www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

লিভ টুগেদার

রোহিণী ঠিক বুঝতে পারেনা, সমস্যাটা কোথায়।
‘Lucy’ মুভির স্কারলেট জোহানসনের মত ছোট চুলের ছাঁট দিয়েছে। সালোয়ার-কামিজ ছেড়ে স্কার্ট-টপস ধরেছে ক্যালগেরি আসার কিছুদিনের মধ্যেই। পার্টি-ড্যান্সগুলো যেমন, ব্যালে, ট্যাঙ্গো, সালসা, সাম্বা, হিপ-হপ সবগুলো অলরেডি শিখে নিয়েছে। শর্ট পোষাকের মত নামটাও শর্ট করে ফেলেছে, ‘রুহি’। বন্ধু বিচারে ছেলেমেয়ের ধার ধারে না। সাদা-কালো নিয়েও মাথাব্যাথা নেই। মোটকথা এদের একজন হতে চায় ও। সাদাদের মত হতে চায়। তারপরও কোথায় যেন একটা ছেঁদ। বাড়ন্ত বৃক্ষচারা যেমন সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে সর্বদাই। কিন্তু সূর্য্য পাত্তা দেয় না, ঠিকই অস্ত চলে যায় । ক্লাসমেটরাও শেষমেশ তাচ্ছিল্য ভরে দেখে ওকে। যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ ঠিক ততটা জোটে না ওর। রোহিণী ঠিক ধরতে পারে না, কারণটা কী? একটা দুর্বলতা অবশ্য আছে, ভাষাটা এখনো স্থানীয় ইংরেজী ভাষাভাষীদের মত হয়নি।
ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা দিচ্ছে। রোহিণীসহ আরো চারজন। গ্যারেথ, ক্রিস, অ্যাডা আর মার্কো। কদিন পর ক্রিসমাস। ওরা প্লান করছে ক্রিসমাস ডিনারটা কোথায় করবে। মার্কোর প্লান কী?
’সেন্টার স্ট্রীটে একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে, স্কুপা নেইবারহুড ইটালিয়ান। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এটাই বেস্ট ইটালিয়ায়ন ফুড এই শহরে। ক্রিসমাসে স্পেশাল মেনু হবে। আমরা ওখানে যেতে পারি।‘ মার্কো উৎসাহের সাথে বলে।
আলবেনিয়ান অ্যাডা নিরুৎসাহিত হয়, ‘তুমি ইটালিয়ান, তাঁই খেতেও চাও তাই। মানলাম ইটালিয়ান ফুড টেস্টি। তাই বলে সবসময় ইটালিয়ান খেতে হবে কেন? এবার জাপানিজ খাই চল। কিঞ্জোতে গেছো কখনো? সুপার সুশি বানায়।‘
ক্রিস আর গ্যারেথ স্থানীয় ছেলে। ক্যালগেরি ওরাই সবচেয়ে ভাল চেনে। ক্রিস ঠিক সারমর্মের মত করে বলে, ‘আমি একটা প্রস্তাব দেই। ফেয়ারমন্ট প্যালিসার ক্রিসমাস ডিনার বাফে অফার করেছে। বিভিন্ন দেশের খাবার আছে বাফেতে। ভ্যারাইটিজ চয়েজ। ইটালিয়ান পাওয়া যাবে আবার জাপানিজ সুশিও আছে। গ্যারেথ, তুমি কী বল?’
‘আমি তোমার সাথে একমত।‘ গ্যারেথের তৎক্ষণাৎ জবাব।
ওকে, আমরা ক্রিসমাস পার্টি ডাউনটাউনের প্যালিসারে করছি।
‘ওয়েট আ মিনিট। তোমরা কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছ না। আমার মতামত নিচ্ছ না।‘ রোহিণী ঝাঁঝের সাথে বলে।
‘কাম ওন, রুহি। তুমিতো এখানকার রেস্টুরেন্ট সম্বন্ধে ভাল জান না। আর তুমি মুসলিম, ক্রিশ্চিয়ানও না। তাই ক্রিসমাস ডিনার নিয়ে তোমার সাথে আলোচনার প্রয়োজন নাই। তুমি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পার।‘ সবাই প্রায় একসাথেই বলে উঠে।
রোহিণীর রাগ চরমে উঠে, ‘এটাই যদি তোমাদের অভিমত হয়, তাহলে আমি তোমাদের সাথে যাব না’।
ওকে, নো প্রব্লেম। সী ইউ রুহি। মেরি ক্রিসমাস।
রোহিণীর কান্না পেয়ে যায়। এত কিছু করে এই বন্ধুদের জন্য, কিন্তু ওরা অবলীলায় তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারে। বুঝতে পারে না কীভাবে কী করলে ও সমান গুরুত্ব পাবে, ওদের একজন হবে। প্রায় দু’বছর হয়ে গেল সাউদার্ন আলবার্টা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (সেইট)-এ পড়ছে ও, পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা। আগামী উইন্টারে গ্রাজুয়েশন শেষ হবে। সবসময় চেষ্টা করেছে বাঙ্গালীদের এড়িয়ে সাদাদের সাথে মিশতে। বাঙ্গালীদের কেমন গেঁয়ে আর ন্যাঁকা মনে হয়, মিশতে ভাল লাগে না। আর হোয়াইটদের সাথে থাকলে স্ট্যাটাসটাও বেড়ে যায়। তাই ওর প্রায় সকল বন্ধুই সাদা, মাত্র দু’একজন সহপাঠী বাঙ্গালী বন্ধু আছে।
