মুক্তিকামীদের জয়োল্লাস
মুক্তিকামীদের জয়োল্লাস
মোঃ রায়হান কাজী
যে শুনে সেই বলে। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কথা যতটা না আমরা পড়েছি। তার থেকে বেশি আমরা লোকজনদের কাছ থেকে ইতিহাস জেনেছি। তাইতো এই প্রতিপাদ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলতে চেয়েছি।
সময়টা ছিলো পঁচিশে মার্চ ১৯৭১ পাক-হানাদার বাহিনী কালো রাত্রের নিরিহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নর্তকীর বেশে অসংখ্য মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় নিরবির্চারে।যুদ্ধের খবর চারিদিকে মুহূর্তের মধ্যে প্রসারিত হতে থাকে মহাসমুদ্রের মতো জলরাশিতে। কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। কেউবা আবার মুক্তিযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এগিয়ে আসে অসীম সাহসে। ফলস্বরূপ রাস্তাঘাটে মানুষজন খুবি কম চোখে পড়ে। আতঙ্ক যে ছড়িয়েছে চারদিকে। বাড়ি থেকে বাহির হতে লোকজন পাচ্ছে ভয় প্রয়োজন অপ্রয়োজনে।
তিন-চার দিনপর প্রধান সড়ক দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীদের কিছু জিপ আসার কথা শুনতে পেলাম।তাই ছুটে চললাম প্রধান সড়কের দিকে।জিপগুলোকে আড়ালে লুকিয়ে দেখতে থাকলাম। গোধূলি বেলায় বারেক আমাকে বললো ওরা নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তাঁবু গেঁথেছ। পরদিন সকালে সর্তকতার সাথে বিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে ওদের ক্যাম্পিং দেখে আসি।
একদিন সন্ধ্যার সময় আমি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রধান সড়ক থেকে বাড়ি যেতে প্রায় পনেরো বিশ মিনিট সময় লাগে।বেলাও শেষ হয়ে এসেছে। তাছাড়া পাকবাহিনীদের ভয় তো মনে ছিলোই। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলতে লাগলাম। আর হাতে ছিলো বাজারের ব্যাগ।
কিছুটা পথ চলার পড় লক্ষ্য করলাম, কে যেন আমার পিছনে পিছনে আসছে? আমার মনে কেমন জানি ভয় হলো। আশেপাশের থেকে গুলি আর বোমার শব্দও ভেসে আসছিলো। আমার হাত পা দু’টো ঠান্ডা হয়ে কাঁপতে লাগলো। সাথে কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ফোঁটা জমা হচ্ছিলো। তখন প্রধান সড়ক থেকে নেমে মাঠের সড়ো আলপথ্ দিয়ে হাঁটা শুরু করি। পরক্ষণে লক্ষ্য করলাম আমার পিছনে এখনো কেউ একজন আসছে।বাড়ির কাছাকাছি এসে ঝোপজঙ্গল ভেঙে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম ঐ লোকটি আমার পিছুপিছু ছুটছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চারপাঁচ জন লোককে বসে থাকতে দেখলাম। তাই আমি বুকে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটা কাছে আসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু লোকটার অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিক চুপ হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম আমার পিছন পিছন ছুটছিলে কেন? প্রতিউত্তরে জবাব দিলো ম্যালেটারি বাহিনী আমাদের পরিবারের সবাইকে হত্যা করছে।তাই ভয়ে ভয়ে তোমার পিছনে আসতে ছিলাম। পাশের লোকজন এসে সব জানতে পেরে তাদের সঙ্গে আবুকে নিয়ে যেতে চায়।তাতে আমি বাঁধা দিয়ে বলি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো। ওরা সহজে বলতে চায়নি। খানিক পড়ে আমার জোরাজোরিতে তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়। শুনামাত্রই আমার দুবাহু আর চোখ খুশিতে ভরে উঠে। আমিও তাদের সাথে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। সাথে আমাদের বাড়ি দেখালাম। আমার নাম জয় বয়স আটারো তাদেরকে বললাম। আবারও তাদের সাথে আমাকে যুদ্ধে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে কিছুদিন পরে নেওয়ার অভয় দিয়ে তারা চলে গেল। তাছাড়া যুবকদের মনে আত্ম অহংকারবোধ ও ক্রোধ সর্বদাই লেগে থাকে। তথাপি আমিও পাকসেনাদের অত্যাচার আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসে উঠি। প্রতিদিন তাদের আসার প্রতিজ্ঞায় দিনগুনতে ছিলাম। সাথে বাড়িতে বাবা-মাকে জানালাম তাড়া কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলোনা।