একদিন
গল্প : একদিন
রেসাদ চেয়ে আছে একদৃষ্টিতে, পলকহীন।
পানির নিরন্তর প্রবাহ বইছে। পরিমান কত হতে পারে? আচ্ছা, পানির প্রবাহ কী দিয়ে যেন মাপে? মনে পড়েছে কিউসেক - কিউবিক ফিট পার সেকেন্ড। ম্যাট্রিক সিস্টেম অবশ্য ভিন্ন - সেকেন্ডে প্রায় আটাশ লিটার পানি বয়ে যায়। কিউসেকের কথা মনে হলেই চট করে পদ্মা নদী আর ফারাক্কা বাঁধের কথা ভেসে উঠে চোখের আয়নায়। কোথায় যেন যোগসূত্র আছে এদের, রেসাদ ভাবে। এ মুহূর্তে পানি প্রবাহের দৃশ্যের মধ্যেই ফজলে লোহানির চেহারাটা ভেসে উঠে রেসাদের মানসপটে। সাদাকালো বিনোদনের যুগেও ক্যামেরা-মাইক্রোফোন নিয়ে সুদূর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে দাঁড়িয়ে গেছেন ভদ্রলোক। কত কিউসেক পানি পার হচ্ছে, কত হবার ছিল - এসব বলছেন আর কি। প্রমত্তা পদ্মার বর্তমান দূর্গতি ভীষণ কাঁদায় রেসাদকে। পদ্মার পানি প্রবাহ কিউসেকে মাপতে হবে? খেতাপুড়ি তোর পানিচুক্তির, ফারাক্কা ভেঙ্গে ফেল ওহে ভারত।
রেসাদ অবশ্য রাজশাহীর টি-গ্রোয়েনের কাছে দাঁড়িয়ে মায়াবতী পদ্মা দেখছে না এখন। মনের দুঃখে পদ্মার পানিপ্রবাহ কিউসেকেও মাপছে না। প্রায় তের হাজার কিলোমিটার দূরে এখন সে। বিশাল এক পড়ন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে অপলক - নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ভাবছে কত পানি কত সেকেন্ডে পড়ছে তার হিসাবটা কী এখানে? গুগল বলছে বাইশ লক্ষ লিটারেরও বেশী পানি প্রতি সেকেন্ডে তেপ্পান্ন মিটার উপর থেকে পরছে। ভাবা যায়, কত শক্তি নিহিত আছে এর মধ্যে! পুরো ঢাকা শহর বিদ্যুতে বিদ্যুতে ছেয়ে ফেলা যেত নিশ্চয়। রেসাদ তাকিয়ে আছে বড় প্রপাতটার দিকে, ঘোড়ার ক্ষুরের মত দেখতে যেটা। ওর বাম পাশে ছোট আরেকটা আছে। মাত্র পাঁচ লক্ষ লিটার পানি ফেলে দেয় প্রতি সেকেন্ডে। বাইশ লক্ষের তুলনায় পাঁচ লক্ষ - মাত্রই তো, তাই না?
তা করুক। গ্যালন-গ্যালন পানি গড়িয়ে পরে পুরো নায়াগ্রা-বাফেলো শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাক - এ নিয়ে রেসাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই এখন। আজ জাগতিক কোন কিছু নিয়েই রেসাদের কোন ভাবনা নেই। মুক্তবিহঙ্গ হয়ে এসেছে ও। শীতের পাখিদের মত উড়বে - কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই দীর্ঘ সে উড়াল। উড়তেই থাকবে যেন অ্যালবাট্রসের মত, অনন্তকাল। বুকের মধ্যে বয়ে চলা লোনাপানির বেঁধে রাখা নদীটিকে ছেড়ে দিয়েছে। হ্রদয়ের ভাঁজে ভাঁজে, অলিন্দ-নিলয়ে লুকিয়ে থাকা সব ভালবাসা নিংড়ে সাথে করে নিয়ে এসেছে। কোন শূন্যতা রাখতে চায় না, রাখতে চায় না কোন হাহাকার।
ঠিক এগারটার সময়; একটু আগেই চলে এসেছে ও। বিদেশে থাকার এ এক যন্ত্রণা! সময়টা কেমন করে যেন মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় - ঘড়ির কাঁটাই জীবন চালায়। মারে স্ট্রিটটা নায়াগ্রা প্রার্কওয়ের সাথে যেখানে মিশেছে তার সামান্য দক্ষিণে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও, কানাডার প্রান্তে। এরপরই খাড়া গিরিখাত, বেশ অনেকটা পর্যন্ত। নীচ দিয়ে বয়ে চলছে খর¯্রােতা নায়াগ্রা নদী। নদীর ঐ পাশেই আমেরিকা। বড় জলপ্রপাতটা এখান থেকে বেশ দূরে, সামনের দিকে। ঘড়ি দেখছে না রেসাদ। অপেক্ষার সময় ঘন ঘন ঘড়ি দেখার বয়স পার হয়ে এসেছে অনেক আগেই। তবে বুঝতে পারছে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। কারণ পা সামান্য ব্যাথা করছে। তা করুক, কিছুই যায় আসে না। ও নীলার জন্য অপেক্ষা করছে। এগারটার আসার কথা, আসবে নিশ্চয়। সময় গণনা, শারীরিক ব্যাথা ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে নয় এখন।
হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এদিকটাতে। তাঁদের বিস্ময়ভরা শব্দ আর অবাককরা দৃষ্টি ভালই লাগে রেসাদের। অনেকবার এসেছে এখানে। প্রতিবারই নতুন করে ম্গ্ধু হয়। অপার্থিব সুন্দর সবকিছু। পড়ন্তজল ছিটকে জলীয় বাস্প হয়ে চারিদিক কেমন ভেজা ভেজা করে রাখে। বৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে এরকম পরিবেশ, অদ্ভুত সুন্দর! আকাশে চকচকে রোদ উঠেছে আজ। জলীয় বাস্প আর রোদ মিলেমিশে মায়াময় পরিবেশ। ছোটবেলার ছড়াটা মনে পরে, ‘রোদ উঠেছে, বৃষ্টি পরে, খেঁকশিয়ালে বিয়ে করে’। বিয়ে না হলেও দৃষ্টিকাড়া ইন্দ্রধনুর উপস্থিতি সার্বক্ষণিক এখানে। প্রাকৃতিক নিয়মেই রোদ-বৃষ্টির এ খেলায় পানির কনাকে প্রিজম বানিয়ে সূর্য্যের সাতরঙ বিচ্ছুরণের মেলা সাজিয়ে বসে থাকে। ভাল লাগে রেসাদের।
সামারের এগারটা মানে প্রায় দুপুর এখানে। উত্তর গোলার্ধের শেষের দিকে থাকায় সকাল হয় অনেক তাড়াতাড়ি।
জলপ্রপাতের দিকেই তাকিয়ে আছে রেসাদ। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই - কোন দিক থেকে আসবে তার কোন ঠিক নেই। তাছাড়া এত মানুষ, চট করে দেখাও যাবে না। নানান ভাবনা খেলা করছে রেসাদের। ক্যালগেরি থেকে টরন্টো এসেছে গতকালই। বন্ধু শিবলীর ওখানে উঠেছে। ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী পাড়ায় থাকে। অনেকদিন পর দেখা। কী যে খুশী! ভাবী মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রাণভরে খাওয়ালেন। বড্ড ভয় করছিল - সকালে আবার না উঠতে পারে। যাহোক, যথাসময়ে নামিয়ে দিয়ে গেছে শিবলী। মাত্র দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। বলেছে সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবে। একমাত্র ওই জানে, নায়াগ্রা কেন এসেছে।
নীলার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ক্যালগেরির হাসপাতালে - পিটার লহিড সেন্টারে। ক্লোরেক্টাল ক্যান্সারের সাথে যুঝছে রেসাদ তখন। পৌনঃপুনিক কেমো চলছিল। বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এসময় আচমকা হাসপাতালে চলে এসেছিল মেয়েটি, সুদূর বাংলাদেশ থেকে। অসুস্থ্য শরীরে ঠিক ঘোরের মধ্যে ছিল সে ক’দিন। ভাল করে মনে করতে পারে না সে সময়ের মধুরতম স্মৃতি। ঝাপসা ঝাপসা লাগে অনেকটা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অপলক চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে - এ দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে এখন। অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি। জলপ্রপাতের পড়ন্ত জলরাশির উপর নীলার সুন্দর মুখখানা ভাসছে এখন, রেসাদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। অবচেতন মন ফটোশপ সফ্টওয়ার দিয়ে কাজটা করেছে নিশ্চয়! কী সুন্দর লাগছে দেখতে!
