কালোপরী
গল্প : কালোপরী
নীলার হ্রদয়ে স্কুল জীবন থেকেই ব্লুনীল নামের নদীটা কষ্টের প্রতীক হিসেবে গেঁথে গেছে। না, বাস্তবের এই নদীর সাথে কষ্টের কোন সম্পর্ক নেই। তবে ইংরেজী-বাংলা মিলিয়ে দু’টি নীল একসাথে আছে, তাই নদীটার কথা মনে হলেই কষ্ট কষ্ট ভাব চলে আসে, সবসময়। অন্যদিকে, কষ্ট পেলেই নীলার এই নদীটার কথাই মনে পরে সবার আগে। যদিও এখন ও জানে এটা ব্লুনীল না ব্লুনাইল রিভার। দু’টি নীল এখানে নেই। তবুও কষ্ট পেলেই আগের মত সর্বপ্রথম এই নদীটা ভেসে উঠে। এ মুহুর্তে ব্লুনীলের মতই কষ্টের একটা তীব্র স্রোত নীলার শিরদাঁড়া বরাবর উঠানামা করছে।
‘কবে হোল? কেমন করে হোল? এখন কেমন আছে ও’? নীলার কণ্ঠে সীমাহীন উদ্বেগ।
দিনকয়েক আগে ধরা পড়েছে। এখন হাসপাতালে আছে। একটা কেমো দেয়া হয়েছে এরিমধ্যে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কেমন আছে। ডাক্তার বলেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভরসা পাচ্ছি না, ভীষণ ভয় ভয় লাগছে। আচ্ছা, আপনি কে বলছেন? এত কথাই বা জিজ্ঞেস করছেন কেন? বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছেন তা বুঝতে পারছি।
আমি নীলা। আপনি নিশ্চয় রেসাদের স্ত্রী। আপনাকে ভাবী বলে ডাকলাম, যদি অনুমতি দেন।
তা বলেন। এর জন্য অনুমতি নেবার দরকার নেই। কিন্তু আপনার পরিচয়টা?
আপনি আমাকে চিনবেন না ভাবী। আপনার স্বামী মানে রেসাদ আর আমরা এক শহরে বড় হয়েছি। ছোট্ট মফস্বল শহর। বন্ধুরা সবাই সবাইকে চিনে। যদিও সত্যি করে বললে আমি আপনার স্বামীকে ছোটবেলায় দেখেছি কিনা ঠিক মনে নেই। অনেক আগের কথা না! সেই স্কুলের সময়কার কথা। ভাবী আপনি শুনছেন তো?
জী ভাই শুনছি, বলেন।
অনেক বছর পর আপনার স্বামীর সাথে কিছুদিন আগে যোগাযোগ হয়। এরপর মাঝে মাঝে আমরা কথা বলেছি। একে অপরের ভালমন্দের খোজ নিয়েছি। ভাল বন্ধুও হয়েছি দুজনে।
আপনারা ছোটবেলার বন্ধু। এখনও বন্ধুত্ব ধরে রেখেছেন, শুনতেই ভাল লাগছে। ওর জন্য একটু দোয়া করবেন ভাই। দুই যুগের বেশী পার করেছি একসাথে। তেমন কোন বড় অসুখে পড়েনি। আজ এতবড় এক অসুখ, আমি ভেঙ্গে পড়েছি। বিদেশে থাকি, আত্মীয়স্বজন তেমন একটা নেই। পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে এখানে, ওনারাই বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন।
ভাবী কাঁদবেন না, প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
নীলা চকিতে কী যেন ভাবে। চিন্তিত মনে হয়। নীচের ঠোঁটটা একটু কামড়ে ধরে। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার দোদুল্যমনতায় ভুগছে, যেন পেন্ডুলামের ঘড়ি। শেষে গা-ঝাড়া দিয়ে বলেই ফেলে, ‘ভাবী আপনাকে একটা কথা বলি, যদি কিছু মনে না করেন।‘
ঠিক আছে; কিছু মনে করব না, বলেন।
ছোটবেলায় রেসাদকে দেখেছি কিনা মনে নেই। এরপরতো আর কখনই দেখা হয়নি। এখন মরনাপন্ন অবস্থা। আল্লাহ না করুক কিছু যদি হয়ে যায়, আর কোনদিন দেখা হবে না। বন্ধু যখন হয়েছি, দায়িত্ব নিশ্চয় কিছু হয়েছে। ভাবী, আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমি আপনার স্বামীকে দেখতে আসতে পারি। আল্লাহর রহমতে আমরা স্বচ্ছল। বলতে পারেন ভালই স্বচ্ছল।
আপনি আপনার বন্ধুকে দেখতে আসবেন আমি অনুমতি দেবার কে? আর বাঁধাই দেব কেন! এটা কেমন কথা ভাই। আপনি কি সত্যিই আসবেন?
কী বলেন ভাবী। মিথ্যা বলব কেন? আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি। টিকেট কেটেই হোটেল বুক দিয়ে দেব। ভাবী, সাথে আমার ছোট মেয়েটা থাকবে। ওর নাম হিয়া আমার দুই মেয়ে। বড়টা টুয়েলভ গ্রেডে পড়ে। ছোটটা সিক্সথ গ্রেডে।
একি বলছেন! আপনারা আমাদের গেস্ট, হোটেলে উঠবেন কেন? আমাদের বাসায় উঠবেন। যদিও বাসাটা কিন্তু খুব ছোট। আপনাদের কষ্ট হবে থাকতে।
ভাবী, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আমাদের কোনই কষ্ট হবে না। আমিও আসলে এটাই চাচ্ছিলাম। যে ক’দিন থাকব আপনাদের সাথেই থাকব, এরকম ইচ্ছাটা মনে ছিল। ফ্লাইট কনফার্ম হলেই আপনাকে জানাব।
কোন সমস্যা নেই ভাই। এয়ারপোর্টে আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিব।
আপনাকে ধন্যবাদ ভাবী। দেখা হবে শীঘ্রই, ইনশাআল্লাহ।
ফোনটা রেখেই নীলা ট্রাভেল এজেন্ট রাজা ভাইকে তাড়া দেয়। ভাই ঢাকা-ক্যালগেরি দু’টো রিটার্ন টিকিট লাগবে। একটা বার বছরের কম, চাইল্ড টিকেট। যত তাড়াতাড়ি পারেন এবং যত কম স্টপওভার করাতে পারেন। মনে করেন, টিকিট পেলে আজকেই যাব।
এমিরেটস এর ফ্লাইট। ঢাকা-দুবাই-সিয়াটল-ক্যালগেরি। মেয়েকে নিয়ে উঠে বসেছে নীলা। দুবাই থেকে ফ্লাইট বেশ লম্বা, প্রায় ১৬ ঘণ্টা। কত কিছু খেলে যাচ্ছে মনে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মত দৃশ্যগুলো পার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। আচ্ছা আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? আমার কে উনারা? রেসাদ অসুস্থ্য, ওকে দেখতে যাচ্ছি। এই মানুষটা আমার কে? শুধু কিছু কথার ফুলঝরি ছাড়া আর কী পরিচয় আমাদের? কোনদিন দেখাও হয়নি। রিলেশনটা কী তাও বলতে পারব না। বন্ধু, তবে কেমন বন্ধু তাও পরিস্কার না। তবে হ্যা, কথা বলতে পারে মানুষটা। প্রবাহমান নদীর মত শব্দের নিরন্তর স্রোত। কথার পৃষ্ঠে কথা, তার পৃষ্ঠে আবার কথা। অনন্ত অসীম সে কথার ভান্ডার। আমি ঠিক করেছি, কথায় হারানো যাবে এ বাজি আমি ওর সাথে কোনদিন ধরব না। আচ্ছা, ওকি কখনো বলেছে আমাকে ভালবাসে? না তাতো বলে নি। তাও আমি কেন যাচ্ছি? বেহায়ার মত হয়ে গেল? কিন্তু আমিইতো বলেছি সবকিছু জানতে নেই, কিছু থাক অধরা। আশ্চর্য! এসব কী ভাবছি? মানুষটা ভীষণ অসুস্থ্য। ক্লোরেকটাল ক্যান্সার। কেমো চলছে। খোদা না করুক মরেও যেতে পারে। আমিতো ওকে ফিল করি, তাই না? তবে কেন যাব না? যা করছি ঠিকই করছি। মুষ্ঠিটা একটু দৃঢ় করে নীলা। সাথে অস্ফুট গোঙ্গানির মত একটা শব্দ বের হয় মুখ থেকে।
মা, তোমার কী হয়েছে? এরকম করছ কেন?
না, কিছু হয়নি। একটু তন্দ্রামত এসেছিল। তোমার কিছু লাগবে? ওয়াশরুমে যাবে?
