www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাবা কতদিন দেখি না তোমায়

গল্প : বাবা কতদিন দেখি না তোমায়!
প্রফেসর সাহেব রিমলেস চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন।
বায়োকেমিস্ট ভদ্রলোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। ওখানেই শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে অধ্যাপকও হয়েছিলেন একসময়। অবশ্য হঠাৎ করে দেখলে ঠিক অধ্যাপক হিসেবে ভ্রম লাগে। লেকচারার বা অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে অনায়াসেই চালিয়ে দেয়া যাবে। ভীষণ মেধাবী ভদ্রলোক - স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনেকগুলো। শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি তাই দ্রুতই হয়েছিল। বাড়ন্ত পুই লতার মত তরতর করে একেবারে অধ্যাপক বনে গেছেন। মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ। অতি সজ্জন - বিনয়ের আধার যেন সব সময়। ভদ্র-ন¤্র স্বভাবের, উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি কখনো।
দেশ ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর। পরিবার নিয়ে কানাডার এডমন্টন শহরে থাকেন। দু’টি ছেলেমেয়ে সমেত সুখী সংসার রীতিমত - দশ পয়সার মুদ্রার উপরে থাকা ছবির মত। নিরিবিলি-নির্ঝঞ্ঝাট জীবন, বাঙ্গালী মহলে সরব উপস্থিতি তেমন একটা নেই। আপন সংসার নিয়েই জগৎ সীমাবদ্ধ। তবে ঘটনাপ্রবাহে বেশ ওয়াকিবহাল, তা দেশী-বিদেশী যে রকমই হোক না কেন। রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজ-সংসার, বিজ্ঞান, খেলাধুলা - সব বিষয়েই বিষম আগ্রহ, জ্ঞানও অবারিত। মতামত দেন ধীরে তবে সুচিন্তিত।
ঘটনাচক্রে আমরা সহকর্মী এখন। কাজ করি দু’জনে, ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। যশোর-কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক টানে কথা বলেন তিনি। তাই কানে শুদ্ধ বাংলাটা ইয়ান্নির পিয়ানোর মত বাজে যেন। শীতের বহমান নদী - কোনরকম তাড়াফাড়া নেই। কথোপকথনের জন্য ভদ্রলোক অবশ্যই সকলের আদর্শ। বলেন কম কিন্তু শোনেন ঢের বেশী। বড় বেমানান এ’যুগে। এখনকার নিয়ম হচ্ছে - সকলেই বলবে কিন্তু কেউ শুনবে না। অনেকটা ফেইসবুক ব্যবহারের মত; সকলেই লিখছে এবং আশা করছে অন্যরা পড়বে। অথচ কেউ কারোরটা পড়ছে না। আমার মত বাচালের জন্য খুবই উপযোগি শ্রোতা তিনি। সারাক্ষণই আবোল-তাবোল বকবক করি। আশ্চর্য! সবই মনোযোগ দিয়ে শোনেন ভদ্রলোক। সময়মত চড়েও বসেন আলোচনার ট্রেনে। তো এমন একজন মানুষের জীবন সম্বন্ধে জানার আগ্রহ হবে না?