অনেক বুঝানোর পরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।তার দুইদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা নেওয়ার জন্য আসলে বাবা-মার দোয়া নিয়ে চলে আসি।
বাড়ি থেকে হোসেনপুরের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। নদীর মাঝে চরের মধ্যে আমাদের ক্যাম্পিং অবস্থিত।সেখানে এসে অন্যদের সাথে ট্রেনিং করা শুরু করি। মুক্তিযোদ্বারা যখন অপারেশনে যেত, তখন আমি প্রহরগুণতাম। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ক্যাম্পের কমান্ডার আমাকে ডেকে কিছু কাজ দিলেন। তারমধ্যে অন্যতম হলো, সবসময় সর্তক থেকে পাকবাহিনিদের খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব আরোপ করলেন। সে দায়িত্ব আমি হাসিমুখে মেনে নিলাম।
কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক আমি তাদের ক্যাম্পের কাছে গেলাম আবার ভালোমত দেখার জন্য।কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। পাকসেনার আমাকে ধরে প্রশ্ন করা শুরু করে।পড়ে ক্যাম্পে নিয়ে ওনাদের কাজ করানো শুরু করে। কোথাও যাওয়ার সময় পথ দেখানোর জন্য আমাকে তাদের সাথে নিয়ে যেত। যাওয়ার পর বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ,নির্যাতন চালায়। পরিশেষে গাছের সাথে বেঁধে তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলে। হত্যা এই করুন দৃশ্য দেখে প্রতিশোধের আগুন বুকে দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এরি মধ্যে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়। পাশাপাশি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করি। এবং তাদেরকে নিয়মিত খোঁজখবর দিতাম।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় পাকবাহিনীদের নদীর পাশে ক্যাম্পিং সম্পর্কে কিছু বলতে শুনি।দূর থেকে ওদের আলাপ আলোচনা পুরোপুরি শুনতে পাচ্ছিলাম না। তাই কাজের বাহানা দিয়ে কাছাকাছি এসে আড়ি পাতার চেষ্টা করি। তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো বাঙালিদেরকে কিভাবে শেষ করেবে, কিভাবে হত্যা করবে, কোথায় কিভাবে অপারেশন চালাবে ইত্যাদি। আলোচনা শেষে হোসেনপুরের ক্যাম্পিং সম্পর্কে বলতে থাকে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কালকে প্রথম প্রহরে আক্রমণ করার। এসব কথাশুনে গাঁয়ে শিহরণ জাগে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে চলে আসি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে রাতে যখন আবু আমার কাছ থেকে হানাদার বাহিনীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আসে।তখন ওদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অভিহিত করি।দ্রুত কমান্ডারকে জানাতে বলি। সাথে ক্যাম্পের অবস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার জন্য সর্তক করি।
আবু তাৎক্ষণিক ছুটে চলে কমান্ডারের কাছে। ওনি সবার সাথে আলোচনা করেন। কিভাবে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে কিংবা যাবে। সে সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে ক্যাম্প ছাড়ার নির্দেশ দেয়। আমাদের ক্যাম্প চরের মধ্যে হওয়ায় নৌকা ছাড়া যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা ছিলো না। এরি পরিপেক্ষিতে কমান্ডার সবার সাথে বসে ছক কষতে থাকে। ছক অনুযায়ী সবার অবস্থান নিশ্চিত করার আর্দেশ দেয়। নির্দেশ পাওয়া সাথে সাথে সবাই সবার অবস্থান অনুযায়ী চলে যায়।
