ট্রান্সকানাডা হাইওয়েতে সাতদিন
বাইবেলে একটি স্তব আছে, ‘May he have dominion from sea to sea and from the river to the ends of the earth’; Pslam 72:8. এই sea to sea বা coast to coast ধারণা থেকেই কানাডা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা মূর্ত হয়ে উঠে আঠার শতকের দিকে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে দেশের আটলান্টিক কোস্ট থেকে প্যাসিফিক কোস্ট পর্যন্ত রেলপথ এবং সড়কপথ নির্মাণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। অনেক ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে বাস্তব হয়ে উঠে দীর্ঘ রেলপথ কানাডা-প্যাসিফিক রেল এবং আঁট হাজার কিলোমিটার লম্বা সড়কপথ। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ গাড়ী চলারপথ ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে নামেই সমধিক পরিচিত। নির্দিষ্ট করে বললে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড প্রদেশের একেবারে পূর্বের সেইন্ট জন শহর থেকে শুরু হয়ে সবগুলো প্রদেশ অতিক্রম করে পশ্চিমে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া শহরে গিয়ে এর শেষ। বানাতে সময় লেগেছে অনেক দিন, পঞ্চাশ বছরেরও বেশী। ১৯৬২ সালে খুলে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য।
বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীর চমৎকার একটি বাইপ্রোডাক্ট হচ্ছে নতুন নতুন জায়গা চেনা। বদলীর চাকুরী, আজ এই জেলা তো কাল আরেক জেলা। ভালই লাগে আমাদের। নতুন জায়গায় পোস্টিং হয়, ভিন্ন রকম মানুষের সাথে পরিচয়। জীবনঘনিষ্ঠ হবার আগেই বিদায়, আরেক জায়গায় আবার। এমন ঘুরতে ঘুরতে অস্ট্রেলিয়ায় বছর দুই কাঁটিয়ে আবার বাংলাদেশ হয়ে কানাডার টরন্টোতে ঘাঁটি গাড়ি। বাস্তবে এখানেও স্থিতি হয় না, পরবর্তী গন্তব্য ক্যালগেরি। এটাই সর্বশেষ আস্তানা। টরন্টো থেকে মালামাল বস্তাবন্দী করে ভ্যানলাইন মুভার দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এক্ষণে আমাদের যাওয়ার পালা। এদিকে বেশ কিছুদিনের অবসর। তাই ভাবছি অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কিছু। অবসরের অলস ভাবনা পেয়ে বসে।
অবসরে কী করেন? সাধারণ এ প্রশ্নটি যদি অসাধারণ সব ব্যক্তিত্বদের করা হয় তবে কে কী বলবেন তার একটা অনুমিত তালিকা করেছি। সৈয়দ শামসুল হক (চিবিয়ে চিবিয়ে) – অবসর কোথায়! বাংলা ভাষার সেবা করেই তো সময় চলে যায়। হুমায়ুন আজাদ – সিমোন দ্য বোভইর-এর দ্য উইমেন ডেস্ট্রয়েড এবং নোয়াম চমস্কির ল্যাংগুয়েজ এন্ড থট পড়ছি। কঠিন কঠিন সব বই পড়ি অবসর কোথায়! হুমায়ূন আহমেদ – আমার কন্যারা টিভি দেখতে খুব পছন্দ করে। আমাদের টিভিটা নাকি পাশের বাড়ির চেয়ে ছোট। তাই বেশী বেশী লেখার চেষ্টা করছি যাতে একটা বড় টিভি কিনতে পারি। জাফর ইকবাল – রাজাকার ছাঁকার ফিল্টারটা পরিস্কার করছি।
আমাকে তো এই প্রশ্ন অন্য কেউ করবে না, তাই নিজেই করি। অবসরে আমি কী করি? মদে তেমন একটা রুচি নেই। গাঁজা আমেরিকার অনেক শহরে বৈধ হলেও কানাডায় এখনো অবৈধ। সত্যি বলতে কি অবসরে আমি শুধু ফেইসবুকের পাতা উল্টাই। লাইকের পর লাইক দিয়ে যাই। ফেইসবুকের কাছে গত কয়েক বছরের লাইকের পরিসংখ্যান যদি থাকে তবে সেই তালিকায় অবশ্যই আমি উপরের দিকে থাকব। তার মানে সারাজীবন খালি অকাজই করে গেছি। ঐকালে সেবা প্রকাশনীর দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা আরো সব জ্ঞানের বই পড়তাম আর এখন ফেইসবুক। অকাজ আর অকাজ!
তো এই ফেইসবুক ভাজাভাজা করে কী পাইলাম। বিভিন্ন ধরনের পোজ দেয়া ছবি, নানান কৌতুক, রাজনীতি আরও কত কী। এছাড়াও নবীন-প্রবীন অনেকেই মনের ভাব প্রকাশের জন্য এখানে দু’চার কলম লেখার চেষ্টা করেন। লেখাগুলোর মধ্যে স্মৃতিচারণমূলক লেখাই সর্বাধিক। কী থাকে না এসব স্মৃতিচারণে! বাল্যকাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব। ভাল ভাল কথাই বেশী থাকে – দু’চারটি দুষ্ট কথাও। মহান সৃষ্টিকর্তা অনেক ভেবেচিন্তে বানালেন ‘ছুচো’ আমরা বলতাম ‘চুহা’। খুবই অপ্রয়োজনীয় এই সৃষ্টি জগতের কোন কল্যাণে লাগছে এ নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তাই বলে চুহাকে তো আর অস্বীকার করতে পারিনা। তাই চিন্তা করছি একটা চুহা বানানোর চেষ্টা করি। একটা মেমোরেবল ভ্রমণ করব, যা থেকে কিছু কিছু স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
আমিই শুরু করলাম, ‘সমস্ত মালামাল চলে গিয়েছে, শুধু আমরা ছাড়া। এবার তোমরা বল কীভাবে টরন্টো থেকে ক্যালগেরি যেতে পারি? গণতন্ত্রের মত ভোটাভুটি হবে’।
ছেলেটা মায়ার সাগর, ‘আমি ক্যালগেরি যাব না। এখানেই থাকব’। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেও।
আহারে! দেখতে খারাপ লাগছে। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু কোন উপায় নাই, বাবা। যেতেই হবে আমাদের। কীভাবে যেতে চাও এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এখন।
‘আমি প্লেনে যাব’, ছেলের সোজাসাপ্টা জবাব।
‘আমার কোন চয়েস নেই’, মেয়ের জবাব। মেয়ের মা’র একই কথা।
আমি একটু ব্যাখ্যা দেই ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের। বলি, ‘এরকম সুযোগতো সবসময় আসে না। আমাদের অবসরও আছে। মন্ট্রিয়াল থেকে রওনা দিয়ে একেবারে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত চলে যেতে পারি, গাড়ী চালিয়ে। সামার চলছে তাই কানাডার কান্ট্রিসাইড দেখার এর চেয়ে ভাল সময় আর সুযোগ আর নাও পেতে পারি। আমার চয়েস গাড়ীতে করে দেখতে দেখতে যাব, প্লেনে যাব না। এবার কার কী মত বল?’।
মেয়ে এক কথায় রাজী, সে গাড়ী করে যাবে। ছেলের অবশ্য একই কথা, প্লেনে যাবে। ওদের মা মৌনব্রত, ভোট দেয়া দেখে বিরত। তো দুই ভোট আর এক ভোট; আমি আর আমার মেয়ে জয়ী। ঠিক হোল, টরন্টো থেকে আগে মন্ট্রিয়াল যাব। এক কাজিন থাকেন সেখানে। উনার ওখানে রাতে থেকে ভোর সকালে গাড়ীতে করে রওনা দিব ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে ধরে। মন্ট্রিয়াল-টরন্টো-ক্যালগেরি-ভ্যাংকুভার হয়ে সোজা ভিক্টোরিয়া; পাঁচ হাজার কিলোমিটারে বেশী পথ। পুরো সাত দিন রাস্তায় থাকা হবে, ভাবতেই কেমন শিহরিত আমরা! আমেরিকানরা একাজ মাঝে মাঝে করে, নিউ ইয়র্ক থেকে গাড়ী চালিয়ে লস এঞ্জেলেস চলে যায়। তবে অস্ট্রেলিয়ারটা অনেক বড়। সমুদ্রপারের কোন এক শহর থেকে শুরু করে পুরো কোস্ট ধরে চলতে চলতে পুনরায় ঐ শহরে ফিরে আসা যায়, মাসখানেকের জন্য পথের রাজা। তবে সবচেয়ে থ্রিল নাকি ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ ধরে মস্কো থেকে ভ্লাডিভোস্টক পর্যন্ত চলে যাওয়া।
যাত্রা শুরু হবে মন্ট্রিয়ালের বায়োডোম থেকে। জিপিএস-এ ভিক্টোরিয়ার মাইল জিরো পয়েন্ট সেট করে গাড়ী ছেড়ে দিলাম। গাড়ীভর্তি খাবার দাবার, হালাল খাবারের সংকটে যাতে না পরি। মেয়েটার কাজ হল প্রতিদিনের সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের তালিকা করা। যাবার পথে একটু ঢু মেরে যাব আমরা। আজকের যাত্রাপথে কানাডার রাজধানী শহরে থামলাম প্রথমে। ইতোমধ্যে ক্যুইবেক প্রদেশ ছেড়ে অন্টারিওতে ঢুকে গেছি। অটোয়া আসলাম আর পার্লামেন্ট হিলে না গেলে হয়! কানাডার সংসদ ভবন থেকে বাংলাদেশ হাই কমিশনের অফিস হয়ে আবার রাস্তায়। পরবর্তী গন্তব্য কিংস্টন শহর। ওয়াশরুম খাওয়া শেষ করে কুইন’স ইউনিভার্সিটি ঢু মেরে যাই। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় পৌনে দুইশ বছর আগের কুইন ভিক্টোরিয়ার আমলের। বিল্ডিংগুলোও পুরনো ধাঁচের, লাইমস্টোন ব্লক দিয়ে বানানো। আর একাডেমিক রেকর্ডও ভালো, ওয়াল্ড র্যাঙ্কিং-এ দুইশ এর মধ্যে।
প্রথম দিনের শেষ গন্তব্য টরন্টো। এক বছর থেকেছি এখানে, তাই দেখার তেমন কিছু বাকী নেই। তবে হাইওয়ের কথা একটু বলতে হবে যে। মন্ট্রিয়াল-টরন্টো রাস্তার নাম কিংস হাইওয়ে ৪০১ বা সংক্ষেপে হাইওয়ে ৪০১ বলে। লোকে বলে, ‘দ্য ফোর-অহ-ওয়ান’। পুরো নর্থ আমেরিকার ব্যস্ততম হাইওয়ের একটি। টরন্টোতে ঢুকে এর নাম ‘হাইওয়ে অব হিরো’স। এত বিশাল! কিছু জায়গায় উভয় দিক মিলিয়ে সার্ভিসলেনসহ প্রায় ২৪ লেনের রাস্তা। স্পিডলিমিট ১০০, আমারা গড়পরতা ১১০ থেকে ১১৫ এর মধ্যে ছিলাম।
‘বাবা, কীসের শব্দ। কেমন ভোঁ করে কিছু একটা পার হয়ে গেল।‘ মেয়েটা চারিদিকে তাকিয়ে বলে।
আমি কৌতুহুলী হই, ’ব্যাপার কী?’ চকিতে শুধু চোখে পড়ল একটা মোটর বাইক মুহুর্তেই আমাদের ওভারটেক করে চলে গেল।
আমি বিষ্ময়ে বলি, ‘দেখছ মা, বাইকের স্পিড কমছে কম ৩০০ হবে। পুলিশ ওদের ধরতে পারবে না। কারণ পুলিশের কোন গাড়ীর স্পীড এত না। আর স্পীড ক্যামেরাতে ক্যাচ করার আগেই চলে যাবে ওরা।‘
যাহোক, রাতে বন্ধু হাবিবের ওখানে থাকব। টরন্টো ডাউন্টাউনের জেরার্ড স্ট্রীটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ব্যাচমেট হাবিব, বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র। ওর সাথে অনেক স্মৃতি আছে। দীর্ঘ হাঁটার একটা চমৎকার ঘটনাও আছে।
কারনে-অকারনে এ জীবনে অনেক হেঁটেছি। দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ সেসব হাঁটা। সবচেয়ে লম্বা হাঁটাগুলি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুতত্ব পড়ার সময় ফিল্ডওয়ার্ক এ যেয়ে। একবার সারাদিন ফিল্ডওয়ার্ক শেষ করে সন্ধ্যায় ইনানী থেকে সৈকত ধরে পায়ে হেঁটে কক্সবাজারের কলাতলির আনবিক শক্তি কমিশন ভবনে আসতে হয়েছিল। চাকুরীর সুবাদে থানচির পাহাড়েও ঘন্টার পর ঘন্টা হাটতে হয়েছে। তবে এসব ছিল অনেকটা বাধ্যতামুলক, প্রয়োজনে হাঁটা। তবে অকারণেও লম্বা পথ হেঁটেছি এরকম তিনটি আছে উল্লেখ করার মত।
হাঁটা-১। সকাল দশটার মত বাজে। ক্যালগেরি ডাউনটাউন থেকে বাসায় যাব। হাতে বেশ কিছু সময় আছে। হঠাৎ মাথা চাড়া দিল পুরোনো রোগ, হাঁটা দিলে কেমন হয়! হাঁটছি তো হাঁটছিই – প্রখর রোদ, ঘেমে নেয়ে একাকার। এক পর্যায়ে রেলক্রসিং-এ ট্রেনের জন্য থামতে হল। ট্রেনটাও বিশাল! দেড়শ বগি পার হয়ে যায় ট্রেন শেষ হয় না। ঘন্টা দুয়েকে পরে হন্টনের সমাপ্তি। আরামদায়ক গণপরিবহন থাকার পরেও এই হাঁটার কোন অর্থ আছে?