‘এই যে, শুনছেন?’
রিন রিনে গলায় পেছন থেকে কে যেন ডাকল, শুদ্ধ বাংলায় বিদেশ বিভুঁইয়ে। চমকে উঠে রেসাদ। এসে পরল নাকি? ঝট করে পিছনে তাকায়। তাইতো, এসে পরেছে। দু’জন মানুষ যে দুরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলে তার থেকে একটু বেশী দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। আপাদমস্তক দেখে রেসাদ, একঝলক। পুরো বাঙ্গালীর সাজ - গাঢ় সবুজ রংয়ের সালোয়ার পরনে, থ্রিকোয়ার্টার হাতা। গলার কাছে, পাড়ের কাছে হাতেবোনা বাহারী কারুকাজ। জামার ধারগুলাতে লাল রংয়ের পাতলা লেস লাগানো। ওড়নাটা সাদা - শান্তির বাণী নিশ্চয়। বাম হাতে সোনার চিকন ব্রেসলেট আর ডান হাতে সুদৃশ্য ঘড়ি। সবুজের কারণে সদ্য অঙ্কুরোদগম হওয়া কোন গাছের মত লাগছে মেয়েটিকে। অথবা এমন হতে পারে, এই মাত্র ম্যাপল গাছের কোন কান্ডে নতুন পাতা গজিয়েছে।
একটু ব্যতিক্রম তো অবশ্যই। এদেশে ঘড়ি পড়ার চল ততটা নেই। আর সেল ফোন আসার পর ঘড়ি প্রায় উঠেই গেছে। সময় দেখতে হলে তাই মানুষ চট করে ফোন বের করে নেয়। ডান হাতে ঘড়ি পড়েছে, এটাও অবাক হবার মত। বাংলাদেশে এই ফ্যাশান হাল আমলে চালু হয়েছে কিনা কে জানে? রেসাদ ভাবে, ‘আমাদের সময় বাম হাতে ঘড়ি পড়ার চল ছিল।’ তবে ঘড়িটা দারুন মানিয়েছে মেয়েটির সরু কব্জিতে। পোশাকে সবসময়ই রুচির চুড়ান্তে নীলা। চমৎকার সব কম্বিনেশন - ভীষণ মানিয়ে যায়।
বরাবরের মত চুলগুলো খোলা, কালো রেশমের মত। নীচের দিকে কয়েকগোছা সোনালী রঙ করা। বাতাসে উড়ছে, মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। বিরাট রোদচশমা মুখের বেশ কিছু অংশ ঢেকে ফেলেছে। অলংকার তেমন একটা নেই - কানে ছোট্ট দুল আর নাকফুল। ঠোঁটদুটো রক্তের মত লাল করা - গাঢ় লিপস্টিক দিয়েছে। সবুজ আর লালে মিলে কি বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলেছে? মুখটা গোলগাল, গাল দু’টো ভরাট। গোল চশমার কারণে আরো বৃত্তাকার লাগছে মুখমন্ডল। সুন্দর লাগছে ওকে। পলক ফেলানো যায় না এরকম।
নার্ভাস লাগে রেসাদের। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘আরে তুমি! কখন এসেছো?’
‘সেই কখন! তখন থেকে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। ডাকব কি ডাকব না, কীভাবে ডাকব - চিন্তায় ছিলাম। আর তুমিও যেমন। একজন মানুষ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে দেখবে না?’
‘তাইতো, এটা কোন কথা হল? স্যরি, আমি আসলে ফলসের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম।’
‘হ্যা, সেটাই তো দেখছি। তুমি এত গভীরভাবে কী ভাবছ, ওদিকে তাকিয়ে? নীলা নামের মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে, তুমি টেরই পেলে না? তোমার কালপরী এরকম মায়াময় পরিবেশে স্বশরীরে ঠিক তোমার পিছনে আর তুমি ঐ জলপ্রপাত দেখছ? তুমিতো মহাগাধা দেখছি!’
‘এতো অন্যায়, মহা অন্যায়! এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, মহারাণী। এখন বলেন, আমার কী শাস্তি?’
‘শাস্তি? হ্যা, শাস্তি তোমাকে একটা দিলাম। এখন আমার এই বাম হাত ধরবে। হাত ধরে ঐ যে রেলিংয়ের শেষ মাথা দেখা যাচ্ছে, ঐ পর্যন্ত হেঁটে যাবে আমার সাথে।’
‘তোমার কাছে যতই কাছে মনে হোক, আসলে শেষটা কিন্তু বেশ দূরে। অতখানি হাঁটতে পারবে?’
‘কোন সমস্যা নেই। যতদূরই হোক, আমি যাব। যদি হাঁটতে না পারি, আমায় কাঁধে বয়ে নিতে হবে। এটাও শাস্তির বর্ধিত অংশ।’
রেসাদ হাসে, ‘ঠিক আছে। মেনে নিলাম তোমার শাস্তি। ভাগ্যিস বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মত কিম্ভুতকিমাকার বানাওনি শরীরটা।’
‘চুপ। ফাজিল কোথাকার!’
