রামচড়
সদাই করছি ওয়ালমার্টে।
বিরাট কলেবরে স্টোরটা! সুপার সেন্টার বলে এরা। উত্তর আমেরিকায় ওয়ালমার্ট দুই ধরণের আছে। সাধারণ ওয়ালমার্টে গ্রোসারি পাওয়া যায় না। আর সুপার সেন্টারে কাচা বাজার মানে মাছ-মাংস-সব্জিসহ সব ধরনের গ্রোসারি পাওয়া যায়। বাসার নিকটের এই সুপার সেন্টারটাতে গেলে ভড়কে যাই নিয়তই। আকারে ইয়া বড়, এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটতে গেল ক্লান্ত প্রাণ সহসাই। তার উপরে মানুষের বেজায় ভীড় লেগেই থাকে! কাস্টমারের চাপে দিশেহারা স্টোর কর্তৃপক্ষ।
সয়ংক্রিয় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে হাতের বায়ে গ্রোসারি। মাঝখানে রান্নার তৈজসপত্র। আর ডানদিকে কাপড়চোপড়। এরপর স্টেশনারী, প্রসাধনী, খেলনা, ইলেকট্রনিক্স, গাড়ির সরঞ্জাম, মাছ ধরা আর খেলাধুলার জিনিস। এরপর বাগান করার জিনিসপত্র এবং জ্যান্ত গাছ। এ জায়গাটা আমাদেও খুবই প্রিয়। একবার ঢু মারা হবেই হবে। এদিকে স্টোরের দেয়াল ঘেষে আছে খাবারের দোকান, চুল কাটার সেলুন, স্টুডিও, ফার্মেসি আরো কত কি! কী নেই এখানে? সুই-সুতো থেকে শুরু করে আলু-পটল সবই আছে ওয়ালমার্টে, দামেও সস্তা। খুচরো ব্যবসার জগতে ওয়ালমার্টের ধারেকাছেও কেউ নেই এই দুনিয়ায়।
সদলবলে আমরা এখানে এখন - পুরো পরিবার নিয়ে এসেছি, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে। অবশ্য আমি শুধু নামেই আছি। কাজের কাজ কিছু করব না। বাজার করার মত দূরহ কাজটা জীবনেও করতে পারলাম না। এরা কেমনে করে কে জানে? যাহোক, কেনাকাটা যা করার ওরাই করবে। আমি পিছনে পিছনে ঘুরব শুধু। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে পিছনে ঘুরা আমার খারাপ লাগে না। বউ-ছেলে-মেয়ে আইলের পর আইল ধরে হাঁটে। এটা ওটা টেনে নামায় - ছুড়ে ফেলে ট্রলিতে। আমি অসীম কৌতূহলে ওদের কান্ডকারখানা দেখি। গভীর মনোযোগে ওদের আলাপ শুনি। কোনটার দাম কত? কোয়ালিটি কেমন? দাম কমল না বাড়ল? পুরো মুখস্থ ওদের। এত বড় স্টোরের কোথায় কী আছে চট করে বলে দিতে পারে পরিবারের সবাই, শুধুমাত্র আমি ছাড়া। এমনকি ছোট্ট মেয়েটাও, আজব লাগে!
আমি নিবিষ্ট মনে ওদের বাজার করা দেখি। সংসারে যে কত কিছু লাগে তা বাজারে না আসলে বিশ্বাস করা কঠিন। আর ওয়ালমার্টের সুপার স্টোরে আসলে তো কথাই নেই। টমেটো-শশা-গাজর থেকে শুরু করে রাইস কুকার কিনতে এসেছে। হঠাৎ মূল্যহ্রাস দেখে টোস্টারের - কিনে ফেলো। ওদিকে মাইক্রোওয়েভ পানির দামে। তাড়াতাড়ি কিনে ফেলো, শেষ হয়ে যাবে।
‘আরে! আমাদেরতো মাইক্রোওয়েভ আছে?’ আমি ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করি।
‘তাতে কী? মূল্যহ্রাসটা দেখবা না? এরকম পানির দামে দিচ্ছে কিনে রাখি।’ স্ত্রী স্বভাবসূলভ ঝামটা।
এই দেশে মূল্যহ্রাসের মাহাত্ম্য অসীম - খালি আমিই বুঝলাম না। বড় আফসুস! তবে মূল্যহ্রাস থাকুক আর না থাকুক এই স্টোরে একটা জিনিস মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হয়। তার আগে বলে নেই, আমরা ক্যালগেরি শহরের যে এলাকায় থাকি সেখানে পাঞ্জাবীদের বহুল বসবাস। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, পাঞ্জাবী শিখদের ধুন্ধুমার আবাসস্থল এখানে। পাগড়ী পড়া অথবা পাগড়ী বিহীন শিখেরা দোর্দন্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায় সকাল-সন্ধ্যা। সংখ্যায় কত জানি না, তবে অনুপাতে এদের সমতূল্য অন্য কোন সম্প্রদায় ক্যালগেরির এদিকটাতে নেই। এই এলাকার জন প্রতিনিধি, মন্ত্রী-সাংসদ সব শিখ। দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বেশীরভাগ ওদের দখলে। কাছাকাছি জায়গায় দুই দুইটা শিখ মন্দির আছে। ভাবা যায়! এরা বলে গুরুদুয়ারা। একটার নাম গুরুদুয়ারা সাহিবা, আরেকটা গুরুদুয়ারা দরবার। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা গুরুদুয়ারা আছে, গুরুদুয়ারা নানক শাহী।