হাঁটা-২। বিশ্বকাপ ক্রিকেট হচ্ছে সাউথ আফ্রিকায়। মেলবোর্নে থাকি, ক্রিকেট পাগল আমার বাসায় খেলা দেখার সুযোগ নেই। উপায় ডাউনটাউনের ক্রাউন ক্যাসিনো। বিশাল পর্দায় অনেকটা সিনেমার মত করে খেলা দেখা। খেলা শুরু হয় সন্ধ্যা ছটার দিকে আর শেষ হয় রাত দুটা/তিনটার দিকে। বিপদটা হল তখন সব গণপরিবহন বন্ধ। পরবর্তি ট্রাম পাঁচটার দিকে। দুর! কে বসে থাকে। অগত্যা হাঁটা দেই। আলোঝলমলে ক্যাসিনো থেকে বের হয়ে রাজপথ ধরে সোজা হাঁটা। ইয়ারা নদী পার হয়ে কখনো খোলা মাঠ আবার কখনো পার্কের গাছপালা-ঝোপঝারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা আর হাঁটা। দিনের বেলা স্বাভাবিক মনে হলেও অন্ধকারে পার্কের ঝোপঝারকেও জংগল ভেবে গাঁ কেমন শিরশির করে। ভয়ের শ্রোত নেমে যায় শিরদাড়া বেয়ে। পাক্কা দু’ঘন্টা ত্রিশ মিনিট হেঁটে বাসায়। পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই ছিল এ রুটিন।
হাঁটা-৩। সবচেয়ে স্মরণীয়। ঢাবি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এখন যৌবন যার যুদ্ধে, থুক্কু 'প্রেম' করার শ্রেষ্ঠ সময় তার। বাঁধভাঙ্গা-উপচেপড়া প্রেমের জোয়ারে চারিদিক প্লাবিত। যেদিকে চউখ যায় শুধু তারেই দেখি। জগতের শুরু এবং শেষ বুঝি ঐখানেই। ভাবনায় আর দ্বিতীয় কিছু নেই, আসেও না। একসময় প্রেমের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হোল। দু’পক্ষে জানাজানি। সকল পত্র-সড়ক-টেলিযোগাযোগ বন্ধ। আমার জীবনও স্তব্ধ। বন্ধু আমার বায়োকেমিস্ট্রির এই হাবিব। গোপিবাগে থাকি আমরা। আর আমার পুরো জগত তখন বাড্ডায় থাকে। এক বিকেলে হাবিব উৎসাহের সাথে বলে, ‘চল বাড্ডা যাই। তবে আমরা গাড়ীতে না হেঁটে যাব।‘ হে হে হে বলিস কী? ঠিক আছে, চল। রওনা দিলাম। টানা এক ঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে গন্তব্যে চলে এলাম। সে এক বিচিত্র অনুভুতি! ঘামের সাথে সাথে বের হতে থাকল সকল শারীরিক উৎকণ্ঠা। বাড্ডায় যখন পৌছুলাম তখন আমি অন্য রকম একজন মানুষ!
টরন্টোর হাবিবের বাসা থেকে বের হয়ে দ্বিতীয় দিন সকালে আবার রাস্তায় নামি আমরা। প্রথম গন্তব্য হাইওয়ে ৪০০ ধরে সাডবারি শহর। একটা কৌতুহুল ছিল এখানকার উঁচু চিমনীটা দেখব। ধোঁয়া বের হবার জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ চিমনী, ৩৮০মিটার; চিন্তা করা যায়! ধোঁয়াটোয়া সব উপর দিয়ে আকাশে পাঠিয়ে দিবে, এটাই ছিল ধারণা। সাডবারিকে বলে অন্টারিও প্রদেশের মাইনিং হাব। একটা সময় খনি থেকে কপার, নিকেল, সোনা তোলা হত। মাইনারদের পদভারে মুখরিত থাকৎ এই জনপদ। এখন অবশ্য কানাডার মাইনিং-এর সেই সুদিন আর নাই। জিওলজিস্ট হওয়ায় সাডবারির মাইনিং-এর প্রতি একটা আকর্ষণ সবসময় ছিল। তাই সু্যোগমত চেখে নেই মাইনিং হাবকে। সবার পেটে ক্ষিদে। আমাদের খেতে হবে, ওয়াশরুম – লেটস গো টু টিম হর্টন্স।
নেক্সট স্টপ sault ste marie শহর। উচ্চারণটা এরকম সু-সেইন্ট-মেরি। সাডবারি থেকে বের হয়ে রাস্তা লেকের দিকে চলে যায়। কাঁদতে থাকা ছেলেটের চোখে জলও বাড়তে বাড়তে লেকের চেয়ে বেশী হয়ে যায়। নয়নাভিরাম লেক হিউরন এর পাশ দিয়ে যেতে থাকি। কানাডা-আমেরিকার বর্ডারের পাঁচটি বৃহৎ লেকের একটি লেক হিউরন। লেক সুপেরিওর আর হিউরনের সংযোগ নদী সেইন্ট মেরি আমেরিকা আর কানাডার বর্ডার। আশ্চর্য হোল নদীর দুইপাশে দুইদেশের শহরের নামও এক; সু-সেইন্ট-মেরি। এখানে ব্যাচওয়ানা ফার্স্ট নেশানদের বসবাস ছিল। এদের পূর্বপুরুষের নির্যাতিত হবার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে। কানাডার সিটিজেনশিপ টেস্ট এর জন্য 'ডিসকভার কানাডা' বইটা পড়েছিলাম। হিস্টরি অব কানাডা চ্যাপ্টারটা পড়ে শরীরের মধ্যে একধরনের কষ্টের তীব্র স্রোত বয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন থাবায় ক্ষতবিক্ষত প্রকৃতির সহজ-সরল আদিবাসীদের করুন আর্তনাদ প্রতিফলিত হচ্ছে বইয়ের পরতে পরতে। তথাকথিত 'সভ্যতা' মঞ্চস্থ করতে রক্তের প্রয়োজন আছে বৈকি।
অদ্য শেষ ঠিকানা ছোট্ট শহর ওয়াওয়া। সু-সেইন্ট-মেরি ছাড়ার পরই আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশাল লেক সুপেরিওর এক পাশে আর এক পাশে পাহাড়। মধ্যে দিয়ে ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে, নয়নাভিরাম। যেন জিলং থেকে বের হয়ে ব্যাস প্রণালীর তীর ধরে গ্রেট ওশান রোডের উপর দিয়ে টুয়েলভ অ্যাপস্টল পর্যন্ত চলে যাওয়া। অথবা সিডনী থেকে তাসমান সাগরের তীর ধরে ওলংগং-এ কফি খেতে যাওয়া। একই রকম অনুভূতি, প্রায় সমপরিমান মুগ্ধতা! পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম হাইওয়ে অনেক আছে। আমাদের কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে ইনানী সে রকম একটি। এই রাস্তাটিকে টেনে আরো লম্বা করে টেকনাফ পর্যন্ত নিয়ে গেলে দুনিয়ার সবাইরে ফেল মেরে দিবে নিশ্চিত।
লেক সুপেরিওর দেখতে সমুদ্রের মত বিশাল, কুল-কিনারা খোঁজা অর্থহীন। মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। প্লেনে গেলে কি এসব দেখা যেত? ওয়াওয়াতে আগেই বলা ছিল বেড এন্ড ব্রেকফাস্টে থাকব। বয়স্ক এক মহিলার নিজের বাসা, অস্বাভাবিক রকমের পরিস্কার, শান্তি শান্তি ভাব। ভদ্রমহিলার নিজস্ব সব্জি বাগান আছে। সেখান থেকে ব্রকোলী, টমেটো আর ফুলকপি ছিড়ে আনল আমাদেরকে রান্না করে খাওয়াবে। ছোট্ট শহরটিতে পৌছুতে পৌছুতে বেলা যায় যায়। তাই কোনমতে খেয়ে ঘুম। সকালে মহিলার বানানো প্যানকেকের নাস্তা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু।
তৃতীয় দিনের প্রথম গন্তব্য নিপিগন শহর। আমরা এখনো অন্টারিও প্রদেশেই আছি। এদিনও লেক সুপেরিওর আমাদের চলার সাথী। লেক বাঁয়ে রেখে আমরা চলছি তো চলছিই। ইতোমধ্যে হিরন বে, টেরেছ বে পার হই। চমৎকার সব দৃশ্যাবলী চারিদিকে। ছোট্ট একটা শহরে এসে পড়ি নাম ‘ম্যারাথন’। নামটা শুনে কৌতুহুলী হয়ে দেখার চেষ্টা করি ম্যারাথন দৌড়ের কোন ছোঁয়া আছে নাকি। না, এটা আসলে ম্যারাথন নামের এক কোম্পানির নাম থেকে এসেছে। নিপিগন ছোট্ট বন্দর-শহর অনেকটা নারায়ণগঞ্জ টাইপের। নর্থ আমেরিকার সুপেয় পানির সবচেয়ে উত্তরের বন্দর। শহরের প্রাণকেন্দ্র মেরিনা দেখতে আদতেই সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন। এখন এসব বাদ আগে খেতে হবে, বাথরুমে যেতে হবে।
চটজলদি ওখান থেকে বের হয়ে গাড়ি চলছে, ইগনেস শহরে যাব। পথে থান্ডার বে শহর আছে, এক্সাইটেড। লেক সুপেরিওর পাড়ের অত্যন্ত মনোরম শহর। কিন্তু জিপিএস শর্ট-কাট করতে যেয়ে আমাদের ট্রান্সকানাডা ছেড়ে অন্য এক রাস্তায় নিয়ে যায়। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারি নি। কিছুদুর যেয়ে মনে হল রাস্তাতো বেশ নির্জন, স্পিডলিমিট মাত্র ৮০ কিমি। এটা নিশ্চয় অন্য রাস্তা। দুইধারে ঘন বন, ঝিরিঝির বৃষ্টি হচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাস বইছে চারিদিকে, এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই অনেকক্ষণ। নির্জনতার পূর্ণ মাত্রা দেখা গেল আরো কিছুক্ষণ পরে। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল কোনদিক থেকে কোন গাড়ী আসছে না। কোন মানুষ নেই, ঘরবাড়ী-দোকানপাঠ কিছুই নেই। ব্যাপার কী? এ বনের শেষ কোথায়। মনে হচ্ছে সুন্দরবনের মধ্যে আছি। খালের মধ্যে দিয়ে নৌকার পরিবর্তে আমরা পীচঢালা রাস্তায় গাড়ীর মধ্যে। ঝিরঝির বৃষ্টি দু’জায়গাতেই ছিল। তবে সুন্দরবনে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ ছিল আর এক্ষণে সে অর্থে প্রায় নির্জন। এ মুহূর্তে সুন্দরবনের একটা ঘটনা মনে পরে যায়।
অনেকদিন আগে বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেড থেকে এমভি ভেলা ভাড়া করেছি। গন্তব্য সুন্দরবন। কটকা পৌছে বনবিভাগের রেস্টহাউসের উল্টো দিকে জাহাজটি নোঙ্গর করা হয়েছে। এখন মাইল তিনেক হেটে জামতলা সৈকত, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য। মন ভারী হয়ে আছে। ছোট্ট মেয়েটির ১০২ ডিগ্রি জ্বর। কেমন তিরতির করে কাঁপছে আর ঘোলা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে পিট পিট করে। বছর চারেকও হয় নি। দোটানায় আছি।
ধুর! যা হয় হবে, বলে ওকে পাজকালো করে দিলাম হাঁটা। এরপর ঘন্টা চারেকের অবিরাম দাপাদাপি। বিষম খেতে খেতে ওর চোখ-নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। লবণাক্ত পানি খেয়ে পেট ফুলে ঢোল! জাহাজে ফিরে দেখি কোথায় জ্বর আর কোথায় কাঁপাকাঁপি? অদ্ভুদ আনন্দে ঝলমল করছে। ঢাকায় ফেরত আসার পরও ওর সেই মোহ কাটে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর রমনা পার্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ঘন গাছপালা দেখেই বলে উঠে, ‘বাবা দেখো, শুধু সুন্দরবন আর সুন্দরবন!’
মেয়েটি এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলছে আরো ঘন্টাখানেক। না, কোথাও কেউ নেই। শুধুই বন আর বন, মেঘলা আবহাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট। চতুর্দিকে কেমন অন্ধকারের আবহ। তাই দেড় ঘন্টা ধরে এক ধরনের ভয়ের মধ্যে সেঁধিয়ে আছি। গাড়ীর কিছু হলে কী হবে? অবশ্য তেল আছে যথেষ্ট। হঠাৎ মরূদ্যানের মত একটা বাড়ী-কাম-কনভেনিয়েন্স স্টোর উদয় হোল। মুহূর্তেই গাড়ী ব্রেক, ঢুকে গেলাম ওখানে। বয়স্ক এক ভদ্রমহিলার কাছ থেকে একটা কফি নিয়ে আলোচনার সারমর্ম হোল; আমরা একটা ইন্ডিয়ান রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ভদ্রমহিলা নিজেও ইন্ডিয়ান। বনের ভিতরের দিকে আদিবাসীরা থাকে। মেইন রাস্তায় সহজে আসে না। আর আজকের আবহাওয়া খারাপ তাই এদিকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আরো ভয়ংকর খবর হল আগামী এক ঘন্টাও ঠিক এরকমই হবে। আমাদের আর কী করার আছে? ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কিসে ভয়?’
নির্জন রাস্তা আর ঘন বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই আমরা একসময় ইগনেস পৌঁছে যাই। অতীব দুঃখের সাথে দেখলাম আগ্রহের থান্ডার বে শহর বাইপাস করে ফেলেছে জিপিএস। ইগনেস পুরনো ছোট্ট শহর, দেড়শত বছর আগের। কানাডা-প্যাসিফিক রেলওয়ের একটা ডিভিশনাল পয়েন্ট এখানে। নিত্যকাজ সেরে আমরা কেনোরা শহরের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছাড়ি। ওখানেই রাত্রি যাপন হবে। নর্দান অন্টারিওর এই জায়গাগুলো পুরোটাই বনজঙ্গলে ভরা। মাঝে মাঝে জলাশয়, লেক, নদী আছে। বনের ভিতর দিয়ে পীচ ঢালা রাস্তা। এসময় আমরা প্রথম টাইম জোন অতিক্রম করে ফেলি। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে যায়। মোবাইলের দিকে তাঁকিয়ে দেখি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময় পরিবর্তনের দৃশ্য। দারুন মজার ব্যাপার ছিল!
