চার খলিফা
‘লিখেন আমার নাম সাজিদ রাব্বানী। আপনার যেখানে খুশী কমপ্লেইন করতে পারেন।’
আমি কৌতুহুলে ছেলেটার দিকে তাকাই। লম্বা আছে বেশ, গায়ের রং ফর্সা। মেদহীন গড়ন, একমাথা সুন্দর করে আঁচড়ানো কালো চুল। চেহারা রাজপুত্রের মত। বয়সের তুলনায় একটু বাচ্চা দেখাচ্ছে, কলেজে-টলেজে পড়ে এরকম। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সদ্য-নিয়োগ পাওয়া ত্রিশজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ময়মনসিংহ ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারী এডুকেশন (নেপ)-এ সবেমাত্র ঢুকেছি, রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের সামনে। এখানে রিপোর্ট করে রুমনম্বর নিয়ে হোস্টেলে যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের মুহূর্তের টগবগে সব তরুণ-তরুণী এরা। ভেঙ্গেচুরে ফেলবে সব - এই করেছে পণ। চোখেমুখে দায়িত্ব আর নৈতিক মূল্যবোধ ছিটকে ছিটকে বেরুচ্ছে। সাম্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাহাড়সম বজ্রমুখ একেকটা। তবে এর চেয়ে ভাল কোন জব হয়নি এই হতাশা এবং ক্ষোভ ক্ষীণ হলেও মুখাবয়বে দৃশ্যমান।
সরকারী চাকুরীতে এই প্রথম আমি। কী সব আইনকানুন আছে, সিনিয়র-জুনিয়র ভেদাভেদ আকাশপ্রতীম! যেখানেই যাই ঝামেলা সুপার গ্লুর মত লেগে থাকে। তাই এবার বউ পই পই করে বলে দিয়েছে যেন কোনরকম ঝামেলা না করি। কিন্তু যদি একটা ছেলে ভুল সিস্টেমের বিরুদ্ধে যেয়ে বাম-টাইপের কথাবার্তা শুরু করে দেয়, সাম্যবাদ শব্দটাও উচ্চারণ করে। আমি কি বসে বসে ভেরেন্ডা ভাজব? চুলায় যাক বউ! গলার স্বর একটু উঁচিয়ে বলি, ‘উনি তো ঠিকই বলেছেন। আপনি মুখ চিনে রুম বরাদ্দ দিচ্ছেন কেন? যে আগে আসবে, তাঁর পছন্দমত রুম দিবেন। এখানেতো আগে বুকিংয়ের সিস্টেম নেই যে তাঁদের জন্য রুম আলাদা করে রাখবেন। সুতরাং উনি যেটা চায় সেটাই দিবেন, তাই না?‘
ছেলেটাকে খুব একটা উৎসাহিত মনে হল না। বলে, ‘আমিতো আমার জন্য ভাল রুম দরকার তা বলছি না। আমার কথা হল কোন রকম স্বজনপ্রীতি চলবে না। আপনাকে সিস্টেমে আসতে হবে।‘
ওরে বাব্বা! এ যে নীতির হিমালয়! রেজিস্ট্রার কমপ্লেইন করবে, দেখে নেবে জাতীয় হম্বিতম্বি করলেও ছেলেটার দৃঢ়তায় পুরাই বিড়াল। লাইটপোস্টের মত সোজা হয়ে বলে, ‘আচ্ছা, আপনাদের দু’জনকে এই রুমটা দিলাম। ডাবল রুম, একসাথে থাকবেন।‘
আমরা দ্বিমত করিনা। ছেলেটার সাথে থাকলে খারাপ হবে না, ‘আমি সাজিদ, আর আপনি?’ বলে হাত বাড়ায় সুদর্শন ছেলেটা।
‘আমি সামির।‘ হাত মিলাই ওর সাথে। ‘আপনার নাম একটু আগেই শুনেছি। রেজিস্ট্রারকে ভালই দিলেন মনে হছে। আপনার নামে কমপ্লেইন করবে বলেছে।’
আরে বেটা মুখ চিনে রুম বরাদ্দ দিবে। ফাইজলামি নাকি, এটা হতে পারে না। আর কমপ্লেইন, এত সাহস ঐ বেটার নাই।
আচ্ছা, এখন বাদ দেন এসব।
বলতে বলতে রুমে পৌঁছে যাই। লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে পরিচয়টা আরেকটু ডিটেইল করার দিকে মনোযোগ আমাদের।
আমার দেশের বাড়ী মাদারীপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিতে মাস্টার্স।
‘বলেন কী? আমার জন্মওতো মাদারীপুর। তবে বড় হয়েছি রাজবাড়ী। আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তবে পলিটিকাল সায়েন্সে।‘, ছেলেটি বেশ উৎসাহের সাথেই বলে।
কথাবার্তা অনেকক্ষণ চলে। কাঁদামাটির মন তখনো শুকায় নি আমাদের, আপনি থেকে তুমি হতে তাই কতক্ষণ! তুমি থেকে তুই হতে যেন লিফটে করে চব্বিশ তলায় উঠা, বা তার চেয়েও কম সময়! ডিনারের সময় হয়ে যায় ইতোমধ্যে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটছি আমরা। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের জীবনের স্বাদ, বেসুরো গলায় চড়া কণ্ঠে গেয়ে উঠি, ‘সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে…’
আমার প্রায় ছ’ফুটের শরীর। আমাকেও ঘাড় উঁচা করে দেখতে হয়। পালোয়ানের শরীর যেন! গায়ের রং শুধু ফর্সা না লাল, পর্দার প্রিন্সদের মত দেখতে। আমি তো অবাক! এরকম একটা হ্যন্ডসাম ছেলে সিনেমা বাদ দিয়ে এই চাকরী করতে কেন এসেছে? আপনি-তুমি বাছবিচার গোল্লায় যাক।
‘বন্ধু, তুমি রুপালী পর্দা বাদ দিয়ে এখানে কেন? পোস্টিং কোথায়?’ সরাসরি প্রশ্ন করি।
বিরাট শরীর হলে কী হবে, হাঁকডাঁক অনেকটা বিড়ালের। মিঁউ মিঁউ করে বলে, ’বাগেরহাট সদর’।
দেশের বাড়ী কোথায়?
