হিয়ার পরশ
‘জীবন যখন যেমন’
গল্পগুচ্ছ
সম্পাদনায় : মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
প্রকাশকাল : একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩ ইং
ভিন্নমাত্রা প্রকাশনী
হিয়ার পরশ
[email protected]
মনুষ্য জাতির প্রত্যেকেই অন্তিমকাল সমাগম হইলে ভাবিয়া থাকে যে, জীবনটা যাদি ধপাস করিয়া থামিয়া না গিয়া চিরকালের জন্য স্থির হইত। তাহাতে দিনগুলি সুন্দরতরভাবে কাটিয়া যাইত। কিন্তু চিরন্তন সত্য হইল সকল জীবের সম্মুখে একদিন মৃত্যুদূত হাতছানি দিয়া থাকে। মেট্টিক পরীক্ষা শেষ। ভাবিতেছিল কি করিবে এখন, ভর্তিই বা হইবে কোথায়। সম্মুখে অনেকটা পথ চলিতে বাকি রহিয়াছে। আশা তাহার মস্তবড়। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হইবার প্রবলাভিলাস বহিতেছিল মনোমধ্যে। কিন্তু সে যে মানবিক বিভাগে পড়িয়াছে তাহা সে ঠাহর করে নাই। কেহই তাহাকে এই তথ্যটা জানাইয়াও দেয় নাই। হতবম্ব হইয়া নানাবিধ ভাবনয়া নিমগড়ব।
তাহার ভগিড়বর শশুরের এক পুত্রবধু রাহেলা। বড় শিক্ষিতা এম. এ পাশ করিয়া ঢাকায় শিক্ষকতা করিতেছে। তাহার নিকট সঠিক পরামর্শ পাইবে। রবির বাবার আশা নয় দীর্ঘ বিশ্বাস। রবির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল রাহেলার।
রাহেলা খুব উদার মনের মানুষ ইহা রবি পূর্ব হইতেই অবগত। তাহার প্রতি সম্মানের কোন ঘাটতি ছিল না রবির। তাহার সকল প্রকার যোগাযোগ চিঠিপত্র, মানি অর্ডার, রবির ইশকুলের ঠিকানায় পাঠাইত। রবির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হইবার পর রাহেলা জানায়, তাহাকে ঢাকাস্থ কোন কলেজে ভর্তি করাইবে। একথা শ্রবণমাত্রই রবি ভাবিল, কোন দিন একা কোন আত্মিয়ের বাড়ি গিয়া একরাত্রিও যাপন কনে নাই আর অতদূর কিভাবে সম্ভবপর হইবে। তাহার শহরে ভর্তির ব্যাপারে রাহেলা যতটা ভাবিল, তাহার পতি জহির তাহার অর্ধেকাংশও ভাবিল না। অবশেষে রবিকে শহরেই ভর্তি হইতে হইল। সকলের উৎসাহে জহিরের বাসায় অবস্থা করিতে হইল, তবে জহিরের কিছু শর্তাবলম্বনে। জীবনের সূচনালগেড়বই একটু খানি ত্যাগ স্বীকার করিয়া অবস্থান করিতে হইল। শহরে জীবনের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। সে মোটামুটি চঞ্চল প্রকৃতির বটে কিন্তু অচিনপুরে প্রবিষ্ট হইবার পর অন্তপুরভেদ করিবার প্রচেষ্টাও করিল না। রবির বাড়ির আর্থিকাবস্থা অসচ্ছল হওয়াই তাহাকে টিউশনি লইতে হইল। যেই ছেলেটি গ্রাম্য পরিবেশে চাঞ্চল্য, প্রফুল্ল আর আনন্দমুখর ছিল, সে কি না আজ নিরব নিস্তব্ধ, নিরুপায়। তাহাকে কেন জানি আনমনা বোধ হইতে লাগিল। তাহার নিকট কেবল একটি কথায় বারংবার বোধ হইতো তাহাকে যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিতে হইতেছে। জহিরের কর্কটময় কথা আর রাহেলার ¯েড়বহের তফাৎ খুঁজিয়া পাইলেও তাহার কিছুই করিবার নাই। রবি যখন অত্যন্ত ছোট তখন কেহ যদি তাহাকে জিজ্ঞাসিত বড় হইয়া কি কর্ম করিবে? তথাপি প্রতিউত্তর করিয়া কহিত, “বড় হয়ে অনেক বড়রকমের চাকরি করব, পয়লা মাসের বেতন দিয়া মায়ের জন্য একখানি শাড়ি আর একটি বোয়াল মাছ কিনব।” তাহার এইসব কথারর অর্থ সে বুঝিত না। শহরে আসিবর পর সে খুব একাকিত্ববোধ করিত আর সেই ছোট্টবেলার কথা মনে করিয়া আনন্দ করিত। কত সময় যে তাহার মাতৃকে তাহার গুরুত্বপূর্ণ
কার্যে বিরক্ত করিয়াছে, অঞ্চল ধরিয়া পাছে পাছে ছুটিতো আর কহিত, কয়টা চাউল আর কাঁঠালের বিচি ভাজিয়া দিতে। মাও সমস্ত কর্ম ফেলিয়া রাখিয়া তাহার আবদার মিটাইত। অনড়ব মাখাইয়া দিয়া এক লোকমা না খাইলে রবি তাহাতে স্পর্শ পর্যন্ত করিত না। অন্যদিকে বাবার আদরমাখা শাসন। এইসব ভাবিয়া ভাবিয়া স্থির করিল পয়লা মাসের মাইনে পাইয়াই বাড়ি যাইবে। জহিরের নিকট বাড়ি যাইবার প্রস্তাব করিলে সে কহিল, এইত সেদিন এলে, এখনি বাড়ির প্রয়োজন কেন? টাকা বড় বেশি হয়ে গেছে? রবি কোন উত্তর করিল না। নিশ্চুপ হইয় রহিল। রবির মনের খবর বুঝিতে পাইয়া রাহেলা জহিরকে বুঝাইয়া বাড়ি যাইবার ব্যবস্থা করিল। পথিমধ্যে ভাবিল তাহার মাতার জন্য কিছু কিনিয়া লইবে। আবার ভাবিল, এই টাকাতো চাকরির নয়। তাছাড়া খরচাদি বাদে অত টাকাও নাই, যা দিয়া কাপড় আর বোয়াল মাছ কিনিয়া লইবে। বাড়ি হইতে ফিরিবার পূর্বে বাবার জন্যে একাজোড়া সেন্ডেল কিনিয়া দিল। তজ্জন্যে রবির পিতা-মাতার অন্তর ভরিয়া গেল। পুত্রের চক্ষু ফুটিয়াছে, নিজের খরচ যোগাইতে সক্ষম। কিন্তু এদিকে জহিরের অন্তরটা শুকাইয়া গিয়াছে। টিউশনীর সমস্ত টাকার হিসাব চাহিতে গিয়া যখন শনিতে পাইল, বাবাকে সেন্ডেল কিনিয়া দিয়াছে, সঙ্গে-সঙ্গেই অবশিষ্ট টাকা অদূরে ছুড়িয়া মারিল। বলিয়া রাখিল, পরবর্তী মাসের পুরোটাই তাহার হস্তে প্রদান করিতে হইবে। অন্যথায় তাহার
কপালে শনির দশা আছে। রাহেলা রবিকে খুব ¯েড়বহ করিত। রাহেলা কষ্ট পাইবে ভাবিয়া তাহার নিকট মর্মচ্ছেদি অনেক কথাই গোপন রাখিত। তথাপিও রাহেলার বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, রবি তাহাদের মধ্যে জহিরের নিকট একটি বুঝামাত্র। কিন্তু কিছুই করিবার নাই রাহেলার। নির্বাক শ্রোতার ভূমিকাই পালন করিতে হইত। কলেজ
হইতে ফিরিবার পর মধ্যাহ্নভোজ অতপর বিশ্রাম। তাহার পর সন্ধ্যাবধি টিউশনী আর ঘুরিয়া ফিরিবার সময়।
রাহেলা তাহাকে সময় দেবার মত কোন সুয়োগ পাইত না। কারণ, সে ইশকুল হইতে ফিরিবার পর ব্যাচাকারে স্তরে-স্তরে ছাত্রী পড়াইত। রাহেলার সহিত তাহার ছাত্রীদিগের বন্ধুশুলভ সম্পর্ক হইয় থাকে।
রোজকার মত রবি আজি বিকালেও বাহিরে। কিন্তু শরীরটা বড় খারাপ অনুভব করায় বাসায় ফিরিয়া আসিল। তাহার কক্ষে দৃষ্টিগোচর করিতেই দেখিতে পাইল, গোটাকয়েক নব যৌবনা হাঁড়ি পাতিলে অন্বেষণ করিতেছ রাহেলা কি রন্ধন করিয়াছে তাহা দেখিবার জন্যে। আজ অন্যান্য তরকারীর সহিত ঢেঁড়স ভাজিও ছিল। তাহা মুখে লইবার ভঙ্গিতেই রবিকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। হতভম্ব হইয়া সংকোচে কড়ায়ের ঢাকনা প্রতিস্থাপন করিতেই
ধপাস করিয়া পড়িয়া বিকট এক আওয়াজ হইল। ভিতর হইতে রাহেলা জিজ্ঞাসিল, কি হয়েছে? প্রতিউত্তরে একজন কহিল, কিছুই না ম্যাডাম। এক এক করিয়া সকলেই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। এদিকে অপেক্ষমান রাবি তাহার কক্ষ খালি পাইয়া চৌপায়ার নিকট বসিতেই শুনিতে পাইল, কেহ একজন ফিস ফিস করিয়া রাহেলাকে
বলিল, ‘আমনের বাই আইছে।’ কথাটি নিশ্চত করিবার জন্যে রাহেলা দুই কদম অগ্রসর হইয়া কহিল, রবি, তোমার কি শরীর খারাপ? রবি কহিল, তেমন কিছু না। রাহেলা কহিল, একটু বিশ্রাম কর ঠিক হয়ে যাবে। তাহার কক্ষটি ছিল বেলকুনিতে। কপাটের উত্তর পার্শ্বে এক খানি খাটিয়া, তাহার পূর্বদিকে পড়িবার জন্যে চৌপায়া,
অন্যপ্রান্তে হাঁড়ি পাতিল রাখিবার একখানি তাক। রবি, তাহার সাধ্যমত শারীরিক পরিপাটি করিলেও তাহার গৃহের কোন যতন করিত না। সমস্ত কিছুই অগুছালো আওলা-ঝাওলা থাকিত। পুস্তকাদির কথা বলিতে গেলে বলিতে হয়, খাটিয়া অপেক্ষা টেবিল অধিকতর অগুছালো। পুস্তক খাটিয়াইও পড়িয়া থাকিত। একদা গোধূলী লগনে রবি বাসায় ফিরিয়া প্রত্যেক্ষ করিল, তাহার গৃহের সমস্ত কিছুই সুসজ্জিত না হইলেও কাপড়, পুস্তকাদি যথাস্থানে রাখিবার ফলে কক্ষের শ্রী বৃদ্ধি পাইয়াছে। তাহার চিত্ত হরষিত হইয়া উঠিল। রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিতে হইলে সর্বাগ্রে রবির
কক্ষ অতিক্রম করিতে হয়। এক ব্যাচ চলিতে থাকিলে অন্য এক ব্যাচকে রবির কক্ষে অপেক্ষা করিতে হইত। প্রতিদিনের মত ছাত্রীদল গৃহে প্রবেশ করিলেই রবি প্রস্থান করিল। গোটাকায়েক টিউশনী করিয়া বাসায় ফিরিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া ঘুরিবার জন্য বাহির হইত। যথারীতি বাসায় ফিরিয়া দেখিতে পাইল তাহার কক্ষ পরিপক্ব হস্তের ছোঁয়ায় সংরক্ষিত। গতদিন অপেক্ষা চাকচিক্যমন্ডিত। তাহার একটি অভ্যাস ছিল কোথাও বাহির হইলেই এক খানি লেখনি আর আর এক খানি পকেটপ্যাড সঙ্গে লইত। প্যাডখানি যেথায় রাখিয়াছিল হেথায় খুঁজিয়া পাইল না। রাহেলাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসিল ‘প্যাড কোথায়?’ কিন্তু সে তাহার কিছুই বলিতে পারিল না। পশ্চাৎপদ করিল। ছাত্রীদের আলাপচারিতা আর রাহেলার গমন ভঙ্গিতে বুঝিতে পাইল, রাহেলা তাহার কক্ষ শোভিত করিয়া রাখে
নাই। ক্ষণপর রাহেলা যখন পূনরায় আগমন করিয়া কহিল, টেবিলের ড্রয়ারের ডান কোণায়, তথাপি রবির আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, রাহেলা ব্যতিত অন্য কেহ তাহার কক্ষের শোভাবর্ধন করিয়াছে। নিত্যদিন কে এমন সুন্দর করিয়া সুসজ্জিত রাখে তাহা জানিবার বাসনা রবির মনোমধ্যে তীব্রতর হইতে লাগিল। তজ্জন্যেই আজিকে বিলম্ব করিয়া বাহির হইবার ইচ্ছাপোষণ করিল। দশম শ্রেণীর ছাত্রীবিৃন্দ হাজির। সালাম করিয়া গৃহে প্রবেশ
করিল। রবির কক্ষে অপেক্ষমান থাকিতে হইল। রবি জিজ্ঞাসিল, আপনারা কেমন আছেন? সকলেই বলিয়া উঠিল, ভাল। তাহাকেও জিজ্ঞাসিল, আপনি? রবিও যথার্থই কহিল। রবি আপনার পরিচয় প্রকাশ করিবার জন্য বলিল, আমার নাম র..। বলিতেই একজন বলিয়া উঠিল, আমনের নাম ‘রবি’। আমনে ম্যাডামের বাই। রবি কহিল, তবে আপনাদের পরিচয়টা? প্রত্যেকেই স্ব-স্ব নাম যথাμমে বলিতে লাগিল, দিপা, আনিকা, নাজু, আলো, শিমু ইত্যাদি।
রবি কহিল একটি কথা জানতে বড় ইচ্ছা করছে বলবেন কি? আমার জন্য প্রতিদিন কষ্ট করে ঘর গুছিয়ে থাকে কে? আলো বলিয়া উঠিল, আমরা সবাই। রবি তাহার প্রশেড়বর সঠিক জবাব না পাইয়াও পূনরায় জিজ্ঞাসা করিল না। বৃহস্পতিবার ও শুμবার রাহেলা কাওকেই পড়াইত না। এমন ছুটির দিনে দশম শ্রেণীর সকলে না আসিলেও আলো, দিপা ও আনিকা পুস্তকবিহীন আসিয়া খোস গল্প করিত। রাহেলা প্রকৃতই প্রকৃতি প্রেমিক। কোন অবকাশ