কিছু লাগবে না। ওয়াশরুমে যাব না এখন। আগে মুভিটা শেষ করি।
হিয়া মনোযোগ দিয়ে ‘দ্য লিজেন্ড অব টারজেন’ দেখছে। ছবিটা নতুন বের হয়েছে। নীলা চিন্তার মোড় ঘোড়াতে মুভির দিকে নজর দেয়। এ এক ভিন্ন টারজেন। বড় হয়েছে জঙ্গলে, এখন শহরে থাকে। ঘটনাচক্রে আবার জঙ্গলে যেতে হয় টারজেনকে। শহর থেকে জঙ্গলে যেয়ে ঐ পরিবেশের সাথে টারজেনের সম্পূর্ণ মিশে যাওয়া উপভোগের চেষ্টা করে নীলা। মুহুর্তে রেসাদের কথা মনে হয়। কানাডায় থেকেও ও কেমন করে বাংলাদেশের সাথে মিশে ছিল। শৈশব, কৈশর কিছুই ভুলেনি। বর্তমানটাও কেমন উজাড় করে দিয়েছিল দেশের কাছে। ভাবা যায়, ভাতও কারো প্রিয় খাবার হতে পারে। ফেসবুক পোস্টগুলোয় সব দেশের ভাবনা। বোধ করি শরীরটাই শুধু ছিল ঐ কানাডায়, আর সবইতো বাংলাদেশে। আহারে! মানুষটা এখন অসুস্থ্য, খুবই অসুস্থ্য। নীলার চোখের কোন চিক চিক করে উঠে, পানি এসে যায়। ক’ফোঁটা চোখের জল গড়িয়েও পড়ে, এই প্রথম। একি! আমি কাঁদছি কেন? মানুষটার জন্য আমার কষ্ট আঁটকে আছে। আমি যে জানতেই পারিনি কখনো। আবার মুভির দিকে দৃষ্টি দেয়।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। প্লেন ক্যালগেরিতে ল্যান্ড করেছে। নিজের অজান্তেই কেমন উত্তেজনা বোধ করছে নীলা। এরকম উত্তেজনা বিয়ের সময় হয়েছিল, বোধহয় প্রথম মেয়েটা হবার সময়ও এরকমটা ছিল। বুকের ভিতরটা কেমন শুন্য শুন্য ভাব। হরমোনগুলো বুকের জায়গাটা বাদ দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। যত সমস্যা বুকের কাছে মনে হয়, খালি। ক্যালগেরির বাতাসে বুক ভরে প্রথম শ্বাস নিয়েই মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। এই বাতাস আমরা দুজনেই শেয়ার করছি। কোথা থেকে কি বাসি শিউলীর গন্ধ পাচ্ছি। কী বোকা আমি! তা হবে কেন? এটা কানাডা, শিউলী আসবে কোত্থেকে। আহারে! মানুষটা যে শিউলী ভালবাসত, শুঁকতে চাইত। আমিও কি নিজের অজান্তে শিউলীর পোঁকা হয়ে গেছি। কী সব ভাবছি, পাগলের মত। লাগেজ নেয়া হয়ে গেছে। নীলা ধীর পায়ে ইন্টারন্যাশনাল এরাইভেলের দিকে এগিয়ে যায়। কত মানুষ এসেছে তাঁদের প্রিয়জনকে রিসিভ করতে।
হ্যা, ঐতো। ঐযে রেসাদের ছেলেটা। ছবিতেও এরকমই দেখতে। তবে বাস্তবে একটু বড় বড় লাগছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়, অজান্তেই। আমাদের পরের জেনারেশন কত বড় হয়ে গেছে। ওরা জায়গা দখলের জন্য দাড়িয়ে গেছে। সুকান্তের সাথে আমি একমত, ‘তাঁদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে স্থান’।
বাবা, তুমি শায়ের, তাই না? তোমার বাবার নাম রেসাদ। আমি তোমার আন্টি। আমাকে নীলা আন্টি বলতে পার।
আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার লাগেজ কী এই? দিন আমার কাছে দিন। চলেন পার্কিং লটের দিকে যাই। স্যরি, একটু হাঁটতে হবে।
কোন সমস্যা নাই। এটুকু হাঁটায় কিছু হবে না। আর প্লেনে বসে থেকে থেকে পায়ে খিল ধরে গেছে। এতদুরে থাক তোমরা। তুমি আমাদের চালিয়ে নিয়ে যাবে? বাব্বা বেশ বড় হয়ে গেছ। শায়ের এ হচ্ছে আমার মেয়ে হিয়া।
হাই, হোয়াটস আপ? আমি শায়ের। নাইস টু মিট ইউ।
নাইস টু মিট ইউ টু। আমি হিয়া।
আন্টি দেখেন এয়ারপোর্ট টানেল। তিন বছর লাগছে টানেলটা বিল্ড করতে। এর কোন মানে হয়, বলেন। এটা একটা টানেল হোল? এটাতো ফ্রিকিং আন্ডারপাস ছাড়া কিছুই না। উপরে দিয়ে শুধু একটা রানওয়ে গেছে। সিডনি টানেলটা দেখেছেন আন্টি? কত বড়! আঁট কিলোমিটার লম্বা।
তাই নাকি? আমার সিডনি যাওয়া হয়নি বাবা।
এই যে, এটা হোল সুপারস্টোর। আমরা গ্রোসারিসহ রেগুলার শপিং এখানেই করি।
তাই। নীলা একটু অন্যমনস্ক হয়। কিছুটা আনমনাও। তাই শায়েরের কথাগুলো ঠিক কানে যাচ্ছিল না। ভাবছে এই শহর, এই রাস্তা দিয়ে কতগুলো বছর পার করেছে রেসাদ। এসব জায়গায় ওর ছোঁয়া আছে, গন্ধও আছে নিশ্চয়। ভাগ্যরেখা আমাকে কোথায় টেনে এনেছে। আমার হাতে রেখাটা কী আমি টেনেছি, এভাবে?
কিচেন থেকে স্যালাড নাইফটা নেই
নিজ হাতে সেই রেখাটা টেনে দেই
পরতে দেই যতটুকু রক্ত আছে
দাগটা যেন না মুছে যায় পাছে
আন্টি আমরা এসে পরেছি। এই যে আমাদের বাসা। খুবই ছোট কিন্তু। তবে আপনারা আম্মুর ঘরে ঘুমাবেন। বাবা তো হাসপাতালে, আর আম্মুও রাতে ঐখানেই থাকে। আম্মু বলেছে আপনাদের ঐরুমে নিয় যেতে।
সেকি! তোমার আম্মুর ব্যক্তিগত রুমে আমরা থাকব?
এটা কোন ব্যাপার না। আমাদের বাসায় ঐ রুমটাই সবচেয়ে বড়। তাছাড়া আম্মু নিজেই বলেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। এটা তোমার বোন সেঁজুতি, রাইট? কেমন আছ মা?
আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি, মা। বাহ! তোমাদের বাসায়তো অনেক গাছ। বাসা প্রায় সবুজ করে ফেলেছ।
আমরা কেউ না আন্টি। এসব আম্মুই করে। শি হ্যাজ দ্য প্যাশেন্স। বিভিন্ন গাছ কিনে আনে। দিনের পর দিন যত্নও নেয়। বাংলাদেশে যখন ছিলাম তখনো আমাদের অনেক গাছ ছিল।
বেশতো। তোমার আম্মু দেখছি বৃক্ষপ্রেমিক। আচ্ছা, তোমাদের সানরুম না কী যেন বলে ঐটা কোথায়। তোমার বাবার কাছে এই রুমের অনেক গল্প শুনেছি।
এইতো এখানে। আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করেন। এরপর ওখানে যেয়ে বসবেন। এখনতো রাত, আপনার ভাল লাগবে। কাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে যাব। আর কিছু লাগলে আমাকে বলবেন, আন্টি।
নীলা ছোট ছোট পা ফেলে মুগ্ধ চোখে বাড়িটি দেখতে থাকে। হাত দিয়ে ছোঁয় একটু। আহ! এই বিছানা, এই ওয়াশরুম। হ্যা এখানেই তো, মানুষটা থাকে। ক্লোজেট ভর্তি কাপড়চোপড়, কেমন অগোছালো। যেন ইচ্ছে করছে ক্লোজেটটা গুছিয়ে দেই। বাড়িটি বেশী বড় না, তবে বেশ গোছালো। যা যা দরকার সবই আছে, কিন্তু বাড়ন্তের আড়ম্বর নেই। ডিনার শেষ করে নীলা বসে সেই ঘরটিতে। রাত নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। শহরের এদিকটা একটু নিরিবিলি। বাইরের কোন শব্দ আসছে না। পেছনদিকের ইলেকট্রিক বাতিগুলো নিভে গেছে।
বাসার পিছনদিক-লাগোয়া কাঁচের ঘরটা। এরা বলে সানরুম। বিরল দৃশ্য দেখার সে এক মোক্ষম জায়গা। রাত একটু গভীর এখন, তাপমাত্রা অনেক কম। চারিদিক তুষারশুভ্র। মস্ত চাঁদ থেকে ধেয়ে আসা আলোর প্রতিটি ফোটন একটি একটি করে ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে চারপাশেই রয়ে গেছে। লাগছে প্রায়-দিনের মত, অপার্থিব। নীলা রেকলাইনারে পুরো শরীরটা এলিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে মস্তিস্ক সিগনাল দিয়ে একে একে শরীরের সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ অবশ করে দিচ্ছে। প্রত্যেকটি মাংসপেশী নির্জীব, কর্মক্ষমতাহীন। শুধু চোখটি চালু আছে, প্রখর দৃষ্টিটা আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে। হাতুরী দিয়ে লোহার ভোতা অংশে বাড়ি দিলে শক্তি কনসেনট্রেট করে চোখা অংশে চলে চায়। তেমনি মেটাবলিজমে সৃষ্ট সবগুলো এটিপি সারা শরীর বেয়ে বেয়ে চোখের কাছে চলে এসেছে। চোখের দৃষ্টি এখন সহস্রগুণ। নেশার আবেশে ভরা আলোর অনুভুতি চোখ থেকে এক্সন-ডেনড্রাইট হয়ে নিউরন থেকে নিউরনে সুনামির মত ছড়িয়ে পরেছে। এ চোখই শুধু জ্যোৎস্না দেখে না, জ্যোৎস্নাও এ চোখের বশীভুত।
নীলা আবেশে বসে আছে কতক্ষণ নিজেই জানে না। একসময় উঠে পড়ে, ঘুমাতে হবে। রাত বেশ হয়েছে। একি! হিয়া আর সেজুঁতি এখনো খেলছে। এত রাতে কী খেলছে ওরা? লুডু না মনপোলি? ওদের খেলা দেখতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে ওদের সাথে খেলায় যোগ দেই। মেয়ে দু’টি কেমন আপন হয়ে গেছে, ঠিক বোনের মত।
মা, ঘুমাতে হবে না। এত বড় জার্নি করে এসেছ, টায়ার্ড তুমি।
তুমি ঘুমাতে যাও, মা। খেলা শেষ করে আমি আপুর সাথে ঘুমাব।
একি! মেয়ে দেখছি বড়দের মত কথা বলছে। যা ইচ্ছা করুক। নীলা বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বড় ভাললাগার অনুভূতি। অপরিচিত বিছানায় অপরিচিত গন্ধ নাকে আসছে। শুঁকতে খারাপ লাগছে না। রাতটা এই বিছানায় কেটে যাবে। নীলাতো ভাবেইনি যে রেসাদের বিছানায় ঘুমাবে। আহ! কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। সকালে নাস্তা খেয়ে রেডি হচ্ছে, হাসপাতালে যেতে হবে। হিয়া, তুমি রেডি হচ্ছ না মা। হাসপাতালে যেতে হবে না।
না মা, তোমরা যাও। আমি হাসপাতালে যাব না। আমি আপুর সাথে খেলব।
আমার আসতে আসতে দুপুর হয়ে যাবে কিন্তু। তুমি থাকতে পারবে একা?