পরদিন খুবভোরে পাকিস্তানিরা আমাকে সাথে নিয়ে নৌকাতে করে মুক্তিকামীদের উদ্দেশ্য রওনা হয় আক্রমণ করার জন্য। যাওয়ার পথে পানির শব্দ ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। খানিকক্ষণ পরে একটা কাক আমাদের পাশ কাটিয়ে উড়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো মুক্তিকামীরা মাথায় কচুরিপানা দিয়ে নদীতে মাছরাঙা পাখির মতো অবস্থান করছিলো। নৌকা মাঝ নদীতে আসা মাত্রয় আক্রমণ শুরু হয়। প্রথমে নৌকার তলাতে লক্ষ্য করে গুলিছুঁড়ে। পরমুহূর্তেই নৌকাগুলো ডুবা শুরু করলে আমি আর মাঝি মিলে ওদের পানিতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে আঠারো জনকে হত্যা করি।
দুপুরের মধ্যেই এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের সৈনিকরা সর্তক অবস্থাজারি করে। আমরাও আক্রমণের জন্য নকশা প্রনয়ণ করি। চারদিক যখন নিস্তব্ধ ঠিক তখন দুইজন সৈনিকে হত্যা করি। রাত তিনটার দিকে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ক্যাম্পে ডুকে তাঁবুর আশেপাশে কিছু মাইন পুঁতে রেখে দূত চলে আসি। কিছুদূর আসার পর মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। সাথে সাথে ওদের ক্যাম্পসহ সবাই মৃত্যুবরণ করেছে কিনা এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়। পরিশেষে আমরা জয়ী হয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসি। মুক্তিকামীদের জয়োল্লাসে সকলে একসাথে মেতে উঠি।
আমাদের প্রধান হাতিয়ার ছিলো একাগ্রতা আর কৌশলী যুদ্ধে তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। বিশেষ দিনগুলোর কথা যখন মনে পড়ে, তখন সবুজের মাঝে রক্তিম সূর্যের আলোয় গর্বে বুকটা ভরে উঠে।
মোঃ রায়হান কাজী
যে শুনে সেই বলে। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কথা যতটা না আমরা পড়েছি। তার থেকে বেশি আমরা লোকজনদের কাছ থেকে ইতিহাস জেনেছি। তাইতো এই প্রতিপাদ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলতে চেয়েছি।
সময়টা ছিলো পঁচিশে মার্চ ১৯৭১ পাক-হানাদার বাহিনী কালো রাত্রের নিরিহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নর্তকীর বেশে অসংখ্য মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় নিরবির্চারে।যুদ্ধের খবর চারিদিকে মুহূর্তের মধ্যে প্রসারিত হতে থাকে মহাসমুদ্রের মতো জলরাশিতে। কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। কেউবা আবার মুক্তিযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এগিয়ে আসে অসীম সাহসে। ফলস্বরূপ রাস্তাঘাটে মানুষজন খুবি কম চোখে পড়ে। আতঙ্ক যে ছড়িয়েছে চারদিকে। বাড়ি থেকে বাহির হতে লোকজন পাচ্ছে ভয় প্রয়োজন অপ্রয়োজনে।
তিন-চার দিনপর প্রধান সড়ক দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীদের কিছু জিপ আসার কথা শুনতে পেলাম।তাই ছুটে চললাম প্রধান সড়কের দিকে।জিপগুলোকে আড়ালে লুকিয়ে দেখতে থাকলাম। গোধূলি বেলায় বারেক আমাকে বললো ওরা নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তাঁবু গেঁথেছ। পরদিন সকালে সর্তকতার সাথে বিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে ওদের ক্যাম্পিং দেখে আসি।
একদিন সন্ধ্যার সময় আমি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রধান সড়ক থেকে বাড়ি যেতে প্রায় পনেরো বিশ মিনিট সময় লাগে।বেলাও শেষ হয়ে এসেছে। তাছাড়া পাকবাহিনীদের ভয় তো মনে ছিলোই। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলতে লাগলাম। আর হাতে ছিলো বাজারের ব্যাগ।
