www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাংলাদেশের ধর্মীয়-সম্প্রীতি

সময়টা দুর্দান্ত ছিল তখন।
শৈশব, দুরন্ত কৈশর পেরিয়ে বেড়ে উঠা - সবই মাদারীপুরে। ছোট্ট মফস্বল শহরটি শুধুমাত্র পায়ে হেঁটেই এধার-ওধার করে দেয়া যেত। সবকিছুই কেমন বড় বড় লাগত ছোট্ট চোখে সেসময়। বাসার পাশের হাই স্কুলের মাঠটাকে মনে হত যেন সবুজের সমুদ্র। নতুন শহরের লেকটাকে মহাসাগর না হলেও সাগর ভাবতাম অতি অবশ্যই। নয়নাভিরাম লেকের পাড়, আড়িয়াল খাঁ নদী, সদ্য-বানানো উপজেলা কমপ্লেক্স সৌন্দর্যে স্বর্গের কাছাকাছি কিছু। একটু দূরে ছিল মোস্তফাপুরে পর্বতের বাগান - বনভোজনের জন্য চমৎকার, ফি-বছরে পা পড়তই পড়ত। চরমুগুরিয়ার বানর, রাজৈর গণ্ উন্নয়ন প্রচেষ্টাও আগ্রহের মধ্যে ছিল। তবুও এসব ছাপিয়ে আমাদের নিত্য আকর্ষণ ছিল খেলার মাঠ আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা। আশ্চর্য! বন্ধু-বাছবিচারে কোন মানদন্ড ছিল না তখন, ধর্মতো কোনক্রমেই নয়।
ধর্মীয় সম্প্রদায়-ভিত্তিক সম্প্রীতি কেমন ছিল তখন? প্রশ্নের উত্তরে শাহ আব্দুল করিমের গানটি যথার্থ নয় কি? সুনামগঞ্জের অজপাড়াগায়ের তথাকথিত অশিক্ষিত এই ভদ্রলোক কতইনা স্বশিক্ষিত! না হলে কীভাবে বলেন তিনি, ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান ... আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ একেবারে মনের কথা - অতি সরল কিন্তু সত্য যেন পর্বত-প্রমাণ। নজরুল বলে গেছেন আরো সুন্দর করে, ‘হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই/ভারতের দুই আঁখি তারা/এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।’ কে বলেন নি? কবিগুরুও যে সেই মিছিলে, ’সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।’ এদিকে কুষ্টিয়ার লালন ফকির গেয়েছেন মনের সুখে, ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে।’
সম্প্রীতির এ ধারাটা তখনও চালু ছিল পুরোদমে। আমার বাল্যবন্ধু নারায়ণ। বাল্য বলতে সেই উদোম-কালের। বন্ধু আমার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। এখন বুঝি, ও পোলিও-আক্রান্ত ছোটবেলা থেকেই। কাছাকাছি থাকতাম আমরা। কথা-খেলা-আড়ি-মারামারিতে দিন গোজরানের সময় তখন। মাঝে মধ্যেই বাহাস ছিল এরকম, ‘তোরা হইলি মালায়ুন, তোগো অনেকগুলান মা। মাটি দিয়া একখান মুর্তি বানাইয়া মা মা কইরা কাইন্দা পরস।’ নারায়ণও কম যায় না, বাঘের মত ফুঁসে উঠে। ঝামটা উত্তর, ‘তোরা হইলি মুসলমান। তাই একটু পরপর মাটিতে উব্বুত হইয়া পরস’। গাছের ডালে বসে বা মাছ ধরছি বা মাঠের কিনারে বসে কোন সময়ে এমন বাহাস সমানে চালিয়ে যেতাম। বাস্, এটুকুই। কোন উন্মত্ততা ছিল না, হিং¯্রতাও না।
বাহাসের বিষয় কিন্তু আরো ছিল। কত কথা! শহরে বিনোদন বলতে তখন দুটি সিনেমা হল, একটি পাবলিক লাইব্রেরী, ক্রীড়ানুষ্ঠান আর কিছু সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। এসবের উর্দ্ধে ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আতিশয্য। ঈদ কিন্তু সর্বাগ্রে, পুজা বিশেষ করে সরস্বতি আর দুর্গাপুজা ছিল সার্বজনীন। এর বাইরে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, বৈশাখী উৎসব আর মেলাগুলো। পুরো শহর ভেঙ্গে পড়ত যেন। তবে ধর্মীয় আচার-পর্বগুলো পালন হত মহাউৎসাহ উদ্দীপনায়। এসব অনুষ্ঠানে সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কেমন ভাললাগার স্মৃতি হয়ে আছে এখনও। বড় বড় উদযাপনগুলো যেমন দুই ঈদের সময়, রমজানের পুরো মাস জুড়ে, বড়পুজায় একটু বাড়তি আয়োজন ছিল, জৌলুসে ভরপুর।
তখন কিন্তু ঘড়ির অ্যালার্মের চল তেমন হয় নাই। এদিকে রমজানে সেহরি খেতে খুব ভোরে উঠতে হয়। কোন কোন বাসায় মহিলারা তাই ঘুমাতেন না। বাড়ির সকলকে সেহরি খাইয়ে একবারে ঘুমাতে যেতেন। তাই ভোররাতে সেহরি খেতে উঠার এক অভিনব পদ্ধতি চালু ছিল সেসময়। কিছু কিশোর-যুবক থালাবাটিকে ঢাক-ঢোল-তবলা বানিয়ে সুরে সুরে গান গেয়ে যেত। আর গানের শব্দে পাড়াপড়শি জেগে উঠত। যাদের অবশ্য রোজা রাখার বালাই ছিল না তাঁদের দু’চারজন যে মনে মনে কষে গালাগাল দিতেন না একথা জোর দিয়া বলা যাবে না। তবে কখনোই তা প্রকাশ্য হয় নাই। যাহোক, কী আশ্চর্য! এসব স্বেচ্ছাসেবী কিশোর-যুবার সকলেই যে মুসলমান ছিল না! নারায়ণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছিল, পরিমল বিরাট দেহটা নিয়ে উচ্চস্বরে গান ধরত। আহারে!