‘একটা প্রশ্ন করি, ভাই?’ আমার আগ্রহ অকৃত্রিম।
‘অবশ্যই, কী প্রশ্ন?’ স্বভাবসুলভ মনোযোগ ভদ্রলোকের।
‘আপনার জীবনের একটা মজার ঘটনা বলেন যা এখনো মনে আছে। অর্থাৎ অনেক আগে ঘটেছিল কিন্তু ভুলতে পারেননি এখনো।’
একটু অবাক হলেন যেন। ‘কী ধরনের ঘটনা শুনতে চাচ্ছেন?’ অপ্রস্তুতও সামান্য।
‘এমন একটা ঘটনা যা অনেক অনেক আগে ঘটেছিল কিন্তু এখনো মনে আছে।’
‘অনেক ঘটনাইতো মনে আছে। কোনটা বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে, আমার জীবনের একটা সামান্য ঘটনা বলি। তখন চার কি পাঁচ বছর বয়স হবে। ঢাকার গোপীবাগে খালার বাসায় এসেছি বেড়াতে। একরাতে বিড়াল দেখে ভয়ে কী চিৎকার! আশ্চর্য, ঐ ঘটনা আজো মনে আছে।’
ভদ্রলোক হাসেন একটু। গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘না, এরকম না। আপনাকে একটা কষ্টের কথা বলি। বলতে পারেন - বাবা হারানো ছেলের কষ্ট।’
একটু হতোদ্যম হই যেন। মজা করতে চাইলাম একটু আর উনি কষ্ট নিয়ে আসলেন। ‘কষ্টের কথা শুনতে ভাল লাগে না ভাই। তারপরও আপনি যখন বলতে চাচ্ছেন, বলেন শুনি।’ নিস্পৃহ গলা আমার।
‘আমার ধারণা আপনার শুনতে ভাল লাগবে। এ’কষ্টের কথা সবাইকে বলি না। অবশ্য আপনি শুনতে না চাইলে বলব না।’ ভদ্রলোক একটু আহত হলেন মনে হল।
‘না না, কোন অসুবিধা নাই। আপনি বলেন, আমি শুনছি।’ আমি উৎসাহ দেখাই।
প্রফেসর সাহেব শুরু করেন, ‘আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে আম্মাই মানুষ করেছেন। জুট মিলে ছোটখাট একটা চাকরি করতেন। ঐ আয় দিয়েই পরম যত্নে সংসার সামলেছেন। ছোটছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে ছিল আম্মার সময়গুলো। তবে এর চেয়েও বেশী ছিল জেদ। আমাদেরকে মানুষ করার প্রবল আকাঙ্খা। করে দেখিয়েছেনও তা। আমরা ভাই-বোনগুলো শিক্ষিত-প্রতিষ্ঠিত এখন; এঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।’
‘কেন আপনার আব্বা? কী করতেন তিনি?’
অধ্যাপক সাহেব গম্ভীর হয়ে যান এরপর। কেমন দূর থেকে ভেসে আসে কথাগুলো, ‘আমার তখন সাত বছর হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে বেশ কয়েকমাস আগে। বয়স কম - তেমন কিছু মনে নেই যুদ্ধের। একাত্তর সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে হবে সে সময়টা। শীত আসি আসি করছে।’
‘আপনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন, তাই না?’
একটু অধৈর্য হন যেন, চোয়ালটা শক্ত হয়, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোন যুদ্ধ ছিল কি?’
লজ্জা পাই একটু, ‘দুঃখিত ভাই, আমি আসলে এমনি এমনি বলেছি। আপনি বলতে থাকেন।’
স্বাভাবিক হন মানুষটি, মাংশপেশী আবার আলগা করে দেন। ‘বুঝিনা তেমন কিছু তখন। আব্বা-আম্মা আলোচনা করেন, আমরা কান পেতে থাকি। কম ভলিউমে রেডিও শোনেন - দেশ-বিদেশের খবর। বড় কিছু হচ্ছে বুঝতে পারতাম।’
‘নভেম্বর মাসে কিছু কিছু জায়গা প্রায় স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল, তাই না?’
‘হ্যা, আব্বা তাই বলতেন আমাদের। আর কী যে খুশী হতেন!’
‘পরিবারে কে কে ছিল আপনার?’
‘আমরা দুই ভাই আর দুই বোন। সবার বড় আমি। ছোট বোনটি সবে বছর দেড়েক হবে তখন। আমার পরের ভাইটি স্কুল শুরু করেছে মাত্র। ছোটছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আব্বা-আম্মার রীতিমত হুলুস্থুল অবস্থা।’
‘আপনার আম্মার ব্যস্ততার বিষয়টা বেশ বুঝতে পারছি।’
‘কথাটা ঠিক বলেছেন। আব্বা তখন জুট মিলে চাকরি করেন। আমার আম্মাও পরে ঐ মিলে চাকরী করেছেন। মিলটি যশোর জেলার নওয়াপাড়া পার হয়ে ফুলতলা এলাকায়। বেশ বড় জুট মিল, অনেক লোকজন কাজ করে। সারাক্ষণই ব্যস্ততা মিলের ভিতরে। যুদ্ধের দামামায় কিছু মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে। তাই মিলে কর্মীসংকট। আব্বাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশী কাজ করতে হত।’
‘আপনাদের বাসাও কি নওয়াপাড়া ছিল?’