শিখদের কাছে গুরুদুয়ারা আমাদের মসজিদের মত। প্রচন্ড ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আমরা যেমন মসজিদে দান-খয়রাত করি। এরাও মন্দিরে তাই করে। তবে পার্থক্য একটু আছে। মসজিদে খাবার পাওয়া যায় না। কিন্তু গুরুদুয়ারায় চব্বিশ ঘন্টাই খাবার পাওয়া যায়। সব্জি, ডাল, রুটি আর মিষ্টিজাতীয় খাবার। আমীষের আহার শিখ সমাজে খুব একটা নেই বিধায় মন্দিরে মাছ-মাংস পাওয়া যায় না। আশ্চর্য হল, খাবার সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ যেকোন সময় গেলেই খাদ্য মিলবে। কোন ধর্মের, কোন বর্ণের এটা বিবেচ্য না। তো খাবারের এই নিত্য ভান্ডার কোত্থেকে আসে? ক্যালগেরির স্থানীয় শিখেরা দান করে। গ্রোসারী করার সময় অনেক শিখ পরিবার সর্বদাই অতিরিক্ত সদাই কিনে। আর সেসব মন্দিরে দান করে যায়। বিশেষ করে এই দুধ। চার লিটারের দুধের ক্যান একটার বেশী কখনো কিনি না আমরা। কিন্তু শিখদের উল্টো, একটা কিনতে কখনো দেখি নি। কমপক্ষে পাঁচটা - কেউ কেউ দশ পনেরটাও কিনে ফেলে। আগেই বলেছি, মুড়িমুড়কির মত দুধ কিনে এরা ওয়ালমার্ট থেকে। মন্দিরে দান করা ছাড়াও নিজেরা দুধের বিভিন্ন পদ রান্না করে নিশ্চয়।
শিখদের আরেকটি বিষয়ে আমার বেজায় আগ্রহ - পাগড়ী। বিচিত্র ধরনের পাগড়ী থাকে এদের মাথায়। শিশু থেকে শুরু করে বয়োঃবৃদ্ধ - সকলেই কিছু না কিছু বাঁধছে মাথায়। এক শিখ বন্ধু আছে আমার, নাম - হারজিত। এদের নামগুলোও বেশ মজার। সকলেরই কেমন হারজিত, হারবিন্দর, রূপিন্দর এরকম নাম - সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন। আমাদের মত রহিম পুরুষ আর রহিমা মহিলা - ঠিক এরকম না। অবশ্য হারজিত আমার মেয়ে বন্ধু। হঠাৎ করেই ওয়ালমার্টে দেখা এখন। বাজারের ট্রলিটা মেয়ের কাছে দিয়ে হারজিতের সাথে গল্প শুরু করি।
‘হাঞ্জি, কেমন আছো?’ আমার জিজ্ঞেস।
‘ভাল। তুমি কেমন আছো?’ হারজিত হাসে আমার মুখে হাঞ্জি শুনে। হাঞ্জি ওদের সম্ভাষণের ভাষা। অনেকটা হাই, হ্যালোর মত। এখানকার সবচেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে এই হাঞ্জি। কান ঝালাপালা একেবারে! তবে মেয়েটা কিন্তু সুশ্রী, নায়িকাদের মত দেখতে। হাসিটাও খুব সুন্দর। লম্বা চুল প্রায় কোমরের কাছে। মাথায় অবশ্য পাগড়ী-টাগড়ী কিছু বাঁধে না হারজিত।
‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি।
‘অবশ্যই, বল।’ আগ্রহ হারজিতের গলায়।
‘এই যে তুমি মাথায় পাগড়ী পড়ছ না। আবার দেখি অনেকেই পড়ছে। তোমাদের এই পাগড়ী নিয়ে আমার কৌতূহল ভীষণ। একটু ব্যাখ্যা করবে?’
‘ও, এই কথা।’ হাসে আবার। ‘শিখ মেয়েদের পাগড়ীর বাধ্যবাধকতা নেই। কিছু মতভেদ আছে এক্ষেত্রে। তবে অধিকাংশ মেয়েই পাগড়ী পড়ে না।’
‘আর ছেলেরা?’
‘হ্যা। ছেলেরা পাগড়ী পড়ে। সেই ছোটবেলা থেকেই।’
‘পাগড়ীর রকম দেখলে রতিমিত ভিরমি খাই যে!’
আবার হাসে হারজিত। ‘তাই নাকি? পাগড়ীর বিভিন্ন রকম সম্বন্ধে জানতে চাও?’
‘খুউব চাই।’
‘ছোট্ট শিশুরা মাথার চুল উপরের দিকে নিয়ে একটা রুমালের মত কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। কেউ কেউ দোপাট্টা বা চুন্নি দিয়েও বাঁধে।’
‘দোপাট্টা মানে তো ওড়না। কিন্তু চুন্নিটা আবার কী?
‘ওড়নার মতই একটা কাপড়। তবে আকারে বড় - দুই মিটারের বেশী।’
‘তাই নাকি? আর বড়রা কী পড়ে?’
‘সাধারণত দৈনন্দিন প্রয়োজনে বড়রা দেড়-দুই মিটার লম্বা কাপড় মাথার চারিদিকে পেঁচিয়ে উপরে বলের মত করে বানিয়ে এক ধরনের পাগড়ী পড়ে। একে বলে পাটকা। খেলোয়াড়রা এরকম পাগড়ী পড়ে হরহামেশা। ক্রিকেটার হারভাজন সিংকে দেখেছ না?’
‘ও হ্যা! অনেক দেখেছি। মানিন্দার সিং, বলবিন্দর সিং সান্ধু আরো অনেককে দেখেছি। এটা তাহলে পাটকা?’
‘ঠিক তাই। এছাড়া, বড় পাগড়ীর নীচে আধা মিটার বা এক মিটারের একটা কাপড় পেঁচানো হয়। একে ফিফটি বলে। এর উপরে দুই-আড়াই মিটারের কাপড় দিয়ে ছোট পাগড়ী পড়ে অনেক সময়। এর নাম কেসকি।’
‘কেসকি? এটাতো এক ধরণের ছোট মাছ আমাদের দেশে!’
‘তাই নাকি? মজার তো! যাহোক, ছয় মিটার কাপড় দিয়ে চোখা টাইপের যে পাগড়ী পড়ে তাকে দস্তর বলে। দস্তর সাধারণ পাগড়ী থেকে বড় হয় এবং বেশ চোখা। তুলনায় সাধারণ পাগড়ী কম চোখা।’
‘আরো আছে নাকি?’
‘আরেক ধরণের পাগড়ী আছে - ডমাল্লা নাম। দশ মিটার কাপড় পেঁচিয়ে এই পাগড়ী বানানো হয়। এটার সাথে অলংকার জুড়ে দিয়ে আরো আকর্ষণীয় করা হয়। এরকমই আরেক ধরনের আছে; ডমাল্লা-ওয়ারিওর। পাগড়ীর সামনে যুদ্ধের সাজে চাঁদতারা বা জার্মান সোয়াজটিকার মত লাগানো থাকে।’
‘মাই গড! পাগড়ীর শেষ নেই যেন!’ আমি সত্যিই অবাক।
মেয়েটি আবার হাসে। ‘শিখদের মধ্যেও কিন্তু পাগড়ীর মত বিভিন্নতা আছে। সবাই এক রকমের শিখ না। ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট এরকম বিভাজন আছে।’
‘তাই নাকি? কী রকম?’