চুয়াডাংগার আলমডাংগা।
আমি আগবাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেই, সাজিদও বলে ওর কথা। ‘দোস্ত, আমি আরমান।‘ লম্বু তাঁর নাম বলে। চল দোস্ত, তিনজনে একসাথে খাই। ক্ষুধা পেটে প্লেটে হাত ডুবিয়ে ভাত খেলাম তিনজন, একেবারে পেট পুরে। সাথে টুকটাক সাধারণ কথাবার্তা। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সাজিদ তোলে, ‘পুরো একমাস থাকতে হবে এখানে। এসব ট্রেনিং-ফ্রেনিং করেতো আর মাস যাবে না। সময় কাঁটাবার মত রসদ তো লাগবে। এদিকে ময়মনসিংহ শহরে আগে আসিনি। ভাল করে চিনিও না।‘ কেমন দার্শনিকের গলা।
আমার বুঝতে সময় লাগে না। কিন্তু আরমান ঠিক বুঝল কীনা কে জানে। তাই একটু চুপ করে থাকি। আরমানই নীরবতা ভাঙ্গে, ‘দোস্ত আমি কার্ড নিয়ে এসেছি। খাওয়ার পর চল তাস খেলতে বসে যাই।‘
আমি প্রশংসার দৃষ্টিতে বলি, ’চমৎকার! খুবই ভাল করেছ দোস্ত। তবে আর একজন প্লেয়ারতো লাগবে। তাছাড়া তাস খেলার ফুয়েলওতো লাগবে, তাই না?’ এবার একটু গলা নামিয়ে, ’দোস্ত, তোরা কী একটা জিনিষ লক্ষ্য করছিস?’
‘কী?’ ওরা বলে।
এ মুহুর্তে আমরা জনা-বিশেক আছি ক্যাফেটেরিয়ায়। জার্নি করে এসেছি সবাই, ক্ষুধার্ত। খাচ্ছিও গোগ্রাসে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ ছেলেটাকে দেখ ছোট ছোট চুল, আর্মিদের মত করে ছাঁটা। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। কারো সাথে কথা বলছে না, আগ্রহও নাই মনে হয়। খাচ্ছেও যেন অনিচ্ছায়, পেটে দিতে হবে তাই ঠেলেঠুলে ভরে দিচ্ছে। একটু ব্যতিক্রম না?
সাজিদ অভিজ্ঞতার ভরপুর বলে, ‘দোস্ত আমাদের চার নম্বরটা পেয়ে গেছি মনে হয়। আয় আমার সাথে।‘
ছেলেটা একা একা খাচ্ছে। আমরা পাশে যেয়ে বসি। সাজিদ বলে, ‘দোস্ত, আমরা তিনজন হয়েছি। এখন আর একজন হলেই কোটা পূরণ হবে। ব্রিজ খেলা শুরু করতে পারব। তুমি খেলবা নাকি?‘
অবশ্যই খেলব। আমার শেষ প্রায়। তোমরা রেডি হও, আমি এখনই আসছি। বাই দ্য ওয়ে, মাই নেম ইজ শরাফ। আমরাও যার যার নাম-পরিচয় দেই। শরাফের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কথার মধ্যে প্রচুর ইংরেজী বলে। চুলেও আর্মিছাঁট। ‘দোস্ত, তুমি কি আর্মিতে ছিলা নাকি কোনসময়?’
‘ঠিক ধরেছ, বন্ধু। ট্রেনিংয়ের সময়ই পালিয়ে চলে এসেছি। অসম্ভব খাটনি। আর শালারা টেরও পেয়ে গেছিল যে আমি ঘাস খাই।‘ নিচু স্বরে বলে।
আমরা একটু স্তম্ভিত হলেও খুশী যেন উপচে পরে। আমাদের তিনজনের অবস্থা এরকম যে পেলে ভাল হয়, আর না পেলে আফসোস; আহারে একটু পেলে দারুন হত টাইপের। কিন্তু শরাফের কথায় আমরা উল্লসিত, উস্তাদ পাওয়া গেছে। আর কোন সমস্যা নাই। মুহূর্তেই আমাদের বস হয়ে গেল; অটোমেটিক চয়েজ।
একবারের জন্য ঘুণাক্ষরেও কেউ বলছে না যে, আমি টায়ার্ড। রাত আড়াইটা বেজে গেছে অলরেডি, তাস খেলা আর ঘাস খাওয়া। এদিকে ভোর সকালেই উঠতে হবে, ওরিয়েন্টেশন শুরু হবে। আরমান মাঝেমধ্যে একটু গাই-গুই তুলেছিল কিন্তু বসের ধমকে চুপ। তবে বসের পরবর্তী নিউজটা আরো ভয়াভহ। নাটোরের ভাষায় বলে, ’আমিতো বুঝি নাই যে তোদের মত জিনিষ ঘাড়ে এসে জুটবে। আমার স্টকতো প্রায় শেষ করে দিলি তোরা। কালকে কিন্তু ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।‘
সকালে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে চোখ ডলতে ডলতে ওরিন্টেশনে উপস্থিত চারজন। পুরো মাস জুড়েই সব কিছুতে দেরী করা আমাদের নিত্যসংগী। আয়োজকগণ অনুরোধ-আদেশ-শাস্তি অনেক রকমের পদ্ধতি প্রয়োগ করেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেন নাই বিধায় শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাহোক, বিকালেই আমরা বের হয়ে যাই। উদ্দেশ্য ঘাসের স্টক বাড়াতে হবে। শহরতো চিনি না একদমই, কী করব এখন? বস একটা ব্যবস্থা হবেতো, নাকি?
বসের আদেশ, ‘সামির তুই আমার সাথে উঠ। আরমান আর সাজিদ তোরা পরের রিক্সায় বস। আমাদেরকে ফলো করবি শুধু। যা করার আমিই করব।‘ আমি একটু ভড়কে শরাফের সাথে রিক্সায়। দেখেশুনে ইয়াং একটা রিক্সাওয়ালা বেছে নিছে ও।
কই যাইবাইন, স্যার।
মোলায়েম সুরে বলে, ‘কোথায় যাব, জান না? চারচারটা ইয়াং ছেলে রিক্সায় উঠেছে শহর চেনে না। তুমি আমাদের চিনিয়ে নিয়া যাবা জায়গামত।‘
রিক্সাওয়ালা ভ্যাবাচেকা, ‘কী যে কইন স্যার, কই যাইবাইন কন?’