রেলিংয়ের পাড় ধরে হাঁটা শুরু করে দু’জনে। নীলার ছিপছিপে গড়ন। বেশ দ্রুতই হাটতে পারে, বোঝা যাচ্ছে। তবে ঠিক পা চালিয়ে হাটছে না ওরা। ধীর লয়ে, ছন্দের মত হেলেদুলে চলছে। তাড়া নেই কোন। মনে হচ্ছে এই পথটুকুই ওদের জীবন। গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে গেল। নায়াগ্রা শহরের এ জায়গাটায় বাতাস সবসময়ই তীব্র। নীলার ঘনকালো চুল উড়ছে বাতাসে। প্রাকৃতিক নিয়মেই রেসাদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে চুলের কিছু অংশ মাঝে মাঝেই। শ্যাম্পুর গন্ধটা অপরিচিত। চিনতে পারছে না শরীর থেকে ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধটাও।
নীলা বাম হাত নিয়ে রেসাদের বাহু ধরে রেখেছে। দু’জনে হাঁটার বেশ পরিচিত দৃশ্য এটা। মানুষ ইচ্ছে করেই এভাবে হাঁটে নাকি প্রকৃতিই দু’জনে হাঁটার এরকম সেটিং করে দেয় - রেসাদ ঠিক জানে না। তবে ডান হাতে নীলার স্পর্শ ওর শরীরকে অবশ করে দিয়েছে। অবশ্যই এলোমলো পা ফেলছে ও। কথোপকথনের মধ্যেই ডান হাত দিয়ে নীলা মাঝে মাঝেই মৃদু ধাক্কা মারছে রেসাদকে।
ঠিক যেমন এখন। ‘তুমি এত শক্ত করে হাত ধরেছ কেন? আমার রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিয়েছো তো।’ রেসাদ হাসতে হাসতে বলে।
ডান হাতের সেই হালকা ঘুসি চলে যায় রেসাদের ঠিক পেট বরাবর। ‘ভাল করেছি। তোমার রক্ত চলাচলের দরকার নেই। ঐখানে এখন আমার রক্ত ঢুকে গেছে। তোমার ব্লাড সার্কুলেশন পরনির্ভর এখন।’
রেসাদ হাসে। অ্যাভাটার সিনেমার মত মনে হয়। একটা বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে। নিজের শরীর রক্তশূন্য হয়ে গেছে। নীলার শরীর থেকে রক্ত আঙ্গুল বেয়ে বেয়ে ওর শরীরে ঢুকে গেছে। রক্ত পাম্প হচ্ছে নীলার হৃৎপিন্ডে কিন্তু চলাচল করছে দু’টো শরীরেই। ধুর! কী সব ভাবছি?
‘আচ্ছা, এটাকে কী নাম দেয়া যায়?’
‘কোনটা?’ নীলা রেসাদের চোখের দিকে তাকায়।
‘কত প্যারেড দুনিয়াতে আছে! ক্যারিবানা প্যারেড, স্ট্যামপিড প্যারেড, মারমেউড প্যারেড ...। এমনকি গে প্যারেডও আছে। এই যে আমরা হাঁটছি, এই প্যারেডকে কী নাম দেয়া যায়?’
নীলা থমকে যায়, ভাবে একটু। ঠিক আছে, এর নাম দিলাম ‘স্বপ্নযাত্রা’।
স্বপ্নযাত্রা চলছে বেশ কিছুক্ষণ হল। দুপুর এখন, রোদ তেঁতে উঠেছে। পরিশ্রমে নীলার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আদুরে মেয়ে, এতাটা হাঁটেনা নিশ্চয়। একটু একটু ঘামছেও যেন, কপালের কাছে। রেসাদ নিশ্চিত এই ঘাম অন্য সবের চেয়ে আলাদা। এর রাসায়নিক গঠনে শুধুমাত্র দুইটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন। সোডিয়াম ক্লোরাইড ধারেকাছেও নেই - তাই কোনভাবেই লবনের অনু পাওয়া যাবে না। স্বাদ অবশ্যই মিষ্টিপানির হবে। সাগরের লোনা পানির মত বিঃস্বাদ কোন ক্রমেই নয়। ঘামের সাথে ব্যাকটেরিয়া মিশে যে বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটে, তা কোনক্রমেই এখানে হবে না। জমজম কূপের পানির মত পবিত্র এই দেহনিঃসৃত জল। প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক সাথে করে নিয়েই এসেছে। দিনের পর দিন বাইরে পড়ে থাকলেও এতে ব্যাকটেরিয়া জমবে না, সামান্য একটুও।
উপরন্তু শিউলীর মিষ্টি গন্ধটা আগের থেকেই বিল্টইন করা আছে, এই পানিতে। তাই বাড়তি পারফিউমের বাহুল্য আছে বলে মনে হয় না। আপন মনেই শিউলির গন্ধটা টের পাচ্ছে রেসাদ, মাদকতাপূর্ণ। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন পানি পড়ছে এই মুহূর্তে নায়াগ্রায় - কি আসে যায় তাতে! রেসাদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলার কপালের দিকে তাকিয়ে আছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘামের দিকেও - সেই পলকহীন দৃষ্টি।
‘ভাইজানের ফলস দেখা শেষ? বুভুক্ষুর মত এদিকে তাকিয়ে আছেন কেন?’ নীলা মুচকি হাসে।
একটু থতমত খায় রেসাদ, অপ্রস্তুত ভীষণ।
পুরো ফলস পার হয়ে এসেছে ওরা, দুজনে হাত ধরাধরি করে। স্বপ্নযাত্রা এখানেই শেষ। এত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়ে গেল? পথ যেন শেষ না হয় টাইপের ভাবনা মাথায় আসার আগেই। আহারে! সবকিছুরই যে শেষ আছে। শেষ নাই শুধু ইউনিভার্সের কিনারার।
‘চল, নদীতে নামি।’ নীলা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে চায়।
‘সাঁতরাবে?’
‘না, সাঁতার জানি না। ঐ যে লঞ্চ দেখা যাচ্ছে, ওখানে উঠব।’ নীলা আঙ্গুল তুলে দেখায়।
‘মেইড অব দ্য মিস্ট। গুড আইডিয়া, চল যাই।’
টিকিটের সাথে দেয়া পলিথিনের বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে লঞ্চে উঠে পরে দু’জন। ট্যুরিস্ট গিজ গিজ করছে। খুঁজে পেতে কোণার দিকে একটু নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়ায় ওরা। জেটি ছেড়ে ধীরে ধীরে ফলসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ। যতটা সম্ভব কাছে যায় এই জলযান। জলপ্রপাতের গর্জন আর এঞ্জিনের শব্দ - কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া দুস্কর এখানে। তাই চিৎকার করে কথা বলছে ওরা।
রেসাদের চশমা জলে ভিজে গেছে। মুখেও জলের ঝাপটা। নীলার ভেজা মুখটা ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছে ও। দীর্ঘশ্বাস বের হয় অজান্তেই - এত সুন্দর কেন মেয়েটি? কালপরীই বলে সবসময় - পরীরাতো সুন্দরই হয়!
‘আমি এই যাত্রার নাম দিলাম - মৃত্যুযাত্রা’।
নীলা চোখ বড় করে তাকায়, ‘মানে? মৃত্যুযাত্রা হবে কেন?’
‘কারণ, লঞ্চের এই ট্রিপটা ভিন্ন হবে। ফলসের কাছে গিয়েও থামবে না। ফেরতও আসবে না। ক্যাপ্টেন ভুলে যাবে সব, অথবা আচমকা এঞ্জিন-মেশিনে গন্ডগোল হয়ে যাবে। লঞ্চ ঘোড়ানো যাবে না। ধীরে ধীরে এটি ফলসের মধ্যে ঢুকে যাবে। সেকেন্ডে সাড়ে বাইশ লক্ষ লিটার পানি গড়িয়ে পড়বে লঞ্চের উপর, আমাদের উপর। সকলেই তলিয়ে যাব নদীর তলদেশে।’
‘চুপ কর। কী সব অলুক্ষণে কথা বলছ!’