রোহিণী পার্টিপ্রাণ। ক্রিসমাস পার্টিতে না গেলে যে মরেই যাবে! ধরে নিয়েছিল এবারের ক্রিসমাস পার্টি ও গ্যারেথদের সাথেই করবে। কিন্তু এদের কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে আরো কয়েকজন সাদা বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে রোহিণী। কিন্তু দূর্ভাগ্য সবাই বুকড। কোন গ্রুপের সাথেই জায়গা পায় ন। মনে হচ্ছে নিজের চুল নিজেই ছিড়বে। কী কুক্ষণে যে অত ভাব ধরতে গিয়েছিল গ্যারেথদের সাথে! মনে মনে ভাবে, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের ব্রাউন। সাহেবদের সাথে থাকছি এইতো বেশী, আবার অভিমান করে দাবী ফলাতে গেছিস। এখন দেখ কেউ তোর সাথে নেই। অগত্যা বাংলাদেশি বন্ধু সাদাতকে ফোন দেয়।
‘হ্যালো, কে রোহিণী?’ সাদাত খুশী হয়।
‘এই সাদাত, তোমাকে না কতদিন বলেছি আমাকে রোহিণী ডাকবে না। রুহি বলবে।‘, রাগে গা জ্বলে রোহিণীর। কিন্তু মাথা ঠান্ডা করতে হবে, রাগলে চলবে না।
‘স্যরি রুহি, ভুল হয়ে গেছে। এবার বল কেন ফোন করেছ? তুমি তো আবার বাঙ্গালীদের সাথে কথাই বল না।’ সাদাতের টিটকারি।
কী যে বল না? বাঙ্গালীদের সাথে কথা বলব না কেন। আসলে গ্যারেথদের সাথে থাকায় তোমাদের সাথে সময় হয়ে উঠে না। তোমাদেরকে সবসময়ই আপন ভাবি আমি। রাফিন আর কৃষিতা কেমন আছে? ওদের সাথে দেখা হয় না অনেকদিন।
ওরা ভাল আছে। তোমার কথা বলে মাঝেমধ্যে।
‘আচ্ছা, ক্রিসমাসে কী করছ তোমারা?’ রোহিণী আগ্রহের সঙ্গে বলে।
রাফিনের অ্যাপার্টমেন্টে পার্টি হবে। কিছু বন্ধুবান্ধব আসবে। খাওয়াদাওয়া করব একসাথে আর আড্ডা হবে। স্কুলের বাইরের কিছু বন্ধুও থাকবে। তবে তোমাকে বলে রাখছি কোন সাদা বন্ধু নেই ওখানে।
‘আরে দুর! সাদাদের কথা কে জিজ্ঞাসা করেছে। আমি কি তোমাদের পার্টিতে আসতে পারি?’ রোহিণীর দ্বিধার কণ্ঠ।
‘ও বুঝেছি। গ্যারেথরা তোমাকে নেইনি তাই না? আমি এটাই ভাবছিলাম। তুমি আমাকে ফোন করেছ, নিশ্চয় কোন কারণ আছে।‘, সাদাত শ্লেষের সাথে বলে।
সত্যি বলছি, তা না। আমি এবার তোমাদের সাথে ক্রিসমাস কাঁটাতে চাই। প্লিজ না কোর না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আসতে পার। তবে আমরা কিন্তু কোন অ্যালকোহল রাখছি না।
ঠিক আছে, কোন সমস্যা নাই। দেখা হবে সেদিন। মেরি ক্রিসমাস, সাদাত।
যথাসম্ভব বাঙ্গালী সাঁজে পার্টিতে যায় রোহিণী। আড়ং থেকে কেনা নীলের উপর কালো কাজ করা সালোয়ার-কামিজের সাথে ওড়নাটা কাঁধের উপর ফেলে দেয়। রাফিনের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ওর ভালই লাগে। দশ/বারোজন হবে। সব ব্যাচেলররা মিলে রান্না করেছে। রাফিনের গার্লফ্রেন্ড কৃষিতা সাহায্য করেছে অবশ্য। খিচুড়ী আছে, টার্কির গ্রিল আর গরুর মাংশ, নানরুটিও আছে। সব্জি করেছে, সিজার স্যালাদ, স্মোডক স্যামন মাছও আছে। ডেজার্ট হিসেবে ঘরে বানানো পুডিং আর কিনে আনা ক্রিসমাস কেক। মনে মনে ভাবে, ঈশ! সাথে শুধুমাত্র ওয়াইন বা বিয়ার থাকলেও জমত।
সাদাত, রাফিন আর কৃষিতা ছাড়া কাউকে চিনে বলে মনে হচ্ছে না। সোফার ঐদিকটাতে একটা ছেলে বসে আছে, চুপচাপ। ব্যয়ামকরা শক্তসমর্থ যুবক লাগছে। মাসলগুলো টি-শার্ট ছিড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। লম্বা চুল পিছনে ঝুটি বাঁধা। চেহারায়ও একটা ম্যানলি ভাব আছে। একমনে সকলের কথা শুনছে, তবে নিজে কিছু বলছে না। সাদাতই পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘এ হচ্ছে রুহি। সেইটে ডিপ্লোমা করছে। অলমোস্ট শেষ।‘ একে একে সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দেয়। শেষে ঐ যুবকের সাথে - নাম সূচক, ভাল কবিতা আবৃতি করে।
ওর পাশেই বসার জায়গা থাকায় রোহিণী বলে, ‘হেই সূচক, আমি কি এখানে বসতে পারি?’
