স্পর্শের অন্তরালে
আমি কলেজের গেইটে ঢোকার আগেই ঘণ্টা পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম, ঢং ঢং ঢং......যাহ, আজ অনেক দেরী হয়ে গেছে। ব্যাগটা কাঁধে টানটান করে চাপিয়ে, বেনী দুটো দুপাশে ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম। করিডোর দিয়ে যেতে যেতেই মোটাসোটা রেবেকা বানুকে হেলেদুলে আসতে দেখলাম। রেবেকা বানু, আমাদের বাংলা টিচার। তার মারকুটে ভাবভঙ্গী আর ফাঁকিবাজি টাইপের টিচিং এর কারণে অনেক স্টুডেন্টই রেবেকা ম্যাডামকে সহ্য করতে পারে না, তাদের মধ্যে আমিও একজন। প্রায় ক্লাসেই তার পড়ার ফাঁকে আমি খুঁত ধরি। আর এই মহৎ কর্মের জন্য উনি আমার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই উনি ক্লাসে ঢোকার আগেই আমাকে ঢুকতে হবে। নইলে আজ উনার ‘কাঁচামরিচের মত কথাবার্তা’র ঝাল পানি খেলেও মিটবেনা। এভাবে শামুকের গতিতে হাঁটলে ম্যাডাম অনায়াসে আমার আগে ক্লাসে ঢুকে যাবেন, আর এরপর... না না, ম্যাডামকে আগে ঢুকতে দেয়া যাবে না, আমিই আগে ঢুকব। হাঁটার বদলে তাই এবার দৌঁড়াতে শুরু করলাম। দূর থেকে আমাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে, রেবেকা ম্যাডামও মনে মনে হয়তবা আমাকে আজ ঝালমুড়ি বানানোর প্ল্যান করছিলেন। একটু পর আমাকে অবাক করে দিয়ে উনারও হাঁটার স্পীড বেড়ে গেল, এক সময় দেখলাম উনিও দৌঁড়াচ্ছেন। কলেজের পিয়ন, বেয়ারা আর অন্যান্য ক্লাসের স্টুডেন্টরা চোখ ডিমের মত করে আমার আর রেবেকা বানুর দৌঁড় প্রতিযোগিতা দেখছে। আমি ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে এক স্লিপে যখন ক্লাসরুমের সামনে, উনি তখনও আমার চেয়ে দুই-তিনহাত দূরে, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছেন। উনার করুণ অবস্থা দেখে দুঃখ করার অবসর পেলাম না, তার আগেই দেরী না করে দৌঁড়ে ভিতরে ঢুকে খালি বেঞ্চ খুঁজতে লাগলাম। হ্যাঁ, ঐ তো, আদিবের পিছনের বেঞ্চটা খালি। দ্রুত যেয়ে ঐ বেঞ্চে বসে পড়লাম। আজকের মত পার পেয়ে গেছি, হিপ হিপ হুররে!
-
“আজ দেরী করলি যে? প্রতিদিন তো দাঁত ব্রাশ না করেই কলেজে চলে আসিস। আজ কি ব্রাশ করতে করতে দেরী হয়ে গেছে?” আদিব দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করল। শুনে পিত্ত জ্বলে গেল আমার। একেই আজ কলেজে ঢুকতেই রেবেকা বানুর সামনে পড়লাম, তার উপর এ আছে আমাকে পঁচানোর তালে।
“না, ব্রাশ প্রতিদিনই করি, আজও করেছি। কারণ, তোর মত হলুদ হলুদ দাঁত বের করে দাঁত কেলানোর আমার অভ্যাস নেই। যা, সামনে তাকা। পিছনে ফিরবিনা আর খবরদার। ফিরলে কলম দিয়ে চোখ ফুটা করে দিব।”
অকস্মাৎ এই আক্রমনে আদিবের মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। কিন্তু এইটুকু একটা মেয়ের কাছে তো দমে থাকা যায়না। ওর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করল হঠাৎ।
“কি রে রশ্মি, তোর জানপাখি, ময়নাপাখি, শকুনপাখি রাফায়েত আজ কলেজে আসল না যে?”
কথাটা বলার সাথে সাথে কাজ হল। আমি ইতিউতি তাকিয়ে, ঘাড়টা বকের মত উঁচিয়ে প্রথম বেঞ্চ থেকে শেষ বেঞ্চ অব্দি খুঁজলাম, রাফায়েত নেই, আসেনি আজ কলেজে। ও তো সচরাচর কলেজ মিস করেনা। তাহলে কী অসুস্থ?
“এই, আমার জানপাখি মানে? আজাইরা কথা বেশি বলিস আজকাল। আর, এই বেয়াদব, তুই ওরে শকুনপাখি বললি কেন? আজকের পর থেকে আর কথা বলবিনা আমার সাথে, মনে থাকে যেন।” এটুকু বলেই মুখ গোঁজ করে বসে থাকলাম। ক্লাস থেকে বের হয়েই ওকে ফোন করতে হবে। ও তো জানে না, ওকে একদিন না দেখলে আমার কেমন অস্থির অস্থির লাগে!
-
অনেকবার রিং দিলাম, ওপাশে কেউ ফোন তুলছেনা। এই নিয়ে তের বার চলছে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ঢুকে প্রথম ওকেই ফোন করেছি। এই শেষ বার, আর দেব না। মন খারাপ করে ডায়াল করলাম রাফায়েতের নাম্বারে। হঠাৎ ফোনটা রিসিভ হল। আমি দ্রুত মোবাইল কানে ঠেকালাম।
“হ্যালো, কে রাফায়েত?”
“না, আমি রাফায়েতের আম্মু। তুমি কে?”
এই মরেছে! এখন আমি কী করি? কেটে দেব, নাকি কথা চালিয়ে যাব? যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসি, কী হবে? আমি তো কখনও ওর আম্মুর সাথে আগে কথা বলিনি। কী করব এখন? আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই উনি বললেন, “মা, তুমি কি ওর ক্লাসমেট?”
“জ্বি আন্টি, আমি আর রাফায়েত একসাথে পড়ি। ও আজ কলেজে আসে নি তো, তাই স্যার-ম্যাডামরা ওর কথা জানতে চাচ্ছিলেন।” উত্তেজনায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইছেনা। তবুও চিঁ চিঁ করতে করতে জবাব দিলাম। আর স্যার-ম্যাডামরা কতটুকু মিস করছে জানি না, তবে আমি ওকে ভীষণ মিস করছি। এটা তো আর আন্টিকে বলা যাবেনা।
“মা, ওর তো আজ সকালে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। বাথরুমে পিছলে পড়ে পা মচকে ফেলেছে। ভেঙ্গে গেছে কি না বুঝতে পারছি না। কপালেও বেশ খানিকটা কেটে গেছে। পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে ওকে আমাদের বাসার দক্ষিনে যে প্রাইভেট হাসপাতাল, সেখানে ভর্তি করে রেখে এসেছি।” কাঁদতে কাঁদতে রাফায়েতের আম্মু কথাগুলো বললেন। আমি চুপচাপ শুনছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, প্রচণ্ড গরমের ভিতর দিয়ে হাঁটছি, আর কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। রাফায়েতের এক্সিডেন্ট! ইচ্ছা করছে বাচ্চা মেয়েদের মত ভেউ ভেউ করে কান্না করি। কিন্তু কাঁদলে তো হবেনা এখন। আমাকে রাফায়েতের কাছে যেতে হবে।
“আন্টি, আংকেল কোথায়? উনি আসেন নি?”
“মা, রাফায়েতের তো আমি ছাড়া আর কেউ নাই।” কান্নার দমকে উনার কথা আটকে যাচ্ছিল। আমার ভেতরটা কেমন যেন অবসন্ন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছি একের পর এক দুঃসংবাদগুলো শুনতে শুনতে। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই!
“আন্টি, হঠাৎ এই সমস্যা হয়ে গেছে, টাকা পয়সার কোনও যোগাড়যন্ত্র হয়েছে?”
“না মা, আমার কাছে যা ছিল, তা দিয়েই আপাতত খরচ করছি। আরও লাগবে কিনা কে জানে। আমি কী করব কিছু বুঝতে পারছিনা।”
“আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি হাসপাতালে যান। আমি বিকালের মধ্যে আসব। একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। ভয় পাবেন না, আল্লাহ সাথে আছেন।”
“ঠিক আছে মা, আমি তাহলে রওনা হই। ছেলেটা আমার একা একা। কী অবস্থা কে জানে। রাখি।”
বিপ বিপ বিপ... ফোন কেটে গেল আর আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কী করব। এত টাকা আমি কোথায় পাব? চাইলেও তো আমাকে দেবেনা মা । সৎ মা হিসেবে উনি যে রুপ আমাকে দেখিয়েছেন, এর পরেও উনার কাছে টাকা চেয়ে বোকামি করার মত বোকাও নই আমি। আর আব্বুর সাথে তো সেই কবে থেকেই দূরত্ব এসে গেছে। উনাকে বলতে যাওয়াও অর্থহীন। কিন্তু এখন আমি কী করি? রুমের ভেতর এই মাথা থেকে ঐ মাথায় পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ একটা আইডিয়া মাথায় এল। কিন্তু, এটা করার পর যে আমার কী হবে, আমি তার কিছু ভাবতে পারছিনা। যাক, যা হওয়ার হোক, এই মুহূর্তে রাফায়েতের জন্য সব জায়েজ আমার কাছে। জামাটা পালটে নিয়ে রুমের বাইরে গেলাম। রুনু, আমার সৎবোন, ও টেবিলে বসে অংক করছে, মায়ের রুম খালি, কেউ নেই। রুনুকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে, কোথায় গেছে আম্মু।
“রুনু, আম্মু কই রে?”
“জান না মনে হয়, আম্মু তিন তলার আন্টির বাসায় প্রতিদিনই তো এই সময়ে যায়।”
“ও আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলে গিয়েছিলাম। রুনু, এক কাজ কর, আমার একটা কলম লাগবে। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তুই নিচ থেকে একটা কলম নিয়ে আয় আপুর জন্য। জলদি যা।” এই বলে ওর সামনে একটা দশ টাকার নোট রেখে দিলাম।
রুনু পেনসিলটা রেখে টাকাটা দুমড়ে মুচড়ে হাতে পুরে, মুখ থমথমে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আর আমি এক দৌঁড়ে আম্মুর রুমে ঢুকলাম। চাবিটা আলমারির উপরেই রাখা আছে। জলদি চাবি দিয়ে আলমারিটা খুলতে লেগে গেলাম, আমার হাত ঠকঠক করে কাঁপছিল। বেশ কিছুক্ষণ গুঁতাগুঁতির পর খুলে গেল। চটজলদি ড্রয়ারে হাত দিলাম খোলার জন্য। টানাটানি করার পরও খুলছে না। কী বিপদ! কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নেমে আসছে। খুলতে পারছি না এই ড্রয়ারটা। ওপাশের ড্রয়ারটা টান দিলাম এবার। তেমন কিছু নেই এখানে। নিচের লকারে অবশ্য আম্মুর গয়নাগাটি থাকে। সেখানে খুঁজতে লাগলাম এবার। এক কোণে কাগজে মোড়ানো একটা স্বর্ণের চেইন দেখতে পেলাম। জলদি সেটাকে পকেটে পুরে আলমারি আটকে দিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে দেখি রুনু দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে, আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি, রুনু দেখে ফেলেছে। কিন্তু, এখন আমার দেরী করার মত সময় নেই। রুনুকে পাশ কাটিয়ে সাত-পাঁচ না চিন্তা করেই ছুট লাগালাম। আমি জানতাম, এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, কিন্তু কতটা ভয়াবহ, সেটার মোটেও আন্দাজ ছিলনা আমার।
-
স্বর্ণের দোকান থেকে টাকাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা রিকশার খোঁজ করতে লাগলাম। আজ কোনও রিকশাও পাচ্ছিনা। অন্যদিন আমাকে রিকশায় চাপিয়ে বয়ে বেড়ানোর জন্য যেন রিকশাওয়ালাদের প্রতিযোগিতা হয়। আজ আর কেউ নেই। দরকারের সময় আসলেই কিছু পাওয়া যায়না। কিছুক্ষণ রিকশার জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটার এক ফাঁকে ঘড়ি দেখে নিলাম। সাড়ে চারটা বাজে। রাফায়েতের কি অবস্থা কে জানে। নানা ভাবনা চিন্তার মধ্য দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে রুম নাম্বার জেনে সোজা দোতলায় চলে গেলাম। দেখলাম, দুইশ বার নাম্বার কেবিনের সামনে এক মহিলা বসে আছেন, ইনিই হয়ত রাফায়েতের আম্মু।
“আন্টি, আমি রশ্মি, দুপুরে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছিল, চিনতে পারছেন?”
“হ্যাঁ, মা, আমার ছেলেটার কি হবে?” বলেই আন্টি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে শিশুদের মত কাঁদতে লাগলেন। প্রচন্ড দুঃখবোধ হলে কি শিশু শিশু ভাব প্রবল হয়ে ওঠে? হতে পারে! আমিও উনাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আমার মা’কে আমি জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাইনি, আমার জন্মের সাথে সাথেই উনার মৃত্যু হয়। আর সৎমা আমাকে তার মেয়ে মনে করেনি। জড়িয়ে ধরার আদিখ্যেতা করার জন্যও মনের মত মানুষ লাগে, আত্মার মানুষ! আমি আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম, আর ব্যাগ থেকে বিশ হাজার টাকা বের করে উনার হাতে দিলাম। উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বলতে পারলেন না। হয়ত মনে মনে নিজেকে ছোট ভাবছেন, নিজের ছেলের জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে এটা ভেবে হয়ত মনঃকষ্ট পাচ্ছেন। আমিই উনাকে মুক্তি দিলাম এই অপরাধবোধ থেকে। বললাম, “আন্টি, এই টাকাটা আমার নিজের। অনেকদিন ধরে জমিয়ে রেখেছি। আপনি এটা রাখুন। আমি জানি, হয়ত দরকার পড়বে। রিস্ক নেয়ার দরকার কী? এটা রাখলে আমি অনেক খুশি হব। কিন্তু রাফায়েতকে এটা বলবেন না, ও যে রাগী আর অভিমানী, এটা শুনলে খুব কষ্ট পাবে, রাগ করবে। আমার কথাটা রাখবেন আন্টি প্লিজ।”
উনি কিছু বললেন না। শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। আমি হাত পেতে দিলাম আমার, উনার চোখের জলে আমার রুক্ষ হাতটা ভিজে উঠল। হয়ত এটাই আমার জন্য আশীর্বাদ!