কিছুটা পথ চলার পড় লক্ষ্য করলাম, কে যেন আমার পিছনে পিছনে আসছে? আমার মনে কেমন জানি ভয় হলো। আশেপাশের থেকে গুলি আর বোমার শব্দও ভেসে আসছিলো। আমার হাত পা দু’টো ঠান্ডা হয়ে কাঁপতে লাগলো। সাথে কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ফোঁটা জমা হচ্ছিলো। তখন প্রধান সড়ক থেকে নেমে মাঠের সড়ো আলপথ্ দিয়ে হাঁটা শুরু করি। পরক্ষণে লক্ষ্য করলাম আমার পিছনে এখনো কেউ একজন আসছে।বাড়ির কাছাকাছি এসে ঝোপজঙ্গল ভেঙে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম ঐ লোকটি আমার পিছুপিছু ছুটছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চারপাঁচ জন লোককে বসে থাকতে দেখলাম। তাই আমি বুকে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটা কাছে আসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু লোকটার অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিক চুপ হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম আমার পিছন পিছন ছুটছিলে কেন? প্রতিউত্তরে জবাব দিলো ম্যালেটারি বাহিনী আমাদের পরিবারের সবাইকে হত্যা করছে।তাই ভয়ে ভয়ে তোমার পিছনে আসতে ছিলাম। পাশের লোকজন এসে সব জানতে পেরে তাদের সঙ্গে আবুকে নিয়ে যেতে চায়।তাতে আমি বাঁধা দিয়ে বলি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো। ওরা সহজে বলতে চায়নি। খানিক পড়ে আমার জোরাজোরিতে তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়। শুনামাত্রই আমার দুবাহু আর চোখ খুশিতে ভরে উঠে। আমিও তাদের সাথে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। সাথে আমাদের বাড়ি দেখালাম। আমার নাম জয় বয়স আটারো তাদেরকে বললাম। আবারও তাদের সাথে আমাকে যুদ্ধে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে কিছুদিন পরে নেওয়ার অভয় দিয়ে তারা চলে গেল। তাছাড়া যুবকদের মনে আত্ম অহংকারবোধ ও ক্রোধ সর্বদাই লেগে থাকে। তথাপি আমিও পাকসেনাদের অত্যাচার আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসে উঠি। প্রতিদিন তাদের আসার প্রতিজ্ঞায় দিনগুনতে ছিলাম। সাথে বাড়িতে বাবা-মাকে জানালাম তাড়া কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলোনা।অনেক বুঝানোর পরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।তার দুইদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা নেওয়ার জন্য আসলে বাবা-মার দোয়া নিয়ে চলে আসি।
বাড়ি থেকে হোসেনপুরের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। নদীর মাঝে চরের মধ্যে আমাদের ক্যাম্পিং অবস্থিত।সেখানে এসে অন্যদের সাথে ট্রেনিং করা শুরু করি। মুক্তিযোদ্বারা যখন অপারেশনে যেত, তখন আমি প্রহরগুণতাম। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ক্যাম্পের কমান্ডার আমাকে ডেকে কিছু কাজ দিলেন। তারমধ্যে অন্যতম হলো, সবসময় সর্তক থেকে পাকবাহিনিদের খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব আরোপ করলেন। সে দায়িত্ব আমি হাসিমুখে মেনে নিলাম।
কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক আমি তাদের ক্যাম্পের কাছে গেলাম আবার ভালোমত দেখার জন্য।কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। পাকসেনার আমাকে ধরে প্রশ্ন করা শুরু করে।পড়ে ক্যাম্পে নিয়ে ওনাদের কাজ করানো শুরু করে। কোথাও যাওয়ার সময় পথ দেখানোর জন্য আমাকে তাদের সাথে নিয়ে যেত। যাওয়ার পর বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ,নির্যাতন চালায়। পরিশেষে গাছের সাথে বেঁধে তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলে। হত্যা এই করুন দৃশ্য দেখে প্রতিশোধের আগুন বুকে দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এরি মধ্যে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়। পাশাপাশি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করি। এবং তাদেরকে নিয়মিত খোঁজখবর দিতাম।