‘অবশ্যই পারেন। বসেন।’ ভরাট গলা যুবকের।
আপনার নামটা কিন্তু সুন্দর। কে রেখেছে?
‘আমার বড় চাচা। উনি শেয়ার ব্যবসা করেনতো তাই সূচক শব্দটি সবসময় মাথায় ঘোরে।‘ শব্দ করে হেসে উঠেন উনি। রোহিণীর বেশ লাগে হাসিটা।
আমি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা করছি সেইট-এ। আর এক সিমেস্টার আছে। আপনি কী করছেন?
এই তো পড়াশুনা শেষ করলাম, একাউন্টিং। এখন ডেভন এনার্জিতে, একাউনটেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট। দু’বছর হয়ে গেল প্রায়।
‘বাহ, বেশতো! তেল কোম্পানীতে আছেন। আমি পাশ করলে আমাকে ডেভনে একটা চাকুরী দিবেন কিন্তু।‘ হাসতে হাসতে বলে রোহিণী।
এদিকে আড্ডা জমে উঠেছে। রাফিন বলে উঠে, ‘দেখছিস, এরশাদ চাচা আরো একটা বিয়ে করেছে। তৃতীয় নাম্বার।‘
‘তাই নাকি? কোন সমস্যা নেই চার পুরা করতে আরো একটা লাগবে।‘ অচেনা কে যেন বলে উঠে।
খালেদ ভাই সবার সিনিয়র। গম্ভীর গলায় বলেন, ‘এখানে কে কে বিশ্বাস করে যে মুসলমানের চারটা বিয়ে করা বৈধ?’
দেখা গেল প্রায় সকলেই।
উনি একটু উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ’কথাটা কিন্তু ঠিক না। তোমরা আমার কথা শুনলেই বুঝবে এটা মিথ্যা। ব্যাখ্যা করে বলছি। মন দিয়ে শুন প্লিজ।’ খালেদ ভাই বরারবরের মত দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করেন।
ক্যালগেরিতে পুর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কয়েকটি পর্যায়ে ফেলা যায়, যেমন ধর স্বামী-স্ত্রী, কমন-ল-পার্টনার, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। যেকোন একটিকেই বৈধ স্বামী-স্ত্রী বলে ধরে নিয়ে জীবন-সংসার চলতে থাকে। তবে যৌনাচারের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বাছবিচারে সবসময় এ রিলেশন মানা হয় না। সম্প্রতি মেরিল স্ট্রিপ অভিনীত ‘The Devil Wears Prada’ দেখেছি। মুভিতে Anne Jacqueline Hathaway তাঁর বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মহাসুখে আছে, গভীর প্রণয়। এক পর্যায়ে অন্য এক পুরুষের সাথে তাঁর সাময়িক পরিচয় হল এবং তাঁরা বিছানায় গেল। আবার পূর্বতন প্রেমিকের কাছে ফেরত আসল। হলিউডের বহু মুভিতেই একের অধিক পুরুষ বা মহিলার সাথে সহবাসের উদাহরণ আছে। তাঁর মানে সামাজিকভাবে কিছুটা নেতিবাচক হলেও এ সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা আছে। নতুন যৌনসংগী খোজার রেসিপি হল এরকম – একটু কথাবার্তা বল .... দু’একটা উপহার দাও .... একদিন ডিনার করাও ...গ্যালনখানিক মদ গিলিয়ে বিছানায় নিয়ে যাও। কাজটি ভাল না খারাপ, বৈধ না অবৈধ এনিয়ে আমার মাথাব্যাথা নাই।
কিন্তু মাথাব্যাথা হল আমাদেরকে অপমান করা নিয়ে। আমার সহকর্মী অধিকাংশই সাদা। ‘তুমি মুসলিম! ইউ আর লাকি, চারটা বিয়ে করতে পার’, ওদের কেউ কেউ বলে। কেউ একটু রসিয়ে বলে, ‘একসাথে চারটা বউ তোমরা কীভাবে মেইনটেইন কর?’। এরা অজ্ঞ। এরা বর্বর সৌদি সমাজব্যবস্থার সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলে। আমি বলি, ‘দেখ, একজন প্রকৃত মুসলিম কোরাণ-হাদিস মেনে চলে’। পবিত্র কোরাণে এ সম্পর্কে একটা আয়াত আছে, ‘And if you fear that you will not deal justly with the orphan girls, then marry those that please you of [other] women, two or three or four. But if you fear that you will not be just, then [marry only] one or those your right hand possesses. That is more suitable that you may not incline [to injustice]. সুরা আননিসা(৪-৩)। এই আয়াত কোনভাবেই একজন মুসলমানকে একসাথে বহুবিবাহের অনুমতি দেয় নাই। মহান প্রফেটগণ ব্লেসড, তাই উনাদের কথা আলাদা। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে একের অধিক স্ত্রীর সাথে ‘just’ করা পুরোপুরি অসম্ভব। তাই আজ পর্যন্ত যারা একইসময়ে একের অধিক স্ত্রীর সাথে জীবনযাপন করছেন, তাঁরা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় করেছেন। ইসলামে বহুগামীতা অন্যায়। আগেই বলেছি এই সমাজে বহুগামীতা অন্যায় নাও হতে পারে।
খালেদ ভাইয়ের কথা শেষ হবার পর সবাই চুপ। পার্টিও কেমন নিস্তেজ হয়ে যায় আস্তে আস্তে। যে যার মত বাড়ী ফিরতে থাকে। রোহিণী সূচককে বলে, ’আপনি কবিতা পড়েন, আর আমিও একটু-আধটু গান গাইতাম আগে। এতদিন পড়াশুনার চাপে এবং বাঙ্গালীদের সাথে কম যোগাযোগ থাকায় গান গাওয়া হয় নি। এখন থেকে দেখা হবে আপনার সাথে, ক্যালগেরির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।‘
দুজনেই বিদায় নেয়। রোহিণী ফাইনাল সিমেস্টার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পরে। আর মাত্র এক সপ্তাহ। পহেলা বৈশাখও এসে যায়। তবে গুড নিউজ ততদিনে ওর পরীক্ষা শেষ। ঠিক করেছে এবারের অনুষ্ঠানে গান গাইবে। যথারীতি রিহার্সেল করে অনুষ্ঠানে যায় ও। অনেকদিন পর পুরো বাঙ্গালীদের মাঝে, খারাপ লাগে না।
এই যে সূচক ভাই, কেমন আছেন? চিনতে পেরেছেন?