‘না, আমাদের জন্ম, বেড়ে উঠা সব যশোরে। পুরাতন যশোর বললে আরো নির্দিষ্ট হবে। এখনকার যশোরের উত্তর দিকের বর্ধিত আধুনিক অংশ তখন ছিল না। আমাদের বাসার কাছেই ছিল প্রধান শহুরে এলাকা। বাজার-ঘাট সব ওখানেই। বড় বাজারটা আমাদের বাসা থেকে হাঁটা-দুরত্বে। ওখানে কাঁচা বাজার, মুদি দোকান, চালের আড়ৎ, এমনকি সাইনবোর্ড লেখার দোকানও ছিল কয়েকটা। আরেকটা বিষয় এখানে বলে রাখা ভাল।’
‘কী বিষয়?’
‘আমরা যে পাড়ায় থাকতাম তা বিহারী পাড়ার অতি নিকটে। বলতে পারেন, বিহারীদের মাঝেই আমাদের বসবাস ছিল। তবে ওদের কারও কারও সাথে আমাদের সম্পর্ক ভাল ছিল।’
‘বলেন কী? মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে এসেও বিহারীদের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকাতো কঠিন! ’
‘কঠিনতো ছিলই। তবে ওদের মধ্যেও ভাল মানুষ ছিল অনেকে। কারো কারো সাথে প্রায় আত্মীয়তার মত সম্পর্ক ছিল। আশ্চর্য কি জানেন - ওদের কেউ কেউ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাক এটাও মনে প্রাণে চাইত। আসলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক দুস্কর্ম দেখে বিরক্ত হয়েছিল বোধ হয়। এদিকে বিহারী পাড়ায় থাকায় একটা সুবিধা আমাদের ছিল - ওখানে পাক হানাদাররা খুব একটা আসেনি।’  
‘বুঝতে পারছি। আপনার আব্বা কি প্রতিদিন ফুলতলা আসা-যাওয়া করতেন?’
‘হ্যা। আব্বা ভোর সকালে বের হতেন, ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা খেয়ে। সে’সময় যোগাযোগ ব্যবস্থাতো আর এত আধুনিক ছিল না। ঘন্টা দুয়েকের বেশী লেগে যেত অফিসে পৌঁছুতে। আবার ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যা পার হয়ে রাত ছুঁই ছুঁই।’
‘আহারে! ভদ্রলোক বেশ কষ্ট করেছেন।’
‘প্রতিদিন একই রুটিন। এদিকে আম্মার সারাদিন মহাব্যস্ততা। ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো - আম্মার ফুরসৎ ছিল না তেমন।’
‘বন্ধের দিনগুলো কেমন ছিল আপনাদের?’
‘বন্ধ বলতে ঐ রবিরার। তাও আবার মাঝে মাঝে রবিবারেও অফিসে যেতে হত আব্বাকে। যাহোক, রবিবার আসলেই আমাদের আতংক পেয়ে বসত। অবশ্য, আতংক শুধুমাত্র সকালের দিকেই ছিল। বইখাতা নিয়ে আব্বার সামনে বসতে হত এ’সময়। পড়ানোর পাশাপাশি দু’চার ঘা নিয়মিত ছিল। তবে এরপর আব্বা অন্যরকম মানুষ।’
‘কী রকম?’
‘পুরোদুস্তর সংসারী বলতে পারেন। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে যা যা করার নির্বিঘ্নে করে যেতেন। রবিবার ছিল বাজার করার দিন। রান্নাবান্না, ভাল খাওয়ারও দিন। সে সময় যুদ্ধের কারণে বেড়াতে যাওয়া হোত না খুব একটা। তারপরেও একদিনের কথা বেশ মনে আছে।’
‘কী করলেন সেদিন?’
