www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বুশরার ফেরা

গল্প : বুশরার ফেরা
বুশরা একাই যাচ্ছে।
এমন না যে ও বিদেশে যায়নি আগে। তবে সবসময় সাথে বাবা-মা ছিল, ভাইটা ছিল। সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইন্ডিয়া সবসময়ই পরিবারসহ গেছে ওরা বেড়াতে। এবারই প্রথম একা যাচ্ছে। তাও আবার অনেক দুরে, বাংলাদেশের উল্টো প্রান্তে। গালফ এয়ারে যাচ্ছে ও, ঢাকা-বাহরাইন-লন্ডন-ক্যালগেরি। ঢাকা থেকে লন্ডন পর্যন্ত গালফ এয়ার আর বাকিটুকু এয়ার কানাডা। ফ্লাইটসূচী তোতাপাখির মত মুখস্ত করে ফেলেছে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরিতে ওর এডমিশন হয়েছে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ আন্ডারগ্রাড করবে। মানুষ পড়তে যায় লন্ডন-আমেরিকা আর ও যাচ্ছে ক্যালগেরি। কী যে আছে কপালে, আল্লাহই জানেন!
সাঁজগোজ বুশরার তেমন পছন্দ না। চোখে একটু কাজল দেয়, এই যা। বন্ধুরা বলে, ওর চোখ দুটি নাকি সুন্দর। ‘কাজল নয়নে এল উজল শশী’ টাইপের। তবে এ মুহুর্তে সুন্দর চোখ জলে আর কাজলে মাখামাখি। মাত্রই প্লেন ঢাকা ছেড়েছে। এদিকে ওর দমকে দমকে কান্না আসছে। চার ঘণ্টা পর মানামা সিটিতে নামবে। কিন্তু মনে হচ্ছে অনন্তকাল লেগে যাবে এই চার ঘণ্টা হতে। এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে বাবা-মা, ছোট ভাইটা, আরো কত আত্মীয়স্বজন এসেছিল! সকলেই ভেউ ভেউ করে কী কান্না! ভাবখানা যেন চিরজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। মাত্র চার বছরের আন্ডারগ্রাড কোর্স। দেখতে দেখতেই চলে যাবে। এরপরতো চলেই আসবে। অবশ্য রেজাল্ট ভাল করলে মাস্টার্স করবে কী না ভেবে দেখবে। বুশরা ভেবে পায় না এত কান্নাকাটি কীসের?
কিন্তু প্লেন টেকঅফ করার সাথে সাথেই মনে হোল বুকের কাছটা কেমন খালি হয়ে যাচ্ছে। শুরুতে বুঝতে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে টের পায় চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। বিদায়ের দৃশ্যটা মনে পরলেই কান্না ধোঁয়ার কুন্ডুলির মত উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। ভাবতেই পারেনি এত মায়া ওর হ্রদয়ে জমা ছিল। এত ভালবাসা ও রেখেছিল পরিবারের জন্য।
পাশের সিটে মধ্যবয়স্ক মহিলা বিষয়টি লক্ষ করছেন। পাশে উনার স্বামীও আছেন। ভদ্রমহিলাই মুখ খুললেন একসময়,
‘এই মেয়ে তোমার নাম কী? এত কাঁদছ কেন?’
বুশরা ভেজাচোখ তুলে তাকায়। কেমন খালাম্মা-খালাম্মা দেখতে, মায়াভরা। আবার চোখ নামিয়ে নেয়। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মহিলা কিছুটা নাছোড়বান্দা, ’কী ব্যাপার কথা বলছ না কেন?’
এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘আমার নাম বুশরা। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে যেতে মায়া লাগছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।‘
সেটাতো বুঝতে পারছি। এই বয়সে একা একা যাচ্ছ। তোমার সাহস আছে মেয়ে। তুমি কাঁদবে কেন? সাহসীদের কাঁদতে নেই। তা কোথায় যাচ্ছ তুমি?