অকস্মাৎ ঘটে যায় যেন। লঞ্চের হেলম খসে পড়ে যায়। জলের নীচে গতিপথ পরিবর্তনের রাডার সোজা হয়ে আটকে আছে। এঞ্জিন চলছে কিন্তু লঞ্চ বাকানো যাচ্ছে না। সোজা ফলসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে চিৎকার-ছুটাছুটি, বাচাও বাচাও আঁকুতি। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খায় যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে নদীতে। রেসাদের নিজেকে টাইটানিক মুভির জ্যাকের মত লাগছে এখন। পুরো লঞ্চ চষে ফেলছে সে। পাগলের মত খুঁজছে - অন্তত একটা লাইফ ভেস্ট যদি পাওয়া যায়। একটাই মাত্র পেয়েছে, মহাখুশী। নীলা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর গায়ে গলিয়ে দেয় ভেস্টটা। ঘটনার আকষ্মিকতায় হকচকিয়ে গেছে মেয়েটি। অবাক বিস্ময়ে আর ভয়ে কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছে না। রেসাদ মুহূর্তেই নিজের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে নীলার ভেজা শীতল ঠোঁট। একটু বেশী সময় নেয় যেন - ‘পাগলি, ভাবিস না। তোকে নিয়ে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন। পরজন্মে হলেও।’ রেসাদ সবল হাতে ধাক্কা মেরে নীলাকে ফেলে দেয়, লঞ্চ থেকে নদীর মধ্যে।
নীলা শুধু শুনতে পায় রেসাদের চিৎকার, ‘ডুবে যাবার আগে লম্বা করে দম নিয়ে নাও’।
ফলসের জল আর চোখের জল মিশিয়ে রেসাদ দেখে নীলা তলিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। পরমুহূর্তেই লঞ্চটি গোত্তা খেয়ে ডুবে যেতে থাকে। রেসাদ ভাল করেই জানে আর ভেসে উঠবে না এই লঞ্চ। তবে এটুকু বিশ্বাস ওর আছে - লাইফ ভেস্ট একটু পরেই নীলাকে ভাসিয়ে দিবে। দুশ্চিন্তা একটাই, ‘শেষ মুহূর্তে মেয়েটা কি লম্বা করে শ্বাস নিয়েছিল?’
মৃত্যু কেমন? বোঝার চেষ্টা করছে রেসাদ।
সাইরেণের তীব্র শব্দ। ভুস করে একটা পুলিশ গাড়ি পার হয়ে যায়। রেসাদ ঘুরে তাকায়। চোখে ঝাপসা দৃষ্টি - ফলস থেকে উঠে আসা জলীয় বাস্প না চোখের জল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঘড়ির দিকে তাকায়, দু’টো বেজে গেছে। পা দু’টো ব্যাথায় টনটন করছে। স্বপ্ন দেখছিল রেসাদ। তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে স্বপ্নের আবেশে। এগারটায় আসার কথা ছিল। তারমানে আর আসবে না। রাগ-বিরক্ত কোনটাই হয় না রেসাদ। ভালবাসায় কোন শূন্যতা নেই ওর, দেখা হবে কোন একদিন নিশ্চয়। আর না হলেই বা কী? একটা জীবন পার করে দিতে পারবে অনায়াসেই। অপমানিত লাগছে কী?
বোধ একটা পর্যায়ে উঠে গেলে মান-অপমান এসব তুচ্ছ বিমূর্ত শব্দ ওজোন লেয়ার ভেদ করতে পারে না। ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন (সিএফসি) হচ্ছে তিন অক্সিজেন-মৌল-গঠিত এই ওজোন-চাদরের মহাশত্রু, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। মনের সিএফসিও নিশ্চয় আয়ত্ত্বের বাইরে নয়। ইচ্ছে করে কেউ আসছে না জেনেও দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকা, ক্লান্তিহীন। সিএফসি স্তরীভূত হচ্ছে দেহে, আলবৎ। যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিবে? না। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধাকে দুনিয়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল কান্ট্রি কোড +১ দিয়ে ফোন করলেও সে ধরবে না। তাই বলে ঐ ভদ্রলোককে ফোন করা কি বন্ধ করা হয়?
মান-অপমানবোধ সেখানেই বিদ্যমান, যেখানে অসীম প্রেমের পরিপূর্ণ কগনিটিভ বিকাশ হয় নাই। এক বর্ষণমূখর বন্যাকবলিত রাতে বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে সুরবালার নিশ্চুপ কথোপকথন কোন একদিন নায়াগ্রার পড়ন্ত বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে সুসম্পন্ন করা যায় অবশ্যই। শর্ত একটাই - প্রেমবোধীয় বিকাশসৃষ্ট হরমোনের যথোপযুক্ত নিঃসরণ। আজকের দিনটি সেই একদিন হয়নি, নিশ্চয় হবে আরেকদিন। দালাই লামাকে স্মরণ করা যায়, ’যত বেশী প্রেমময় হবে তত অকুতভয় আর সংকীর্ণতামুক্তি ঘটবে’।
রেসাদ নিজের মনেই বলে, তিনকোণা বস্তুটার ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা সব ভালবাসা নিংড়ে এনে তোর পানে ছুড়েছিলাম। ব্রাজিলের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সেই পাইতিতি শহরের বিশাল সোনার স্তুপ তোর সামনে ছিল। পপলারসারি পেরিয়ে যে নীল জলের বিশাল দিঘীটা, তাঁর সবগুলো পানি শুষে এনেছিলাম তোর কোমল পায়ের কাছে। লজ্জাবতী নির্লজ্জ ছিল সম্পূর্ণ সেদিন। নিশুতি রাতে মলিন আলোতে ফিসফিস করে বলেছিল। পরীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন চোখ ধরে যায়, ঝলসে যাওয়ার কাছাকাছি। যখন সমস্ত স্নায়ু বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে শাষণের, তখন শুনিয়েছিলাম। হায়! কোহিনুর ফিরিয়ে দেবার অসীম ক্ষমতা ব্রিটিশ কুইনের নেই। জেরুজালেম অধিগ্রহণ ছাড়ার সুবুদ্ধিও ইজরায়েলের নেই। কাঁধে কাঁধ, বুকে বুক লাগানোর উদারতা দুই কোরিয়ার আজও হয় নাই। আহারে! বড়ই দূর্ভাগা! দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা রেসাদের নাগালের বাইরে। হেলেন কেলারই কি ঠিক, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল এবং সুন্দর জিনিসটা দেখা যায় না, এমনকি ছোঁয়াও যায় না - শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়।’
ভুবন-বিখ্যাত নায়াগ্রা তেতো লাগে রেসাদের। শিবলীকে ফোন করে ‘দোস্ত, চলে আস। আমি টরন্টো ফিরব।’
‘এতো তাড়াতাড়ি?’