পারব। একা কোথায়? আপু আছে না, তুমি যাও।
সেই মুহুর্তটি চলে আসে। কত ঘন্টার অধীর অপেক্ষা। ক’দিন আগেও ভাবেনি এটা হতে পারে। ঘটনা হচ্ছে অনেকটা রাবারের মত। ইলাস্টিসিটির কোন শেষ নেই মনে হয়। নীলা ভাবে ঘটনার ঘনঘটায় আমি সবসময়ই বিমূর্ত একজন। এ বরাবর দেখে আসছি। ঘটনা ঠিক তাঁর মত ঘটে যায়, আমি নিরবে এর স্বাক্ষী হয়ে যাই। যেন অযতনে ব্যবহ্রত হয়ে যাই। সাবান বানাতে হবে? পিওর হচ্ছে না? ঠিক আছে, ইথানল মিশিয়ে দাও। বাইপ্রোডাক্ট গ্লিসারিন? ঠিক আছে, ফেলে দাও। ইভেন্টগুলো নিয়ন্ত্রণে আমার কোনই হাত থাকে না, কোনসময় না। তা সে যেরকম ঘটনাই হোক না কেন। অনেককেই বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখি অবলীলায় ঘটনা পয়দা করে ফেলেন। ঘটনাকে ইচ্ছেমত বাড়তে দেন, কমতে দেন। দিব্যি জানেন, কখন কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে, কখন টেনে ধরতে হবে এবং কখন শেষ করে দিতে হবে। প্রতিটা স্টেপ জানেন। এরপর কী ঘটবে, তাও যেন মুখস্ত, যেন মহাজাতক! এনারা ঘটনার মা-বাপ, ইভেন্টগুলো এদের একান্ত বশীভূত।
নীলা ওদের দলে না। তাই নিয়তি ওকে টানতে টানতে এখানে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালের কেবিনে ঢুকেই নীলা অপলক চেয়ে থাকে। এই কি সে? রোগাক্লিষ্ট ফ্যাকাসে মুখ। ছবির চেয়েও কাল লাগছে। শুয়ে আছে হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায়। গলাঅব্দি কম্বল টানা। মুখভর্তি কয়েকদিনের না কামানো খোঁচাখোঁচা কাঁচাপাঁকা দাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো। ঘুমিয়ে আছে গভীরভাবে, একটু কুঁজো হয়ে। নিশ্বাসের সাথে বুকের কাছটা উঠানামা করছে। মুহুর্তে একরাশ হতাশা গ্রাস করে নীলাকে। কেন আসল এখানে? কোন আকর্ষণ আছে কী?
ডাক্তার বলেছে সবসময় একজন এটেনডেন্ট থাকলে ভাল হয়। আপা আপনি কি দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারবেন এখানে। তাহলে আমি বাসায় গিয়ে একটু ঘুমাতে পারব। কিছু রান্নাও করতে হবে। আর আপনি না থাকলে শায়ের আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে এখানে। ও থাকবে তখন।
নীলা এক মুহুর্ত চিন্তা করে। ঠিক আছে ভাবী আমি থাকব। কোন সমস্যা হবে না।
ধন্যবাদ আপা। রেসাদের মোবাইলটা আপনার কাছে থাকল। প্রয়োজনে কথা বলা যাবে। আপনি চা খান তো? আমি শায়েরকে দিয়ে ফ্লাস্ক ভর্তি চা পাঠিয়ে দিব। সাথে কিছু খাবার নিয়ে আসবে। নীচে একটা ম্যাকডোনাল্ডস আছে, বিপদের সঙ্গী আমাদের।
নীলা এই প্রথম পূর্ণ দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকায়। উজ্জল শামলা বলা যায়। সারারাত প্রায় না ঘুমানোর চিহ্ন চোখেমুখে। অশ্রুর দাগ আছে শ্যামলা কপোলে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কথা বলছে আস্তে আস্তে প্রায় নিঃশব্দে। যেন একটু শব্দ হলেই তাঁর স্বামী জেগে উঠবে। মুখমন্ডলে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। এতে মায়াময় মুখশ্রী ঠিক ঢাকা পরছে না। পরিশ্রমী মায়েদের মত গঠন। মা দূর্গার মত দশ হাত নিয়ে বিদেশে থাকতে হয় মায়েদের, আলসেমির কোন সুযোগ নেই। রেসাদ ঠিকই বলেছে। চোখদুটি আসলেই সুন্দর। কবির কল্পনার চোখ, যেন কবিতার চোখ।
আমি আসি নীলা আপা। দুপুরে দেখা হবে।
ঠিক আছে ভাবী। বাই।
ওরা চলে গেছে কিছুক্ষণ। নীলা হাসপাতালের গদিমোড়া নরম চেয়ারে বসে আছে। নিস্পলক তাকিয়ে রেসাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে। মাথায় রাজ্যের সব ভাবনা খেলা করছে। কত কথা, কত খুনসুটি ভার্চুয়ালি, সব মস্তিষ্ক রিওয়াইন্ড করছে। আমাকে একদিন বলে, ‘তুমি তো পরী’। আমি বলি, ‘পরীরাতো সুন্দর হয়, ফিনফিনে ফর্সা। আর আমিতো কালো’। তখন থেকে আমাকে ডাকতে শুরু করেন উনার দেয়া নামে, কালোপরী। কিছু হলেই ‘এই যে কালোপরী’ দিয়ে শুরু। এত স্বপ্ন, এত প্রাণশক্তি মানুষটার মাঝে। ভাবতেই শির শির লাগে। আচ্ছা, চেহারার মাঝে কোথায় যেন একটা লাবন্যতা আছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আমি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি? গেলামই বা। আমাকে কেন এত কঠিন হতে হবে? এতদূর যখন এসেছি আমার পাওনা নিয়ে যাব; এটাই তো ঠিক, না।
এই উঠ, ঘুমাও কেন? দেখো কে এসেছে? তোমার কালপরী।
একটু যেন নড়ে উঠে ঘুমন্ত দেহটা।
নীলা আরেকটু ঝুকে বলে, হ্যা আমি এসেছি। তুমি উঠ।
ঘুমন্ত চোখ একটু একটু করে মেলতে থাকে। আলোটা সয়ে যাবার সময় লাগছে। শুন্য দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকায় রেসাদ। দেখে মনে হচ্ছে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। দেখেইনিতো কোনদিন। ছবিতে নীলা সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন, পুরু মেকাপের কাছে আত্মসমর্পিত।
রোগাক্লান্ত ক্লিষ্ট চোখেমুখে প্রাণশক্তি ফিরে আসছে, ধীরে ধীরে। দু’চোখ চিনতে চেষ্টা করছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চোখের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে বিস্ফারিত হচ্ছে। অতি উত্তেজনায় বোধকরি কপালের ভেইনটা ছিড়ে যাবে। দুর্বল ডান হাতটা কম্বলের নীচ থেকে বের করছে। মনে হচ্ছে আমার দিকে আংগুল তুলে অনেক অনেক কিছু বলবে।
তুমি? সত্যিই তুমি? সেই কালোপরী! আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?
জ্বীনা। আপনি স্বপ্নটপ্ন কিছুই দেখছেন না। আপনার সেই কালপরী সশরীরে এখন আপনার সামনে। আপনি ইচ্ছে করলে ছুঁয়েও দেখতে পারেন। এই যে দেখেন আমার হাত।
রেসাদ আলতো করে ছুঁয়ে দেখে। না স্বপ্ন না, আনন্দময় বাস্তব। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছ? কবে? কখন?
এত প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে এই – কয়েকদিন ধরে তুমি উধাও। একেবারে লাপাত্তা, কোন টেক্সট নেই। শেষে তোমার মোবাইলে ফোন দিলাম কয়েকবার, কেউ ধরে না। শেষবার ভাবী ধরল, মানে তোমার বউ। ভাবীর সাথে কথা হল। তোমার অসুখের খবর পেলাম। তারপর চলে এলাম। কাল সন্ধ্যায় এসেছি। দেখলে, তোমাকে চমকে দিলাম।
শুধু চমক বলছ কেন? তুমি আমাকে পুরাই টাস্কি করে দিয়েছ। মানুষের অবাক হবার যে একটা সীমা আছে। আমার সে সীমা পার হয়ে গেছে। যাহোক, হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পরেছে। একটা কেমো দিয়ে ফেলেছে। এরকম অনেকগুলো দিবে, পৌনঃপুনিক কেমো চলবে। বাঁচব কীনা কে জানে। এরকম এক দুঃসময়ে তুমি উদয় হলে। এটাকে চমক বললে এই ঘটনার অপমান হবে। ক্যান্সারের কী ক্ষমতা দেখ, তোমাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে।
হইছে হইছে এত বিস্তারিত বলিতে হইবে না। আমি বুঝতে পারছি। তোমার শরীর এখন কেমন?
অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। এখন একটু ভাল লাগছে। তোমার ভাবী কোথায়?
উনি বাসায় গেছেন ঘুমাতে। আমাকে তোমার পাহারায় রেখে গেছেন। তুমি তোমার কালোপরীকে এখন ইচ্ছেমত দেখতে পার। কমপক্ষে দুপুর পর্যন্ত। আস তোমার নাস্তা দেই।
অনেক উত্তেজনা, অনেক কথা - তাই নাস্তার পর রেসাদ আবার ঘুমিয়ে পরে।
নীলা দুঃসাহসিক এক কাজ করে ফেলে তখন। আলগোছে ঠোঁট দুটো রেসাদের কপালে রাখে। মুহুর্তেই ঝট করে সরে আসে।
এটা আমি কী করলাম? কেন করলাম? আমার এত ভাল লাগছে কেন? আমার কি এতটা আবেগ ওর জন্য আছে। এত দুর্বল হলে বাঁকি দিনগুলি কীভাবে থাকব এখানে। পাঁচদিনের জন্য এসেছি, মাত্র একদিন গেছে। জেটল্যাগের ঘোর কাঁটেনি এখনো। সারা শরীরে ঘুমের মাদকতা। এর সাথে ভাললাগা, বোধ করি কিছুটা ভালবাসার আবেশ। নীলা কেমন খেই হারিয়ে ফেলছে।
চিন্তার স্রোত গ্লেসিয়ারের মত গড়িয়ে-গুড়িয়ে চলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকালের শুরুতেই সদলবলে সব চলে আসে। হিয়াকে দেখে সম্বিৎ পায়। আরে মেয়ের কথাতো ভুলেই গিয়েছিলাম। আহ! বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে ওকে। মা, কেমন ছিলে তুমি?