পাইলেই ঘনিষ্ট ছাত্রীদের লইয়া বেড়াইতে যাইত। তেমনি এক বৃহস্পতিবার বৈকালে রবিসহ সকলে মিলিয়া পাশের নদী পাড়ি দিয়া ওপারের কাঁশফুল উপভোগ করিতে গেল। সন্ধ্যাবধি হাঁটিয়া ক্লান্ত হইলে হিজল গাছের তলায় স্বস্থিতে ক্ষণিক বসিল। প্রত্যেকেই আপন আপন পরিধেয় বস্ত্রের পানে চাহিয়া প্রত্যেক্ষ করিল একপ্রকার উদ্ভিদের কাঁটা তড়িতাকর্ষণে বস্ত্রের বুনোনিতে আশ্রয় করিয়া লইয়াছে। হাঁটু হইতে গোড়ালী পর্যন্ত ইঞ্চি পরিমাণ
জায়গাও কেহই ফাঁকা পাইল না। রবি ইহার নাম জিজ্ঞাসা করিলে রাহেলা সঠিক উত্তর করিতে পারিল না। আলো কহিয়া দিল, “প্রেমকাঁটা”। রবি প্রতিউত্তর করিল, প্রেম না করিতেই প্রেমের কাঁটা বিধিল কিভাবে? সূর্য্য অস্তগামী হইলে তাহারা ফিরতি পথে নৌাকায় চড়িল। নদীর সমস্ত জল আকাশের প্রতিচ্ছায়ায় সোনালী রঙ ধারণ করিয়াছে। আলো কৌতুহলে ওই জলস্পর্শ করিয়া নায়ের আগা হইতে গোড়া পর্যন্ত ছিটাইয়া দিয়া সহাস্যে চিৎকার
করিয়া উঠিল। ইহা ঠাহর করিল না যে, তাহার ছিটানো পানির অর্ধেকাংশই রবির উপর পতিত হইয়াছে। বাসায়গমনপূর্বক রবির পরিধেয় বস্ত্র পরিবর্তণ করিয়া খাটিয়ায় রাখিয়া দিয়া মনে মনে ভাবিয়া রাখিল আগামীকাল ইহা বস্ত্র হইতে পৃক করিবে। রবি সর্বদায় বোতল হইতে পানি পান করিয়া থাকে। রাহেলার কক্ষ হইতে বোতল আনয়ণ করিয়া দেখিতে পাইল, আলো দিপা ও আনিকা তাহার বস্ত্র হইতে প্রেমকাঁটা অপসারণ কার্যে লিপ্ত। রবি অবাক হইয়া কহিল, আপনারা এসব করছেন কেন? আলো উত্তর করিল, আপনি একা সবগুলো শেষ করতে পারবেন না তাই। রবি কহিল, এপর্যন্তই রাখেন, বাকি সব আমি..। না ধরেছি যেহেতু শেষ করেই চাড়ব। রবি প্রতিউত্তর না করিয়া বোতলের সিপি খুলিয়া পানি পান করিতে আরম্ভ করিল। আলো কহিল তৃষ্ণা কি শুধু আপনার একার নাকি আমাদেরও আছে? তাহাদের উদ্দেশ্যে না আনিলেও কিঞ্চিতবিলম্ব না করিয়া বলিয়া দিল, এই পানিপূর্ণ বোতল সকলের জন্যই এনেছি যাতে সবার তৃষ্ণা নিবারণ হয়। বোতল হস্তান্তর করিয়া সিপি দিয়া খেলা করিতে লাগিল। তাহার এ হাত ও হাত, উপরে নিচে ঘুরাইতে লাগিল। বোতলের সিপিকে এই অঞ্চলের লোকেরা ‘মোক্ষা’ বলিয়া অভিহিত কলিয়া থাকে। দীর্ঘদিন ধরিয়া এমন বোতলের মোক্ষা লইয়া খেলা করা দেখিয়া রবিকে প্রয়ই
বলিত আপনার মোক্ষা কই? রবি কোন উত্তর না করিয়া মৃদু হাস্যে সাঁই দিয়া থাকিত। আজ রাহেলা স্বীয় কোন প্রোয়োজনে বাহিরে গিয়াছে। যাইবার পূর্বে রবিকে বলিয়া গিয়াছে, ছাত্রীরা এলে ফিরাইয়া দিতে। ছাত্রীরা ইহা শ্রবণমাত্রই গোলাকার হইয়া বসিয়া রবিকে ডাকিয়া কহিল, আমাদের মাঝে এখন একটি গান পনিবেশন করবেন মোক্ষা ভাই। রবি তাহার সাধ্যমত পাশকাটাইয়া গান গাওয়া হইতে মুক্তি পাইল। তাহারা সকলে মিলিয়া রবিকে তাহাদের বন্ধুত্বের উচ্চ শিখরে বসাইয়া অন্তরঙ্গ করিয়া লইয়াছে। ইহা রবি ঠাহর করিতে পারে নাই। কোনদিন যদি রবি বাসায় ফিরিতে বিলম্ব করিত, তথাপি তাহার আগমনপূর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করিত। আর তাহার খাতা নাড়িয়া চাড়িয়া কোথাও বানানের কোন ভূল পাইলে তাহা বৃত্তাকার করিয়া রাখিত। রবি ফিরিলেই তাহা দেখাইয়া কহিত, মোক্ষা বাই, এই বানানের সঠিকটা দেখিয়া লইবেন। আলো ইহা বিশেষভাবে করিত। এইসব রবির কল্যাণের জন্য তাহা সে অনুভব করিল। রবিও তাহাদিগকে আপন করিয়া লইল। পূর্ব হইতেই যদি আলো কখনো অবগত হইত যে, আজ বিকালে সে তাহার কোন সমস্যার কারণে রাহেলার নিকট পড়িতে যাইতে পারিবে না। তাহা হইলে ইশকুলের কোন ক্লাসের ফাঁকে নতুবা ক্লাস বাদ দিয়ে হইলেও রবির কক্ষে গিয়া তাহার সমস্ত কিছু পরিপাটি করিয়া আসিত। আলোর পিত্রালয় এই শহর হইতে বহুμোশ পশ্চিমে। তাহার পিতৃবিয়োগ হইবার পর আবাল্যকাল জহুরাদের বাড়িতে ভাড়ায় অবস্থান করিয়া আসিতেছে। জহুরা আর আলো ছোট বেলার খুব ভাল বন্ধু। তাহারা পরস্পরে একই শ্রেণীতে অধ্যায়ণ করিত। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইবার পর বিষেশ কোন কারণবশত তাহাকে পড়াশোনা হইতে ইস্তফা দিতে হইয়াছে। জহুরার সম্পর্কে আলো রবিকে পূর্বেই অবহিত করিয়াছে। রবিকে সকলেই তাহাদের বাড়িতে লইয়া যাইত এবং যথেষ্ট কদর করিত। তাহাদের প্রতি অনুরাগি হইয়া রবির পদ্য রচণার প্রবনতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। নুতন কোন কবিতা রচিলেই সন্ধ্যাকালীণ কোন সময়ে আলো অথবা দিপার বাড়ি গিয়া শোনাইত। দিপা শ্যামা মেয়ে। সে বোধ করিত ইহা তাহার জন্য
খুবই লজ্জাকর একটি বিষয়। সে খুবই সংকোচে লোকসম্মুখে আত্মপ্রকাশ করিত। কিন্তু তাহার ভিতর যে চাঞ্চল্যতা, বিচক্ষণতা, তিক্ষèমেধা আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা সো ঠাহর করিতে পারিলেও আত্মতৃপ্তি পাইত না। রবি এবং তাহাদের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠতার দরুণ ‘তুই’ সম্মোধন করিয়া পরস্পরে পরিতৃপ্ত হইত।
রাহেলার কক্ষে সকলেই পড়িতেছিল। রবি তাহার কক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া দিপাকে ডাকিল। দিপাও সিডরের ন্যায় আগমনপূর্বক তাহার অঞ্চল খানি চঞ্চল করিয়া টানিয়া শাহাদাত আঙ্গুলের অগ্রভাগে পেঁচাইয়া দুই পাটিদন্তে টিবুনী দিয়া লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করিয়া কহিল, মোক্ষা বাই আমার জন্য কিছু আনছস্? রবি কহিল, না এমনিতেই। দিপা সমস্ত ভঙ্গিমা ত্যাগিয়া গম্ভির বদনে কহিল, তাইলে ক কিজন্য ডাকছস্? রবি কহিল তোদের জন্য চানাচুর এনেছি। দিপা সহাস্যে কহিল, কি প্রয়োজন ছিল এইসব করার। আমরা কি আনতে বলেছি নাকি? রবিও তাহার ছলনা বুঝিতে পাইয়া কহিল, তবে থাক্ যেইদি চাইবি সেইদিন না হয় দিব? অমনি খপ্ করিয়া তাহার হস্ত হইতে ছুটাইয়া লইয়া রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া সকলকে দেখাইয়া কহিল, মোক্ষা বাই আমারে চানাচুর দিছে।
সকলেই তাহার হস্ত হইতে কাড়াকাড়ি করিয়া লইয় খাইতে শরু করিল। দিপা রবির কক্ষে পূনগমন করিয়া কহিল, আমার চানাচুর সব নিয়া নিছে। রবি জিজ্ঞাসা করিল, চানাচুর সব তোর ছিল? দিপা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। রবি বলিল, চিন্তা করিস্ না তোকে আরও ভাল কিছু দিমু। দিপা কহিল, সত্যিই দিবা বাই? হুঁ। কি দিবা কও..। কহিয়াই রবির স্কন্ধদেশে মৃদু টিপুনি দিয়া কহিল, ক... না বাই কি দিবি? কিয়দক্ষণ ভাবিয়া কহিল, তোরে অনেক সুন্দর একজন পাত্রের নিকট পাত্রস্থকরব। দিপা তাহার চঞ্চলতা প্রকাশ করিয়া কহিল, সত্যি কইতাছস্ বাই? হুঁ, সত্যি। বুঝিস্ কইলাম। কহিয়াই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া পড়ায় মনোনিবেশ করিল। এমনই মজার মানুষ দিপা। রবি, দিপার আসল রূপ লইয়া এবং তাহার চাঞ্চল্যতার স্বরূপ এক খানি কবিতা রচনা করিয়া এক সন্ধ্যায় দিপার বাড়ি হাজির হইল। দিপা সমস্ত কর্ম ত্যাগিয়া আপ্যায়ণের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। রবি তাহাকে ডাকিয়া কহিল, আগে আমার কবিতা শুনবি পরে খাব। নতুবা খাব না। পা গুটাইয়া বসিয়া কহিল, আবৃত্তি করেন জনাব। আবৃত্তি শরু হইল আর দিপা ভাবিতে লাগিল কি পরিবেষণ করিবে। কিছুক্ষণ পর যখন আবছা আবছা বুঝিতে
পাইল কবিতায় তাহারই গুণকীর্তন করা হইতেছে, তখন সে পুরোপুরি মনোনিবেশ করিয়া অবশিষ্ট সমস্তই শ্রবণ করিয়া বলিল, মিছামিছি প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দা করাই ভাল। কিন্তু তাহার ভগিড়ব নাজু কবিতার অর্থ বুজিতে পাইয়া রবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
জহুরার সহিত আলো তাহার আনন্দ বেদনা ভাগা ভাগি করিয়া লইত। ইদানিং আলোর চঞ্চলতার পরিধি বৃদ্ধি পাইয়াছে। জহুরা বাড়িতে বসিয়াই কুটির শিল্পের কর্ম করিত। তাহার সহিত আলোর উঠা বসার দরুণ আলোর হস্তদ্বয় আরো পরিপক্ব হইয়াছে। একদা সন্ধ্যায় রবিকে আলো তাহাদের বাসায় লইয়া তাহার মাতা এবং জহুরার সহিত পরিচয় পর্ব সূচনালগেড়বই সমাপ্ত করিল। আলো আম্রাচার বাহির করিয়া খাইতে লাগিল আর কহিল, মোক্ষা, খাবি? রবি হস্ত প্রসারিত করিতেই আলো কহিল, এটা তোর জন্য নয়, এটা খাইলে দাঁত টক হয়ে যাবে, তুই ভাত খাইতে পারবি না। তোর জন্য শুটকি ভর্তা বানিয়ে রেখেছি। রবি জহুরাকে জিজ্ঞাসিল, আপনি এখন অবসর অথচ পড়া লেখা বাদ দিয়েছেন কেন? জহুরা উত্তর করিল, সে অনেক কথা, অন্যদিন বলব। আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, জহুরা বলিল। জহুরার কথা শ্রবণে রবি আশ্চার্যান্বিত হইলে জহুরা কহিল, আলো সারাক্ষণ আপনার কথাই বলে। তাই খুবই ইচ্ছে ছিল আপনাকে দেখার। রবি খাইতেছিল এমতাবস্থায় আলো পাশের কোঠা হইতে একখানি শ্বেত কাপড়ের ফতুয়া হস্তশিল্পের উপকরণাদিসহ আসিয়া কহিল, মোক্ষারে.... ফতুয়াটা কেমন হয়েছে দেখত। ফতুয়ার গঠন সুন্দর এবং ইহার উপরিভাগ হইতে নি¤ড়ববধি কারুকার্যের যেই রেখা বহিয়া গিয়াছে
তাহাও সুন্দরতম নকশা। রবি বলিল, এটা কার জন্য? আলো উত্তর করিল, একজন কাছের মানুষকে দিব। এমন প্রসস্ত ললাট কাহার তাহা জানিবার জন্য দ্বিতীয়বার রবি প্রশড়ব করিল না। এমন নিপুন হস্তের লাবণ্যম-িত কারুকার্য্য, পরিপক্ব হস্তের শুটকি ভরতা, প্রতিদিনের ঘর গুছিয়ে দেওয়া, রবির হস্তলেখার প্রতি যতড়ব নেয়া এবং তাহার প্রেরণা যোগানো এতসব গুণের আধার এই আলো। রবি তাহাকে প্রশংসা করিবার মতো কোন ভাষা না খুঁজিয়া পাইয়া কহিল, তুই একটা “আমড়া কাঠের ঢেঁকি” জহুরা কহিল, কেন? রবি কহিল এই ফতুয়া পর্যন্তই শেষ ওর দ্বারা আর কিছুই হবে না। আপনি নাকি ইতোপূর্বেও বলেছিলেন তাকে দ্বারা আর কিছুই হবে না, তারপরওতো ফতুয়া হইতেছে। রবি কহিল, আলো তাহার প্রতিটি কর্মের জন্য প্রশংসার দাবিদার। তাকে প্রশংসা করে তার