‘প্রধানত চার রকমের বলা যায় - অমৃতধারী, কেশধারী, সহজধারী এবং পতিত। এর মধ্যে অমৃতধারীরা সবচেয়ে ধার্মিক শিখ। এরা চুল কাটে না, বালা পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর পতিতরা শিখ কোড অব কন্ডাডাক্ট ভঙ্গ করেছে। তাই পতিত।’
‘যাক। অনেক কিছুই শিখলাম তোমার কাছ থেকে।’
হারজিতের সাথে কথা শেষ করে আবার পরিবারের কাছে ফিরি। এরা দেখি বীর দর্পে যুদ্ধ জয়ের মত এটা-ওটা কিনেই যাচ্ছে। চীজ, মেয়োনিজ, ইওগার্ট কিনছে এখন। আমি যথারীতি আবার অন্য মানুষদের দিকে দৃষ্টি দেই। বার রকমের মানুষ বাজার করছে। নানান রঙের, নানান বর্ণের - বিচিত্র সব চেহারা! বিচিত্র কাজকর্ম। যেমন, চাইনিজদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম দামি জিনিস কেনা। কৃপনই বলা যায় ওদের। ভারতীয়রাও কৃপণ তবে চাইনিজদের মত ওতটা না। যেখানে কম দামি জিনিষ বা মূল্যহ্রাসে বিক্রির কিছু আছে ওখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়বে এরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিনিসের দাম দেখে সবচেয়ে সস্তাটা কেনা ওদের আরাধ্য কার্য। তাই চাইনিজরা যে জিনিস কিনছে নির্দিধায় তা কিনে ফেলা যায়, কোনরকম বাছবিচার না করেই। অবশ্য জিনিসের গুনাগুন নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে।
সাদাদের অবশ্য এরকম খুঁতখুঁতানি কম। সামনে যা পায় ধুপধাপ করে ট্রলিতে ভরতে থাকে। একটা সময় ট্রলি ফুলে ফেঁপে উঠে জিনিসের ভারে। যা দরকার তা কিনে, আবার যা দরকার না তাও কিনে। তবে একটা বিষয় উল্লেখ করা যায় নিশ্চিন্তেই - এরা রেডি-মেইড গ্রোসারি বেশী কিনে। রান্না করা লাগবে না, শুধু মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই হবে - এরকম জিনিস এদের অতি প্রিয়। অনেকক্ষণ ধরে রান্না করার ইচ্ছা বা সময় কোনটাই এদের নেই। আবার রান্না করে ঘর-বাড়ি গন্ধ করে ফেলবে, এ চিন্তা থেকেও রান্না বর্জন করে ফেলে এরা।
আমরা মোড়কজাত খাদ্যের আইলে ঘুরছি এখন। পুত্র-কন্যা চিপস কিনবে। পপকর্ন, সালসা, আর চকলেট বার। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠে, ‘বাবা দেখ, একটা খালি ¯িœর্কাস চকোলেট বারের প্যাকেট পড়ে আছে।’
‘তাই তো?’ আমি অবাক। চকোলেট বারের প্যাকেটটা চোখে পড়ল। খালি স্নির্কাসএর প্যাকেট, ভিতরে কিছু নেই। কেঊ একজন স্টোরের ভিতরে খেয়ে প্যাকেট ফেলে পয়সা না দিয়ে চলে গেছে। হারামজাদাকে কষে একটা গালি দিয়ে ফেললাম মনে মনে, ‘আরে বেটা খাবি, পয়সা দিবি না? খবিশ!’
অবশ্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলি, ‘মনে হয় কেউ একজন খেয়ে, ভুলে ফেলে রেখে গেছে।’
‘তাই হবে বোধ হয়।’ মেয়েটি আস্তে আস্তে বলে।
চকোলেটের জায়গাটা ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে পাস্তা-নুডুলস কেনা শুরু করল ওরা। হঠাৎ আমাদের চোখ পড়ল ঐ খালি প্যাকেটটার কাছাকাছি জায়গায়। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক ঐ আইল থেকে এটা-ওটা ট্রলিতে ভরছে। একসময় দেখি সেই খালি চকোলেটের প্যাকেটটাও ট্রলিতে রাখল। একটু অবাকই হলাম। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। কিছু বললাম না, কী মনে করে আবার। সামনে এগিয়ে গেল ওরা, চাল কিনবে। চাল কিনতে গেলে সবসময়ই একটা বাহাস লেগে যেত আগে। বাসমতি না জাসমিন রাইস কোনটা কিনতে হবে? এখন অবশ্য বিষয়টা স্থিত হয়ে গেছে। দ্বিগুণ দাম দিয়ে বাসমতি কেনার কোন মানেই হয় না। তারচেয়ে থাই জাসমিন রাইস যেমন সস্তা আর খেতেও খারাপ না।
ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর জায়গাটা পার হতে গেলেই আমি থেমে পড়ি সব সময়। বিশেষ করে ল্যাপটপের বিস্তরণে একটু চোখ বুলিয়ে যাবই যাব। অনেক দিনের শখ অ্যাপলের একটা হাইএন্ড ম্যাকবুক প্রো কিনব। বোধ হয় এ জনমে আর হবে না। এত দাম! সেলফোনের কাছেও সতৃষ্ণ ঢু মারি একটু। এরপর আইপ্যাড, ট্যাবলেট এগুলোতো আছেই। বিশাল বিশাল সব টিভির দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে যাই।
মেয়েটা অবশ্য ভিন্ন আমাদের চেয়ে। ওর তড়িৎ গমন বইয়ের সারিতে। বিভিন্ন লেখকের বই পাঁজা করে রাখা আছে ওখানে। মেয়েটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পছন্দের বই বের করে ফেলে, কিনবে বলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু বইয়ের চুম্বক অংশ পড়েও ফেলে এরই মাঝে। বই-পোকা বলা যায় ওকে। নিজের কক্ষে দেয়াল ঘেষে ছোট্ট একটা বইয়ের শেলফ বানিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। নাই নাই করতে করতে সেই শেলফ ভরেও ফেলেছে প্রায়। সবগুলোই কিন্তু পঠিত বই। না পড়ে কোন বই শেলফে রাখে না ও।
আমার সেলফোন বেজে উঠে হঠাৎ, ‘হ্যালো?’
‘কোথায় তোমরা?’ আমার স্ত্রীর কণ্ঠ।
‘এই তো, ইলেকট্রনিক্স আইলে।’
‘মেয়ে কোথায়?’
‘জানি না। বইয়ের তাকের কাছে মনে হয়।’ আমার অনিশ্চিত জবাব।
‘মেয়েকে নিয়ে পঁচিশ নম্বর আইলে চলে আস।’
‘আসছি’ বলে ফোন রাখি। পঁচিশ নম্বর আইলে গিয়ে দেখি বিশ লিটারের তেলের ক্যানটা ট্রলিতে উঠাতে হবে। কে উঠাবে? আমি ছাড়া আর কে?