আরে রুহি যে। চিনব না কেন। ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন? মনে হচ্ছে গাইবেন, অনুষ্ঠানসূচীতে আপনার নাম দেখলাম।
আপনার আবৃতিও শুনব কিন্তু।
পুরো বিকাল-সন্ধ্যা মার্লবোরো কমিউনিটি সেন্টারে কাঁটিয়ে দেয় ওরা। পরস্পরের পারফর্মেন্স দেখে, আলোচনা-সমালোচনা করে। একসময় টেলিফোন নাম্বার দেয়া-নেয়া হয়। ‘আবার কথা হবে’ এভাবেই বিদায় নেয় দু’জন।
কথা হয়ও। পরের দিন থেকেই কথা শুরু হয়। প্রায় প্রতিদিনই ওরা ফোন করে একে অপরকে।
‘হ্যালো, কী খবর? কেমন আছেন?’ সূচকই ফোন করে বেশী।
‘ভাল আছি। আচ্ছা, আপনিতো বয়সে আমার বড়। আমাকে আপনি বলেন কেন?’
‘তা ঠিক। তবে শুরুতেই আপনি বলে ফেলায় এখন তুমি বলতে বাঁধো বাঁধো ঠেকছে।‘ সূচক আমতা আমতা করে বলে।
‘ওকে এখন বাঁধটা ভেঙ্গে ফেলেন। এটাতো আর ফারাক্কা না যে ভাঙ্গা যাবে না।‘
‘ওকে এখন থেকে তুমি। তাহলে তোমাকে একটা প্রস্তাব দেই। আগামীকাল আমি হাইকিং-এ যাবো। প্রথমে ব্যানফ শহরে যাব গাড়ীতে, ওখান থেকে সানশাইন মিডোস ট্রেইল ধরে হাঁটা। মোট দুই ঘণ্টার ট্রেইল, আসা যাওয়া মিলিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার। ট্রেইলটায় আপহিল-ডাউনহিল কম, অন্যান্য ট্রেইল থেকে তুলনামূলক প্লেইন। যাবে নাকি?’
এমা! আপনি হাইকিং করেন! আমারতো খুবই পছন্দ। কাল বন্ধ আছে। ঠিক আছে আমি যাব। বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে বলা হয় নি আমার হাস্কি এনার্জিতে চাকরিটা হয়েছে। রিজার্ভ্যয়ার টেকনোলজিস্ট।
গুড নিউজ। কংগ্রাচুলেশন। তাহলে কাল সকালে তোমাকে তুলে নেব, ওকে।
সি ইউ টুমরো।
সকাল সকালেই বেড়িয়ে পরে ওরা। যথাসম্ভব ব্যাকপ্যাকার-টাইপ প্রস্তুতি। শর্টস, নন-স্লিপারি কেডস, পাতলা টি-শার্ট, রাউন্ড হ্যাট, সাথে হ্যাভারস্যাক। হাঁটা শুরু করে ধীরে ধীরে। কিছুদুর পরেই বনের মধ্যে ঢুকে যায়। নিঃশব্দেই চলছিল ওরা। হঠাৎ নীরবতা ভাঙ্গে রোহিণী।
কি ব্যাপার? কচ্ছপের মত শব্দহীন হেঁটে যাচ্ছেন। কিছু একটা বলেন? আচ্ছা, একটা কবিতা বলেননা।
এখনতো ক্লান্ত! এসময় কবিতা কীভাবে হবে?
আরে বলেননা একটা।
আস, এই গাছের গুড়িটায় বসি। একটু রেস্ট নেই আগে।
নেন এখন শুরু করেন।
কবিতা পরে আগে চারিদিকটা তাকিয়ে দেখ। সামনে সবুজ জলের লেক। চারিদিকে ঘন বন। কোন শব্দ নেই, ঝিঁঝিঁ পোকাও ডাকছে না। প্রকৃতির নীরবতা এখানে হিরণ্ময়। এখানে এই জলের ঠিক কিনারে বসবে দুজন, পাশাপাশি। তাকিয়ে রবে জলের আয়নায় নিজেদের দিকে, একে অপরের দিকে। বিনিময় হবে রাজ্যের সব ভাবনা, এক নতুন ভাষায় নিঃশব্দে। হঠাৎ কোত্থেকে একটা কাক এসে ডানা ঝাপটে বলবে কা কা, নিঃশব্দকে খান খান করে দিয়ে। চকিতে দুজন দুজনকে দেখবে, অন্যচোখে।
কল্পনা খারাপ লাগে না কী বল?