কেনোরাতে কিচেনেটসহ একটা মোটেল ভাড়া নেই। আসার সময় কিছু গ্রোসারী আর ডিম কিনেছিলাম। গরম গরম রান্না হবে আজ রাতে। ভাতের সাথে ডিমভাজি আর আলুভর্তা। সাথে বিফ রান্না ছিল। রান্নার মসলাপাতি সাথেই আছে। সেই সাথে একটা মোবাইল চুলাও ছিল। ভেতো বাঙ্গালী যেখানেই যায়, রসুইঘর সাথেই যায়। এমনিতেই ক্লান্ত তার উপর গরম ভাত, স্বর্গতো এখানেই। পেট পুরে গলা অব্দি খেলাম। নিশ্ছিদ্র ঘুমের বড়ই প্রয়োজন। শরীরটা নেশার ঘোরের মত নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ঘোরের মধ্যেই অনেকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পরছে।
দৃশ্যটা ভাবলে এখনো মুগ্ধ লাগে। ১৯৮৯/৯০ সালের দিকে। চিটাগং থেকে রাঙ্গামাটির বাসে উঠেছি, আমরা ক’বন্ধু। লক্কর-ঝক্কর বাস। পিছনের দিকে বসেছি। গেরুয়া পড়া মাঝ-বয়সী এক ভদ্রলোক আমাদের পাশের সিটে। মাথা কামানো, চেহারায় সৌম্য-সৌম্য একটা ভাব। বৌদ্ধ সন্যাসী-টন্যাসী হবে। কেমন ঝিম মেরে বসে আছেন। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পরেছেন। বাস চলছে, একটু দ্রুতই চলছে। পাহাড়ী রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো, পিছনের দিকে ঝাঁকিটা গায়ে লাগছে। আমাদের বয়স কম, এসব নিয়ে কে ভাবে। গল্প করছি। যাত্রীদের কেউ কেউ চালককে আস্তে চালাতে বলছে। এক পর্যায়ে বাসের ঝাঁকাঝাঁকি এবং যাত্রীদের চেঁচামেচি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার মত অবস্থা হল। ‘এই বেটা আস্তে চালা, নইলে তোর ....’, যাত্রীদের তাঁরস্বরে চিৎকার। এ রকম সিচুয়েশনে সবকিছু ছাপিয়ে হঠাৎ গুরুগম্ভীর আওয়াজ, ‘এই, চুপ’! আমরা আচমকা শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখি গেরুয়া। বসা থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাড়াল। যাত্রীরাও কেমন চুপ মেরে গেল। ভাবল ড্রাইভারকে উনি কষে গাল দিবেন। না, গেরুয়া তাঁর দুইহাত পাখির মত প্রসারিত করে উড়ে যাবার ঢঙ্গে অত্যন্ত মোলায়েম সুরে বলে উঠল, ‘ড্রাইভার, উড়ে যা’। আমরা বিষ্মিত, বিমোহিত! দাদা যে সপ্তম স্বর্গে আছেন। পুরো বাস স্তব্ধ, শুধু ড্রাইভার মহা-উৎসাহে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে গেরুয়াও ধীরে ধীরে ঝিমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।
আমিও গেরুয়ার মত ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। চতুর্থ দিন সকালে ঝরঝরে হয়ে ঘুম ভাঙল। উড়ুক্কু মনে যাওয়ার নেশা, দেখার নেশা। আজকে অন্টারিও থেকে ম্যানিটোবা প্রদেশে ঢুকব। ছোটবেলায় ভুগোলে পড়া কানেইডিয়ান প্রেইরী এখান থেকেই শুরু। মাইলের পর মাইল ধু ধু তৃণভূমি। সাডবারির পর থেকে পুরো ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে সিঙ্গেল লেনের, স্পিডলিমিট ৯০কিমি। কিন্তু ম্যানিটোবায় ঢুকেই ডাবল লেনের ফ্রীওয়ে, স্পিডলিমিট ১১০কিমি। ওয়াও! চালাও গাড়ি! সমতল রাস্তা, উঁচুনিচু নেই। গাড়ীর ক্রুজকন্ট্রোলে স্পিড সেট করে দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাক। আলসে ড্রাইভিং। উইনিপেগ পৌঁছে গেলাম সহসাই।
উইনিপেগ ম্যানিটোবার রাজধানী শহর, বেশ বড়। ছেলেমেয়েরা ম্যাকডোনাল্ডসে যেতে চাচ্ছে, ফার্স্টফুড খাব। নিকটেই খুঁজে পাওয়া গেল। ম্যাকডোনাল্ডস চান্দে গেলেও পাওয়া যাবে, নিশ্চিত। ফিস-অ-ফিলে আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাবাড় করে শহরটাকে চক্কর দিতে হবে। গাড়ী করে যতটুকু দেখা যায়। কানাডার বড় শহরগুলোর মধ্যে এখানেই আদিবাসীদের আধিক্য বেশী। রেড রিভার আর আসিনিবোয়েন রিভারের সংযোগস্থলকে উইনিপেগের কেন্দ্রস্থল বলা যায়। এই জায়গাটা খুবই চমৎকার, নয়ন মনোহর। সুন্দর একটা নামও রেখেছে, দ্য ফর্ক। ম্যানিটোবার সুদৃশ্য সংসদ ভবনটা এখানেই। শপিং মল আছে, এন্টারটেইনমেন্টের যাবতীয় সব ইভেন্ট সাজানো আছে এখানে। এদিকে যে শহরেই যাই না কেন চায়না টাউন আমাদেরকে টানে। এখানেও তাই, এক পলক চায়না টাউন না দেখে গেলে কি হয়!
উইনিপেগ ছেড়ে গাড়ী ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে ধরে পশ্চিম দিকে চলছে। ব্রান্ডনে গিয়ে থামব আবার। ডাবল-লেনের ফ্রীওয়ে, দ্রুতগতিতে গাড়ী চালানো যায়। চারিদিকে বৈচিত্রতা তেমন নাই বললেই চলে। সোজা রাস্তা কোন আঁকাবাঁকা নাই, চোখ বন্ধ করেও চালানো যাবে। মাঝে মাঝে দু’ধারে উইন্ডমিল দেখা যাচ্ছে। সময়মতই ব্রান্ডনে পৌঁছে যাই। প্রাকৃতিক কর্ম শেষ করে আবার চলা শুরু।
এবারের গন্তব্য রেজাইনা। সাস্কাচুয়ান প্রদেশের রাজধানী। কিছুক্ষণ পরেই ম্যানিটোবা ছেড়ে সাস্কাচুয়ানে ঢুকে যাব। সেই একঘেয়ে প্রেইরী, ধু ধু সমতলভূমি। একটু পরপর একেকটা ছোট শহর আসে আবার পার হয়ে যায়। পথের দুধারে ফসলের মাঠ। হলুদ সরিষা ক্ষেত চোখ জুড়িয়ে দেয়। রেজাইনা পৌঁছে আজকের রাত্রি যাপন, বেস্ট ওয়েস্টার্ণ প্লাস হোটেলে। চেকইন করে লাগেজ রেখেই বেড়িয়ে যাই শহর দেখতে। সাস্কাচুয়ানের রাজধানী হলেও বেশ ছোট্ট শহর। বিশ মিনিটেই এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া যায়। সাস্কাচুয়ানের লেজিসলেচার বিল্ডিংটা ঘুরে আসলাম চট করে। ইতোমধ্যে বাইরে থাকা বেশ কষ্টকর হয়ে দাড়াল। কারণ মশার অত্যাচার। পারলে নাকে-কানে মশা ঢুকে যায়, গুনগুনতো আছেই। এত মশা এ শহরে আছে চিন্তাই করতে পারিনি।
পঞ্চমদিন ক্যালগেরির উদ্দেশ্যে যাত্রা। কোন বৈচিত্র নেই, চোখ বন্ধ করে গাড়ী চালাচ্ছি। একটানে মেডিসিন হ্যাট শহরে পৌঁছে গেলাম। এই শহরের নামটা অদ্ভুদ লাগে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ওষুধের টুপি। ইতোমধ্যে আমরা সাস্কাচুয়ান ছেড়ে আলবার্টা প্রদেশে ঢুকে পরেছি। সাথে সাথে আমরা পরবর্তী টাইম জোনেও এসে পরেছি। ঘড়ির কাঁটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার একঘন্টা পিছিয়ে যায়। মেডিসিন হ্যাটে খেয়েদেয়ে আবার চলা ক্যালগেরি পর্যন্ত। বিকালেই এসে পরি ক্যালগেরি, কানাডার পেট্রোলিয়াম হাব। পুরো প্রদেশটা যেন তেলের উপর ভাসছে। হিউস্টনকে মক্কা ধরলে পেট্রোলিয়াম দুনিয়ায় ক্যালগেরি হচ্ছে মদিনা। ডাউন্টাউনের ৭০ভাগ দালানকোঠা কোন না কোন তেল কোম্পানির। শহরটি ছোটই ছিল কিন্তু বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এখন অবশ্য রিসেশন চলছে। অতীত ঢাকার সাথে ক্যালগেরির কিছুটা মিল আছে বোধ হয়।
ঢাকা শহরের উত্থান-পতন বহু যুগের স্বাক্ষী। সময়ের সাথে এর শৌর্য্য-বীর্য্য বেড়েছে কমেছে। একদিনে তো আর বুড়িগঙ্গা থেকে টঙ্গী অব্দি চলে যায়নি শহরটা! মোঘলদের সময়ে নতুন রাজধানী হিসেবে এর জৌলুশ ছিল সুপারমুনের মত। ঐ টুকু শহরে ৯ লক্ষ মানুষ! কিন্তু রাজধানী মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ায় গুরুত্ব হারায় শহরটি। জনপ্রিয়তা কমতে কমতে মাত্র ৫০ হাজারে নেমে আসে। ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গের বাইপ্রোডাক্ট রাজধানী হিসেবে জৌলুস আবার বাড়তে শুরু করে। রবীবাবুসহ কতকের আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ রদ গুরুত্ব সামান্য কমিয়ে দিলেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজধানী হয়ে ঢাকা তিলোত্তমার আঁকার ধারণ করছে।
ঢাকার এই পরিবর্তন হয়েছে অনেক বছরে, ঠিক করে বললে কয়েকশ বছরে। আর আশ্চর্য! ক্যালগেরির পরিবর্তন মাত্র কয়েক দশকের। ছোট্ট শহরটি বাড়ে-কমে করতে করতে এখন বেশ বড় শহর হয়ে গেছে, কানাডার চতুর্থ বৃহত্তম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তেলের দামের সাথে উঠানামা করে এই শহরের ভাবভংগী। মাত্র কয়েক বছর আগে শহরটি শান-শওকতে পরিপূর্ণ ছিল। আর এখন স্মরণকালের ভয়াবহ রিসেশন ভোগ করছে। প্রায় সত্তুর শতাংশ জৌলুস একেবারে ধুলায়-মাটিতে গড়াগড়ি। বিশ্ববাজারে তেলের যে বর্তমান মতিগতি তাতে আরো কয়েক বছর এ অবস্থা থাকবে নিশ্চিত। মানে ক্যালগেরি আরো তলিয়ে যাবে। ভুতুড়ে থেকে আরো ভুতুড়ে হয়ে যাবে শহরটি। তবে আশার কথা গত কয়েক দশকে বার কয়েক এ চক্র দেখেছে ক্যালগেরিয়ানরা। তাই ফিঙ্গার ক্রস করে আছে!