রাফায়েতের পাশে বসলাম কিছুক্ষণ। যতটা সময়ই বসে ছিলাম, কিছু বলতে পারিনি। কান্না এলেও জোর করে চেপে ধরে রাখলাম। মনের সাথে মনের মিল থাকলে নাকি পিনপতন নিস্তব্ধতায়ও মনের কথা শোনা যায়। আমি জানি না, রাফায়েত আমার মনের কথা পড়তে পারছে কি না। যদি পারত, তাহলে হয়ত জানত, এই পাগল ছেলেটার জন্য কতখানি ভালবাসা বুকে পুষে রেখেছি আমি!
বাসায় ফেরার পথে ফোন করলাম আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী, রেশমাকে। ও আমার সাথে একই কলেজে পড়ে না, তা সত্যি, তবে ও-ই আমার একমাত্র কাছের বান্ধবী। ফোন করে সব জানালাম ওকে। আমার পাগলামীর কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল রেশমা। ও আশঙ্কা করল, আজ বাসায় গেলে আমার কপালে অনেক বিপদ আছে। আমার যে ভয় লাগছিল না, তাও কিন্তু না। কিন্তু, রাফায়েতের জন্য এর চেয়ে ভয়ংকর কিছু যদি আমাকে করতে হত, তাহলে আমি সেটাও করতে রাজি ছিলাম। রেশমার সাথে কথা শেষ করে একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম দ্রুত। দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, মা ছাড়াও আরও পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছে বসার রুমে। আজ হয়ত এদের সবার সামনে আমার বিচার হবে। আমি ভেতরে ঢুকতেই মা আমার চুলের গোছা ধরে আমাকে টেনে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললেন। তারপর, রুলটানা স্কেলটা দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলেন।
“চোরের বাচ্চা চোর, আমার স্বর্ণের চেইন চুরি করে কী করছিস, বল? মনে করছিলি, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না, তাই না? তোর চুরি করা আজ জন্মের মত আমি ঘুচায়ে দিব।” এই বলে আমাকে আরও জোরে মারতে শুরু করলেন। আমি বাধা দিলাম না, কারণ, আমি এই পরিণতি হবে জেনেই এই কাজটা করেছি। পাশ থেকে দু’তিনজনকে বলতে শুনলাম, “ছি ছি, সৎ মা হোক, তাই বলে তার জিনিস চুরি করবা তুমি? ছিহ, তুমি না লেখাপড়া জানা মেয়ে?”
কথাগুলো যেন আমার কলিজা কেটে খচ করে ভেতরে ঢুকে গেল। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি নেমে এল, তবুও বাধা দিলাম না আমি। আজ এটুকু আমার পাওনা।
-
গায়ে খুব জ্বর এসেছে। কিন্তু আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে। সেটার প্রিপারেশন নিতে হবে। এমনিতেই গত পরীক্ষাগুলো তেমন একটা ভাল হয় নি। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলাম। উহহ, ঠোঁটের কাটা জায়গাটা জ্বলছে ভীষণ। বিছানা থেকে উঠতে পারছিনা। মা কথা বলছেন বাবার সাথে ফোনে, আমি শুধু মায়ের গলার আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। বাবা ওপাশ থেকে কী বলছেন তা শুনতে না পারলেও অনুমান করতে পারছি। মা চিৎকার করছেন, বাবা এসে এর একটা বিহিত না করলে উনি আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। আমাকে মেরে ফেলবেন! আমি চোখ বন্ধ করলাম। চোখের পানি একপাশ দিয়ে গড়িয়ে কানের গহ্বরে ঢুকে গেল। জীবনটা তেতো মনে হতে লাগল আমার কাছে। একটা ইট পাথরের দেয়ালে যেন আমি বন্দী হয়ে আছি, যেখান থেকে মৃত্যু ছাড়া নিস্তার পাবার উপায় নেই। হঠাৎ কপালে কেউ হাত রাখল যেন। অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখলাম রুনু দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে দেখেই তড়াক করে বসে পড়লাম। মা ওকে দেখতে পেলে আস্ত রাখবেনা।
“আপু, এই ওষুধটা লাগিয়ে নাও। তোমার ব্যথা কমে যাবে।”
আমি ওর হাতের এন্টিসেপ্টিক মলমটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জীবনে কখনও কী আমার এই মলমের দরকার হয়েছে? না, হয়নি। সব কাটা-ছেঁড়া এমনি এমনিই সেরে গেছে। আজ এই মলম দিয়ে আর কী হবে?
“তুই যা, মা দেখলে তোকে বকবে আবার। তুই যা এখান থেকে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে রুনু হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, কী বলব, কী করব।
“আপু, আমি আর কখনও তোর নামে আম্মুর কাছে কিছু বলবনা, আমি সরি।”
“সরি বলতে শিখেছে! দে মলমটা, তুই যা এখন।”
হাতে মলমটা গুঁজে দিয়ে রুনু লাইট নিভিয়ে দিল। আমি অন্ধকারে বসে থাকলাম। চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আমার ঘর, হয়ত আমার মনটাও। এই আলো কি মানুষের জীবন থেকে সব আঁধার মুছে দিতে পারেনা? পারে হয়ত। সেটাও হয়ত সবার জন্য না, অন্তত আমার জন্য না!
-
পরদিন কলেজ শেষ করে রাফায়েতকে দেখতে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছে, পায়ের কোনও হাড় ভাঙ্গেনি। তবে একটা হালকা ফ্র্যাকচার আছে। ওটা সারতে সপ্তাহ দুয়েক একদম বেডে থাকতে হবে। দু’দিন পর ওকে রিলিজ করা হবে। রাফায়েতের কেবিনে উঁকি দিলাম, ঘুমুচ্ছে ছেলেটা। কেমন মায়াবী লাগছে, কী অদ্ভুত একটা ভাল লাগা। হঠাৎ আন্টি আমার পিঠে হাত রাখলেন।
“কখন এলে? ওমা, তোমার মুখে এগুলো কিসের দাগ?”
“এগুলো......এগুলো হল, ঐতো আজ ক্লাসে পড়া পারিনি তো, তাই স্যার মেরেছে।”
“পড়া পারনি বলে এভাবে মারল? ছিহ। ব্যথা লেগেছে খুব, না?”
জবাবটা আর মুখে দিতে পারলাম না। হ্যাঁ, অনেক ব্যথা লেগেছে, কিন্তু আমি এই ব্যথাটুকু সহ্য না করলে তোমাকে অনেক ব্যথা পেতে হত, কষ্ট পেতে হত রাফায়েতের জন্য। কিছু করতে না পেরে আমিও দুঃখ পেতাম। আমার একটু কষ্টে যদি কেউ ভাল থাকে, সেটাই ভাল। তারপর ভালমন্দ আশা-আশ্বাস দিয়ে রাফায়েতকে দু’দিন পর বাড়ি নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি বাসার পথ ধরলাম।
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ পর রাফায়েতকে ফোন দিলাম। ওর ফোনটা বিজি বলছে। হয়ত সবাই ওর খবর নিচ্ছে, ওর এক্সিডেন্টের খবরটা আমিই সবাইকে দিয়েছি। ভাবলাম, রেশমাকে একটা কল দেই। আমার ভাল-মন্দ দিনের খবর ও ছাড়া এত ভাল করে আর কে জানে। ফোন করলাম রেশমাকে। বললাম ওকে, যা ঘটেছে। ওপাশের দীর্ঘশ্বাস আর আমার শরীরের ব্যথা- দুই মিলিয়ে সন্ধ্যাটা কেমন বিষাদের গোধূলিতে ছেয়ে গেল, ঐ গোধূলীর রঙ যেন আমার হৃদয়ের রক্তপাত।
রাতে রাফায়েতের ফোনটা ফ্রী পেলাম। ভাবলাম, ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে কে জানে। আমারও শরীরটা মোটেও ভাল লাগছেনা। জ্বর আসছে যেন। চোখ দুটো খুলে রাখতে পারছিনা। একটু পর রাফায়েতের নাম্বার থেকে কল আসল। দ্রুত রিসিভ করলাম আমি।
“হ্যালো, রাফায়েত, কেমন আছিস এখন?”
“ভাল, কে? রশ্মি নাকি?”
“হ্যাঁ, আমার নাম্বার সেভড নেই তোর সেল এ?”
“না আসলে, আমি ভেবেছি তন্নী... আচ্ছা কেমন আছিস? মা তোর কথা বলেছিল অবশ্য, তুই নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলি। মা অনেক প্রশংসা করল তোর।”
একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। আন্টিটা না জানি কী বলেছে। কেনও যেন খুব হাসি পেতে লাগল আমার, লজ্জার হাসি।
“ওসব ছাড়। তুই কেমন আছিস এখন? পায়ের ব্যথাটা কি কিছুটা কমেছে?”
“হ্যাঁ, আমি ফিট আছি। দেখবি, সপ্তাহ দুয়েক পরই আমি কলেজে ব্যাক করব। আচ্ছা, তোকে একটা ছেলে পছন্দ করত যে, রাব্বি নাম, ওর কী খবর?”
“আরে ছাড় তো। তোর এইটা এখনও মনে আছে? এই কাহিনীর ল্যাটা তো কবেই চুকে গেছে। হঠাৎ এই প্রশ্ন যে?”
“না এমনিতেই। মনে পড়ল আর কি। এই শোন, আমার পারমিশন না নিয়ে রিলেশন করতে যাস না যেন, কেমন? মনে থাকবে?”
বোকা ছেলেটা, তোর পারমিশন পেলেও তো করব না। আমার মনে তুই ছাড়া আর কারও থাকার অধিকার নেই, দেব না আমি কাওকে সেই অধিকার।
“আচ্ছা, থাকবে। এখন তুই রেস্ট নে। আমি রাখছি। ভাল থাকিস।”
-
পরের দু’তিনদিন আমি জ্বর গায়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। কেউ দেখতে এল না। বাবা এলেন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে। কিন্তু আমার সাথে দেখা করলেন না। রুনু বাবাকে বলেছে, আপুর অনেক জ্বর। তবুও বাবা একটি বার এলেন না আমাকে দেখতে। হয়ত রাগ করেছেন খুব, মায়ের গয়না চুরি করেছি, রাগ তো হবারই কথা।
কপাল মন্দ হলে যা হয়, তাই হল। বিকেলের দিকে কলেজের একজন স্যার এলেন বাসায়। আমি শুধু শুনছিলাম, স্যার বলছেন, আমার রেজাল্ট গত কয়েক মাস ধরে খারাপ হচ্ছে। বাবা ছিলেন না, মা তাই যাচ্ছেতাই বলেছেন স্যারকে। আমি নাকি পড়ালেখা করি না, পড়ার ভান করে বসে থাকি বই খুলে, কলেজেও যাই কিনা কে জানে, আমি বখে গেছি, এই সেই। তারপর সন্ধ্যায় বাবা এলে মা নালিশ দিলেন। একটু পর, বাবা আমার রুমে আসলেন। আমি ভাবলাম, বাবা হয়ত সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন। আমার কাছে আসার সময় পান নি। তাই এখন এসেছেন। মনে মনে একটু খুশি হলাম আমি। বাবার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠোঁটের ব্যথাটার জন্য হাসতে পারলাম না। কিন্তু বাবার হাতে ওটা কী? একটা কাগজ, রেজাল্ট কার্ডের মত মনে হচ্ছে, আমার রেজাল্ট কার্ড! কার্ডটার দিকে একবার তাকালাম। উপরে লাল কালিতে বড় করে F লেখা। বাবা আমার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে ঠাস করে চড় মারলেন একটা। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম বিছানার এক কোণায়। মাথার কোথায় যেন পিনপিন করছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। বাবার এই কাজে অবাক হবার আগেই আমার হঠাৎ মনে হল, সব আঁধার, আঁধার ঘেরা।
-
পরদিন চোখ মেলে নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করলাম। বুঝতে পারলাম, আমাকে মেরে বাবার মনে কোনও প্রকার অপরাধবোধ নেই। তাই অতশত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে হাত-মুখ ধুয়ে কলেজের ড্রেস গায়ে চাপিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিন্তু আজ কলেজে যাবনা, রাফায়েতের বাসায় যাব। ওকে দেখতে যাব। মনে যতটুকু কষ্ট জমে আছে, রাফায়েতকে না দেখলে সেটা কমবেনা। ওদের বাসার সামনে এসে দরজাটা খোলা দেখতে পেলাম। ভিতরে যাব কী যাব না ভাবছিলাম। দরজার বাহিরে একজোড়া হাই হিল রাখা। নিশ্চয়ই কেউ এসেছে ওদের বাসায়। ভেতরে ঢুকলাম আমি। দুটোই ঘর মোটে, তার মধ্যে একটায় ফ্লোরে বিছানা পাতা, এলোমেলো বইপত্র রাখা। মনে হয়, এটা রাফায়েতের রুম। ও অসুস্থ থাকায় হয়ত আন্টির রুমে আছে। আমি আন্টির রুমে উঁকি দিতেই এমন কিছু দেখলাম, আমার নিজের চোখ দুটাকে বিশ্বাস হল না। মনে হল, আমি এখনও বাবার হাতে মার খেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছি, ভুলভাল স্বপ্ন দেখছি। রাফায়েত আমাদের জুনিয়র ক্লাসের একটা মেয়ে, তন্নীকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আমি খুব নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললাম। যদি ওরা টের পেয়ে যায়, কি ভাববে? ভাববে কিছু না কিছু অবশ্যই, কিন্তু আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, সেটা দেখতে তো পারবেনা। আমার ভেতরটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগল। মনে হল, কত কাল ধরে এই হৃদপিণ্ডে স্পন্দন হয়নি, চোখের পলক পড়েনি। আমি ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় নেমে এলাম। আকাশ গর্জন করছে, যে কোন মুহূর্তে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে বৃষ্টি নামবে। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। ফুটপাত কেটে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগলাম। দু’তিনটা ছেলে শিষ মারল আমাকে দেখে, একটা গাড়ি পাশ ঘেঁষে যাবার সময় ময়লা কাদায় আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল, আমার ভ্রুক্ষেপ নেই আজ। আমার যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
-
রাতে রাফায়েতকে ফোন দিতে খুব ইচ্ছা হল, কিন্তু দিলাম না। রাফায়েত কী কখনও বুঝতে পারেনি, আমি ওকে কতটা ভালবাসি। আমি ওকে বুঝাতে পারি নি? আমি তো চেষ্টাই করিনি। না, আজ আমাকে চেষ্টা করতে হবে। যা হবার হোক। কয়েকবার রিং হবার পর রাফায়েত ফোন তুলল।
“হ্যালো, রশ্মি বল।”
“রাফায়েত, আমার তোর সাথে কথা আছে, জরুরি কথা।”
“এত রাতে হঠাৎ তোর জরুরি কথা মনে পড়ল? তোরা মেয়েরা পারিস ও বটে। কী কথা, শুনি?”