কানাডার ক্যালগেরি। ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। সেপ্টেম্বরেই ক্লাস শুরু।
তাহলেতো ভালই হোল। লন্ডন পর্যন্ত আমরা একসাথেই যেতে পারবে। আর ওখান থেকে তো মাত্র একটা ফ্লাইট। বিদেশে পড়তে যাচ্ছ, খুব ভাল খবর। মন দিয়ে পড়বে কিন্তু।
ভাল কি না জানিনা। কী হবে তাও জানি না। আমার এখন ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
আমার হাজবেন্ড লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সে পড়ায়, এসোসিয়েট প্রফেসর। উনার কাছ থেকেই শুনেছি, এখানে পড়াশুনা মানে প্রত্যেকদিনের পড়া প্রত্যেকদিন শেষ করা। ক্লাশ মিস করবে না কখনো।
না, সেরকম কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি পড়তেই যাচ্ছি। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
সারাপথই ভদ্রমহিলার সাথে এটা-ওটা অনেক কথা হয়। মনের কষ্ট-ভাবটাও কমে আসে অনেক। লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালে নেমে বুশরা কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলে। খালাম্মা টাইপের মহিলা চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। কী বিশাল টার্মিনাল! কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে সব যেন গুলিয়ে ফেলে। হাতড়েপাতড়ে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে উঠেই তবে রক্ষা। আঁট ঘণ্টা বাদে ক্যালগেরি এয়ারপোর্টে নামে ও। ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল এরাইভেলে গিয়ে খালাম্মাকে দেখতে পায়। মার খালাতো বোন। খালাম্মা খুশীতে টগবগ করে উঠে,
এই যে বুশরা। বারে! কত বড় হয়ে গেছো! কতদিন পর দেখা।
জ্বী খালাম্মা, গুণে গুণে পুরো ছয় বছর পর দেখা আপনার সাথে। আমিতো ভেবেছিলাম আমাকে চিনতেই পারবেন না।
কী যে বল না তুমি, চিনব না কেন? চল চল, আগে বাসায় চল। খাওয়াদাওয়া করবে, এরপর রেস্ট। লম্বা জার্নি করে এসেছ, নিশ্চয় ভীষণ টায়ার্ড তুমি। দেশ থেকে এত দুরে থাকি আমরা! কাউকে আসতে বললেও বিপদ।
খালাম্মা আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। আমাকে কালই হোস্টেলে যেতে হবে কিন্তু। সবকিছু গুছিয়ে ফেলব। পরশুদিনই ওরিয়েন্টেশন শুরু হবে।
ঠিক আছে ঠিক আছে, কালই তোমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিব।
পরেরদিন খালাম্মার বাসা থেকে হোস্টেলে আসে। রুমে ঢুকেই মনটা ভাল হয়ে উঠে। দু’জনের থাকার জন্য ডাবল বেডের চমৎকার রুম। প্রচুর আলো রুমময়। এটাচড বাথরুম। কমন কিচেন করিডোরের কোনার দিকে। লন্ড্রিটাও কিচেনের পাশে। জানালা দিয়ে ইউনিভার্সিটি ট্রেন স্টেশনটা পরিস্কার দেখা যায়। মানুষজন নামছে উঠছে। স্টেশনের পাশ দিয়ে বইছে অতিব্যস্ত ক্রোচাইল্ড ট্রেইল। দু’ধারের বহমান গাড়ীর সারির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে বুশরা।
হেই, আই অ্যাম লিন্ডা। কেনিয়া থেকে এসেছি।
বুশরা চমকে তাকায়। হঠাৎ করে কালো মেয়েটির পানে চেয়ে একটু ভড়কে যায়। কিন্তু লিন্ডার সরলতা আর আন্তরিকতায় বুশরা রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যায়। চেহারার মধ্যে শিশুসুলভ একটা ভাব আছে মেয়েটির। কিছুক্ষণ বাদেই ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় আকার ধারণ করে। জিওলজিতে আন্ডারগ্রাড করবে ও। লিন্ডার সাথে এনরলমেন্ট সেন্টারে গিয়ে ভর্তি কনফার্ম করে এ বছরের কোর্স ঠিক করে ফেলে বুশরা। ফল সিমেস্টারে চারটি কোর্স নেয়, উইন্টারেও চারটা আর সামার-স্প্রিং মিলিয়ে দু’টা। দশটা করে কোর্স নিলে চার বছরে শেষ হয়ে যাবে প্রোগ্রাম। কাল ওরিয়েন্টেশন শুরু হবে। মোট চারদিনব্যাপী কর্মসূচী। কী হবে কে জানে? বুশরা কিছুটা উত্তেজিত। ভোর হতেই লিন্ডাকে তাড়া দেয়,
লিন্ডা, গেট আপ। রেডি হও তাড়াতাড়ি। প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে যে!
লিন্ডা ঘুমকাতুরে, ‘এইতো উঠছি। তুমি আগে রেডি হও। আমার সময় লাগবে না।’
ওরিয়েন্টেশনে এসে বুশরা রীতিমত হকচকিয়ে গেছে। কী বিশাল আয়োজন! কী করতে হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চারিদিকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। কিন্তু বেশ সুশৃঙ্খল। ছাত্রছাত্রীদেরকে শুরুতেই ডিপার্টমেন্ট অনুসারে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। জায়গায় জায়গায় ভলান্টিয়ার আছে। এদের সহায়তায় বুশরা ঠিকই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। অনুষ্ঠানসূচী দেখে ওর বেড়া-ছেড়া অবস্থা! পুরো ক্যাম্পাস ঘুড়ে দেখাবে। সাথে বিভিন্ন খেলার আইটেম। ক্রিস্টাল মেজ নামক খেলার অংশ হিসেবে সেই ডাউনটাউনেও দৌড়াতে হল। কমপ্লিমেন্টারী খাবারদাবার, বিভিন্ন স্টেশনারী ফ্রি, আরো কত কী! বুশরা সারা বছর চলার মত কলম আর ফ্লাস-ড্রাইভ সংগ্রহ করে ফেলল। এক কথায় ও বিমোহিত!