দক্ষিণ এশীয়দের বাজারের আরেকটা আবশ্যিক সদাই হলো মশলাপাতি। হরেক রকম মশলায় রান্নাঘরের তাকের পর তাক ভরে ফেলে এরা। স্টোরের শেলফে যতখানি জায়গাগুড়ে মশলাপাতি থাকে ততখানি জুড়ে আর কিছু থাকে না বোধ হয়। মাছ-মাংস রান্নার মশলা থেকে শুরু করে কাবাব-বিরানীর মশলাও এখন তৈরী পাওয়া যায়। আর এখন তো মাছ-মাংস-সব্জি সবই কাটা পাওয়া যায়। শুধুমাত্র মশলা আর পানি দিয়ে চড়িয়ে দিলেই হবে। আর কিছুই করতে হবে না। রান্নাটা কত সহজ হয়ে গেছে!
ট্রলি ভর্তি করে একেকজন চেক-আউট কাউন্টারে যাচ্ছে। আমাদের ট্রলিও যথারীতি উপচে পড়ছে মালামালের আতিশয্যে। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠে, ‘বাবা দেখ, ঐ লোকটা।’
‘কোন লোকটা?’ আমি বলি।
‘ঐ যে প্যাকেট ফুড আইলে ছিল। খালি স্নির্কাস্ বারের প্যাকেটা ট্রলিতে রেখেছিল।’ হাপাচ্ছে মেয়েটি। একটু উত্তেজিত।
‘তো, এতে উত্তেজিত হবার কী আছে।’
‘না মানে, দেখার ইচ্ছে ছিল প্যাকেটটা নিয়ে কী করেন তিনি। আমি ভীষণ উত্তেজিত বাবা।’ মেয়েটি আগ্রহে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে।
আমিও ভদ্রলোকের দিকে তাকাই ভাল করে। পঞ্চাশের কম বয়স। গায়ের রঙ লালচে ফরসা। সোনালী চুল পেছনে ঝুটি করা - পনিটেইল বলে একে। ইতালির বিখ্যাত ফুটবলার রবার্তো ব্যাজিও এরকম চুল রেখেছিল। ওখান থেকেই নামটা জেনেছি। যা হোক, ব্যায়াম করা পেটানো শরীর ভদ্রলোকের। পেশীগুলো ফুলে রয়েছে স্যান্ডো গেঞ্জি ভেদ করে। হাতাকাটা গেঞ্জি বাহুর মাংসপেশী যাচ্ছেতাই ভাবে বের করে দিয়েছে। সাথে রঙবেরঙের উল্কি ডানহাত ভর্তি। বাম হাতে অবশ্য তেমন কিছু নেই। পুরু গোঁফ ঠোটের উপরের জায়গা ছেড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে মিশেছে। দাড়িগোঁফও সোনালী রঙের, এই বডি বিল্ডারের।
গায়ে অসুরের শক্তি মানুষটার। চল্লিশ পাউন্ডের চালের বস্তাটা অবলীলায় কাউন্টারে তুলে ফেলল। ভাবছি, এত চাল দিয়ে কী করবেন ভদ্রলোক? এরাতো ভাত খায় না তেমন। আলুই এদের প্রধান খাদ্য। যাহোক, সব মালামালের সাথে সেই চকোলেট বারের খালি প্যাকেটটাও ক্যাশিয়ার মেয়েটার কাছে দিল। মেয়েটি সব স্ক্যান করে বিল ধরিয়ে দিল - একশ একানব্বই ডলার। লোকটি বিল দিয়ে দিচ্ছে।
আমি তাজ্জব! কে না কে খেয়েছে চকোলেট বারটা? তিনি বিল দিচ্ছেন কেন?
আমি থমকে উঠে বলি, ‘এই চকোলেট তো আপনি খান নি?’
‘আপনি জানলেন কেমন করে?’ বিরক্ত চোখে তাকায় আমার দিকে।
‘কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে অনধিকার চর্চা করছি। দুঃখিত, তবুও একটা প্রশ্ন করি।’
‘ঠিক আছে। বলেন কী প্রশ্ন?’
‘আপনি এটার বিল দিচ্ছেন কেন? এটাতো শেলফে পড়ে ছিল, আপনি খান নি।’
ভদ্রলোক কৌতুকে তাকান, ‘আপনি দেখেছেন?’
আমি দৃঢ় স্বরে বলি, ‘হ্যা, দেখেছি। আমার মেয়েও দেখেছে।’
ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে যান। ধীরে ধীরে বলেন, ‘কারও নিশ্চয় ক্ষুধা লেগেছিল, খেয়ে ফেলেছে। পয়সা ছিল না মনে হয়, তাই ফেলে চলে গেছে। তার হয়ে না হয় বিলটা আমিই দিয়ে দিলাম।’ ভদ্রলোক ট্রলি ঠেলে চলে গেলেন উদাসীনভাবে।
আমি চলে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি নিস্পলক। একটু আগে উল্কি-পড়া দশাসই চেহারাটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলাম বেশ। আর যে লোকটি চকোলেট খেয়ে বিল না দিয়ে চলে গিয়েছিল তাকে কষে গাল দিয়েছিলাম। অথচ বডি বিল্ডার আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে মানবতা শিখিয়ে গেল। চড় দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে সত্যিকারের মানুষ হতে হয়।
আহারে! চড়টা ভালই খেলাম, বিরাট রামচড়।
ক্যাশিয়ার মেয়েটি আমার বিহ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওয়ালমার্টে তিন ধরনের কাস্টমার আসে। বেশীর ভাগই নিজের জিনিস নিয়ে বিল দিয়ে চলে যায়। কেউ কেউ বিল না দিয়ে খালি প্যাকেট ফেলে চলে যায়। অথবা চুরি করে মালামাল নিয়ে চলে যায়। আর অতি স্বল্প সংখ্যক কাস্টমার আছে যারা নিজের বিলের সাথে অন্যের না-দেয়া বিলটাও দিয়ে দেয়। আমরা এখন আর তেমন অবাক হই না।’ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় মেয়েটির গলা। আমি কিছুই যেন শুনতে পাই না।
বিরাট রামচড় খেয়ে আজ আমার অবাক হবার পালা!
