www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তোয়ালের ফুল

গল্প : তোয়ালের ফুল
‘এটা কি কোন মনুষ্য প্রজাতির, না তার পূর্বেরটার আবাস?’ তিথির চোখে বিস্ময়।
তমাল অসহায় চোখে তাকায়। আমতা আমতা করে, ‘কী বলছ, ঠিক বুঝতে পারছি না?’
‘বলি, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব যে সঠিক তা তুমি প্রমাণ করে দেখালে।’
‘আমি? কীভাবে?’
‘তোমার শরীরে যে পূর্বপুরুষ বানরের জিন আছে তার চমৎকার প্রমাণ এই অতি অগোছালো নোংরা বাসা।’ তিথি যথারীতি নির্দ্বিধায় বলে ফেলে। মেয়েটি এ রকমই। সত্যি কথা বলতে একটুও বাঁধে না।
‘একটু অগোছালো ঠিক আছে। তাই বলে আমাকে বানর বলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু।’ তমাল ক্ষীণ স্বরে অভিযোগ করে।
‘দেখি, তুমি সরো এখন। বের হও এখান থেকে। আমি দরজা বন্ধ করব।’ তিথি ঠেলা দেয় তমালকে।
‘মানে? কী বলছ তুমি? কোথায় সরব?’ তমাল অবাক এবার।
‘হ্যা, ঠিকই বলছি। তুমি পনের মিনিট বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি ঘরটা গুছিয়ে তোমাকে ডাকব।’
‘কেন? আমি ভিতরেই থাকি। তোমাকে সাহায্য করি।’ তমাল আবারো দূর্বল স্বরে বলার চেষ্টা করে।
তিথির ঝামটা, ‘আহা! বাবুর শখ হয়েছে ধুলা খাওয়ার। যাও বলছি, বেরোও।’ দড়াম করে তমালের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। আর ভিতর থেকে গজরাতে থাকে সমানে, ‘গোয়ালঘর বানিয়ে রেখেছে যেন। বনের পশুও এর চেয়ে গোছানো থাকে।’
তমাল বাইরে সিঁড়ির একটা ধাপে গিয়ে বসে। ধীরে ধীরে ভাবনার রাজ্যে তলিয়ে যায়। তিন তলায় ওর অ্যাপার্টমেন্ট। ছোট্ট এক বেডরুমের, একাই থাকে। মাস তিনেক হল এখানে এসে উঠেছে। একটা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় পরামর্শকের কাজ, বেতন বেশ ভাল। এক বছরের চুক্তি। নবায়নের সুযোগ আছে। কাজের চাপ আছে তবে পরামর্শক বিধায় অনেকটা স্বাধীন। নিজের মনেই কাজ করে, কেউ ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নেই।
কক্সবাজার শহরের কলাতলী ভিউপয়েন্ট থেকে মাইল দুয়েক উত্তর-পশ্চিমে গেলে উত্তরণ সমবায় সমিতি আবাসিক এলাকা। ওখানকার একটা চারতলা ভবনের তিনতলায় থাকে তমাল। এলাকাটা বেশ নিরিবিলি - সৈকতের ভিড় আর কোলাহলমুক্ত। গাছপালা ঘেরা ছায়া সুনিবিড় চারিদিক। সামান্য একটু হেঁটে গেলেই ছোট্ট কিন্তু নয়নাভিরাম খলিফা ওমর জামে মসজিদ। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যায়, গর্জনও শোনা যায় নিজের মত করে। প্রায় বিকেলেই অফিস শেষে হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে চলে যায় তমাল। বসে বসে সূর্যাস্ত দেখে, গুনগুন করে গায় দু’য়েক গানের প্রিয় কিছু কলি। অনেকটা রুটিন হয়ে গেছে যেন।