এদিকে ঈদের দিন আমাদের সাথে নতুন জামাকাপড় পড়ে নারায়ণও সামিল! এবাসা-ওবাসা করে নিজের পাড়া-মহল্লা ছেড়ে অন্য পাড়ায় চলে গেছি আমরা। অন্য ধর্মের ছিল বলে বোধ করি একটু বেশীই খাতির পেত ওরা। আবার আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। তখন নারায়ণ-পরিমল নামগুলো কবির-সিদ্দিকের মতই যেন - এর বাইরে কিছু নয়। ধর্মভিত্তিক নামতো নয়ই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এত এত স্লোগান দিয়েছি - ’শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার অধিকার’, ’প্রতিরোধের প্রতিশোধ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার স্লোগান-জীবন শুরু হয়েছিল অনেক আগে। সেই ‘সরস্বতির মা’য় কী? জয়’ দিয়ে।
পুজা-মন্ডপগুলো ঘুড়ে এসে আমরা ছোটরা জটলা করে বসতাম পুকুর-পারে, জলের ধারে। বিরাট বস্সা লেগে যেত - কোনটা প্রথম হয়েছে। বাদামতলারটা কেউ বলত আবার কারো কাছে পুরান বাজারেরটা। ওহ! মারামারি লেগে যায় আর কি! রিক্সাভ্যানে মুর্তি বসিয়ে পিছনে এক-দঙ্গল লোক মিছিল নিয়ে বের হত। প্রতিমা-মিছিলের আগে না থাকতে পারলে নিজেকে তুচ্ছ লাগত। সেই সাথে অনভ্যস্ত-আনাড়ী মুখে ক্যাপস্টান আর খুকখুক কাশিতো ছিলই। মিছিলকারীরা হিন্দু না মুসলমান - এ নিয়ে কোন মন্তব্য কানে আসে নি কখনোও।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর এরকমই। মধুর সহাবস্থানের এটাই শেষ কথা। বর্তমানে কিছু ‘ভাবে সেক্যুলার’ অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, ধর্মকে বিশেষ করে ইসলামকে গালি দিয়ে। আদতে এরাও সাম্প্রদায়িক কোন না কোনভাবে। ধর্মভিত্তিক জাতি হবার কোন সুযোগ নেই দুনিয়াতে। তথাপি জাতিগত সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বলতে ধর্মকে টেনে এনে অজান্তেই সাম্প্রাদায়িক হয়ে যান, যা তাঁরা নিজেরাই জানেন না। এরা মানুষকে হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টানে ভাগ করে ফেলেন। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই কবেই বলে গেছেন, ’আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’
বাংলা ভাষায় অসাম্প্রদায়িক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে নজরুলের সমতুল্য আর কেই নেই বোধ হয়। তিনি অতি সত্য কথাটি লিখেছেন আক্ষেপে, ‘দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির-কলঙ্কিত হইয়া রহিল।’ তিনি ধর্মান্ধতা ছুড়ে ফেলে মানুষের কথা, মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যবাদী এ কবির দৃপ্ত ঘোষণা,
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলেছেন অনেকে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের ধর্মের পার্থক্য থাকে, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী।’ বড় সত্য কথা বাংলার গাঁও-গেরামের এ দৃশ্য। জাত-পাত ছেড়ে সকলকে এক কাতারে আসতে লালনও বলেছেন, ’ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি/ একি জলেই সব হয় গো সুচি/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাউকে ছাড়বে না।’ আসলেই, সবাইকে মরতে হবে। মৃত্যু কেমন সকলকে এক কাতারে এনে দেয় - ধনী-দরিদ্র সকলকে।
সম্প্রতি ভারতের গো-হত্যা নিয়ে চরম নৃশংসতা হচ্ছে। এ নিয়ে মমতা বন্ধোপাধ্যায় বলেছের এভাবে, ‘ছাগল-মুরগীতে দোষ নেই, যত দোষ গরু খেলে।’ এর চেয়ে সহজ করে আর বলা যায়? মানবতার জয়গান যে মানুষটি সবচেয়ে আন্তরিকতায় গেয়েছেন আজীবন তিনি মাদার তেরেসা, ‘যদি তুমি মানুষকে বিচার করতে যাও তাহলে ভালবাসার সময় পাবে না।’ সত্যিই তো! ভালবাসা বাদ দিয়ে বিচার করতে থাকলে জীবন শেষে ভান্ডারে কী থাকবে? তাইতো চন্ডীদাস সেই কবেই গেয়েছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
সম্প্রতি ফেসবুকে কে যেন লিখেছেন, ‘নামাজটা পড়ে এসেই মন্দির পাহাড়া দিব। দেখি কোন শালার মৌলবাদী আসে?’ আমাদের সোনার দেশটা এভাবেই থাকুক, এসব মানুষ দিয়েই ভরে উঠুক আবার। সাম্প্রদায়িকতার লকলকে বিষ-জিহ্বা চিরবিদায় নিক। হাজার বছরের শান্তি-সম্প্রীতি চির অম্লান থাকুক।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১১৪২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৯/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • লেখার বাহিরে গিয়ে একটা কথা বলি এবার আমি, লেখা নিয়ে মন্তব্য টা পরেই করবো। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বা আমরা অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি এটা হল সবচেয়ে বাজে কথা।