খুব ভাল। আমি আর আপু সারাদিন খেলেছি আর টিভি দেখেছি।
ওমা! এ কেমন আপুভক্ত মেয়েরে বাবা! চেনা নেই, জানা নেই আমার আপু। যাহোক, ছেলেমেয়েরা চল আজকে আমরা বাহিরে খাব। তোমাদের আন্টির কিন্তু বেশ টাকা আছে। সুতরাং মেনু নিয়ে কোন চিন্তা করবে না। আমিতো ক্যালগেরি চিনি না তাই তোমাদের পছন্দমত রেস্টুরেন্টে খাব, চল।
ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,’ভাবী আমরা যাই। কাল সকালে আবার আসব, আপনাকে রিলিজ করতে।‘
ঠিক আছে আপা। আপনি বেড়াতে এসেছেন। আর আমি আপনাকে খাটিয়ে নিচ্ছি।
কী যে বলেন? আমিতো নিজের থেকেই এসেছি, নাকি? আর আমিতো বেড়াতে আসিনি। বন্ধুকে দেখতে এসেছি। এইযে বাচ্চারা চল। এবার বল, কোথায় খাব আমরা?
আন্টি, ক্যালগেরি টাওয়ারের উপরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চলেন ওখানে যাই। ডিনার হবে, আবার উপর থেকে শহর দেখা হবে। বাবা ওখানে যেতে চায় না সহজে। উনার হাইটফোবিয়া আছে, মানে অ্যাক্রোফোবিয়া।
ভেরি গুড আইডিয়া। থ্যাঙ্ক ইউ তোমাদের। চল ওখানেই যাব। আমার ওসব ফোবিয়া-টোবিয়া নাই। আকাশের কাছে বসে চউমিন খাব, হা হা হা।
জী না আন্টি, ক্যালগেরি টাওয়ার এত উঁচু না। ডাউনটাউনের বেশীরভাগ বিল্ডিংই ক্যালগেরি টাওয়ারের চেয়ে উঁচু। টরন্টোর সিএন টাওয়ারে গেলে মনে হয় যেন আকাশে আছি, সবার চেয়ে উপরে আছি।
ঠিক বলেছ, আমি বছর দুই গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আকাশ ছুঁয়ে ফেলব। এবার তোমাদের টাওয়ারের সাথে কমপেয়ার করে দেখব।
দুনিয়ার কিছুইতো আর চিরস্থায়ী না। ক্ষণস্থায়ী, রঙধনুর রংয়ের মত। বৃষ্টি শেষে এক ঝলক দেখা দেয় সৌন্দর্যের বিশাল পসরা সাজিয়ে, সকল মুগ্ধতা কেড়ে নিয়ে। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় কোন এক সময়। দেখতে দেখতে চারটি দিন শেষ হয়ে গেল নীলার। প্রতিদিন একই রুটিন। সকালে হাসপাতালে চলে আসা। রেসাদের সাথে রাজ্যের আলাপ। বিকালে বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে খেয়ে বাসায় যাওয়া। রাতে ঘুম। আগামীকাল চলে যেতে হবে। আজই শেষ যাওয়া হাসপাতালে। পরশু দ্বিতীয় কেমো শুরু হবে। প্রথম কেমোর প্রভাব কিছুটা কমে এসেছে। এখন ওর শরীর ভাল, বেশ ঝরঝরে। বোঝাই যায় না যে শরীরে ক্যান্সারের মরণ বাসা বেঁধেছে। অনেক লাইভলি লাগছে আজ। কথাবার্তাও সপ্রতিভ হয়ে এসেছে। সেই আগের মত খুনসুটি মার্কা। বলে কি, ‘আজকের আদরটা কোথায়’। পাজী, অসভ্য কোথাকার। লজ্জা শরম বো রিভারের বরফঠান্ডা জলে ফেলে দিয়েছে।
একটু তন্দ্রামত এসেছিল নীলার। চোখ মেলে দেখে রেসাদ ঘুমিয়ে পরেছে। মাথার মধ্যে আদিম দুষ্টমিটা খেলা করে। একটু ঝুঁকে ঠোট দু’টো ওর কপালে ছোঁয়। শরীরটা একটু অবশ হয়ে আসে। অজান্তেই নিজের শরীরটা রেসাদের ঘুমন্ত শরীরের উপর ছেড়ে দেয়। বুক ধড়ফড় করছে, রক্ত কনিকাগুলো তীব্র বেগে চলাচল করছে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নীলা। লোহিত কনিকা অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করছে। রেসাদ দ্বিধার সঙ্গে বলে, ‘তুমি ভুল করছ। পরে খারাপ লাগবে’। এখন শোনার সময় নেই নীলার। যথারীতি বিকালের দিকে সবাই চলে এসেছে।
কালতো চলে যাচ্ছি ভাবী। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়ে গেলাম।
কী যে বলেন। আপনি থাকায় আমি একটু সময় পেয়েছি ঘুমানোর, রান্না করার। আপনি চলে গেলে আমাকে দিনরাত আপনার বন্ধুর সাথে হাসপাতালেই থাকতে হবে। বাসার যে কী হবে কে জানে? আপনার বন্ধুর জন্য একটু দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমার সংসারটাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে না দেন। সব ছেড়েছিলাম এক সময়, দু’জনে মিলে থাকব বলে। আল্লাহ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিবেন তাই কী হয়?
এয়ারপোর্টে মা-ছেলে-মেয়ে সবাই চলে এসেছে বিদায় জানাতে। চেক-ইন করে সিকিউরিটির দিকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শেষ বিদায়টা বেশ আবেগঘন হয়ে গেল। নীলা এতটা আশা করেনি। মেয়ে দুটি জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। ছেলেটা বোকার মত তাঁকিয়ে আছে। ভাবীও আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি কাকে শান্তনা দিব, নিজেরই কান্না লুকানোই দায়।
অস্ফুট স্বরে বলে, ‘আমার স্বামীর জন্য একটু দোয়া করবেন, প্লিজ।‘
জী ভাবী, অবশ্যই দোয়া করব। আমাকে যে করতেই হবে।
ফিরতি বিমানে মেয়েটিকে নিয়ে বসে আছে নীলা। ওয়েস্টজেট এর ফ্লাইট – ক্যালগেরি টু সিয়াটল। এরপর এমিরেটসে দুবাই হয়ে ঢাকা। এই ফ্লাইটটা ছোট্ট, গায়ে গাঁ লাগার মত। মাত্র দেড় ঘণ্টাই তো! এরপর এয়ারবাস ৩৮০, দোতলা বিশাল প্লেন। ছোট্ট প্লেনটাতে দুজনে জড়সড় হয়ে বসেছে। বিদায়ের তীব্র এক কষ্ট নীলার বুকে বাজছে। ওকি সেই ব্লুনীল নদীটা দেখতে পাচ্ছে। কষ্টের উৎস কোথায় বুঝতে পারছে না। তবে বেয়াড়া কষ্টটা কেমন দলা পাকিয়ে লিফটের মত উপরের দিকে উঠে আসছে। গলার কাছটা ব্যাথায় টনটন করছে। ব্যাথার অনুভূতিগুলি চলতে চলতে নেত্রনালীর বাঁকে এসে থমকে দাড়িয়ে পরেছে। জোর করে নেত্রনালীর দরজা খুলে দিচ্ছে। নীলা কাঁদতে চায় না। তারপরও নিয়ন্ত্রণহীন চোখের জল কপোলঅব্দি নেমে আসছে টের পায় নীলা। আরে! মেয়েটা কী ভাববে। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে তা।
ক্ষণিকের এক চিলতে আলো বলছে, মনের এক কোনায় একটা আনন্দ খেলা করছে। নিজের তলপেটে আলতো হাত রাখে নীলা। ভাবছে, ঝাঁকে ঝাঁকে স্পার্ম সাঁতরে যাচ্ছে ফেলোপিয়ান টিউব ধরে। মিলিওন্স অব স্পার্ম। কয়দিন লাগে সাঁতরে যেতে? নীলা কি টের পাচ্ছে সেই দুঃসাহসিক ভ্রমন। একটাকে ফেলে আরেকটার এগিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টা। ওরা জানে ঐ জায়গাটায় না যেতে পারলে মুহুর্তেই ধ্বংস হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে প্রাণবায়ু। প্রতিযোগিতা করে কোন একটা স্পার্ম নিশ্চয় ওভাম ছুঁয়ে ফেলবে। ওভামপ্রাচীর ছিদ্র করে ঢুকেও যাবে ভিতরে, জাইগোট করে ফেলতেও পারে। জাইগোটটি আমার শরীরেই বড় হবে, আমার জরায়ুর ভিতরে। ছেলে হবে না মেয়ে হবে? এই সন্তানের বাবার পরিচয়ে আমি কী বলব সমাজের কাছে, নিজের কাছে? স্পষ্টভাষী আমি এই সত্যটি কি নির্ভয়ে বলতে পারব? আমি কি অন্যায় করে ফেললাম? আমার স্বামী, রেসাদের স্ত্রী এদের সাথে প্রতারণা করে এলাম। কিন্তু আমার মন বলছে, না। যা করেছি সঠিক করেছি। রেসাদতো বলেছে ভালবাসা থাকলে শরীর তুচ্ছ বিষয়। আমি আমার ভালবাসার সম্পদ সাথে নিয়ে যাচ্ছি। বাঁকি জীবনটা ওকে নিয়েই কাঁটিয়ে দিতে পারব। সর্বদাই রেসাদের স্মৃতি আমার সাথে থাকবে। আর ভাবীর প্রিয় ভালবাসার মানুষটাকে তো রেখেই যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও ভাল হয়ে উঠবে।
নীলার হ্রদয়ে স্কুল জীবন থেকেই ব্লুনীল নামের নদীটা কষ্টের প্রতীক হিসেবে গেঁথে গেছে। না, বাস্তবের এই নদীর সাথে কষ্টের কোন সম্পর্ক নেই। তবে ইংরেজী-বাংলা মিলিয়ে দু’টি নীল একসাথে আছে, তাই নদীটার কথা মনে হলেই কষ্ট কষ্ট ভাব চলে আসে, সবসময়। অন্যদিকে, কষ্ট পেলেই নীলার এই নদীটার কথাই মনে পরে সবার আগে। যদিও এখন ও জানে এটা ব্লুনীল না ব্লুনাইল রিভার। দু’টি নীল এখানে নেই। তবুও কষ্ট পেলেই আগের মত সর্বপ্রথম এই নদীটা ভেসে উঠে। এ মুহুর্তে ব্লুনীলের মতই কষ্টের একটা তীব্র স্রোত নীলার শিরদাঁড়া বরাবর উঠানামা করছে।
‘কবে হোল? কেমন করে হোল? এখন কেমন আছে ও’? নীলার কণ্ঠে সীমাহীন উদ্বেগ।
দিনকয়েক আগে ধরা পড়েছে। এখন হাসপাতালে আছে। একটা কেমো দেয়া হয়েছে এরিমধ্যে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কেমন আছে। ডাক্তার বলেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভরসা পাচ্ছি না, ভীষণ ভয় ভয় লাগছে। আচ্ছা, আপনি কে বলছেন? এত কথাই বা জিজ্ঞেস করছেন কেন? বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছেন তা বুঝতে পারছি।
আমি নীলা। আপনি নিশ্চয় রেসাদের স্ত্রী। আপনাকে ভাবী বলে ডাকলাম, যদি অনুমতি দেন।
তা বলেন। এর জন্য অনুমতি নেবার দরকার নেই। কিন্তু আপনার পরিচয়টা?