বিরাট হলরুমে প্লেনারী সেশন। ঠিক মাঝখানে স্টেজ, ছাত্র-ছাত্রীরা চারিদিকে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়ালরা বক্তৃতা করছেন। খুবই সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রফেসর উইলার্ড বয়েল কখন মঞ্চে উঠবেন। বুশরা এই লোকের নামই শুনেনি কখনো, চিনাতো দুরের কথা। ব্রোশিয়র দেখে জেনেছে কানাডার নোভা স্কোশিয়ায় জন্ম প্রফেসরের। পড়াশুনা মন্ট্রিয়ালের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি। পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ২০০৯ সালে। আজকের সেশনের উনি প্রধান বক্তা। উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দিবেন। কী বলেন উনি, সবার আগ্রহ ঠিক ঐখানে।
পাশের সিটটা এতক্ষণ খালি ছিল। হঠাৎ কে যেন এসে বসল। নাকে একটা গন্ধ আসছে। বুশরা পারফিউমটা চিনে, আরমানি এক্সচেঞ্জ। একটু কৌতহুলী হয়। তাই চোখ তুলে তাকায়। একটা ছেলে এসে বসেছে। সোনালী চুল, চিরুনি পরেনি বছরখানেক মনে হয়। নীল রংয়ের একটা গোলগলা টি-শার্ট পরে এসেছে। বুশরা ভিমরী খায়। এরকম অনুষ্ঠানে টি-শার্ট পরে আসে কেউ!
‘হাই, আমি রায়ান।‘ সপ্রতিভ স্পষ্ট গলায় বলে ছেলেটি।
বুশরা একটু থতমত খায়, ‘ওহ! হ্যালো, আমি বুশরা।‘
নাইস টু মিট ইউ বুশরা।
নাইস টু মিট ইউ টু।
মনে হচ্ছে প্রফেসর বয়েল চমৎকার কিছু কথা বলবেন। আমি এক্সাইটেড বুশরা। বাই দ্য ওয়ে, আমার হয়ত এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না, তবুও বলি তোমার চোখ দু’টি খুব সুন্দর। স্যরি, তুমি কিছু মনে কোর না। আমি আসলে মনের কথা সরাসরি বলে ফেলি।
বুশরার হঠাৎ করে লজ্জা পেয়ে যায়। চোখের প্রশংসা আগেও মানুষ করেছে। তবে এভাবে স্বল্প পরিচয়ে সরাসরি কেউ বলে নি। নীচু গলায় বলে, ‘তোমাকে ধন্যবাদ, রায়ান’। বুশরা তাঁকিয়ে দেখে ছেলেটি স্টেজের দিকে নজর দিয়েছে। চোখদুটো নীল রংয়ের। মুখের ভাবটা দিপ্তীমাখা। গায়ের রং পুরোপুরি ককেশিয়ান না, মনে হয় বাবা-মা যে কোন একজন সাদা না। কোথায় যেন একটা আকর্ষণ আছে। আরে! একটা বিদেশি ছেলের জন্য বুশরা এত ভাবছে কেন?
বক্তৃতা শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে পিনপতন নিস্তব্দতা। সবাই গভীর আগ্রহে শুনছে। বুশরার ইংরেজী এত ভাল হয়নি এখনো। অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না। সকলের আগ্রহ দেখে ও মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু বারে বারে ওর চিন্তা দেশে চলে যায়। বাবা-মা, ভাইটা কেমন আছে। ওদেরকে দেখাতে পারলে ভাল হত – কী বিশাল হল, কত ছেলেমেয়ে! কখন বক্তৃতা শেষ হয়েছে খেয়াল করেনি। হঠাৎ রায়ানের কথায় সম্বিৎ পায়,
বাই বুশরা। হোপ টু সি ইউ এগেইন।
বাই রায়ান।
আজকের মত ওরিয়েন্টেশনের প্রোগ্রাম শেষ। রুমে চলে যায় ও। নেক্সট উইকে ক্লাস শুরু হবে। তাই একটু পরেই লাইব্রেরিতে যায়। কিছু প্রয়োজনীয় বই তুলে আর এপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স ২১৭ এর জন্য একটা বই কিনে ফেলে। গণিত বরাবরই ওর প্রিয়। ইন্টারনেট থেকে লেকচার নোটগুলো প্রিন্ট করে নেড়েচড়ে দেখা শুরু করে। ক্লাসের প্রস্তুতি শেষ করে আনতে হবে। বুশরা ঠিক করেছে শুরু থেকেই রেজাল্ট ভাল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস আজ। বুশরা ভীষণ উত্তেজিত। হোস্টেল থেকে মাত্র সাত মিনিট হেঁটেই ক্লাসরুম। উত্তেজনায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই ক্লাসে পৌঁছে যায় ও। সায়েন্স থিয়েটার ১৪৬ - গ্যালারি টাইপের বিরাট ক্লাসরুম। কমছে কম দেড়শ জন তো হবেই। বুশরা অবাক হয়ে দেখে, ওর পাশে সেই ছেলেটা এসে বসেছে, ওরিয়েন্টেশনে দেখা রায়ান।
হাই বুশরা, তুমি এই ক্লাসে?