ক্যালগেরিতে আমাদের এপার্টমেন্ট ভাড়া করা আছে। মালপত্র নিয়ে নিজের বাসায়, আহ শান্তি! খাবারদাবার গুছিয়ে নিলাম। কিছু জিনিসপত্র রেখেও গেলাম। সকালে উঠেই আবার যাত্রা, উদ্দেশ্য ভ্যাংকুভার।
ষষ্ঠ দিন শুরু হয়ে গেল। ক্যালগেরি থেকে আধাঘন্টা পশ্চিমে গেলেই ভূগোলে পড়া বিখ্যাত সেই রকি মাউন্টেইন। ছোটখাট পাহাড়-টিলা পার হয়ে কানানাস্কিস এলাকা থেকে পাহাড় উঁচু হতে থাকে। গ্রেট রকি তাঁর আসল রূপ দেখাতে থাকে। পরবর্তি আঁটশত কিলোমিটার শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সাথে আছে নয়নাভিরাম সব পাহাড়ী লেক, নদী, ঝরণা। ক্যালগেরি থেকে দেড়ঘণ্টা পরেই ব্যানফ শহর। গাড়ি ঘুড়িয়ে শহরটা একটু চক্কর দিয়ে যাই। পর্যটনের স্বর্গ ব্যানফ। চারিদিকে উঁচু পাহাড় মাঝখানে ভ্যালির মত শহর। একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে, স্বর্গোদ্যান অবশ্যই। এরপর নয়নাভিরাম লেক লুইজ ঘুড়ে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে ঢুকে পরি। প্রথম শহরের নাম ফিল্ড, অদ্ভুদ নাম। আরো একটু এগিয়ে গেলেই কিকিং হর্স এলাকা, এখানেই ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে সবচেয়ে উঁচু ১৬৪৩ মিটার সমুদ্র লেভেল থেকে। ঠিক বান্দরবান-থানচি রুটের পিক-৬৯ এর মত। অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে, মেঘমালা আমাদের নীচে দিয়ে চলছে। কানের মধ্যে উচ্চতাজনিত চাঁপ অনুভূত হয়। এর মধ্যে তৃতীয় টাইম জোনটাও পার হই আমরা।
আমাদের যাত্রাবিরতি গোল্ডেন শহরে। এখানে পুরো হাইওয়ে পাহাড়ী, উঁচুনিচু। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ড্রাইভিং-এর জন্য আদর্শ। রাস্তার উপরে কৃত্রিম ব্রিজ বানিয়ে রাখা হয়েছে যাতে বন্যপ্রাণী রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে। হঠাৎ গাড়ীর জটলা, সব গাড়ী দাড়িয়ে গেছে। কেন? চারচারটা ভাল্লুক রাস্তার কাছাকাছি, গাছের গুড়ি খাচ্ছে। ছবি তোলার হিড়িক পরে গেছে। গোল্ডেনের পরেই সিলক্রিক মাউন্টেইন, বছরে প্রায় ১০ মিটার বরফ পরার রেকর্ড আছে।
এরপর রেভেলস্টক হয়ে আমরা কামলুপের পথে। রাস্তায় স্যালমন আর্ম শহর পার হই। এটা এক আজব শহর! প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হাজার হাজার লাখ লাখ স্যামন ফিস আসে এখানে। নদীর রং লাল হয়ে যায় মাছের রংয়ের সাথে মিশে। লিপ ইয়ারের মত চার বছর অন্তর মাছের সংখ্যা কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। কামলুপ শহরে দিনের দ্বিতীয় যাত্রবিরতি। লেকের পাড়ে চমৎকার বাগানের মত খোলা জায়গায় বসে পরি আমরা। বাসা থেকে আনা বিরিয়ানী পেট পুরে খাই। ঝির ঝির বাতাস বইছে, মনে হচ্ছে ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পরি। শহরটা বড়। বিশেষত্ব হচ্ছে - কামলুপ কানাডার টুর্নামেন্ট সিটি। কারণ এখানে আছে ৮৪টি বেসবল ফিল্ড, ৭৩টি ফুটবল খেলার মাঠ, ৫টি আইচ হকি এরেনা, ১০টি জিম, ৫৩টি টেনিস কোর্ট, ১১টি গলফ কোর্স এবং একটি স্টেডিয়াম। কামলুপের মত একটি শহরের জন্য যথেষ্ট বেশী সংখ্যাগুলো।
কামলুপের যাত্রাবিরতি শরীরে ক্লান্তি এনে দিলেও সময় তো আর থেমে থাকে না। অগত্যা উঠতে হয়। গাড়ী চলে ভ্যাংকুভারের উদ্দেশ্যে। পার হই পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ককুইহালা হাইওয়ে। স্পিডলিমিট ১২০ কিমি এবং প্রশস্ত। পাহাড়ী উঁচুনিচু ঢালবিশিষ্ট রাস্তা। চারিদিকে মনোরম সব দৃশ্যাবলী – চোখের দৃষ্টি রাস্তা ছেড়ে প্রকৃতির দিকে ছুটে যায়। দুর্ঘটনা ঘটে কিনা কে জানে? অবশ্য শীতকালে অ্যাভালেন্স বা বরফধ্বস হয়ে দুর্ঘটনা প্রায়শ ঘটে। আরেকটি বিচিত্র নামের শহর পার হই এখানে - মেরিট। এখান থেকে একটু আগালে শহরটির নাম হোপ, বিচিত্র নামই তো! হোপের পরেই রকি মাউন্টেনের আপাতঃ সমাপ্তি। আমরা সমতলে চলে আসি। ভ্যাংকুভার আর মাত্র দেড়শ কিলোমিটার। মাঝখানে অ্যাবোটসফোর্ড, সারে তারপরই বহু আকাঙ্ক্ষিত ভ্যাংকুভার।
কানাডার তিনটি বৃহৎ শহর; টরন্টো, মন্ট্রিয়াল এবং ভ্যাংকুভার। এ যাত্রায় তিনটি শহরেই আমাদের ছোঁয়া লাগে। এর মধ্যে ভ্যাংকুভার ব্যতিক্রম শহর। প্রতি বছরই দুনিয়ার সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ভ্যাংকুভার উপরের দিকেই থাকে। প্যাসিফিকের পারের নির্মল বাতাসের শহর, নিত্য বৃষ্টি হয় বলে সর্বদাই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে এত এত দর্শনীয় স্থান আছে যে বর্ণনা করার জায়গা পাওয়া যাবে না। তবে স্ট্যানলি পার্কের কথা না বললেই নয়। পুরো পার্কটি যেন সবুজের আঁধার। এরপর লায়ন্সগেট ব্রিজ পেরিয়ে ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ। প্রচন্ড ভয় আর শঙ্কা নিয়ে হেঁটে ব্রীজটি পার হবার পর মনে হয় এ যাত্রা যেন বেচেই গেলাম। রাত হয়ে গেলে হোটেলে প্রত্যাবর্তন, ফেয়ারমন্ট প্যাসিফিক রিম – সদ্য বানানো আধুনিক হোটেল একেবারে স্টেইট-অব-দ্য-আর্ট। সপ্তমদিন খুব ভোরে উঠতে হল আমাদের। প্রথম ফেরিটা ধরতে হবে ডিপারচার বে থেকে। ওখান থেকে ভ্যাংকুভার আইল্যান্ড। ফেরি পারাপারের সময় আমার গোয়ালন্দ-আরিচা লঞ্চ পারাপারে দৃশ্যটা মনে পরে, আমি নিজের মনেই হেসে উঠি।
১৯৯৮/৯৯ সালের দিকের কথা। পরিবার তখন ঢাকায় থাকে। আমি প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-গোয়ালন্দ আসাযাওয়া করি। বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন। বড়ই উপভোগ্য, আনন্দময়। পদ্মায় লঞ্চ-পারাপার ছিল আরেকটি বিনোদনের বিষয়। তবে বর্ষাকালে একটা বিপদ ছিল, লঞ্চের দুলুনী। নদীর বিশেষ একটা জায়গায় দুলুনীটা বেশীই ছিল। মাঝে-মাঝেই ঢেউয়ের পানি লঞ্চের ভিতরে পর্যন্ত ঢুকে যেত। এ লাইনে অনভ্যস্ত-আনকোরাদের জন্য বেশ ভয়ংকর। ছুটাছুটি, কান্নাকাটি, সৃষ্টিকর্তার দয়াভিক্ষা এসব ছিল নিত্তনৈমত্তিক। দৃশ্যগুলো ভালই লাগত। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি ভয়ের খুব একটা কারণ নেই। কদাচিৎ লঞ্চডুবি হয় এখানে।
একদিনের ঘটনা। যথারীতি লঞ্চে উঠেছি। দুজন অতি-আধুনিক তরুনী লঞ্চের যাত্রী। আমি আঁড়চোখে তাঁদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছি। তখন সবে মোবাইল এসেছে কিছু মানুষের হাতে। তরুনীদের মোবাইল তাঁদের স্মার্টনেস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কথা-বার্তা চোস্ত ইংরেজীতেই বলছে। বয়স্ক এক ভদ্রলোকের মাথায় টুপি এবং গালে দাড়ি দেখে সেকি হাসি। ইংরেজীতে বেশ কিছু গালিও দিয়ে দিল। গালিতে ধর্মও বাদ গেল না। ভাগ্যিস ভদ্রলোক এই ভাষা জানেন না।
এরিমধ্যে লঞ্চ সেই বিপদজনক জায়গায় এসে পড়ছে এবং শুরু হোল দুলুনী। সেদিন দুলুনীটা একটু বেশীই ছিল। পানির ঝাঁপটা আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। যাত্রীরা এপাশ থেকে ওপাশে ছিটকে যাচ্ছে। চারিদিকে চিৎকার-কান্নার রোল। মানুষ তাঁরস্বরে আল্লাহ-ভগবানকে ডাকছে। আমি আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছি - তরুনীরা কী করে। কিছুক্ষণ আগের ড্যামকেয়ার অভিব্যক্তি মুহুর্তেই উধাও। অজানা ভয়ে দুজনে দুজনকে ধরে কুঁকড়ে আছে। এরিমধ্যে মাথায় কাপড় দিয়ে ফেলেছে। বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছে। বুঝলাম মুসলমানের মেয়ে, বিপদে পরে দোয়া-দুরুদ পড়ছে। আমি মিটিমিটি হাসছি। বিস্ময় কপালে তুলে দেখি একটু আগে যেই ভদ্রলোককে নিয়ে হাসাহাসি তাঁকে বলছে একটু দোয়া করতে। চাচাজান-চাচাজান বলে কান্নাকাটি করছে। আমার হাসি ঠেকায় কে? বাড়তে বাড়তে দুকান ছুয়েছে। ভাবি, হায়রে আধুনিক! লঞ্চঘাটে নামার সময় তরুনীদের একজন আমাকে বলছে, ‘আপনি মানুষ না পিশাচ। এমন বিপদে কেউ হাসে?’ আমি আরেকটা হাসি দিয়ে ঘাটে নেমে যাই।
যাহোক, হালকা কুয়াশাঘেরা সকালে নর্থ ভ্যাংকুভারের ডিপারচার বে থেকে ফেরিতে উঠেই চোখ ছানাবড়া! দুনিয়াটা এত সুন্দর! ঠিক পানির ভিতর থেকেই ছোটবড় পাহাড় উঠে গেছে, আমাদের ফেরি এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। আবছা আলোয় সবকিছু অপার্থিব লাগছে। মোট দুঘণ্টা আমরা যেন ঘোড়ের মধ্যে ছিলাম। মালয়েশিয়ায় অনেকদিন আগের আলোর সেতার আর লংকাউই ফেরি পারাপারের সাথে তুলনীয় মনে হল। অতঃপর নানাইমো ঘাটে ফেরি ভিড়ল, আমাদের সাময়িক বিরতি। নয়নাভিরাম নানাইমো শহরটি ঘুরে দেখার মত। একটার পর একটা সি-প্লেন আসছে, যাচ্ছে। ট্যুরিস্টের ছড়াছড়ি সবখানে। ওখান থেকে বেরিয়ে ইংলিশম্যান রিভার ফলস দেখতে যাওয়া। গা ছমছম করা রেইনফরেস্টের বিশাল বড় বড় গাছ, বেড় দিতে পাঁচজন মানুষ লাগবে। তাঁর মধ্যে ছোট্ট একটা ওয়াটার ফলস। চমৎকার লাগল আমাদের। পরবর্তি গন্তব্য পোর্ট আলবের্নি, ছোটখাট বন্দরশহর। নদীর পাড়ের চমৎকার একটা জায়গায় আমরা খাওয়া সারলাম। চারিদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম। খেয়েই রওনা দেই টফিনোর উদ্দেশ্যে। কানাডার পশ্চিম উপকূলের শেষ ভৌগলিক সীমানা। এরপরই দ্য মাইটি প্যাসিফিক!
পোর্ট আলবের্নি পার হয়ে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কোন নেটওয়ার্ক নেই, গা ছমছম করা পাহাড়ী রাস্তা। খুবই সরু এবং অপ্রশস্ত, গায়ে গা লেগে যাবার মত। তবে প্রচন্ড অ্যাডভেঞ্চার আছে এখানে। পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হয় আকাশে উঠে গেলাম আবার নামতে নামতে পাতালে। রাস্তার পাশেই বিরাট খাত, এরপর লেক; এক কথায় অপুর্ব! সামান্য এদিওদিক হলেই কুপোকাত। পাহাড়ী বাঁকে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে হাত ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগার। তবে টফিনোর চেস্টারম্যান বিচে নেমে আমাদের সব বিষ্ময় একসাথে একজায়গায় ঘনীভূত হোল। বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে আমরা সমস্বরে বিরাট এক চিৎকারে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেই, ‘উই আর ইন মাইটি প্যাসিফিক নাউ!’
প্রশান্ত মহাসাগরে জীবনের প্রথম অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখে আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছেড়ে দেই। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তা শরীরে উত্তেজনা এবং ভয়ের অদ্ভুদ মিশেল তৈরি করে। লক্ষ্য ভিক্টোরিয়া শহরের ফেয়ারমন্ট এমপ্রেস হোটেল – ব্রিটিশ ঐতিহ্যের চমৎকার নিদর্শন। পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোর দুইটা বেজে যায়। হোটেলে ঢোকার আগে ভিক্টোরিয়াতে ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের শেষ মাথা জিরো মাইল ছুঁয়ে আসি আমরা। পাঁচ হাজার কিলোমিটার রাস্তার এখানেই শেষ। বিশাল এক জার্নি-বাই-রোডের আপাতঃ সমাপ্তি এখানেই। ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছে খুটা গাড়া শেষ।
কানাডা শান্তিময় দেশ। পুরো রাস্তায় ভ্রমণে কখনই মনে হয়নি আমাদের ভয়ের কিছু আছে, বিশেষ করে মনুষ্য-বিপদ। যাহোক, এখন ক্যালগেরি ফিরতে হবে, প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। সাতদিন যাবৎ চলার ক্লান্তিতে শরীরের সব নাট-বল্টু ঢিলা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট নাই কিছু শরীরে। দিতে দিতে এখন নিঃশেষিত প্রায়। শুরুতে যতটা গর্জন ছিল তার ছিটেফোঁটা নেই এখন। এক্ষেত্রে মোমবাতির উপমাই বলে সকলে, ‘যত জ্বলে তত গলে’। ছড়িয়ে দেয় আলো, সবাইকে। নিজেকে নিঃশেষ করে, একেবারে বিলিয়ে দিয়ে। বিরাট ত্যাগ-ট্যাগ এর ব্যপার, নিঃসার্থ! আশ্চর্য! কেউ কিসমিসের কথা বলে না। কিসমিসের আত্মত্যাগের কথা কোথাও নাই। কী কুক্ষণে যে একগাদা ঘন চিনির দ্রবণ সে ধারণ করেছিল! ফলে মুঠোভরে তাঁর জায়গা হয় পায়েশের হাড়িতে। পাতলা লিকুইড নিংরে-চিপ্সে-চুষে বের করে আনে চিনিমিশ্রিত সুস্বাদু ঘন মধু। কিসমিস দিতে না চাইলেও ছিদ্রযুক্ত পাতলা মেমব্রেন-এর বাইরে ছেড়ে দিতে হয় প্রিয় সুধাকে। বিনিময়ে পায় শুধুই পাতলা পানি। দুঃখের বিষয় এই পানির কারণে ও ফুলেফেঁপে উঠে, একসময় ঢোলের মত হয়ে যায়। বোধ করি টুপ করে ফেঁটেও যায়, হয় সলিল সমাধি। আহারে!
গত সাত দিনে ঘটনা যা ঘটছে, নিংরে-ফিংরে সব রস অলরেডী শুষে নিয়েছে। কোনভাবেই আমার চামড়ার ছিদ্রগুলি বন্ধ করতে পারছি না। একটু একটু করে ঢুকিয়ে দিয়েছে ঐ পাতলা পানি, অতি-সচেতনভাবেই। পেটমোটা সুমো কুস্তিগীর হয়ে গেছি এবং ফেঁটে যাবার প্রহর গুনছি।
আমার ছোট ভাই দশ বছরের ছোট। পুরনো দিনের কথা, ও তখন আরো ছোট। বলে কি, ‘চোঙ্গা লাগবে’। আমি আর বুঝি না। একটু পরে জানলাম যে চঙ্গের কথা বলছে। কী এক বিচিত্র কারণে চঙ্গকে ও চোঙ্গা বলত। আমাদের এলাকায় ‘চঙ্গ’ নামটা বেশ প্রচলিত ছিল। এখন বোধ হয় মই চালু হয়ে গেছে। অতি-আধুনিকেরা নিশ্চয় ল্যাডার বলে। ভিক্টোরিয়াতে গত দুইদিন যাবৎ একখান চঙ্গের খুব অভাব বোধ করছি। প্রচুর ফালাফালি করছি। ডান পা’টা ভেঙ্গেছে ১৯৯৯ সালে। তাই নিয়েই জেভিয়ের সটোমেয়র-এর রেকর্ড লাফখানা দেই। কোন কাম হয় না। একখান চঙ্গের খুব দরকার। ফাঁটতে চাইনা। দেড় হাজার কিলোমিটার অনেক রাস্তা, পার হতে হবে। ক্যালগেরি পৌছাতে হবে যে!
বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীর চমৎকার একটি বাইপ্রোডাক্ট হচ্ছে নতুন নতুন জায়গা চেনা। বদলীর চাকুরী, আজ এই জেলা তো কাল আরেক জেলা। ভালই লাগে আমাদের। নতুন জায়গায় পোস্টিং হয়, ভিন্ন রকম মানুষের সাথে পরিচয়। জীবনঘনিষ্ঠ হবার আগেই বিদায়, আরেক জায়গায় আবার। এমন ঘুরতে ঘুরতে অস্ট্রেলিয়ায় বছর দুই কাঁটিয়ে আবার বাংলাদেশ হয়ে কানাডার টরন্টোতে ঘাঁটি গাড়ি। বাস্তবে এখানেও স্থিতি হয় না, পরবর্তী গন্তব্য ক্যালগেরি। এটাই সর্বশেষ আস্তানা। টরন্টো থেকে মালামাল বস্তাবন্দী করে ভ্যানলাইন মুভার দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এক্ষণে আমাদের যাওয়ার পালা। এদিকে বেশ কিছুদিনের অবসর। তাই ভাবছি অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কিছু। অবসরের অলস ভাবনা পেয়ে বসে।
অবসরে কী করেন? সাধারণ এ প্রশ্নটি যদি অসাধারণ সব ব্যক্তিত্বদের করা হয় তবে কে কী বলবেন তার একটা অনুমিত তালিকা করেছি। সৈয়দ শামসুল হক (চিবিয়ে চিবিয়ে) – অবসর কোথায়! বাংলা ভাষার সেবা করেই তো সময় চলে যায়। হুমায়ুন আজাদ – সিমোন দ্য বোভইর-এর দ্য উইমেন ডেস্ট্রয়েড এবং নোয়াম চমস্কির ল্যাংগুয়েজ এন্ড থট পড়ছি। কঠিন কঠিন সব বই পড়ি অবসর কোথায়! হুমায়ূন আহমেদ – আমার কন্যারা টিভি দেখতে খুব পছন্দ করে। আমাদের টিভিটা নাকি পাশের বাড়ির চেয়ে ছোট। তাই বেশী বেশী লেখার চেষ্টা করছি যাতে একটা বড় টিভি কিনতে পারি। জাফর ইকবাল – রাজাকার ছাঁকার ফিল্টারটা পরিস্কার করছি।
আমাকে তো এই প্রশ্ন অন্য কেউ করবে না, তাই নিজেই করি। অবসরে আমি কী করি? মদে তেমন একটা রুচি নেই। গাঁজা আমেরিকার অনেক শহরে বৈধ হলেও কানাডায় এখনো অবৈধ। সত্যি বলতে কি অবসরে আমি শুধু ফেইসবুকের পাতা উল্টাই। লাইকের পর লাইক দিয়ে যাই। ফেইসবুকের কাছে গত কয়েক বছরের লাইকের পরিসংখ্যান যদি থাকে তবে সেই তালিকায় অবশ্যই আমি উপরের দিকে থাকব। তার মানে সারাজীবন খালি অকাজই করে গেছি। ঐকালে সেবা প্রকাশনীর দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা আরো সব জ্ঞানের বই পড়তাম আর এখন ফেইসবুক। অকাজ আর অকাজ!
তো এই ফেইসবুক ভাজাভাজা করে কী পাইলাম। বিভিন্ন ধরনের পোজ দেয়া ছবি, নানান কৌতুক, রাজনীতি আরও কত কী। এছাড়াও নবীন-প্রবীন অনেকেই মনের ভাব প্রকাশের জন্য এখানে দু’চার কলম লেখার চেষ্টা করেন। লেখাগুলোর মধ্যে স্মৃতিচারণমূলক লেখাই সর্বাধিক। কী থাকে না এসব স্মৃতিচারণে! বাল্যকাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব। ভাল ভাল কথাই বেশী থাকে – দু’চারটি দুষ্ট কথাও। মহান সৃষ্টিকর্তা অনেক ভেবেচিন্তে বানালেন ‘ছুচো’ আমরা বলতাম ‘চুহা’। খুবই অপ্রয়োজনীয় এই সৃষ্টি জগতের কোন কল্যাণে লাগছে এ নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তাই বলে চুহাকে তো আর অস্বীকার করতে পারিনা। তাই চিন্তা করছি একটা চুহা বানানোর চেষ্টা করি। একটা মেমোরেবল ভ্রমণ করব, যা থেকে কিছু কিছু স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
আমিই শুরু করলাম, ‘সমস্ত মালামাল চলে গিয়েছে, শুধু আমরা ছাড়া। এবার তোমরা বল কীভাবে টরন্টো থেকে ক্যালগেরি যেতে পারি? গণতন্ত্রের মত ভোটাভুটি হবে’।
ছেলেটা মায়ার সাগর, ‘আমি ক্যালগেরি যাব না। এখানেই থাকব’। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেও।
আহারে! দেখতে খারাপ লাগছে। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু কোন উপায় নাই, বাবা। যেতেই হবে আমাদের। কীভাবে যেতে চাও এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এখন।
‘আমি প্লেনে যাব’, ছেলের সোজাসাপ্টা জবাব।
‘আমার কোন চয়েস নেই’, মেয়ের জবাব। মেয়ের মা’র একই কথা।
আমি একটু ব্যাখ্যা দেই ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের। বলি, ‘এরকম সুযোগতো সবসময় আসে না। আমাদের অবসরও আছে। মন্ট্রিয়াল থেকে রওনা দিয়ে একেবারে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত চলে যেতে পারি, গাড়ী চালিয়ে। সামার চলছে তাই কানাডার কান্ট্রিসাইড দেখার এর চেয়ে ভাল সময় আর সুযোগ আর নাও পেতে পারি। আমার চয়েস গাড়ীতে করে দেখতে দেখতে যাব, প্লেনে যাব না। এবার কার কী মত বল?’।
মেয়ে এক কথায় রাজী, সে গাড়ী করে যাবে। ছেলের অবশ্য একই কথা, প্লেনে যাবে। ওদের মা মৌনব্রত, ভোট দেয়া দেখে বিরত। তো দুই ভোট আর এক ভোট; আমি আর আমার মেয়ে জয়ী। ঠিক হোল, টরন্টো থেকে আগে মন্ট্রিয়াল যাব। এক কাজিন থাকেন সেখানে। উনার ওখানে রাতে থেকে ভোর সকালে গাড়ীতে করে রওনা দিব ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে ধরে। মন্ট্রিয়াল-টরন্টো-ক্যালগেরি-ভ্যাংকুভার হয়ে সোজা ভিক্টোরিয়া; পাঁচ হাজার কিলোমিটারে বেশী পথ। পুরো সাত দিন রাস্তায় থাকা হবে, ভাবতেই কেমন শিহরিত আমরা! আমেরিকানরা একাজ মাঝে মাঝে করে, নিউ ইয়র্ক থেকে গাড়ী চালিয়ে লস এঞ্জেলেস চলে যায়। তবে অস্ট্রেলিয়ারটা অনেক বড়। সমুদ্রপারের কোন এক শহর থেকে শুরু করে পুরো কোস্ট ধরে চলতে চলতে পুনরায় ঐ শহরে ফিরে আসা যায়, মাসখানেকের জন্য পথের রাজা। তবে সবচেয়ে থ্রিল নাকি ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ ধরে মস্কো থেকে ভ্লাডিভোস্টক পর্যন্ত চলে যাওয়া।
যাত্রা শুরু হবে মন্ট্রিয়ালের বায়োডোম থেকে। জিপিএস-এ ভিক্টোরিয়ার মাইল জিরো পয়েন্ট সেট করে গাড়ী ছেড়ে দিলাম। গাড়ীভর্তি খাবার দাবার, হালাল খাবারের সংকটে যাতে না পরি। মেয়েটার কাজ হল প্রতিদিনের সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের তালিকা করা। যাবার পথে একটু ঢু মেরে যাব আমরা। আজকের যাত্রাপথে কানাডার রাজধানী শহরে থামলাম প্রথমে। ইতোমধ্যে ক্যুইবেক প্রদেশ ছেড়ে অন্টারিওতে ঢুকে গেছি। অটোয়া আসলাম আর পার্লামেন্ট হিলে না গেলে হয়! কানাডার সংসদ ভবন থেকে বাংলাদেশ হাই কমিশনের অফিস হয়ে আবার রাস্তায়। পরবর্তী গন্তব্য কিংস্টন শহর। ওয়াশরুম খাওয়া শেষ করে কুইন’স ইউনিভার্সিটি ঢু মেরে যাই। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় পৌনে দুইশ বছর আগের কুইন ভিক্টোরিয়ার আমলের। বিল্ডিংগুলোও পুরনো ধাঁচের, লাইমস্টোন ব্লক দিয়ে বানানো। আর একাডেমিক রেকর্ডও ভালো, ওয়াল্ড র্যাঙ্কিং-এ দুইশ এর মধ্যে।
প্রথম দিনের শেষ গন্তব্য টরন্টো। এক বছর থেকেছি এখানে, তাই দেখার তেমন কিছু বাকী নেই। তবে হাইওয়ের কথা একটু বলতে হবে যে। মন্ট্রিয়াল-টরন্টো রাস্তার নাম কিংস হাইওয়ে ৪০১ বা সংক্ষেপে হাইওয়ে ৪০১ বলে। লোকে বলে, ‘দ্য ফোর-অহ-ওয়ান’। পুরো নর্থ আমেরিকার ব্যস্ততম হাইওয়ের একটি। টরন্টোতে ঢুকে এর নাম ‘হাইওয়ে অব হিরো’স। এত বিশাল! কিছু জায়গায় উভয় দিক মিলিয়ে সার্ভিসলেনসহ প্রায় ২৪ লেনের রাস্তা। স্পিডলিমিট ১০০, আমারা গড়পরতা ১১০ থেকে ১১৫ এর মধ্যে ছিলাম।
‘বাবা, কীসের শব্দ। কেমন ভোঁ করে কিছু একটা পার হয়ে গেল।‘ মেয়েটা চারিদিকে তাকিয়ে বলে।
আমি কৌতুহুলী হই, ’ব্যাপার কী?’ চকিতে শুধু চোখে পড়ল একটা মোটর বাইক মুহুর্তেই আমাদের ওভারটেক করে চলে গেল।
আমি বিষ্ময়ে বলি, ‘দেখছ মা, বাইকের স্পিড কমছে কম ৩০০ হবে। পুলিশ ওদের ধরতে পারবে না। কারণ পুলিশের কোন গাড়ীর স্পীড এত না। আর স্পীড ক্যামেরাতে ক্যাচ করার আগেই চলে যাবে ওরা।‘
যাহোক, রাতে বন্ধু হাবিবের ওখানে থাকব। টরন্টো ডাউন্টাউনের জেরার্ড স্ট্রীটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ব্যাচমেট হাবিব, বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র। ওর সাথে অনেক স্মৃতি আছে। দীর্ঘ হাঁটার একটা চমৎকার ঘটনাও আছে।
কারনে-অকারনে এ জীবনে অনেক হেঁটেছি। দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ সেসব হাঁটা। সবচেয়ে লম্বা হাঁটাগুলি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুতত্ব পড়ার সময় ফিল্ডওয়ার্ক এ যেয়ে। একবার সারাদিন ফিল্ডওয়ার্ক শেষ করে সন্ধ্যায় ইনানী থেকে সৈকত ধরে পায়ে হেঁটে কক্সবাজারের কলাতলির আনবিক শক্তি কমিশন ভবনে আসতে হয়েছিল। চাকুরীর সুবাদে থানচির পাহাড়েও ঘন্টার পর ঘন্টা হাটতে হয়েছে। তবে এসব ছিল অনেকটা বাধ্যতামুলক, প্রয়োজনে হাঁটা। তবে অকারণেও লম্বা পথ হেঁটেছি এরকম তিনটি আছে উল্লেখ করার মত।
হাঁটা-১। সকাল দশটার মত বাজে। ক্যালগেরি ডাউনটাউন থেকে বাসায় যাব। হাতে বেশ কিছু সময় আছে। হঠাৎ মাথা চাড়া দিল পুরোনো রোগ, হাঁটা দিলে কেমন হয়! হাঁটছি তো হাঁটছিই – প্রখর রোদ, ঘেমে নেয়ে একাকার। এক পর্যায়ে রেলক্রসিং-এ ট্রেনের জন্য থামতে হল। ট্রেনটাও বিশাল! দেড়শ বগি পার হয়ে যায় ট্রেন শেষ হয় না। ঘন্টা দুয়েকে পরে হন্টনের সমাপ্তি। আরামদায়ক গণপরিবহন থাকার পরেও এই হাঁটার কোন অর্থ আছে?
হাঁটা-২। বিশ্বকাপ ক্রিকেট হচ্ছে সাউথ আফ্রিকায়। মেলবোর্নে থাকি, ক্রিকেট পাগল আমার বাসায় খেলা দেখার সুযোগ নেই। উপায় ডাউনটাউনের ক্রাউন ক্যাসিনো। বিশাল পর্দায় অনেকটা সিনেমার মত করে খেলা দেখা। খেলা শুরু হয় সন্ধ্যা ছটার দিকে আর শেষ হয় রাত দুটা/তিনটার দিকে। বিপদটা হল তখন সব গণপরিবহন বন্ধ। পরবর্তি ট্রাম পাঁচটার দিকে। দুর! কে বসে থাকে। অগত্যা হাঁটা দেই। আলোঝলমলে ক্যাসিনো থেকে বের হয়ে রাজপথ ধরে সোজা হাঁটা। ইয়ারা নদী পার হয়ে কখনো খোলা মাঠ আবার কখনো পার্কের গাছপালা-ঝোপঝারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা আর হাঁটা। দিনের বেলা স্বাভাবিক মনে হলেও অন্ধকারে পার্কের ঝোপঝারকেও জংগল ভেবে গাঁ কেমন শিরশির করে। ভয়ের শ্রোত নেমে যায় শিরদাড়া বেয়ে। পাক্কা দু’ঘন্টা ত্রিশ মিনিট হেঁটে বাসায়। পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই ছিল এ রুটিন।
হাঁটা-৩। সবচেয়ে স্মরণীয়। ঢাবি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এখন যৌবন যার যুদ্ধে, থুক্কু 'প্রেম' করার শ্রেষ্ঠ সময় তার। বাঁধভাঙ্গা-উপচেপড়া প্রেমের জোয়ারে চারিদিক প্লাবিত। যেদিকে চউখ যায় শুধু তারেই দেখি। জগতের শুরু এবং শেষ বুঝি ঐখানেই। ভাবনায় আর দ্বিতীয় কিছু নেই, আসেও না। একসময় প্রেমের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হোল। দু’পক্ষে জানাজানি। সকল পত্র-সড়ক-টেলিযোগাযোগ বন্ধ। আমার জীবনও স্তব্ধ। বন্ধু আমার বায়োকেমিস্ট্রির এই হাবিব। গোপিবাগে থাকি আমরা। আর আমার পুরো জগত তখন বাড্ডায় থাকে। এক বিকেলে হাবিব উৎসাহের সাথে বলে, ‘চল বাড্ডা যাই। তবে আমরা গাড়ীতে না হেঁটে যাব।‘ হে হে হে বলিস কী? ঠিক আছে, চল। রওনা দিলাম। টানা এক ঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে গন্তব্যে চলে এলাম। সে এক বিচিত্র অনুভুতি! ঘামের সাথে সাথে বের হতে থাকল সকল শারীরিক উৎকণ্ঠা। বাড্ডায় যখন পৌছুলাম তখন আমি অন্য রকম একজন মানুষ!