না, ভাল লাগে তবে কল্পনা কল্পনাই। বাস্তব বড় নির্মম। দেখেন কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি, ঝিমিয়ে পরছি। তারচেয়ে আপনি একটা কবিতাই বলেন।
রবীন্দ্রনাথ শুনবে? শুন তাহলে,
‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।‘
আপানি আমাকে প্রেমের কবিতা শুনাচ্ছেন কেন? আপনি কি আমার প্রেমে পরেছেন নাকি?
সেটা কী আমার অন্যায় হবে?
রোহিণী ক্ষীণস্বরে বলে, ’না, অন্যায় হবে না তবে...। আচ্ছা বাদ দেন, চলেনতো হাঁটি।’
পুরো ট্রেইলটা শেষ করতে ওদের ঘণ্টা তিনেক লেগে যায়। আরো কবিতা হয়, গান হয়। চলে খুনসুটি। প্রায় অন্য মানুষ হয়ে রোহিণী ঘরে ফিরে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কিন্তু চিত্ত চঞ্চলা। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই সারা শরীর ব্যাথা, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যেন।
সূচকের ভীষণ মন খারাপ হয়। সেলফোনে টেক্সট দেয়, ‘তোমার জ্বরের খবরে খারাপ লাগছে। তুমি ভাল থাক, তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে উঠ। এ মুহুর্তে একটা দৃশ্য চোখে ভাসছে। একেবারেই গ্রামে চলে এসেছি। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষাকাল। চারিদিক পানিতে থৈ থৈ, সবুজ কচুরীপানার মাঝে নৌকা চলার একচিলতে পথ। ছোট্ট একটা নৌকায় বসে আছি, বৈঠা হাতে। হাত বন্ধ, চোখ খোলা। নৌকার অপর পাশে তুমিই বসে আছ। খোঁপাবিহীন চুল বৃষ্টির পানিতে ভেজা, চুয়ে চুয়ে জল ঝরছে ওখান থেকে। জ্বরের তাপে চোখদুটো ঈষৎ ঘোলাটে। নীল রংয়ের ভেজা শাড়িটা শরীরে লেপ্টে আছে, বৃষ্টির ফোঁটা সব তাপ শুষে বাতাসে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।‘
টেক্সট পড়ে রোহিণীর শরীরে ভাললাগার স্রোত বয়ে যায় মুহুর্তেই। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠে। কিন্তু ওর রক্তে যে পশ্চিম ঢুকে গেছে এখানে আসার পরপরই। অনেকদিন নাইটক্লাবে যায় না, ড্রিঙ্কস হয় না। তাই দুদিন পরে সূচককে ফোন দেয়, ‘সূচক, চল এই উইকএন্ডে টুইস্টেড এলিমেন্টে যাই। ড্রিঙ্কস আর নাচ হবে। নতুন এক ডিজে এসেছে ওখানে। সকলের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।‘
সূচকের এগুলো ঠিক যায় না, দোনামনা করে। কিন্তু রোহিণী এত করে বলছে, নাও করতে পারে না। প্রায় ভোররাত অব্দি অ্যালকোহল-মিউজিক-নাচে মেতে থাকে ওরা। রোহিণী যেন আকাশে উড়তে থাকে, ভাবে যেন ‘ফুল অব লাইফে’ আছে। কিছুটা বেসামাল, সারা শরীরে ভালবাসার ভাললাগা। খেই হারিয়ে ফেলে। বলে, ‘এখন বাসায় যাব না, তোমার ওখানে যাব।’
সূচক একটু থতমত খায়, ‘আমার ওখানে মানে?’
হ্যা, তোমার ফ্লাটে যাব। তুমি আমাকে ভালবাস তাই না? তবে তোমার ওখানে যেতে সমস্যা কোথায়?
‘তা ঠিক।‘ নেশার ঘোরে সূচক ভালমত চিন্তাও করতে পারে না। একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে সূচকের ফ্লাটে চলে যায়। যাবার পথে বোস্টন পিজা থেকে ন্যাচো অর্ডার দেয়। দুজন পূর্ণবয়স্ক যুবক-যুবতি দেশ থেকে এবং সমস্ত সামাজিক নিষেধাজ্ঞা থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে পরস্পরের নিঃশ্বাসের দুরত্বে। প্রকৃতি বাঁধা দিতে পারে না। ভরপেট খেয়ে আদিম খেলায় মেতে উঠে।
সকালে বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে সূচক। রোহিণী তখনো ঘুমুচ্ছে। চকিতে সব মনে পরে যায়। শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে অপরাধী লাগে, এভাবেতো ও চায়নি। নিঃশ্বাসের শব্দে রোহিণী জেগে উঠে। একটু লজ্জা পায় মনে হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে উঠে। জোর দিয়ে বলে, ‘আমি কিন্তু আর আমার অ্যাপার্টমেন্ট ফিরে যাচ্ছি না। আমি এখানেই থাকব।‘
‘কী বলছ এসব? এখানে থাকবে মানে? আমাদের রিলেশনটা কী?’ সূচক আকাশ থেকে পরে।
কেন আমরা লিভ-টুগেদার করব। উই আর কমন-ল-পার্টনার বাই ল। এটা কানাডায় বৈধ। তোমার কোন সমস্যা আছে?