‘আব্বার সেকি উৎসাহ! যুদ্ধ পরিস্থিতি একটু ভাল তখন। সবাই মিলে বেড়াতে যাব সেদিন, কপোতাক্ষের পাড়ে। পরিবহন বলতে তখন রিক্সাভ্যান - সবাই চেপে বসেছি। আব্বা অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন - একে ওকে বকাও দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে গুনগুন করছেন দু’এক ছত্র। আহারে! স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে এখন।’
প্রফেসর সাহেব আবার চশমা খুললেন, চোখ মুছতে হবে তাই। ‘বেড়ানো নিশ্চয় উপভোগ্য ছিল সেদিন?’ আমি আনন্দের ভঙ্গি করি।
‘না, উপভোগ্য হয় নি।’ প্রফেসর সাহেব মন খারাপ করেন।
‘কেন, কেন হয়নি?’
‘যুদ্ধের দিনগুলো এরকমই ছিল। হঠাৎ হঠাৎ পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেত। আমরা কিছুদূর গিয়েছি। এরিমধ্যে কোত্থেকে বিকট শব্দ! বোমাটোমা পড়েছে কাছে কোথাও। চিৎকার-হট্টগোল চারিদিকে। এরমধ্যে কে বেড়াতে যায়, বলুন? বাসায় ফিরে আসি আমরা।’
‘আহারে! বাচ্চা মনে কী কষ্ট!’
‘আর বলবেন না। তবে এবার আসল কষ্টের কথা বলি। এ’কষ্টের কাছে অন্যগুলো পুরোপুরি ম্লান। সেদিনও রবিবার ছিল। আমাদের পঠন-আতংক সবে শেষ হয়েছে। আম্মা আব্বাকে বলছেন, ছোট বোনটার জন্য দুধ আনতে।’
‘ওর তখন দেড় বছর বয়স, তাই না?’
‘বাহ! মনে রেখেছেন দেখছি। যাহোক, আব্বা বের হয়েছেন। সাথে আব্বার এক বন্ধু ছিল। ঐ বন্ধুর কাছ থেকেই পরে সব শুনেছি আমরা।’
‘কী হয়েছিল?’
‘আব্বা বাজারের খালই আর দুধের জগ নিয়ে মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে বসেছেন। খালই চেনেন তো?’ ভদ্রলোক আমার দিকে তাকায়।
‘চিনব না কেন? বাঁশ দিয়ে বানানো ঝুড়ির মত।’ আমি সবজান্তার ভঙ্গি করি।
‘ঠিক ধরেছেন। চা শেষ করে প্রথমে কাঁচা বাজারে যান আব্বারা। সেখান থেকে বের হয়ে দুধ কিনে বাসায় আসবেন। পথিমধ্যে মুদি দোকানগুলো পার হয়ে কয়েকটা সাইনবোর্ড লেখার দোকান।’
ভদ্রলোক থামেন একটু। আমি তাড়া দেই, ‘তারপর?’
‘সাইনবোর্ডের দোকানের পাশ দিয়ে দু’জনে হেঁটে যাচ্ছেন, আব্বা আর তাঁর বন্ধু। যুদ্ধের বাজার, লোকজন তেমন একটা নেই - চারিদিক ফাঁকা ফাঁকা। শীতের শুরুতে বৃষ্টি না থাকায় শুকনো খটখটে সবকিছু। বাতাসে রাজ্যের ধূলা উড়ছে। পৌষের সকালের হালকা রোদ, তেজ তেমন একটা নেই। কয়েকটি দাঁড়কাক সদ্যই কেঁটে ফেলা একটি গরুর নাড়ি নিয়ে টানাটানি করছে। হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে কোত্থেকে একটা কুকুর এসে কাক তাড়িয়ে নাড়িটা নিয়ে চলে যায়। রাস্তার ঐ পাশে একটা চায়ের দোকান। কয়েকজন বসে চা-সিঙাড়া খাচ্ছে আর গল্প করছে। দু’এক জন বিহারীও আছে ওদের মধ্যে। রাস্তা দিয়ে টুংটাং করে বেল বাজিয়ে রিক্সা যাচ্ছে। তবে সংখ্যায় বেশী না, দু’চারটা।’
‘সাইনবোর্ডের দোকানের কথা বলছিলেন অনেকবার। নিশ্চয় এর মধ্যে কোন কিন্তু আছে?’