রেসাদ কিছু বলে না। একদিনের দুঃখটা বড় বেশী বাজে। দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয় শুধু।
রেসাদ চেয়ে আছে একদৃষ্টিতে, পলকহীন।
পানির নিরন্তর প্রবাহ বইছে। পরিমান কত হতে পারে? আচ্ছা, পানির প্রবাহ কী দিয়ে যেন মাপে? মনে পড়েছে কিউসেক - কিউবিক ফিট পার সেকেন্ড। ম্যাট্রিক সিস্টেম অবশ্য ভিন্ন - সেকেন্ডে প্রায় আটাশ লিটার পানি বয়ে যায়। কিউসেকের কথা মনে হলেই চট করে পদ্মা নদী আর ফারাক্কা বাঁধের কথা ভেসে উঠে চোখের আয়নায়। কোথায় যেন যোগসূত্র আছে এদের, রেসাদ ভাবে। এ মুহূর্তে পানি প্রবাহের দৃশ্যের মধ্যেই ফজলে লোহানির চেহারাটা ভেসে উঠে রেসাদের মানসপটে। সাদাকালো বিনোদনের যুগেও ক্যামেরা-মাইক্রোফোন নিয়ে সুদূর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে দাঁড়িয়ে গেছেন ভদ্রলোক। কত কিউসেক পানি পার হচ্ছে, কত হবার ছিল - এসব বলছেন আর কি। প্রমত্তা পদ্মার বর্তমান দূর্গতি ভীষণ কাঁদায় রেসাদকে। পদ্মার পানি প্রবাহ কিউসেকে মাপতে হবে? খেতাপুড়ি তোর পানিচুক্তির, ফারাক্কা ভেঙ্গে ফেল ওহে ভারত।
রেসাদ অবশ্য রাজশাহীর টি-গ্রোয়েনের কাছে দাঁড়িয়ে মায়াবতী পদ্মা দেখছে না এখন। মনের দুঃখে পদ্মার পানিপ্রবাহ কিউসেকেও মাপছে না। প্রায় তের হাজার কিলোমিটার দূরে এখন সে। বিশাল এক পড়ন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে অপলক - নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ভাবছে কত পানি কত সেকেন্ডে পড়ছে তার হিসাবটা কী এখানে? গুগল বলছে বাইশ লক্ষ লিটারেরও বেশী পানি প্রতি সেকেন্ডে তেপ্পান্ন মিটার উপর থেকে পরছে। ভাবা যায়, কত শক্তি নিহিত আছে এর মধ্যে! পুরো ঢাকা শহর বিদ্যুতে বিদ্যুতে ছেয়ে ফেলা যেত নিশ্চয়। রেসাদ তাকিয়ে আছে বড় প্রপাতটার দিকে, ঘোড়ার ক্ষুরের মত দেখতে যেটা। ওর বাম পাশে ছোট আরেকটা আছে। মাত্র পাঁচ লক্ষ লিটার পানি ফেলে দেয় প্রতি সেকেন্ডে। বাইশ লক্ষের তুলনায় পাঁচ লক্ষ - মাত্রই তো, তাই না?
তা করুক। গ্যালন-গ্যালন পানি গড়িয়ে পরে পুরো নায়াগ্রা-বাফেলো শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাক - এ নিয়ে রেসাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই এখন। আজ জাগতিক কোন কিছু নিয়েই রেসাদের কোন ভাবনা নেই। মুক্তবিহঙ্গ হয়ে এসেছে ও। শীতের পাখিদের মত উড়বে - কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই দীর্ঘ সে উড়াল। উড়তেই থাকবে যেন অ্যালবাট্রসের মত, অনন্তকাল। বুকের মধ্যে বয়ে চলা লোনাপানির বেঁধে রাখা নদীটিকে ছেড়ে দিয়েছে। হ্রদয়ের ভাঁজে ভাঁজে, অলিন্দ-নিলয়ে লুকিয়ে থাকা সব ভালবাসা নিংড়ে সাথে করে নিয়ে এসেছে। কোন শূন্যতা রাখতে চায় না, রাখতে চায় না কোন হাহাকার।
ঠিক এগারটার সময়; একটু আগেই চলে এসেছে ও। বিদেশে থাকার এ এক যন্ত্রণা! সময়টা কেমন করে যেন মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় - ঘড়ির কাঁটাই জীবন চালায়। মারে স্ট্রিটটা নায়াগ্রা প্রার্কওয়ের সাথে যেখানে মিশেছে তার সামান্য দক্ষিণে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও, কানাডার প্রান্তে। এরপরই খাড়া গিরিখাত, বেশ অনেকটা পর্যন্ত। নীচ দিয়ে বয়ে চলছে খর¯্রােতা নায়াগ্রা নদী। নদীর ঐ পাশেই আমেরিকা। বড় জলপ্রপাতটা এখান থেকে বেশ দূরে, সামনের দিকে। ঘড়ি দেখছে না রেসাদ। অপেক্ষার সময় ঘন ঘন ঘড়ি দেখার বয়স পার হয়ে এসেছে অনেক আগেই। তবে বুঝতে পারছে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। কারণ পা সামান্য ব্যাথা করছে। তা করুক, কিছুই যায় আসে না। ও নীলার জন্য অপেক্ষা করছে। এগারটার আসার কথা, আসবে নিশ্চয়। সময় গণনা, শারীরিক ব্যাথা ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে নয় এখন।
হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এদিকটাতে। তাঁদের বিস্ময়ভরা শব্দ আর অবাককরা দৃষ্টি ভালই লাগে রেসাদের। অনেকবার এসেছে এখানে। প্রতিবারই নতুন করে ম্গ্ধু হয়। অপার্থিব সুন্দর সবকিছু। পড়ন্তজল ছিটকে জলীয় বাস্প হয়ে চারিদিক কেমন ভেজা ভেজা করে রাখে। বৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে এরকম পরিবেশ, অদ্ভুত সুন্দর! আকাশে চকচকে রোদ উঠেছে আজ। জলীয় বাস্প আর রোদ মিলেমিশে মায়াময় পরিবেশ। ছোটবেলার ছড়াটা মনে পরে, ‘রোদ উঠেছে, বৃষ্টি পরে, খেঁকশিয়ালে বিয়ে করে’। বিয়ে না হলেও দৃষ্টিকাড়া ইন্দ্রধনুর উপস্থিতি সার্বক্ষণিক এখানে। প্রাকৃতিক নিয়মেই রোদ-বৃষ্টির এ খেলায় পানির কনাকে প্রিজম বানিয়ে সূর্য্যের সাতরঙ বিচ্ছুরণের মেলা সাজিয়ে বসে থাকে। ভাল লাগে রেসাদের।
সামারের এগারটা মানে প্রায় দুপুর এখানে। উত্তর গোলার্ধের শেষের দিকে থাকায় সকাল হয় অনেক তাড়াতাড়ি।
জলপ্রপাতের দিকেই তাকিয়ে আছে রেসাদ। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই - কোন দিক থেকে আসবে তার কোন ঠিক নেই। তাছাড়া এত মানুষ, চট করে দেখাও যাবে না। নানান ভাবনা খেলা করছে রেসাদের। ক্যালগেরি থেকে টরন্টো এসেছে গতকালই। বন্ধু শিবলীর ওখানে উঠেছে। ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী পাড়ায় থাকে। অনেকদিন পর দেখা। কী যে খুশী! ভাবী মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রাণভরে খাওয়ালেন। বড্ড ভয় করছিল - সকালে আবার না উঠতে পারে। যাহোক, যথাসময়ে নামিয়ে দিয়ে গেছে শিবলী। মাত্র দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। বলেছে সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবে। একমাত্র ওই জানে, নায়াগ্রা কেন এসেছে।
নীলার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ক্যালগেরির হাসপাতালে - পিটার লহিড সেন্টারে। ক্লোরেক্টাল ক্যান্সারের সাথে যুঝছে রেসাদ তখন। পৌনঃপুনিক কেমো চলছিল। বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এসময় আচমকা হাসপাতালে চলে এসেছিল মেয়েটি, সুদূর বাংলাদেশ থেকে। অসুস্থ্য শরীরে ঠিক ঘোরের মধ্যে ছিল সে ক’দিন। ভাল করে মনে করতে পারে না সে সময়ের মধুরতম স্মৃতি। ঝাপসা ঝাপসা লাগে অনেকটা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অপলক চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে - এ দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে এখন। অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি। জলপ্রপাতের পড়ন্ত জলরাশির উপর নীলার সুন্দর মুখখানা ভাসছে এখন, রেসাদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। অবচেতন মন ফটোশপ সফ্টওয়ার দিয়ে কাজটা করেছে নিশ্চয়! কী সুন্দর লাগছে দেখতে!