“আমি তোকে ভালবাসি রাফায়েত।”
মনে হল কোথাও বিস্ফোরন হয়েছে, চারদিকে সবাই ছুটোছুটি করছে। শুধু আমার আর রাফায়েতই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি চুপচাপ। আমার চোখ ভিজে উঠছে। রাফায়েত কী আমাকে ফিরিয়ে দেবে?
“আসলে রশ্মি, হয়েছে কী, আমি তো আসলে.........”
মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে পাগলের মত বলে উঠলাম, “আসলে তুই কী, হ্যাঁ? তুই তন্নীকে ভালবাসিস? তন্নীকে? তুই জানিস, ও এই পর্যন্ত কয়টা ছেলেকে ঘুরিয়েছে? তুই ওর সাথে...আর আমি? আমি যে তোকে ভালবাসি, এটা কী তুই কখনও এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারিস নি? একবারও আমার কথা ভাবিস নি তন্নীর সাথে রিলেশন করার আগে আমার কথাটা?”
“দেখ রশ্মি, আমি জানি, একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের ভাল কোনওদিন বলতে পারে না, তাই তন্নীর ব্যাপারে তুই যা যা বললি, আমি গায়ে মাখলাম না। মেয়েটা আমাকে অনেক ভালবাসে। আমার করার মত কিছু নেই। দেখ, আমরা বন্ধু আছি, বন্ধুর মত থাকব, সেটাই ভাল। কিন্তু একটা কথা, তুই যদি ভবিষ্যতে ওর ব্যাপারে উলটাপালটা কিছু বলিস, তাহলে আমাকে তোর সাথে বন্ধুত্ব ডিসমিস করতে হবে। সো, বেটার ইউ ফরগেট দিজ ম্যাটার, টেক ইট ইজি।”
আমি কোনও প্রত্যুত্তর দিলাম না। আমার আওয়াজ না পেয়ে ফোন কেটে দিল রাফায়েত। আর আমি ডুবে গেলাম একরাশ হতাশায়।
-
কয়েকদিন বাসা থেকে বের হলাম না। কলেজেও গেলাম না। মাঝে রেশমা বারকয়েক ফোন দিল। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মত অবস্থা ছিল না। এর মাঝে রাফায়েত কলেজে গিয়ে জানতে পারল, আমি কলেজে আসছিনা কয়েকদিন ধরে, তাই হয়ত আমাকে ফোন দিল।
“হ্যালো, রশ্মি, কেমন আছিস?”
আমি উত্তর দিলাম না। দিতে পারলাম ও না, কান্নাগুলো যেন কাগজের টুকরা হয়ে আমার গলায় আটকে আছে। কিছু বলতে পারছি না, পারছি না বোঝাতে, আমি কি নিদারুন কষ্টে আছি।
“ দেখ রশ্মি, এভাবে করলে হবে? পরীক্ষা খারাপ হবে শুধু শুধু। এমন করিস না।”
“কেমন করব রাফায়েত, তুই বলে দে।”
আমার প্রশ্নের ধরণটা শুনে চুপ মেরে গেল রাফায়েত। আমি মন দিয়ে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছিলাম। এত আপন লাগে ওকে, এত ভালবাসি, আর ও আমার কথাটা কোনওদিন ভাবেনি। এমন সময় রেশমার কল আসল। আমি কনফারেন্স করে নিলাম তিনজনের।
“হ্যালো, রশ্মি, তোর জ্বর কমেছে? গায়ের ব্যথাগুলো সেরেছে? ওষুধ নিয়েছিলি?”
রাফায়েত এবার অবাক হল, জ্বর, গায়ের ব্যথা, এগুলো কী?
“হ্যালো, কে?”
“আমি রেশমা, আপনি কে?”
“ও, আমি রাফায়েত। রশ্মির বন্ধু। একসাথে পড়ি।”
“ও আপনিই সেই রাফায়েত?” রাফায়েত একটু অবাক হল। রেশমা নামের কেউ ওদের ক্লাসে পড়েনা। আর সেই রাফায়েত, এভাবে বলল কেন মেয়েটা?
“ সেই রাফায়েত মানে বুঝলাম না। আপনি আমাকে চেনেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, চিনি, ভাল করে চিনি। আপনি একটা স্বার্থপর শ্রেণির মানুষ। আপনি একটা......”
রেশমাকে থামিয়ে দিলাম আমি। কী সব ভুলভাল বকছে পাগলীটা। রাফায়েত কী মনে করবে এসব শুনে। ভাববে, আমি মানুষের কাছে এসব বলে বেড়াচ্ছি। উফফ, আর কত যন্ত্রনা আমাকে নিতে হবে?
“রেশমা, থাম প্লিজ।”
“না, থামবে কেনও? বলুন রেশমা, কী বলছিলেন? আমি স্বার্থপর? কী স্বার্থপরতা করেছি আমি আপনার সাথে?”
“এখনও জিজ্ঞেস করতে আপনার লজ্জা করছে না? কেমন মানুষ আপনি? আপনার জন্য মেয়েটা বাসা থেকে মায়ের গয়না চুরি করে, বিক্রি করে, হাসপাতালে আপনার খরচের সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। বাসায় ফেরার পর ওর সৎ মা ওকে প্রচুর মেরেছে, ওর বাবা ওকে ভুল বুঝেছে। এরপরেও আপনি বলছেন, আপনি কী স্বার্থপরতা করেছেন? লজ্জা করেনা আপনার?”
রাফায়েতের গালে যেন চড় মেরে গেল কেউ। রশ্মি এসব...... কিন্তু ও তো কিছুই জানত না। কিছু জানত না রাফায়েত। মা’ও ওকে কিছু বলে নি, রশ্মিও বলেনি।
“দেখুন, আমি আসলে এসব কিছুই জানতাম না।”
“জানতেন না? এটা না হয় জানতেন না, কিন্তু আপনি যে একটা থার্ড ক্লাস প্রস্টিটিউট টাইপের মেয়ের সাথে রিলেশন.........”
কথাটা শেষ করতে না করতেই যেন বাঘের মত গর্জে উঠল রাফায়েত। আমার বুক ধ্বক করে উঠল। আমি কখনও রাফায়েতকে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনি নি, এই প্রথমবার।
“খবরদার, তন্নীর সম্পর্কে আর একটা বাজে কথাও শুনতে চাইনা। আপনার ভালবাসার মানুষের নামে আপনাকে কেউ খারাপ কথা বললে আপনি সহ্য করবেন? নেহাত আপনি একটা মেয়ে, তাই ছেড়ে দিলাম আপনাকে। না হলে...”
কথা শেষ করার আগেই ফোন কেটে দিল রেশমা। আমি কাঁদতে লাগলাম। আমি চাই নি রেশমা আমার জন্য কিছু বলুক, আমার জন্য তন্নীকে খারাপভাবে রাফায়েতের সামনে উপস্থাপন করুক,সেটা সত্যি হোক, বা মিথ্যাই হোক, আমি এসবের কিছুই চাইনি। রাফায়েতও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
“রশ্মি, তুই আজকের পর থেকে এই মেয়েটার সাথে আর কখনও কথা বলবি না। এটা আমার অর্ডার।”
কথাটা শুনে আমার মাথায় ঝাঁ করে রক্ত উঠে গেল। প্রেম করবে তন্নীর সাথে, আর অধিকার খাটাবে আমার উপর? বাহ, কি বিচার!
“রাফায়েত, তুই আমার উপর অধিকার খাটাতে পারিস না। তোর যদি অধিকার খাটানোর ইচ্ছা থাকে, তুই তন্নীর উপরে খাটা। কিন্তু, আমি তোর কথাটা মানতে পারলাম না। আমি রেশমার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে পারব না। এবার তোর যা ইচ্ছা তুই কর।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমি ফোনটা কেটে দিলাম। ওদিকে ক্রুদ্ধ রাফায়েত ফোনটা বিছানায় আছড়ে ফেলে বাহিরে চলে গেল।
রেশমার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। রেশমা অনুচিত কিছু বলেনি। যা বলেছে, একদম সত্যি বলেছে। কারণ, তন্নী রেশমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথেও সম্পর্কে জড়িয়েছিল। অনেক টাকাপয়সা উড়িয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে ছেলেটাকে বিদেয় করে দিয়েছে। রাফায়েত আঘাত পাবে ভেবে হয়ত রেশমা এসব কিছুই বলেনি।
“রেশমা, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, বল। কথা শেষ ঐ বেয়াদবটার সাথে?”
“প্লিজ এভাবে বলিস না। আমি সরি, আমার জন্য তোকে কড়া কড়া কথা শুনতে হল। রাফায়েত আসলে আমাকে বা কাওকে বিশ্বাস করতেই চাইছে না যে, তন্নী মেয়েটা...”
“বাদ দে ওর কথা। তোকে আমি যেভাবে বলি, সেভাবে শুনবি। কাল কলেজে যাবি, তারপর তোকে একটা ছেলে প্রপোজ করেছিল না? রাব্বি? ওকে খুঁজে বের করবি। বুঝতে পেরেছিস?”
“হ্যাঁ, তারপর?”
“এরপর ওর সাথে কয়েকদিন হেসে হেসে কথা বলবি, রাফায়েতকে দেখিয়ে দেখিয়ে। দেখ, কী হয়?”
“আচ্ছা রেশমা, তোর কী মনে হয়, আমি এসব করলে ও আমার কাছে ফিরে আসবে? আসলেও সেই আসাটা কী আদৌ ভালবাসার কারণে হবে? নাকি শুধু জেলাসির কারণে?”
“এত কিছু তোর ভাবতে হবেনা, করতে বলেছি, করবি ব্যস। আচ্ছা শোন, আমি এখন রাখছি। আমার একটা কল আসছে।”
“কল? এত রাতে? এত রাতে তো তুই কারও সাথে কথা বলিস না, ইভেন আমার সাথেও না।”
“আসলে তোকে বলার সুযোগ পাইনি, একচ্যুয়ালি, আই থিঙ্ক আই এম ইন লাভ।” রেশমার কণ্ঠটা কেমন যেন লাজুক লাজুক হয়ে গেল। ভাল লাগল আমার। আমি সুখে নেই, তাতে কী? আমার ফ্রেন্ডটা ভাল আছে, এটাই বড় কথা।
“তাই? কবে হল বললি না তো। দেখা করিয়ে দিস আমার সাথে অবশ্যই। তোদের দুইজনের জন্যই দো’আ রইল। ভাল থাকিস তোরা।”
ফোনটা রেখে দিয়ে ছাদে গেলাম। বৃষ্টি হয়ে ছাদটা ভিজে আছে একদম। ভেজা ছাদের উপর শুয়ে পড়লাম। আকাশটা পরিষ্কার, ফকফকা। লক্ষ অগনিত তারা যেন আমাকেই চেয়ে চেয়ে দেখছে, আর ভাবছে, এত কষ্ট কেনও মেয়েটার মনে!
-
পরদিন কলেজে গিয়ে রাব্বিকে খুঁজে বের করলাম, হেসে হেসে কথা বললাম। রাফায়েত সব দেখছিল, আমি ওর দিকে না তাকিয়েও সেটা ধরতে পারছিলাম। জেলাস হচ্ছে ও? হোক, এটাই ওর জন্য উচিত। ক্লাস শেষ করে প্রতিদিন আমি রাফায়েতের সাথেই বাসায় ফিরি, কিন্তু আজ রাব্বিকে বললাম, আমাকে বাসা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে। কলেজের গেইট পার হয়ে মন্টু ভাইয়ের দোকানে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম আমি আর রাব্বি, এমন সময় রাফায়েত হাজির।
“রাব্বি, আমার রশ্মির সাথে একটু কথা আছে।”
“তোর যা কথা, পরে বলিস। আমি এখন রশ্মিকে বাসায় ছেড়ে দিয়ে আসব।”
“কেনও? তুই ওকে বাসায় ছেড়ে আসতে যাবার কে? ওর বাসা অবধি আজ পর্যন্ত আমিই ওকে এগিয়ে দিয়ে এসেছি। আজও আমিই যাব।” রাফায়েতের মুখের পেশী টানটান হয়ে যায় জবাব দিতে গিয়ে। আমার কেনও যেন ভয় লাগে, যদি এরা দু’জন এখন মারামারি শুরু করে। কী হবে?
“রাব্বি, আজ না হয় রাফায়েতের সাথেই গেলাম। তোর সাথে আরেকদিন যাব, কিছু মনে করিস না।”
রাব্বি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর, ঝালমুড়ির প্যাকেটটা ফেলে পায়ের নিচে পিষে, হাঁটা ধরল ওর বাসার দিকে। ঝালমুড়িওয়ালার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আমি আর রাফায়েত হাঁটতে শুরু করলাম। পুরোটা পথ নিশ্চুপ হয়ে হাঁটার পর, বাসার কাছাকাছি আসতেই রাফায়েত আমার হাত চেপে ধরল।
“কী হল, ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি তো হাতে, লাগছে খুব।”
“ছাড়ব, তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দে সত্যি করে।”
ওর মুখের দিকে তাকালাম। কেমন যেন একটা ক্রোধ ছড়িয়ে আছে ওর পুরো চাহনীতে। মনে হচ্ছে, এই ক্রোধের আগুনে আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে ও। কেনও? এত রাগ কেনও?
“তোর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে কী আমি বাধ্য?”