রোহিনীর দৃঢ়তা দেখে সূচক চুপসে যায়। এটা সম্ভব, তবে ঠিক মানতে পারে না। বলে, ‘আমরাতো বিয়ে করেই থাকতে পারি। তুমি তোমার বাবা-মার সাথে কথা বলতে পার’।
বাবা-মাকে একথা বলা যায়? তাছাড়া উনারা কখনই রাজী হবে না। আমার জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছেন তাঁরা। আর আমি নিজেও বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আর শীঘ্রই বাচ্চাও নিব না। লাইফটা এনজয় করি আগে।
নাইটক্লাব, ভ্রমণ-হাইকিং, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, হপ্তায়-হপ্তায় মুভি দেখা সাধারণ ব্যাপার হয়ে যায় ওদের। বাঙ্গালী কালচারাল প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার সময় পায় না তেমন। এরমধ্যে একদিন রোহিণী বরফে পিছলে পরে হাঁটুর নীচে ফ্রাকচার করে ফেল। হাসপাতালে থাকতে হয় কয়েকদিন, প্রচন্ড কষ্ট পায়। প্রথম দিনের কষ্ট দেখে সূচক সহ্য করতে পারে না। দার্শনিকদের মত করে টেক্সট লিখে ফেলে একটা।
‘শুরু থেকে এ পর্যন্ত কত কত জীব দুনিয়াতে এসেছিল। তাঁর কতকগুলো টিকে আছে, আবার কেউ কেউ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক নির্বাচন বা কৃত্রিম নির্বাচনই ঠিক করে দেয় কে থাকবে কে থাকবে না। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে এসব জীবের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। তবে পাঁচটি সময়ে মেজর বিলুপ্তি ঘটেছে। তার মধ্যে পারমিয়ান যুগে অর্থাৎ আজ থেকে ২৫ প্রায় কোটি বছর আগে সবথেকে বেশি বিলুপ্তি ঘটেছে। দুনিয়ার প্রায় ৯৬ শতাংশ জীব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই এটাকে বলে ‘The Great Dying’. মাত্র যে ৪ শতাংশ ছিল তা থেকেই আবার জীবের বিবর্তন হয়েছে, মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে।
গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেই বললেন, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখে থাক’। আমি উনার মতই মানুষের শুধু সুখ কামনা করি। সকলের দুঃখ-কষ্ট দুর হয়ে যাক, এটাই আমার আন্তরিক চাওয়া। মানুষের দুঃখে আমার বুকের মধ্যে লোনাপানির যে নদীটা আছে তা বাস্পীভূত হয়। আমার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠে। আরো ঘনীভূত হয়ে জলের আকার ধারণ করে। টুপ টুপ করে পরে যাবার আগেই আমি মাথা নিচু করে ফেলি। হাটুর ভাজে লুকিয়ে নিরবে-নিঃশব্দে ঝাপসা চোখে চেয়ে দেখি লোনাপানির ফল্গুধারা। বিধাতাকে প্রশ্ন করি, কেন পারমিয়ান যুগে ৯৬ শতাংশ না হয়ে পুরো জীবজগৎ বিলুপ্ত করে দিলে না? দুনিয়াতে আর কোন প্রাণ থাকতো না, কোন দুঃখ থাকত না, কষ্ট থাকত না। অন্তত তোমাকে এখন কষ্ট পেতে হত না।‘
রোহিণী ভাল হয়ে উঠে। স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা থেকে সেনসাস করতে আসে ওদের ফ্লাটে। নাম-ঠিকানা, পড়াশুনা, চাকুরীর তথ্য আরো কত কী চায়! এক জায়গায় আছে দুজনের রিলেশন কী? ওরা একটু থমকে যায়। ওকে, উই আর কমন-ল-পার্টনার। অফিসিয়ালি কানাডায় এটাই ওদের পরিচয় এখন। দুজনে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত উদ্দাম জীবনে ভেসে যায়। তীব্র ভালবাসায় সিক্ত হয়ে নানাবিধ পাগলামি ভর করে ওদের। প্রতি উইকএন্ডেই নাইটক্লাবে যায়। পার্টি মিউজিকের সাথে উদ্দাম নাচানাচি অ্যালকোহল পান কেমন নিত্য হয়ে যায়। অভিভাবকহীন প্রবাস জীবন বল্গাহীন ঘোড়ার মত ছুটতে থাকে।
আস্তাবলের সবচেয়ে তেজি ম্যাসট্যাং ঘোড়াটাও একসময় ক্লান্ত হয়। ভরা পূর্ণিমাও ফিকে হয়ে আসে, মোম যত জ্বলে গলেও তত। ওদের কাছেও এই উদ্দেশ্যহীন জীবন পানশে হয়ে আসতে থাকে। আর কত? বাসায় খুটিনাটি লাগা শুরু হয়। ডিশ ধোও না কেন? ওয়াশরুম শেয়ার করে পরিস্কার করতে হবে। রান্না-বান্নাও শেয়ার করতে হবে। ক্যাটারিং থেকে খাবার আনতে হবে, রান্না বন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। তার চেয়েও বড় বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত বাঙ্গালীদের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দুই ভাবীর কথোপকথন শুনে ফেলে ওরা।
ভাবী, ইদানিং সূচক-রোহিনীদের দেখছি না। কবিতা-গানও তেমন করছে না। ব্যাপার কী?