গুণাবলি নশ্বর করতে চাই না। ইহার পর রবির জন্মদিন বা কোনা উৎসব ব্যতিতও যদি কোন উপহার প্রদান করিত তবে তাহার গয়ে লিখিয়া দিত ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’।
তাহাদের বান্ধবি সকলের বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হইয়াছে দিপা এবং আলো। বোধ হয় একই অনুতে দুইটি অঙ্গ গাাঁ, একজন অন্যজন ব্যতিত কেহই স্বস্থিবোধ করিত না। রবির মনোমধ্যে যে হাহাকারের ক্ষত ছিল তাহারা সকলে মিলিয়া মুছিয়া দিয়া পর্যাপ্ত আনন্দ ঢালিয়া দিয়াছে। সকলের সহিত রবির মেলামেশার কারণে রাহেলা বা জহির কেহই তাহাকে কোন প্রকার সন্দেহ বা বারণ করিত না। তাহারাও বুঝিয়াছিল যে, ইহারা খুব ভালো বন্ধু। রবির হাতের লেখায় বানানের যেই ভুল সাধিত হইত তাহা নিরসনের জন্য যথেষ্ট সচেতন থাকিলেও নির্ভুল হাতের লেখা হইয়া উঠে নাই। আলো প্রতিদিনকার মতো আজিও ভুল বানানগুলো বৃত্তাকার করিয়া চৌপায়ায় রাখিয়া রাহেলার কক্ষে গমন করিয়া রবির দক্ষিণ কর্ণলতি টানিয়া তাহার কক্ষে আনিয়া আঙ্গুলীনির্দেশ করিয়া কহিল, এইসব কবে নাগাদ সঠিক হবে? প্রতিউত্তরে রবি কহিল, আগামিকাল দেখিস্ কোন ভুল পাবি না। আলো বলিল, তোমার প্রতিদিনের আগামীকালতো গত হইতেছে না। পড়ালেখা সমাপ্ত করিয়া গৃহ গুছাইয়া ফিরিবার পূর্বমুহূর্তে রবির নাসিকা তাহার শাহাদাৎ ও বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বারা চাপিয়া ধরিয়া উত্তর দক্ষিণে মৃদু ঝাকুনি দিয়া কপোলে আহ্লাদ মাখা আলতো চড় মারিয়া চলিয়া গেল। ঈদৃশ কার্য নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হইয়া গেল। এমন আসা যাওয়ার মাঝেও রবিকে ফোন করিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে পনসকাননে গিয়া আয়েশ করিয়া কথা বলিত। আলোর নিজস্ব কোন ফোন ছিল না বিধায় জহুরার ফোনে কথা কহিত। রাত্রিযাপনও একই খাটিয়ায় করিত। রবির কোন কর্মে আলো বাঁধা হইয়া দাঁড়াইত না। বরঞ্চ প্রেরণার আশিস হইয়া দাঁড়াইত। গত রাত্রিতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিনড়ব হইয়া গিয়াছিল পুরো মহল্লায়। গৃষ্মের কড়া তাপদাহে কোন গৃহেই টিকিতে পারিতেছিল না কেহই। রবিও মধ্যরাত্তিরে উঠিয়া প্রধান সড়কের নিকট গমন করিয়া ক্লান্ত শরীর খানি জুড়াইতে ছিল আর ভাবিল, আলো, জহুরা সকলে মিলিয়া হইতবা গল্প করিতেছে, নয়ত এই প্রচ- গরমে নিদ্রা যাওয়া সম্ভবপর নয়। জহুরাকে ফোন করিল, আলোও ভবিতেছিল তাহাকে ফোন করিবে কিন্তু অধিক রাত্রি হওয়ায় ফোন করিল না। গরমের কথা ভাবিয়া আলো প্রশড়বও করিল না রবি ঘুমায়নি কেন। আলো নিঃসন্দেহে ভাবিয়াই নিয়াছিল রবি তাহার কক্ষেই বিদ্যুৎ অপেক্ষায় কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (ফখরুদ্দিন) কড়া নির্দেশে জরুরী অবস্থা চলিতেছিল। রাত্রি নয়টার পর কেহই রাস্তায় অবস্থান করিতে পারিবে না। কিন্তু যথাপি শুনিল প্রধান সড়কের নিকটে, তথাপি এক মিনিটও বিলম্ব না করিয়া বাসায় ফিরিবার নির্দেশ করিল।
দিন কয়েক পর রোজার মাস। জহির, রাহেলাকে কিছু না জানাইয়াই মোরে মোরে রবির জন্য জাগির বাড়ি খুঁজিতে লাগিল। তাহার পরিকল্পনায় ছিল, রবি ঈদের পর বাড়ি হইতে এলেই তাহাকে জাগির বাড়ি পাঠাইবে। পশ্চিম দক্ষিণ গগনে রমযান মাসের বাঁকা চাঁদ উদয় হইল। সেহ্রী খাওয়ার জন্য আলো রবিকে ফোন করিয়া জাগাইয়া
দিয়া তাহার বাকি কর্ম সমাপ্ত করিল। রবি ফজরের নামাজান্তে লেপ মোড়ি দিয়া ঘুমাইল। ঘন্টাধেক পর রবির ফোন বাজিয়া উঠিল। রবি বলিল, ঢেঁকি’র চোখের পাতায়া কি ঘুম নাই? আলো কহিল, ঘুম পাইতেছিল না তাই তোকেও ঘুমাইতে দিলাম না। এই আমড়া কাঠের ঢেঁকি আর কিছু না পারলেও তোর ঘুম ভাঙ্গাতে পেরেছি। ফোন রাখলেতো ঘুমাবই, রবি কহিল। আলো কহিল, ফোন রাখলেতো! কতক্ষণ কথা বলতে পারবি? সূর্যোদয় পর্যন্ত। তারপর যদি ঘুমাই। না, ঘুমাবি না। কেন? আলো কহিল, আমি যে ঘুমাব না। রবি বলিল, আমার আমারতো ঘুম হবে। না, তুই ঘুমাবি না, পড়বি। রবি বলিল, আচ্ছা। উষালগেড়ব ফোন রাখিবার প্রাক্কালে আলো কহিল, ঘুমাইস্না কইলাম। রবির আর ঘুম পাইল না ঘুমাইবার প্রচেষ্টাও করিল না। সূর্য্য মাথার পর হইতে পশ্চিমাকাশে ঢলিয়া পড়িল আর তাহারা সকলেই পড়িতে উপস্থিত হইল। সকলেই রাহেলাকে আজ অল্প পড়াইতে অনুরোধ করিল। রাহেলাও প্র ম রোজার খাতিরে মঞ্জুর করিল। সকলে বইপত্র গোছাইবার পূর্বেই আলো তাহার সমস্ত কিছু লইয়া রবির কক্ষে গমন করিল। কক্ষটি গুছইয়া রবির নাসিক্য ধরিয়া এদিক ওদিক নাড়িয়া আহ্লাদের চড় দিয়া প্রস্থান করিল। ফজরের নামাজান্তে রবি ভাবিল, আজ আলোকে ঘুমাইতেদিবে না। ফোন করিল। কথোপকথনে তাহাদের হর্ষ বিষাদ একে অপরকে অবহিত করিত। যদ্দারা চিত্ত বিহ্বলে সহমর্মিতা প্রতিস্থাপিত হইল। কতটুকু অন্তরঙ্গ হইলে একজন আর একজনকে প্রত্যেক্ষ করিয়া বা না করিয়া তাহাদের ভিতরকার অবস্থা অনুভব করিতে পারা যায় তাহার সমস্তই তাহারা লব্ধ করিয়া লইয়াছে। প্রভাত হইয়া
গেল। ফোনে কথা বলিতে বলিতে রবি ভাবিল আলোকে না জানাইয়া তাহাদের বাড়ি গিয়া সাক্ষাত করিবে। অন্যদিকে আলোও এমনটি ভাবিল। একে অপরের অজান্তে কথা কহিতে কহিতে অগ্রসর হইতে লগিল। আলোকে ডাহিনে এবং রবিবে বামে মোড় ঘুরিতে হইবে। মধ্যখানে দোকান। মোড় ঘুরিতে আরম্ভ করিল। একে অপরকে
প্রত্যেক্ষ করিবার পূর্বেই তাহাদের ফোনে যে কথাগুলো বাজিতেছিল তাহার আওয়াজ বাস্তবিক হইয়া গেল। হরষে একই সঙ্গে কর্ণ হইতে ফোন নামাইয়া বলিল, তোকে দেখার জন্যই যাইতেছিলাম। ইহা শুধু হিয়ার পরশেই হইয় থাকে। তাহাদের স্বচোক্ষে না দেখিয়া উহা বিচার করিতে কঠিন। দিন কয়েক পর
যথারীতি দূরালাপন আরম্ভ হইল। কিন্তু পূর্ববৎ দীর্ঘ হইল না। রবি কহিল, শরীরটা ভাল না, আজ রাখি বিকালে তুই এলে দেখা হবে। আলো ব্যগ্রকন্ঠে জিজ্ঞাসিল, কি হয়েছে তোর? জ্বর, নাকি মাথা ব্যথা? সেহ্রী খাস নাই? রবি নম্রকন্ঠে উত্তর করিল, ওসব কিছু না। জহির ভাই কি কিছু বলেছে? আলোকে সঠিক তথ্যটি জানাইল না। কি হইয়াছে তাহা জানিবার আগ্রহ বৃদ্ধি পাইতে লগিল। কিঞ্চত বিলম্ব না করিয়া দিপার বাসায় গিয়া তাহাকে কহিল, দিপু মোক্ষার কি জানি হয়েছে। চল্ গিয়ে দেখে আসি। দিপা কহিল, এই রাইতের বেলা? আলো কহিল, তাতে কি কাছেইত মাত্র চার মিনিটের পথ। পনসকানন ভেদ করিয়া রবির দ্বারে হাজির। দরজায় করাঘাত করিতে চাহিয়া করিল না। সকলের ঘুম ভঙ্গিবে বলিয়া। পশ্চাৎগমন করিয়া রবিকে ফোন করিয়া কহিল, বাহির হইতে। রবি বিস্মিত কন্ঠে কহিল, কোথায়? ইশকুল গেইটে। ইশকুল আর রবির বাসা একটি মাত্র বাড়ির ব্যবধান। তাহাদের প্রত্যেক্ষ করিয়া কহিল, তোরা এইখানে? আলো আঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া দিপাকে দেখাইয়া বুঝাইয়া দিল, সে আনিয়াছে। রবি মৃদু হাসিয়া দিপাকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছিস? দিপা উত্তর করিল ভাল না থাকলে কি তোমারে রাইতের বেলা দেখতে আইছি! তোর কি হইছে ওইড্যা ক। রবি আপনাকে সংবরণ করিয়া কহিল, অনেক রাত্রে ঘুমানোর কারণে শরীরটা বড় ক্লান্ত, তাই.....। আলো কহিল, তোর কি হয়েছে সত্যি কইরা ক। রবি বলিল, এই বাসায় হযতবা আমার থাকা হবে না। সামনের মাসে কোন মেসে নয়তবা হোস্টেলে উঠব। কেন? জানিতে চাইলেও কোন উত্তর পাইল না। রবি যেন তাহাদের আগাইয়া দিয়া আসে তজ্জন্যে দিপা কহিল, জানস্ বাই, আমরা আইতেছিলাম আর ওই বাগানে তিনড্যা কাঁঠাল গাছে দুইড্যা ভূত বইসে ছিল। আমাগো দেইখ্যা খাড়াইতে কইছিল। পরেদা আমরা বুদ্ধি কইরা কইলাম, তোমাগো যেই বোতলে বন্দি কইরা রাখমু সেই বোতলের মোক্ষার সমস্যা হইছে মেরামত করেত যাইতেছি। ওমনেই দৌড়ে চইল্যা আইছি। একটু আগাইয়া দে না বাই। আলোও
পার্শ্ব হইতে কহিল হ বাই আয় নয়লে যদি আবার সামনে খাড়ায়।
রোযার শেষার্ধে রবি মনোস্থির করিল পঁচিশ রমযানে বাড়ি যাইবে। তেইশ রমযান তাহারা যথারীতি পড়িতে আসিয়া রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। আলো জহিরকে ডাকিয়া কহিল, আমনের আর ঈদে কেনাকাটা করার প্রয়োজন নাই। বলিয়াই তাহার ব্যাগ হইতে তিনটি কাটা গেঞ্জি বাহির করিয়া তাহার হস্তে প্রদান করিল। তাহার
জন্য একটি, বাকি দুইটি তাহার পুত্রদ্বয়ের জন্য। হস্তদ্বয় পশ্চাদে রাখিয়া রবির কক্ষে গমনপূর্বক কড়া সাশনে কহিল, দাঁড়া। রবিও আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হস্তদ্বয় উপরে তুলিয়া দাঁড়াইল। আজ্ঞা মহারাণী। বলুন কি করিতে হইবে? রবি বলিল। পুনরায় সাশাইয়া কহিল, কাপড় খোল। জামা খুলিয়া প্যান্টের উপর হস্ত রাখিয়া কহিল, এটিও? আলো আঁধারে হাস্যরেখা গোপন করিয়া তাহার হস্তদ্বয় সম্মুখে আনিয়া ফতুয়াটি পরাইয়া দিয়া নাসিক্য
ধরিয়া এদিক ওদিক করিয়া কহিল, এটা তোর জন্যই তিলে হিলে পূর্ণতা দান করেছি। পছন্দ হয়নি? রবি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। কেন? আমার জন্যে এতোদিন ধরে অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিস তাই। আলো কহিল, তোর জন্য কোন কষ্টকেই আমার কষ্ট মনে হয় না। বলিয়াই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। ঈদ পরবর্তী কয়েকদিন বিগত হইবার পর এক পড়ন্তবেলায় জহির রবিকে ডাকিয়া কহিল, তোমার জন্য জাগির বাড়ি ঠিক করে এলাম। সকালের নাস্তা আমার বাসায় করবে। তারা শুধু দুপুরে আর রাত্রে খাওয়াবে। আর রাত্রে এখানেই থাকবে। তাতে তুমি কিছু টাকাও সঞ্চয় করতে পারবে। রবি মাথা নাড়িয়া সায় দিলেও রাহেলা শ্রবণমাত্রই জহিরের সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইয়া গেল। রবি ভবিয়া সিদ্ধান্ত লইতে বিলম্ব করিল না, সে স্থির করিল জগির বাড়ি খাইতে হইলে খাইবে