হ্যা, আমি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করছি। তুমিও দেখি এখানে আছো? কী করছ আন্ডারগ্রাডে, কয়টা কোর্স নিয়েছ?
আমিও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করছি। পাঁচটা কোর্স নিয়েছি এই সিমেস্টারে।
বুশরা নামগুলো দেখে খুশী হয়। তিনটি কোর্সে ওদের মিল আছে। থিওরী, টিউটোরিয়াল এবং ল্যাবগুলোও একসাথে। একঘণ্টা পনের মিনিটের ক্লাস একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়। লেকচারের অনেক কিছুই বুঝতে পারে না ও। তাই অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মত স্বগোতক্তি করে উঠে, ‘না, এখানে পড়া মনে হয় হবে না আমার। কিছুই বুঝছি না’।
চকিতে রায়ান বলে উঠে, ‘না, ও কিছু না। প্রথম প্রথম এরকম একটু হবে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। তোমার পরবর্তী ক্লাস কখন?’
এই তো ৪৫ মিনিট পর।
গুড। তাহলে তো একটু সময় আছে। আচ্ছা বল কোন বিষয়টা তুমি বুঝনি।
অনেক কিছুই বুঝিনি। তুমি পারলে আমাকে সহজভাবে বল, টিচার এতক্ষণ কী পড়াল।
রায়ান আগ্রহ নিয়ে একে একে সব গুছিয়ে বলতে থাকে। বুশরার মনে হয়, আরে এতো কঠিন কিছু নয়! শুধু ভাষার জন্য যত গন্ডগোল লেগে গেছে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারে, ছেলেটা মেধাবী। যথেষ্ট জ্ঞান রাখে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রায়ান। যাই পরবর্তি ক্লাসে যেতে হবে।
বাই বুশরা।
ক্লাস শেষ করে লাঞ্চের জন্য ম্যাককাওয়ান বিল্ডিংয়ের দিকে যায়। বিরাট ফুডকোর্ট। ভিলা মদিনা থেকে একটা চিকেন শর্মা র‍্যাপ নিয়ে চেয়ারে মাত্র বসেছে, এরিমধ্যে আবার রায়ান।
হাই, তুমি একা কেন বুশরা? এখনো বন্ধু হয়নি?
না, তেমন কেউ নেই। আসলে আমি একটু লাজুক এ ব্যপারে। সহজে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয় না। তবে একবার হয়ে গেলে সুপার গ্লুর মত লেগে যায়। সহজে ছোটে না।
হ্যাবিটটা একেবারে খারাপ না। কোয়ান্টিটি কম হওয়া ভাল, যদি কোয়ালিটি ভাল হয়। এনিওয়ে, তোমার সাথে বসতে পারি?
অবশ্যই, বস।
আজকে কেমিস্ট্রি ল্যাব আছে, বিকালে। তোমারওতো আছে, তাই না?
হ্যা। এত এত ক্লাস, ল্যাব, টিউটোরিয়াল! মনে হচ্ছে সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি।
হা হা হা, এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? সবেতো শুরু হোল। দেখবে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওহ গড! তাই যেন হয়।
রুমে যেয়ে আবার আজকের পড়া নিয়ে বসে। পুরো লেকচারগুলো রিভাইস দেয়। আগামীকালের লেকচারগুলো দেখে নেয়। ফাঁকে রায়ানের কথাও মনে হয়। কী মেধাবী ছেলেটা! সব পারে, সব বুঝে। আবার কী বিনয়ী।
‘এই বুশরা কী ভাবছ?’ লিন্ডা জিজ্ঞাসা করে।
না, তেমন কিছু না। এত পড়া কী যে করব?
আমিও তাই ভাবছি। মাই গড! পাশ করতে পারব না মনে হয়।
কী যে হয়, কে জানে? এখন ঘুমাও। গুড নাইট।
পরের দিন আবার ক্লাসে যায় ও। ক্লাস শেষে যথারীতি রায়ানের সাথে বসে, আজকের পড়া নিয়ে। লাঞ্চ টাইমে দুজনে একসাথেই ফুডকোর্টের দিকে যায়। খেতে খেতে বুশরা বলে,
আচ্ছা, তুমি আমাকে এভাবে সাহায্য করছ কেন?
রায়ান হাসতে হাসতে বলে, ‘আমি জানতাম তুমি এই প্রশ্নটা করবে। মনে হয় দু’টো কারণে তোমাকে সাহায্য করছি - তুমি ভিনদেশী মেয়ে এখানে এসে বিপদে পরেছ। অন্য কারণটা হল, এতে আমার পড়াটাও হয়ে যাচ্ছে। রুমে গিয়ে আর পড়তে হচ্ছে না।‘
গুড, ভেরি গুড। চালিয়ে যাও এই সাহায্যপ্রথা। আমার ভীষণ উপকারে লাগছে যে!