টরন্টোর হাবিবের বাসা থেকে বের হয়ে দ্বিতীয় দিন সকালে আবার রাস্তায় নামি আমরা। প্রথম গন্তব্য হাইওয়ে ৪০০ ধরে সাডবারি শহর। একটা কৌতুহুল ছিল এখানকার উঁচু চিমনীটা দেখব। ধোঁয়া বের হবার জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ চিমনী, ৩৮০মিটার; চিন্তা করা যায়! ধোঁয়াটোয়া সব উপর দিয়ে আকাশে পাঠিয়ে দিবে, এটাই ছিল ধারণা। সাডবারিকে বলে অন্টারিও প্রদেশের মাইনিং হাব। একটা সময় খনি থেকে কপার, নিকেল, সোনা তোলা হত। মাইনারদের পদভারে মুখরিত থাকৎ এই জনপদ। এখন অবশ্য কানাডার মাইনিং-এর সেই সুদিন আর নাই। জিওলজিস্ট হওয়ায় সাডবারির মাইনিং-এর প্রতি একটা আকর্ষণ সবসময় ছিল। তাই সু্যোগমত চেখে নেই মাইনিং হাবকে। সবার পেটে ক্ষিদে। আমাদের খেতে হবে, ওয়াশরুম – লেটস গো টু টিম হর্টন্স।
নেক্সট স্টপ sault ste marie শহর। উচ্চারণটা এরকম সু-সেইন্ট-মেরি। সাডবারি থেকে বের হয়ে রাস্তা লেকের দিকে চলে যায়। কাঁদতে থাকা ছেলেটের চোখে জলও বাড়তে বাড়তে লেকের চেয়ে বেশী হয়ে যায়। নয়নাভিরাম লেক হিউরন এর পাশ দিয়ে যেতে থাকি। কানাডা-আমেরিকার বর্ডারের পাঁচটি বৃহৎ লেকের একটি লেক হিউরন। লেক সুপেরিওর আর হিউরনের সংযোগ নদী সেইন্ট মেরি আমেরিকা আর কানাডার বর্ডার। আশ্চর্য হোল নদীর দুইপাশে দুইদেশের শহরের নামও এক; সু-সেইন্ট-মেরি। এখানে ব্যাচওয়ানা ফার্স্ট নেশানদের বসবাস ছিল। এদের পূর্বপুরুষের নির্যাতিত হবার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে। কানাডার সিটিজেনশিপ টেস্ট এর জন্য 'ডিসকভার কানাডা' বইটা পড়েছিলাম। হিস্টরি অব কানাডা চ্যাপ্টারটা পড়ে শরীরের মধ্যে একধরনের কষ্টের তীব্র স্রোত বয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন থাবায় ক্ষতবিক্ষত প্রকৃতির সহজ-সরল আদিবাসীদের করুন আর্তনাদ প্রতিফলিত হচ্ছে বইয়ের পরতে পরতে। তথাকথিত 'সভ্যতা' মঞ্চস্থ করতে রক্তের প্রয়োজন আছে বৈকি।
অদ্য শেষ ঠিকানা ছোট্ট শহর ওয়াওয়া। সু-সেইন্ট-মেরি ছাড়ার পরই আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশাল লেক সুপেরিওর এক পাশে আর এক পাশে পাহাড়। মধ্যে দিয়ে ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে, নয়নাভিরাম। যেন জিলং থেকে বের হয়ে ব্যাস প্রণালীর তীর ধরে গ্রেট ওশান রোডের উপর দিয়ে টুয়েলভ অ্যাপস্টল পর্যন্ত চলে যাওয়া। অথবা সিডনী থেকে তাসমান সাগরের তীর ধরে ওলংগং-এ কফি খেতে যাওয়া। একই রকম অনুভূতি, প্রায় সমপরিমান মুগ্ধতা! পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম হাইওয়ে অনেক আছে। আমাদের কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে ইনানী সে রকম একটি। এই রাস্তাটিকে টেনে আরো লম্বা করে টেকনাফ পর্যন্ত নিয়ে গেলে দুনিয়ার সবাইরে ফেল মেরে দিবে নিশ্চিত।
লেক সুপেরিওর দেখতে সমুদ্রের মত বিশাল, কুল-কিনারা খোঁজা অর্থহীন। মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। প্লেনে গেলে কি এসব দেখা যেত? ওয়াওয়াতে আগেই বলা ছিল বেড এন্ড ব্রেকফাস্টে থাকব। বয়স্ক এক মহিলার নিজের বাসা, অস্বাভাবিক রকমের পরিস্কার, শান্তি শান্তি ভাব। ভদ্রমহিলার নিজস্ব সব্জি বাগান আছে। সেখান থেকে ব্রকোলী, টমেটো আর ফুলকপি ছিড়ে আনল আমাদেরকে রান্না করে খাওয়াবে। ছোট্ট শহরটিতে পৌছুতে পৌছুতে বেলা যায় যায়। তাই কোনমতে খেয়ে ঘুম। সকালে মহিলার বানানো প্যানকেকের নাস্তা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু।
তৃতীয় দিনের প্রথম গন্তব্য নিপিগন শহর। আমরা এখনো অন্টারিও প্রদেশেই আছি। এদিনও লেক সুপেরিওর আমাদের চলার সাথী। লেক বাঁয়ে রেখে আমরা চলছি তো চলছিই। ইতোমধ্যে হিরন বে, টেরেছ বে পার হই। চমৎকার সব দৃশ্যাবলী চারিদিকে। ছোট্ট একটা শহরে এসে পড়ি নাম ‘ম্যারাথন’। নামটা শুনে কৌতুহুলী হয়ে দেখার চেষ্টা করি ম্যারাথন দৌড়ের কোন ছোঁয়া আছে নাকি। না, এটা আসলে ম্যারাথন নামের এক কোম্পানির নাম থেকে এসেছে। নিপিগন ছোট্ট বন্দর-শহর অনেকটা নারায়ণগঞ্জ টাইপের। নর্থ আমেরিকার সুপেয় পানির সবচেয়ে উত্তরের বন্দর। শহরের প্রাণকেন্দ্র মেরিনা দেখতে আদতেই সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন। এখন এসব বাদ আগে খেতে হবে, বাথরুমে যেতে হবে।
চটজলদি ওখান থেকে বের হয়ে গাড়ি চলছে, ইগনেস শহরে যাব। পথে থান্ডার বে শহর আছে, এক্সাইটেড। লেক সুপেরিওর পাড়ের অত্যন্ত মনোরম শহর। কিন্তু জিপিএস শর্ট-কাট করতে যেয়ে আমাদের ট্রান্সকানাডা ছেড়ে অন্য এক রাস্তায় নিয়ে যায়। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারি নি। কিছুদুর যেয়ে মনে হল রাস্তাতো বেশ নির্জন, স্পিডলিমিট মাত্র ৮০ কিমি। এটা নিশ্চয় অন্য রাস্তা। দুইধারে ঘন বন, ঝিরিঝির বৃষ্টি হচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাস বইছে চারিদিকে, এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই অনেকক্ষণ। নির্জনতার পূর্ণ মাত্রা দেখা গেল আরো কিছুক্ষণ পরে। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল কোনদিক থেকে কোন গাড়ী আসছে না। কোন মানুষ নেই, ঘরবাড়ী-দোকানপাঠ কিছুই নেই। ব্যাপার কী? এ বনের শেষ কোথায়। মনে হচ্ছে সুন্দরবনের মধ্যে আছি। খালের মধ্যে দিয়ে নৌকার পরিবর্তে আমরা পীচঢালা রাস্তায় গাড়ীর মধ্যে। ঝিরঝির বৃষ্টি দু’জায়গাতেই ছিল। তবে সুন্দরবনে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ ছিল আর এক্ষণে সে অর্থে প্রায় নির্জন। এ মুহূর্তে সুন্দরবনের একটা ঘটনা মনে পরে যায়।
অনেকদিন আগে বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেড থেকে এমভি ভেলা ভাড়া করেছি। গন্তব্য সুন্দরবন। কটকা পৌছে বনবিভাগের রেস্টহাউসের উল্টো দিকে জাহাজটি নোঙ্গর করা হয়েছে। এখন মাইল তিনেক হেটে জামতলা সৈকত, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য। মন ভারী হয়ে আছে। ছোট্ট মেয়েটির ১০২ ডিগ্রি জ্বর। কেমন তিরতির করে কাঁপছে আর ঘোলা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে পিট পিট করে। বছর চারেকও হয় নি। দোটানায় আছি।
ধুর! যা হয় হবে, বলে ওকে পাজকালো করে দিলাম হাঁটা। এরপর ঘন্টা চারেকের অবিরাম দাপাদাপি। বিষম খেতে খেতে ওর চোখ-নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। লবণাক্ত পানি খেয়ে পেট ফুলে ঢোল! জাহাজে ফিরে দেখি কোথায় জ্বর আর কোথায় কাঁপাকাঁপি? অদ্ভুদ আনন্দে ঝলমল করছে। ঢাকায় ফেরত আসার পরও ওর সেই মোহ কাটে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর রমনা পার্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ঘন গাছপালা দেখেই বলে উঠে, ‘বাবা দেখো, শুধু সুন্দরবন আর সুন্দরবন!’
মেয়েটি এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলছে আরো ঘন্টাখানেক। না, কোথাও কেউ নেই। শুধুই বন আর বন, মেঘলা আবহাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট। চতুর্দিকে কেমন অন্ধকারের আবহ। তাই দেড় ঘন্টা ধরে এক ধরনের ভয়ের মধ্যে সেঁধিয়ে আছি। গাড়ীর কিছু হলে কী হবে? অবশ্য তেল আছে যথেষ্ট। হঠাৎ মরূদ্যানের মত একটা বাড়ী-কাম-কনভেনিয়েন্স স্টোর উদয় হোল। মুহূর্তেই গাড়ী ব্রেক, ঢুকে গেলাম ওখানে। বয়স্ক এক ভদ্রমহিলার কাছ থেকে একটা কফি নিয়ে আলোচনার সারমর্ম হোল; আমরা একটা ইন্ডিয়ান রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ভদ্রমহিলা নিজেও ইন্ডিয়ান। বনের ভিতরের দিকে আদিবাসীরা থাকে। মেইন রাস্তায় সহজে আসে না। আর আজকের আবহাওয়া খারাপ তাই এদিকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আরো ভয়ংকর খবর হল আগামী এক ঘন্টাও ঠিক এরকমই হবে। আমাদের আর কী করার আছে? ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কিসে ভয়?’
নির্জন রাস্তা আর ঘন বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই আমরা একসময় ইগনেস পৌঁছে যাই। অতীব দুঃখের সাথে দেখলাম আগ্রহের থান্ডার বে শহর বাইপাস করে ফেলেছে জিপিএস। ইগনেস পুরনো ছোট্ট শহর, দেড়শত বছর আগের। কানাডা-প্যাসিফিক রেলওয়ের একটা ডিভিশনাল পয়েন্ট এখানে। নিত্যকাজ সেরে আমরা কেনোরা শহরের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছাড়ি। ওখানেই রাত্রি যাপন হবে। নর্দান অন্টারিওর এই জায়গাগুলো পুরোটাই বনজঙ্গলে ভরা। মাঝে মাঝে জলাশয়, লেক, নদী আছে। বনের ভিতর দিয়ে পীচ ঢালা রাস্তা। এসময় আমরা প্রথম টাইম জোন অতিক্রম করে ফেলি। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে যায়। মোবাইলের দিকে তাঁকিয়ে দেখি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময় পরিবর্তনের দৃশ্য। দারুন মজার ব্যাপার ছিল!