‘এই যে, শুনছেন?’
রিন রিনে গলায় পেছন থেকে কে যেন ডাকল, শুদ্ধ বাংলায় বিদেশ বিভুঁইয়ে। চমকে উঠে রেসাদ। এসে পরল নাকি? ঝট করে পিছনে তাকায়। তাইতো, এসে পরেছে। দু’জন মানুষ যে দুরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলে তার থেকে একটু বেশী দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। আপাদমস্তক দেখে রেসাদ, একঝলক। পুরো বাঙ্গালীর সাজ - গাঢ় সবুজ রংয়ের সালোয়ার পরনে, থ্রিকোয়ার্টার হাতা। গলার কাছে, পাড়ের কাছে হাতেবোনা বাহারী কারুকাজ। জামার ধারগুলাতে লাল রংয়ের পাতলা লেস লাগানো। ওড়নাটা সাদা - শান্তির বাণী নিশ্চয়। বাম হাতে সোনার চিকন ব্রেসলেট আর ডান হাতে সুদৃশ্য ঘড়ি। সবুজের কারণে সদ্য অঙ্কুরোদগম হওয়া কোন গাছের মত লাগছে মেয়েটিকে। অথবা এমন হতে পারে, এই মাত্র ম্যাপল গাছের কোন কান্ডে নতুন পাতা গজিয়েছে।
একটু ব্যতিক্রম তো অবশ্যই। এদেশে ঘড়ি পড়ার চল ততটা নেই। আর সেল ফোন আসার পর ঘড়ি প্রায় উঠেই গেছে। সময় দেখতে হলে তাই মানুষ চট করে ফোন বের করে নেয়। ডান হাতে ঘড়ি পড়েছে, এটাও অবাক হবার মত। বাংলাদেশে এই ফ্যাশান হাল আমলে চালু হয়েছে কিনা কে জানে? রেসাদ ভাবে, ‘আমাদের সময় বাম হাতে ঘড়ি পড়ার চল ছিল।’ তবে ঘড়িটা দারুন মানিয়েছে মেয়েটির সরু কব্জিতে। পোশাকে সবসময়ই রুচির চুড়ান্তে নীলা। চমৎকার সব কম্বিনেশন - ভীষণ মানিয়ে যায়।
বরাবরের মত চুলগুলো খোলা, কালো রেশমের মত। নীচের দিকে কয়েকগোছা সোনালী রঙ করা। বাতাসে উড়ছে, মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। বিরাট রোদচশমা মুখের বেশ কিছু অংশ ঢেকে ফেলেছে। অলংকার তেমন একটা নেই - কানে ছোট্ট দুল আর নাকফুল। ঠোঁটদুটো রক্তের মত লাল করা - গাঢ় লিপস্টিক দিয়েছে। সবুজ আর লালে মিলে কি বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলেছে? মুখটা গোলগাল, গাল দু’টো ভরাট। গোল চশমার কারণে আরো বৃত্তাকার লাগছে মুখমন্ডল। সুন্দর লাগছে ওকে। পলক ফেলানো যায় না এরকম।
নার্ভাস লাগে রেসাদের। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘আরে তুমি! কখন এসেছো?’
‘সেই কখন! তখন থেকে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। ডাকব কি ডাকব না, কীভাবে ডাকব - চিন্তায় ছিলাম। আর তুমিও যেমন। একজন মানুষ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে দেখবে না?’
‘তাইতো, এটা কোন কথা হল? স্যরি, আমি আসলে ফলসের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম।’
‘হ্যা, সেটাই তো দেখছি। তুমি এত গভীরভাবে কী ভাবছ, ওদিকে তাকিয়ে? নীলা নামের মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে, তুমি টেরই পেলে না? তোমার কালপরী এরকম মায়াময় পরিবেশে স্বশরীরে ঠিক তোমার পিছনে আর তুমি ঐ জলপ্রপাত দেখছ? তুমিতো মহাগাধা দেখছি!’
‘এতো অন্যায়, মহা অন্যায়! এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, মহারাণী। এখন বলেন, আমার কী শাস্তি?’
‘শাস্তি? হ্যা, শাস্তি তোমাকে একটা দিলাম। এখন আমার এই বাম হাত ধরবে। হাত ধরে ঐ যে রেলিংয়ের শেষ মাথা দেখা যাচ্ছে, ঐ পর্যন্ত হেঁটে যাবে আমার সাথে।’
‘তোমার কাছে যতই কাছে মনে হোক, আসলে শেষটা কিন্তু বেশ দূরে। অতখানি হাঁটতে পারবে?’
‘কোন সমস্যা নেই। যতদূরই হোক, আমি যাব। যদি হাঁটতে না পারি, আমায় কাঁধে বয়ে নিতে হবে। এটাও শাস্তির বর্ধিত অংশ।’
রেসাদ হাসে, ‘ঠিক আছে। মেনে নিলাম তোমার শাস্তি। ভাগ্যিস বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মত কিম্ভুতকিমাকার বানাওনি শরীরটা।’
‘চুপ। ফাজিল কোথাকার!’