বস বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঘষা দেয়ার মত কী একটা করে আর বলে, ‘যাও’। রিক্সাওয়ালা মুচকি হেসেই উল্কা বেগে ছেড়ে দেয়। একটা প্রায় অন্ধগলির মোড়ে এসে রিক্সা দাড় করায়। বলে, ‘ভিতরে যায়া কইবাইন রুস্তম ভাইয়ের খুঁজতাছি। তাইলেই সব ঠিক।‘
গলির মধ্যে ঢুকেই আমাদের নায়ক আরমান ভড়কে যায়, ‘দোস্ত, নিষিদ্ধ পল্লী মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা হবে নাতো আবার?’
বস ধমক লাগায়,’চুপ, একেবারে চুপ। কেউ কোন কথা বলবি না। যা বলার আমি বলব। তোরা চুপচাপ সাথে থাকবি।‘
রোগা-পাতলা রুস্তম ভাই বসে বসে ডালিমের বিচি খাচ্ছে। ‘কী চাইন আন্নেরা?’ রুস্তম ভাই, আমরা ইনফরমেশন নিয়েই এসেছি। তাই কথা বাড়ানোর দরকার নাই। এই যে নেন টাকা, আপাতত দুই পুইরা দেন। পরে আবার আসব। এরকম জায়গায় আমাদের তিনজনের অভিজ্ঞতা প্রথম। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে এক পশলা শাওয়ার হয়ে গেল। কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছি, আর অপেক্ষা করছি কত তাড়াতাড়ি বের হব এই নরক থেকে। আরমান পারলে উসাইন বোল্টের সদ্য শেষ হওয়া একশ মিটারের স্প্রিন্টা এখনই লাগায়।
সোজা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে চলে যাই। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এ জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর। ছোট একটা পার্কের মত বানিয়েছে এরা। বেঞ্চিতে বসে তরুণতরুণীরা নিজেদের আর প্রকৃতির শোভা দেখছে। নদীর ঐপাড়ে ফুটে থাকা কাশবন – সাদা চুলের ডঃ জাফর ইকবাল যেন। নৌকা ভিড়ানো আছে, ইচ্ছেমত বেড়ানো যায় নদীতে। বেশ বৃদ্ধমত একজন মাঝি দেখে নৌকায় উঠে পরি। মাঝি, আমাদের ওপারে নিয়ে চলেন। লম্বা পাটক্ষেত পাশে রেখে আর একটু এগোলে কাশবনের ঝাড়। এপাশটা নিরিবিলি, কোথাও কেউ নেই। কাশবনের পাশে ঘাসের উপরে চারজন পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। বস একটিভ মানুষ, সব ইন্সট্রুমেন্ট সাথেই আছে। স্কিল্ড হাতে কাটিং-মেকিং-এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার সাথে হেঁড়ে গলায় আসরের সুর তোলে,
‘বাপে ড্রাইভার পোলা খালাশী
গাড়ীর নম্বর তিনশ আশি
চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী।
ধোয়াড়ী ধোঁয়ার রাজ্যে আসমানে ঘর বান্দে রে…‘
মাই গড! কখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে গেছে। দোস্ত উঠ, যেতে হবে না।
আরে দুর! বয় আরেকটু। আমরা স্বপ্নের সাগরে ভেসে যাচ্ছি। নদীটাকে পানি না ভেবে পিচঢালা রাস্তা আর নৌকাগুলি লাগছে ঠিক ইন্ডিয়ান মারুতি গাড়ীর মত। কী তামসা দেখছোস? গাড়ীতে কোন পেট্রোল লাগে না, আপনা আপনি চলে। ইঞ্জিনের শব্দ নাই, নিঃশব্দ। আজিব!
এই ব্যটা উঠ। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাবে। না খেয়ে থাকতে হবে তখন।
রাখ তোর ক্যান্টিন। রাতে খেতেই হবে, এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে? মাইরি বলছি দোস্ত, আরেকবার কেউ যাবার নাম নিবি তো ধরে নদীতে ফেলে দিব।
বসের হুঙ্কার, কে অমান্য করবে?