কিন্তু এই বাড়িতে অবস্থান করিয়া নয়। এদিকে সূর্যাস্তের পর এক মেসে গিয়া কথা পাঁকা করিয়া আসিল। সূর্যোদয় হইল প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করিয়া আসবাবপত্রাদি গুছাইতে লাগিল। রাহেলা নির্বাক শ্রোতা ব্যতিত কিছুই করিতে পারিল না। রবি তাহার নিকট গিয়া কহিল, মানুষ চির জীবন ইচ্ছা করলেও এক সাথে থাকতে পারে না।
প্রয়োজনই তাকে সরিয়ে দেয়। আমি এই ক্ষাণেই থাকবো বেশি দূরে নয়। প্রায়ই আসব। রাহেলা অশ্রুসজল নেত্রে কোনো কথাই কহিতে পারিল না। অধিক শোক তাহাকে গ্রাস করিয়াছে। উত্তাল উর্মির ন্যায় তাহার নয়ণতীর ভাসিয়া লবাণাক্ত জল প্রবল বেগে বহিতে শুরু করিল। রাহেলার আকুতি, তাহার ¯েড়বহ-মমতাকে উপেক্ষা করিয়া রবিকে অচেনা শহরে একটিমাত্র পরিচিত বাড়ি তাহাও ছাড়িতে হইল। অদ্য বৈকালে কেহই রবির কক্ষে অপেক্ষা
না করিয়া রাহোলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইল, সে সকল কর্ম স্থগিত রাখিয়া শুধুই μন্দন করিতেছে। আজিকে কেহই আর পড়িল না। আলো, রাহেলার গৃহ ত্যাগ করিতেই ভুলিয়া গিয়াছে যে, রবি নাই। প্রতিদিনকার অভ্যাস গড়িয়া উঠায় আজও খাটিয়ায় বসিল। কিন্তু সে গুছাইবে কি? চৌপায়া নাই, খাটিয়াই কোন লুঙ্গী বা অন্য
কোন কাপড় নাই। হঠাৎ মনে পড়িল রবি চলিয়া গিয়াছে। তাহার হৃদয়টা যেন ভাঙ্গিয়া গেল। বাড়ি গিয়া রবিকে ফোন করিয়া সমস্ত খবর লইল। আলোদের মেট্টিক পরীক্ষা সমাগম হইল। রবি বোধ করিল প্রেরণা স্বরূপ পরীক্ষার উপকরণাদি হইলেও কিছু প্রদান করা আবশ্যক। প্র মত, তাহারা রবির খুব ভাল বন্ধু। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকেই রবির সকল কাজের প্রেরণাদানকারিণী। তৃতীয়ত, সেও অনেক প্রীতিজ্ঞাপক উপটৌকন তাহাদের নিকট হইতে পাইয়াছে। সর্বোপরি রবি তাহাদের সকলের শ্রদ্ধেয়। তাহার নিকট অতিরিক্ত কোন টাকাও নাই। আবার কমপক্ষে পনের টাকার প্রতিদিনের প্রাতঃরাশ হোটেলে করিতে হইত। রবির ক্লাসমেড ও রুমমেড শুভ‘র নিকট হইতে অনিদৃষ্টকালের জন্য তিনশত টাকা করজো করিয়া তাহার আত্মসম্মান রক্ষা করিল। ইহা পরিশোধের জন্য প্রাতঃরাশ করিতে আর হোটেলমুখি হইল না বরং রাস্তার মোড়ে চাউলের গুড়ার তিন টাকা দামের গোটা দুই পিঠা খাইয়া দিনাতিপাত করিত। একদিন বৈকালে রবির ফোন বাজিয় উঠিল, কিন্তু অপরিচিত নম্বর। হ্যালো কহিতেই রবির চিনিতে বাকি রহিল না ওই প্রান্তের লোকটি কে। রবি জিজ্ঞসিল এই ফোন কার? আলো কহিল, আমার।
আজই নিলাম এবং প্র ম কলটি তোকে দিয়েই আরম্ভ করলাম। ভেবেছিলাম তোর সাথে একটু মজা করব কিন্তু তা আর হল না। রবি কহিল, আমাকে হঠাৎ গ্রামের বাড়ি যাইতে হইতেছে। কারণ জানতে চাহিলে রবি কহিল, বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে হইতবা। এবছর নাকি আর ঢাকায় ফিরতে দিবে না। আর এখন ফোন করেছে যাবার জন্য। তোদের সাথে এ বছর আর হইতবা দেখা হবে না। আর যদি দেখা না করতে পারি তবে ক্ষমা করিস। আলো তাহার অর্থ ঠিকমত বুঝিতে না পাইয়া দিপাকে সঙ্গে লইয়া তাহার মেসে আগমনপূর্বক প্রশড়ব করিল, কি হয়েছে? রবি কোন উত্তর করিল না। কিছুক্ষণ পর রবি সহাস্যে কহিল, আজ কয় তারিখ? আলো কহিল, ঊনত্রিশ। কি মাস? দিপা কহিল, ডিসেম্বর মাস। রবি কহিল, ডিসেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখে বাড়ি গেলে কোন মা কি জানুয়ারি মাসের আগে ফিরতে দিবে? অমনিতে হাসির ঢল পড়িয়া গেল। আলো কহিল, তাহলে এমন ভয় দেখালি কেন? রবি উত্তর করিল, তোদেরকে দেখার জন্য। সজোরে এক চপেটাঘাত করিয়া আলো বলিয়া উঠিল, এমন ভয় আর কখনোই দেখাবি না। রবির একাকিত্ব সময় বড় বিড়ম্বনার হইয়া পড়িল। তাহার কক্ষে এখন আর কেহই তাহার জন্য অপেক্ষা করে না। নিপুন হতের গৃহসজ্জা আর অপরিপক্ব হাতের গৃহসাজের ফারাক বুঝিল। যখনই বিষণড়বতায়া ভর করিত তথাপি ছুটিয়া যাইত দিপার বাড়ি নয়ত বা আলোর বাড়ি কখনো বা আনিকার বাড়ি আথবা আলোকে ফোন করিয়া শোক তাড়াইত। একদা কাননে বসিয়া রবি ভাবিল, আলোর বাসায় প্রবেশ করিবে কি করিবে না। এমতাবস্থায় আলো বাড়ির বাহির হইয়া রবিকে বলিল, তুই এইখানে কতক্ষণ? কারণ জানিতে চাহিলে আলো কহিল, আমার কেন জানি পনের বিশ মিনিট যাবৎ মনে হইতেছিল, তুই আশেপাশেই কোথাও আছিস। সচরাচর এমনটাই ঘটিত রবি ওই পথ দিয়া হাঁটিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে আসিতেই আলো বাহির হইয়া আসিয়া অপেক্ষা করিত। ইহা কি করিয়া সম্ভব জানিতে চাহিলে আলো কহিল, তুই এই বাড়ির আশে পাশে এলেই আমার বুকের ভিতরটা মৃদু কাঁপিয়া ওঠে। এমনই একদিন আলো বাহির হইল না। রবি অন্তপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইল সে বাসায় নাই। আলোদের বাড়ির নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হইয়াছে। আসবাব পত্র নূতন বাড়িতে লইয়া গিয়াছে। জহুরা তাহাকে নিজের কক্ষে বসাইয়া কুশলাদি বিনিময়ের এক ফাঁকে জিজ্ঞাসিল, আপনি কি আলোকে নিয়া কিছু ভাবেন? রবি বিষয়টি না বুঝিয়া পুনরায় জানিতে চাহিল। জহুরা : আপনাকে নিয়ে সে অনেক কিছুই ভাবে। আপনার কথাই সারাক্ষণ গুনগুন করে। আপনি আশে পাশে এলেই সে বাড়ির বাইরে চলে যায় আপনাকে দেখার জন্য।
রবি : আমিও কয়েকদিন থেকে ভাবি, সে আমার খুব কাছের একজন বন্ধু। তাই তাকে না দেখলে তার সাথেকথা বললে কেন জানি অপূর্ণতা থেকে যায়।
জহুরা : শুধু কি তাই? আপনি তাকে ভালোবাসেন না?
রবি : বাসি তবে প্রেমিকের চোখে নায় বন্ধুর চোখে।
জহুরা : কিন্তু, সেতো আপনাকে ভালোবাসে!
রবি : অসম্ভব!
জহুরা : কেন?
রবি : আমি তাকে অনেক আগেই ভালোবাসতাম যদি তার উপযুক্ত হতাম।
জহুরা : তফাৎতা কোথায়?
রবি : আমি ছেলে মানুষ, সবেমাত্র আই. এ.পাশ। আর সে বিবাহের উপযুক্তা মেট্টিক পাশ। তার ভাল একটা সম্মন্ধ এলেই তাকে বিয়ে দিবে। অন্যদিকে আমি অনার্স-মাষ্টার্স চাকরি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব মিলিয়ে আট দশ বছরের কথা। তাছাড়া আমি ওকে ওভাবে কখনোই ভাবিনি।
জহুরা : এখন ভাবেন! আপনার জন্য না হয় সে অপেক্ষা করবে।
রবি : আমার জন্য অপেক্ষা করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এমন কথোপকথনে রবি দ্বিধান্বিত হইয়া পড়িল। সামান্য স্বস্থি পাইবার জন্য ছুটিয়া গেল দিপার বাড়ি। দিপা তাহাকে দেখিবামাত্রই জিজ্ঞাসিল, কেমন আছিস? তোর আলো কেমন আছে? বলিতেই তাহার রসনা বাহিরে প্রবিষ্ট হইল। আর কহিল, এইড্যা আমি কইতে
চাই নাই হঠাৎ...। কিছু মনে করিস না। রবি হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, তোরা কি আমাদের সন্দেহ করিস? দিপা কহিল, এই যে কান ধরলাম আর কখনো বলব না। তবে মানাবে ভাল। ওই সমস্ত কথা দিপাকে বলিবার ইচ্ছা না থাকিলেও রবি মনোস্থির করিল দিপাকে সমস্তই খুলিয়া বলিবে। বলিলও। কিন্তু কোন সমাধান পাইল না। বরঞ্চ আলোর কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে রবির সহিত কোন প্রকার যোগাযোগ পর্যন্তও করিল না। রবি ফোন করিলেও আলো রিসিভার চাপিয়া কথা বলিল না। অনেকদিনপর পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হইল। রবি তাহার চলনভঙ্গি প্রত্যেক্ষ করিয়া বুঝিতে পাইল আলো তাহার সহিত কথা বলিবে না। তাহাকে পাশকাটাইয়া যাইবে। তথাপিও তাহার সম্মুখে হস্তদ্বয় দুইদিকে প্রশস্ত করিয়া বাঁধা হইয়া দাঁড়াইল। তবুও কোন কথা না কহিয়া পাশকাটাইয়াই চলিয়া
গেল। রবি তাহার এই ব্যক্তিগত নম্বরটিও বন্ধ পাইল। সে আলোর বাড়ি গিয়াও কোন সাড়া পাইল না। রবি পরোক্ষভাবে জানিতে পাইল, আলো তাহার মোবাইল ফোনটি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। কাহারো সহিত কোন প্রকার যোগাযোগ করিবার প্রচেষ্টাও করিত না। আলো কলেজে ভর্তি হইবার পর রাহেলার বাসায় কালে ভাদ্রে বেড়াইতে যাইত। কোন ভাবেই রবি তাহার সহিত যোগাযোগ করিতে পারিল না। মাসছয়েক পর গোধূলীবেলায় আলো হঠাৎ রবিকে ফোন করিল। সে আশ্চার্যান্বিত হইয়া ফোন ধরিল। কেমন আছিস? আলো বলিল, যেমনটি রেখেছিস! রবি উত্তর করিল, মিছামিছি দোষ চাপাইয়া কি লাভ? আলো কহিল, জহুরা কি বলেছে না বলেছে সেটা আমাকে বলতে পারতি, আমার সাথে পরামর্শ করতে পারতি। তা না করে অন্য কাওকে বলতে গেলি কেন? রবি কহিল, আমি জানি দিপা তোর পরম বন্ধু। তোর আর তার মধ্যে কোন তফাৎ আমি দেখিনি। ভেবেছিলাম তোর কোন কথা তার নিকট গোপন করা না করা সমান। তাছাড়া যেটা হয়ে গেছে সেটাত অতীত। দিপাকে কথাগুলো বলা ব্যতিত আমারতো কোন দোষ আমি দেখি না। সব কিছু বুঝেও আমার সাথে কথা বলিস না কেন? অভিমান করে আর কতদিন থাকবি? আলো কহিল, কে বলেছে আমি অভিমান করেছি? রবি বলিল, অতীতে কখনোনইতো অভিমান ব্যতিত রাগ করে থাকিসনি! প্রতিউত্তরে আলো কহিল, আগে কখনো রাগ করার মতো কোন কাজ করিসনি তাই।
রবি : তবে ফোন করেছিস কেন?
আলো : খুব খারাপ লাগছিল, তোকেও মনে পড়ছিল তাই।
রবি : আমার কি মন নেই? আমিওতো ফোন করেছিলাম।
আলো : না, তোর কোন মন নেই, আমার জন্যে কারো কাছে ফোন করে কাওকে বিরক্ত করবি না।
রবি : আচ্ছা, তোর কি খারাপ লাগে না? কথা বলতে ইচ্ছা জাগে না?
আলো : হ্যাঁ, লাগে। ইচ্ছাও জাগে। কিন্তু কোন উপায় নেই।
রবি : তুইও জানিস আমার সাথে কথা না বললে তোর খারাপ লাগে, আমিও জানি তোর সাথে কথা না বললে আমারও খারাপ লাগে। তবে এমন কষ্ট পাওয়ার কি দরকার?
আলো : কষ্ট করিস না!
রবি : তুই কষ্ট করিস কেন? তুই কি আমায় কোনদিন ভুলতে পারবি?
আলো : না।
রবি : তবে এমন ভনিতা করার কি প্রয়োজন?
আলো : আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
রবি : ঠিক আছে, তবে ফোন রাখ্?