আর বলবেন না, বিয়ে-থা করেনি একসাথে থাকে। তাও আবার এক ফ্লাটে, লীভ-টুগেদার করছে। টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। কী সমাজে যে এসে পরলাম! ছেলেমেয়ে দু’টোকে নিয়ে চিন্তায় আছি।
বলেন কী? এটাতো শুনিনি আগে। এনিওয়ে, এটা ওদের পারসোনাল ব্যাপার। তবে আবৃতিটা খুব ভাল করে ছেলেটা।
এসব কথা এখন ওদের কানে বাজে। বিশেষ করে রোহিণীর মনটা এলোমেলো করে দেয়। শত হলেও মেয়ে তো! এদিকে মায়ের একটা সত্বাও জেগে উঠে। ইদানিং ও একটি সন্তান চায়, মা হতে চায়। সূচকের সাথে জোড় করে। কিন্তু সূচক আর আগের মত সাড়া দেয় না। ও নাকি বিয়ে-বাচ্চা এসব নিয়ে ভাবছে না এখন। আরো ভয়ংকর ব্যাপার রোহিনীর সঙ্গও তেমন উপভোগ করে না। রোহিনীর ভীষণ মন খারাপ হয়, চিন্তিত হয়ে পরে।
বাংলাদেশ থেকে মা ফোন দেয়, ‘এসব কী শুনছি রোহিণী? তুমি একটা ছেলের সাথে থাকছ। এর মানে কী? তুমি তো জান তোমার জন্য ছেলে ঠিক করা আছে। রীজেনের পিএইচডিটা হলেই তোমাদের বিয়ে।’
কী যে বল মা। তুমি ভুল শুনেছ। ও আমার ফ্রেন্ড। মাঝেমাঝে একসাথে গল্প করি আড্ডা দেই। এর বেশী কিছু না। মানুষের কথায় কান দিও না।
‘তাই যেন হয় মা। দুর দেশে থাক। কী কর না কর কীছুই জানি না। মায়ের মন তো! আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি যেন ভাল থাক।‘ মায়ের কণ্ঠে দ্বিধা।
রোহিণী ঠিক করে, ভুল যা হয়েছে হয়েছে। আর ভুল করা যাবে না। সূচকের সাথে একটা বোঝাপড়া করে ফেলতে হবে। হা-না জাতীয় ব্যাপার।
সূচক তোমাকে একটা প্রশ্ন করি, সরাসরি জবাব দিবে।
‘প্রশ্ন কর, জবাব দিব কী দিব না সেটা আমার ব্যাপার।‘ সূচক ঠেস দিয়ে বলে।
‘তোমাকে আমি ভালবাসি। আগে বলেছিলাম লীভ-টুগেদার করব ওটা ভুল ছিল। আমি তোমাকে বিয়ে করে সুস্থ্য-স্বাভাবিক জীবন চাই। আমি মা হতে চাই।‘ রোহিণী আবেগে বলে।
সূচক দৃঢ় কন্ঠে বলে, ‘তারমানে আমরা এখন সুস্থ্য-স্বাভাবিক জীবনে নাই? আমার কাছেতো কোন সমস্যা মনে হচ্ছে না। আর বিয়ে-বাচ্চা এসব ব্যাপারে আমি কিছু ভাবছি না এখন।‘
রোহিণী কাঁদ কাঁদ কন্ঠে বলে, ‘মেয়ে হলে তুমি বুঝতে এটা কেমন জীবন। যাহোক, তাহলে এটাই তোমার শেষ কথা?’
হ্যা। আপাতত এর বাইরে অন্য কিছুই বলার নাই আমার।
রোহিণী অথৈ সাগরে পড়ে। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এখানকার জীবন আর ভাল লাগছে না। বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে একটা সুখের সংসার করতে চায়। এতদিন যা করেছে তা ভীষণ ভুল মনে হয়। সংসারের জন্য আকূল হয়ে উঠে মন। কিন্তু সূচক তা বুঝছে না। ভালবাসাও আর আগের মত নেই। শরীরের দিকেই বেশী নজর এখন, রোহিণী বেশ বুঝতে পারে।
‘এটা হতে দেয়া যায় না। জীবনটা বদলাতে হবে।‘ রোহিণী গা ঝাড়া দেয়।
মাকে ফোন দেয়, ‘মা আমি শিঘ্রই দেশে আসছি। তুমি তোমার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের আয়োজন করতে পার।’
মা শুনে খুশী হয়। বলে, ‘রীজেনের পড়াশুনা শেষ হবে আর দুই মাস। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস। আমরা প্রস্তুতি নিতে নিতে ও এসে যাবে।‘
বাংলাদেশে রোহিণীর দিনগুলি স্বপ্নের মত কাঁটে। বাড়িতে বিয়ে আয়োজন চলছে। নিজের বিয়ের কেনাকাটা, প্লান-প্রোগ্রামে নিজেই জড়িয়ে যায়। লজ্জা লাগে ওর কাছে, তবে খারাপ লাগে না। আসলে সূচককে ভুলে থাকতে চায়, তাই কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
এরমধ্যে রীজেন দেশে চলে আসে। কেন যেন, রোহিণীকে এয়ারপোর্টে যেতে মানা করেছে। তাই ওর সাথে এখনো দেখা হয় নাই। কোথায় যেন একটা খটকা লাগে। রীজেনের বাবা ঐদিনই রোহিণীদের বাসায় আসে। মুখে উদ্ধিগ্নতার ছাপ।
ভাই সাহেব, রীজেনের এক বন্ধু ক্যালগেরি থাকে। ওর কাছ থেকেই শুনেছে রোহিণী একটা ছেলের সাথে থাকত ওখানে। রীজেন খুবই আপসেট। ব্যাপারটা সত্যি কী না বলেন?