প্রতিদিনের রুটিন চলতে থাকে। ক্লাসে যাও, লাইব্রেরিতে যাও। পড়া রেডি কর রায়ানের সাথে। একসাথে লাঞ্চ করা দু’জনে। এরিমধ্যে আরো কিছু বন্ধু হয়েছে, ওদের সাথেও আড্ডা হয় পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। রাতে লিন্ডার সাথে গল্প। দ্রুতগতিতে সময় চলে যাচ্ছে। কোনদিক দিয়ে যে মাস পার হয়ে গেছে টেরও পায় না ও। প্রথম মিডটার্মটা এসে গেল। মাঝে মাঝে খালাম্মা খোঁজ নেয়। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে তেমন একটা যোগাযোগও হয় নাই।
‘হ্যালো বুশরা, তোমার খবর কী? অনেকদিন কোন সংবাদ পাই না।‘ হঠাৎ খালাম্মার ফোন।
খালাম্মা আমি ভাল আছি। ভীষণ পড়ার চাপ। একেবারে চিড়ে-চ্যাপ্টা করে দিচ্ছে। ভাবছি প্রথম বাচ্চা হলে নাম রাখব ‘অ্যাসাইনমেন্ট’।
খালাম্মা হাসে। এই উইকএন্ডে চলে আস আমাদের বাসায়। ভালমন্দ কিছু রেধে খাওয়াব। ওখানে কী খাচ্ছ কে জানে?
আরে খালাম্মা! কী খাচ্ছি তা দেখার সময় কোথায়? পুরাই নুডুলসের উপরে আছি। সোমবার মিডটার্ম আছে, তাই এ উইকএন্ডে কোনমতেই বের হতে পারব না।
দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা হলের দিকে যাচ্ছে বুশরা। প্রথম মিডটার্ম। কিন্তু ক্লাসরুমে ঢুকেই ওর সব ভয় উধাও। ছেলেমেয়েরা হাসিখুশী, কোন টেনশন নেই। একটু পরেই পরীক্ষা, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা ক্লাস করতে এসেছে। রায়ানও আছে ওদের মধ্যে, হাসছে।
কী খবর? প্রস্তুতি শেষ? দেখে মনে হচ্ছে ঘাবড়ে গেছ তুমি।
কী বল তুমি? ঘাবড়াবো না? পরীক্ষা মানে তো বিরাট ব্যাপার।
রায়ান হাসে। পরীক্ষা শেষ হবার পরও হাসে। দেখলে না, পরীক্ষা কি সহজ ব্যাপার।
এতো সহজে হবে বুঝতে পারি নি। টেনশনে তো রাতে ঠিকমত ঘুমাতেই পারিনি। এখন বেশ ভাল লাগছে, রিলিফ হয়েছি।
তাই নাকি। তাহলে চল বিকালে ইউঅবসি ডাইনো আর ক্যালগেরি ফ্লেমসের মধ্যে হকি খেলা দেখে আসি। এইতো কাছেই, ম্যাকমোহন স্টেডিয়ামে।
বল কী? আইচ হকির কিছুই আমি বুঝি না। আবার একটু পর পর খেলোয়াড়রা খালি মারামারি করে, দেখতে ভাল লাগে না।
হা হা হা। এটা কোন সমস্যা না, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব। মারামারিটা হচ্ছে পার্ট অব দ্য গেম।
খেলা দেখার ফাঁকে টুকটাক কথা হয়। পড়াশুনার বাইরে এবারই প্রথম ওরা কোন সামাজিক ইভেন্টে এসেছে। প্রথমবারের মত বুশরা অন্যভাবে রায়ানকে দেখে। ভাল লাগার একটা অনুভূতি।
রাতে লিন্ডাও প্রসঙ্গটা তুলে। ভিনদেশী হলেও মেয়ে তো। হাড়ি দেখেই বুঝে ফেলে ভাত ফুটেছে কিনা। বুশরা, তোমাকে রায়ানের সাথে দেখি প্রায় সময়। কিছু হচ্ছে নাকি ফ্রেন্ড। ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ?
দুর! কী যে বল না। পড়াশুনার বাইরে আর কিছু না। বুশরা লজ্জা পায় একটু। জোর দিয়ে না করতে পারে না। পরেরদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। রুমেই থাকতে হবে। কেমন যেন খালি খালি লাগে। বিকালের দিকে ঠিকই অস্থিরতা শুরু হয়। আজ রায়ানের সাথে দেখা হবে না। ফোন করতে পারে কিন্তু লজ্জা লাগছে। ভাবে খালাম্মার ওখান থেকে ঘুরে আসলে হয়।
খালাম্মা আপনি বাসায়? আমি কি আসতে পারি এখন?
অবশ্যই।, আস আস, এক্ষণি চলে আস। খালাম্মার বাসায় আসতে আবার অনুমতি লাগবে নাকি মেয়ে। আহারে! আগে বলবে না, ভালমন্দ রান্না করে রাখতাম।
খালাম্মার বাসায় পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া হয়। এরপর লম্বা আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। পরের দিন হন্তদন্ত হয়ে ক্যাম্পাসে যায় বুশরা। কোথায় ও? ক্লাসতো শুরু হয়ে যাচ্ছে প্রায়। এইযে এতক্ষণে আসলেন উনি। একটু উদভ্রান্ত লাগছে যেন।
হাই বুশরা, মিস ইউ ইয়েস্টারডে।
বুশরা একটু ধাক্কামত খায়, আনন্দিতও হয়। কিন্তু মুখে বলে, তাই নাকি?