রেলিংয়ের পাড় ধরে হাঁটা শুরু করে দু’জনে। নীলার ছিপছিপে গড়ন। বেশ দ্রুতই হাটতে পারে, বোঝা যাচ্ছে। তবে ঠিক পা চালিয়ে হাটছে না ওরা। ধীর লয়ে, ছন্দের মত হেলেদুলে চলছে। তাড়া নেই কোন। মনে হচ্ছে এই পথটুকুই ওদের জীবন। গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে গেল। নায়াগ্রা শহরের এ জায়গাটায় বাতাস সবসময়ই তীব্র। নীলার ঘনকালো চুল উড়ছে বাতাসে। প্রাকৃতিক নিয়মেই রেসাদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে চুলের কিছু অংশ মাঝে মাঝেই। শ্যাম্পুর গন্ধটা অপরিচিত। চিনতে পারছে না শরীর থেকে ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধটাও।
নীলা বাম হাত নিয়ে রেসাদের বাহু ধরে রেখেছে। দু’জনে হাঁটার বেশ পরিচিত দৃশ্য এটা। মানুষ ইচ্ছে করেই এভাবে হাঁটে নাকি প্রকৃতিই দু’জনে হাঁটার এরকম সেটিং করে দেয় - রেসাদ ঠিক জানে না। তবে ডান হাতে নীলার স্পর্শ ওর শরীরকে অবশ করে দিয়েছে। অবশ্যই এলোমলো পা ফেলছে ও। কথোপকথনের মধ্যেই ডান হাত দিয়ে নীলা মাঝে মাঝেই মৃদু ধাক্কা মারছে রেসাদকে।
ঠিক যেমন এখন। ‘তুমি এত শক্ত করে হাত ধরেছ কেন? আমার রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিয়েছো তো।’ রেসাদ হাসতে হাসতে বলে।
ডান হাতের সেই হালকা ঘুসি চলে যায় রেসাদের ঠিক পেট বরাবর। ‘ভাল করেছি। তোমার রক্ত চলাচলের দরকার নেই। ঐখানে এখন আমার রক্ত ঢুকে গেছে। তোমার ব্লাড সার্কুলেশন পরনির্ভর এখন।’
রেসাদ হাসে। অ্যাভাটার সিনেমার মত মনে হয়। একটা বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে। নিজের শরীর রক্তশূন্য হয়ে গেছে। নীলার শরীর থেকে রক্ত আঙ্গুল বেয়ে বেয়ে ওর শরীরে ঢুকে গেছে। রক্ত পাম্প হচ্ছে নীলার হৃৎপিন্ডে কিন্তু চলাচল করছে দু’টো শরীরেই। ধুর! কী সব ভাবছি?
‘আচ্ছা, এটাকে কী নাম দেয়া যায়?’
‘কোনটা?’ নীলা রেসাদের চোখের দিকে তাকায়।
‘কত প্যারেড দুনিয়াতে আছে! ক্যারিবানা প্যারেড, স্ট্যামপিড প্যারেড, মারমেউড প্যারেড ...। এমনকি গে প্যারেডও আছে। এই যে আমরা হাঁটছি, এই প্যারেডকে কী নাম দেয়া যায়?’
নীলা থমকে যায়, ভাবে একটু। ঠিক আছে, এর নাম দিলাম ‘স্বপ্নযাত্রা’।
স্বপ্নযাত্রা চলছে বেশ কিছুক্ষণ হল। দুপুর এখন, রোদ তেঁতে উঠেছে। পরিশ্রমে নীলার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আদুরে মেয়ে, এতাটা হাঁটেনা নিশ্চয়। একটু একটু ঘামছেও যেন, কপালের কাছে। রেসাদ নিশ্চিত এই ঘাম অন্য সবের চেয়ে আলাদা। এর রাসায়নিক গঠনে শুধুমাত্র দুইটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন। সোডিয়াম ক্লোরাইড ধারেকাছেও নেই - তাই কোনভাবেই লবনের অনু পাওয়া যাবে না। স্বাদ অবশ্যই মিষ্টিপানির হবে। সাগরের লোনা পানির মত বিঃস্বাদ কোন ক্রমেই নয়। ঘামের সাথে ব্যাকটেরিয়া মিশে যে বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটে, তা কোনক্রমেই এখানে হবে না। জমজম কূপের পানির মত পবিত্র এই দেহনিঃসৃত জল। প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক সাথে করে নিয়েই এসেছে। দিনের পর দিন বাইরে পড়ে থাকলেও এতে ব্যাকটেরিয়া জমবে না, সামান্য একটুও।
উপরন্তু শিউলীর মিষ্টি গন্ধটা আগের থেকেই বিল্টইন করা আছে, এই পানিতে। তাই বাড়তি পারফিউমের বাহুল্য আছে বলে মনে হয় না। আপন মনেই শিউলির গন্ধটা টের পাচ্ছে রেসাদ, মাদকতাপূর্ণ। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন পানি পড়ছে এই মুহূর্তে নায়াগ্রায় - কি আসে যায় তাতে! রেসাদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলার কপালের দিকে তাকিয়ে আছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘামের দিকেও - সেই পলকহীন দৃষ্টি।
‘ভাইজানের ফলস দেখা শেষ? বুভুক্ষুর মত এদিকে তাকিয়ে আছেন কেন?’ নীলা মুচকি হাসে।
একটু থতমত খায় রেসাদ, অপ্রস্তুত ভীষণ।
পুরো ফলস পার হয়ে এসেছে ওরা, দুজনে হাত ধরাধরি করে। স্বপ্নযাত্রা এখানেই শেষ। এত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়ে গেল? পথ যেন শেষ না হয় টাইপের ভাবনা মাথায় আসার আগেই। আহারে! সবকিছুরই যে শেষ আছে। শেষ নাই শুধু ইউনিভার্সের কিনারার।
‘চল, নদীতে নামি।’ নীলা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে চায়।
‘সাঁতরাবে?’
‘না, সাঁতার জানি না। ঐ যে লঞ্চ দেখা যাচ্ছে, ওখানে উঠব।’ নীলা আঙ্গুল তুলে দেখায়।
‘মেইড অব দ্য মিস্ট। গুড আইডিয়া, চল যাই।’
টিকিটের সাথে দেয়া পলিথিনের বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে লঞ্চে উঠে পরে দু’জন। ট্যুরিস্ট গিজ গিজ করছে। খুঁজে পেতে কোণার দিকে একটু নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়ায় ওরা। জেটি ছেড়ে ধীরে ধীরে ফলসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ। যতটা সম্ভব কাছে যায় এই জলযান। জলপ্রপাতের গর্জন আর এঞ্জিনের শব্দ - কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া দুস্কর এখানে। তাই চিৎকার করে কথা বলছে ওরা।
রেসাদের চশমা জলে ভিজে গেছে। মুখেও জলের ঝাপটা। নীলার ভেজা মুখটা ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছে ও। দীর্ঘশ্বাস বের হয় অজান্তেই - এত সুন্দর কেন মেয়েটি? কালপরীই বলে সবসময় - পরীরাতো সুন্দরই হয়!
‘আমি এই যাত্রার নাম দিলাম - মৃত্যুযাত্রা’।
নীলা চোখ বড় করে তাকায়, ‘মানে? মৃত্যুযাত্রা হবে কেন?’
‘কারণ, লঞ্চের এই ট্রিপটা ভিন্ন হবে। ফলসের কাছে গিয়েও থামবে না। ফেরতও আসবে না। ক্যাপ্টেন ভুলে যাবে সব, অথবা আচমকা এঞ্জিন-মেশিনে গন্ডগোল হয়ে যাবে। লঞ্চ ঘোড়ানো যাবে না। ধীরে ধীরে এটি ফলসের মধ্যে ঢুকে যাবে। সেকেন্ডে সাড়ে বাইশ লক্ষ লিটার পানি গড়িয়ে পড়বে লঞ্চের উপর, আমাদের উপর। সকলেই তলিয়ে যাব নদীর তলদেশে।’
‘চুপ কর। কী সব অলুক্ষণে কথা বলছ!’