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় পাকবাহিনীদের নদীর পাশে ক্যাম্পিং সম্পর্কে কিছু বলতে শুনি।দূর থেকে ওদের আলাপ আলোচনা পুরোপুরি শুনতে পাচ্ছিলাম না। তাই কাজের বাহানা দিয়ে কাছাকাছি এসে আড়ি পাতার চেষ্টা করি। তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো বাঙালিদেরকে কিভাবে শেষ করেবে, কিভাবে হত্যা করবে, কোথায় কিভাবে অপারেশন চালাবে ইত্যাদি। আলোচনা শেষে হোসেনপুরের ক্যাম্পিং সম্পর্কে বলতে থাকে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কালকে প্রথম প্রহরে আক্রমণ করার। এসব কথাশুনে গাঁয়ে শিহরণ জাগে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে চলে আসি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে রাতে যখন আবু আমার কাছ থেকে হানাদার বাহিনীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আসে।তখন ওদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অভিহিত করি।দ্রুত কমান্ডারকে জানাতে বলি। সাথে ক্যাম্পের অবস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার জন্য সর্তক করি।
আবু তাৎক্ষণিক ছুটে চলে কমান্ডারের কাছে। ওনি সবার সাথে আলোচনা করেন। কিভাবে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে কিংবা যাবে। সে সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে ক্যাম্প ছাড়ার নির্দেশ দেয়। আমাদের ক্যাম্প চরের মধ্যে হওয়ায় নৌকা ছাড়া যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা ছিলো না। এরি পরিপেক্ষিতে কমান্ডার সবার সাথে বসে ছক কষতে থাকে। ছক অনুযায়ী সবার অবস্থান নিশ্চিত করার আর্দেশ দেয়। নির্দেশ পাওয়া সাথে সাথে সবাই সবার অবস্থান অনুযায়ী চলে যায়।
পরদিন খুবভোরে পাকিস্তানিরা আমাকে সাথে নিয়ে নৌকাতে করে মুক্তিকামীদের উদ্দেশ্য রওনা হয় আক্রমণ করার জন্য। যাওয়ার পথে পানির শব্দ ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। খানিকক্ষণ পরে একটা কাক আমাদের পাশ কাটিয়ে উড়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো মুক্তিকামীরা মাথায় কচুরিপানা দিয়ে নদীতে মাছরাঙা পাখির মতো অবস্থান করছিলো। নৌকা মাঝ নদীতে আসা মাত্রয় আক্রমণ শুরু হয়। প্রথমে নৌকার তলাতে লক্ষ্য করে গুলিছুঁড়ে। পরমুহূর্তেই নৌকাগুলো ডুবা শুরু করলে আমি আর মাঝি মিলে ওদের পানিতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে আঠারো জনকে হত্যা করি।
দুপুরের মধ্যেই এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের সৈনিকরা সর্তক অবস্থাজারি করে। আমরাও আক্রমণের জন্য নকশা প্রনয়ণ করি। চারদিক যখন নিস্তব্ধ ঠিক তখন দুইজন সৈনিকে হত্যা করি। রাত তিনটার দিকে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ক্যাম্পে ডুকে তাঁবুর আশেপাশে কিছু মাইন পুঁতে রেখে দূত চলে আসি। কিছুদূর আসার পর মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। সাথে সাথে ওদের ক্যাম্পসহ সবাই মৃত্যুবরণ করেছে কিনা এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়। পরিশেষে আমরা জয়ী হয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসি। মুক্তিকামীদের জয়োল্লাসে সকলে একসাথে মেতে উঠি।
আমাদের প্রধান হাতিয়ার ছিলো একাগ্রতা আর কৌশলী যুদ্ধে তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। বিশেষ দিনগুলোর কথা যখন মনে পড়ে, তখন সবুজের মাঝে রক্তিম সূর্যের আলোয় গর্বে বুকটা ভরে উঠে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ আমিনুল ইসলাম মিঠু ০৫/০৩/২০২২মুক্তির যুদ্ধের অনন্য লেখা।
-
ফয়জুল মহী ০২/০৩/২০২২অসাধারণ প্রকাশ করেছেন
পড়ে মুগ্ধ হলাম। -
আব্দুর রহমান আনসারী ০২/০৩/২০২২মুগ্ধতায় পূর্ণ অপরূপ সৃজন