে। সেখান বাঁধ সাধলো খেয়াঘাটে খেয়া পারাপারের জন্য কোনো ব্যবস্তা না থাকা। যার কারণে স্থানীয় লোকের কাছ থেকে জানতে পারলাম দুই কিলোমিটার দূরে নদী পার হওয়ার জন্য একটা ঘাটের কথা বললো। সেই অনুযায়ী আমরা বাইকে চেপে বসলাম। আর চলতে শুরু করলাম খেয়াঘাটের সম্মুখে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম সুবিস্তীর্ণ বাঁশ দিয়ে গড়া সেতু। সেই সেতু পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পড়ি নেত্রকোনা উপজেলায়।
মনোমুগ্ধকর অপার সৌন্দর্যে হাতছানি তার সাথে গারো পাহাড় আর নদীর বিস্তৃত জলরাশীর মাঝ দিয়ে ছুটে চলছিলাম সেগুন, শাল প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দুর্গাপুর উপজেলায়। সেখানে গিয়ে এক গারোর দোকানে কিছুক্ষণ দুপুরের খাবার শেষ করে স্থানীয় একটা পাহাড়ে উঠি। পাহাড় থেকে নেমে আনসার ক্যাম্প পাশ দিয়ে চলে যায় স্বচ্ছপানি আর ধু ধু বালুচর দিয়ে বিস্তৃত সোমেশ্বরী নদীর কিনারায়। নদীর অববাহিকায় গিয়ে শীতল জলরাশিতে পা' রাখতেই মনে মুগ্ধতার দোলা লাগে। নদীর অন্য পাশে মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেষে দূর থেকে দেখতে পেলাম কোনো কিছু উত্তোলন করার মেশিনের মতো। সত্যি বলতে দূর থেকে এটা অস্পষ্ট ছিলো। পরে জানতে পারি ঐখানে কয়লা তুলা হচ্ছে। তা দেখার জন্য নদী পারি দিতে হবে।
এরপরে আমরা যাত্রা করি সেই খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে। বেশ ভালো একটা দূরত্ব পারি দিয়ে খেয়াঘাটে পৌঁছি। সেখান থেকে নদী পার হয়ে সবুজ পাহাড়ের পথ দিয়ে পৌঁছায় কয়লার খনির কাছে। সময় কম থাকার কারনে সেখান থেকে দ্রুত চলে আছি দুর্গাপুর বিরিশিরি পাহাড়ে। বিরিশিরি মূল আকর্ষণ হচ্ছে বিজয়পুর চিনামাটির খনি। এর বুক চিরে বয়ে গেছে সবুজ ও নীলছে স্বচ্ছ পানির হৃদ। যা দেখার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। নানা কর্মব্যস্তার পাশ কাটিয়ে এসে অবশেষে কিছুটা হলে শান্তির পরশ বুকে শিহরণ জাগালো। আমরা সবাই কিছুক্ষণ থেকে চারদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘুরেঘুরে উপভোগ করি।
বিরিশিরি থেকে হালুয়াঘাট ফেরার পথে দেখতে পেলাম সাদা মাটির পাহাড়। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে এবং দেখে জানতে পারি এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহ করা হয়। যা কিনা আমাদের কাছে চায়না ক্লে নামে পরিচিত। চায়না ক্লে সংগ্রহ করার কারণে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট গভীর জলাধার। যার ফলস্বরূপ পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধারগুলো তৈরি হয়েছে। এগুলো দেখতে খুবই চমৎকার।
সব সৌন্দর্য পিছনে ফেলে যখন ফেরার উদ্দেশ্য রওনা হয়। তখন খানিকটা পথ পারি দিয়ে রাস্তা দিয়ে আসার সময় একটা বাড়িতে খাঁচার ভিতর শিকল দিয়ে আটকিয়ে শূকর পালন করতে দেখলাম। পরিশেষে হালুয়াঘাট সদরে এসে মহাখালী উদ্দেশ্য রওনা হয় মিজান ভাই ও সুফিয়ান ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাসে চেপে বসি। সত্যি বলতে এই যাত্রা আমার মনে দীর্ঘদিন ধরে অক্ষত থাকবে গারো পাহাড়, সোমেশ্বরী নদী আর বিরিশিরির সৌন্দর্যের মুগ্ধতার কারণে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শ.ম. শহীদ ১৯/১২/২০২৪ভ্রমণ বান্ধব পোস্ট!
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ১৩/০৬/২০২৪অনন্য