বিরাট কলেবরে স্টোরটা! সুপার সেন্টার বলে এরা। উত্তর আমেরিকায় ওয়ালমার্ট দুই ধরণের আছে। সাধারণ ওয়ালমার্টে গ্রোসারি পাওয়া যায় না। আর সুপার সেন্টারে কাচা বাজার মানে মাছ-মাংস-সব্জিসহ সব ধরনের গ্রোসারি পাওয়া যায়। বাসার নিকটের এই সুপার সেন্টারটাতে গেলে ভড়কে যাই নিয়তই। আকারে ইয়া বড়, এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটতে গেল ক্লান্ত প্রাণ সহসাই। তার উপরে মানুষের বেজায় ভীড় লেগেই থাকে! কাস্টমারের চাপে দিশেহারা স্টোর কর্তৃপক্ষ।
সয়ংক্রিয় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে হাতের বায়ে গ্রোসারি। মাঝখানে রান্নার তৈজসপত্র। আর ডানদিকে কাপড়চোপড়। এরপর স্টেশনারী, প্রসাধনী, খেলনা, ইলেকট্রনিক্স, গাড়ির সরঞ্জাম, মাছ ধরা আর খেলাধুলার জিনিস। এরপর বাগান করার জিনিসপত্র এবং জ্যান্ত গাছ। এ জায়গাটা আমাদেও খুবই প্রিয়। একবার ঢু মারা হবেই হবে। এদিকে স্টোরের দেয়াল ঘেষে আছে খাবারের দোকান, চুল কাটার সেলুন, স্টুডিও, ফার্মেসি আরো কত কি! কী নেই এখানে? সুই-সুতো থেকে শুরু করে আলু-পটল সবই আছে ওয়ালমার্টে, দামেও সস্তা। খুচরো ব্যবসার জগতে ওয়ালমার্টের ধারেকাছেও কেউ নেই এই দুনিয়ায়।
সদলবলে আমরা এখানে এখন - পুরো পরিবার নিয়ে এসেছি, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে। অবশ্য আমি শুধু নামেই আছি। কাজের কাজ কিছু করব না। বাজার করার মত দূরহ কাজটা জীবনেও করতে পারলাম না। এরা কেমনে করে কে জানে? যাহোক, কেনাকাটা যা করার ওরাই করবে। আমি পিছনে পিছনে ঘুরব শুধু। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে পিছনে ঘুরা আমার খারাপ লাগে না। বউ-ছেলে-মেয়ে আইলের পর আইল ধরে হাঁটে। এটা ওটা টেনে নামায় - ছুড়ে ফেলে ট্রলিতে। আমি অসীম কৌতূহলে ওদের কান্ডকারখানা দেখি। গভীর মনোযোগে ওদের আলাপ শুনি। কোনটার দাম কত? কোয়ালিটি কেমন? দাম কমল না বাড়ল? পুরো মুখস্থ ওদের। এত বড় স্টোরের কোথায় কী আছে চট করে বলে দিতে পারে পরিবারের সবাই, শুধুমাত্র আমি ছাড়া। এমনকি ছোট্ট মেয়েটাও, আজব লাগে!
আমি নিবিষ্ট মনে ওদের বাজার করা দেখি। সংসারে যে কত কিছু লাগে তা বাজারে না আসলে বিশ্বাস করা কঠিন। আর ওয়ালমার্টের সুপার স্টোরে আসলে তো কথাই নেই। টমেটো-শশা-গাজর থেকে শুরু করে রাইস কুকার কিনতে এসেছে। হঠাৎ মূল্যহ্রাস দেখে টোস্টারের - কিনে ফেলো। ওদিকে মাইক্রোওয়েভ পানির দামে। তাড়াতাড়ি কিনে ফেলো, শেষ হয়ে যাবে।
‘আরে! আমাদেরতো মাইক্রোওয়েভ আছে?’ আমি ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করি।
‘তাতে কী? মূল্যহ্রাসটা দেখবা না? এরকম পানির দামে দিচ্ছে কিনে রাখি।’ স্ত্রী স্বভাবসূলভ ঝামটা।
এই দেশে মূল্যহ্রাসের মাহাত্ম্য অসীম - খালি আমিই বুঝলাম না। বড় আফসুস! তবে মূল্যহ্রাস থাকুক আর না থাকুক এই স্টোরে একটা জিনিস মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হয়। তার আগে বলে নেই, আমরা ক্যালগেরি শহরের যে এলাকায় থাকি সেখানে পাঞ্জাবীদের বহুল বসবাস। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, পাঞ্জাবী শিখদের ধুন্ধুমার আবাসস্থল এখানে। পাগড়ী পড়া অথবা পাগড়ী বিহীন শিখেরা দোর্দন্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায় সকাল-সন্ধ্যা। সংখ্যায় কত জানি না, তবে অনুপাতে এদের সমতূল্য অন্য কোন সম্প্রদায় ক্যালগেরির এদিকটাতে নেই। এই এলাকার জন প্রতিনিধি, মন্ত্রী-সাংসদ সব শিখ। দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বেশীরভাগ ওদের দখলে। কাছাকাছি জায়গায় দুই দুইটা শিখ মন্দির আছে। ভাবা যায়! এরা বলে গুরুদুয়ারা। একটার নাম গুরুদুয়ারা সাহিবা, আরেকটা গুরুদুয়ারা দরবার। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা গুরুদুয়ারা আছে, গুরুদুয়ারা নানক শাহী।