‘হ্যা, সাইনবোর্ডের দোকান। ওখানেই যে সব শেষ হল!’ ভদ্রলোকের দীর্ঘশ্বাস। চশমা খুলেন আবার।
আমি দুঃখিত হবার চেষ্টা করি, ‘শেষ হল মানে?’
‘আব্বা বন্ধুসমেত ঐ সাইনবোর্ডের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখে পরে, সাইনবোর্ড শুধু উর্দুতে লেখা হচ্ছে। ছোটছোট ছেলেমেয়ে রেখে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি বিধায় আব্বার মনে একটা কষ্ট সব সময়ই ছিল। মাঝে মাঝে বলতেনও আক্ষেপ করে। বিহারী পাড়ার কাছে বাসা হওয়ায় পাক সেনাদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে নিরাপদে ছিলাম আমরা। এ সুযোগে আব্বা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে বাসায় নিয়ে আসতেন। ভালমন্দ খাইয়ে দিতেন। পরিস্থিতি একটু ভাল হলে তারা চলেও যেতেন।’
‘সাইনবোর্ডের কী হল?’
‘ওহ! সাইনবোর্ড। তখনকার নিয়ম ছিল - সাইনবোর্ড আগে বাংলায় লিখতে হবে। এরপর উর্দুতে লেখা যাবে। তাই শুধু উর্দু লেখা দেখে আব্বার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। তিনি সোজা দোকানের সামনে চলে যান। চিৎকার করে বলেন, এই সাইনবোর্ড কার? কিন্তু আশেপাশের লোকজন চুপচাপ, তেমন একটা সাড়া নেই। কেউ আসেও না কাছে। চায়ের দোকানের হট্টগোল থেমে যায়। আর্টিস্টও কিছু বলতে পারে না।’
‘আপনার আব্বার সাহস আছে মনে হচ্ছে।’
‘হ্যা, আব্বার বেজায় সাহস। বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে উনি নিজের হাতে রঙতুলি নিয়ে সাইনবোর্ডের উর্দু লেখা মুছতে থাকেন। আর গজড়াতে থাকেন, এত বড় সাহস। আমার দেশে বসে আমার ভাষার অপমান।’ ইতোমধ্যে বিহারীপাড়ায় খবর চলে যায়।
‘বলেন কী? এরপর?’
‘লাঠিসোটা হাতে একদল বিহারী মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির। আব্বা ততক্ষণে সব সাইনবোর্ড নষ্ট করে ফেলেছেন। এদিকে আব্বার বন্ধু পরিস্থিতি ভয়ংকর দেখে চট করে একপাশে সরে পড়েন।’
‘কী করল বিহারীগুলো?’
‘এক দঙ্গল লাঠিসোটা দেখে আশেপাশের দোকানগুলো আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চায়ের দোকানটা মুহূর্তেই খালি। চারিদিক সুনসান নীরবতা। কেউ কিছু বলল না, কোন বাঁধা আসল না। ওরা আব্বাকে উঠিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। ’
‘চলে গেল মানে, কোথায় গেল?’
‘আমরা বাসায় বসে আছি। দুপুর পার হয়ে যায়। আব্বা আসে না। কোন খবরও নেই। দুশ্চিন্তা পার হয়ে আস্তে আস্তে ভয় করা শুরু হল আমাদের। সন্ধ্যার কিছু আগে আব্বার সেই বন্ধু এসে হাজির। আব্বা এখনও বাসায় আসেনি শুনে সব খুলে বললেন।’ প্রফেসর সাহেবের গলা ভারী হয়ে আসছে।
‘আপনার আব্বার বন্ধু এত পরে আসলেন কেন?’