“বাধ্য কী অবাধ্য এত কথা তোর জানার প্রয়োজন নেই, আমারও শুনার প্রয়োজন নেই। তোকে তো রাব্বি প্রপোজ করেছিল, তখন তো পাত্তা দিস নি। এখন রাব্বির সাথে কথা বলিস কেনও? কেনও রশ্মি, বল?”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর মুখের দিকে। কি শুনতে চায় ও আমার কাছে? আমাকে তো ভালবাসে না, ভালবাসে ঐ তন্নীকে। কিন্তু, অধিকার খাটাচ্ছে আমার উপর। কী চায় ও আমার কাছে? রাফায়েতের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আলগোছে।
“কারণ, আমি যাকে পাত্তা দিয়েছি সবসময়, তার কাছেই আমার আজ আর পাত্তা নেই, লাপাত্তা হয়ে গেছি আমি তার জীবন থেকে।” কথাটা বলেই বাসার দিকে পথ ধরলাম। একবারও তাকিয়ে দেখলাম না, রাফায়েত কেমন অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-
বিকেলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম, দেখলাম রাফায়েত ওর বাসার পাশের টং দোকানটায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ছেলেটা সিগারেট খাওয়া শুরু করে দিয়েছে? এত অধঃপতন ওর কবে থেকে হল? ওকে দেখেও না দেখার ভান করে আমি দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।
“রশ্মি, দাঁড়া।”
আমি দাঁড়ালাম না, বরং ওর গলা পেয়ে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। এবার পেছন থেকে ও দৌঁড়ে এল। পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা।
“কথা বলবি না আমার সাথে?”
আমি ‘না’ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। কেনও কথা বলব? আমি কী ওর সাথে কথা বলার কেউ? কেউ না। কেনও কথা বলব তাহলে? বাসার প্রায় কাছে চলে এসেছি দেখে এবার রাফায়েতকে বললাম, “তুই এবার যা, আমি বাসায় ঢুকব এখন। কেউ দেখলে সমস্যা হবে। এমনিতেই আমার সমস্যার শেষ নেই। আর পারলে, এসব সিগারেট, ছাইপাশ খাওয়া ছেড়ে দিস।”
রাফায়েত ফিরে যাওয়ার বদলে আমার পেছন পেছন আসতে লাগল। ব্যাপার কী? ও যাচ্ছে না কেনও?
“তোকে কী বললাম, প্লিজ যা। কেউ দেখলে আমার সমস্যা হবে তো।” আমার চোখে মুখে ভয় আর উদ্বিগ্নতা খেলা করছিল। অথচ ওর যেন কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। হঠাৎ আমার ডান হাতটা ওর দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। আমি অবাক হয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“আমি সরি রশ্মি। তুই আমার জন্য যা করেছিস, করছিস, আমি সেটা কখনই তোকে ফেরত দিতে পারব না। আমি জানি, তুই আমাকে কতটা ভালবাসিস। সেই হিসেবে আমার ও তোর উপর অধিকার আছে, বল, নেই?”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা নাড়লাম। ও হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি তন্নীকে সত্যি অনেক ভালবাসি। আমি জানি, তুই সবসময় চাইবি, আমি যেন ভাল থাকি, সুখে থাকি। তাহলে তুই কেনও নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছিস? তুই নিজেকে কষ্ট দিলে আমাকে ভাল রাখবে কে বল?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এত জ্বালা করছে কেনও চোখ দুটো? কিছু পড়েছে বোধহয়!
“আমি এখন যাই, রাফায়েত। কেউ দেখবে।”
আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল ও। আমি অবাকের চেয়েও চুড়ান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কী হল এটা?
“তুই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। লাভ ইউ অলওয়েজ এজ এ ফ্রেন্ড। আর খবরদার, আমি ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলবি না। আর আমার...” কথাটা শেষ না হতেই একটা মেয়েলী গলা পেলাম। পাশের বাসার আন্টি............
“ছিহ, রশ্মি, তোমাকে তো ভাল মেয়ে বলে জানতাম, আর তুমি... দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি তোমার আম্মুকে যেয়ে সব বলছি।”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। রাফায়েতও ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে গেল। দেরী না করে ওকে ঠেলে বের করে দিলাম।
“তুই এখান থেকে পালা দ্রুত। আমি সামলে নেব। যা তুই।”
রাফায়েত এক মুহূর্ত দেরী না করে ছুটে চলে গেল। আমি একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চার তলায় উঠলাম। মা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ঘরে ঢোকার জায়গা করে দিল। আমার বুক দুর্ভাবনায় ঢিপ ঢিপ করছিল। আম্মু কী কিছু জানে না তাহলে, পাশের বাসার আন্টি কিছু বলে নি?
কোনওমতে আমার রুমে ঢুকে দেখি পাশের বাসার আন্টি বসে আছে। আমি দ্রুত উনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি ভুল বুঝেছেন আমাকে। সত্যিটা আমাকে বলতে হবে।
“আন্টি, বিলিভ মি, আমার সাথে ঐ ছেলের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা ভাল বন্ধু, শুধু এটুকুই। আমি...” বাকি কথাটুকু মুখেই রয়ে গেল। আম্মু পর্দা ঝোলানোর রডটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
“ভাবি, আপনি বাসায় যান। এর ব্যবস্থা আমি করছি। এর প্রেম-পিরিতির শখ আজকের পর আর থাকবে না, পিটিয়ে এটার হাত-পা আমি ভেঙ্গে দিব আজকে। আপনি যান বাসায়।”
আন্টি আমার দিকে বিদ্রুপাত্মক একটা দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন। আম্মু আমার রুমের দরজা লক করে রডটা হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।
“লোকজনরে দেখায় দেখায় প্রেম করতেছিস, তাই না? তোর মত বেজন্মারে আমি এতদিন খাওয়ায় পরায় বড় করসি? তোরে তো আমার এই বাড়িতে আসার পরেই লাথি দিয়ে বের করে দেয়া উচিত ছিল। সেটা আমি করি নাই, আমার ভুল হইসে। আমার ভুল আমিই শুধরাবো।” এই বলে মা আমাকে বেধড়ক পেটালেন। ইচ্ছেমত ঘা বসালেন, মনের সব ঝাল মিটিয়ে। আমার মনে হল, অনন্তকাল ধরে উনি আমাকে মারছেন, এর কোনও শেষ নেই। মুখের লালায় জামাকাপড় সব ভিজে গেল। হাঁপাতে লাগলাম ক্লান্ত চড়ুই পাখির মত। মা কথ্য-অকথ্য সব গালিগালাজ করতে লাগলেন। আমি চুপচাপ শুনে যেতে লাগলাম, ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছিল। হঠাৎ মাথায় খুব সজোরে আঘাত করলেন মা। এবার আর সহ্য করতে পারলাম না। ‘মা গো’ বলে জোরে চিৎকার দিলাম একটা। খানিকটা রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে চোখ পর্যন্ত নেমে এল, অন্ধকার করে দিতে চাইল দৃষ্টি। এরপরেই সব ঘোলাটে, আর কিছু মনে নেই আমার।
-
সম্ভবত দু’দিন আমি এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। চোখ মেলার পর নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। একটা বেডে শুয়ে আছি আমি। হাতে একটা ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইনের বোতলে টিপ টিপ করে স্যালাইন জমছে, আর ঢুকছে আমার রগে রগে। মাথাটা কেমন পাথরের মত ভারী লা্গছে। নাড়াতে পারছিনা একদম। মাথায় হয়ত ব্যান্ডেজ লাগানো। বাম হাতটা কোনওভাবে তুলে মাথায় হাত দিলাম। এ কী? আমার চুল কোথায়? আমার চোখে পানি এসে গেল। কাঁদতে শুরু করলাম আমি। আমার চুল কোথায় গেল? আমার কান্নার আওয়াজ শুনে নার্স দৌড়ে আসল।
“কী হয়েছে, যন্ত্রণা হচ্ছে?”
“আমার চুল কোথায়, হ্যাঁ?” আমি কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না।
“আসলে, আপনার মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল এক্সিডেন্টের কারণে। অপারেশনের সুবিধার্থে, চুল কেটে ফেলতে হয়েছে। চিন্তা করবেন না, কয়েক মাসের মধ্যেই চুল গজিয়ে যাবে।” এক গাল হাসি হেসে নার্স জবাব দিল।
“আচ্ছা, এখানে আমাকে কে এনেছে?”
“একজন পুরুষ, সাথে একটা ছোট মেয়ে ছিল। আর কাওকে দেখি নি।”
কে এসেছিল? বাবা আর রুনু? হয়তো। বাবাকে নিশ্চয়ই মা এসব বলে দিয়েছে। বাবা আমাকে কী ভাবলেন, ছি ছি ছি। সবার কাছে এভাবে ছোট হয়ে যাব, কোনদিন ভাবিনি আমি। দস্যি এই আমি এভাবে গম্ভীর হয়ে যাব জীবনের দুর্বিপাকে, কে জানত! একটু পর বাবাকে আসতে দেখলাম, নার্সের সাথে কী যেন বলছেন উনি। কেবিনে ঢুকে আমার পাশে বসলেন।
“খুব ব্যথা হচ্ছে?”
বাবার প্রশ্নে আমার চোখে জল এসে গেল। কী উত্তর দেব, ভেবে পেলাম না। মাথায় কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে জানি না, তবে এটুকু জানি, বুকের ভেতরটায় তার চাইতে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক বেশি।
“কী হয়েছিল মা, আমাকে একটু বলবি?”
আমি বাবাকে সব বললাম, সবটা। যা যা ঘটেছিল, তার পুরোটাই বললাম। বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যা হয়েছে ভুলে যা। আমি তোকে এখানে রাখব না আর। তোর কলেজটা শেষ হলে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেব। সেখানে কেউ থাকবে না তোকে কষ্ট দেয়ার।”
আমি বাবার এক হাত জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। অনেকদিন পর একটু শান্তি শান্তি লাগছে। আসলেই দুঃখের পর ক্ষণিকের জন্য হলেও সুখ আসে। আমি বুঝতে পারছি, আমার ভাল লাগছে, বহুদিন পর আমার একটু শান্তি লাগছে।
-
বাসায় ফিরে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। রাফায়েতের একটা মেসেজ। আর কারও কোন কল নেই, মেসেজ নেই। মেসেজটা ওপেন করলাম।
“আমার জন্য তোমার এভাবে ঝামেলা হয়ে গেল, আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি আর কখনও তোমার সামনে আসব না। পারলে তুমিও আমাকে ভুলে যেও। এটাই ভাল হবে।”
একটা ছোট্ট গভীর নিঃশ্বাস ফেললাম। দূরত্ব চলে আসলে তুই থেকে তুমি হয়ে যায় সম্বোধনগুলো? রেশমার সাথে কথা বলতে হবে, মনটা হালকা করতে হবে আমার। ও এই সাত-আটদিনে আমাকে একবারও ফোন করেনি! আচ্ছা, দুর্দিনে আসলেই কী কেউ পাশে থাকেনা?
“হ্যালো, রেশমা?”
“হ্যাঁ, কে বলছেন?”
“আমি, রশ্মি, চিনতে পারছিস না?” আমি অবাক হয়ে গেলাম। রেশমা এই কয়েকদিনের ব্যবধানে আমার কণ্ঠও ভুলে গেছে।
“ও রশ্মি, কী খবর কেমন আছিস, শুনেছিলাম তোর এক্সিডেন্ট। এখন ঠিক আছিস তো?”
“মোটামুটি। তুই একবার আসবি বাসায়?”
“না রে। আমার সময় নেই। আজ রায়হানের সাথে দেখা করার কথা। একটু পরই বের হব। আমি এখন রাখছি, বাই।”
কেটে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুই মিনিট, পনের সেকেন্ড... আবার কষ্ট লাগতে শুরু করেছে। রাফায়েতের কথায়ও যে মেয়ের সাথে আমি বন্ধুত্ব শেষ করি নি, আজ সেই কিনা........
বিতৃষ্ণা এসে গেল জীবনের প্রতি। কেনও এমনটাই হবে আমার সাথে? কেনও? ওদিকে মা, বাবার সাথে খুব চিৎকার- চেঁচামেচি করছে, হয় উনি বাসায় থাকবেন, নয়তো আমি থাকব। আমার কারণে উনি সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারছেন না। কী করব আমি? কীভাবে বাঁচব আমি? ছোট বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলাম।
“আল্লাহ, সাহায্য কর আমাকে, প্লিজ।”
-
শীতের সকাল, বাহিরে মিষ্টি রোদ। আমি একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছি। সকাল সকালই কয়েকটা ছেলেমেয়ে ক্রিকেট খেলছে। আমি দেখছি ওদের খেলা। যদিও ক্রিকেট আমি তেমন বুঝিনা, তবুও ভাল লাগছে দেখতে। একটু দূরে রাফায়েত দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
“ডাক্তার, ওর কন্ডিশন কী বুঝলেন? এখন আগের চাইতে বেটার তো?”
“দেখুন, রশ্মি একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে আর কিছু মনে করতে পারছে না। টোটালি সেই দিনের পর থেকে কী হয়েছিল, ওর আর কিছু মনে নেই। বলতে পারেন, ওর জীবন ওখানেই থেমে পড়ে আছে। তবে আপনাকে মেয়েটা অনেক ভালবাসে, আপনি চাইলে ওকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।”
রাফায়েত মাথা নেড়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। আমি খানিকটা সরে ওকে বসার জায়গা করে দিলাম।
“রাফায়েত, তুমি যে এখানে এসেছ, তন্নী জানতে পারলে রাগ করবে না?” উৎসুক দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
“না, করবে না। কারণ, ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই। রাগ করার প্রশ্নই আসে না। তুমি কেমন আছ আজ, সেটা বল। কিছু মনে করতে পারছ?”
“রাফায়েত, মনে করার কিছু নেই। আমি পাগলের মত এখানে পড়ে আছি, আমার চিকিৎসা হচ্ছে, সবাই ভাবছে আমি মানসিক ভারসাম্যহীন, আর তুমি হয়ত মনে মনে ভাবছ, তোমার জন্যই আমার এমনটা হয়েছে। সেরকম কিছু না। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পার। আমি সত্যটা স্বীকার করে নিয়েছি। আমাকে আর শুধু শুধু মিথ্যা বলতে হবে না। আমি ভাল আছি একলা একলা। ভালই থাকব।”
রাফায়েত আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি তাকালাম ওর দিকে। ওর দুই চোখে অনেক ভালবাসা। কিন্তু, আমার জন্য কি না, জানি না আমি।
“তুমি কেনও বিশ্বাস করছ না, সেদিন মেসেজটা দেয়ার পর আমি খুব অপরাধবোধে ভুগছিলাম, তন্নীকে ঠিকমত সময় দিতে পারছিলাম না। আর তন্নী অন্য একটা ছেলের সাথে এই সুযোগে রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিল। যখন সব জানতে পারলাম, যখন আমার ভুলটা বুঝতে পারলাম, তোমার কাছে ফিরে আসলাম। কিন্তু তখন তুমি...”