আলোও কহিল তুই রাখ্! কেহই ফোন রাখিতে পারিল না। এভাবে দুই এক কথায় সাতাইশ মিনিট কাটিয়া গিয়াছে কেহই ঠাহর করিল না। আটাইশ মিনিটে গিয়া কাহারো মুখ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। তাহারা নিস্তব্ধ হইয়া গেল। নিরবতায় লগন কাটিতে লাগিল। কেহই কোন অনুভূতি প্রকাশ করিবার কোন আভাস খুঁজিয়া
পাইল না। দুই জন দুই প্রন্তে ফোন কর্ণে চাপিয়া ধরিয়াই রহিল। দুই জনেই অধীরাগ্রহে প্রতিক্ষা করিতে লাগিল কেহ কোন প্রশড়ব করিলেই অন্যজন উত্তর করিবে। কিন্তু কেহই কোন কথা বলিল না। চারিদিকে আঁধার নামিয়া আসিল। পৃথিবীর কোন ক্ষুদ্রতম ধ্বনিও তাহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল না। দুই জনই প্রতীক্ষায় ছিল, কেহ কোন প্রশড়ব করিলেই আর একটু কথা বলিবে। খুব অভিমানে কেহই তাহা করিল না। সূর্য্য অস্তমিত হইল, রবি আর বিকিরণ ঘটাইল না। আলোর আলোক রশ্মিও রবির সরলতার পথ খুঁজিল না। হিয়ার পরশে হিয়া বিগলিত হইলেও পরম্পরায় বিমুখ হইয়া রহিল। প্রীতি ও বিরহের হিসাব এক কিন্তু ইহার সাধ বহুতর তফাৎ হইলেও ইহার ফারাক খুঁজিয়া পাইল না। কাছে থাকিলেও যে ভালোবাসা হয় না অশ্রুও ঝড়ে, তাহাই কেবল অনুভব হইতে লাগিল।
সমাপ্ত
গল্পগুচ্ছ
সম্পাদনায় : মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
প্রকাশকাল : একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩ ইং
ভিন্নমাত্রা প্রকাশনী
হিয়ার পরশ
[email protected]
মনুষ্য জাতির প্রত্যেকেই অন্তিমকাল সমাগম হইলে ভাবিয়া থাকে যে, জীবনটা যাদি ধপাস করিয়া থামিয়া না গিয়া চিরকালের জন্য স্থির হইত। তাহাতে দিনগুলি সুন্দরতরভাবে কাটিয়া যাইত। কিন্তু চিরন্তন সত্য হইল সকল জীবের সম্মুখে একদিন মৃত্যুদূত হাতছানি দিয়া থাকে। মেট্টিক পরীক্ষা শেষ। ভাবিতেছিল কি করিবে এখন, ভর্তিই বা হইবে কোথায়। সম্মুখে অনেকটা পথ চলিতে বাকি রহিয়াছে। আশা তাহার মস্তবড়। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হইবার প্রবলাভিলাস বহিতেছিল মনোমধ্যে। কিন্তু সে যে মানবিক বিভাগে পড়িয়াছে তাহা সে ঠাহর করে নাই। কেহই তাহাকে এই তথ্যটা জানাইয়াও দেয় নাই। হতবম্ব হইয়া নানাবিধ ভাবনয়া নিমগড়ব।
তাহার ভগিড়বর শশুরের এক পুত্রবধু রাহেলা। বড় শিক্ষিতা এম. এ পাশ করিয়া ঢাকায় শিক্ষকতা করিতেছে। তাহার নিকট সঠিক পরামর্শ পাইবে। রবির বাবার আশা নয় দীর্ঘ বিশ্বাস। রবির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল রাহেলার।
রাহেলা খুব উদার মনের মানুষ ইহা রবি পূর্ব হইতেই অবগত। তাহার প্রতি সম্মানের কোন ঘাটতি ছিল না রবির। তাহার সকল প্রকার যোগাযোগ চিঠিপত্র, মানি অর্ডার, রবির ইশকুলের ঠিকানায় পাঠাইত। রবির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হইবার পর রাহেলা জানায়, তাহাকে ঢাকাস্থ কোন কলেজে ভর্তি করাইবে। একথা শ্রবণমাত্রই রবি ভাবিল, কোন দিন একা কোন আত্মিয়ের বাড়ি গিয়া একরাত্রিও যাপন কনে নাই আর অতদূর কিভাবে সম্ভবপর হইবে। তাহার শহরে ভর্তির ব্যাপারে রাহেলা যতটা ভাবিল, তাহার পতি জহির তাহার অর্ধেকাংশও ভাবিল না। অবশেষে রবিকে শহরেই ভর্তি হইতে হইল। সকলের উৎসাহে জহিরের বাসায় অবস্থা করিতে হইল, তবে জহিরের কিছু শর্তাবলম্বনে। জীবনের সূচনালগেড়বই একটু খানি ত্যাগ স্বীকার করিয়া অবস্থান করিতে হইল। শহরে জীবনের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। সে মোটামুটি চঞ্চল প্রকৃতির বটে কিন্তু অচিনপুরে প্রবিষ্ট হইবার পর অন্তপুরভেদ করিবার প্রচেষ্টাও করিল না। রবির বাড়ির আর্থিকাবস্থা অসচ্ছল হওয়াই তাহাকে টিউশনি লইতে হইল। যেই ছেলেটি গ্রাম্য পরিবেশে চাঞ্চল্য, প্রফুল্ল আর আনন্দমুখর ছিল, সে কি না আজ নিরব নিস্তব্ধ, নিরুপায়। তাহাকে কেন জানি আনমনা বোধ হইতে লাগিল। তাহার নিকট কেবল একটি কথায় বারংবার বোধ হইতো তাহাকে যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিতে হইতেছে। জহিরের কর্কটময় কথা আর রাহেলার ¯েড়বহের তফাৎ খুঁজিয়া পাইলেও তাহার কিছুই করিবার নাই। রবি যখন অত্যন্ত ছোট তখন কেহ যদি তাহাকে জিজ্ঞাসিত বড় হইয়া কি কর্ম করিবে? তথাপি প্রতিউত্তর করিয়া কহিত, “বড় হয়ে অনেক বড়রকমের চাকরি করব, পয়লা মাসের বেতন দিয়া মায়ের জন্য একখানি শাড়ি আর একটি বোয়াল মাছ কিনব।” তাহার এইসব কথারর অর্থ সে বুঝিত না। শহরে আসিবর পর সে খুব একাকিত্ববোধ করিত আর সেই ছোট্টবেলার কথা মনে করিয়া আনন্দ করিত। কত সময় যে তাহার মাতৃকে তাহার গুরুত্বপূর্ণ
কার্যে বিরক্ত করিয়াছে, অঞ্চল ধরিয়া পাছে পাছে ছুটিতো আর কহিত, কয়টা চাউল আর কাঁঠালের বিচি ভাজিয়া দিতে। মাও সমস্ত কর্ম ফেলিয়া রাখিয়া তাহার আবদার মিটাইত। অনড়ব মাখাইয়া দিয়া এক লোকমা না খাইলে রবি তাহাতে স্পর্শ পর্যন্ত করিত না। অন্যদিকে বাবার আদরমাখা শাসন। এইসব ভাবিয়া ভাবিয়া স্থির করিল পয়লা মাসের মাইনে পাইয়াই বাড়ি যাইবে। জহিরের নিকট বাড়ি যাইবার প্রস্তাব করিলে সে কহিল, এইত সেদিন এলে, এখনি বাড়ির প্রয়োজন কেন? টাকা বড় বেশি হয়ে গেছে? রবি কোন উত্তর করিল না। নিশ্চুপ হইয় রহিল। রবির মনের খবর বুঝিতে পাইয়া রাহেলা জহিরকে বুঝাইয়া বাড়ি যাইবার ব্যবস্থা করিল। পথিমধ্যে ভাবিল তাহার মাতার জন্য কিছু কিনিয়া লইবে। আবার ভাবিল, এই টাকাতো চাকরির নয়। তাছাড়া খরচাদি বাদে অত টাকাও নাই, যা দিয়া কাপড় আর বোয়াল মাছ কিনিয়া লইবে। বাড়ি হইতে ফিরিবার পূর্বে বাবার জন্যে একাজোড়া সেন্ডেল কিনিয়া দিল। তজ্জন্যে রবির পিতা-মাতার অন্তর ভরিয়া গেল। পুত্রের চক্ষু ফুটিয়াছে, নিজের খরচ যোগাইতে সক্ষম। কিন্তু এদিকে জহিরের অন্তরটা শুকাইয়া গিয়াছে। টিউশনীর সমস্ত টাকার হিসাব চাহিতে গিয়া যখন শনিতে পাইল, বাবাকে সেন্ডেল কিনিয়া দিয়াছে, সঙ্গে-সঙ্গেই অবশিষ্ট টাকা অদূরে ছুড়িয়া মারিল। বলিয়া রাখিল, পরবর্তী মাসের পুরোটাই তাহার হস্তে প্রদান করিতে হইবে। অন্যথায় তাহার
কপালে শনির দশা আছে। রাহেলা রবিকে খুব ¯েড়বহ করিত। রাহেলা কষ্ট পাইবে ভাবিয়া তাহার নিকট মর্মচ্ছেদি অনেক কথাই গোপন রাখিত। তথাপিও রাহেলার বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, রবি তাহাদের মধ্যে জহিরের নিকট একটি বুঝামাত্র। কিন্তু কিছুই করিবার নাই রাহেলার। নির্বাক শ্রোতার ভূমিকাই পালন করিতে হইত। কলেজ
হইতে ফিরিবার পর মধ্যাহ্নভোজ অতপর বিশ্রাম। তাহার পর সন্ধ্যাবধি টিউশনী আর ঘুরিয়া ফিরিবার সময়।
রাহেলা তাহাকে সময় দেবার মত কোন সুয়োগ পাইত না। কারণ, সে ইশকুল হইতে ফিরিবার পর ব্যাচাকারে স্তরে-স্তরে ছাত্রী পড়াইত। রাহেলার সহিত তাহার ছাত্রীদিগের বন্ধুশুলভ সম্পর্ক হইয় থাকে।
রোজকার মত রবি আজি বিকালেও বাহিরে। কিন্তু শরীরটা বড় খারাপ অনুভব করায় বাসায় ফিরিয়া আসিল। তাহার কক্ষে দৃষ্টিগোচর করিতেই দেখিতে পাইল, গোটাকয়েক নব যৌবনা হাঁড়ি পাতিলে অন্বেষণ করিতেছ রাহেলা কি রন্ধন করিয়াছে তাহা দেখিবার জন্যে। আজ অন্যান্য তরকারীর সহিত ঢেঁড়স ভাজিও ছিল। তাহা মুখে লইবার ভঙ্গিতেই রবিকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। হতভম্ব হইয়া সংকোচে কড়ায়ের ঢাকনা প্রতিস্থাপন করিতেই
ধপাস করিয়া পড়িয়া বিকট এক আওয়াজ হইল। ভিতর হইতে রাহেলা জিজ্ঞাসিল, কি হয়েছে? প্রতিউত্তরে একজন কহিল, কিছুই না ম্যাডাম। এক এক করিয়া সকলেই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। এদিকে অপেক্ষমান রাবি তাহার কক্ষ খালি পাইয়া চৌপায়ার নিকট বসিতেই শুনিতে পাইল, কেহ একজন ফিস ফিস করিয়া রাহেলাকে
বলিল, ‘আমনের বাই আইছে।’ কথাটি নিশ্চত করিবার জন্যে রাহেলা দুই কদম অগ্রসর হইয়া কহিল, রবি, তোমার কি শরীর খারাপ? রবি কহিল, তেমন কিছু না। রাহেলা কহিল, একটু বিশ্রাম কর ঠিক হয়ে যাবে। তাহার কক্ষটি ছিল বেলকুনিতে। কপাটের উত্তর পার্শ্বে এক খানি খাটিয়া, তাহার পূর্বদিকে পড়িবার জন্যে চৌপায়া,
অন্যপ্রান্তে হাঁড়ি পাতিল রাখিবার একখানি তাক। রবি, তাহার সাধ্যমত শারীরিক পরিপাটি করিলেও তাহার গৃহের কোন যতন করিত না। সমস্ত কিছুই অগুছালো আওলা-ঝাওলা থাকিত। পুস্তকাদির কথা বলিতে গেলে বলিতে হয়, খাটিয়া অপেক্ষা টেবিল অধিকতর অগুছালো। পুস্তক খাটিয়াইও পড়িয়া থাকিত। একদা গোধূলী লগনে রবি বাসায় ফিরিয়া প্রত্যেক্ষ করিল, তাহার গৃহের সমস্ত কিছুই সুসজ্জিত না হইলেও কাপড়, পুস্তকাদি যথাস্থানে রাখিবার ফলে কক্ষের শ্রী বৃদ্ধি পাইয়াছে। তাহার চিত্ত হরষিত হইয়া উঠিল। রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিতে হইলে সর্বাগ্রে রবির
কক্ষ অতিক্রম করিতে হয়। এক ব্যাচ চলিতে থাকিলে অন্য এক ব্যাচকে রবির কক্ষে অপেক্ষা করিতে হইত। প্রতিদিনের মত ছাত্রীদল গৃহে প্রবেশ করিলেই রবি প্রস্থান করিল। গোটাকায়েক টিউশনী করিয়া বাসায় ফিরিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া ঘুরিবার জন্য বাহির হইত। যথারীতি বাসায় ফিরিয়া দেখিতে পাইল তাহার কক্ষ পরিপক্ব হস্তের ছোঁয়ায় সংরক্ষিত। গতদিন অপেক্ষা চাকচিক্যমন্ডিত। তাহার একটি অভ্যাস ছিল কোথাও বাহির হইলেই এক খানি লেখনি আর আর এক খানি পকেটপ্যাড সঙ্গে লইত। প্যাডখানি যেথায় রাখিয়াছিল হেথায় খুঁজিয়া পাইল না। রাহেলাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসিল ‘প্যাড কোথায়?’ কিন্তু সে তাহার কিছুই বলিতে পারিল না। পশ্চাৎপদ করিল। ছাত্রীদের আলাপচারিতা আর রাহেলার গমন ভঙ্গিতে বুঝিতে পাইল, রাহেলা তাহার কক্ষ শোভিত করিয়া রাখে
নাই। ক্ষণপর রাহেলা যখন পূনরায় আগমন করিয়া কহিল, টেবিলের ড্রয়ারের ডান কোণায়, তথাপি রবির আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, রাহেলা ব্যতিত অন্য কেহ তাহার কক্ষের শোভাবর্ধন করিয়াছে। নিত্যদিন কে এমন সুন্দর করিয়া সুসজ্জিত রাখে তাহা জানিবার বাসনা রবির মনোমধ্যে তীব্রতর হইতে লাগিল। তজ্জন্যেই আজিকে বিলম্ব করিয়া বাহির হইবার ইচ্ছাপোষণ করিল। দশম শ্রেণীর ছাত্রীবিৃন্দ হাজির। সালাম করিয়া গৃহে প্রবেশ
করিল। রবির কক্ষে অপেক্ষমান থাকিতে হইল। রবি জিজ্ঞাসিল, আপনারা কেমন আছেন? সকলেই বলিয়া উঠিল, ভাল। তাহাকেও জিজ্ঞাসিল, আপনি? রবিও যথার্থই কহিল। রবি আপনার পরিচয় প্রকাশ করিবার জন্য বলিল, আমার নাম র..। বলিতেই একজন বলিয়া উঠিল, আমনের নাম ‘রবি’। আমনে ম্যাডামের বাই। রবি কহিল, তবে আপনাদের পরিচয়টা? প্রত্যেকেই স্ব-স্ব নাম যথাμমে বলিতে লাগিল, দিপা, আনিকা, নাজু, আলো, শিমু ইত্যাদি।