এক সময় উঠতেই হয়। এদিকে মাঝি চাচাও তাড়া দেয়।
নামার সময় চাচারে বলে যাই যে কাল আবার আসব। আপনি এখানে থাকবেন কিন্তু। পরের দিন বিকালে চাচা ঠিকই জায়গামত উপস্থিত। আমাদের চারজনকে বিস্মিত করে দিয়ে বলে, ‘কাইল আন্নেরা কী ছাইপাশ খাইছুইন। এইডা লন, আইজকা এইডা খাইয়া দেহুইন কীরম লাগে। আর নৌকা থেইক্কা নামনের কাম কী? আমি আস্তে আস্তে বাডির দিকে যায়াম। মনে লয় আপনেরা আমারে চিনছুন না। অয়োময় নাটকে আমারে দেখছুইন না, মির্জা সাইব নৌকা লইয়া বার হইল। এইডা হেই নৌকা, আমিই মাঝি আছিলাম হেই নৌকায়।‘
আমরাতো অবাক! আজকে বিকালটা আসলেই বিষ্ময়ের! একটার পর একটা সব অবাক করা ঘটনা। যেমন মাঝি চাচা নৌকার মধ্যেই ইয়া বড় এক সুখটান দিয়ে কাশতে কাশতে বিষম তুলে। পরমুহূর্তেই আমাদেরকে এক অপার্থিব জগতে নিয়ে যায়, স্বর্গীয় সুরে রক্তে নাচন ধরা গান শুরু করে দিয়ে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ক্ষীণ জলধারা বইছে তির তির করে। অনেকটা দিঘীর জলের মত শান্ত। নৌকা পাড় থেকে অনেকটা দুরে সরে এসেছে। এই পাশের কাশবন দুলছে মৃদুমন্দ বাতাসে। ধোঁয়ার কুন্ডুলী হাতবদল হচ্ছে নিঃশব্দে। আরমানের চোখ ইতোমধ্যে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। প্রিন্সের মত মুখটা নুইয়ে গেছে। মাঝি চাচা এনেস্থেশিয়া দিয়ে আমাদের অবশ করে রেখেছে যেন। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। শব্দহীন জগতের চার বাসিন্দা আমরা।
শুধু থেকে থেকে চাচার কাশি; খক খক, খক খক। আর সেই ভুবন-ভুলানো সুর। জীবনেও যে গান শুনিনি, কোনদিন না। আশি বছরের বৃদ্ধ স্ট্যামিনায় আমাদের চারজনের যৌবনকে রীতিমত ধুলায়-মাটিতে গড়িয়ে দেয়। কাশতে কাশতে বলে, ‘মদ্দে মদ্দে আন্নেগের মত মানুষ এনু ট্রেনিং-এ আহে। কাইলকা আমি আন্নেগরে দেক্কাই বুচচি আন্নেরা ঐ রহম দলের। আন্নেগরে জিনিসের গুন্দু হুইংগাই বুচচি বুল জাগার জিনিষ, বালা না।‘
পুরো মাস জুড়ে চাচার আতিথীয়তায় আমরা সর্বদাই মেঘের উপরের আকাশে বিচরণ করেছি। আমাদের পুষ্টিচাহিদা জেনে জুতসই ফুড সাপ্লাই দিয়ে গেছেন পুরোটা সময়। সাথে অফুরন্ত গানের ভান্ডার। সেলফোনের যুগ নয় তখন। আহারে! গানগুলো রেকর্ড করতে পারলাম না। ভবিষ্যতের পাথেয় থাকত। চাচা যাবার সময় বলেছেন, ‘পরের বার ট্রেনিংয়ে আবার এনু আবাইন। আমি এনুই থাকুম, এনুই নৌকা বাইয়াম। আন্নেগরে সেরাম বালা লাগছে। এরহম বালা আর দিলখোলা মানুষ সহজে পাওন যায় না।‘
আমাদের চোখ ভিজে উঠে। কেমন আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলেন এ কয়দিনে। ট্রেনিং-পরবর্তি বছরগুলো মহা-আনন্দেই কাঁটে আমাদের। প্রাথমিক শিক্ষায় ইতোমধ্যে চাউর হয়ে যায় ‘চার খলিফা।‘ কখনো বাগেরহাট, কখনো শৈলকূপা, ভেড়ামারা, গোয়ালন্দ। উপলক্ষ্য লাগে না কোন। সময় সুযোগ হলেই এক হয়ে যাই আমরা চার খলিফা। যার যার কর্মস্থলে আমরা পুরাই অন্য মানুষ! সততা আর কর্মনিষ্ঠার রকি মাউন্টেন একেকজন। পুরো ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে আছে আমাদের সততা আর একনিষ্ঠ কর্মগাঁথা। কিন্তু এর বাইরে বিচিত্র আমাদের জীবন!
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল আমাদের বস শরাফের বিয়ের সময়। ঢাকায় আছি তখন। এক সকালে শরাফের ফোন। কালকে ওর বিয়ে। হঠাৎ করেই সব ঠিক হয়েছে। আজ বিকালে ঢাকা থেকে বরযাত্রী যাবে নাটোরে। তুই রেডি হ।
আমি বলি, ‘আর সবাই?’
ওরাও আসবে।
আমি দ্বিধায় একটু। এ কেমন বিয়ে? রেডি হয়ে বরের মাইক্রোবাসে উঠেছি, ওমা! চারজনই আছি। আর দেরী কেন? তিনদিন নাটোরে ছিলাম। জামাই বাসর রাতে দরজায় খিল দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। চাঁদনি রাত ঘরে বসে থাকবে কেন? বউ ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। সময়তো আর থেমে নেই। এনজয় ম্যান! এনজয়!
চার খলিফার জীবনচলা নিরবচ্ছিন্ন থাকে না। পথে বিভিন্ন বাঁক আসতে থাকে। এদিক-ওদিক ছিটকে যেতেও থাকে। সাজিদ আর আমি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেই। ঘটনাচক্রে ইউএনডিপি ঘুরে কানাডা চলে আসি আমি। আর সাজিদ ইউনিসেফের সাথে ঘাটছড়া বেঁধে ফেলে। ওদিকে আরমানও ঘটনাচক্রে কানাডা চলে আসে। তবে আমরা দুজন দুই শহরে চলে আসি।
সবচেয়ে মর্মান্তিক হয় বসের জীবন। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মানুষের একজন ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দুকযুদ্ধে শামসুন্নাহার হলের সামনে মারা যায়। এখন ওখানে মিজানের স্মরণে একটা মনুমেন্ট বানানো হয়েছে, নামটা বোধ হয় ‘জয় তারুন্য’। বন্ধুটি সেই থেকে আজ অবধি আমার হ্রদয়ের অনেকটা জুড়ে আছে।