একা থাকার কিছু সুবিধা আছে, তমাল টের পায়। নিজের মত করে ভাবা যায়। জীবনের পাওয়া না পাওয়া, পিছন ফিরে দেখা যায়। শখ ছিল প্যারিসের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটবে আর হেড়ে গলায় বাংলা গান ধরবে। অথবা নিউ ইয়র্কের টাইমস্ স্কোয়ারে বসে ঝালমুড়ি খাবে। অদ্ভুত সব শখ ওর। আমাজনের গহীন জঙ্গলে উলঙ্গ হয়ে হাঁটতে ইচ্ছেও করে। সেদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গেছে। ভরা জ্যোৎস্না ছিল, মায়াময় চারিধার। বের হয়ে গেছে তমাল, সৈকতে হাঁটবে। অসম্ভব ভাললাগার অনুভূতি, ব্যাখ্যার অতীত।
এ সময়টা নির্জন সৈকতে বসে তিথিকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে। ছিপছিপে গড়নের শ্যামলামত মেয়েটি কেমন করে যেন ওর মানসপটে ঢুকে আছে অনেকদিন, অনেক বছর। বের করতে চায় তমাল, কিন্তু পারে না। চায়ও না মনে হয়। মোটকথা, একটা তিথি-মায়াজালে আটকে আছে তমাল। ভালবাসে কিনা তাও জানে না। কিন্তু চীনের প্রাচীরের মত দৃঢ় উপস্থিতি তমালের হৃদয়ে। ঘুন পোকার মত সারাক্ষণ কুরে কুরে খাচ্ছে ওর স্নায়ুস্কোষগুলো। একসময় কি নিউরনশূন্য হয়ে যাবে ও? এইযে নির্জন সৈকতে বসে আছে। বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। বড় বড় ঢেউগুলি সৈকতে আছড়ে পড়ছে। তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সমুদ্র বা সূর্যাস্ত কিছুই দেখছে না গভীর মনোযোগে। সবকিছুর মাঝেই তিথির সুন্দর মুখটি ভেসে উঠছে।
প্রিয় তিথি আজ কক্সবাজারে এসেছে, তমালের কাছে। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারের ফ্লাইট ধরেছে। সকাল দশটা এখন, মাত্রই বিমান নেমেছে। বিকাল চারটায় ফিরতি ফ্লাইট। চলে যাবে আজই। মাঝখানে কয়েক ঘন্টামাত্র সময়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে প্রথম কথাটা তিথিই বলে, ‘তোমার বাসায় কিচেন আছে?’
‘আছে। কিন্তু কেন?’ তমাল অবাক।
‘গুড। এবার বল, তোমাদের এখানে কাঁচা বাজারটা কোনদিকে? সোজা সেখানে চলে যাও।’
তমাল আবারো অবাক, ‘বাজারের খোঁজ করছ কেন? ওখানে গিয়ে কী করবে?’ কাঁচা বাজারে কখনও যায় নি তমাল। তাই নিজেও জানে না কোনদিকে।
‘সেটা দিয়ে তোমার দরকার কী? বুঝেছি, জীবনেও বাজারে যাওনি, আর এখানে বাজার কী ভাবে চিনবে। ড্রাইভার সাহেব, আপনি কাঁচা বাজারটা চিনেন? ওখানে নিয়ে যান আমাদের।’ তিথির কণ্ঠে কৌতুকের ছোঁয়া।
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি বাজারে যেতে চাচ্ছ কেন? তাও আবার কাঁচা বাজারে?’