ক্লাস শুরু হয়ে যায়। আবার পূর্বের রুটিন চলতে থাকে। কিন্তু ইদানীং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কেমন যেন আনমনা হয় রায়ান। লাইব্রেরীর কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওর দৃষ্টি অনেক দুরে চলে যায়, ঠিক যেন পাইন গাছের চুড়াটা পর্যন্ত বা আরো দুরে কোথাও। কিছু একটা বলতে চায়, আবার চায় না। বুশরা মেয়ে। তাই বুঝতে পারে সহজেই। এমনিতে সপ্রতিভ, স্ট্রেইট কথা বলার মানুষ। কিন্তু এ ব্যাপারে রায়ানকে বেশ লাজুক বলেই মনে হচ্ছে।
একদিন রায়ান বলে, তুমি পড়াশুনার বাইরে অন্য কিছু চিন্তা কর না?
বুশরাতো অবাক, ‘কী চিন্তা করব’?
না মানে আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতে পারি। যেমন ধরো তোমার পরিবার সম্পর্কে। তোমার দেশ, সংস্কৃতি কেমন। আমার পরিবার সম্বন্ধেও জানতে পার।
ওকে। বাংলাদেশে আমার বাবা-মা আছে, ছোট একটা ভাই আছে। আমার দেশ বা সংস্কৃতি সম্পর্কে ঠিক কী জানতে চাচ্ছ তুমি?
ঠিক বুঝতে পারছি না কী জানতে চাচ্ছি। তোমার যা মনে আসে বল।
বুশরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কোত্থেকে শুরু করবে। সেদিনের মত উঠে পরে।
আরেকদিন রায়ান বলে, ‘একটা সুন্দর মুভি এসেছে থিয়েটারে। তুমি রাজী থাকলে আজ সন্ধ্যায় দেখতে পারি’। মুভির নাম ‘লাইক ক্রেজী’।
ঠিক আছে যাব। এক কথায় রাজী হয়ে যায় বুশরা।
সিনেপ্লেক্স ওডিওন ক্রোফুট থিয়েটারে ওরা ঢুকে পপকর্ণ আর কোক হাতে। বুশরা অবাক হয়ে দেখে এক ব্রিটিশ কলেজ ছাত্রী আর আমেরিকান ছাত্রের প্রেম। বেশ রোমান্টিক প্রেম শেষ পর্যন্ত বিয়োগান্তক হয়। কারণ ছাত্রীটির ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাঁকে আমেরিকা ত্যাগ করতে হয়।
রায়ান উৎসুক চোখে তাঁকায়, ‘মুভি কেমন লাগল’?
ভাল। তুমি কি ইচ্ছা করে আমাকে এই মুভি দেখাতে নিয়ে এসেছ? ব্রিটিশ তরুণীর জায়গায় তুমি আমাকে ভাবছ? বাংলাদেশের একটা মেয়েকে?
তা বলতে পার। তোমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছি কয়েকদিন থেকে, কিন্তু কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। তাই ভাবলাম মুভি দেখে তুমি যদি বুঝতে পার।
এটা কি সম্ভব? তুমি কি জান আমাদের মধ্যে জীবন-সংস্কৃতির কত পার্থক্য! এতো কখনই হবার নয়। আমার বাবা-মা কখনই মেনে নিবেন না।
তোমার কথা ঠিক। আমি তোমাদের সম্পর্কে তেমন জানি না। সেজন্য গত কিছুদিন বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে বেশ পড়াশুনা করেছি। কিছু কিছু জানতে পেরেছি। তোমাদের ট্র্যাডিশন, কালচার এখন কিছুটা জানি। তোমাদের বিয়ের সিস্টেমও কিছু জেনেছি।
বুশরা অবাক। তুমি এসব কেন করেছ?
আমাকে সিদ্ধান্ত নেবার আগে নিজেকে রেডি করতে হবে না? পরীক্ষার আগের প্রস্তুতির মত। তুমি আমাকে প্রশ্ন করে দেখতে পার।
বুশরা প্রশ্ন করে না, জানে বইপাগল এই ছেলে সব পড়ে ফেলেছে। নিশ্চিত বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার চেয়ে ঐ ছেলেই বেশী জানে এখন।
দিন গড়িয়ে যায়। ওরা আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। পড়াশুনার ফাঁকে অনেক কথা হয়। আকাশের চাঁদটাও ওদের কথার বিষয় হয়। কথা বলে জীবন নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। রাস্তার উপর দু’টো ম্যাগপাই পাখি বসেছে, ওদের কথার বিষয় এখানেও আছে। ভালবাসাতো একেই বলে। রাতে লিন্ডার খুনসুটিতে এখন আর রেগে উঠে না বুশরা। লজ্জা লাগার একটা অনুভূতি হয়। ভাল লাগে ওর।
সিমেস্টার ব্রেক চলে আসে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ আগেই। বুশরার রেজাল্ট বেশ ভাল। সবগুলো কোর্সের গ্রেড - এ মাইনাস আর এ প্লাসের মধ্যে। ফল আর উইন্টার সিমেস্টারের মাঝে ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের ব্রেক। রায়ান উৎসাহে বলে,
চল ভ্যাংকুভার যাই। ওখান থেকে ইউক্লুলেট। একেবারে প্যাসেফিকের পাড়ে সুদৃশ্য বীচ, চমৎকার জায়গা। মহাসমুদ্রে শয্যা পাতব আমরা। তোমার ভাল লাগবে।
বুশরা না করতে পারে না। যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু খালাম্মার ফোন,
বুশরা, এখনতো সিমেস্টার ব্রেক। আমাদের এখানে কয়েকদিন থেকে যাও।
খালাম্মা ভ্যাংকুভার যাচ্ছি কালকে। ওখান থেকে এসে আপনার বাসায় আসব।
ভ্যাংকুভার যাচ্ছ মানে? কেন, কার সাথে যাচ্ছ? কোথায় থাকবে?