শিখদের কাছে গুরুদুয়ারা আমাদের মসজিদের মত। প্রচন্ড ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আমরা যেমন মসজিদে দান-খয়রাত করি। এরাও মন্দিরে তাই করে। তবে পার্থক্য একটু আছে। মসজিদে খাবার পাওয়া যায় না। কিন্তু গুরুদুয়ারায় চব্বিশ ঘন্টাই খাবার পাওয়া যায়। সব্জি, ডাল, রুটি আর মিষ্টিজাতীয় খাবার। আমীষের আহার শিখ সমাজে খুব একটা নেই বিধায় মন্দিরে মাছ-মাংস পাওয়া যায় না। আশ্চর্য হল, খাবার সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ যেকোন সময় গেলেই খাদ্য মিলবে। কোন ধর্মের, কোন বর্ণের এটা বিবেচ্য না। তো খাবারের এই নিত্য ভান্ডার কোত্থেকে আসে? ক্যালগেরির স্থানীয় শিখেরা দান করে। গ্রোসারী করার সময় অনেক শিখ পরিবার সর্বদাই অতিরিক্ত সদাই কিনে। আর সেসব মন্দিরে দান করে যায়। বিশেষ করে এই দুধ। চার লিটারের দুধের ক্যান একটার বেশী কখনো কিনি না আমরা। কিন্তু শিখদের উল্টো, একটা কিনতে কখনো দেখি নি। কমপক্ষে পাঁচটা - কেউ কেউ দশ পনেরটাও কিনে ফেলে। আগেই বলেছি, মুড়িমুড়কির মত দুধ কিনে এরা ওয়ালমার্ট থেকে। মন্দিরে দান করা ছাড়াও নিজেরা দুধের বিভিন্ন পদ রান্না করে নিশ্চয়।
শিখদের আরেকটি বিষয়ে আমার বেজায় আগ্রহ - পাগড়ী। বিচিত্র ধরনের পাগড়ী থাকে এদের মাথায়। শিশু থেকে শুরু করে বয়োঃবৃদ্ধ - সকলেই কিছু না কিছু বাঁধছে মাথায়। এক শিখ বন্ধু আছে আমার, নাম - হারজিত। এদের নামগুলোও বেশ মজার। সকলেরই কেমন হারজিত, হারবিন্দর, রূপিন্দর এরকম নাম - সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন। আমাদের মত রহিম পুরুষ আর রহিমা মহিলা - ঠিক এরকম না। অবশ্য হারজিত আমার মেয়ে বন্ধু। হঠাৎ করেই ওয়ালমার্টে দেখা এখন। বাজারের ট্রলিটা মেয়ের কাছে দিয়ে হারজিতের সাথে গল্প শুরু করি।
‘হাঞ্জি, কেমন আছো?’ আমার জিজ্ঞেস।
‘ভাল। তুমি কেমন আছো?’ হারজিত হাসে আমার মুখে হাঞ্জি শুনে। হাঞ্জি ওদের সম্ভাষণের ভাষা। অনেকটা হাই, হ্যালোর মত। এখানকার সবচেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে এই হাঞ্জি। কান ঝালাপালা একেবারে! তবে মেয়েটা কিন্তু সুশ্রী, নায়িকাদের মত দেখতে। হাসিটাও খুব সুন্দর। লম্বা চুল প্রায় কোমরের কাছে। মাথায় অবশ্য পাগড়ী-টাগড়ী কিছু বাঁধে না হারজিত।
‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি।
‘অবশ্যই, বল।’ আগ্রহ হারজিতের গলায়।
‘এই যে তুমি মাথায় পাগড়ী পড়ছ না। আবার দেখি অনেকেই পড়ছে। তোমাদের এই পাগড়ী নিয়ে আমার কৌতূহল ভীষণ। একটু ব্যাখ্যা করবে?’
‘ও, এই কথা।’ হাসে আবার। ‘শিখ মেয়েদের পাগড়ীর বাধ্যবাধকতা নেই। কিছু মতভেদ আছে এক্ষেত্রে। তবে অধিকাংশ মেয়েই পাগড়ী পড়ে না।’
‘আর ছেলেরা?’
‘হ্যা। ছেলেরা পাগড়ী পড়ে। সেই ছোটবেলা থেকেই।’
‘পাগড়ীর রকম দেখলে রতিমিত ভিরমি খাই যে!’
আবার হাসে হারজিত। ‘তাই নাকি? পাগড়ীর বিভিন্ন রকম সম্বন্ধে জানতে চাও?’
‘খুউব চাই।’
‘ছোট্ট শিশুরা মাথার চুল উপরের দিকে নিয়ে একটা রুমালের মত কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। কেউ কেউ দোপাট্টা বা চুন্নি দিয়েও বাঁধে।’
‘দোপাট্টা মানে তো ওড়না। কিন্তু চুন্নিটা আবার কী?
‘ওড়নার মতই একটা কাপড়। তবে আকারে বড় - দুই মিটারের বেশী।’
‘তাই নাকি? আর বড়রা কী পড়ে?’
‘সাধারণত দৈনন্দিন প্রয়োজনে বড়রা দেড়-দুই মিটার লম্বা কাপড় মাথার চারিদিকে পেঁচিয়ে উপরে বলের মত করে বানিয়ে এক ধরনের পাগড়ী পড়ে। একে বলে পাটকা। খেলোয়াড়রা এরকম পাগড়ী পড়ে হরহামেশা। ক্রিকেটার হারভাজন সিংকে দেখেছ না?’
‘ও হ্যা! অনেক দেখেছি। মানিন্দার সিং, বলবিন্দর সিং সান্ধু আরো অনেককে দেখেছি। এটা তাহলে পাটকা?’
‘ঠিক তাই। এছাড়া, বড় পাগড়ীর নীচে আধা মিটার বা এক মিটারের একটা কাপড় পেঁচানো হয়। একে ফিফটি বলে। এর উপরে দুই-আড়াই মিটারের কাপড় দিয়ে ছোট পাগড়ী পড়ে অনেক সময়। এর নাম কেসকি।’
‘কেসকি? এটাতো এক ধরণের ছোট মাছ আমাদের দেশে!’
‘তাই নাকি? মজার তো! যাহোক, ছয় মিটার কাপড় দিয়ে চোখা টাইপের যে পাগড়ী পড়ে তাকে দস্তর বলে। দস্তর সাধারণ পাগড়ী থেকে বড় হয় এবং বেশ চোখা। তুলনায় সাধারণ পাগড়ী কম চোখা।’
‘আরো আছে নাকি?’
‘আরেক ধরণের পাগড়ী আছে - ডমাল্লা নাম। দশ মিটার কাপড় পেঁচিয়ে এই পাগড়ী বানানো হয়। এটার সাথে অলংকার জুড়ে দিয়ে আরো আকর্ষণীয় করা হয়। এরকমই আরেক ধরনের আছে; ডমাল্লা-ওয়ারিওর। পাগড়ীর সামনে যুদ্ধের সাজে চাঁদতারা বা জার্মান সোয়াজটিকার মত লাগানো থাকে।’
‘মাই গড! পাগড়ীর শেষ নেই যেন!’ আমি সত্যিই অবাক।
মেয়েটি আবার হাসে। ‘শিখদের মধ্যেও কিন্তু পাগড়ীর মত বিভিন্নতা আছে। সবাই এক রকমের শিখ না। ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট এরকম বিভাজন আছে।’
‘তাই নাকি? কী রকম?’