“প্লিজ রাফায়েত, এক মিথ্যা বারবার বললে সেটা সত্য হয়ে যায় না কোনওদিন। আর বল না এসব কখনও। ভাল লাগে না আমার।” আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলাম আমার কেবিনের দিকে। আর রাফায়েত বেঞ্চে বসে হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে লাগল, ক্রমশ ঘোলাটে থেকে ঘোলাটে হয়ে গেল আমার অবয়ব, আর ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ল জল......হয়ত আমার জন্য!
-
“আজ দেরী করলি যে? প্রতিদিন তো দাঁত ব্রাশ না করেই কলেজে চলে আসিস। আজ কি ব্রাশ করতে করতে দেরী হয়ে গেছে?” আদিব দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করল। শুনে পিত্ত জ্বলে গেল আমার। একেই আজ কলেজে ঢুকতেই রেবেকা বানুর সামনে পড়লাম, তার উপর এ আছে আমাকে পঁচানোর তালে।
“না, ব্রাশ প্রতিদিনই করি, আজও করেছি। কারণ, তোর মত হলুদ হলুদ দাঁত বের করে দাঁত কেলানোর আমার অভ্যাস নেই। যা, সামনে তাকা। পিছনে ফিরবিনা আর খবরদার। ফিরলে কলম দিয়ে চোখ ফুটা করে দিব।”
অকস্মাৎ এই আক্রমনে আদিবের মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। কিন্তু এইটুকু একটা মেয়ের কাছে তো দমে থাকা যায়না। ওর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করল হঠাৎ।
“কি রে রশ্মি, তোর জানপাখি, ময়নাপাখি, শকুনপাখি রাফায়েত আজ কলেজে আসল না যে?”
কথাটা বলার সাথে সাথে কাজ হল। আমি ইতিউতি তাকিয়ে, ঘাড়টা বকের মত উঁচিয়ে প্রথম বেঞ্চ থেকে শেষ বেঞ্চ অব্দি খুঁজলাম, রাফায়েত নেই, আসেনি আজ কলেজে। ও তো সচরাচর কলেজ মিস করেনা। তাহলে কী অসুস্থ?
“এই, আমার জানপাখি মানে? আজাইরা কথা বেশি বলিস আজকাল। আর, এই বেয়াদব, তুই ওরে শকুনপাখি বললি কেন? আজকের পর থেকে আর কথা বলবিনা আমার সাথে, মনে থাকে যেন।” এটুকু বলেই মুখ গোঁজ করে বসে থাকলাম। ক্লাস থেকে বের হয়েই ওকে ফোন করতে হবে। ও তো জানে না, ওকে একদিন না দেখলে আমার কেমন অস্থির অস্থির লাগে!
-
অনেকবার রিং দিলাম, ওপাশে কেউ ফোন তুলছেনা। এই নিয়ে তের বার চলছে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ঢুকে প্রথম ওকেই ফোন করেছি। এই শেষ বার, আর দেব না। মন খারাপ করে ডায়াল করলাম রাফায়েতের নাম্বারে। হঠাৎ ফোনটা রিসিভ হল। আমি দ্রুত মোবাইল কানে ঠেকালাম।
“হ্যালো, কে রাফায়েত?”
“না, আমি রাফায়েতের আম্মু। তুমি কে?”
এই মরেছে! এখন আমি কী করি? কেটে দেব, নাকি কথা চালিয়ে যাব? যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসি, কী হবে? আমি তো কখনও ওর আম্মুর সাথে আগে কথা বলিনি। কী করব এখন? আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই উনি বললেন, “মা, তুমি কি ওর ক্লাসমেট?”
“জ্বি আন্টি, আমি আর রাফায়েত একসাথে পড়ি। ও আজ কলেজে আসে নি তো, তাই স্যার-ম্যাডামরা ওর কথা জানতে চাচ্ছিলেন।” উত্তেজনায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইছেনা। তবুও চিঁ চিঁ করতে করতে জবাব দিলাম। আর স্যার-ম্যাডামরা কতটুকু মিস করছে জানি না, তবে আমি ওকে ভীষণ মিস করছি। এটা তো আর আন্টিকে বলা যাবেনা।
“মা, ওর তো আজ সকালে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। বাথরুমে পিছলে পড়ে পা মচকে ফেলেছে। ভেঙ্গে গেছে কি না বুঝতে পারছি না। কপালেও বেশ খানিকটা কেটে গেছে। পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে ওকে আমাদের বাসার দক্ষিনে যে প্রাইভেট হাসপাতাল, সেখানে ভর্তি করে রেখে এসেছি।” কাঁদতে কাঁদতে রাফায়েতের আম্মু কথাগুলো বললেন। আমি চুপচাপ শুনছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, প্রচণ্ড গরমের ভিতর দিয়ে হাঁটছি, আর কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। রাফায়েতের এক্সিডেন্ট! ইচ্ছা করছে বাচ্চা মেয়েদের মত ভেউ ভেউ করে কান্না করি। কিন্তু কাঁদলে তো হবেনা এখন। আমাকে রাফায়েতের কাছে যেতে হবে।
“আন্টি, আংকেল কোথায়? উনি আসেন নি?”
“মা, রাফায়েতের তো আমি ছাড়া আর কেউ নাই।” কান্নার দমকে উনার কথা আটকে যাচ্ছিল। আমার ভেতরটা কেমন যেন অবসন্ন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছি একের পর এক দুঃসংবাদগুলো শুনতে শুনতে। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই!
“আন্টি, হঠাৎ এই সমস্যা হয়ে গেছে, টাকা পয়সার কোনও যোগাড়যন্ত্র হয়েছে?”
“না মা, আমার কাছে যা ছিল, তা দিয়েই আপাতত খরচ করছি। আরও লাগবে কিনা কে জানে। আমি কী করব কিছু বুঝতে পারছিনা।”
“আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি হাসপাতালে যান। আমি বিকালের মধ্যে আসব। একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। ভয় পাবেন না, আল্লাহ সাথে আছেন।”
“ঠিক আছে মা, আমি তাহলে রওনা হই। ছেলেটা আমার একা একা। কী অবস্থা কে জানে। রাখি।”
বিপ বিপ বিপ... ফোন কেটে গেল আর আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কী করব। এত টাকা আমি কোথায় পাব? চাইলেও তো আমাকে দেবেনা মা । সৎ মা হিসেবে উনি যে রুপ আমাকে দেখিয়েছেন, এর পরেও উনার কাছে টাকা চেয়ে বোকামি করার মত বোকাও নই আমি। আর আব্বুর সাথে তো সেই কবে থেকেই দূরত্ব এসে গেছে। উনাকে বলতে যাওয়াও অর্থহীন। কিন্তু এখন আমি কী করি? রুমের ভেতর এই মাথা থেকে ঐ মাথায় পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ একটা আইডিয়া মাথায় এল। কিন্তু, এটা করার পর যে আমার কী হবে, আমি তার কিছু ভাবতে পারছিনা। যাক, যা হওয়ার হোক, এই মুহূর্তে রাফায়েতের জন্য সব জায়েজ আমার কাছে। জামাটা পালটে নিয়ে রুমের বাইরে গেলাম। রুনু, আমার সৎবোন, ও টেবিলে বসে অংক করছে, মায়ের রুম খালি, কেউ নেই। রুনুকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে, কোথায় গেছে আম্মু।
“রুনু, আম্মু কই রে?”
“জান না মনে হয়, আম্মু তিন তলার আন্টির বাসায় প্রতিদিনই তো এই সময়ে যায়।”
“ও আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলে গিয়েছিলাম। রুনু, এক কাজ কর, আমার একটা কলম লাগবে। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তুই নিচ থেকে একটা কলম নিয়ে আয় আপুর জন্য। জলদি যা।” এই বলে ওর সামনে একটা দশ টাকার নোট রেখে দিলাম।
রুনু পেনসিলটা রেখে টাকাটা দুমড়ে মুচড়ে হাতে পুরে, মুখ থমথমে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আর আমি এক দৌঁড়ে আম্মুর রুমে ঢুকলাম। চাবিটা আলমারির উপরেই রাখা আছে। জলদি চাবি দিয়ে আলমারিটা খুলতে লেগে গেলাম, আমার হাত ঠকঠক করে কাঁপছিল। বেশ কিছুক্ষণ গুঁতাগুঁতির পর খুলে গেল। চটজলদি ড্রয়ারে হাত দিলাম খোলার জন্য। টানাটানি করার পরও খুলছে না। কী বিপদ! কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নেমে আসছে। খুলতে পারছি না এই ড্রয়ারটা। ওপাশের ড্রয়ারটা টান দিলাম এবার। তেমন কিছু নেই এখানে। নিচের লকারে অবশ্য আম্মুর গয়নাগাটি থাকে। সেখানে খুঁজতে লাগলাম এবার। এক কোণে কাগজে মোড়ানো একটা স্বর্ণের চেইন দেখতে পেলাম। জলদি সেটাকে পকেটে পুরে আলমারি আটকে দিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে দেখি রুনু দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে, আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি, রুনু দেখে ফেলেছে। কিন্তু, এখন আমার দেরী করার মত সময় নেই। রুনুকে পাশ কাটিয়ে সাত-পাঁচ না চিন্তা করেই ছুট লাগালাম। আমি জানতাম, এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, কিন্তু কতটা ভয়াবহ, সেটার মোটেও আন্দাজ ছিলনা আমার।
-
স্বর্ণের দোকান থেকে টাকাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা রিকশার খোঁজ করতে লাগলাম। আজ কোনও রিকশাও পাচ্ছিনা। অন্যদিন আমাকে রিকশায় চাপিয়ে বয়ে বেড়ানোর জন্য যেন রিকশাওয়ালাদের প্রতিযোগিতা হয়। আজ আর কেউ নেই। দরকারের সময় আসলেই কিছু পাওয়া যায়না। কিছুক্ষণ রিকশার জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটার এক ফাঁকে ঘড়ি দেখে নিলাম। সাড়ে চারটা বাজে। রাফায়েতের কি অবস্থা কে জানে। নানা ভাবনা চিন্তার মধ্য দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে রুম নাম্বার জেনে সোজা দোতলায় চলে গেলাম। দেখলাম, দুইশ বার নাম্বার কেবিনের সামনে এক মহিলা বসে আছেন, ইনিই হয়ত রাফায়েতের আম্মু।
“আন্টি, আমি রশ্মি, দুপুরে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছিল, চিনতে পারছেন?”
“হ্যাঁ, মা, আমার ছেলেটার কি হবে?” বলেই আন্টি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে শিশুদের মত কাঁদতে লাগলেন। প্রচন্ড দুঃখবোধ হলে কি শিশু শিশু ভাব প্রবল হয়ে ওঠে? হতে পারে! আমিও উনাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আমার মা’কে আমি জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাইনি, আমার জন্মের সাথে সাথেই উনার মৃত্যু হয়। আর সৎমা আমাকে তার মেয়ে মনে করেনি। জড়িয়ে ধরার আদিখ্যেতা করার জন্যও মনের মত মানুষ লাগে, আত্মার মানুষ! আমি আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম, আর ব্যাগ থেকে বিশ হাজার টাকা বের করে উনার হাতে দিলাম। উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বলতে পারলেন না। হয়ত মনে মনে নিজেকে ছোট ভাবছেন, নিজের ছেলের জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে এটা ভেবে হয়ত মনঃকষ্ট পাচ্ছেন। আমিই উনাকে মুক্তি দিলাম এই অপরাধবোধ থেকে। বললাম, “আন্টি, এই টাকাটা আমার নিজের। অনেকদিন ধরে জমিয়ে রেখেছি। আপনি এটা রাখুন। আমি জানি, হয়ত দরকার পড়বে। রিস্ক নেয়ার দরকার কী? এটা রাখলে আমি অনেক খুশি হব। কিন্তু রাফায়েতকে এটা বলবেন না, ও যে রাগী আর অভিমানী, এটা শুনলে খুব কষ্ট পাবে, রাগ করবে। আমার কথাটা রাখবেন আন্টি প্লিজ।”
উনি কিছু বললেন না। শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। আমি হাত পেতে দিলাম আমার, উনার চোখের জলে আমার রুক্ষ হাতটা ভিজে উঠল। হয়ত এটাই আমার জন্য আশীর্বাদ!
রাফায়েতের পাশে বসলাম কিছুক্ষণ। যতটা সময়ই বসে ছিলাম, কিছু বলতে পারিনি। কান্না এলেও জোর করে চেপে ধরে রাখলাম। মনের সাথে মনের মিল থাকলে নাকি পিনপতন নিস্তব্ধতায়ও মনের কথা শোনা যায়। আমি জানি না, রাফায়েত আমার মনের কথা পড়তে পারছে কি না। যদি পারত, তাহলে হয়ত জানত, এই পাগল ছেলেটার জন্য কতখানি ভালবাসা বুকে পুষে রেখেছি আমি!
বাসায় ফেরার পথে ফোন করলাম আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী, রেশমাকে। ও আমার সাথে একই কলেজে পড়ে না, তা সত্যি, তবে ও-ই আমার একমাত্র কাছের বান্ধবী। ফোন করে সব জানালাম ওকে। আমার পাগলামীর কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল রেশমা। ও আশঙ্কা করল, আজ বাসায় গেলে আমার কপালে অনেক বিপদ আছে। আমার যে ভয় লাগছিল না, তাও কিন্তু না। কিন্তু, রাফায়েতের জন্য এর চেয়ে ভয়ংকর কিছু যদি আমাকে করতে হত, তাহলে আমি সেটাও করতে রাজি ছিলাম। রেশমার সাথে কথা শেষ করে একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম দ্রুত। দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, মা ছাড়াও আরও পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছে বসার রুমে। আজ হয়ত এদের সবার সামনে আমার বিচার হবে। আমি ভেতরে ঢুকতেই মা আমার চুলের গোছা ধরে আমাকে টেনে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললেন। তারপর, রুলটানা স্কেলটা দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলেন।
“চোরের বাচ্চা চোর, আমার স্বর্ণের চেইন চুরি করে কী করছিস, বল? মনে করছিলি, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না, তাই না? তোর চুরি করা আজ জন্মের মত আমি ঘুচায়ে দিব।” এই বলে আমাকে আরও জোরে মারতে শুরু করলেন। আমি বাধা দিলাম না, কারণ, আমি এই পরিণতি হবে জেনেই এই কাজটা করেছি। পাশ থেকে দু’তিনজনকে বলতে শুনলাম, “ছি ছি, সৎ মা হোক, তাই বলে তার জিনিস চুরি করবা তুমি? ছিহ, তুমি না লেখাপড়া জানা মেয়ে?”