দ্বিতীয়টি হল এই শরাফ, আমাদের বস। আমার দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল মানুষদের একজন হঠাৎ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পরপারে চলে যায়। আমাদের বাঁকী তিনজনের জীবনে এ ছিল এক মর্মান্তিক আঘাত। কষ্টে বোবা হয়ে যাই আমরা। নাটোরে বন্ধুর দাফন হয় আর আমরা তিনবন্ধু কাঁদি, অঝোরে কাঁদি। ভাল মানুষ দুনিয়াতে বেশীদিন থাকে না। আমাদের মত তেলাপোকারা বেঁচে থাকে, মরে যায় পাহাড়সম মনের আমার বন্ধুটি। আল্লাহ ওর আত্মার শান্তি দিন।
আমি কৌতুহুলে ছেলেটার দিকে তাকাই। লম্বা আছে বেশ, গায়ের রং ফর্সা। মেদহীন গড়ন, একমাথা সুন্দর করে আঁচড়ানো কালো চুল। চেহারা রাজপুত্রের মত। বয়সের তুলনায় একটু বাচ্চা দেখাচ্ছে, কলেজে-টলেজে পড়ে এরকম। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সদ্য-নিয়োগ পাওয়া ত্রিশজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ময়মনসিংহ ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারী এডুকেশন (নেপ)-এ সবেমাত্র ঢুকেছি, রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের সামনে। এখানে রিপোর্ট করে রুমনম্বর নিয়ে হোস্টেলে যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের মুহূর্তের টগবগে সব তরুণ-তরুণী এরা। ভেঙ্গেচুরে ফেলবে সব - এই করেছে পণ। চোখেমুখে দায়িত্ব আর নৈতিক মূল্যবোধ ছিটকে ছিটকে বেরুচ্ছে। সাম্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাহাড়সম বজ্রমুখ একেকটা। তবে এর চেয়ে ভাল কোন জব হয়নি এই হতাশা এবং ক্ষোভ ক্ষীণ হলেও মুখাবয়বে দৃশ্যমান।
সরকারী চাকুরীতে এই প্রথম আমি। কী সব আইনকানুন আছে, সিনিয়র-জুনিয়র ভেদাভেদ আকাশপ্রতীম! যেখানেই যাই ঝামেলা সুপার গ্লুর মত লেগে থাকে। তাই এবার বউ পই পই করে বলে দিয়েছে যেন কোনরকম ঝামেলা না করি। কিন্তু যদি একটা ছেলে ভুল সিস্টেমের বিরুদ্ধে যেয়ে বাম-টাইপের কথাবার্তা শুরু করে দেয়, সাম্যবাদ শব্দটাও উচ্চারণ করে। আমি কি বসে বসে ভেরেন্ডা ভাজব? চুলায় যাক বউ! গলার স্বর একটু উঁচিয়ে বলি, ‘উনি তো ঠিকই বলেছেন। আপনি মুখ চিনে রুম বরাদ্দ দিচ্ছেন কেন? যে আগে আসবে, তাঁর পছন্দমত রুম দিবেন। এখানেতো আগে বুকিংয়ের সিস্টেম নেই যে তাঁদের জন্য রুম আলাদা করে রাখবেন। সুতরাং উনি যেটা চায় সেটাই দিবেন, তাই না?‘
ছেলেটাকে খুব একটা উৎসাহিত মনে হল না। বলে, ‘আমিতো আমার জন্য ভাল রুম দরকার তা বলছি না। আমার কথা হল কোন রকম স্বজনপ্রীতি চলবে না। আপনাকে সিস্টেমে আসতে হবে।‘
ওরে বাব্বা! এ যে নীতির হিমালয়! রেজিস্ট্রার কমপ্লেইন করবে, দেখে নেবে জাতীয় হম্বিতম্বি করলেও ছেলেটার দৃঢ়তায় পুরাই বিড়াল। লাইটপোস্টের মত সোজা হয়ে বলে, ‘আচ্ছা, আপনাদের দু’জনকে এই রুমটা দিলাম। ডাবল রুম, একসাথে থাকবেন।‘
আমরা দ্বিমত করিনা। ছেলেটার সাথে থাকলে খারাপ হবে না, ‘আমি সাজিদ, আর আপনি?’ বলে হাত বাড়ায় সুদর্শন ছেলেটা।
‘আমি সামির।‘ হাত মিলাই ওর সাথে। ‘আপনার নাম একটু আগেই শুনেছি। রেজিস্ট্রারকে ভালই দিলেন মনে হছে। আপনার নামে কমপ্লেইন করবে বলেছে।’
আরে বেটা মুখ চিনে রুম বরাদ্দ দিবে। ফাইজলামি নাকি, এটা হতে পারে না। আর কমপ্লেইন, এত সাহস ঐ বেটার নাই।
আচ্ছা, এখন বাদ দেন এসব।
বলতে বলতে রুমে পৌঁছে যাই। লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে পরিচয়টা আরেকটু ডিটেইল করার দিকে মনোযোগ আমাদের।
আমার দেশের বাড়ী মাদারীপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিতে মাস্টার্স।
‘বলেন কী? আমার জন্মওতো মাদারীপুর। তবে বড় হয়েছি রাজবাড়ী। আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তবে পলিটিকাল সায়েন্সে।‘, ছেলেটি বেশ উৎসাহের সাথেই বলে।
কথাবার্তা অনেকক্ষণ চলে। কাঁদামাটির মন তখনো শুকায় নি আমাদের, আপনি থেকে তুমি হতে তাই কতক্ষণ! তুমি থেকে তুই হতে যেন লিফটে করে চব্বিশ তলায় উঠা, বা তার চেয়েও কম সময়! ডিনারের সময় হয়ে যায় ইতোমধ্যে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটছি আমরা। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের জীবনের স্বাদ, বেসুরো গলায় চড়া কণ্ঠে গেয়ে উঠি, ‘সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে…’
আমার প্রায় ছ’ফুটের শরীর। আমাকেও ঘাড় উঁচা করে দেখতে হয়। পালোয়ানের শরীর যেন! গায়ের রং শুধু ফর্সা না লাল, পর্দার প্রিন্সদের মত দেখতে। আমি তো অবাক! এরকম একটা হ্যন্ডসাম ছেলে সিনেমা বাদ দিয়ে এই চাকরী করতে কেন এসেছে? আপনি-তুমি বাছবিচার গোল্লায় যাক।
‘বন্ধু, তুমি রুপালী পর্দা বাদ দিয়ে এখানে কেন? পোস্টিং কোথায়?’ সরাসরি প্রশ্ন করি।
বিরাট শরীর হলে কী হবে, হাঁকডাঁক অনেকটা বিড়ালের। মিঁউ মিঁউ করে বলে, ’বাগেরহাট সদর’।
দেশের বাড়ী কোথায়?