কেনোরাতে কিচেনেটসহ একটা মোটেল ভাড়া নেই। আসার সময় কিছু গ্রোসারী আর ডিম কিনেছিলাম। গরম গরম রান্না হবে আজ রাতে। ভাতের সাথে ডিমভাজি আর আলুভর্তা। সাথে বিফ রান্না ছিল। রান্নার মসলাপাতি সাথেই আছে। সেই সাথে একটা মোবাইল চুলাও ছিল। ভেতো বাঙ্গালী যেখানেই যায়, রসুইঘর সাথেই যায়। এমনিতেই ক্লান্ত তার উপর গরম ভাত, স্বর্গতো এখানেই। পেট পুরে গলা অব্দি খেলাম। নিশ্ছিদ্র ঘুমের বড়ই প্রয়োজন। শরীরটা নেশার ঘোরের মত নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ঘোরের মধ্যেই অনেকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পরছে।
দৃশ্যটা ভাবলে এখনো মুগ্ধ লাগে। ১৯৮৯/৯০ সালের দিকে। চিটাগং থেকে রাঙ্গামাটির বাসে উঠেছি, আমরা ক’বন্ধু। লক্কর-ঝক্কর বাস। পিছনের দিকে বসেছি। গেরুয়া পড়া মাঝ-বয়সী এক ভদ্রলোক আমাদের পাশের সিটে। মাথা কামানো, চেহারায় সৌম্য-সৌম্য একটা ভাব। বৌদ্ধ সন্যাসী-টন্যাসী হবে। কেমন ঝিম মেরে বসে আছেন। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পরেছেন। বাস চলছে, একটু দ্রুতই চলছে। পাহাড়ী রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো, পিছনের দিকে ঝাঁকিটা গায়ে লাগছে। আমাদের বয়স কম, এসব নিয়ে কে ভাবে। গল্প করছি। যাত্রীদের কেউ কেউ চালককে আস্তে চালাতে বলছে। এক পর্যায়ে বাসের ঝাঁকাঝাঁকি এবং যাত্রীদের চেঁচামেচি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার মত অবস্থা হল। ‘এই বেটা আস্তে চালা, নইলে তোর ....’, যাত্রীদের তাঁরস্বরে চিৎকার। এ রকম সিচুয়েশনে সবকিছু ছাপিয়ে হঠাৎ গুরুগম্ভীর আওয়াজ, ‘এই, চুপ’! আমরা আচমকা শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখি গেরুয়া। বসা থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাড়াল। যাত্রীরাও কেমন চুপ মেরে গেল। ভাবল ড্রাইভারকে উনি কষে গাল দিবেন। না, গেরুয়া তাঁর দুইহাত পাখির মত প্রসারিত করে উড়ে যাবার ঢঙ্গে অত্যন্ত মোলায়েম সুরে বলে উঠল, ‘ড্রাইভার, উড়ে যা’। আমরা বিষ্মিত, বিমোহিত! দাদা যে সপ্তম স্বর্গে আছেন। পুরো বাস স্তব্ধ, শুধু ড্রাইভার মহা-উৎসাহে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে গেরুয়াও ধীরে ধীরে ঝিমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।
আমিও গেরুয়ার মত ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। চতুর্থ দিন সকালে ঝরঝরে হয়ে ঘুম ভাঙল। উড়ুক্কু মনে যাওয়ার নেশা, দেখার নেশা। আজকে অন্টারিও থেকে ম্যানিটোবা প্রদেশে ঢুকব। ছোটবেলায় ভুগোলে পড়া কানেইডিয়ান প্রেইরী এখান থেকেই শুরু। মাইলের পর মাইল ধু ধু তৃণভূমি। সাডবারির পর থেকে পুরো ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে সিঙ্গেল লেনের, স্পিডলিমিট ৯০কিমি। কিন্তু ম্যানিটোবায় ঢুকেই ডাবল লেনের ফ্রীওয়ে, স্পিডলিমিট ১১০কিমি। ওয়াও! চালাও গাড়ি! সমতল রাস্তা, উঁচুনিচু নেই। গাড়ীর ক্রুজকন্ট্রোলে স্পিড সেট করে দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাক। আলসে ড্রাইভিং। উইনিপেগ পৌঁছে গেলাম সহসাই।
উইনিপেগ ম্যানিটোবার রাজধানী শহর, বেশ বড়। ছেলেমেয়েরা ম্যাকডোনাল্ডসে যেতে চাচ্ছে, ফার্স্টফুড খাব। নিকটেই খুঁজে পাওয়া গেল। ম্যাকডোনাল্ডস চান্দে গেলেও পাওয়া যাবে, নিশ্চিত। ফিস-অ-ফিলে আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাবাড় করে শহরটাকে চক্কর দিতে হবে। গাড়ী করে যতটুকু দেখা যায়। কানাডার বড় শহরগুলোর মধ্যে এখানেই আদিবাসীদের আধিক্য বেশী। রেড রিভার আর আসিনিবোয়েন রিভারের সংযোগস্থলকে উইনিপেগের কেন্দ্রস্থল বলা যায়। এই জায়গাটা খুবই চমৎকার, নয়ন মনোহর। সুন্দর একটা নামও রেখেছে, দ্য ফর্ক। ম্যানিটোবার সুদৃশ্য সংসদ ভবনটা এখানেই। শপিং মল আছে, এন্টারটেইনমেন্টের যাবতীয় সব ইভেন্ট সাজানো আছে এখানে। এদিকে যে শহরেই যাই না কেন চায়না টাউন আমাদেরকে টানে। এখানেও তাই, এক পলক চায়না টাউন না দেখে গেলে কি হয়!
উইনিপেগ ছেড়ে গাড়ী ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে ধরে পশ্চিম দিকে চলছে। ব্রান্ডনে গিয়ে থামব আবার। ডাবল-লেনের ফ্রীওয়ে, দ্রুতগতিতে গাড়ী চালানো যায়। চারিদিকে বৈচিত্রতা তেমন নাই বললেই চলে। সোজা রাস্তা কোন আঁকাবাঁকা নাই, চোখ বন্ধ করেও চালানো যাবে। মাঝে মাঝে দু’ধারে উইন্ডমিল দেখা যাচ্ছে। সময়মতই ব্রান্ডনে পৌঁছে যাই। প্রাকৃতিক কর্ম শেষ করে আবার চলা শুরু।
এবারের গন্তব্য রেজাইনা। সাস্কাচুয়ান প্রদেশের রাজধানী। কিছুক্ষণ পরেই ম্যানিটোবা ছেড়ে সাস্কাচুয়ানে ঢুকে যাব। সেই একঘেয়ে প্রেইরী, ধু ধু সমতলভূমি। একটু পরপর একেকটা ছোট শহর আসে আবার পার হয়ে যায়। পথের দুধারে ফসলের মাঠ। হলুদ সরিষা ক্ষেত চোখ জুড়িয়ে দেয়। রেজাইনা পৌঁছে আজকের রাত্রি যাপন, বেস্ট ওয়েস্টার্ণ প্লাস হোটেলে। চেকইন করে লাগেজ রেখেই বেড়িয়ে যাই শহর দেখতে। সাস্কাচুয়ানের রাজধানী হলেও বেশ ছোট্ট শহর। বিশ মিনিটেই এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া যায়। সাস্কাচুয়ানের লেজিসলেচার বিল্ডিংটা ঘুরে আসলাম চট করে। ইতোমধ্যে বাইরে থাকা বেশ কষ্টকর হয়ে দাড়াল। কারণ মশার অত্যাচার। পারলে নাকে-কানে মশা ঢুকে যায়, গুনগুনতো আছেই। এত মশা এ শহরে আছে চিন্তাই করতে পারিনি।
পঞ্চমদিন ক্যালগেরির উদ্দেশ্যে যাত্রা। কোন বৈচিত্র নেই, চোখ বন্ধ করে গাড়ী চালাচ্ছি। একটানে মেডিসিন হ্যাট শহরে পৌঁছে গেলাম। এই শহরের নামটা অদ্ভুদ লাগে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ওষুধের টুপি। ইতোমধ্যে আমরা সাস্কাচুয়ান ছেড়ে আলবার্টা প্রদেশে ঢুকে পরেছি। সাথে সাথে আমরা পরবর্তী টাইম জোনেও এসে পরেছি। ঘড়ির কাঁটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার একঘন্টা পিছিয়ে যায়। মেডিসিন হ্যাটে খেয়েদেয়ে আবার চলা ক্যালগেরি পর্যন্ত। বিকালেই এসে পরি ক্যালগেরি, কানাডার পেট্রোলিয়াম হাব। পুরো প্রদেশটা যেন তেলের উপর ভাসছে। হিউস্টনকে মক্কা ধরলে পেট্রোলিয়াম দুনিয়ায় ক্যালগেরি হচ্ছে মদিনা। ডাউন্টাউনের ৭০ভাগ দালানকোঠা কোন না কোন তেল কোম্পানির। শহরটি ছোটই ছিল কিন্তু বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এখন অবশ্য রিসেশন চলছে। অতীত ঢাকার সাথে ক্যালগেরির কিছুটা মিল আছে বোধ হয়।
ঢাকা শহরের উত্থান-পতন বহু যুগের স্বাক্ষী। সময়ের সাথে এর শৌর্য্য-বীর্য্য বেড়েছে কমেছে। একদিনে তো আর বুড়িগঙ্গা থেকে টঙ্গী অব্দি চলে যায়নি শহরটা! মোঘলদের সময়ে নতুন রাজধানী হিসেবে এর জৌলুশ ছিল সুপারমুনের মত। ঐ টুকু শহরে ৯ লক্ষ মানুষ! কিন্তু রাজধানী মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ায় গুরুত্ব হারায় শহরটি। জনপ্রিয়তা কমতে কমতে মাত্র ৫০ হাজারে নেমে আসে। ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গের বাইপ্রোডাক্ট রাজধানী হিসেবে জৌলুস আবার বাড়তে শুরু করে। রবীবাবুসহ কতকের আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ রদ গুরুত্ব সামান্য কমিয়ে দিলেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজধানী হয়ে ঢাকা তিলোত্তমার আঁকার ধারণ করছে।
ঢাকার এই পরিবর্তন হয়েছে অনেক বছরে, ঠিক করে বললে কয়েকশ বছরে। আর আশ্চর্য! ক্যালগেরির পরিবর্তন মাত্র কয়েক দশকের। ছোট্ট শহরটি বাড়ে-কমে করতে করতে এখন বেশ বড় শহর হয়ে গেছে, কানাডার চতুর্থ বৃহত্তম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তেলের দামের সাথে উঠানামা করে এই শহরের ভাবভংগী। মাত্র কয়েক বছর আগে শহরটি শান-শওকতে পরিপূর্ণ ছিল। আর এখন স্মরণকালের ভয়াবহ রিসেশন ভোগ করছে। প্রায় সত্তুর শতাংশ জৌলুস একেবারে ধুলায়-মাটিতে গড়াগড়ি। বিশ্ববাজারে তেলের যে বর্তমান মতিগতি তাতে আরো কয়েক বছর এ অবস্থা থাকবে নিশ্চিত। মানে ক্যালগেরি আরো তলিয়ে যাবে। ভুতুড়ে থেকে আরো ভুতুড়ে হয়ে যাবে শহরটি। তবে আশার কথা গত কয়েক দশকে বার কয়েক এ চক্র দেখেছে ক্যালগেরিয়ানরা। তাই ফিঙ্গার ক্রস করে আছে!
ক্যালগেরিতে আমাদের এপার্টমেন্ট ভাড়া করা আছে। মালপত্র নিয়ে নিজের বাসায়, আহ শান্তি! খাবারদাবার গুছিয়ে নিলাম। কিছু জিনিসপত্র রেখেও গেলাম। সকালে উঠেই আবার যাত্রা, উদ্দেশ্য ভ্যাংকুভার।
ষষ্ঠ দিন শুরু হয়ে গেল। ক্যালগেরি থেকে আধাঘন্টা পশ্চিমে গেলেই ভূগোলে পড়া বিখ্যাত সেই রকি মাউন্টেইন। ছোটখাট পাহাড়-টিলা পার হয়ে কানানাস্কিস এলাকা থেকে পাহাড় উঁচু হতে থাকে। গ্রেট রকি তাঁর আসল রূপ দেখাতে থাকে। পরবর্তি আঁটশত কিলোমিটার শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সাথে আছে নয়নাভিরাম সব পাহাড়ী লেক, নদী, ঝরণা। ক্যালগেরি থেকে দেড়ঘণ্টা পরেই ব্যানফ শহর। গাড়ি ঘুড়িয়ে শহরটা একটু চক্কর দিয়ে যাই। পর্যটনের স্বর্গ ব্যানফ। চারিদিকে উঁচু পাহাড় মাঝখানে ভ্যালির মত শহর। একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে, স্বর্গোদ্যান অবশ্যই। এরপর নয়নাভিরাম লেক লুইজ ঘুড়ে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে ঢুকে পরি। প্রথম শহরের নাম ফিল্ড, অদ্ভুদ নাম। আরো একটু এগিয়ে গেলেই কিকিং হর্স এলাকা, এখানেই ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে সবচেয়ে উঁচু ১৬৪৩ মিটার সমুদ্র লেভেল থেকে। ঠিক বান্দরবান-থানচি রুটের পিক-৬৯ এর মত। অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে, মেঘমালা আমাদের নীচে দিয়ে চলছে। কানের মধ্যে উচ্চতাজনিত চাঁপ অনুভূত হয়। এর মধ্যে তৃতীয় টাইম জোনটাও পার হই আমরা।
আমাদের যাত্রাবিরতি গোল্ডেন শহরে। এখানে পুরো হাইওয়ে পাহাড়ী, উঁচুনিচু। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ড্রাইভিং-এর জন্য আদর্শ। রাস্তার উপরে কৃত্রিম ব্রিজ বানিয়ে রাখা হয়েছে যাতে বন্যপ্রাণী রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে। হঠাৎ গাড়ীর জটলা, সব গাড়ী দাড়িয়ে গেছে। কেন? চারচারটা ভাল্লুক রাস্তার কাছাকাছি, গাছের গুড়ি খাচ্ছে। ছবি তোলার হিড়িক পরে গেছে। গোল্ডেনের পরেই সিলক্রিক মাউন্টেইন, বছরে প্রায় ১০ মিটার বরফ পরার রেকর্ড আছে।
এরপর রেভেলস্টক হয়ে আমরা কামলুপের পথে। রাস্তায় স্যালমন আর্ম শহর পার হই। এটা এক আজব শহর! প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হাজার হাজার লাখ লাখ স্যামন ফিস আসে এখানে। নদীর রং লাল হয়ে যায় মাছের রংয়ের সাথে মিশে। লিপ ইয়ারের মত চার বছর অন্তর মাছের সংখ্যা কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। কামলুপ শহরে দিনের দ্বিতীয় যাত্রবিরতি। লেকের পাড়ে চমৎকার বাগানের মত খোলা জায়গায় বসে পরি আমরা। বাসা থেকে আনা বিরিয়ানী পেট পুরে খাই। ঝির ঝির বাতাস বইছে, মনে হচ্ছে ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পরি। শহরটা বড়। বিশেষত্ব হচ্ছে - কামলুপ কানাডার টুর্নামেন্ট সিটি। কারণ এখানে আছে ৮৪টি বেসবল ফিল্ড, ৭৩টি ফুটবল খেলার মাঠ, ৫টি আইচ হকি এরেনা, ১০টি জিম, ৫৩টি টেনিস কোর্ট, ১১টি গলফ কোর্স এবং একটি স্টেডিয়াম। কামলুপের মত একটি শহরের জন্য যথেষ্ট বেশী সংখ্যাগুলো।