কথাগুলো যেন আমার কলিজা কেটে খচ করে ভেতরে ঢুকে গেল। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি নেমে এল, তবুও বাধা দিলাম না আমি। আজ এটুকু আমার পাওনা।
-
গায়ে খুব জ্বর এসেছে। কিন্তু আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে। সেটার প্রিপারেশন নিতে হবে। এমনিতেই গত পরীক্ষাগুলো তেমন একটা ভাল হয় নি। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলাম। উহহ, ঠোঁটের কাটা জায়গাটা জ্বলছে ভীষণ। বিছানা থেকে উঠতে পারছিনা। মা কথা বলছেন বাবার সাথে ফোনে, আমি শুধু মায়ের গলার আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। বাবা ওপাশ থেকে কী বলছেন তা শুনতে না পারলেও অনুমান করতে পারছি। মা চিৎকার করছেন, বাবা এসে এর একটা বিহিত না করলে উনি আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। আমাকে মেরে ফেলবেন! আমি চোখ বন্ধ করলাম। চোখের পানি একপাশ দিয়ে গড়িয়ে কানের গহ্বরে ঢুকে গেল। জীবনটা তেতো মনে হতে লাগল আমার কাছে। একটা ইট পাথরের দেয়ালে যেন আমি বন্দী হয়ে আছি, যেখান থেকে মৃত্যু ছাড়া নিস্তার পাবার উপায় নেই। হঠাৎ কপালে কেউ হাত রাখল যেন। অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখলাম রুনু দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে দেখেই তড়াক করে বসে পড়লাম। মা ওকে দেখতে পেলে আস্ত রাখবেনা।
“আপু, এই ওষুধটা লাগিয়ে নাও। তোমার ব্যথা কমে যাবে।”
আমি ওর হাতের এন্টিসেপ্টিক মলমটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জীবনে কখনও কী আমার এই মলমের দরকার হয়েছে? না, হয়নি। সব কাটা-ছেঁড়া এমনি এমনিই সেরে গেছে। আজ এই মলম দিয়ে আর কী হবে?
“তুই যা, মা দেখলে তোকে বকবে আবার। তুই যা এখান থেকে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে রুনু হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, কী বলব, কী করব।
“আপু, আমি আর কখনও তোর নামে আম্মুর কাছে কিছু বলবনা, আমি সরি।”
“সরি বলতে শিখেছে! দে মলমটা, তুই যা এখন।”
হাতে মলমটা গুঁজে দিয়ে রুনু লাইট নিভিয়ে দিল। আমি অন্ধকারে বসে থাকলাম। চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আমার ঘর, হয়ত আমার মনটাও। এই আলো কি মানুষের জীবন থেকে সব আঁধার মুছে দিতে পারেনা? পারে হয়ত। সেটাও হয়ত সবার জন্য না, অন্তত আমার জন্য না!
-
পরদিন কলেজ শেষ করে রাফায়েতকে দেখতে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছে, পায়ের কোনও হাড় ভাঙ্গেনি। তবে একটা হালকা ফ্র্যাকচার আছে। ওটা সারতে সপ্তাহ দুয়েক একদম বেডে থাকতে হবে। দু’দিন পর ওকে রিলিজ করা হবে। রাফায়েতের কেবিনে উঁকি দিলাম, ঘুমুচ্ছে ছেলেটা। কেমন মায়াবী লাগছে, কী অদ্ভুত একটা ভাল লাগা। হঠাৎ আন্টি আমার পিঠে হাত রাখলেন।
“কখন এলে? ওমা, তোমার মুখে এগুলো কিসের দাগ?”
“এগুলো......এগুলো হল, ঐতো আজ ক্লাসে পড়া পারিনি তো, তাই স্যার মেরেছে।”
“পড়া পারনি বলে এভাবে মারল? ছিহ। ব্যথা লেগেছে খুব, না?”
জবাবটা আর মুখে দিতে পারলাম না। হ্যাঁ, অনেক ব্যথা লেগেছে, কিন্তু আমি এই ব্যথাটুকু সহ্য না করলে তোমাকে অনেক ব্যথা পেতে হত, কষ্ট পেতে হত রাফায়েতের জন্য। কিছু করতে না পেরে আমিও দুঃখ পেতাম। আমার একটু কষ্টে যদি কেউ ভাল থাকে, সেটাই ভাল। তারপর ভালমন্দ আশা-আশ্বাস দিয়ে রাফায়েতকে দু’দিন পর বাড়ি নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি বাসার পথ ধরলাম।
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ পর রাফায়েতকে ফোন দিলাম। ওর ফোনটা বিজি বলছে। হয়ত সবাই ওর খবর নিচ্ছে, ওর এক্সিডেন্টের খবরটা আমিই সবাইকে দিয়েছি। ভাবলাম, রেশমাকে একটা কল দেই। আমার ভাল-মন্দ দিনের খবর ও ছাড়া এত ভাল করে আর কে জানে। ফোন করলাম রেশমাকে। বললাম ওকে, যা ঘটেছে। ওপাশের দীর্ঘশ্বাস আর আমার শরীরের ব্যথা- দুই মিলিয়ে সন্ধ্যাটা কেমন বিষাদের গোধূলিতে ছেয়ে গেল, ঐ গোধূলীর রঙ যেন আমার হৃদয়ের রক্তপাত।
রাতে রাফায়েতের ফোনটা ফ্রী পেলাম। ভাবলাম, ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে কে জানে। আমারও শরীরটা মোটেও ভাল লাগছেনা। জ্বর আসছে যেন। চোখ দুটো খুলে রাখতে পারছিনা। একটু পর রাফায়েতের নাম্বার থেকে কল আসল। দ্রুত রিসিভ করলাম আমি।
“হ্যালো, রাফায়েত, কেমন আছিস এখন?”
“ভাল, কে? রশ্মি নাকি?”
“হ্যাঁ, আমার নাম্বার সেভড নেই তোর সেল এ?”
“না আসলে, আমি ভেবেছি তন্নী... আচ্ছা কেমন আছিস? মা তোর কথা বলেছিল অবশ্য, তুই নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলি। মা অনেক প্রশংসা করল তোর।”
একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। আন্টিটা না জানি কী বলেছে। কেনও যেন খুব হাসি পেতে লাগল আমার, লজ্জার হাসি।
“ওসব ছাড়। তুই কেমন আছিস এখন? পায়ের ব্যথাটা কি কিছুটা কমেছে?”
“হ্যাঁ, আমি ফিট আছি। দেখবি, সপ্তাহ দুয়েক পরই আমি কলেজে ব্যাক করব। আচ্ছা, তোকে একটা ছেলে পছন্দ করত যে, রাব্বি নাম, ওর কী খবর?”
“আরে ছাড় তো। তোর এইটা এখনও মনে আছে? এই কাহিনীর ল্যাটা তো কবেই চুকে গেছে। হঠাৎ এই প্রশ্ন যে?”
“না এমনিতেই। মনে পড়ল আর কি। এই শোন, আমার পারমিশন না নিয়ে রিলেশন করতে যাস না যেন, কেমন? মনে থাকবে?”
বোকা ছেলেটা, তোর পারমিশন পেলেও তো করব না। আমার মনে তুই ছাড়া আর কারও থাকার অধিকার নেই, দেব না আমি কাওকে সেই অধিকার।
“আচ্ছা, থাকবে। এখন তুই রেস্ট নে। আমি রাখছি। ভাল থাকিস।”
-
পরের দু’তিনদিন আমি জ্বর গায়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। কেউ দেখতে এল না। বাবা এলেন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে। কিন্তু আমার সাথে দেখা করলেন না। রুনু বাবাকে বলেছে, আপুর অনেক জ্বর। তবুও বাবা একটি বার এলেন না আমাকে দেখতে। হয়ত রাগ করেছেন খুব, মায়ের গয়না চুরি করেছি, রাগ তো হবারই কথা।
কপাল মন্দ হলে যা হয়, তাই হল। বিকেলের দিকে কলেজের একজন স্যার এলেন বাসায়। আমি শুধু শুনছিলাম, স্যার বলছেন, আমার রেজাল্ট গত কয়েক মাস ধরে খারাপ হচ্ছে। বাবা ছিলেন না, মা তাই যাচ্ছেতাই বলেছেন স্যারকে। আমি নাকি পড়ালেখা করি না, পড়ার ভান করে বসে থাকি বই খুলে, কলেজেও যাই কিনা কে জানে, আমি বখে গেছি, এই সেই। তারপর সন্ধ্যায় বাবা এলে মা নালিশ দিলেন। একটু পর, বাবা আমার রুমে আসলেন। আমি ভাবলাম, বাবা হয়ত সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন। আমার কাছে আসার সময় পান নি। তাই এখন এসেছেন। মনে মনে একটু খুশি হলাম আমি। বাবার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠোঁটের ব্যথাটার জন্য হাসতে পারলাম না। কিন্তু বাবার হাতে ওটা কী? একটা কাগজ, রেজাল্ট কার্ডের মত মনে হচ্ছে, আমার রেজাল্ট কার্ড! কার্ডটার দিকে একবার তাকালাম। উপরে লাল কালিতে বড় করে F লেখা। বাবা আমার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে ঠাস করে চড় মারলেন একটা। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম বিছানার এক কোণায়। মাথার কোথায় যেন পিনপিন করছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। বাবার এই কাজে অবাক হবার আগেই আমার হঠাৎ মনে হল, সব আঁধার, আঁধার ঘেরা।
-
পরদিন চোখ মেলে নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করলাম। বুঝতে পারলাম, আমাকে মেরে বাবার মনে কোনও প্রকার অপরাধবোধ নেই। তাই অতশত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে হাত-মুখ ধুয়ে কলেজের ড্রেস গায়ে চাপিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিন্তু আজ কলেজে যাবনা, রাফায়েতের বাসায় যাব। ওকে দেখতে যাব। মনে যতটুকু কষ্ট জমে আছে, রাফায়েতকে না দেখলে সেটা কমবেনা। ওদের বাসার সামনে এসে দরজাটা খোলা দেখতে পেলাম। ভিতরে যাব কী যাব না ভাবছিলাম। দরজার বাহিরে একজোড়া হাই হিল রাখা। নিশ্চয়ই কেউ এসেছে ওদের বাসায়। ভেতরে ঢুকলাম আমি। দুটোই ঘর মোটে, তার মধ্যে একটায় ফ্লোরে বিছানা পাতা, এলোমেলো বইপত্র রাখা। মনে হয়, এটা রাফায়েতের রুম। ও অসুস্থ থাকায় হয়ত আন্টির রুমে আছে। আমি আন্টির রুমে উঁকি দিতেই এমন কিছু দেখলাম, আমার নিজের চোখ দুটাকে বিশ্বাস হল না। মনে হল, আমি এখনও বাবার হাতে মার খেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছি, ভুলভাল স্বপ্ন দেখছি। রাফায়েত আমাদের জুনিয়র ক্লাসের একটা মেয়ে, তন্নীকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আমি খুব নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললাম। যদি ওরা টের পেয়ে যায়, কি ভাববে? ভাববে কিছু না কিছু অবশ্যই, কিন্তু আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, সেটা দেখতে তো পারবেনা। আমার ভেতরটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগল। মনে হল, কত কাল ধরে এই হৃদপিণ্ডে স্পন্দন হয়নি, চোখের পলক পড়েনি। আমি ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় নেমে এলাম। আকাশ গর্জন করছে, যে কোন মুহূর্তে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে বৃষ্টি নামবে। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। ফুটপাত কেটে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগলাম। দু’তিনটা ছেলে শিষ মারল আমাকে দেখে, একটা গাড়ি পাশ ঘেঁষে যাবার সময় ময়লা কাদায় আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল, আমার ভ্রুক্ষেপ নেই আজ। আমার যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
-
রাতে রাফায়েতকে ফোন দিতে খুব ইচ্ছা হল, কিন্তু দিলাম না। রাফায়েত কী কখনও বুঝতে পারেনি, আমি ওকে কতটা ভালবাসি। আমি ওকে বুঝাতে পারি নি? আমি তো চেষ্টাই করিনি। না, আজ আমাকে চেষ্টা করতে হবে। যা হবার হোক। কয়েকবার রিং হবার পর রাফায়েত ফোন তুলল।
“হ্যালো, রশ্মি বল।”
“রাফায়েত, আমার তোর সাথে কথা আছে, জরুরি কথা।”
“এত রাতে হঠাৎ তোর জরুরি কথা মনে পড়ল? তোরা মেয়েরা পারিস ও বটে। কী কথা, শুনি?”
“আমি তোকে ভালবাসি রাফায়েত।”
মনে হল কোথাও বিস্ফোরন হয়েছে, চারদিকে সবাই ছুটোছুটি করছে। শুধু আমার আর রাফায়েতই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি চুপচাপ। আমার চোখ ভিজে উঠছে। রাফায়েত কী আমাকে ফিরিয়ে দেবে?
“আসলে রশ্মি, হয়েছে কী, আমি তো আসলে.........”
মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে পাগলের মত বলে উঠলাম, “আসলে তুই কী, হ্যাঁ? তুই তন্নীকে ভালবাসিস? তন্নীকে? তুই জানিস, ও এই পর্যন্ত কয়টা ছেলেকে ঘুরিয়েছে? তুই ওর সাথে...আর আমি? আমি যে তোকে ভালবাসি, এটা কী তুই কখনও এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারিস নি? একবারও আমার কথা ভাবিস নি তন্নীর সাথে রিলেশন করার আগে আমার কথাটা?”
“দেখ রশ্মি, আমি জানি, একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের ভাল কোনওদিন বলতে পারে না, তাই তন্নীর ব্যাপারে তুই যা যা বললি, আমি গায়ে মাখলাম না। মেয়েটা আমাকে অনেক ভালবাসে। আমার করার মত কিছু নেই। দেখ, আমরা বন্ধু আছি, বন্ধুর মত থাকব, সেটাই ভাল। কিন্তু একটা কথা, তুই যদি ভবিষ্যতে ওর ব্যাপারে উলটাপালটা কিছু বলিস, তাহলে আমাকে তোর সাথে বন্ধুত্ব ডিসমিস করতে হবে। সো, বেটার ইউ ফরগেট দিজ ম্যাটার, টেক ইট ইজি।”
আমি কোনও প্রত্যুত্তর দিলাম না। আমার আওয়াজ না পেয়ে ফোন কেটে দিল রাফায়েত। আর আমি ডুবে গেলাম একরাশ হতাশায়।
-
কয়েকদিন বাসা থেকে বের হলাম না। কলেজেও গেলাম না। মাঝে রেশমা বারকয়েক ফোন দিল। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মত অবস্থা ছিল না। এর মাঝে রাফায়েত কলেজে গিয়ে জানতে পারল, আমি কলেজে আসছিনা কয়েকদিন ধরে, তাই হয়ত আমাকে ফোন দিল।
“হ্যালো, রশ্মি, কেমন আছিস?”