চুয়াডাংগার আলমডাংগা।
আমি আগবাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেই, সাজিদও বলে ওর কথা। ‘দোস্ত, আমি আরমান।‘ লম্বু তাঁর নাম বলে। চল দোস্ত, তিনজনে একসাথে খাই। ক্ষুধা পেটে প্লেটে হাত ডুবিয়ে ভাত খেলাম তিনজন, একেবারে পেট পুরে। সাথে টুকটাক সাধারণ কথাবার্তা। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সাজিদ তোলে, ‘পুরো একমাস থাকতে হবে এখানে। এসব ট্রেনিং-ফ্রেনিং করেতো আর মাস যাবে না। সময় কাঁটাবার মত রসদ তো লাগবে। এদিকে ময়মনসিংহ শহরে আগে আসিনি। ভাল করে চিনিও না।‘ কেমন দার্শনিকের গলা।
আমার বুঝতে সময় লাগে না। কিন্তু আরমান ঠিক বুঝল কীনা কে জানে। তাই একটু চুপ করে থাকি। আরমানই নীরবতা ভাঙ্গে, ‘দোস্ত আমি কার্ড নিয়ে এসেছি। খাওয়ার পর চল তাস খেলতে বসে যাই।‘
আমি প্রশংসার দৃষ্টিতে বলি, ’চমৎকার! খুবই ভাল করেছ দোস্ত। তবে আর একজন প্লেয়ারতো লাগবে। তাছাড়া তাস খেলার ফুয়েলওতো লাগবে, তাই না?’ এবার একটু গলা নামিয়ে, ’দোস্ত, তোরা কী একটা জিনিষ লক্ষ্য করছিস?’
‘কী?’ ওরা বলে।
এ মুহুর্তে আমরা জনা-বিশেক আছি ক্যাফেটেরিয়ায়। জার্নি করে এসেছি সবাই, ক্ষুধার্ত। খাচ্ছিও গোগ্রাসে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ ছেলেটাকে দেখ ছোট ছোট চুল, আর্মিদের মত করে ছাঁটা। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। কারো সাথে কথা বলছে না, আগ্রহও নাই মনে হয়। খাচ্ছেও যেন অনিচ্ছায়, পেটে দিতে হবে তাই ঠেলেঠুলে ভরে দিচ্ছে। একটু ব্যতিক্রম না?
সাজিদ অভিজ্ঞতার ভরপুর বলে, ‘দোস্ত আমাদের চার নম্বরটা পেয়ে গেছি মনে হয়। আয় আমার সাথে।‘
ছেলেটা একা একা খাচ্ছে। আমরা পাশে যেয়ে বসি। সাজিদ বলে, ‘দোস্ত, আমরা তিনজন হয়েছি। এখন আর একজন হলেই কোটা পূরণ হবে। ব্রিজ খেলা শুরু করতে পারব। তুমি খেলবা নাকি?‘
অবশ্যই খেলব। আমার শেষ প্রায়। তোমরা রেডি হও, আমি এখনই আসছি। বাই দ্য ওয়ে, মাই নেম ইজ শরাফ। আমরাও যার যার নাম-পরিচয় দেই। শরাফের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কথার মধ্যে প্রচুর ইংরেজী বলে। চুলেও আর্মিছাঁট। ‘দোস্ত, তুমি কি আর্মিতে ছিলা নাকি কোনসময়?’
‘ঠিক ধরেছ, বন্ধু। ট্রেনিংয়ের সময়ই পালিয়ে চলে এসেছি। অসম্ভব খাটনি। আর শালারা টেরও পেয়ে গেছিল যে আমি ঘাস খাই।‘ নিচু স্বরে বলে।
আমরা একটু স্তম্ভিত হলেও খুশী যেন উপচে পরে। আমাদের তিনজনের অবস্থা এরকম যে পেলে ভাল হয়, আর না পেলে আফসোস; আহারে একটু পেলে দারুন হত টাইপের। কিন্তু শরাফের কথায় আমরা উল্লসিত, উস্তাদ পাওয়া গেছে। আর কোন সমস্যা নাই। মুহূর্তেই আমাদের বস হয়ে গেল; অটোমেটিক চয়েজ।
একবারের জন্য ঘুণাক্ষরেও কেউ বলছে না যে, আমি টায়ার্ড। রাত আড়াইটা বেজে গেছে অলরেডি, তাস খেলা আর ঘাস খাওয়া। এদিকে ভোর সকালেই উঠতে হবে, ওরিয়েন্টেশন শুরু হবে। আরমান মাঝেমধ্যে একটু গাই-গুই তুলেছিল কিন্তু বসের ধমকে চুপ। তবে বসের পরবর্তী নিউজটা আরো ভয়াভহ। নাটোরের ভাষায় বলে, ’আমিতো বুঝি নাই যে তোদের মত জিনিষ ঘাড়ে এসে জুটবে। আমার স্টকতো প্রায় শেষ করে দিলি তোরা। কালকে কিন্তু ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।‘
সকালে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে চোখ ডলতে ডলতে ওরিন্টেশনে উপস্থিত চারজন। পুরো মাস জুড়েই সব কিছুতে দেরী করা আমাদের নিত্যসংগী। আয়োজকগণ অনুরোধ-আদেশ-শাস্তি অনেক রকমের পদ্ধতি প্রয়োগ করেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেন নাই বিধায় শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাহোক, বিকালেই আমরা বের হয়ে যাই। উদ্দেশ্য ঘাসের স্টক বাড়াতে হবে। শহরতো চিনি না একদমই, কী করব এখন? বস একটা ব্যবস্থা হবেতো, নাকি?
বসের আদেশ, ‘সামির তুই আমার সাথে উঠ। আরমান আর সাজিদ তোরা পরের রিক্সায় বস। আমাদেরকে ফলো করবি শুধু। যা করার আমিই করব।‘ আমি একটু ভড়কে শরাফের সাথে রিক্সায়। দেখেশুনে ইয়াং একটা রিক্সাওয়ালা বেছে নিছে ও।
কই যাইবাইন, স্যার।
মোলায়েম সুরে বলে, ‘কোথায় যাব, জান না? চারচারটা ইয়াং ছেলে রিক্সায় উঠেছে শহর চেনে না। তুমি আমাদের চিনিয়ে নিয়া যাবা জায়গামত।‘
রিক্সাওয়ালা ভ্যাবাচেকা, ‘কী যে কইন স্যার, কই যাইবাইন কন?’