অকস্মাৎ ঘটে যায় যেন। লঞ্চের হেলম খসে পড়ে যায়। জলের নীচে গতিপথ পরিবর্তনের রাডার সোজা হয়ে আটকে আছে। এঞ্জিন চলছে কিন্তু লঞ্চ বাকানো যাচ্ছে না। সোজা ফলসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে চিৎকার-ছুটাছুটি, বাচাও বাচাও আঁকুতি। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খায় যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে নদীতে। রেসাদের নিজেকে টাইটানিক মুভির জ্যাকের মত লাগছে এখন। পুরো লঞ্চ চষে ফেলছে সে। পাগলের মত খুঁজছে - অন্তত একটা লাইফ ভেস্ট যদি পাওয়া যায়। একটাই মাত্র পেয়েছে, মহাখুশী। নীলা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর গায়ে গলিয়ে দেয় ভেস্টটা। ঘটনার আকষ্মিকতায় হকচকিয়ে গেছে মেয়েটি। অবাক বিস্ময়ে আর ভয়ে কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছে না। রেসাদ মুহূর্তেই নিজের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে নীলার ভেজা শীতল ঠোঁট। একটু বেশী সময় নেয় যেন - ‘পাগলি, ভাবিস না। তোকে নিয়ে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন। পরজন্মে হলেও।’ রেসাদ সবল হাতে ধাক্কা মেরে নীলাকে ফেলে দেয়, লঞ্চ থেকে নদীর মধ্যে।
নীলা শুধু শুনতে পায় রেসাদের চিৎকার, ‘ডুবে যাবার আগে লম্বা করে দম নিয়ে নাও’।
ফলসের জল আর চোখের জল মিশিয়ে রেসাদ দেখে নীলা তলিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। পরমুহূর্তেই লঞ্চটি গোত্তা খেয়ে ডুবে যেতে থাকে। রেসাদ ভাল করেই জানে আর ভেসে উঠবে না এই লঞ্চ। তবে এটুকু বিশ্বাস ওর আছে - লাইফ ভেস্ট একটু পরেই নীলাকে ভাসিয়ে দিবে। দুশ্চিন্তা একটাই, ‘শেষ মুহূর্তে মেয়েটা কি লম্বা করে শ্বাস নিয়েছিল?’
মৃত্যু কেমন? বোঝার চেষ্টা করছে রেসাদ।
সাইরেণের তীব্র শব্দ। ভুস করে একটা পুলিশ গাড়ি পার হয়ে যায়। রেসাদ ঘুরে তাকায়। চোখে ঝাপসা দৃষ্টি - ফলস থেকে উঠে আসা জলীয় বাস্প না চোখের জল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঘড়ির দিকে তাকায়, দু’টো বেজে গেছে। পা দু’টো ব্যাথায় টনটন করছে। স্বপ্ন দেখছিল রেসাদ। তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে স্বপ্নের আবেশে। এগারটায় আসার কথা ছিল। তারমানে আর আসবে না। রাগ-বিরক্ত কোনটাই হয় না রেসাদ। ভালবাসায় কোন শূন্যতা নেই ওর, দেখা হবে কোন একদিন নিশ্চয়। আর না হলেই বা কী? একটা জীবন পার করে দিতে পারবে অনায়াসেই। অপমানিত লাগছে কী?
বোধ একটা পর্যায়ে উঠে গেলে মান-অপমান এসব তুচ্ছ বিমূর্ত শব্দ ওজোন লেয়ার ভেদ করতে পারে না। ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন (সিএফসি) হচ্ছে তিন অক্সিজেন-মৌল-গঠিত এই ওজোন-চাদরের মহাশত্রু, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। মনের সিএফসিও নিশ্চয় আয়ত্ত্বের বাইরে নয়। ইচ্ছে করে কেউ আসছে না জেনেও দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকা, ক্লান্তিহীন। সিএফসি স্তরীভূত হচ্ছে দেহে, আলবৎ। যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিবে? না। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধাকে দুনিয়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল কান্ট্রি কোড +১ দিয়ে ফোন করলেও সে ধরবে না। তাই বলে ঐ ভদ্রলোককে ফোন করা কি বন্ধ করা হয়?
মান-অপমানবোধ সেখানেই বিদ্যমান, যেখানে অসীম প্রেমের পরিপূর্ণ কগনিটিভ বিকাশ হয় নাই। এক বর্ষণমূখর বন্যাকবলিত রাতে বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে সুরবালার নিশ্চুপ কথোপকথন কোন একদিন নায়াগ্রার পড়ন্ত বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে সুসম্পন্ন করা যায় অবশ্যই। শর্ত একটাই - প্রেমবোধীয় বিকাশসৃষ্ট হরমোনের যথোপযুক্ত নিঃসরণ। আজকের দিনটি সেই একদিন হয়নি, নিশ্চয় হবে আরেকদিন। দালাই লামাকে স্মরণ করা যায়, ’যত বেশী প্রেমময় হবে তত অকুতভয় আর সংকীর্ণতামুক্তি ঘটবে’।
রেসাদ নিজের মনেই বলে, তিনকোণা বস্তুটার ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা সব ভালবাসা নিংড়ে এনে তোর পানে ছুড়েছিলাম। ব্রাজিলের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সেই পাইতিতি শহরের বিশাল সোনার স্তুপ তোর সামনে ছিল। পপলারসারি পেরিয়ে যে নীল জলের বিশাল দিঘীটা, তাঁর সবগুলো পানি শুষে এনেছিলাম তোর কোমল পায়ের কাছে। লজ্জাবতী নির্লজ্জ ছিল সম্পূর্ণ সেদিন। নিশুতি রাতে মলিন আলোতে ফিসফিস করে বলেছিল। পরীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন চোখ ধরে যায়, ঝলসে যাওয়ার কাছাকাছি। যখন সমস্ত স্নায়ু বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে শাষণের, তখন শুনিয়েছিলাম। হায়! কোহিনুর ফিরিয়ে দেবার অসীম ক্ষমতা ব্রিটিশ কুইনের নেই। জেরুজালেম অধিগ্রহণ ছাড়ার সুবুদ্ধিও ইজরায়েলের নেই। কাঁধে কাঁধ, বুকে বুক লাগানোর উদারতা দুই কোরিয়ার আজও হয় নাই। আহারে! বড়ই দূর্ভাগা! দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা রেসাদের নাগালের বাইরে। হেলেন কেলারই কি ঠিক, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল এবং সুন্দর জিনিসটা দেখা যায় না, এমনকি ছোঁয়াও যায় না - শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়।’
ভুবন-বিখ্যাত নায়াগ্রা তেতো লাগে রেসাদের। শিবলীকে ফোন করে ‘দোস্ত, চলে আস। আমি টরন্টো ফিরব।’
‘এতো তাড়াতাড়ি?’
রেসাদ কিছু বলে না। একদিনের দুঃখটা বড় বেশী বাজে। দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয় শুধু।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
এম এম হোসেন ০৯/০৮/২০১৭ধন্যবাদ।
-
তীর্থের কাক ০৯/০৮/২০১৭দারুন
-
সাঁঝের তারা ০৯/০৮/২০১৭ভাল