আমি উত্তর দিলাম না। দিতে পারলাম ও না, কান্নাগুলো যেন কাগজের টুকরা হয়ে আমার গলায় আটকে আছে। কিছু বলতে পারছি না, পারছি না বোঝাতে, আমি কি নিদারুন কষ্টে আছি।
“ দেখ রশ্মি, এভাবে করলে হবে? পরীক্ষা খারাপ হবে শুধু শুধু। এমন করিস না।”
“কেমন করব রাফায়েত, তুই বলে দে।”
আমার প্রশ্নের ধরণটা শুনে চুপ মেরে গেল রাফায়েত। আমি মন দিয়ে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছিলাম। এত আপন লাগে ওকে, এত ভালবাসি, আর ও আমার কথাটা কোনওদিন ভাবেনি। এমন সময় রেশমার কল আসল। আমি কনফারেন্স করে নিলাম তিনজনের।
“হ্যালো, রশ্মি, তোর জ্বর কমেছে? গায়ের ব্যথাগুলো সেরেছে? ওষুধ নিয়েছিলি?”
রাফায়েত এবার অবাক হল, জ্বর, গায়ের ব্যথা, এগুলো কী?
“হ্যালো, কে?”
“আমি রেশমা, আপনি কে?”
“ও, আমি রাফায়েত। রশ্মির বন্ধু। একসাথে পড়ি।”
“ও আপনিই সেই রাফায়েত?” রাফায়েত একটু অবাক হল। রেশমা নামের কেউ ওদের ক্লাসে পড়েনা। আর সেই রাফায়েত, এভাবে বলল কেন মেয়েটা?
“ সেই রাফায়েত মানে বুঝলাম না। আপনি আমাকে চেনেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, চিনি, ভাল করে চিনি। আপনি একটা স্বার্থপর শ্রেণির মানুষ। আপনি একটা......”
রেশমাকে থামিয়ে দিলাম আমি। কী সব ভুলভাল বকছে পাগলীটা। রাফায়েত কী মনে করবে এসব শুনে। ভাববে, আমি মানুষের কাছে এসব বলে বেড়াচ্ছি। উফফ, আর কত যন্ত্রনা আমাকে নিতে হবে?
“রেশমা, থাম প্লিজ।”
“না, থামবে কেনও? বলুন রেশমা, কী বলছিলেন? আমি স্বার্থপর? কী স্বার্থপরতা করেছি আমি আপনার সাথে?”
“এখনও জিজ্ঞেস করতে আপনার লজ্জা করছে না? কেমন মানুষ আপনি? আপনার জন্য মেয়েটা বাসা থেকে মায়ের গয়না চুরি করে, বিক্রি করে, হাসপাতালে আপনার খরচের সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। বাসায় ফেরার পর ওর সৎ মা ওকে প্রচুর মেরেছে, ওর বাবা ওকে ভুল বুঝেছে। এরপরেও আপনি বলছেন, আপনি কী স্বার্থপরতা করেছেন? লজ্জা করেনা আপনার?”
রাফায়েতের গালে যেন চড় মেরে গেল কেউ। রশ্মি এসব...... কিন্তু ও তো কিছুই জানত না। কিছু জানত না রাফায়েত। মা’ও ওকে কিছু বলে নি, রশ্মিও বলেনি।
“দেখুন, আমি আসলে এসব কিছুই জানতাম না।”
“জানতেন না? এটা না হয় জানতেন না, কিন্তু আপনি যে একটা থার্ড ক্লাস প্রস্টিটিউট টাইপের মেয়ের সাথে রিলেশন.........”
কথাটা শেষ করতে না করতেই যেন বাঘের মত গর্জে উঠল রাফায়েত। আমার বুক ধ্বক করে উঠল। আমি কখনও রাফায়েতকে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনি নি, এই প্রথমবার।
“খবরদার, তন্নীর সম্পর্কে আর একটা বাজে কথাও শুনতে চাইনা। আপনার ভালবাসার মানুষের নামে আপনাকে কেউ খারাপ কথা বললে আপনি সহ্য করবেন? নেহাত আপনি একটা মেয়ে, তাই ছেড়ে দিলাম আপনাকে। না হলে...”
কথা শেষ করার আগেই ফোন কেটে দিল রেশমা। আমি কাঁদতে লাগলাম। আমি চাই নি রেশমা আমার জন্য কিছু বলুক, আমার জন্য তন্নীকে খারাপভাবে রাফায়েতের সামনে উপস্থাপন করুক,সেটা সত্যি হোক, বা মিথ্যাই হোক, আমি এসবের কিছুই চাইনি। রাফায়েতও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
“রশ্মি, তুই আজকের পর থেকে এই মেয়েটার সাথে আর কখনও কথা বলবি না। এটা আমার অর্ডার।”
কথাটা শুনে আমার মাথায় ঝাঁ করে রক্ত উঠে গেল। প্রেম করবে তন্নীর সাথে, আর অধিকার খাটাবে আমার উপর? বাহ, কি বিচার!
“রাফায়েত, তুই আমার উপর অধিকার খাটাতে পারিস না। তোর যদি অধিকার খাটানোর ইচ্ছা থাকে, তুই তন্নীর উপরে খাটা। কিন্তু, আমি তোর কথাটা মানতে পারলাম না। আমি রেশমার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে পারব না। এবার তোর যা ইচ্ছা তুই কর।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমি ফোনটা কেটে দিলাম। ওদিকে ক্রুদ্ধ রাফায়েত ফোনটা বিছানায় আছড়ে ফেলে বাহিরে চলে গেল।
রেশমার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। রেশমা অনুচিত কিছু বলেনি। যা বলেছে, একদম সত্যি বলেছে। কারণ, তন্নী রেশমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথেও সম্পর্কে জড়িয়েছিল। অনেক টাকাপয়সা উড়িয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে ছেলেটাকে বিদেয় করে দিয়েছে। রাফায়েত আঘাত পাবে ভেবে হয়ত রেশমা এসব কিছুই বলেনি।
“রেশমা, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, বল। কথা শেষ ঐ বেয়াদবটার সাথে?”
“প্লিজ এভাবে বলিস না। আমি সরি, আমার জন্য তোকে কড়া কড়া কথা শুনতে হল। রাফায়েত আসলে আমাকে বা কাওকে বিশ্বাস করতেই চাইছে না যে, তন্নী মেয়েটা...”
“বাদ দে ওর কথা। তোকে আমি যেভাবে বলি, সেভাবে শুনবি। কাল কলেজে যাবি, তারপর তোকে একটা ছেলে প্রপোজ করেছিল না? রাব্বি? ওকে খুঁজে বের করবি। বুঝতে পেরেছিস?”
“হ্যাঁ, তারপর?”
“এরপর ওর সাথে কয়েকদিন হেসে হেসে কথা বলবি, রাফায়েতকে দেখিয়ে দেখিয়ে। দেখ, কী হয়?”
“আচ্ছা রেশমা, তোর কী মনে হয়, আমি এসব করলে ও আমার কাছে ফিরে আসবে? আসলেও সেই আসাটা কী আদৌ ভালবাসার কারণে হবে? নাকি শুধু জেলাসির কারণে?”
“এত কিছু তোর ভাবতে হবেনা, করতে বলেছি, করবি ব্যস। আচ্ছা শোন, আমি এখন রাখছি। আমার একটা কল আসছে।”
“কল? এত রাতে? এত রাতে তো তুই কারও সাথে কথা বলিস না, ইভেন আমার সাথেও না।”
“আসলে তোকে বলার সুযোগ পাইনি, একচ্যুয়ালি, আই থিঙ্ক আই এম ইন লাভ।” রেশমার কণ্ঠটা কেমন যেন লাজুক লাজুক হয়ে গেল। ভাল লাগল আমার। আমি সুখে নেই, তাতে কী? আমার ফ্রেন্ডটা ভাল আছে, এটাই বড় কথা।
“তাই? কবে হল বললি না তো। দেখা করিয়ে দিস আমার সাথে অবশ্যই। তোদের দুইজনের জন্যই দো’আ রইল। ভাল থাকিস তোরা।”
ফোনটা রেখে দিয়ে ছাদে গেলাম। বৃষ্টি হয়ে ছাদটা ভিজে আছে একদম। ভেজা ছাদের উপর শুয়ে পড়লাম। আকাশটা পরিষ্কার, ফকফকা। লক্ষ অগনিত তারা যেন আমাকেই চেয়ে চেয়ে দেখছে, আর ভাবছে, এত কষ্ট কেনও মেয়েটার মনে!
-
পরদিন কলেজে গিয়ে রাব্বিকে খুঁজে বের করলাম, হেসে হেসে কথা বললাম। রাফায়েত সব দেখছিল, আমি ওর দিকে না তাকিয়েও সেটা ধরতে পারছিলাম। জেলাস হচ্ছে ও? হোক, এটাই ওর জন্য উচিত। ক্লাস শেষ করে প্রতিদিন আমি রাফায়েতের সাথেই বাসায় ফিরি, কিন্তু আজ রাব্বিকে বললাম, আমাকে বাসা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে। কলেজের গেইট পার হয়ে মন্টু ভাইয়ের দোকানে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম আমি আর রাব্বি, এমন সময় রাফায়েত হাজির।
“রাব্বি, আমার রশ্মির সাথে একটু কথা আছে।”
“তোর যা কথা, পরে বলিস। আমি এখন রশ্মিকে বাসায় ছেড়ে দিয়ে আসব।”
“কেনও? তুই ওকে বাসায় ছেড়ে আসতে যাবার কে? ওর বাসা অবধি আজ পর্যন্ত আমিই ওকে এগিয়ে দিয়ে এসেছি। আজও আমিই যাব।” রাফায়েতের মুখের পেশী টানটান হয়ে যায় জবাব দিতে গিয়ে। আমার কেনও যেন ভয় লাগে, যদি এরা দু’জন এখন মারামারি শুরু করে। কী হবে?
“রাব্বি, আজ না হয় রাফায়েতের সাথেই গেলাম। তোর সাথে আরেকদিন যাব, কিছু মনে করিস না।”
রাব্বি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর, ঝালমুড়ির প্যাকেটটা ফেলে পায়ের নিচে পিষে, হাঁটা ধরল ওর বাসার দিকে। ঝালমুড়িওয়ালার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আমি আর রাফায়েত হাঁটতে শুরু করলাম। পুরোটা পথ নিশ্চুপ হয়ে হাঁটার পর, বাসার কাছাকাছি আসতেই রাফায়েত আমার হাত চেপে ধরল।
“কী হল, ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি তো হাতে, লাগছে খুব।”
“ছাড়ব, তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দে সত্যি করে।”
ওর মুখের দিকে তাকালাম। কেমন যেন একটা ক্রোধ ছড়িয়ে আছে ওর পুরো চাহনীতে। মনে হচ্ছে, এই ক্রোধের আগুনে আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে ও। কেনও? এত রাগ কেনও?
“তোর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে কী আমি বাধ্য?”
“বাধ্য কী অবাধ্য এত কথা তোর জানার প্রয়োজন নেই, আমারও শুনার প্রয়োজন নেই। তোকে তো রাব্বি প্রপোজ করেছিল, তখন তো পাত্তা দিস নি। এখন রাব্বির সাথে কথা বলিস কেনও? কেনও রশ্মি, বল?”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর মুখের দিকে। কি শুনতে চায় ও আমার কাছে? আমাকে তো ভালবাসে না, ভালবাসে ঐ তন্নীকে। কিন্তু, অধিকার খাটাচ্ছে আমার উপর। কী চায় ও আমার কাছে? রাফায়েতের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আলগোছে।
“কারণ, আমি যাকে পাত্তা দিয়েছি সবসময়, তার কাছেই আমার আজ আর পাত্তা নেই, লাপাত্তা হয়ে গেছি আমি তার জীবন থেকে।” কথাটা বলেই বাসার দিকে পথ ধরলাম। একবারও তাকিয়ে দেখলাম না, রাফায়েত কেমন অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-
বিকেলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম, দেখলাম রাফায়েত ওর বাসার পাশের টং দোকানটায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ছেলেটা সিগারেট খাওয়া শুরু করে দিয়েছে? এত অধঃপতন ওর কবে থেকে হল? ওকে দেখেও না দেখার ভান করে আমি দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।
“রশ্মি, দাঁড়া।”
আমি দাঁড়ালাম না, বরং ওর গলা পেয়ে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। এবার পেছন থেকে ও দৌঁড়ে এল। পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা।
“কথা বলবি না আমার সাথে?”
আমি ‘না’ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। কেনও কথা বলব? আমি কী ওর সাথে কথা বলার কেউ? কেউ না। কেনও কথা বলব তাহলে? বাসার প্রায় কাছে চলে এসেছি দেখে এবার রাফায়েতকে বললাম, “তুই এবার যা, আমি বাসায় ঢুকব এখন। কেউ দেখলে সমস্যা হবে। এমনিতেই আমার সমস্যার শেষ নেই। আর পারলে, এসব সিগারেট, ছাইপাশ খাওয়া ছেড়ে দিস।”
রাফায়েত ফিরে যাওয়ার বদলে আমার পেছন পেছন আসতে লাগল। ব্যাপার কী? ও যাচ্ছে না কেনও?
“তোকে কী বললাম, প্লিজ যা। কেউ দেখলে আমার সমস্যা হবে তো।” আমার চোখে মুখে ভয় আর উদ্বিগ্নতা খেলা করছিল। অথচ ওর যেন কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। হঠাৎ আমার ডান হাতটা ওর দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। আমি অবাক হয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“আমি সরি রশ্মি। তুই আমার জন্য যা করেছিস, করছিস, আমি সেটা কখনই তোকে ফেরত দিতে পারব না। আমি জানি, তুই আমাকে কতটা ভালবাসিস। সেই হিসেবে আমার ও তোর উপর অধিকার আছে, বল, নেই?”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা নাড়লাম। ও হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি তন্নীকে সত্যি অনেক ভালবাসি। আমি জানি, তুই সবসময় চাইবি, আমি যেন ভাল থাকি, সুখে থাকি। তাহলে তুই কেনও নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছিস? তুই নিজেকে কষ্ট দিলে আমাকে ভাল রাখবে কে বল?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এত জ্বালা করছে কেনও চোখ দুটো? কিছু পড়েছে বোধহয়!