বেড়াতে যাচ্ছি খালাম্মা, ভ্যাকেশন ট্রিপ। আমার ক্লাসমেট রায়ানের সাথে। ওর গাড়ী আছে, ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে। হোটেল বুক করা আছে। ভ্যাংকুভার থেকে যাব ইউক্লুলেট।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। ছেলেবন্ধুর সাথে এত দূরে যাচ্ছ, তাও একা একা। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি বাতিল কর বুশরা।
এই প্রথম বুশরা একটু ধাক্কামত খায়। এভাবেতো ভাবেনি ও। তবে খারাপ কিছু ওর মাথায় আসছে না। মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নেয়, না যাবেই ও। বলে,
না খালাম্মা, কোন সমস্যা নাই। ও ভাল ছেলে। আমি ফিরে এসে আপনার সাথে কথা বলব।
বুশরারা ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার দিকে রওনা দেয় আর খালাম্মা বাংলাদেশে কথা বলে,
দুলাভাই, আমার ভয় হচ্ছে। বুশরা এক ছেলেবন্ধুর সাথে ভ্যাংকুভার যাচ্ছে। তাও আবার সাদা ছেলে। আমি অনেকবার যেতে বারণ করেছি। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বিষয়টা কিন্তু ভাল ঠেকছে না।
বল কী? দাঁড়াও আমি বুশরাকে ফোন দিচ্ছি।
হ্যালো, বুশরা?
হ্যালো, বাবা তুমি কেমন আছ?
আমি ভাল আছি মা। তুমি কেমন আছো?
এই তো ভাল। বেশ ভাল আছি।
পরীক্ষাতো শেষ। তোমার রেজাল্টে আমরা খুব খুশী হয়েছি। যাহোক, সিমেস্টার ব্রেকে খালাম্মার সাথে কিছুদিন থেকে এস।
বাবা, আমি ভ্যাংকুভার যাচ্ছি। দিন পাঁচেকের মত থাকব। ওখান থেকে ঘুরে এসেই খালাম্মার ওখানে যাব।
ভ্যাংকুভার কেন যাচ্ছ? কার সাথে?
আমার এক বন্ধুর সাথে। রায়ান, খুব ভাল ছেলে। ভীষণ মেধাবী।
বুশরা তুমি কি বুঝতে পারছ, কী করছ? অচেনা একটা ছেলের সাথে পাঁচ দিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছ। সাদাদের কালচারে এটা কোন সমস্যা না হতে পারে কিন্তু আমাদের জন্য এটা স্বাভাবিক না। তুমি কাজটা ঠিক করছ না মা।
বাবা, আমি তো বলেছি ছেলেটা ভাল। কোন সমস্যা হবে না।
মা, তুমি বড় হয়েছ। তোমার যা ভাল মনে হয় কর। আমি বাঁধা দিব না। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল রেখ, আমাদের যেন কারো কাছে জবাবদিহি করতে না হয়।
বুশরা রওনা দেয়।
এদিকে বুশরার বাবা ওর খালাম্মাকে টেলিফোন করে,
আমি বুশরার সাথে কথা বলেছি। ও যাবেই। আমারও বিষয়টা ভাল ঠেকছে না। তুমি কষ্ট করে বুশরার যে রুমমেট আছে লিন্ডা ওর সাথে কথা বলে দেখ। নিশ্চয় ও কিছু বলতে পারবে রায়ান সম্পর্কে?
ঠিক আছে দুলাভাই।
খালাম্মা নিজেই বুশরার হোস্টেলে যায়, লিন্ডার সাথে কথা বলতে। লিন্ডার কথা শুনে উনার মাথায় হাঁত। তলে তলে এতদুর!