‘প্রধানত চার রকমের বলা যায় - অমৃতধারী, কেশধারী, সহজধারী এবং পতিত। এর মধ্যে অমৃতধারীরা সবচেয়ে ধার্মিক শিখ। এরা চুল কাটে না, বালা পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর পতিতরা শিখ কোড অব কন্ডাডাক্ট ভঙ্গ করেছে। তাই পতিত।’
‘যাক। অনেক কিছুই শিখলাম তোমার কাছ থেকে।’
হারজিতের সাথে কথা শেষ করে আবার পরিবারের কাছে ফিরি। এরা দেখি বীর দর্পে যুদ্ধ জয়ের মত এটা-ওটা কিনেই যাচ্ছে। চীজ, মেয়োনিজ, ইওগার্ট কিনছে এখন। আমি যথারীতি আবার অন্য মানুষদের দিকে দৃষ্টি দেই। বার রকমের মানুষ বাজার করছে। নানান রঙের, নানান বর্ণের - বিচিত্র সব চেহারা! বিচিত্র কাজকর্ম। যেমন, চাইনিজদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম দামি জিনিস কেনা। কৃপনই বলা যায় ওদের। ভারতীয়রাও কৃপণ তবে চাইনিজদের মত ওতটা না। যেখানে কম দামি জিনিষ বা মূল্যহ্রাসে বিক্রির কিছু আছে ওখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়বে এরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিনিসের দাম দেখে সবচেয়ে সস্তাটা কেনা ওদের আরাধ্য কার্য। তাই চাইনিজরা যে জিনিস কিনছে নির্দিধায় তা কিনে ফেলা যায়, কোনরকম বাছবিচার না করেই। অবশ্য জিনিসের গুনাগুন নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে।
সাদাদের অবশ্য এরকম খুঁতখুঁতানি কম। সামনে যা পায় ধুপধাপ করে ট্রলিতে ভরতে থাকে। একটা সময় ট্রলি ফুলে ফেঁপে উঠে জিনিসের ভারে। যা দরকার তা কিনে, আবার যা দরকার না তাও কিনে। তবে একটা বিষয় উল্লেখ করা যায় নিশ্চিন্তেই - এরা রেডি-মেইড গ্রোসারি বেশী কিনে। রান্না করা লাগবে না, শুধু মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই হবে - এরকম জিনিস এদের অতি প্রিয়। অনেকক্ষণ ধরে রান্না করার ইচ্ছা বা সময় কোনটাই এদের নেই। আবার রান্না করে ঘর-বাড়ি গন্ধ করে ফেলবে, এ চিন্তা থেকেও রান্না বর্জন করে ফেলে এরা।
আমরা মোড়কজাত খাদ্যের আইলে ঘুরছি এখন। পুত্র-কন্যা চিপস কিনবে। পপকর্ন, সালসা, আর চকলেট বার। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠে, ‘বাবা দেখ, একটা খালি ¯িœর্কাস চকোলেট বারের প্যাকেট পড়ে আছে।’
‘তাই তো?’ আমি অবাক। চকোলেট বারের প্যাকেটটা চোখে পড়ল। খালি স্নির্কাসএর প্যাকেট, ভিতরে কিছু নেই। কেঊ একজন স্টোরের ভিতরে খেয়ে প্যাকেট ফেলে পয়সা না দিয়ে চলে গেছে। হারামজাদাকে কষে একটা গালি দিয়ে ফেললাম মনে মনে, ‘আরে বেটা খাবি, পয়সা দিবি না? খবিশ!’
অবশ্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলি, ‘মনে হয় কেউ একজন খেয়ে, ভুলে ফেলে রেখে গেছে।’
‘তাই হবে বোধ হয়।’ মেয়েটি আস্তে আস্তে বলে।
চকোলেটের জায়গাটা ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে পাস্তা-নুডুলস কেনা শুরু করল ওরা। হঠাৎ আমাদের চোখ পড়ল ঐ খালি প্যাকেটটার কাছাকাছি জায়গায়। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক ঐ আইল থেকে এটা-ওটা ট্রলিতে ভরছে। একসময় দেখি সেই খালি চকোলেটের প্যাকেটটাও ট্রলিতে রাখল। একটু অবাকই হলাম। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। কিছু বললাম না, কী মনে করে আবার। সামনে এগিয়ে গেল ওরা, চাল কিনবে। চাল কিনতে গেলে সবসময়ই একটা বাহাস লেগে যেত আগে। বাসমতি না জাসমিন রাইস কোনটা কিনতে হবে? এখন অবশ্য বিষয়টা স্থিত হয়ে গেছে। দ্বিগুণ দাম দিয়ে বাসমতি কেনার কোন মানেই হয় না। তারচেয়ে থাই জাসমিন রাইস যেমন সস্তা আর খেতেও খারাপ না।
ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর জায়গাটা পার হতে গেলেই আমি থেমে পড়ি সব সময়। বিশেষ করে ল্যাপটপের বিস্তরণে একটু চোখ বুলিয়ে যাবই যাব। অনেক দিনের শখ অ্যাপলের একটা হাইএন্ড ম্যাকবুক প্রো কিনব। বোধ হয় এ জনমে আর হবে না। এত দাম! সেলফোনের কাছেও সতৃষ্ণ ঢু মারি একটু। এরপর আইপ্যাড, ট্যাবলেট এগুলোতো আছেই। বিশাল বিশাল সব টিভির দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে যাই।
মেয়েটা অবশ্য ভিন্ন আমাদের চেয়ে। ওর তড়িৎ গমন বইয়ের সারিতে। বিভিন্ন লেখকের বই পাঁজা করে রাখা আছে ওখানে। মেয়েটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পছন্দের বই বের করে ফেলে, কিনবে বলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু বইয়ের চুম্বক অংশ পড়েও ফেলে এরই মাঝে। বই-পোকা বলা যায় ওকে। নিজের কক্ষে দেয়াল ঘেষে ছোট্ট একটা বইয়ের শেলফ বানিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। নাই নাই করতে করতে সেই শেলফ ভরেও ফেলেছে প্রায়। সবগুলোই কিন্তু পঠিত বই। না পড়ে কোন বই শেলফে রাখে না ও।
আমার সেলফোন বেজে উঠে হঠাৎ, ‘হ্যালো?’
‘কোথায় তোমরা?’ আমার স্ত্রীর কণ্ঠ।
‘এই তো, ইলেকট্রনিক্স আইলে।’
‘মেয়ে কোথায়?’
‘জানি না। বইয়ের তাকের কাছে মনে হয়।’ আমার অনিশ্চিত জবাব।
‘মেয়েকে নিয়ে পঁচিশ নম্বর আইলে চলে আস।’
‘আসছি’ বলে ফোন রাখি। পঁচিশ নম্বর আইলে গিয়ে দেখি বিশ লিটারের তেলের ক্যানটা ট্রলিতে উঠাতে হবে। কে উঠাবে? আমি ছাড়া আর কে?