‘তোমাকে আমি বুঝতে বলেছি? তুমি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাক। কোন কথা বলবে না, চোখের পলকও ফেলবে না। যেভাবে আমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাক ঠিক সেভাবে। তোমার বিষ্মিত দৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।’ তিথি আবেগে থরথর করে কাঁপছে।
‘দেখ, আমি মারমেইড ক্যাফেতে রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছি। ওখানে কফি খাব এখন, সাথে তুমি কিছু নাস্তা করে নিতে পার। এত দূর থেকে এসেছ। ক্যাফেটা কিন্তু চমৎকার! চারিদিক খোলা - উপরে বাঁশ আর খড়ের চালা।’ তমাল ইতস্তত করে বলে।
‘রাখ তোমার মারমেইড না ফারমেইড। ওসব বাদ। একা থাক, বাজার নেই নিশ্চয়। তাই এখন বাজার করব। তারপর তোমার বাসায় যেয়ে রান্না করব। নিজের হাতে খাওয়াব। এরপর অন্যকিছু, এখন চুপটি করে আমার হাত ধরে বসে থাক।’
এতক্ষণে তমালের কাছে পরিস্কার হয় সব। তবুও একটু বলার চেষ্টা করে দূর্বল স্বরে, ‘এখানে কী যেন একটা রেস্টুরেন্ট আছে জ্যান্ত মাছ রেঁধে দেয়, দুপুরে ওখানে খাবার ব্যবস্থা ...’ তিথির অগ্নিদৃষ্টির সামনে কথা মুখেই আটকে যায়।
ইতোমধ্যে গাড়ি বাজারে চলে এসেছে। তমাল এদিকটাতে কখনো আসে নি। সবকিছু অপরিচিত। ‘আরে নামো গাড়ি থেকে?’ তিথির তাড়া।
তমাল বিষ্মিত হয়ে দেখে তিথি রীতিমত দামাদামি করে আলু কিনছে। ডাল কিনল, ডিম কিনল, উচ্ছে, টমেটো, শশাও কিনল। এরপর বড় দেখে একটা ইলিশ। সবকিছু ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলে, ‘গাড়িতে নিয়ে যান।’
‘তোমাকে কে রান্না করে খাওয়ায়? হোটেলে নিশ্চয় খাও না তুমি।’
‘একটা ছুটা বুয়া আছে। সকালে রান্না করে। ঐ সারাদিন খাই।’
‘গুড। বুয়া যেহেতু রান্না করে, তেল-মসলা নিশ্চয় আছে। আর চালও। তাই এগুলো কিনলাম না।’ আপন মনে বলে যাচ্ছে তিথি।
তমাল আবারো কিছু বলে না। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। বাসায় পৌঁছে গেছে ওরা।
’এগুলি ধর। ড্রাইভার সাহেব, আপনাকে আসতে হবে না।‘ তিথির কথায় এখনো সেই আহ্লাদ।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজা মাত্র খুলেছে তমাল, তিথির বিস্ময় চরমে। এরপরই তমালকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কী করছে কে জানে? ঝাড়–র শব্দ আসছে ভিতর থেকে - সপাং সপাং। গানের গুনগুন কি শুনছে না তমাল? হ্যা, ঐ তো। কান খাড়া করে ও। মেয়েটির গানের গলা আছে বেশ। ওহ! সিঁড়িতে বসে থাকতে থাকতে পা জমে গেল।
আচমকাই দরজা খুলে যায়। তমাল থমকে যায়। নীল রঙের শাড়িটা কোমরে পেঁচানো। হাতে একটা শলার ঝাড়–, কোত্থেকে পেয়েছে কে জানে। এই জিনিস বাসায় ছিল নাকি! হাঁচি-কাশিতে ভরে নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে জল ঝরছে একটু একটু। এ মুর্তি তমালের অচেনা। বুভুক্ষুর মত তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর কেন মেয়েটি!
‘আসেন, নোংরাবাবু ভিতরে আসেন।’ কৌতুক তিথির কণ্ঠে।
ভিতরে ঢুকে তমাল হকচকিয়ে গেছে রীতিমত। এমন না যে নতুন কিছু নিয়ে এসেছে মেয়েটি। যা ছিল তাই শুধু এদিক ওদিক করে রেখেছে। কিন্তু স্বর্গ হয়ে গেছে যেন বাসাটি। মেয়েটি জাদু-টাদু কিছু জানে বোধ হয়। না, তা হবে কেন? আসলে মেয়েটির মধ্যে ক্রিয়েটিভ আর্টস গিজ গিজ করছে নিশ্চিত। শয়ন কক্ষে ঢুকে চক্ষু ছানাবড়া। না ছানাবড়া না, চক্ষু আসলে প্রমাণ সাইজের রসগোল্লা। বিস্ময় মগডালের পাতার আগায় যেন। বিছানার উপর একটা ফুল বিছানো। কী ফুল, তার নাম জানেনা ও। কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। অবাক করা বিষয় হচ্ছে ফুলটি বানানো হয়েছে বাথরুমের নীল তোয়ালে দিয়ে। কৃত্রিম তোয়ালের ফুল - এত সুন্দর হতে পারে! সাদা চাদরের উপর নীল ফুলটি যেন দীঘির জলে ফোঁটা গোটা একটা পদ্ম। আহ! তিথির বানানো নীল তোয়ালের ফুল।
‘কী, কেমন লাগছে?’ তিথির কণ্ঠে গর্ব।
‘তুমি না একটা জিনিয়াস। এই ফুল বানানো কোথায় শিখেছো?’