‘উনি ভয় পেয়েছিলেন। যদি আমাদের বাসায় আসার পথে ধরে নিয়ে যায়। যাহোক, খবর পেয়েই আম্মা পুলিশের কাছে ছুটলেন। জুটমিলে যোগাযোগ করা হল এরপর। কোথাও কোন খবর নেই। কেউ বলতে পারে না - আব্বা কোথায়।’
‘কেউ না?’ আমার বিস্ময়।
‘না, সারা যশোর আম্মা চষে বেড়িয়েছেন। বিহারী পাড়ায় ঢুকে প্রত্যেকটা বাড়িতে গিয়েছেন। কেউ বলতে পারে নি। মানুষটা যেন হঠাৎ করে নাই হয়ে গেলেন। হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া যেন। দুঃখটা কি জানেন, আব্বাকে মেরে ফেলা হয়েছে কিনা তাও জানি না আমরা। আব্বার লাশও ফেরত পাই নি কোনদিন, আজও না। ভাবেন, কতটা আশা করে দিন পার করেছি আমরা ভাইবোন, আমাদের আম্মা - বছরের পর বছর। বোধ করি এখনও আছি।’ ভদ্রলোকের গলা ধরে আসে। ‘জেমসের বাবা গানটা যখন শুনলাম মনে হল আরে এত আমার কথাই বলছে।’
সব সময় কানে বাজে, ‘বাবা কতদিন দেখি না তোমায়।’
ভদ্রলোকের প্রফেসরসুলভ গাম্ভীর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এবার সত্যিই কেঁদে ফেলেন তিনি। ফুঁপিয়ে না, বেশ শব্দ করেই। বাচ্চাদের মত কান্না। পুরু লেন্সের চশমাটা হাতে ধরা। আমি গভীর মমতায় ভদ্রলোকের পিঠে একটা হাত রাখি। ডেস্ক থেকে টিস্যুর প্যাকেটটা এগিয়ে দেই চোখ মুছতে। এর বেশী কীইবা করতে পারি?
কিছু বলার ভাষা আমার নেই এখন। ছেলের কষ্টে আমি বাকরুদ্ধ। বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি শুধু, ক্রন্দনরত মুখের দিকে। পয়তাল্লিশ বছর ধরে একটা কষ্ট বুকে লালন করে আছেন মানুষটি - বাবা হারানোর কষ্ট। ছোট্ট মনের সেই বাবা হারানোর কষ্ট ভোঁতা শেলের মত বিঁধে প্রতিনিয়ত নিশ্চয়। ভদ্রলোককে দেখতে এখন সেই সাত বছরের শিশুটিই মনে হচ্ছে। যেদিন তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন, ঠিক সেই দিনের মত। সেদিনও নিশ্চয় এরকম করে বা এর চেয়ে বেশীই কেঁদেছিলেন। কান্নার দমকে যেন সেই সুরটিই বাজছে - ‘বাবা কতদিন দেখিনা তোমায়’! একাত্তরে পাক-হানাদারের পাশাপাশি এই বিহারীদের অনেক অত্যাচার-নিপিড়নের কথা শুনেছি। আজ এরকমই এক দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হলাম। রাগে-ঘৃনায় মনটা কেমন তেতো হয়ে গেল। ভদ্রলোকের দুঃখের বোঝা লাঘবে কোন সাহায্য না করতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কষ্টের একটা স্রোত আমার স্নায়ু বেয়েও খেলতে শুরু করে। মজা হিসেবে শুরু করা দৃশ্যটা কেমন দুঃখের পাথরে বেশ ভারী হয়ে গেল। দুঃখের একটা বড় কারণ বছরের পর বছর তিনি এ কষ্টটা লালন করছেন। ভদ্রলোক আমৃত্যু এ কষ্টটা বহন করবেন। নিশ্চয় পাষাণ হয়ে গেছেন এতদিনে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, কতটা ক্ষরণ হলে হৃদয় হয় শ্মশান তা বুঝি ভদ্রলোকের পাষাণ হৃদয়ই জানে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ফয়জুল মহী ০৫/০৯/২০১৭
    অপূর্ব শব্দের অনন্য ব্যবহার
  • শব্দের জাল যেভাবে বিস্তার করেছেন তাতে মুগ্ধতা রয়েছে।
  • মোনালিসা ০৩/০৯/২০১৭
    খুব ভাল
  • মোনালিসা ০১/০৯/২০১৭
    সঠিক
  • MONALISA ০১/০৯/২০১৭
    খুব ভাল গল্প
  • সমির প্রামাণিক ৩১/০৮/২০১৭
    চমৎকার! অতি সুন্দর। বৈঠকি গল্প বলার মেজাজ পাওয়া গেলো আপনার লেখনীতে। আবারও বলি চমৎকার। শেষটা অপূর্ব। শুভেচ্ছা রইলো।
 
Quantcast