‘কী যে বলেন? আমার মেয়ে এরকম হতেই পারে না। আর বিদেশে দু’একজন বন্ধু তো থাকতেই পারে। তাই বলে একসাথে থাকবে? ইম্পোসিবল!‘ রোহিণীর মা জোর দিয়ে বলে।
ঠিক আছে। এক কাজ করুন রোহিণীকে ডাকুন, ওকেই জিজ্ঞাসা করি। সত্য না মিথ্যা ঐ বলুক।
‘তুমি ক্যালগেরিতে খালেদ নামের কাউকে চেন?’ রীজেনের বাবা জিজ্ঞাসা করে।
জী আংকেল, চিনি। উনি আমাদের বড় ভাইয়ের মত।
‘খালেদ সব বলেছে রীজেনকে। তুমি সূচক নামের একটা ছেলের সাথে অনেকদিন থেকেছ। এক ফ্লাটে থেকে স্বামী-স্ত্রীর জীবন কাঁটিয়েছ। কথাটা কী মিথ্যে?’
রোহিণী অবাক হয়, ‘খালেদ ভাই বলেছে এসব কথা?’
কে বলেছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ না। ঘটনা সত্যি কিনা তাই বল?
রোহিণী বুঝে ফেলে ওর বলায় আর কিছু যায় আসে না। এরা সব জেনে গেছে। সামান্য খেয়ালের বসে একটা ভুল করেছিল। না বুঝে যে ভুল ও করেছে, সে ভুলের খেসারৎ এখন ওকেই দিতে হবে। লিভ-টুগেদার করা একটা মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
‘জী, সত্যি।‘ রোহিণী অস্ফুট স্বরে বলে।
রীজেনের বাবা উঠে পরে, ’সত্যি কথা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ রোহিণী। এ বিয়ে আর হচ্ছে না ভাই সাহেব। রীজেন অলরেডি না করে দিয়েছে। আমি শুধু সত্যমিথ্যা যাচাই করতে এসেছি। আপনাদের জন্য সত্যিই খারাপ লাগছে। আমরা দুঃখিত।’
রোহিণীর বাবা-মা কিছু বলে না। পাথরের মত চেয়ে থাকে। মেয়েটিকে নিয়ে কতই না গর্ব করেছে ওরা! সব মিথ্যে, সব মিথ্যে।
সীমাহীন কষ্ট রোহিণীর স্নায়ু অবশ করে দেয়। ভাবে নিউরোলজির উপর অধিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে হিউম্যান বিয়িং-এর সর্বময় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। ইলেকট্রিক সুইচের মত অ্যাক্সন-ডেনড্রাইটের কানেকশন অফ-অন করে দেয়া যাবে। মস্তিস্ক ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়া অন্য স্নায়ুতে আসবে না। কোন অনুভূতি বুঝবে না। রোহিণী বেশ কিছুদিন যাবত কাদায় আঁটকে গিয়েছিল। সেই কাঁদা আবার সুন্দরবনের পিওর টাইডাল ক্লে না। এ কাদা বালুমিশ্রিত মিথ্যা, চরম ভুল। জগতের চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে মিথ্যা টিকে না। আর এটাই ওর সবচেয়ে আশার বাণী।
দুর্বল মানুষের ততোধিক দুর্বল একটা ক্যারেক্টারিস্টিক্স হচ্ছে, ভুল করে শেষ পর্যন্ত হলেও ভুলের শান্তনা খোঁজা। শেষ পর্যন্ত কিছুই না পাওয়া গেলে শান্তনাকে বায়বীয় করে দেয়া হয়, যেমন – আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যই করেন। আমি আমার মহাভুলের শান্তনা দেই এভাবে - ভুলতো মানুষেই করে, ভুল যে করে না সে হচ্ছে শয়তান। কত মিথ্যা মানুষ জানে – জিয়ার মাজার মিথ্যা জায়গায় দাড়িয়ে আছে, মিথ্যা তথ্যে বুশ-ব্লেয়ার ইরাকে পাঁচ লক্ষ মানুষ মেরেছে, প্রেমের তাজমহল নিজেই মিথ্যা, প্রপঞ্চ! রোহিণীর বোধদয় - আমার জীবনেও না হয় একটা ভুল থাকল, মিথ্যা থাকল। না, পরাজিত ও হবে না। এই ভুল, এই মিথ্যার উপর দাড়িয়েই জীবন-স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙ্গবে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছুতে ওকে হবেই।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ফয়জুল মহী ১৪/০৮/২০১৭
    অপূর্ব লিখনি।
  • Saurav Goswami ১৩/০৮/২০১৭
    ভাল
  • গুড
  • মল্লিকা রায় ১০/০৮/২০১৭
    বাহ্ সময় লাগলেও পড়লাম ভালো লাগল।
 
Quantcast