লিন্ডা একেবারে নিশ্চিত করে বলে, ‘দে আর ইন লাভ। কিন্তু তোমরা এত উদ্বিগ্ন কেন? রায়ান ভাল ছেলে, ওদের ক্লাসের সবচেয়ে মেরিটরিয়াস। বুশরা লাকি যে রায়ান ওর প্রেমে পরেছে।‘
হোস্টেল থেকে এসে খালাম্মা বাংলাদেশে ফোন দেয়, ‘পুরো বিষয়টি খুলে বলে’।
বুশরার বাবা যেন আকাশ থেকে পরে, ‘আমার মেয়ে একাজ করতে পারল? আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ক্যালগেরি আসছি।‘
দিন চারেক পরেই উনি ক্যালগেরিতে হাজির। সারা পথ কাঁদতে কাঁদতে এসেছেন। এরিমধ্যে বুশরাও ফেরত চলে এসেছে। খালাম্মাই ফোন করে,
বুশরা তোমার বাবা এসেছে। আমাদের বাসায় আছে। তুমি এখনি চলে এসো।
বুশরা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে। বাবা এসময় এখানে। খুবই সিরিয়াস কিছু না হলে তো এখন বাবার আসার কোন কারণ নেই। তারমানে বাবা সব জেনে গেছেন। এখন কী হবে?
বাবা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে, ‘বুশরা তুমি সত্যি করে বল ঐ ছেলের সাথে তোমার কী সম্পর্ক।‘
ছোটবেলা থেকেই সত্য বলে অভ্যস্ত বুশরা, এবারেও ব্যতিক্রম করে না। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘বাবা ওকে আমি ভালবাসি। ও খুব ভাল ছেলে। বিদেশী হলেও ওর চিন্তাধারা, মানসিকতা আমাদের মতই। আর আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। তুমি ওর সাথে কথা বলে দেখতে পার।‘
তাহলে এটাই তোমার শেষ কথা।
জ্বী বাবা।
তোমার একটু ভেবে দেখা উচিৎ ছিল যে আমাদের আর ওদের মধ্যের ব্যবধান। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের সাথে আলোচনা করতে পারতে?
বাবা, ভালবাসা আলোচনা করে হয় না কখনো।
ঠিক আছে, এ নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না। তোমার মার সাথেও কথা বলেছি। আমাদের পক্ষে তোমার এই সম্পর্ক কোনভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আমি বাংলাদেশের টিকেট কাঁটছি। তুমি সবকিছু গুছিয়ে নেও। দেশে চলে যাব।
বল কী, বাবা? আমার পড়াশুনা?
দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিব। আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।
আর কথা বাড়ায় না বুশরা। জানে বাবা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে। সুতরাং কথা বলে লাভ নেই। হোস্টেলে যায় সবকিছু গোছাতে। কাঁদতেও ভুলে গেছে ও। জানে না কীভাবে রায়ানের মুখোমুখি হবে। কী বলবে ওকে। বাবা-মা রাজি না তো তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি – এদেশের কালচারে এটা নেই। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক ওরা। ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এখানে। কিন্তু বুশরা এটা পারবে না। বাবা-মার অমতে কিছুই করতে পারবে না। ওর সাধ্যের অতীত।
বিকালে রায়ান আসে। বুশরা সব খুলে বলে, ধীরে ধীরে। রায়ান ওর বাবার সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু বুশরা রাজী হয় না। বলে, এতে কোন লাভ হবে না। তারচেয়ে তুমি আমাদের বিষয়টা ভুলে যাও। আমি চলে যাচ্ছি, সময়ে তুমি এমনিতেও ভুলে যাবে।
রায়ান কিছুই বলে না। শুধু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। নীল চোখদুটি জলে ভরে উঠছে। কিন্তু না, সামলে নেয় ছেলেটা। বড় শক্ত এদের গঠন। কোন ভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। আমি জানি ভেতরে ভেতরে গ্লুটিন-ফ্রী পাউরুটির মত খুলে খুলে যাচ্ছে ও। কিন্তু উপরে ঠিকই প্রলেপটা দেয়া আছে। কিন্তু চোখ, ঐ চোখেই লেখা আছে সব কষ্ট, সব ব্যাথা।
বুশরার ফেরার শুরু। প্রিয় রায়ান, প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে ওকে। ফিরে যেতে হবে বাংলাদেশে। বড় আশা করে দেশ ছেড়েছিল – উন্নত বিশ্বে যাচ্ছে। ওখানে লেখাপড়া করে মস্ত একটা কিছু হয়ে যাবে। আজ ফিরে যাচ্ছে শুন্য হাতে। নিয়ে যাচ্ছে একরাশ মন খারাপ করা কষ্টের স্মৃতি। ফিরতি প্লেন ক্যালগেরি ছাড়ার সাথে সাথে বুশরা তাঁর সব দুঃখ সব বেদনা একসাথে বের করে দেয়। দৌড়ে প্লেনের ওয়াশরুমে ঢুকে ছেড়ে দেয় চোখের সব জল, ফ্লাশফ্লাডের তীব্র স্রোতের মত। এত জল কবে থেকে চোখে জমা ছিল ও নিজেই বুঝতে পারেনি। ঝাপসা চোখে সিলভার রংয়ের বেসিনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের নোনা জল আর ট্যাপের পরিষ্কার জলের মাখামাখি, সময় যেন থমকে গেছে এখানে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭১৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ভালো লাগলো
 
Quantcast