“আমি এখন যাই, রাফায়েত। কেউ দেখবে।”
আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল ও। আমি অবাকের চেয়েও চুড়ান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কী হল এটা?
“তুই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। লাভ ইউ অলওয়েজ এজ এ ফ্রেন্ড। আর খবরদার, আমি ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলবি না। আর আমার...” কথাটা শেষ না হতেই একটা মেয়েলী গলা পেলাম। পাশের বাসার আন্টি............
“ছিহ, রশ্মি, তোমাকে তো ভাল মেয়ে বলে জানতাম, আর তুমি... দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি তোমার আম্মুকে যেয়ে সব বলছি।”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। রাফায়েতও ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে গেল। দেরী না করে ওকে ঠেলে বের করে দিলাম।
“তুই এখান থেকে পালা দ্রুত। আমি সামলে নেব। যা তুই।”
রাফায়েত এক মুহূর্ত দেরী না করে ছুটে চলে গেল। আমি একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চার তলায় উঠলাম। মা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ঘরে ঢোকার জায়গা করে দিল। আমার বুক দুর্ভাবনায় ঢিপ ঢিপ করছিল। আম্মু কী কিছু জানে না তাহলে, পাশের বাসার আন্টি কিছু বলে নি?
কোনওমতে আমার রুমে ঢুকে দেখি পাশের বাসার আন্টি বসে আছে। আমি দ্রুত উনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি ভুল বুঝেছেন আমাকে। সত্যিটা আমাকে বলতে হবে।
“আন্টি, বিলিভ মি, আমার সাথে ঐ ছেলের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা ভাল বন্ধু, শুধু এটুকুই। আমি...” বাকি কথাটুকু মুখেই রয়ে গেল। আম্মু পর্দা ঝোলানোর রডটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
“ভাবি, আপনি বাসায় যান। এর ব্যবস্থা আমি করছি। এর প্রেম-পিরিতির শখ আজকের পর আর থাকবে না, পিটিয়ে এটার হাত-পা আমি ভেঙ্গে দিব আজকে। আপনি যান বাসায়।”
আন্টি আমার দিকে বিদ্রুপাত্মক একটা দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন। আম্মু আমার রুমের দরজা লক করে রডটা হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।
“লোকজনরে দেখায় দেখায় প্রেম করতেছিস, তাই না? তোর মত বেজন্মারে আমি এতদিন খাওয়ায় পরায় বড় করসি? তোরে তো আমার এই বাড়িতে আসার পরেই লাথি দিয়ে বের করে দেয়া উচিত ছিল। সেটা আমি করি নাই, আমার ভুল হইসে। আমার ভুল আমিই শুধরাবো।” এই বলে মা আমাকে বেধড়ক পেটালেন। ইচ্ছেমত ঘা বসালেন, মনের সব ঝাল মিটিয়ে। আমার মনে হল, অনন্তকাল ধরে উনি আমাকে মারছেন, এর কোনও শেষ নেই। মুখের লালায় জামাকাপড় সব ভিজে গেল। হাঁপাতে লাগলাম ক্লান্ত চড়ুই পাখির মত। মা কথ্য-অকথ্য সব গালিগালাজ করতে লাগলেন। আমি চুপচাপ শুনে যেতে লাগলাম, ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছিল। হঠাৎ মাথায় খুব সজোরে আঘাত করলেন মা। এবার আর সহ্য করতে পারলাম না। ‘মা গো’ বলে জোরে চিৎকার দিলাম একটা। খানিকটা রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে চোখ পর্যন্ত নেমে এল, অন্ধকার করে দিতে চাইল দৃষ্টি। এরপরেই সব ঘোলাটে, আর কিছু মনে নেই আমার।
-
সম্ভবত দু’দিন আমি এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। চোখ মেলার পর নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। একটা বেডে শুয়ে আছি আমি। হাতে একটা ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইনের বোতলে টিপ টিপ করে স্যালাইন জমছে, আর ঢুকছে আমার রগে রগে। মাথাটা কেমন পাথরের মত ভারী লা্গছে। নাড়াতে পারছিনা একদম। মাথায় হয়ত ব্যান্ডেজ লাগানো। বাম হাতটা কোনওভাবে তুলে মাথায় হাত দিলাম। এ কী? আমার চুল কোথায়? আমার চোখে পানি এসে গেল। কাঁদতে শুরু করলাম আমি। আমার চুল কোথায় গেল? আমার কান্নার আওয়াজ শুনে নার্স দৌড়ে আসল।
“কী হয়েছে, যন্ত্রণা হচ্ছে?”
“আমার চুল কোথায়, হ্যাঁ?” আমি কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না।
“আসলে, আপনার মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল এক্সিডেন্টের কারণে। অপারেশনের সুবিধার্থে, চুল কেটে ফেলতে হয়েছে। চিন্তা করবেন না, কয়েক মাসের মধ্যেই চুল গজিয়ে যাবে।” এক গাল হাসি হেসে নার্স জবাব দিল।
“আচ্ছা, এখানে আমাকে কে এনেছে?”
“একজন পুরুষ, সাথে একটা ছোট মেয়ে ছিল। আর কাওকে দেখি নি।”
কে এসেছিল? বাবা আর রুনু? হয়তো। বাবাকে নিশ্চয়ই মা এসব বলে দিয়েছে। বাবা আমাকে কী ভাবলেন, ছি ছি ছি। সবার কাছে এভাবে ছোট হয়ে যাব, কোনদিন ভাবিনি আমি। দস্যি এই আমি এভাবে গম্ভীর হয়ে যাব জীবনের দুর্বিপাকে, কে জানত! একটু পর বাবাকে আসতে দেখলাম, নার্সের সাথে কী যেন বলছেন উনি। কেবিনে ঢুকে আমার পাশে বসলেন।
“খুব ব্যথা হচ্ছে?”
বাবার প্রশ্নে আমার চোখে জল এসে গেল। কী উত্তর দেব, ভেবে পেলাম না। মাথায় কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে জানি না, তবে এটুকু জানি, বুকের ভেতরটায় তার চাইতে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক বেশি।
“কী হয়েছিল মা, আমাকে একটু বলবি?”
আমি বাবাকে সব বললাম, সবটা। যা যা ঘটেছিল, তার পুরোটাই বললাম। বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যা হয়েছে ভুলে যা। আমি তোকে এখানে রাখব না আর। তোর কলেজটা শেষ হলে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেব। সেখানে কেউ থাকবে না তোকে কষ্ট দেয়ার।”
আমি বাবার এক হাত জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। অনেকদিন পর একটু শান্তি শান্তি লাগছে। আসলেই দুঃখের পর ক্ষণিকের জন্য হলেও সুখ আসে। আমি বুঝতে পারছি, আমার ভাল লাগছে, বহুদিন পর আমার একটু শান্তি লাগছে।
-
বাসায় ফিরে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। রাফায়েতের একটা মেসেজ। আর কারও কোন কল নেই, মেসেজ নেই। মেসেজটা ওপেন করলাম।
“আমার জন্য তোমার এভাবে ঝামেলা হয়ে গেল, আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি আর কখনও তোমার সামনে আসব না। পারলে তুমিও আমাকে ভুলে যেও। এটাই ভাল হবে।”
একটা ছোট্ট গভীর নিঃশ্বাস ফেললাম। দূরত্ব চলে আসলে তুই থেকে তুমি হয়ে যায় সম্বোধনগুলো? রেশমার সাথে কথা বলতে হবে, মনটা হালকা করতে হবে আমার। ও এই সাত-আটদিনে আমাকে একবারও ফোন করেনি! আচ্ছা, দুর্দিনে আসলেই কী কেউ পাশে থাকেনা?
“হ্যালো, রেশমা?”
“হ্যাঁ, কে বলছেন?”
“আমি, রশ্মি, চিনতে পারছিস না?” আমি অবাক হয়ে গেলাম। রেশমা এই কয়েকদিনের ব্যবধানে আমার কণ্ঠও ভুলে গেছে।
“ও রশ্মি, কী খবর কেমন আছিস, শুনেছিলাম তোর এক্সিডেন্ট। এখন ঠিক আছিস তো?”
“মোটামুটি। তুই একবার আসবি বাসায়?”
“না রে। আমার সময় নেই। আজ রায়হানের সাথে দেখা করার কথা। একটু পরই বের হব। আমি এখন রাখছি, বাই।”
কেটে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুই মিনিট, পনের সেকেন্ড... আবার কষ্ট লাগতে শুরু করেছে। রাফায়েতের কথায়ও যে মেয়ের সাথে আমি বন্ধুত্ব শেষ করি নি, আজ সেই কিনা........
বিতৃষ্ণা এসে গেল জীবনের প্রতি। কেনও এমনটাই হবে আমার সাথে? কেনও? ওদিকে মা, বাবার সাথে খুব চিৎকার- চেঁচামেচি করছে, হয় উনি বাসায় থাকবেন, নয়তো আমি থাকব। আমার কারণে উনি সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারছেন না। কী করব আমি? কীভাবে বাঁচব আমি? ছোট বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলাম।
“আল্লাহ, সাহায্য কর আমাকে, প্লিজ।”
-
শীতের সকাল, বাহিরে মিষ্টি রোদ। আমি একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছি। সকাল সকালই কয়েকটা ছেলেমেয়ে ক্রিকেট খেলছে। আমি দেখছি ওদের খেলা। যদিও ক্রিকেট আমি তেমন বুঝিনা, তবুও ভাল লাগছে দেখতে। একটু দূরে রাফায়েত দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
“ডাক্তার, ওর কন্ডিশন কী বুঝলেন? এখন আগের চাইতে বেটার তো?”
“দেখুন, রশ্মি একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে আর কিছু মনে করতে পারছে না। টোটালি সেই দিনের পর থেকে কী হয়েছিল, ওর আর কিছু মনে নেই। বলতে পারেন, ওর জীবন ওখানেই থেমে পড়ে আছে। তবে আপনাকে মেয়েটা অনেক ভালবাসে, আপনি চাইলে ওকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।”
রাফায়েত মাথা নেড়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। আমি খানিকটা সরে ওকে বসার জায়গা করে দিলাম।
“রাফায়েত, তুমি যে এখানে এসেছ, তন্নী জানতে পারলে রাগ করবে না?” উৎসুক দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
“না, করবে না। কারণ, ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই। রাগ করার প্রশ্নই আসে না। তুমি কেমন আছ আজ, সেটা বল। কিছু মনে করতে পারছ?”
“রাফায়েত, মনে করার কিছু নেই। আমি পাগলের মত এখানে পড়ে আছি, আমার চিকিৎসা হচ্ছে, সবাই ভাবছে আমি মানসিক ভারসাম্যহীন, আর তুমি হয়ত মনে মনে ভাবছ, তোমার জন্যই আমার এমনটা হয়েছে। সেরকম কিছু না। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পার। আমি সত্যটা স্বীকার করে নিয়েছি। আমাকে আর শুধু শুধু মিথ্যা বলতে হবে না। আমি ভাল আছি একলা একলা। ভালই থাকব।”
রাফায়েত আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি তাকালাম ওর দিকে। ওর দুই চোখে অনেক ভালবাসা। কিন্তু, আমার জন্য কি না, জানি না আমি।
“তুমি কেনও বিশ্বাস করছ না, সেদিন মেসেজটা দেয়ার পর আমি খুব অপরাধবোধে ভুগছিলাম, তন্নীকে ঠিকমত সময় দিতে পারছিলাম না। আর তন্নী অন্য একটা ছেলের সাথে এই সুযোগে রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিল। যখন সব জানতে পারলাম, যখন আমার ভুলটা বুঝতে পারলাম, তোমার কাছে ফিরে আসলাম। কিন্তু তখন তুমি...”
“প্লিজ রাফায়েত, এক মিথ্যা বারবার বললে সেটা সত্য হয়ে যায় না কোনওদিন। আর বল না এসব কখনও। ভাল লাগে না আমার।” আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলাম আমার কেবিনের দিকে। আর রাফায়েত বেঞ্চে বসে হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে লাগল, ক্রমশ ঘোলাটে থেকে ঘোলাটে হয়ে গেল আমার অবয়ব, আর ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ল জল......হয়ত আমার জন্য!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রূপক বিধৌত সাধু ০১/১২/২০১৪ভালো লাগলো ।
-
আবিদ আল আহসান ০১/১২/২০১৪awesome
-
অগ্নিপক্ষ ৩০/১১/২০১৪তারুণ্যে স্বাগতম!
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ৩০/১১/২০১৪লেখাটা পুরোটা পড়লাম। অফিসের কাজের ফাকে ফাকে। আজকের দিনে আর অন্য কোনো পোষ্ট পড়ার সুযোগ হয়নি। আর লেখাটি কেমন লেগেছে সে ব্যাপারে যে কোন ভালো মন্তব্য বা ফিলিংস আ যে কম হয়ে যাবে। এটি আপনার প্রথম লেখা কাহীনি কথামালা গল্পের বিন্যাশ সব মিলিয়ে এক অন্যন্য সাহিত্যের রস পেলাম। তবে মন্তব্যে হয়তো সব প্রকাশ করতে পারলাম না। তবে এইটুকু বলি প্রিয়তে রেখে দিলাম। মাঝে মধ্যেই মন খারাপ কিংবা বেশী ভালো থাকলে লেখাটা পড়বো। আর আসরে আপনাকে সু-স্বাগতম জানাচ্ছি। ভালো থাকা হয় যেনো.............
-
মোঃ শফিকুল ইসলাম মোল্লা (সজীব) ৩০/১১/২০১৪ভালো লিখেছেন
-
অ ২৯/১১/২০১৪অনেক বড় কিন্তু মুগ্ধকরা লেখা । একটুও ক্লান্তি আসেনি । তবে উত্তম পুরুষে না লিখে নাম পুরুষে লিখলে মনে হয় ভাল হত । একটা লাইনে পড়লাম "রাফায়েত ফোনটা বিছানায় আছড়ে ফেলে বাইরে চলে গেল" এমন একটা লেখা । আপনি যেহেতু উত্তম পুরুষে লিখছেন এই ঘটনাটি আপনার জানার কথা নয় । এখানে আপনি অনুমান করে বলছেন এমন একটা বাক্যও ব্যবহার করতে পারতেন ।
দু'একটা লাইন পরিবর্তন করে উত্তম পুরুষে রাখলেও মন্দ হয়না ।
তবে সর্বোপরি বলতে গেলে মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা ।
ভালো থাকবেন ।