‘কোথাও না। হঠাৎ মনে হল, বানিয়ে ফেললাম।’
‘বল কী? হঠাৎ করে এ জিনিস বানানো যায়? আমিতো এক বছরেও পারব না।’
‘তোমাকে এটা পারতে হবে কেন? সবাই সব কিছু পারে? তুমি যে এত সুন্দর করে চিঠি লেখ আমাকে, আমি কি তা পারি?’ তিথির কণ্ঠে আবেগ।
‘চিঠি লেখা কোন কঠিন কাজ না।’
‘শোনেন, বাসা গুছিয়ে দিলাম। এরকম যেন থাকে। আবার এসে যদি দেখি গোয়াল ঘর বানিয়ে রেখেছো, একেবারে বের করে দিব।’
‘তারমানে তুমি আবার আসবে? সত্যি বলছ তো?’ তমাল উৎসাহিত।
‘সে পরে দেখা যাবে। এখন সর, রান্না করতে হবে। সময় বেশী নেই। তুমি এক কাজ কর, চেয়ারটা নিয়ে এই যে এখানে দরজার কাছে বস।’
রান্না ঘরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন। নীল শাড়িটা এখনো কোমরে পেঁচানো। চুলের গোছা মাথার পেছনে ক্লিপ দিয়ে বেঁধে রাখা। কপাল বিন্দু বিন্দু ঘামছেও। নিপুন হাতে কাটাকাটি শেষ করে ফেলেছে। ‘শোন, তোমার পছন্দের খাবার আমি জানি। আজকের মেনু কী বলতো?’ তিথি জিজ্ঞাসা করে।
‘আমি কী করে বলব? তবে বাজার যা করেছ, তাতে আলুর কিছু একটা হবে। সাথে ডাল, ডিমভাজি আর ইলিশ মাছ। ঠিক বলিনি?’ তমাল আগ্রহে বলে।
‘বাহ! তোমারতো বুদ্ধি আছে দেখছি! আমিতো ভেবেছিলাম, তুমি একটা জড় পদার্থ।’ তিথি হাসে।
‘ধন্যবাদ, প্রশংসার জন্য।’
‘আচ্ছা, আমি বলছি শোন। আজকের মেনু - ভাত, পাতলা ডাল, উচ্ছে ভাজি, আলু ভর্তা, ডিম ভাজা, ইলিশ কড়া ভাজা এবং ধনে পাতা ভর্তা। আর সালাদতো হবেই।’
‘একটা অনুরোধ আছে ম্যাডাম।’
‘কী?’
‘ডিম ভাজাটা কিন্তু কাঁচা কাঁচা হতে হবে।’
‘আপনাকে বলতে হবে না। আমি জানি। এবার বল, তোমার ঐ মারমেইড না কী যেন নাম রেস্টুরেন্টের থেকে এ খাবার কি খারাপ হবে?’
‘কী যে বল না! এর তুলনীয় আর কিছু আছে? স্বর্গে এই খাবার থাকবে না বলে ওখানে যেতে ইচ্ছে করে না একটুও। আমার কিন্তু তর সইছে না।’
‘চুপ, সময় লাগবে আরো। তুমি বস আমি চা নিয়ে আসছি। চা খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘দেখছো, একমাত্র তুমিই জান কোন কাজটা কখন করতে হয়। আমার চা’য়ে কিন্তু দুধ-চিনি থাকবে।’
‘আবার কথা বলে! আমি জানি তো।’ তিথির কণ্ঠে ঝাঁজ। চায়ের কাপ দু’টি টেবিলে রেখে তাড়া দেয়, ‘তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নাও, আমরা বের হব।’
তমাল আবারো অবাক, ‘বের হব মানে?’
‘বের হব মানে, বের হব।’
‘তোমার রান্না?’
‘রান্না প্রায় শেষ। ভাত চড়িয়ে দিয়েছি রাইস কুকারে। শেষ হতে আধা ঘন্টার বেশী লাগবে। এই ফাঁকে চল আমরা বেরিয়ে আসি।’
‘কোথায় যাব?’