কামলুপের যাত্রাবিরতি শরীরে ক্লান্তি এনে দিলেও সময় তো আর থেমে থাকে না। অগত্যা উঠতে হয়। গাড়ী চলে ভ্যাংকুভারের উদ্দেশ্যে। পার হই পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ককুইহালা হাইওয়ে। স্পিডলিমিট ১২০ কিমি এবং প্রশস্ত। পাহাড়ী উঁচুনিচু ঢালবিশিষ্ট রাস্তা। চারিদিকে মনোরম সব দৃশ্যাবলী – চোখের দৃষ্টি রাস্তা ছেড়ে প্রকৃতির দিকে ছুটে যায়। দুর্ঘটনা ঘটে কিনা কে জানে? অবশ্য শীতকালে অ্যাভালেন্স বা বরফধ্বস হয়ে দুর্ঘটনা প্রায়শ ঘটে। আরেকটি বিচিত্র নামের শহর পার হই এখানে - মেরিট। এখান থেকে একটু আগালে শহরটির নাম হোপ, বিচিত্র নামই তো! হোপের পরেই রকি মাউন্টেনের আপাতঃ সমাপ্তি। আমরা সমতলে চলে আসি। ভ্যাংকুভার আর মাত্র দেড়শ কিলোমিটার। মাঝখানে অ্যাবোটসফোর্ড, সারে তারপরই বহু আকাঙ্ক্ষিত ভ্যাংকুভার।
কানাডার তিনটি বৃহৎ শহর; টরন্টো, মন্ট্রিয়াল এবং ভ্যাংকুভার। এ যাত্রায় তিনটি শহরেই আমাদের ছোঁয়া লাগে। এর মধ্যে ভ্যাংকুভার ব্যতিক্রম শহর। প্রতি বছরই দুনিয়ার সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ভ্যাংকুভার উপরের দিকেই থাকে। প্যাসিফিকের পারের নির্মল বাতাসের শহর, নিত্য বৃষ্টি হয় বলে সর্বদাই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে এত এত দর্শনীয় স্থান আছে যে বর্ণনা করার জায়গা পাওয়া যাবে না। তবে স্ট্যানলি পার্কের কথা না বললেই নয়। পুরো পার্কটি যেন সবুজের আঁধার। এরপর লায়ন্সগেট ব্রিজ পেরিয়ে ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ। প্রচন্ড ভয় আর শঙ্কা নিয়ে হেঁটে ব্রীজটি পার হবার পর মনে হয় এ যাত্রা যেন বেচেই গেলাম। রাত হয়ে গেলে হোটেলে প্রত্যাবর্তন, ফেয়ারমন্ট প্যাসিফিক রিম – সদ্য বানানো আধুনিক হোটেল একেবারে স্টেইট-অব-দ্য-আর্ট। সপ্তমদিন খুব ভোরে উঠতে হল আমাদের। প্রথম ফেরিটা ধরতে হবে ডিপারচার বে থেকে। ওখান থেকে ভ্যাংকুভার আইল্যান্ড। ফেরি পারাপারের সময় আমার গোয়ালন্দ-আরিচা লঞ্চ পারাপারে দৃশ্যটা মনে পরে, আমি নিজের মনেই হেসে উঠি।
১৯৯৮/৯৯ সালের দিকের কথা। পরিবার তখন ঢাকায় থাকে। আমি প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-গোয়ালন্দ আসাযাওয়া করি। বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন। বড়ই উপভোগ্য, আনন্দময়। পদ্মায় লঞ্চ-পারাপার ছিল আরেকটি বিনোদনের বিষয়। তবে বর্ষাকালে একটা বিপদ ছিল, লঞ্চের দুলুনী। নদীর বিশেষ একটা জায়গায় দুলুনীটা বেশীই ছিল। মাঝে-মাঝেই ঢেউয়ের পানি লঞ্চের ভিতরে পর্যন্ত ঢুকে যেত। এ লাইনে অনভ্যস্ত-আনকোরাদের জন্য বেশ ভয়ংকর। ছুটাছুটি, কান্নাকাটি, সৃষ্টিকর্তার দয়াভিক্ষা এসব ছিল নিত্তনৈমত্তিক। দৃশ্যগুলো ভালই লাগত। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি ভয়ের খুব একটা কারণ নেই। কদাচিৎ লঞ্চডুবি হয় এখানে।
একদিনের ঘটনা। যথারীতি লঞ্চে উঠেছি। দুজন অতি-আধুনিক তরুনী লঞ্চের যাত্রী। আমি আঁড়চোখে তাঁদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছি। তখন সবে মোবাইল এসেছে কিছু মানুষের হাতে। তরুনীদের মোবাইল তাঁদের স্মার্টনেস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কথা-বার্তা চোস্ত ইংরেজীতেই বলছে। বয়স্ক এক ভদ্রলোকের মাথায় টুপি এবং গালে দাড়ি দেখে সেকি হাসি। ইংরেজীতে বেশ কিছু গালিও দিয়ে দিল। গালিতে ধর্মও বাদ গেল না। ভাগ্যিস ভদ্রলোক এই ভাষা জানেন না।
এরিমধ্যে লঞ্চ সেই বিপদজনক জায়গায় এসে পড়ছে এবং শুরু হোল দুলুনী। সেদিন দুলুনীটা একটু বেশীই ছিল। পানির ঝাঁপটা আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। যাত্রীরা এপাশ থেকে ওপাশে ছিটকে যাচ্ছে। চারিদিকে চিৎকার-কান্নার রোল। মানুষ তাঁরস্বরে আল্লাহ-ভগবানকে ডাকছে। আমি আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছি - তরুনীরা কী করে। কিছুক্ষণ আগের ড্যামকেয়ার অভিব্যক্তি মুহুর্তেই উধাও। অজানা ভয়ে দুজনে দুজনকে ধরে কুঁকড়ে আছে। এরিমধ্যে মাথায় কাপড় দিয়ে ফেলেছে। বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছে। বুঝলাম মুসলমানের মেয়ে, বিপদে পরে দোয়া-দুরুদ পড়ছে। আমি মিটিমিটি হাসছি। বিস্ময় কপালে তুলে দেখি একটু আগে যেই ভদ্রলোককে নিয়ে হাসাহাসি তাঁকে বলছে একটু দোয়া করতে। চাচাজান-চাচাজান বলে কান্নাকাটি করছে। আমার হাসি ঠেকায় কে? বাড়তে বাড়তে দুকান ছুয়েছে। ভাবি, হায়রে আধুনিক! লঞ্চঘাটে নামার সময় তরুনীদের একজন আমাকে বলছে, ‘আপনি মানুষ না পিশাচ। এমন বিপদে কেউ হাসে?’ আমি আরেকটা হাসি দিয়ে ঘাটে নেমে যাই।
যাহোক, হালকা কুয়াশাঘেরা সকালে নর্থ ভ্যাংকুভারের ডিপারচার বে থেকে ফেরিতে উঠেই চোখ ছানাবড়া! দুনিয়াটা এত সুন্দর! ঠিক পানির ভিতর থেকেই ছোটবড় পাহাড় উঠে গেছে, আমাদের ফেরি এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। আবছা আলোয় সবকিছু অপার্থিব লাগছে। মোট দুঘণ্টা আমরা যেন ঘোড়ের মধ্যে ছিলাম। মালয়েশিয়ায় অনেকদিন আগের আলোর সেতার আর লংকাউই ফেরি পারাপারের সাথে তুলনীয় মনে হল। অতঃপর নানাইমো ঘাটে ফেরি ভিড়ল, আমাদের সাময়িক বিরতি। নয়নাভিরাম নানাইমো শহরটি ঘুরে দেখার মত। একটার পর একটা সি-প্লেন আসছে, যাচ্ছে। ট্যুরিস্টের ছড়াছড়ি সবখানে। ওখান থেকে বেরিয়ে ইংলিশম্যান রিভার ফলস দেখতে যাওয়া। গা ছমছম করা রেইনফরেস্টের বিশাল বড় বড় গাছ, বেড় দিতে পাঁচজন মানুষ লাগবে। তাঁর মধ্যে ছোট্ট একটা ওয়াটার ফলস। চমৎকার লাগল আমাদের। পরবর্তি গন্তব্য পোর্ট আলবের্নি, ছোটখাট বন্দরশহর। নদীর পাড়ের চমৎকার একটা জায়গায় আমরা খাওয়া সারলাম। চারিদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম। খেয়েই রওনা দেই টফিনোর উদ্দেশ্যে। কানাডার পশ্চিম উপকূলের শেষ ভৌগলিক সীমানা। এরপরই দ্য মাইটি প্যাসিফিক!
পোর্ট আলবের্নি পার হয়ে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কোন নেটওয়ার্ক নেই, গা ছমছম করা পাহাড়ী রাস্তা। খুবই সরু এবং অপ্রশস্ত, গায়ে গা লেগে যাবার মত। তবে প্রচন্ড অ্যাডভেঞ্চার আছে এখানে। পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হয় আকাশে উঠে গেলাম আবার নামতে নামতে পাতালে। রাস্তার পাশেই বিরাট খাত, এরপর লেক; এক কথায় অপুর্ব! সামান্য এদিওদিক হলেই কুপোকাত। পাহাড়ী বাঁকে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে হাত ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগার। তবে টফিনোর চেস্টারম্যান বিচে নেমে আমাদের সব বিষ্ময় একসাথে একজায়গায় ঘনীভূত হোল। বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে আমরা সমস্বরে বিরাট এক চিৎকারে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেই, ‘উই আর ইন মাইটি প্যাসিফিক নাউ!’
প্রশান্ত মহাসাগরে জীবনের প্রথম অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখে আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছেড়ে দেই। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তা শরীরে উত্তেজনা এবং ভয়ের অদ্ভুদ মিশেল তৈরি করে। লক্ষ্য ভিক্টোরিয়া শহরের ফেয়ারমন্ট এমপ্রেস হোটেল – ব্রিটিশ ঐতিহ্যের চমৎকার নিদর্শন। পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোর দুইটা বেজে যায়। হোটেলে ঢোকার আগে ভিক্টোরিয়াতে ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের শেষ মাথা জিরো মাইল ছুঁয়ে আসি আমরা। পাঁচ হাজার কিলোমিটার রাস্তার এখানেই শেষ। বিশাল এক জার্নি-বাই-রোডের আপাতঃ সমাপ্তি এখানেই। ট্রান্সকানাডা হাইওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছে খুটা গাড়া শেষ।
কানাডা শান্তিময় দেশ। পুরো রাস্তায় ভ্রমণে কখনই মনে হয়নি আমাদের ভয়ের কিছু আছে, বিশেষ করে মনুষ্য-বিপদ। যাহোক, এখন ক্যালগেরি ফিরতে হবে, প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। সাতদিন যাবৎ চলার ক্লান্তিতে শরীরের সব নাট-বল্টু ঢিলা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট নাই কিছু শরীরে। দিতে দিতে এখন নিঃশেষিত প্রায়। শুরুতে যতটা গর্জন ছিল তার ছিটেফোঁটা নেই এখন। এক্ষেত্রে মোমবাতির উপমাই বলে সকলে, ‘যত জ্বলে তত গলে’। ছড়িয়ে দেয় আলো, সবাইকে। নিজেকে নিঃশেষ করে, একেবারে বিলিয়ে দিয়ে। বিরাট ত্যাগ-ট্যাগ এর ব্যপার, নিঃসার্থ! আশ্চর্য! কেউ কিসমিসের কথা বলে না। কিসমিসের আত্মত্যাগের কথা কোথাও নাই। কী কুক্ষণে যে একগাদা ঘন চিনির দ্রবণ সে ধারণ করেছিল! ফলে মুঠোভরে তাঁর জায়গা হয় পায়েশের হাড়িতে। পাতলা লিকুইড নিংরে-চিপ্সে-চুষে বের করে আনে চিনিমিশ্রিত সুস্বাদু ঘন মধু। কিসমিস দিতে না চাইলেও ছিদ্রযুক্ত পাতলা মেমব্রেন-এর বাইরে ছেড়ে দিতে হয় প্রিয় সুধাকে। বিনিময়ে পায় শুধুই পাতলা পানি। দুঃখের বিষয় এই পানির কারণে ও ফুলেফেঁপে উঠে, একসময় ঢোলের মত হয়ে যায়। বোধ করি টুপ করে ফেঁটেও যায়, হয় সলিল সমাধি। আহারে!
গত সাত দিনে ঘটনা যা ঘটছে, নিংরে-ফিংরে সব রস অলরেডী শুষে নিয়েছে। কোনভাবেই আমার চামড়ার ছিদ্রগুলি বন্ধ করতে পারছি না। একটু একটু করে ঢুকিয়ে দিয়েছে ঐ পাতলা পানি, অতি-সচেতনভাবেই। পেটমোটা সুমো কুস্তিগীর হয়ে গেছি এবং ফেঁটে যাবার প্রহর গুনছি।
আমার ছোট ভাই দশ বছরের ছোট। পুরনো দিনের কথা, ও তখন আরো ছোট। বলে কি, ‘চোঙ্গা লাগবে’। আমি আর বুঝি না। একটু পরে জানলাম যে চঙ্গের কথা বলছে। কী এক বিচিত্র কারণে চঙ্গকে ও চোঙ্গা বলত। আমাদের এলাকায় ‘চঙ্গ’ নামটা বেশ প্রচলিত ছিল। এখন বোধ হয় মই চালু হয়ে গেছে। অতি-আধুনিকেরা নিশ্চয় ল্যাডার বলে। ভিক্টোরিয়াতে গত দুইদিন যাবৎ একখান চঙ্গের খুব অভাব বোধ করছি। প্রচুর ফালাফালি করছি। ডান পা’টা ভেঙ্গেছে ১৯৯৯ সালে। তাই নিয়েই জেভিয়ের সটোমেয়র-এর রেকর্ড লাফখানা দেই। কোন কাম হয় না। একখান চঙ্গের খুব দরকার। ফাঁটতে চাইনা। দেড় হাজার কিলোমিটার অনেক রাস্তা, পার হতে হবে। ক্যালগেরি পৌছাতে হবে যে!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পারভেজ এ রহমান ০৫/১০/২০১৭শুভেচ্ছা রইল
-
আব্দুল হক ০৪/১০/২০১৭অনেক বেশী সুন্দর লিখনী!!ধন্যবাদ!
-
কামরুজ্জামান সাদ ০৪/১০/২০১৭বেশ তথ্যবহুল ও গোছালো লেখা।
-
Tanju H ০৩/১০/২০১৭শুভেচ্ছা প্রিয় কবি।।
-
সমির প্রামাণিক ০৩/১০/২০১৭অপূর্ব লাগলো। শুভকামনা জানাই।
-
অমিত শমূয়েল সমদ্দার ০৩/১০/২০১৭সুন্দর প্রকাশ করেছেন।ভাল লেগেছে।