দক্ষিণ এশীয়দের বাজারের আরেকটা আবশ্যিক সদাই হলো মশলাপাতি। হরেক রকম মশলায় রান্নাঘরের তাকের পর তাক ভরে ফেলে এরা। স্টোরের শেলফে যতখানি জায়গাগুড়ে মশলাপাতি থাকে ততখানি জুড়ে আর কিছু থাকে না বোধ হয়। মাছ-মাংস রান্নার মশলা থেকে শুরু করে কাবাব-বিরানীর মশলাও এখন তৈরী পাওয়া যায়। আর এখন তো মাছ-মাংস-সব্জি সবই কাটা পাওয়া যায়। শুধুমাত্র মশলা আর পানি দিয়ে চড়িয়ে দিলেই হবে। আর কিছুই করতে হবে না। রান্নাটা কত সহজ হয়ে গেছে!
ট্রলি ভর্তি করে একেকজন চেক-আউট কাউন্টারে যাচ্ছে। আমাদের ট্রলিও যথারীতি উপচে পড়ছে মালামালের আতিশয্যে। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠে, ‘বাবা দেখ, ঐ লোকটা।’
‘কোন লোকটা?’ আমি বলি।
‘ঐ যে প্যাকেট ফুড আইলে ছিল। খালি স্নির্কাস্ বারের প্যাকেটা ট্রলিতে রেখেছিল।’ হাপাচ্ছে মেয়েটি। একটু উত্তেজিত।
‘তো, এতে উত্তেজিত হবার কী আছে।’
‘না মানে, দেখার ইচ্ছে ছিল প্যাকেটটা নিয়ে কী করেন তিনি। আমি ভীষণ উত্তেজিত বাবা।’ মেয়েটি আগ্রহে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে।
আমিও ভদ্রলোকের দিকে তাকাই ভাল করে। পঞ্চাশের কম বয়স। গায়ের রঙ লালচে ফরসা। সোনালী চুল পেছনে ঝুটি করা - পনিটেইল বলে একে। ইতালির বিখ্যাত ফুটবলার রবার্তো ব্যাজিও এরকম চুল রেখেছিল। ওখান থেকেই নামটা জেনেছি। যা হোক, ব্যায়াম করা পেটানো শরীর ভদ্রলোকের। পেশীগুলো ফুলে রয়েছে স্যান্ডো গেঞ্জি ভেদ করে। হাতাকাটা গেঞ্জি বাহুর মাংসপেশী যাচ্ছেতাই ভাবে বের করে দিয়েছে। সাথে রঙবেরঙের উল্কি ডানহাত ভর্তি। বাম হাতে অবশ্য তেমন কিছু নেই। পুরু গোঁফ ঠোটের উপরের জায়গা ছেড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে মিশেছে। দাড়িগোঁফও সোনালী রঙের, এই বডি বিল্ডারের।
গায়ে অসুরের শক্তি মানুষটার। চল্লিশ পাউন্ডের চালের বস্তাটা অবলীলায় কাউন্টারে তুলে ফেলল। ভাবছি, এত চাল দিয়ে কী করবেন ভদ্রলোক? এরাতো ভাত খায় না তেমন। আলুই এদের প্রধান খাদ্য। যাহোক, সব মালামালের সাথে সেই চকোলেট বারের খালি প্যাকেটটাও ক্যাশিয়ার মেয়েটার কাছে দিল। মেয়েটি সব স্ক্যান করে বিল ধরিয়ে দিল - একশ একানব্বই ডলার। লোকটি বিল দিয়ে দিচ্ছে।
আমি তাজ্জব! কে না কে খেয়েছে চকোলেট বারটা? তিনি বিল দিচ্ছেন কেন?
আমি থমকে উঠে বলি, ‘এই চকোলেট তো আপনি খান নি?’
‘আপনি জানলেন কেমন করে?’ বিরক্ত চোখে তাকায় আমার দিকে।
‘কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে অনধিকার চর্চা করছি। দুঃখিত, তবুও একটা প্রশ্ন করি।’
‘ঠিক আছে। বলেন কী প্রশ্ন?’
‘আপনি এটার বিল দিচ্ছেন কেন? এটাতো শেলফে পড়ে ছিল, আপনি খান নি।’
ভদ্রলোক কৌতুকে তাকান, ‘আপনি দেখেছেন?’
আমি দৃঢ় স্বরে বলি, ‘হ্যা, দেখেছি। আমার মেয়েও দেখেছে।’
ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে যান। ধীরে ধীরে বলেন, ‘কারও নিশ্চয় ক্ষুধা লেগেছিল, খেয়ে ফেলেছে। পয়সা ছিল না মনে হয়, তাই ফেলে চলে গেছে। তার হয়ে না হয় বিলটা আমিই দিয়ে দিলাম।’ ভদ্রলোক ট্রলি ঠেলে চলে গেলেন উদাসীনভাবে।
আমি চলে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি নিস্পলক। একটু আগে উল্কি-পড়া দশাসই চেহারাটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলাম বেশ। আর যে লোকটি চকোলেট খেয়ে বিল না দিয়ে চলে গিয়েছিল তাকে কষে গাল দিয়েছিলাম। অথচ বডি বিল্ডার আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে মানবতা শিখিয়ে গেল। চড় দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে সত্যিকারের মানুষ হতে হয়।
আহারে! চড়টা ভালই খেলাম, বিরাট রামচড়।
ক্যাশিয়ার মেয়েটি আমার বিহ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওয়ালমার্টে তিন ধরনের কাস্টমার আসে। বেশীর ভাগই নিজের জিনিস নিয়ে বিল দিয়ে চলে যায়। কেউ কেউ বিল না দিয়ে খালি প্যাকেট ফেলে চলে যায়। অথবা চুরি করে মালামাল নিয়ে চলে যায়। আর অতি স্বল্প সংখ্যক কাস্টমার আছে যারা নিজের বিলের সাথে অন্যের না-দেয়া বিলটাও দিয়ে দেয়। আমরা এখন আর তেমন অবাক হই না।’ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় মেয়েটির গলা। আমি কিছুই যেন শুনতে পাই না।
বিরাট রামচড় খেয়ে আজ আমার অবাক হবার পালা!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Tanju H ৩০/০৯/২০১৭চমৎকার!!
-
কামরুজ্জামান সাদ ৩০/০৯/২০১৭দারুণ
-
মুক্তপুরুষ ৩০/০৯/২০১৭লেখাটা প্রিয়তে রেখ্ব দিলাম
-
আজাদ আলী ৩০/০৯/২০১৭ভালোইতো