আপনি আমাকে চিনবেন না ভাবী। আপনার স্বামী মানে রেসাদ আর আমরা এক শহরে বড় হয়েছি। ছোট্ট মফস্বল শহর। বন্ধুরা সবাই সবাইকে চিনে। যদিও সত্যি করে বললে আমি আপনার স্বামীকে ছোটবেলায় দেখেছি কিনা ঠিক মনে নেই। অনেক আগের কথা না! সেই স্কুলের সময়কার কথা। ভাবী আপনি শুনছেন তো?
জী ভাই শুনছি, বলেন।
অনেক বছর পর আপনার স্বামীর সাথে কিছুদিন আগে যোগাযোগ হয়। এরপর মাঝে মাঝে আমরা কথা বলেছি। একে অপরের ভালমন্দের খোজ নিয়েছি। ভাল বন্ধুও হয়েছি দুজনে।
আপনারা ছোটবেলার বন্ধু। এখনও বন্ধুত্ব ধরে রেখেছেন, শুনতেই ভাল লাগছে। ওর জন্য একটু দোয়া করবেন ভাই। দুই যুগের বেশী পার করেছি একসাথে। তেমন কোন বড় অসুখে পড়েনি। আজ এতবড় এক অসুখ, আমি ভেঙ্গে পড়েছি। বিদেশে থাকি, আত্মীয়স্বজন তেমন একটা নেই। পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে এখানে, ওনারাই বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন।
ভাবী কাঁদবেন না, প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
নীলা চকিতে কী যেন ভাবে। চিন্তিত মনে হয়। নীচের ঠোঁটটা একটু কামড়ে ধরে। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার দোদুল্যমনতায় ভুগছে, যেন পেন্ডুলামের ঘড়ি। শেষে গা-ঝাড়া দিয়ে বলেই ফেলে, ‘ভাবী আপনাকে একটা কথা বলি, যদি কিছু মনে না করেন।‘
ঠিক আছে; কিছু মনে করব না, বলেন।
ছোটবেলায় রেসাদকে দেখেছি কিনা মনে নেই। এরপরতো আর কখনই দেখা হয়নি। এখন মরনাপন্ন অবস্থা। আল্লাহ না করুক কিছু যদি হয়ে যায়, আর কোনদিন দেখা হবে না। বন্ধু যখন হয়েছি, দায়িত্ব নিশ্চয় কিছু হয়েছে। ভাবী, আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমি আপনার স্বামীকে দেখতে আসতে পারি। আল্লাহর রহমতে আমরা স্বচ্ছল। বলতে পারেন ভালই স্বচ্ছল।
আপনি আপনার বন্ধুকে দেখতে আসবেন আমি অনুমতি দেবার কে? আর বাঁধাই দেব কেন! এটা কেমন কথা ভাই। আপনি কি সত্যিই আসবেন?
কী বলেন ভাবী। মিথ্যা বলব কেন? আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি। টিকেট কেটেই হোটেল বুক দিয়ে দেব। ভাবী, সাথে আমার ছোট মেয়েটা থাকবে। ওর নাম হিয়া আমার দুই মেয়ে। বড়টা টুয়েলভ গ্রেডে পড়ে। ছোটটা সিক্সথ গ্রেডে।
একি বলছেন! আপনারা আমাদের গেস্ট, হোটেলে উঠবেন কেন? আমাদের বাসায় উঠবেন। যদিও বাসাটা কিন্তু খুব ছোট। আপনাদের কষ্ট হবে থাকতে।
ভাবী, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আমাদের কোনই কষ্ট হবে না। আমিও আসলে এটাই চাচ্ছিলাম। যে ক’দিন থাকব আপনাদের সাথেই থাকব, এরকম ইচ্ছাটা মনে ছিল। ফ্লাইট কনফার্ম হলেই আপনাকে জানাব।
কোন সমস্যা নেই ভাই। এয়ারপোর্টে আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিব।
আপনাকে ধন্যবাদ ভাবী। দেখা হবে শীঘ্রই, ইনশাআল্লাহ।
ফোনটা রেখেই নীলা ট্রাভেল এজেন্ট রাজা ভাইকে তাড়া দেয়। ভাই ঢাকা-ক্যালগেরি দু’টো রিটার্ন টিকিট লাগবে। একটা বার বছরের কম, চাইল্ড টিকেট। যত তাড়াতাড়ি পারেন এবং যত কম স্টপওভার করাতে পারেন। মনে করেন, টিকিট পেলে আজকেই যাব।
এমিরেটস এর ফ্লাইট। ঢাকা-দুবাই-সিয়াটল-ক্যালগেরি। মেয়েকে নিয়ে উঠে বসেছে নীলা। দুবাই থেকে ফ্লাইট বেশ লম্বা, প্রায় ১৬ ঘণ্টা। কত কিছু খেলে যাচ্ছে মনে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মত দৃশ্যগুলো পার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। আচ্ছা আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? আমার কে উনারা? রেসাদ অসুস্থ্য, ওকে দেখতে যাচ্ছি। এই মানুষটা আমার কে? শুধু কিছু কথার ফুলঝরি ছাড়া আর কী পরিচয় আমাদের? কোনদিন দেখাও হয়নি। রিলেশনটা কী তাও বলতে পারব না। বন্ধু, তবে কেমন বন্ধু তাও পরিস্কার না। তবে হ্যা, কথা বলতে পারে মানুষটা। প্রবাহমান নদীর মত শব্দের নিরন্তর স্রোত। কথার পৃষ্ঠে কথা, তার পৃষ্ঠে আবার কথা। অনন্ত অসীম সে কথার ভান্ডার। আমি ঠিক করেছি, কথায় হারানো যাবে এ বাজি আমি ওর সাথে কোনদিন ধরব না। আচ্ছা, ওকি কখনো বলেছে আমাকে ভালবাসে? না তাতো বলে নি। তাও আমি কেন যাচ্ছি? বেহায়ার মত হয়ে গেল? কিন্তু আমিইতো বলেছি সবকিছু জানতে নেই, কিছু থাক অধরা। আশ্চর্য! এসব কী ভাবছি? মানুষটা ভীষণ অসুস্থ্য। ক্লোরেকটাল ক্যান্সার। কেমো চলছে। খোদা না করুক মরেও যেতে পারে। আমিতো ওকে ফিল করি, তাই না? তবে কেন যাব না? যা করছি ঠিকই করছি। মুষ্ঠিটা একটু দৃঢ় করে নীলা। সাথে অস্ফুট গোঙ্গানির মত একটা শব্দ বের হয় মুখ থেকে।
মা, তোমার কী হয়েছে? এরকম করছ কেন?
না, কিছু হয়নি। একটু তন্দ্রামত এসেছিল। তোমার কিছু লাগবে? ওয়াশরুমে যাবে?