বস বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঘষা দেয়ার মত কী একটা করে আর বলে, ‘যাও’। রিক্সাওয়ালা মুচকি হেসেই উল্কা বেগে ছেড়ে দেয়। একটা প্রায় অন্ধগলির মোড়ে এসে রিক্সা দাড় করায়। বলে, ‘ভিতরে যায়া কইবাইন রুস্তম ভাইয়ের খুঁজতাছি। তাইলেই সব ঠিক।‘
গলির মধ্যে ঢুকেই আমাদের নায়ক আরমান ভড়কে যায়, ‘দোস্ত, নিষিদ্ধ পল্লী মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা হবে নাতো আবার?’
বস ধমক লাগায়,’চুপ, একেবারে চুপ। কেউ কোন কথা বলবি না। যা বলার আমি বলব। তোরা চুপচাপ সাথে থাকবি।‘
রোগা-পাতলা রুস্তম ভাই বসে বসে ডালিমের বিচি খাচ্ছে। ‘কী চাইন আন্নেরা?’ রুস্তম ভাই, আমরা ইনফরমেশন নিয়েই এসেছি। তাই কথা বাড়ানোর দরকার নাই। এই যে নেন টাকা, আপাতত দুই পুইরা দেন। পরে আবার আসব। এরকম জায়গায় আমাদের তিনজনের অভিজ্ঞতা প্রথম। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে এক পশলা শাওয়ার হয়ে গেল। কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছি, আর অপেক্ষা করছি কত তাড়াতাড়ি বের হব এই নরক থেকে। আরমান পারলে উসাইন বোল্টের সদ্য শেষ হওয়া একশ মিটারের স্প্রিন্টা এখনই লাগায়।
সোজা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে চলে যাই। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এ জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর। ছোট একটা পার্কের মত বানিয়েছে এরা। বেঞ্চিতে বসে তরুণতরুণীরা নিজেদের আর প্রকৃতির শোভা দেখছে। নদীর ঐপাড়ে ফুটে থাকা কাশবন – সাদা চুলের ডঃ জাফর ইকবাল যেন। নৌকা ভিড়ানো আছে, ইচ্ছেমত বেড়ানো যায় নদীতে। বেশ বৃদ্ধমত একজন মাঝি দেখে নৌকায় উঠে পরি। মাঝি, আমাদের ওপারে নিয়ে চলেন। লম্বা পাটক্ষেত পাশে রেখে আর একটু এগোলে কাশবনের ঝাড়। এপাশটা নিরিবিলি, কোথাও কেউ নেই। কাশবনের পাশে ঘাসের উপরে চারজন পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। বস একটিভ মানুষ, সব ইন্সট্রুমেন্ট সাথেই আছে। স্কিল্ড হাতে কাটিং-মেকিং-এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার সাথে হেঁড়ে গলায় আসরের সুর তোলে,
‘বাপে ড্রাইভার পোলা খালাশী
গাড়ীর নম্বর তিনশ আশি
চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী।
ধোয়াড়ী ধোঁয়ার রাজ্যে আসমানে ঘর বান্দে রে…‘
মাই গড! কখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে গেছে। দোস্ত উঠ, যেতে হবে না।
আরে দুর! বয় আরেকটু। আমরা স্বপ্নের সাগরে ভেসে যাচ্ছি। নদীটাকে পানি না ভেবে পিচঢালা রাস্তা আর নৌকাগুলি লাগছে ঠিক ইন্ডিয়ান মারুতি গাড়ীর মত। কী তামসা দেখছোস? গাড়ীতে কোন পেট্রোল লাগে না, আপনা আপনি চলে। ইঞ্জিনের শব্দ নাই, নিঃশব্দ। আজিব!
এই ব্যটা উঠ। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাবে। না খেয়ে থাকতে হবে তখন।
রাখ তোর ক্যান্টিন। রাতে খেতেই হবে, এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে? মাইরি বলছি দোস্ত, আরেকবার কেউ যাবার নাম নিবি তো ধরে নদীতে ফেলে দিব।
বসের হুঙ্কার, কে অমান্য করবে?
এক সময় উঠতেই হয়। এদিকে মাঝি চাচাও তাড়া দেয়।
নামার সময় চাচারে বলে যাই যে কাল আবার আসব। আপনি এখানে থাকবেন কিন্তু। পরের দিন বিকালে চাচা ঠিকই জায়গামত উপস্থিত। আমাদের চারজনকে বিস্মিত করে দিয়ে বলে, ‘কাইল আন্নেরা কী ছাইপাশ খাইছুইন। এইডা লন, আইজকা এইডা খাইয়া দেহুইন কীরম লাগে। আর নৌকা থেইক্কা নামনের কাম কী? আমি আস্তে আস্তে বাডির দিকে যায়াম। মনে লয় আপনেরা আমারে চিনছুন না। অয়োময় নাটকে আমারে দেখছুইন না, মির্জা সাইব নৌকা লইয়া বার হইল। এইডা হেই নৌকা, আমিই মাঝি আছিলাম হেই নৌকায়।‘
আমরাতো অবাক! আজকে বিকালটা আসলেই বিষ্ময়ের! একটার পর একটা সব অবাক করা ঘটনা। যেমন মাঝি চাচা নৌকার মধ্যেই ইয়া বড় এক সুখটান দিয়ে কাশতে কাশতে বিষম তুলে। পরমুহূর্তেই আমাদেরকে এক অপার্থিব জগতে নিয়ে যায়, স্বর্গীয় সুরে রক্তে নাচন ধরা গান শুরু করে দিয়ে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ক্ষীণ জলধারা বইছে তির তির করে। অনেকটা দিঘীর জলের মত শান্ত। নৌকা পাড় থেকে অনেকটা দুরে সরে এসেছে। এই পাশের কাশবন দুলছে মৃদুমন্দ বাতাসে। ধোঁয়ার কুন্ডুলী হাতবদল হচ্ছে নিঃশব্দে। আরমানের চোখ ইতোমধ্যে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। প্রিন্সের মত মুখটা নুইয়ে গেছে। মাঝি চাচা এনেস্থেশিয়া দিয়ে আমাদের অবশ করে রেখেছে যেন। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। শব্দহীন জগতের চার বাসিন্দা আমরা।