‘আরে উল্লুক! কক্সবাজারে এসে কেউ ঘরে বসে থাকে? সৈকতের ধারে নিয়ে যাবে, হাত ধরে হাঁটবে। মিষ্টি কিছু কথা বলবে, ভালবাসার কথা। গুনগুনিয়ে গাইবে প্রিয় কিছু গান। ওঠতো।’
সৈকত ধরেই হাঁটছে ওরা। পর্যটনের সময় নয় এখন, ভীড় অনেক কম। তাও আবার মধ্য দুপুর। সৈকতে আসার ব্যস্ত সময় এখন না। যথারীতি বাতাস বইছে শোঁ শোঁ। পারফিউমের সাথে তেল-মসলার গন্ধ মিলিয়ে অদ্ভুত ভাললাগার সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে তিথি। খোলা আঁচল বাতাসে উড়ছে, সাথে খোলা চুলগুলোও। স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। পরীদের মত লাগছে ওকে।
‘এই, একটা গান কর না?’ তিথির কণ্ঠে আবেগ।
‘আমি! কী যে বল না। তুমি শিল্পী মানুষ, তুমিই বরং গাও।’
‘সব সময় তো আমিই গাই। আজকে তুমি।’
‘যে যা পারে সে তাই করবে, নাকি?’
তিথি সুর তোলে, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে...’
‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’ তিথি তাকায় তমালের দিকে।
‘বল।’
‘তুমি কি আমাকে ভালবেসে ফেলেছো। এবং আমি।’ তিথি অস্ফুট স্বরে বলে।
তমাল কিছু বলে না। থমকে যায় যেন। গম্ভীর হয়ে ভাবতে থাকে।
‘কী, উত্তর দিলে না?’ তিথি আবার জিজ্ঞেস করে।
তমাল কেঁপে উঠে সহসা। কী জবাব দিবে এ প্রশ্নের? জড়িয়ে যায় কথা। গলা একটু পরিস্কার করে বলে, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নিজেকেই প্রশ্ন কর আগে?’
তিথি মাথা নীচু করে বালুর দিকে তাকায়। চোখ ভিজে আসে। মৃদু স্বরে বলে, ‘আজও বললে না। এভাবে আর কত কষ্ট দিবে আমাকে।’
‘আমিতো তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি না।’
‘ভাত হয়ে গেছে। চল বাসায় চল। ইলিশ মাছ ভাজতে হবে।’ কাঁদ স্বরে বলে তিথি।
বাসায় এসে অন্য মানুষ যেন মেয়েটি। নিজ হাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। আরেকটু খাও, আরেকটু খাও বলে ছেলেমানুষী করছে। নিজে অবশ্য তেমন একটা খাচ্ছে না।
‘রান্নাটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। এত আরাম করে আমি অনেকদিন খাইনি।’ আন্তরিক স্বরে বলে তমাল।
‘ভাল না কচু।’ তিথি মুচকি হাসে।
‘আমার কতদিনের ইচ্ছা ছিল তোমার হাতের রান্না খাব। ভাবিনি এ জনমে এটা সম্ভব হবে। বিধাতা সে ইচ্ছা পূরণ করেছেন।’ তমাল আবেগে বলে।
‘হয়েছে হয়েছে, আর আবেগ করতে হবে না। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেল। চল এয়ারপোর্টে যাই।’
অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। খুব তাড়াতাড়িই চেকইন হয়ে যায়। সিকিউরিটি গেটের দিকে এগিয়ে যায় ওরা। শেষ বিদায়ের জন্য হাত তুলে তিথি।
‘একি তোমার হাতে কীসের দাগ?’ তমাল কৌতুহূলে তাকায়।
‘কিছু না।’ তিথি মৃদু স্বরে বলে।
‘দাঁড়াও, দেখি কী ওখানে।’ তমাল দৃঢ় হয়।
‘বললামতো কিছু না। তুমি যাও।’
তমাল চট করে তিথির হাত ধরে ফেলে। সদ্য হওয়া একটা পোড়া দাগ। ‘কখন, কখন পুড়ল?’ তমাল উদ্বেগে বলে।