কিছু লাগবে না। ওয়াশরুমে যাব না এখন। আগে মুভিটা শেষ করি।
হিয়া মনোযোগ দিয়ে ‘দ্য লিজেন্ড অব টারজেন’ দেখছে। ছবিটা নতুন বের হয়েছে। নীলা চিন্তার মোড় ঘোড়াতে মুভির দিকে নজর দেয়। এ এক ভিন্ন টারজেন। বড় হয়েছে জঙ্গলে, এখন শহরে থাকে। ঘটনাচক্রে আবার জঙ্গলে যেতে হয় টারজেনকে। শহর থেকে জঙ্গলে যেয়ে ঐ পরিবেশের সাথে টারজেনের সম্পূর্ণ মিশে যাওয়া উপভোগের চেষ্টা করে নীলা। মুহুর্তে রেসাদের কথা মনে হয়। কানাডায় থেকেও ও কেমন করে বাংলাদেশের সাথে মিশে ছিল। শৈশব, কৈশর কিছুই ভুলেনি। বর্তমানটাও কেমন উজাড় করে দিয়েছিল দেশের কাছে। ভাবা যায়, ভাতও কারো প্রিয় খাবার হতে পারে। ফেসবুক পোস্টগুলোয় সব দেশের ভাবনা। বোধ করি শরীরটাই শুধু ছিল ঐ কানাডায়, আর সবইতো বাংলাদেশে। আহারে! মানুষটা এখন অসুস্থ্য, খুবই অসুস্থ্য। নীলার চোখের কোন চিক চিক করে উঠে, পানি এসে যায়। ক’ফোঁটা চোখের জল গড়িয়েও পড়ে, এই প্রথম। একি! আমি কাঁদছি কেন? মানুষটার জন্য আমার কষ্ট আঁটকে আছে। আমি যে জানতেই পারিনি কখনো। আবার মুভির দিকে দৃষ্টি দেয়।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। প্লেন ক্যালগেরিতে ল্যান্ড করেছে। নিজের অজান্তেই কেমন উত্তেজনা বোধ করছে নীলা। এরকম উত্তেজনা বিয়ের সময় হয়েছিল, বোধহয় প্রথম মেয়েটা হবার সময়ও এরকমটা ছিল। বুকের ভিতরটা কেমন শুন্য শুন্য ভাব। হরমোনগুলো বুকের জায়গাটা বাদ দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। যত সমস্যা বুকের কাছে মনে হয়, খালি। ক্যালগেরির বাতাসে বুক ভরে প্রথম শ্বাস নিয়েই মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। এই বাতাস আমরা দুজনেই শেয়ার করছি। কোথা থেকে কি বাসি শিউলীর গন্ধ পাচ্ছি। কী বোকা আমি! তা হবে কেন? এটা কানাডা, শিউলী আসবে কোত্থেকে। আহারে! মানুষটা যে শিউলী ভালবাসত, শুঁকতে চাইত। আমিও কি নিজের অজান্তে শিউলীর পোঁকা হয়ে গেছি। কী সব ভাবছি, পাগলের মত। লাগেজ নেয়া হয়ে গেছে। নীলা ধীর পায়ে ইন্টারন্যাশনাল এরাইভেলের দিকে এগিয়ে যায়। কত মানুষ এসেছে তাঁদের প্রিয়জনকে রিসিভ করতে।
হ্যা, ঐতো। ঐযে রেসাদের ছেলেটা। ছবিতেও এরকমই দেখতে। তবে বাস্তবে একটু বড় বড় লাগছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়, অজান্তেই। আমাদের পরের জেনারেশন কত বড় হয়ে গেছে। ওরা জায়গা দখলের জন্য দাড়িয়ে গেছে। সুকান্তের সাথে আমি একমত, ‘তাঁদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে স্থান’।
বাবা, তুমি শায়ের, তাই না? তোমার বাবার নাম রেসাদ। আমি তোমার আন্টি। আমাকে নীলা আন্টি বলতে পার।
আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার লাগেজ কী এই? দিন আমার কাছে দিন। চলেন পার্কিং লটের দিকে যাই। স্যরি, একটু হাঁটতে হবে।
কোন সমস্যা নাই। এটুকু হাঁটায় কিছু হবে না। আর প্লেনে বসে থেকে থেকে পায়ে খিল ধরে গেছে। এতদুরে থাক তোমরা। তুমি আমাদের চালিয়ে নিয়ে যাবে? বাব্বা বেশ বড় হয়ে গেছ। শায়ের এ হচ্ছে আমার মেয়ে হিয়া।
হাই, হোয়াটস আপ? আমি শায়ের। নাইস টু মিট ইউ।
নাইস টু মিট ইউ টু। আমি হিয়া।
আন্টি দেখেন এয়ারপোর্ট টানেল। তিন বছর লাগছে টানেলটা বিল্ড করতে। এর কোন মানে হয়, বলেন। এটা একটা টানেল হোল? এটাতো ফ্রিকিং আন্ডারপাস ছাড়া কিছুই না। উপরে দিয়ে শুধু একটা রানওয়ে গেছে। সিডনি টানেলটা দেখেছেন আন্টি? কত বড়! আঁট কিলোমিটার লম্বা।
তাই নাকি? আমার সিডনি যাওয়া হয়নি বাবা।
এই যে, এটা হোল সুপারস্টোর। আমরা গ্রোসারিসহ রেগুলার শপিং এখানেই করি।
তাই। নীলা একটু অন্যমনস্ক হয়। কিছুটা আনমনাও। তাই শায়েরের কথাগুলো ঠিক কানে যাচ্ছিল না। ভাবছে এই শহর, এই রাস্তা দিয়ে কতগুলো বছর পার করেছে রেসাদ। এসব জায়গায় ওর ছোঁয়া আছে, গন্ধও আছে নিশ্চয়। ভাগ্যরেখা আমাকে কোথায় টেনে এনেছে। আমার হাতে রেখাটা কী আমি টেনেছি, এভাবে?
কিচেন থেকে স্যালাড নাইফটা নেই
নিজ হাতে সেই রেখাটা টেনে দেই
পরতে দেই যতটুকু রক্ত আছে
দাগটা যেন না মুছে যায় পাছে
আন্টি আমরা এসে পরেছি। এই যে আমাদের বাসা। খুবই ছোট কিন্তু। তবে আপনারা আম্মুর ঘরে ঘুমাবেন। বাবা তো হাসপাতালে, আর আম্মুও রাতে ঐখানেই থাকে। আম্মু বলেছে আপনাদের ঐরুমে নিয় যেতে।
সেকি! তোমার আম্মুর ব্যক্তিগত রুমে আমরা থাকব?
এটা কোন ব্যাপার না। আমাদের বাসায় ঐ রুমটাই সবচেয়ে বড়। তাছাড়া আম্মু নিজেই বলেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। এটা তোমার বোন সেঁজুতি, রাইট? কেমন আছ মা?
আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি, মা। বাহ! তোমাদের বাসায়তো অনেক গাছ। বাসা প্রায় সবুজ করে ফেলেছ।
আমরা কেউ না আন্টি। এসব আম্মুই করে। শি হ্যাজ দ্য প্যাশেন্স। বিভিন্ন গাছ কিনে আনে। দিনের পর দিন যত্নও নেয়। বাংলাদেশে যখন ছিলাম তখনো আমাদের অনেক গাছ ছিল।
বেশতো। তোমার আম্মু দেখছি বৃক্ষপ্রেমিক। আচ্ছা, তোমাদের সানরুম না কী যেন বলে ঐটা কোথায়। তোমার বাবার কাছে এই রুমের অনেক গল্প শুনেছি।
এইতো এখানে। আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করেন। এরপর ওখানে যেয়ে বসবেন। এখনতো রাত, আপনার ভাল লাগবে। কাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে যাব। আর কিছু লাগলে আমাকে বলবেন, আন্টি।
নীলা ছোট ছোট পা ফেলে মুগ্ধ চোখে বাড়িটি দেখতে থাকে। হাত দিয়ে ছোঁয় একটু। আহ! এই বিছানা, এই ওয়াশরুম। হ্যা এখানেই তো, মানুষটা থাকে। ক্লোজেট ভর্তি কাপড়চোপড়, কেমন অগোছালো। যেন ইচ্ছে করছে ক্লোজেটটা গুছিয়ে দেই। বাড়িটি বেশী বড় না, তবে বেশ গোছালো। যা যা দরকার সবই আছে, কিন্তু বাড়ন্তের আড়ম্বর নেই। ডিনার শেষ করে নীলা বসে সেই ঘরটিতে। রাত নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। শহরের এদিকটা একটু নিরিবিলি। বাইরের কোন শব্দ আসছে না। পেছনদিকের ইলেকট্রিক বাতিগুলো নিভে গেছে।
বাসার পিছনদিক-লাগোয়া কাঁচের ঘরটা। এরা বলে সানরুম। বিরল দৃশ্য দেখার সে এক মোক্ষম জায়গা। রাত একটু গভীর এখন, তাপমাত্রা অনেক কম। চারিদিক তুষারশুভ্র। মস্ত চাঁদ থেকে ধেয়ে আসা আলোর প্রতিটি ফোটন একটি একটি করে ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে চারপাশেই রয়ে গেছে। লাগছে প্রায়-দিনের মত, অপার্থিব। নীলা রেকলাইনারে পুরো শরীরটা এলিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে মস্তিস্ক সিগনাল দিয়ে একে একে শরীরের সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ অবশ করে দিচ্ছে। প্রত্যেকটি মাংসপেশী নির্জীব, কর্মক্ষমতাহীন। শুধু চোখটি চালু আছে, প্রখর দৃষ্টিটা আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে। হাতুরী দিয়ে লোহার ভোতা অংশে বাড়ি দিলে শক্তি কনসেনট্রেট করে চোখা অংশে চলে চায়। তেমনি মেটাবলিজমে সৃষ্ট সবগুলো এটিপি সারা শরীর বেয়ে বেয়ে চোখের কাছে চলে এসেছে। চোখের দৃষ্টি এখন সহস্রগুণ। নেশার আবেশে ভরা আলোর অনুভুতি চোখ থেকে এক্সন-ডেনড্রাইট হয়ে নিউরন থেকে নিউরনে সুনামির মত ছড়িয়ে পরেছে। এ চোখই শুধু জ্যোৎস্না দেখে না, জ্যোৎস্নাও এ চোখের বশীভুত।
নীলা আবেশে বসে আছে কতক্ষণ নিজেই জানে না। একসময় উঠে পড়ে, ঘুমাতে হবে। রাত বেশ হয়েছে। একি! হিয়া আর সেজুঁতি এখনো খেলছে। এত রাতে কী খেলছে ওরা? লুডু না মনপোলি? ওদের খেলা দেখতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে ওদের সাথে খেলায় যোগ দেই। মেয়ে দু’টি কেমন আপন হয়ে গেছে, ঠিক বোনের মত।
মা, ঘুমাতে হবে না। এত বড় জার্নি করে এসেছ, টায়ার্ড তুমি।
তুমি ঘুমাতে যাও, মা। খেলা শেষ করে আমি আপুর সাথে ঘুমাব।
একি! মেয়ে দেখছি বড়দের মত কথা বলছে। যা ইচ্ছা করুক। নীলা বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বড় ভাললাগার অনুভূতি। অপরিচিত বিছানায় অপরিচিত গন্ধ নাকে আসছে। শুঁকতে খারাপ লাগছে না। রাতটা এই বিছানায় কেটে যাবে। নীলাতো ভাবেইনি যে রেসাদের বিছানায় ঘুমাবে। আহ! কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। সকালে নাস্তা খেয়ে রেডি হচ্ছে, হাসপাতালে যেতে হবে। হিয়া, তুমি রেডি হচ্ছ না মা। হাসপাতালে যেতে হবে না।
না মা, তোমরা যাও। আমি হাসপাতালে যাব না। আমি আপুর সাথে খেলব।
আমার আসতে আসতে দুপুর হয়ে যাবে কিন্তু। তুমি থাকতে পারবে একা?