শুধু থেকে থেকে চাচার কাশি; খক খক, খক খক। আর সেই ভুবন-ভুলানো সুর। জীবনেও যে গান শুনিনি, কোনদিন না। আশি বছরের বৃদ্ধ স্ট্যামিনায় আমাদের চারজনের যৌবনকে রীতিমত ধুলায়-মাটিতে গড়িয়ে দেয়। কাশতে কাশতে বলে, ‘মদ্দে মদ্দে আন্নেগের মত মানুষ এনু ট্রেনিং-এ আহে। কাইলকা আমি আন্নেগরে দেক্কাই বুচচি আন্নেরা ঐ রহম দলের। আন্নেগরে জিনিসের গুন্দু হুইংগাই বুচচি বুল জাগার জিনিষ, বালা না।‘
পুরো মাস জুড়ে চাচার আতিথীয়তায় আমরা সর্বদাই মেঘের উপরের আকাশে বিচরণ করেছি। আমাদের পুষ্টিচাহিদা জেনে জুতসই ফুড সাপ্লাই দিয়ে গেছেন পুরোটা সময়। সাথে অফুরন্ত গানের ভান্ডার। সেলফোনের যুগ নয় তখন। আহারে! গানগুলো রেকর্ড করতে পারলাম না। ভবিষ্যতের পাথেয় থাকত। চাচা যাবার সময় বলেছেন, ‘পরের বার ট্রেনিংয়ে আবার এনু আবাইন। আমি এনুই থাকুম, এনুই নৌকা বাইয়াম। আন্নেগরে সেরাম বালা লাগছে। এরহম বালা আর দিলখোলা মানুষ সহজে পাওন যায় না।‘
আমাদের চোখ ভিজে উঠে। কেমন আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলেন এ কয়দিনে। ট্রেনিং-পরবর্তি বছরগুলো মহা-আনন্দেই কাঁটে আমাদের। প্রাথমিক শিক্ষায় ইতোমধ্যে চাউর হয়ে যায় ‘চার খলিফা।‘ কখনো বাগেরহাট, কখনো শৈলকূপা, ভেড়ামারা, গোয়ালন্দ। উপলক্ষ্য লাগে না কোন। সময় সুযোগ হলেই এক হয়ে যাই আমরা চার খলিফা। যার যার কর্মস্থলে আমরা পুরাই অন্য মানুষ! সততা আর কর্মনিষ্ঠার রকি মাউন্টেন একেকজন। পুরো ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে আছে আমাদের সততা আর একনিষ্ঠ কর্মগাঁথা। কিন্তু এর বাইরে বিচিত্র আমাদের জীবন!
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল আমাদের বস শরাফের বিয়ের সময়। ঢাকায় আছি তখন। এক সকালে শরাফের ফোন। কালকে ওর বিয়ে। হঠাৎ করেই সব ঠিক হয়েছে। আজ বিকালে ঢাকা থেকে বরযাত্রী যাবে নাটোরে। তুই রেডি হ।
আমি বলি, ‘আর সবাই?’
ওরাও আসবে।
আমি দ্বিধায় একটু। এ কেমন বিয়ে? রেডি হয়ে বরের মাইক্রোবাসে উঠেছি, ওমা! চারজনই আছি। আর দেরী কেন? তিনদিন নাটোরে ছিলাম। জামাই বাসর রাতে দরজায় খিল দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। চাঁদনি রাত ঘরে বসে থাকবে কেন? বউ ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। সময়তো আর থেমে নেই। এনজয় ম্যান! এনজয়!
চার খলিফার জীবনচলা নিরবচ্ছিন্ন থাকে না। পথে বিভিন্ন বাঁক আসতে থাকে। এদিক-ওদিক ছিটকে যেতেও থাকে। সাজিদ আর আমি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেই। ঘটনাচক্রে ইউএনডিপি ঘুরে কানাডা চলে আসি আমি। আর সাজিদ ইউনিসেফের সাথে ঘাটছড়া বেঁধে ফেলে। ওদিকে আরমানও ঘটনাচক্রে কানাডা চলে আসে। তবে আমরা দুজন দুই শহরে চলে আসি।
সবচেয়ে মর্মান্তিক হয় বসের জীবন। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মানুষের একজন ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দুকযুদ্ধে শামসুন্নাহার হলের সামনে মারা যায়। এখন ওখানে মিজানের স্মরণে একটা মনুমেন্ট বানানো হয়েছে, নামটা বোধ হয় ‘জয় তারুন্য’। বন্ধুটি সেই থেকে আজ অবধি আমার হ্রদয়ের অনেকটা জুড়ে আছে।
দ্বিতীয়টি হল এই শরাফ, আমাদের বস। আমার দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল মানুষদের একজন হঠাৎ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পরপারে চলে যায়। আমাদের বাঁকী তিনজনের জীবনে এ ছিল এক মর্মান্তিক আঘাত। কষ্টে বোবা হয়ে যাই আমরা। নাটোরে বন্ধুর দাফন হয় আর আমরা তিনবন্ধু কাঁদি, অঝোরে কাঁদি। ভাল মানুষ দুনিয়াতে বেশীদিন থাকে না। আমাদের মত তেলাপোকারা বেঁচে থাকে, মরে যায় পাহাড়সম মনের আমার বন্ধুটি। আল্লাহ ওর আত্মার শান্তি দিন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সোলাইমান ২৭/১০/২০১৭
-
রিজভী নাভিন ২৫/১০/২০১৭মুগ্ধময় । ভাল হয়েছে ।
-
ফয়জুল মহী ২৪/১০/২০১৭চয়নে চয়নে ছড়িয়ে দিলাম মুগ্ধতা।
-
রায়হান আজিজ ২৩/১০/২০১৭দারুন
-
হাসান হামিদ ২২/১০/২০১৭দারুণ
-
আজাদ আলী ২২/১০/২০১৭সুন্দর । প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন অফুরান প্রিয় কবি।
-
নাজিবুল হাসান মোল্লা ২২/১০/২০১৭সুন্দর হয়েছে
-
মধু মঙ্গল সিনহা ২১/১০/২০১৭সুন্দর
অনেক ভালো লাগা নিয়ে গেলাম শ্রদ্ধেয় কবি।।
ভালো থাকবেন সতত।।