‘জানি না কখন হল। ও কিছু না, সেরে যাবে।’ তিথি নিরুৎসাহে বলে।
‘এ হতে পারে না। তুমি জান কখন হয়েছে। না বললে তোমাকে ছাড়ছি না।’ তমাল জেদ করে।
‘সারা জীবন ধরে রাখতে পারবে, এই হাত?’ তিথি চোখ বড় করে।
তমাল অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না।
‘আচ্ছা শোন, দাগটা আমি ইচ্ছে করে দিয়েছি। রান্না করার সময় তোমার খুন্তি গরম করে দাগটা দিয়েছি।’ তিথি স্বাভাবিকভাবে বলে।
‘কেন, কেন করেছ এ কাজ? তুমি কি পাগল নাকি?’ তমাল উদ্বেগে ফেটে পরে যেন।
আন্তরিকতাটুকু উপভোগ করে তিথি, আহ! কী শান্তি! বলে, ‘আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে। তাই স্মৃতি হিসেবে দাগটা রেখে দিলাম।’
‘পাগলী মেয়ে। তোমার তখনকার কথার উত্তর আমি দেইনি। তবে আমার উত্তর তোমার ভাল লাগবে না, তবুও বলি। নিয়তি তোমাকে-আমাকে এখানে এনেছে, এক বিন্দুতে বেঁধেছে। আমাদের কোন র্প্বূ-পরিকল্পনা ছিল না। দৈবাৎ এ কাজটি হয়ে গেছে। তাই আমি ভবিষৎও নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়েছি। নিয়তি যদি তোমার আমার মিলন ঘটায় আমার চেয়ে খুশী কেউ হবে না। আর না হলেও ভাবব নিয়তি চায় নি। একটা কথা কিন্তু সত্যি।’
‘কী কথা?’
‘আমি ভবিষ্যৎবাদী নই। কিছুটা অতীতমুখী হলেও বর্তমান নিয়েই আমার বসবাস। এইযে আজকের আমাদের পেরিয়ে যাওয়া সময়টুকু আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে-পরে ভাবাভাবি করে এ সময়টুকু নষ্ট করতে চাই না।’
‘বিদায় তমাল। তুমি ভাল থেক। দেখি তোমার নিয়তি কী করে।’ তিথি ধীরে ধীরে সিকিউরিটি গেট পার হয়ে যায়।
তমাল ফিরে এসে মন্ত্র মুগ্ধের মত বিছানায় সেই তোয়ালের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিথির পোড়া দাগটুকু ঐ ফুলের মাঝে জ্বল জ্বল করছে। মস্তিস্কের নিউরনে নিউরনে সঞ্চিত হচ্ছে এ দৃশ্য। মেমোরি সেলগুলো ভরে ফেলবে নাকি? মেয়েটা কি আজীবন এমনি করে ওর স্মৃতি জুড়ে থাকবে? আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয় - বিছানাটা এরকমই থাকুক। তমাল না হয় মেঝেতেই ঘুমাবে। তিথি যদি আবার কখনো এ বাসায় আসে, নিশ্চয় ফুলটা বিছানায় দেখে অবাক হয়ে যাবে। মুগ্ধ কণ্ঠে বলবে, ‘তুমি এখনো ফুলটা রেখে দিয়েছ?’
ঐ মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে আজীবন বিছানা ছেড়ে মেঝেতে ঘুমাতে রাজি তমাল। তিথির হাতের ছোঁয়া রয়ে যাক বিছানায়, তোয়ালের ফুলে। বালিশটা টেনে নেয় তমাল বিছানা থেকে। একটা চাদর বিছিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। বন্ধ চোখে ভাসছে সুন্দর মুখখানি। জ্বল জ্বল করছে পোড়া দাগটি মুখায়ববের উপর, সূর্যের চেয়েও বেশী ঔজ্জ্বল্য ধরে রেখে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৮৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সমির প্রামাণিক ১৯/০৮/২০১৭
    খুব সুন্দর। পোড়া দাগটা খুব, খুব সুন্দর।
  • লেখনশৈলী চমৎকার ছিল
  • রাহিদ ১৮/০৮/২০১৭
    অনেক সুন্দর।।
 
Quantcast