পারব। একা কোথায়? আপু আছে না, তুমি যাও।
সেই মুহুর্তটি চলে আসে। কত ঘন্টার অধীর অপেক্ষা। ক’দিন আগেও ভাবেনি এটা হতে পারে। ঘটনা হচ্ছে অনেকটা রাবারের মত। ইলাস্টিসিটির কোন শেষ নেই মনে হয়। নীলা ভাবে ঘটনার ঘনঘটায় আমি সবসময়ই বিমূর্ত একজন। এ বরাবর দেখে আসছি। ঘটনা ঠিক তাঁর মত ঘটে যায়, আমি নিরবে এর স্বাক্ষী হয়ে যাই। যেন অযতনে ব্যবহ্রত হয়ে যাই। সাবান বানাতে হবে? পিওর হচ্ছে না? ঠিক আছে, ইথানল মিশিয়ে দাও। বাইপ্রোডাক্ট গ্লিসারিন? ঠিক আছে, ফেলে দাও। ইভেন্টগুলো নিয়ন্ত্রণে আমার কোনই হাত থাকে না, কোনসময় না। তা সে যেরকম ঘটনাই হোক না কেন। অনেককেই বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখি অবলীলায় ঘটনা পয়দা করে ফেলেন। ঘটনাকে ইচ্ছেমত বাড়তে দেন, কমতে দেন। দিব্যি জানেন, কখন কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে, কখন টেনে ধরতে হবে এবং কখন শেষ করে দিতে হবে। প্রতিটা স্টেপ জানেন। এরপর কী ঘটবে, তাও যেন মুখস্ত, যেন মহাজাতক! এনারা ঘটনার মা-বাপ, ইভেন্টগুলো এদের একান্ত বশীভূত।
নীলা ওদের দলে না। তাই নিয়তি ওকে টানতে টানতে এখানে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালের কেবিনে ঢুকেই নীলা অপলক চেয়ে থাকে। এই কি সে? রোগাক্লিষ্ট ফ্যাকাসে মুখ। ছবির চেয়েও কাল লাগছে। শুয়ে আছে হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায়। গলাঅব্দি কম্বল টানা। মুখভর্তি কয়েকদিনের না কামানো খোঁচাখোঁচা কাঁচাপাঁকা দাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো। ঘুমিয়ে আছে গভীরভাবে, একটু কুঁজো হয়ে। নিশ্বাসের সাথে বুকের কাছটা উঠানামা করছে। মুহুর্তে একরাশ হতাশা গ্রাস করে নীলাকে। কেন আসল এখানে? কোন আকর্ষণ আছে কী?
ডাক্তার বলেছে সবসময় একজন এটেনডেন্ট থাকলে ভাল হয়। আপা আপনি কি দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারবেন এখানে। তাহলে আমি বাসায় গিয়ে একটু ঘুমাতে পারব। কিছু রান্নাও করতে হবে। আর আপনি না থাকলে শায়ের আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে এখানে। ও থাকবে তখন।
নীলা এক মুহুর্ত চিন্তা করে। ঠিক আছে ভাবী আমি থাকব। কোন সমস্যা হবে না।
ধন্যবাদ আপা। রেসাদের মোবাইলটা আপনার কাছে থাকল। প্রয়োজনে কথা বলা যাবে। আপনি চা খান তো? আমি শায়েরকে দিয়ে ফ্লাস্ক ভর্তি চা পাঠিয়ে দিব। সাথে কিছু খাবার নিয়ে আসবে। নীচে একটা ম্যাকডোনাল্ডস আছে, বিপদের সঙ্গী আমাদের।
নীলা এই প্রথম পূর্ণ দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকায়। উজ্জল শামলা বলা যায়। সারারাত প্রায় না ঘুমানোর চিহ্ন চোখেমুখে। অশ্রুর দাগ আছে শ্যামলা কপোলে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কথা বলছে আস্তে আস্তে প্রায় নিঃশব্দে। যেন একটু শব্দ হলেই তাঁর স্বামী জেগে উঠবে। মুখমন্ডলে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। এতে মায়াময় মুখশ্রী ঠিক ঢাকা পরছে না। পরিশ্রমী মায়েদের মত গঠন। মা দূর্গার মত দশ হাত নিয়ে বিদেশে থাকতে হয় মায়েদের, আলসেমির কোন সুযোগ নেই। রেসাদ ঠিকই বলেছে। চোখদুটি আসলেই সুন্দর। কবির কল্পনার চোখ, যেন কবিতার চোখ।
আমি আসি নীলা আপা। দুপুরে দেখা হবে।
ঠিক আছে ভাবী। বাই।
ওরা চলে গেছে কিছুক্ষণ। নীলা হাসপাতালের গদিমোড়া নরম চেয়ারে বসে আছে। নিস্পলক তাকিয়ে রেসাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে। মাথায় রাজ্যের সব ভাবনা খেলা করছে। কত কথা, কত খুনসুটি ভার্চুয়ালি, সব মস্তিষ্ক রিওয়াইন্ড করছে। আমাকে একদিন বলে, ‘তুমি তো পরী’। আমি বলি, ‘পরীরাতো সুন্দর হয়, ফিনফিনে ফর্সা। আর আমিতো কালো’। তখন থেকে আমাকে ডাকতে শুরু করেন উনার দেয়া নামে, কালোপরী। কিছু হলেই ‘এই যে কালোপরী’ দিয়ে শুরু। এত স্বপ্ন, এত প্রাণশক্তি মানুষটার মাঝে। ভাবতেই শির শির লাগে। আচ্ছা, চেহারার মাঝে কোথায় যেন একটা লাবন্যতা আছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আমি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি? গেলামই বা। আমাকে কেন এত কঠিন হতে হবে? এতদূর যখন এসেছি আমার পাওনা নিয়ে যাব; এটাই তো ঠিক, না।
এই উঠ, ঘুমাও কেন? দেখো কে এসেছে? তোমার কালপরী।
একটু যেন নড়ে উঠে ঘুমন্ত দেহটা।
নীলা আরেকটু ঝুকে বলে, হ্যা আমি এসেছি। তুমি উঠ।
ঘুমন্ত চোখ একটু একটু করে মেলতে থাকে। আলোটা সয়ে যাবার সময় লাগছে। শুন্য দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকায় রেসাদ। দেখে মনে হচ্ছে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। দেখেইনিতো কোনদিন। ছবিতে নীলা সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন, পুরু মেকাপের কাছে আত্মসমর্পিত।
রোগাক্লান্ত ক্লিষ্ট চোখেমুখে প্রাণশক্তি ফিরে আসছে, ধীরে ধীরে। দু’চোখ চিনতে চেষ্টা করছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চোখের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে বিস্ফারিত হচ্ছে। অতি উত্তেজনায় বোধকরি কপালের ভেইনটা ছিড়ে যাবে। দুর্বল ডান হাতটা কম্বলের নীচ থেকে বের করছে। মনে হচ্ছে আমার দিকে আংগুল তুলে অনেক অনেক কিছু বলবে।
তুমি? সত্যিই তুমি? সেই কালোপরী! আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?
জ্বীনা। আপনি স্বপ্নটপ্ন কিছুই দেখছেন না। আপনার সেই কালপরী সশরীরে এখন আপনার সামনে। আপনি ইচ্ছে করলে ছুঁয়েও দেখতে পারেন। এই যে দেখেন আমার হাত।
রেসাদ আলতো করে ছুঁয়ে দেখে। না স্বপ্ন না, আনন্দময় বাস্তব। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছ? কবে? কখন?
এত প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে এই – কয়েকদিন ধরে তুমি উধাও। একেবারে লাপাত্তা, কোন টেক্সট নেই। শেষে তোমার মোবাইলে ফোন দিলাম কয়েকবার, কেউ ধরে না। শেষবার ভাবী ধরল, মানে তোমার বউ। ভাবীর সাথে কথা হল। তোমার অসুখের খবর পেলাম। তারপর চলে এলাম। কাল সন্ধ্যায় এসেছি। দেখলে, তোমাকে চমকে দিলাম।
শুধু চমক বলছ কেন? তুমি আমাকে পুরাই টাস্কি করে দিয়েছ। মানুষের অবাক হবার যে একটা সীমা আছে। আমার সে সীমা পার হয়ে গেছে। যাহোক, হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পরেছে। একটা কেমো দিয়ে ফেলেছে। এরকম অনেকগুলো দিবে, পৌনঃপুনিক কেমো চলবে। বাঁচব কীনা কে জানে। এরকম এক দুঃসময়ে তুমি উদয় হলে। এটাকে চমক বললে এই ঘটনার অপমান হবে। ক্যান্সারের কী ক্ষমতা দেখ, তোমাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে।
হইছে হইছে এত বিস্তারিত বলিতে হইবে না। আমি বুঝতে পারছি। তোমার শরীর এখন কেমন?
অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। এখন একটু ভাল লাগছে। তোমার ভাবী কোথায়?
উনি বাসায় গেছেন ঘুমাতে। আমাকে তোমার পাহারায় রেখে গেছেন। তুমি তোমার কালোপরীকে এখন ইচ্ছেমত দেখতে পার। কমপক্ষে দুপুর পর্যন্ত। আস তোমার নাস্তা দেই।
অনেক উত্তেজনা, অনেক কথা - তাই নাস্তার পর রেসাদ আবার ঘুমিয়ে পরে।
নীলা দুঃসাহসিক এক কাজ করে ফেলে তখন। আলগোছে ঠোঁট দুটো রেসাদের কপালে রাখে। মুহুর্তেই ঝট করে সরে আসে।
এটা আমি কী করলাম? কেন করলাম? আমার এত ভাল লাগছে কেন? আমার কি এতটা আবেগ ওর জন্য আছে। এত দুর্বল হলে বাঁকি দিনগুলি কীভাবে থাকব এখানে। পাঁচদিনের জন্য এসেছি, মাত্র একদিন গেছে। জেটল্যাগের ঘোর কাঁটেনি এখনো। সারা শরীরে ঘুমের মাদকতা। এর সাথে ভাললাগা, বোধ করি কিছুটা ভালবাসার আবেশ। নীলা কেমন খেই হারিয়ে ফেলছে।
চিন্তার স্রোত গ্লেসিয়ারের মত গড়িয়ে-গুড়িয়ে চলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকালের শুরুতেই সদলবলে সব চলে আসে। হিয়াকে দেখে সম্বিৎ পায়। আরে মেয়ের কথাতো ভুলেই গিয়েছিলাম। আহ! বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে ওকে। মা, কেমন ছিলে তুমি?