রবি কহিল একটি কথা জানতে বড় ইচ্ছা করছে বলবেন কি? আমার জন্য প্রতিদিন কষ্ট করে ঘর গুছিয়ে থাকে কে? আলো বলিয়া উঠিল, আমরা সবাই। রবি তাহার প্রশেড়বর সঠিক জবাব না পাইয়াও পূনরায় জিজ্ঞাসা করিল না। বৃহস্পতিবার ও শুμবার রাহেলা কাওকেই পড়াইত না। এমন ছুটির দিনে দশম শ্রেণীর সকলে না আসিলেও আলো, দিপা ও আনিকা পুস্তকবিহীন আসিয়া খোস গল্প করিত। রাহেলা প্রকৃতই প্রকৃতি প্রেমিক। কোন অবকাশ
পাইলেই ঘনিষ্ট ছাত্রীদের লইয়া বেড়াইতে যাইত। তেমনি এক বৃহস্পতিবার বৈকালে রবিসহ সকলে মিলিয়া পাশের নদী পাড়ি দিয়া ওপারের কাঁশফুল উপভোগ করিতে গেল। সন্ধ্যাবধি হাঁটিয়া ক্লান্ত হইলে হিজল গাছের তলায় স্বস্থিতে ক্ষণিক বসিল। প্রত্যেকেই আপন আপন পরিধেয় বস্ত্রের পানে চাহিয়া প্রত্যেক্ষ করিল একপ্রকার উদ্ভিদের কাঁটা তড়িতাকর্ষণে বস্ত্রের বুনোনিতে আশ্রয় করিয়া লইয়াছে। হাঁটু হইতে গোড়ালী পর্যন্ত ইঞ্চি পরিমাণ
জায়গাও কেহই ফাঁকা পাইল না। রবি ইহার নাম জিজ্ঞাসা করিলে রাহেলা সঠিক উত্তর করিতে পারিল না। আলো কহিয়া দিল, “প্রেমকাঁটা”। রবি প্রতিউত্তর করিল, প্রেম না করিতেই প্রেমের কাঁটা বিধিল কিভাবে? সূর্য্য অস্তগামী হইলে তাহারা ফিরতি পথে নৌাকায় চড়িল। নদীর সমস্ত জল আকাশের প্রতিচ্ছায়ায় সোনালী রঙ ধারণ করিয়াছে। আলো কৌতুহলে ওই জলস্পর্শ করিয়া নায়ের আগা হইতে গোড়া পর্যন্ত ছিটাইয়া দিয়া সহাস্যে চিৎকার
করিয়া উঠিল। ইহা ঠাহর করিল না যে, তাহার ছিটানো পানির অর্ধেকাংশই রবির উপর পতিত হইয়াছে। বাসায়গমনপূর্বক রবির পরিধেয় বস্ত্র পরিবর্তণ করিয়া খাটিয়ায় রাখিয়া দিয়া মনে মনে ভাবিয়া রাখিল আগামীকাল ইহা বস্ত্র হইতে পৃক করিবে। রবি সর্বদায় বোতল হইতে পানি পান করিয়া থাকে। রাহেলার কক্ষ হইতে বোতল আনয়ণ করিয়া দেখিতে পাইল, আলো দিপা ও আনিকা তাহার বস্ত্র হইতে প্রেমকাঁটা অপসারণ কার্যে লিপ্ত। রবি অবাক হইয়া কহিল, আপনারা এসব করছেন কেন? আলো উত্তর করিল, আপনি একা সবগুলো শেষ করতে পারবেন না তাই। রবি কহিল, এপর্যন্তই রাখেন, বাকি সব আমি..। না ধরেছি যেহেতু শেষ করেই চাড়ব। রবি প্রতিউত্তর না করিয়া বোতলের সিপি খুলিয়া পানি পান করিতে আরম্ভ করিল। আলো কহিল তৃষ্ণা কি শুধু আপনার একার নাকি আমাদেরও আছে? তাহাদের উদ্দেশ্যে না আনিলেও কিঞ্চিতবিলম্ব না করিয়া বলিয়া দিল, এই পানিপূর্ণ বোতল সকলের জন্যই এনেছি যাতে সবার তৃষ্ণা নিবারণ হয়। বোতল হস্তান্তর করিয়া সিপি দিয়া খেলা করিতে লাগিল। তাহার এ হাত ও হাত, উপরে নিচে ঘুরাইতে লাগিল। বোতলের সিপিকে এই অঞ্চলের লোকেরা ‘মোক্ষা’ বলিয়া অভিহিত কলিয়া থাকে। দীর্ঘদিন ধরিয়া এমন বোতলের মোক্ষা লইয়া খেলা করা দেখিয়া রবিকে প্রয়ই
বলিত আপনার মোক্ষা কই? রবি কোন উত্তর না করিয়া মৃদু হাস্যে সাঁই দিয়া থাকিত। আজ রাহেলা স্বীয় কোন প্রোয়োজনে বাহিরে গিয়াছে। যাইবার পূর্বে রবিকে বলিয়া গিয়াছে, ছাত্রীরা এলে ফিরাইয়া দিতে। ছাত্রীরা ইহা শ্রবণমাত্রই গোলাকার হইয়া বসিয়া রবিকে ডাকিয়া কহিল, আমাদের মাঝে এখন একটি গান পনিবেশন করবেন মোক্ষা ভাই। রবি তাহার সাধ্যমত পাশকাটাইয়া গান গাওয়া হইতে মুক্তি পাইল। তাহারা সকলে মিলিয়া রবিকে তাহাদের বন্ধুত্বের উচ্চ শিখরে বসাইয়া অন্তরঙ্গ করিয়া লইয়াছে। ইহা রবি ঠাহর করিতে পারে নাই। কোনদিন যদি রবি বাসায় ফিরিতে বিলম্ব করিত, তথাপি তাহার আগমনপূর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করিত। আর তাহার খাতা নাড়িয়া চাড়িয়া কোথাও বানানের কোন ভূল পাইলে তাহা বৃত্তাকার করিয়া রাখিত। রবি ফিরিলেই তাহা দেখাইয়া কহিত, মোক্ষা বাই, এই বানানের সঠিকটা দেখিয়া লইবেন। আলো ইহা বিশেষভাবে করিত। এইসব রবির কল্যাণের জন্য তাহা সে অনুভব করিল। রবিও তাহাদিগকে আপন করিয়া লইল। পূর্ব হইতেই যদি আলো কখনো অবগত হইত যে, আজ বিকালে সে তাহার কোন সমস্যার কারণে রাহেলার নিকট পড়িতে যাইতে পারিবে না। তাহা হইলে ইশকুলের কোন ক্লাসের ফাঁকে নতুবা ক্লাস বাদ দিয়ে হইলেও রবির কক্ষে গিয়া তাহার সমস্ত কিছু পরিপাটি করিয়া আসিত। আলোর পিত্রালয় এই শহর হইতে বহুμোশ পশ্চিমে। তাহার পিতৃবিয়োগ হইবার পর আবাল্যকাল জহুরাদের বাড়িতে ভাড়ায় অবস্থান করিয়া আসিতেছে। জহুরা আর আলো ছোট বেলার খুব ভাল বন্ধু। তাহারা পরস্পরে একই শ্রেণীতে অধ্যায়ণ করিত। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইবার পর বিষেশ কোন কারণবশত তাহাকে পড়াশোনা হইতে ইস্তফা দিতে হইয়াছে। জহুরার সম্পর্কে আলো রবিকে পূর্বেই অবহিত করিয়াছে। রবিকে সকলেই তাহাদের বাড়িতে লইয়া যাইত এবং যথেষ্ট কদর করিত। তাহাদের প্রতি অনুরাগি হইয়া রবির পদ্য রচণার প্রবনতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। নুতন কোন কবিতা রচিলেই সন্ধ্যাকালীণ কোন সময়ে আলো অথবা দিপার বাড়ি গিয়া শোনাইত। দিপা শ্যামা মেয়ে। সে বোধ করিত ইহা তাহার জন্য
খুবই লজ্জাকর একটি বিষয়। সে খুবই সংকোচে লোকসম্মুখে আত্মপ্রকাশ করিত। কিন্তু তাহার ভিতর যে চাঞ্চল্যতা, বিচক্ষণতা, তিক্ষèমেধা আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা সো ঠাহর করিতে পারিলেও আত্মতৃপ্তি পাইত না। রবি এবং তাহাদের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠতার দরুণ ‘তুই’ সম্মোধন করিয়া পরস্পরে পরিতৃপ্ত হইত।
রাহেলার কক্ষে সকলেই পড়িতেছিল। রবি তাহার কক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া দিপাকে ডাকিল। দিপাও সিডরের ন্যায় আগমনপূর্বক তাহার অঞ্চল খানি চঞ্চল করিয়া টানিয়া শাহাদাত আঙ্গুলের অগ্রভাগে পেঁচাইয়া দুই পাটিদন্তে টিবুনী দিয়া লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করিয়া কহিল, মোক্ষা বাই আমার জন্য কিছু আনছস্? রবি কহিল, না এমনিতেই। দিপা সমস্ত ভঙ্গিমা ত্যাগিয়া গম্ভির বদনে কহিল, তাইলে ক কিজন্য ডাকছস্? রবি কহিল তোদের জন্য চানাচুর এনেছি। দিপা সহাস্যে কহিল, কি প্রয়োজন ছিল এইসব করার। আমরা কি আনতে বলেছি নাকি? রবিও তাহার ছলনা বুঝিতে পাইয়া কহিল, তবে থাক্ যেইদি চাইবি সেইদিন না হয় দিব? অমনি খপ্ করিয়া তাহার হস্ত হইতে ছুটাইয়া লইয়া রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া সকলকে দেখাইয়া কহিল, মোক্ষা বাই আমারে চানাচুর দিছে।
সকলেই তাহার হস্ত হইতে কাড়াকাড়ি করিয়া লইয় খাইতে শরু করিল। দিপা রবির কক্ষে পূনগমন করিয়া কহিল, আমার চানাচুর সব নিয়া নিছে। রবি জিজ্ঞাসা করিল, চানাচুর সব তোর ছিল? দিপা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। রবি বলিল, চিন্তা করিস্ না তোকে আরও ভাল কিছু দিমু। দিপা কহিল, সত্যিই দিবা বাই? হুঁ। কি দিবা কও..। কহিয়াই রবির স্কন্ধদেশে মৃদু টিপুনি দিয়া কহিল, ক... না বাই কি দিবি? কিয়দক্ষণ ভাবিয়া কহিল, তোরে অনেক সুন্দর একজন পাত্রের নিকট পাত্রস্থকরব। দিপা তাহার চঞ্চলতা প্রকাশ করিয়া কহিল, সত্যি কইতাছস্ বাই? হুঁ, সত্যি। বুঝিস্ কইলাম। কহিয়াই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া পড়ায় মনোনিবেশ করিল। এমনই মজার মানুষ দিপা। রবি, দিপার আসল রূপ লইয়া এবং তাহার চাঞ্চল্যতার স্বরূপ এক খানি কবিতা রচনা করিয়া এক সন্ধ্যায় দিপার বাড়ি হাজির হইল। দিপা সমস্ত কর্ম ত্যাগিয়া আপ্যায়ণের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। রবি তাহাকে ডাকিয়া কহিল, আগে আমার কবিতা শুনবি পরে খাব। নতুবা খাব না। পা গুটাইয়া বসিয়া কহিল, আবৃত্তি করেন জনাব। আবৃত্তি শরু হইল আর দিপা ভাবিতে লাগিল কি পরিবেষণ করিবে। কিছুক্ষণ পর যখন আবছা আবছা বুঝিতে
পাইল কবিতায় তাহারই গুণকীর্তন করা হইতেছে, তখন সে পুরোপুরি মনোনিবেশ করিয়া অবশিষ্ট সমস্তই শ্রবণ করিয়া বলিল, মিছামিছি প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দা করাই ভাল। কিন্তু তাহার ভগিড়ব নাজু কবিতার অর্থ বুজিতে পাইয়া রবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
জহুরার সহিত আলো তাহার আনন্দ বেদনা ভাগা ভাগি করিয়া লইত। ইদানিং আলোর চঞ্চলতার পরিধি বৃদ্ধি পাইয়াছে। জহুরা বাড়িতে বসিয়াই কুটির শিল্পের কর্ম করিত। তাহার সহিত আলোর উঠা বসার দরুণ আলোর হস্তদ্বয় আরো পরিপক্ব হইয়াছে। একদা সন্ধ্যায় রবিকে আলো তাহাদের বাসায় লইয়া তাহার মাতা এবং জহুরার সহিত পরিচয় পর্ব সূচনালগেড়বই সমাপ্ত করিল। আলো আম্রাচার বাহির করিয়া খাইতে লাগিল আর কহিল, মোক্ষা, খাবি? রবি হস্ত প্রসারিত করিতেই আলো কহিল, এটা তোর জন্য নয়, এটা খাইলে দাঁত টক হয়ে যাবে, তুই ভাত খাইতে পারবি না। তোর জন্য শুটকি ভর্তা বানিয়ে রেখেছি। রবি জহুরাকে জিজ্ঞাসিল, আপনি এখন অবসর অথচ পড়া লেখা বাদ দিয়েছেন কেন? জহুরা উত্তর করিল, সে অনেক কথা, অন্যদিন বলব। আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, জহুরা বলিল। জহুরার কথা শ্রবণে রবি আশ্চার্যান্বিত হইলে জহুরা কহিল, আলো সারাক্ষণ আপনার কথাই বলে। তাই খুবই ইচ্ছে ছিল আপনাকে দেখার। রবি খাইতেছিল এমতাবস্থায় আলো পাশের কোঠা হইতে একখানি শ্বেত কাপড়ের ফতুয়া হস্তশিল্পের উপকরণাদিসহ আসিয়া কহিল, মোক্ষারে.... ফতুয়াটা কেমন হয়েছে দেখত। ফতুয়ার গঠন সুন্দর এবং ইহার উপরিভাগ হইতে নি¤ড়ববধি কারুকার্যের যেই রেখা বহিয়া গিয়াছে
তাহাও সুন্দরতম নকশা। রবি বলিল, এটা কার জন্য? আলো উত্তর করিল, একজন কাছের মানুষকে দিব। এমন প্রসস্ত ললাট কাহার তাহা জানিবার জন্য দ্বিতীয়বার রবি প্রশড়ব করিল না। এমন নিপুন হস্তের লাবণ্যম-িত কারুকার্য্য, পরিপক্ব হস্তের শুটকি ভরতা, প্রতিদিনের ঘর গুছিয়ে দেওয়া, রবির হস্তলেখার প্রতি যতড়ব নেয়া এবং তাহার প্রেরণা যোগানো এতসব গুণের আধার এই আলো। রবি তাহাকে প্রশংসা করিবার মতো কোন ভাষা না খুঁজিয়া পাইয়া কহিল, তুই একটা “আমড়া কাঠের ঢেঁকি” জহুরা কহিল, কেন? রবি কহিল এই ফতুয়া পর্যন্তই শেষ ওর দ্বারা আর কিছুই হবে না। আপনি নাকি ইতোপূর্বেও বলেছিলেন তাকে দ্বারা আর কিছুই হবে না, তারপরওতো ফতুয়া হইতেছে। রবি কহিল, আলো তাহার প্রতিটি কর্মের জন্য প্রশংসার দাবিদার। তাকে প্রশংসা করে তার