    এবার আসি কিছু থিমে। আমার সব সময় কেটেছে মুসলমান বন্ধুদের সাথে।ধরতে গেলে সারা জীবন। জীবনে ধর্মের কারনে তিক্ততা যেমন পেয়েছি তেমন করে বন্ধুত্বের কারনে পেয়েছি ভালোবাসা।

    আমারও অনেক অনেক মুসলমান বন্ধু ছিল । দেখা গেছে আমার মুসলমান বন্ধুরাই ভালো ছিল , আমাদের বাঁচাতে তারা অনেক কৌশল নিয়েছিল ১৯৯০ -৯১ এ ।

    তবে শত শত যুবককে আবার ঘরে আগুন দিতেও দেখেছি।
    নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আছে।
    হিন্দু হওয়ার কারনে এদেশ আমার দেশ না এটা এখনো শুনতে হয়। আবার আমার সেই মুসলমান বন্ধুদের কথা মনে হয় সত্যি সত্যি তাদের মত ছেলে থাকলে মৌলবাদী শক্তি কোনদিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।

    সব শেষে লেখাটা দারুন হয়েছে।
  • ‌‍ধ্রুবক ০৩/০৯/২০১৭
    মানুষ ধর্মের দাস হতে পারে না, যেগুলোকে আমরা ধর্ম বলছি সেগুলো আসলে ভিন্ন ভিন্ন মতামত। মানবধর্মই শ্রষ্ঠ আবার প্রত‍্যেকের নিজস্ব ধর্ম আছে। ভিন্ন মতামতের সহাবস্থান আমাদের আরও উন্নত মানুষ হতে সাহায্য করবে যেহেতু আমরা এখনও পুরোপুরি মানুষ নই।
  • মোনালিসা ০৩/০৯/২০১৭
    খুব ভাল হ্গ্য়েছে
  • সমির প্রামাণিক ০২/০৯/২০১৭
    বাহ! চমৎকার ভাবনায় ভাবিত। এত সুন্দর করে কথা বলেন আপনি। সত্যিই সুন্দর। আমাদের কাব্য ইতিহাসের প্রায় সবাইকে নিয়ে এসেছেন আপনার নিবন্ধটিতে। সম্প্রীতির এমন বাতাবরণে আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে থাকবো-পাশাপাশি। ধন্যবাদ।
 
Quantcast