খুব ভাল। আমি আর আপু সারাদিন খেলেছি আর টিভি দেখেছি।
ওমা! এ কেমন আপুভক্ত মেয়েরে বাবা! চেনা নেই, জানা নেই আমার আপু। যাহোক, ছেলেমেয়েরা চল আজকে আমরা বাহিরে খাব। তোমাদের আন্টির কিন্তু বেশ টাকা আছে। সুতরাং মেনু নিয়ে কোন চিন্তা করবে না। আমিতো ক্যালগেরি চিনি না তাই তোমাদের পছন্দমত রেস্টুরেন্টে খাব, চল।
ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,’ভাবী আমরা যাই। কাল সকালে আবার আসব, আপনাকে রিলিজ করতে।‘
ঠিক আছে আপা। আপনি বেড়াতে এসেছেন। আর আমি আপনাকে খাটিয়ে নিচ্ছি।
কী যে বলেন? আমিতো নিজের থেকেই এসেছি, নাকি? আর আমিতো বেড়াতে আসিনি। বন্ধুকে দেখতে এসেছি। এইযে বাচ্চারা চল। এবার বল, কোথায় খাব আমরা?
আন্টি, ক্যালগেরি টাওয়ারের উপরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চলেন ওখানে যাই। ডিনার হবে, আবার উপর থেকে শহর দেখা হবে। বাবা ওখানে যেতে চায় না সহজে। উনার হাইটফোবিয়া আছে, মানে অ্যাক্রোফোবিয়া।
ভেরি গুড আইডিয়া। থ্যাঙ্ক ইউ তোমাদের। চল ওখানেই যাব। আমার ওসব ফোবিয়া-টোবিয়া নাই। আকাশের কাছে বসে চউমিন খাব, হা হা হা।
জী না আন্টি, ক্যালগেরি টাওয়ার এত উঁচু না। ডাউনটাউনের বেশীরভাগ বিল্ডিংই ক্যালগেরি টাওয়ারের চেয়ে উঁচু। টরন্টোর সিএন টাওয়ারে গেলে মনে হয় যেন আকাশে আছি, সবার চেয়ে উপরে আছি।
ঠিক বলেছ, আমি বছর দুই গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আকাশ ছুঁয়ে ফেলব। এবার তোমাদের টাওয়ারের সাথে কমপেয়ার করে দেখব।
দুনিয়ার কিছুইতো আর চিরস্থায়ী না। ক্ষণস্থায়ী, রঙধনুর রংয়ের মত। বৃষ্টি শেষে এক ঝলক দেখা দেয় সৌন্দর্যের বিশাল পসরা সাজিয়ে, সকল মুগ্ধতা কেড়ে নিয়ে। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় কোন এক সময়। দেখতে দেখতে চারটি দিন শেষ হয়ে গেল নীলার। প্রতিদিন একই রুটিন। সকালে হাসপাতালে চলে আসা। রেসাদের সাথে রাজ্যের আলাপ। বিকালে বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে খেয়ে বাসায় যাওয়া। রাতে ঘুম। আগামীকাল চলে যেতে হবে। আজই শেষ যাওয়া হাসপাতালে। পরশু দ্বিতীয় কেমো শুরু হবে। প্রথম কেমোর প্রভাব কিছুটা কমে এসেছে। এখন ওর শরীর ভাল, বেশ ঝরঝরে। বোঝাই যায় না যে শরীরে ক্যান্সারের মরণ বাসা বেঁধেছে। অনেক লাইভলি লাগছে আজ। কথাবার্তাও সপ্রতিভ হয়ে এসেছে। সেই আগের মত খুনসুটি মার্কা। বলে কি, ‘আজকের আদরটা কোথায়’। পাজী, অসভ্য কোথাকার। লজ্জা শরম বো রিভারের বরফঠান্ডা জলে ফেলে দিয়েছে।
একটু তন্দ্রামত এসেছিল নীলার। চোখ মেলে দেখে রেসাদ ঘুমিয়ে পরেছে। মাথার মধ্যে আদিম দুষ্টমিটা খেলা করে। একটু ঝুঁকে ঠোট দু’টো ওর কপালে ছোঁয়। শরীরটা একটু অবশ হয়ে আসে। অজান্তেই নিজের শরীরটা রেসাদের ঘুমন্ত শরীরের উপর ছেড়ে দেয়। বুক ধড়ফড় করছে, রক্ত কনিকাগুলো তীব্র বেগে চলাচল করছে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নীলা। লোহিত কনিকা অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করছে। রেসাদ দ্বিধার সঙ্গে বলে, ‘তুমি ভুল করছ। পরে খারাপ লাগবে’। এখন শোনার সময় নেই নীলার। যথারীতি বিকালের দিকে সবাই চলে এসেছে।
কালতো চলে যাচ্ছি ভাবী। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়ে গেলাম।
কী যে বলেন। আপনি থাকায় আমি একটু সময় পেয়েছি ঘুমানোর, রান্না করার। আপনি চলে গেলে আমাকে দিনরাত আপনার বন্ধুর সাথে হাসপাতালেই থাকতে হবে। বাসার যে কী হবে কে জানে? আপনার বন্ধুর জন্য একটু দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমার সংসারটাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে না দেন। সব ছেড়েছিলাম এক সময়, দু’জনে মিলে থাকব বলে। আল্লাহ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিবেন তাই কী হয়?
এয়ারপোর্টে মা-ছেলে-মেয়ে সবাই চলে এসেছে বিদায় জানাতে। চেক-ইন করে সিকিউরিটির দিকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শেষ বিদায়টা বেশ আবেগঘন হয়ে গেল। নীলা এতটা আশা করেনি। মেয়ে দুটি জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। ছেলেটা বোকার মত তাঁকিয়ে আছে। ভাবীও আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি কাকে শান্তনা দিব, নিজেরই কান্না লুকানোই দায়।
অস্ফুট স্বরে বলে, ‘আমার স্বামীর জন্য একটু দোয়া করবেন, প্লিজ।‘
জী ভাবী, অবশ্যই দোয়া করব। আমাকে যে করতেই হবে।
ফিরতি বিমানে মেয়েটিকে নিয়ে বসে আছে নীলা। ওয়েস্টজেট এর ফ্লাইট – ক্যালগেরি টু সিয়াটল। এরপর এমিরেটসে দুবাই হয়ে ঢাকা। এই ফ্লাইটটা ছোট্ট, গায়ে গাঁ লাগার মত। মাত্র দেড় ঘণ্টাই তো! এরপর এয়ারবাস ৩৮০, দোতলা বিশাল প্লেন। ছোট্ট প্লেনটাতে দুজনে জড়সড় হয়ে বসেছে। বিদায়ের তীব্র এক কষ্ট নীলার বুকে বাজছে। ওকি সেই ব্লুনীল নদীটা দেখতে পাচ্ছে। কষ্টের উৎস কোথায় বুঝতে পারছে না। তবে বেয়াড়া কষ্টটা কেমন দলা পাকিয়ে লিফটের মত উপরের দিকে উঠে আসছে। গলার কাছটা ব্যাথায় টনটন করছে। ব্যাথার অনুভূতিগুলি চলতে চলতে নেত্রনালীর বাঁকে এসে থমকে দাড়িয়ে পরেছে। জোর করে নেত্রনালীর দরজা খুলে দিচ্ছে। নীলা কাঁদতে চায় না। তারপরও নিয়ন্ত্রণহীন চোখের জল কপোলঅব্দি নেমে আসছে টের পায় নীলা। আরে! মেয়েটা কী ভাববে। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে তা।
ক্ষণিকের এক চিলতে আলো বলছে, মনের এক কোনায় একটা আনন্দ খেলা করছে। নিজের তলপেটে আলতো হাত রাখে নীলা। ভাবছে, ঝাঁকে ঝাঁকে স্পার্ম সাঁতরে যাচ্ছে ফেলোপিয়ান টিউব ধরে। মিলিওন্স অব স্পার্ম। কয়দিন লাগে সাঁতরে যেতে? নীলা কি টের পাচ্ছে সেই দুঃসাহসিক ভ্রমন। একটাকে ফেলে আরেকটার এগিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টা। ওরা জানে ঐ জায়গাটায় না যেতে পারলে মুহুর্তেই ধ্বংস হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে প্রাণবায়ু। প্রতিযোগিতা করে কোন একটা স্পার্ম নিশ্চয় ওভাম ছুঁয়ে ফেলবে। ওভামপ্রাচীর ছিদ্র করে ঢুকেও যাবে ভিতরে, জাইগোট করে ফেলতেও পারে। জাইগোটটি আমার শরীরেই বড় হবে, আমার জরায়ুর ভিতরে। ছেলে হবে না মেয়ে হবে? এই সন্তানের বাবার পরিচয়ে আমি কী বলব সমাজের কাছে, নিজের কাছে? স্পষ্টভাষী আমি এই সত্যটি কি নির্ভয়ে বলতে পারব? আমি কি অন্যায় করে ফেললাম? আমার স্বামী, রেসাদের স্ত্রী এদের সাথে প্রতারণা করে এলাম। কিন্তু আমার মন বলছে, না। যা করেছি সঠিক করেছি। রেসাদতো বলেছে ভালবাসা থাকলে শরীর তুচ্ছ বিষয়। আমি আমার ভালবাসার সম্পদ সাথে নিয়ে যাচ্ছি। বাঁকি জীবনটা ওকে নিয়েই কাঁটিয়ে দিতে পারব। সর্বদাই রেসাদের স্মৃতি আমার সাথে থাকবে। আর ভাবীর প্রিয় ভালবাসার মানুষটাকে তো রেখেই যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও ভাল হয়ে উঠবে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শাহানাজ সুলতানা (শাহানাজ) ১৩/০৮/২০১৭অনেক দীর্ঘ তবু ধর্য্যধরে পড়লাম ভালো লাগলো ,