গুণাবলি নশ্বর করতে চাই না। ইহার পর রবির জন্মদিন বা কোনা উৎসব ব্যতিতও যদি কোন উপহার প্রদান করিত তবে তাহার গয়ে লিখিয়া দিত ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’।
তাহাদের বান্ধবি সকলের বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হইয়াছে দিপা এবং আলো। বোধ হয় একই অনুতে দুইটি অঙ্গ গাাঁ, একজন অন্যজন ব্যতিত কেহই স্বস্থিবোধ করিত না। রবির মনোমধ্যে যে হাহাকারের ক্ষত ছিল তাহারা সকলে মিলিয়া মুছিয়া দিয়া পর্যাপ্ত আনন্দ ঢালিয়া দিয়াছে। সকলের সহিত রবির মেলামেশার কারণে রাহেলা বা জহির কেহই তাহাকে কোন প্রকার সন্দেহ বা বারণ করিত না। তাহারাও বুঝিয়াছিল যে, ইহারা খুব ভালো বন্ধু। রবির হাতের লেখায় বানানের যেই ভুল সাধিত হইত তাহা নিরসনের জন্য যথেষ্ট সচেতন থাকিলেও নির্ভুল হাতের লেখা হইয়া উঠে নাই। আলো প্রতিদিনকার মতো আজিও ভুল বানানগুলো বৃত্তাকার করিয়া চৌপায়ায় রাখিয়া রাহেলার কক্ষে গমন করিয়া রবির দক্ষিণ কর্ণলতি টানিয়া তাহার কক্ষে আনিয়া আঙ্গুলীনির্দেশ করিয়া কহিল, এইসব কবে নাগাদ সঠিক হবে? প্রতিউত্তরে রবি কহিল, আগামিকাল দেখিস্ কোন ভুল পাবি না। আলো বলিল, তোমার প্রতিদিনের আগামীকালতো গত হইতেছে না। পড়ালেখা সমাপ্ত করিয়া গৃহ গুছাইয়া ফিরিবার পূর্বমুহূর্তে রবির নাসিকা তাহার শাহাদাৎ ও বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বারা চাপিয়া ধরিয়া উত্তর দক্ষিণে মৃদু ঝাকুনি দিয়া কপোলে আহ্লাদ মাখা আলতো চড় মারিয়া চলিয়া গেল। ঈদৃশ কার্য নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হইয়া গেল। এমন আসা যাওয়ার মাঝেও রবিকে ফোন করিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে পনসকাননে গিয়া আয়েশ করিয়া কথা বলিত। আলোর নিজস্ব কোন ফোন ছিল না বিধায় জহুরার ফোনে কথা কহিত। রাত্রিযাপনও একই খাটিয়ায় করিত। রবির কোন কর্মে আলো বাঁধা হইয়া দাঁড়াইত না। বরঞ্চ প্রেরণার আশিস হইয়া দাঁড়াইত। গত রাত্রিতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিনড়ব হইয়া গিয়াছিল পুরো মহল্লায়। গৃষ্মের কড়া তাপদাহে কোন গৃহেই টিকিতে পারিতেছিল না কেহই। রবিও মধ্যরাত্তিরে উঠিয়া প্রধান সড়কের নিকট গমন করিয়া ক্লান্ত শরীর খানি জুড়াইতে ছিল আর ভাবিল, আলো, জহুরা সকলে মিলিয়া হইতবা গল্প করিতেছে, নয়ত এই প্রচ- গরমে নিদ্রা যাওয়া সম্ভবপর নয়। জহুরাকে ফোন করিল, আলোও ভবিতেছিল তাহাকে ফোন করিবে কিন্তু অধিক রাত্রি হওয়ায় ফোন করিল না। গরমের কথা ভাবিয়া আলো প্রশড়বও করিল না রবি ঘুমায়নি কেন। আলো নিঃসন্দেহে ভাবিয়াই নিয়াছিল রবি তাহার কক্ষেই বিদ্যুৎ অপেক্ষায় কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (ফখরুদ্দিন) কড়া নির্দেশে জরুরী অবস্থা চলিতেছিল। রাত্রি নয়টার পর কেহই রাস্তায় অবস্থান করিতে পারিবে না। কিন্তু যথাপি শুনিল প্রধান সড়কের নিকটে, তথাপি এক মিনিটও বিলম্ব না করিয়া বাসায় ফিরিবার নির্দেশ করিল।
দিন কয়েক পর রোজার মাস। জহির, রাহেলাকে কিছু না জানাইয়াই মোরে মোরে রবির জন্য জাগির বাড়ি খুঁজিতে লাগিল। তাহার পরিকল্পনায় ছিল, রবি ঈদের পর বাড়ি হইতে এলেই তাহাকে জাগির বাড়ি পাঠাইবে। পশ্চিম দক্ষিণ গগনে রমযান মাসের বাঁকা চাঁদ উদয় হইল। সেহ্রী খাওয়ার জন্য আলো রবিকে ফোন করিয়া জাগাইয়া
দিয়া তাহার বাকি কর্ম সমাপ্ত করিল। রবি ফজরের নামাজান্তে লেপ মোড়ি দিয়া ঘুমাইল। ঘন্টাধেক পর রবির ফোন বাজিয়া উঠিল। রবি বলিল, ঢেঁকি’র চোখের পাতায়া কি ঘুম নাই? আলো কহিল, ঘুম পাইতেছিল না তাই তোকেও ঘুমাইতে দিলাম না। এই আমড়া কাঠের ঢেঁকি আর কিছু না পারলেও তোর ঘুম ভাঙ্গাতে পেরেছি। ফোন রাখলেতো ঘুমাবই, রবি কহিল। আলো কহিল, ফোন রাখলেতো! কতক্ষণ কথা বলতে পারবি? সূর্যোদয় পর্যন্ত। তারপর যদি ঘুমাই। না, ঘুমাবি না। কেন? আলো কহিল, আমি যে ঘুমাব না। রবি বলিল, আমার আমারতো ঘুম হবে। না, তুই ঘুমাবি না, পড়বি। রবি বলিল, আচ্ছা। উষালগেড়ব ফোন রাখিবার প্রাক্কালে আলো কহিল, ঘুমাইস্না কইলাম। রবির আর ঘুম পাইল না ঘুমাইবার প্রচেষ্টাও করিল না। সূর্য্য মাথার পর হইতে পশ্চিমাকাশে ঢলিয়া পড়িল আর তাহারা সকলেই পড়িতে উপস্থিত হইল। সকলেই রাহেলাকে আজ অল্প পড়াইতে অনুরোধ করিল। রাহেলাও প্র ম রোজার খাতিরে মঞ্জুর করিল। সকলে বইপত্র গোছাইবার পূর্বেই আলো তাহার সমস্ত কিছু লইয়া রবির কক্ষে গমন করিল। কক্ষটি গুছইয়া রবির নাসিক্য ধরিয়া এদিক ওদিক নাড়িয়া আহ্লাদের চড় দিয়া প্রস্থান করিল। ফজরের নামাজান্তে রবি ভাবিল, আজ আলোকে ঘুমাইতেদিবে না। ফোন করিল। কথোপকথনে তাহাদের হর্ষ বিষাদ একে অপরকে অবহিত করিত। যদ্দারা চিত্ত বিহ্বলে সহমর্মিতা প্রতিস্থাপিত হইল। কতটুকু অন্তরঙ্গ হইলে একজন আর একজনকে প্রত্যেক্ষ করিয়া বা না করিয়া তাহাদের ভিতরকার অবস্থা অনুভব করিতে পারা যায় তাহার সমস্তই তাহারা লব্ধ করিয়া লইয়াছে। প্রভাত হইয়া
গেল। ফোনে কথা বলিতে বলিতে রবি ভাবিল আলোকে না জানাইয়া তাহাদের বাড়ি গিয়া সাক্ষাত করিবে। অন্যদিকে আলোও এমনটি ভাবিল। একে অপরের অজান্তে কথা কহিতে কহিতে অগ্রসর হইতে লগিল। আলোকে ডাহিনে এবং রবিবে বামে মোড় ঘুরিতে হইবে। মধ্যখানে দোকান। মোড় ঘুরিতে আরম্ভ করিল। একে অপরকে
প্রত্যেক্ষ করিবার পূর্বেই তাহাদের ফোনে যে কথাগুলো বাজিতেছিল তাহার আওয়াজ বাস্তবিক হইয়া গেল। হরষে একই সঙ্গে কর্ণ হইতে ফোন নামাইয়া বলিল, তোকে দেখার জন্যই যাইতেছিলাম। ইহা শুধু হিয়ার পরশেই হইয় থাকে। তাহাদের স্বচোক্ষে না দেখিয়া উহা বিচার করিতে কঠিন। দিন কয়েক পর
যথারীতি দূরালাপন আরম্ভ হইল। কিন্তু পূর্ববৎ দীর্ঘ হইল না। রবি কহিল, শরীরটা ভাল না, আজ রাখি বিকালে তুই এলে দেখা হবে। আলো ব্যগ্রকন্ঠে জিজ্ঞাসিল, কি হয়েছে তোর? জ্বর, নাকি মাথা ব্যথা? সেহ্রী খাস নাই? রবি নম্রকন্ঠে উত্তর করিল, ওসব কিছু না। জহির ভাই কি কিছু বলেছে? আলোকে সঠিক তথ্যটি জানাইল না। কি হইয়াছে তাহা জানিবার আগ্রহ বৃদ্ধি পাইতে লগিল। কিঞ্চত বিলম্ব না করিয়া দিপার বাসায় গিয়া তাহাকে কহিল, দিপু মোক্ষার কি জানি হয়েছে। চল্ গিয়ে দেখে আসি। দিপা কহিল, এই রাইতের বেলা? আলো কহিল, তাতে কি কাছেইত মাত্র চার মিনিটের পথ। পনসকানন ভেদ করিয়া রবির দ্বারে হাজির। দরজায় করাঘাত করিতে চাহিয়া করিল না। সকলের ঘুম ভঙ্গিবে বলিয়া। পশ্চাৎগমন করিয়া রবিকে ফোন করিয়া কহিল, বাহির হইতে। রবি বিস্মিত কন্ঠে কহিল, কোথায়? ইশকুল গেইটে। ইশকুল আর রবির বাসা একটি মাত্র বাড়ির ব্যবধান। তাহাদের প্রত্যেক্ষ করিয়া কহিল, তোরা এইখানে? আলো আঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া দিপাকে দেখাইয়া বুঝাইয়া দিল, সে আনিয়াছে। রবি মৃদু হাসিয়া দিপাকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছিস? দিপা উত্তর করিল ভাল না থাকলে কি তোমারে রাইতের বেলা দেখতে আইছি! তোর কি হইছে ওইড্যা ক। রবি আপনাকে সংবরণ করিয়া কহিল, অনেক রাত্রে ঘুমানোর কারণে শরীরটা বড় ক্লান্ত, তাই.....। আলো কহিল, তোর কি হয়েছে সত্যি কইরা ক। রবি বলিল, এই বাসায় হযতবা আমার থাকা হবে না। সামনের মাসে কোন মেসে নয়তবা হোস্টেলে উঠব। কেন? জানিতে চাইলেও কোন উত্তর পাইল না। রবি যেন তাহাদের আগাইয়া দিয়া আসে তজ্জন্যে দিপা কহিল, জানস্ বাই, আমরা আইতেছিলাম আর ওই বাগানে তিনড্যা কাঁঠাল গাছে দুইড্যা ভূত বইসে ছিল। আমাগো দেইখ্যা খাড়াইতে কইছিল। পরেদা আমরা বুদ্ধি কইরা কইলাম, তোমাগো যেই বোতলে বন্দি কইরা রাখমু সেই বোতলের মোক্ষার সমস্যা হইছে মেরামত করেত যাইতেছি। ওমনেই দৌড়ে চইল্যা আইছি। একটু আগাইয়া দে না বাই। আলোও
পার্শ্ব হইতে কহিল হ বাই আয় নয়লে যদি আবার সামনে খাড়ায়।
রোযার শেষার্ধে রবি মনোস্থির করিল পঁচিশ রমযানে বাড়ি যাইবে। তেইশ রমযান তাহারা যথারীতি পড়িতে আসিয়া রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। আলো জহিরকে ডাকিয়া কহিল, আমনের আর ঈদে কেনাকাটা করার প্রয়োজন নাই। বলিয়াই তাহার ব্যাগ হইতে তিনটি কাটা গেঞ্জি বাহির করিয়া তাহার হস্তে প্রদান করিল। তাহার
জন্য একটি, বাকি দুইটি তাহার পুত্রদ্বয়ের জন্য। হস্তদ্বয় পশ্চাদে রাখিয়া রবির কক্ষে গমনপূর্বক কড়া সাশনে কহিল, দাঁড়া। রবিও আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হস্তদ্বয় উপরে তুলিয়া দাঁড়াইল। আজ্ঞা মহারাণী। বলুন কি করিতে হইবে? রবি বলিল। পুনরায় সাশাইয়া কহিল, কাপড় খোল। জামা খুলিয়া প্যান্টের উপর হস্ত রাখিয়া কহিল, এটিও? আলো আঁধারে হাস্যরেখা গোপন করিয়া তাহার হস্তদ্বয় সম্মুখে আনিয়া ফতুয়াটি পরাইয়া দিয়া নাসিক্য
ধরিয়া এদিক ওদিক করিয়া কহিল, এটা তোর জন্যই তিলে হিলে পূর্ণতা দান করেছি। পছন্দ হয়নি? রবি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। কেন? আমার জন্যে এতোদিন ধরে অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিস তাই। আলো কহিল, তোর জন্য কোন কষ্টকেই আমার কষ্ট মনে হয় না। বলিয়াই রাহেলার কক্ষে প্রবেশ করিল। ঈদ পরবর্তী কয়েকদিন বিগত হইবার পর এক পড়ন্তবেলায় জহির রবিকে ডাকিয়া কহিল, তোমার জন্য জাগির বাড়ি ঠিক করে এলাম। সকালের নাস্তা আমার বাসায় করবে। তারা শুধু দুপুরে আর রাত্রে খাওয়াবে। আর রাত্রে এখানেই থাকবে। তাতে তুমি কিছু টাকাও সঞ্চয় করতে পারবে। রবি মাথা নাড়িয়া সায় দিলেও রাহেলা শ্রবণমাত্রই জহিরের সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইয়া গেল। রবি ভবিয়া সিদ্ধান্ত লইতে বিলম্ব করিল না, সে স্থির করিল জগির বাড়ি খাইতে হইলে খাইবে
কিন্তু এই বাড়িতে অবস্থান করিয়া নয়। এদিকে সূর্যাস্তের পর এক মেসে গিয়া কথা পাঁকা করিয়া আসিল। সূর্যোদয় হইল প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করিয়া আসবাবপত্রাদি গুছাইতে লাগিল। রাহেলা নির্বাক শ্রোতা ব্যতিত কিছুই করিতে পারিল না। রবি তাহার নিকট গিয়া কহিল, মানুষ চির জীবন ইচ্ছা করলেও এক সাথে থাকতে পারে না।
প্রয়োজনই তাকে সরিয়ে দেয়। আমি এই ক্ষাণেই থাকবো বেশি দূরে নয়। প্রায়ই আসব। রাহেলা অশ্রুসজল নেত্রে কোনো কথাই কহিতে পারিল না। অধিক শোক তাহাকে গ্রাস করিয়াছে। উত্তাল উর্মির ন্যায় তাহার নয়ণতীর ভাসিয়া লবাণাক্ত জল প্রবল বেগে বহিতে শুরু করিল। রাহেলার আকুতি, তাহার ¯েড়বহ-মমতাকে উপেক্ষা করিয়া রবিকে অচেনা শহরে একটিমাত্র পরিচিত বাড়ি তাহাও ছাড়িতে হইল। অদ্য বৈকালে কেহই রবির কক্ষে অপেক্ষা
না করিয়া রাহোলার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইল, সে সকল কর্ম স্থগিত রাখিয়া শুধুই μন্দন করিতেছে। আজিকে কেহই আর পড়িল না। আলো, রাহেলার গৃহ ত্যাগ করিতেই ভুলিয়া গিয়াছে যে, রবি নাই। প্রতিদিনকার অভ্যাস গড়িয়া উঠায় আজও খাটিয়ায় বসিল। কিন্তু সে গুছাইবে কি? চৌপায়া নাই, খাটিয়াই কোন লুঙ্গী বা অন্য
কোন কাপড় নাই। হঠাৎ মনে পড়িল রবি চলিয়া গিয়াছে। তাহার হৃদয়টা যেন ভাঙ্গিয়া গেল। বাড়ি গিয়া রবিকে ফোন করিয়া সমস্ত খবর লইল। আলোদের মেট্টিক পরীক্ষা সমাগম হইল। রবি বোধ করিল প্রেরণা স্বরূপ পরীক্ষার উপকরণাদি হইলেও কিছু প্রদান করা আবশ্যক। প্র মত, তাহারা রবির খুব ভাল বন্ধু। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকেই রবির সকল কাজের প্রেরণাদানকারিণী। তৃতীয়ত, সেও অনেক প্রীতিজ্ঞাপক উপটৌকন তাহাদের নিকট হইতে পাইয়াছে। সর্বোপরি রবি তাহাদের সকলের শ্রদ্ধেয়। তাহার নিকট অতিরিক্ত কোন টাকাও নাই। আবার কমপক্ষে পনের টাকার প্রতিদিনের প্রাতঃরাশ হোটেলে করিতে হইত। রবির ক্লাসমেড ও রুমমেড শুভ‘র নিকট হইতে অনিদৃষ্টকালের জন্য তিনশত টাকা করজো করিয়া তাহার আত্মসম্মান রক্ষা করিল। ইহা পরিশোধের জন্য প্রাতঃরাশ করিতে আর হোটেলমুখি হইল না বরং রাস্তার মোড়ে চাউলের গুড়ার তিন টাকা দামের গোটা দুই পিঠা খাইয়া দিনাতিপাত করিত। একদিন বৈকালে রবির ফোন বাজিয় উঠিল, কিন্তু অপরিচিত নম্বর। হ্যালো কহিতেই রবির চিনিতে বাকি রহিল না ওই প্রান্তের লোকটি কে। রবি জিজ্ঞসিল এই ফোন কার? আলো কহিল, আমার।
আজই নিলাম এবং প্র ম কলটি তোকে দিয়েই আরম্ভ করলাম। ভেবেছিলাম তোর সাথে একটু মজা করব কিন্তু তা আর হল না। রবি কহিল, আমাকে হঠাৎ গ্রামের বাড়ি যাইতে হইতেছে। কারণ জানতে চাহিলে রবি কহিল, বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে হইতবা। এবছর নাকি আর ঢাকায় ফিরতে দিবে না। আর এখন ফোন করেছে যাবার জন্য। তোদের সাথে এ বছর আর হইতবা দেখা হবে না। আর যদি দেখা না করতে পারি তবে ক্ষমা করিস। আলো তাহার অর্থ ঠিকমত বুঝিতে না পাইয়া দিপাকে সঙ্গে লইয়া তাহার মেসে আগমনপূর্বক প্রশড়ব করিল, কি হয়েছে? রবি কোন উত্তর করিল না। কিছুক্ষণ পর রবি সহাস্যে কহিল, আজ কয় তারিখ? আলো কহিল, ঊনত্রিশ। কি মাস? দিপা কহিল, ডিসেম্বর মাস। রবি কহিল, ডিসেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখে বাড়ি গেলে কোন মা কি জানুয়ারি মাসের আগে ফিরতে দিবে? অমনিতে হাসির ঢল পড়িয়া গেল। আলো কহিল, তাহলে এমন ভয় দেখালি কেন? রবি উত্তর করিল, তোদেরকে দেখার জন্য। সজোরে এক চপেটাঘাত করিয়া আলো বলিয়া উঠিল, এমন ভয় আর কখনোই দেখাবি না। রবির একাকিত্ব সময় বড় বিড়ম্বনার হইয়া পড়িল। তাহার কক্ষে এখন আর কেহই তাহার জন্য অপেক্ষা করে না। নিপুন হতের গৃহসজ্জা আর অপরিপক্ব হাতের গৃহসাজের ফারাক বুঝিল। যখনই বিষণড়বতায়া ভর করিত তথাপি ছুটিয়া যাইত দিপার বাড়ি নয়ত বা আলোর বাড়ি কখনো বা আনিকার বাড়ি আথবা আলোকে ফোন করিয়া শোক তাড়াইত। একদা কাননে বসিয়া রবি ভাবিল, আলোর বাসায় প্রবেশ করিবে কি করিবে না। এমতাবস্থায় আলো বাড়ির বাহির হইয়া রবিকে বলিল, তুই এইখানে কতক্ষণ? কারণ জানিতে চাহিলে আলো কহিল, আমার কেন জানি পনের বিশ মিনিট যাবৎ মনে হইতেছিল, তুই আশেপাশেই কোথাও আছিস। সচরাচর এমনটাই ঘটিত রবি ওই পথ দিয়া হাঁটিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে আসিতেই আলো বাহির হইয়া আসিয়া অপেক্ষা করিত। ইহা কি করিয়া সম্ভব জানিতে চাহিলে আলো কহিল, তুই এই বাড়ির আশে পাশে এলেই আমার বুকের ভিতরটা মৃদু কাঁপিয়া ওঠে। এমনই একদিন আলো বাহির হইল না। রবি অন্তপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইল সে বাসায় নাই। আলোদের বাড়ির নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হইয়াছে। আসবাব পত্র নূতন বাড়িতে লইয়া গিয়াছে। জহুরা তাহাকে নিজের কক্ষে বসাইয়া কুশলাদি বিনিময়ের এক ফাঁকে জিজ্ঞাসিল, আপনি কি আলোকে নিয়া কিছু ভাবেন? রবি বিষয়টি না বুঝিয়া পুনরায় জানিতে চাহিল। জহুরা : আপনাকে নিয়ে সে অনেক কিছুই ভাবে। আপনার কথাই সারাক্ষণ গুনগুন করে। আপনি আশে পাশে এলেই সে বাড়ির বাইরে চলে যায় আপনাকে দেখার জন্য।
রবি : আমিও কয়েকদিন থেকে ভাবি, সে আমার খুব কাছের একজন বন্ধু। তাই তাকে না দেখলে তার সাথেকথা বললে কেন জানি অপূর্ণতা থেকে যায়।
জহুরা : শুধু কি তাই? আপনি তাকে ভালোবাসেন না?
রবি : বাসি তবে প্রেমিকের চোখে নায় বন্ধুর চোখে।
জহুরা : কিন্তু, সেতো আপনাকে ভালোবাসে!
রবি : অসম্ভব!
জহুরা : কেন?
রবি : আমি তাকে অনেক আগেই ভালোবাসতাম যদি তার উপযুক্ত হতাম।
জহুরা : তফাৎতা কোথায়?
রবি : আমি ছেলে মানুষ, সবেমাত্র আই. এ.পাশ। আর সে বিবাহের উপযুক্তা মেট্টিক পাশ। তার ভাল একটা সম্মন্ধ এলেই তাকে বিয়ে দিবে। অন্যদিকে আমি অনার্স-মাষ্টার্স চাকরি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব মিলিয়ে আট দশ বছরের কথা। তাছাড়া আমি ওকে ওভাবে কখনোই ভাবিনি।
জহুরা : এখন ভাবেন! আপনার জন্য না হয় সে অপেক্ষা করবে।
রবি : আমার জন্য অপেক্ষা করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এমন কথোপকথনে রবি দ্বিধান্বিত হইয়া পড়িল। সামান্য স্বস্থি পাইবার জন্য ছুটিয়া গেল দিপার বাড়ি। দিপা তাহাকে দেখিবামাত্রই জিজ্ঞাসিল, কেমন আছিস? তোর আলো কেমন আছে? বলিতেই তাহার রসনা বাহিরে প্রবিষ্ট হইল। আর কহিল, এইড্যা আমি কইতে
চাই নাই হঠাৎ...। কিছু মনে করিস না। রবি হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, তোরা কি আমাদের সন্দেহ করিস? দিপা কহিল, এই যে কান ধরলাম আর কখনো বলব না। তবে মানাবে ভাল। ওই সমস্ত কথা দিপাকে বলিবার ইচ্ছা না থাকিলেও রবি মনোস্থির করিল দিপাকে সমস্তই খুলিয়া বলিবে। বলিলও। কিন্তু কোন সমাধান পাইল না। বরঞ্চ আলোর কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে রবির সহিত কোন প্রকার যোগাযোগ পর্যন্তও করিল না। রবি ফোন করিলেও আলো রিসিভার চাপিয়া কথা বলিল না। অনেকদিনপর পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হইল। রবি তাহার চলনভঙ্গি প্রত্যেক্ষ করিয়া বুঝিতে পাইল আলো তাহার সহিত কথা বলিবে না। তাহাকে পাশকাটাইয়া যাইবে। তথাপিও তাহার সম্মুখে হস্তদ্বয় দুইদিকে প্রশস্ত করিয়া বাঁধা হইয়া দাঁড়াইল। তবুও কোন কথা না কহিয়া পাশকাটাইয়াই চলিয়া
গেল। রবি তাহার এই ব্যক্তিগত নম্বরটিও বন্ধ পাইল। সে আলোর বাড়ি গিয়াও কোন সাড়া পাইল না। রবি পরোক্ষভাবে জানিতে পাইল, আলো তাহার মোবাইল ফোনটি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। কাহারো সহিত কোন প্রকার যোগাযোগ করিবার প্রচেষ্টাও করিত না। আলো কলেজে ভর্তি হইবার পর রাহেলার বাসায় কালে ভাদ্রে বেড়াইতে যাইত। কোন ভাবেই রবি তাহার সহিত যোগাযোগ করিতে পারিল না। মাসছয়েক পর গোধূলীবেলায় আলো হঠাৎ রবিকে ফোন করিল। সে আশ্চার্যান্বিত হইয়া ফোন ধরিল। কেমন আছিস? আলো বলিল, যেমনটি রেখেছিস! রবি উত্তর করিল, মিছামিছি দোষ চাপাইয়া কি লাভ? আলো কহিল, জহুরা কি বলেছে না বলেছে সেটা আমাকে বলতে পারতি, আমার সাথে পরামর্শ করতে পারতি। তা না করে অন্য কাওকে বলতে গেলি কেন? রবি কহিল, আমি জানি দিপা তোর পরম বন্ধু। তোর আর তার মধ্যে কোন তফাৎ আমি দেখিনি। ভেবেছিলাম তোর কোন কথা তার নিকট গোপন করা না করা সমান। তাছাড়া যেটা হয়ে গেছে সেটাত অতীত। দিপাকে কথাগুলো বলা ব্যতিত আমারতো কোন দোষ আমি দেখি না। সব কিছু বুঝেও আমার সাথে কথা বলিস না কেন? অভিমান করে আর কতদিন থাকবি? আলো কহিল, কে বলেছে আমি অভিমান করেছি? রবি বলিল, অতীতে কখনোনইতো অভিমান ব্যতিত রাগ করে থাকিসনি! প্রতিউত্তরে আলো কহিল, আগে কখনো রাগ করার মতো কোন কাজ করিসনি তাই।
রবি : তবে ফোন করেছিস কেন?
আলো : খুব খারাপ লাগছিল, তোকেও মনে পড়ছিল তাই।
রবি : আমার কি মন নেই? আমিওতো ফোন করেছিলাম।
আলো : না, তোর কোন মন নেই, আমার জন্যে কারো কাছে ফোন করে কাওকে বিরক্ত করবি না।
রবি : আচ্ছা, তোর কি খারাপ লাগে না? কথা বলতে ইচ্ছা জাগে না?
আলো : হ্যাঁ, লাগে। ইচ্ছাও জাগে। কিন্তু কোন উপায় নেই।
রবি : তুইও জানিস আমার সাথে কথা না বললে তোর খারাপ লাগে, আমিও জানি তোর সাথে কথা না বললে আমারও খারাপ লাগে। তবে এমন কষ্ট পাওয়ার কি দরকার?
আলো : কষ্ট করিস না!
রবি : তুই কষ্ট করিস কেন? তুই কি আমায় কোনদিন ভুলতে পারবি?
আলো : না।
রবি : তবে এমন ভনিতা করার কি প্রয়োজন?
আলো : আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
রবি : ঠিক আছে, তবে ফোন রাখ্?
আলোও কহিল তুই রাখ্! কেহই ফোন রাখিতে পারিল না। এভাবে দুই এক কথায় সাতাইশ মিনিট কাটিয়া গিয়াছে কেহই ঠাহর করিল না। আটাইশ মিনিটে গিয়া কাহারো মুখ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। তাহারা নিস্তব্ধ হইয়া গেল। নিরবতায় লগন কাটিতে লাগিল। কেহই কোন অনুভূতি প্রকাশ করিবার কোন আভাস খুঁজিয়া
পাইল না। দুই জন দুই প্রন্তে ফোন কর্ণে চাপিয়া ধরিয়াই রহিল। দুই জনেই অধীরাগ্রহে প্রতিক্ষা করিতে লাগিল কেহ কোন প্রশড়ব করিলেই অন্যজন উত্তর করিবে। কিন্তু কেহই কোন কথা বলিল না। চারিদিকে আঁধার নামিয়া আসিল। পৃথিবীর কোন ক্ষুদ্রতম ধ্বনিও তাহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল না। দুই জনই প্রতীক্ষায় ছিল, কেহ কোন প্রশড়ব করিলেই আর একটু কথা বলিবে। খুব অভিমানে কেহই তাহা করিল না। সূর্য্য অস্তমিত হইল, রবি আর বিকিরণ ঘটাইল না। আলোর আলোক রশ্মিও রবির সরলতার পথ খুঁজিল না। হিয়ার পরশে হিয়া বিগলিত হইলেও পরম্পরায় বিমুখ হইয়া রহিল। প্রীতি ও বিরহের হিসাব এক কিন্তু ইহার সাধ বহুতর তফাৎ হইলেও ইহার ফারাক খুঁজিয়া পাইল না। কাছে থাকিলেও যে ভালোবাসা হয় না অশ্রুও ঝড়ে, তাহাই কেবল অনুভব হইতে লাগিল।
সমাপ্ত
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Înšigniã Āvî ০২/০১/২০১৪অসাধারণ...