www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শহীদ জব্বার ও আমার ভাষা

হাছেন আলি দাওয়ায় বসে হুক্কা টানছে।
আশ্বীনের মাঝামাঝি। ভাদ্রের কাঠফাঁটা গরমের রেশ এখনো বেশ আছে। সময়টা সকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁই ছুঁই। মধ্যগগনে সূর্য্যের তেজ বাড়তে বাড়তে উনুনের আঁচ হয়ে চারিদিক পুড়ছে যেন। লু হাওয়া বইছে আজ। বাতাসের ঝাপটা আগুনের হলকার মত গায়ে বিঁধছে। হাছেন আলি তখন থেকেই ঘামছে দর দর করে। দাওয়ার খুটিতে হেলান দিয়ে হুক্কার ধোঁয়া ছাড়ছে কুন্ডুলী পাকিয়ে। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে অনেক। একটু পরপর তাই বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মাটির দো’চালা ঘর, উপরের চালা খড়ের। দরজা-জানালা কাঠের, ভিতর থেকে বন্ধ এখন।
হাছেন আলির বউ ছাফাতুন পয়েলাবার পোয়াতি। বউটার বয়স বেশী না। প্রথম বাচ্চা, তাই ভয়ে আর ব্যাথায় দমকে দমকে উচ্চস্বরে কাৎরাচ্ছে বদ্ধ ঘরে। কান খাড়া করে আছে হাছেন আলি। কখন বাচ্চাটার জন্ম-কান্না শুনতে পায়। মুখের ভেতরটা তামাকের বিশ্রী ধোঁয়ায় তেতো হয়ে আছে। বড় করে একটা হাই তোলে, থু করে একদলা থুথু ফেলে কয়েকদিনের না-লেপা উঠোনের দিকে। বিরক্তি চরমে উঠেছে, ‘কখন যে হইব আল্লাহমাবুদ জানে?’
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনী চলে আসে হাছেন আলির, তন্দ্রামত আচ্ছন্নতা। টেরই পায় না কখন যে কেঁদে উঠে বাচ্চাটা। সম্বিৎ পায় খালাজীর ডাকে, ’ঐ হাছাইন্না, তাড়াতাড়ি আজান দে। তোর তো বিরাট ভাগ্য, পোলা হইছে তোর!’ খালা এতক্ষণ পোয়াতির ঘরেই ছিল। ঢুকেছে সেই ভোরে, বের হল এই মাত্র। ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার পশ্চাৎপদ পাঁচুয়া গ্রামে ডাক্তার-হাসপাতালের বিলাসিতা তেমন নাই। বড় ধরনের ঝামেলা না হলে পোয়াতির জন্য কেউ হাসপাতালে যায় না। এই খালাজীই এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বাচ্চা প্রসবের কাজ সারে।
হাছেন আলি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে। হুক্কা ফেলে ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। বুকটা ধরফর করছে উত্তেজনায়। বউ আর ছোট্ট ছেলেটার দিকে বিস্ময়ে তাকায়। রোগা আর এতটুকুন লাগে বাচ্চাটাকে। কেমন লেপ্টে আছে মায়ের সাথে। অবাক হয়ে ভাবে - আমার রক্ত, আমার কষ্টের ধন! এদিকে বউটা কষ্ট-যন্ত্রণার পর একেবারে নেতিয়ে পড়ে আছে। সকাল থেকেই প্রসবের ধকল সইছে যে! ক্লান্ত মুখে রাজ্যের সব লজ্জা ভরে স্বামীর দিকে তাকায়, আড়চোখে। হাছেন আলি গলার সমস্ত জোর এক করে চিৎকার দেয়, ’আল্লাহু আকবর ...।’
রোগা-পাতলা হলেও ছেলেটারে নিয়া হাছেন আলির বেজায় আনন্দ। আদর করে নাম রাখে, ’আব্দুল জব্বার’। সারাক্ষণ কোলে কোলে রাখে। পারতপক্ষে কারোরে দেয় না। ’বাজান, সোনা বাজান ক্ষিধা লাগছে? দুধ খাইবা?’ আরো কত কী! কোলে করে ধোপাঘাট হাটেও নিয়ে যায়। গরীবের সংসার, তারপরও এটা-ওটা কিনে দেয়। আনন্দে ঝলমল করে হাছেন আলি। হাটের মধ্যে নূরান কাকা একদিন বলে, ’হাছেন মিয়া, জব্বাররে স্কুলে দিবা না? কান্ধে কান্ধে আর কয়দিন ঘুরব।’
ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাইল কয়েক পশ্চিমে। যাই যাই করেও দেরী করে ফেলে হাছেন আলি। আসলে বাচ্চাটাকে ছেড়ে থাকতে মন চায় না। তাই একটু বেশী বয়সে স্কুলে যায় জব্বার, যখন সাত বছর ওর। অন্যরা কিন্তু পাঁচ/ছয় বছরেই ক্লাস ওয়ান শুরু করে দেয়। ’তাতে কী? এক দুই বছর কোন বিষয় না।’ হাছেন আলী স্বগোতক্তি করে।
স্কুল ভাল লাগে জব্বারের, ভীষণ। বাংলা অক্ষর শেখে, সুর করে নামতা পড়ে, কত ছড়া যে মুখস্ত করে ফেলে! তর তর করে ক্লাস ফোরে উঠেও যায়। স্কুলের মাঠ পরিস্কার করতে হবে, জব্বার সবার আগে। বার্ষিক ক্রীড়া, জব্বার সবার সামনে আবার। স্বয়ংক্রিয় নেতা যেন।
হাছেন আলির শরীরটা কয়দিন ধরে বেশ খারাপ। কাজে যেতে পারে না, বিছানায় শুয়ে থাকার অবস্থা। উত্তরের ক্ষেতে ধান গজিয়ে বাড়ছে তর তর করে। সেই সাথে আগাছাও, নিড়ানী দিতেই হবে। ’বাজান পয়সা দেও, খাতা কিনন লাগব।’ জব্বার ভয়ে ভয়ে বলে। দূর্বল স্বর হাছেন আলীর, ’আইজ আর স্কুলে যাওনের কাম নাই বাজান। উত্তরের ক্ষেতে যা। ঘাসগুলান নিড়ানী দিলে ধান জলদি বাড়ব।’
’আমারে যে স্কুলে যাওন লাগব বাজান, পরীক্ষা কয়দিন পর।’
হাছেন আলী দূর্বল শরীরে গলা উঁচু করে, ’রাখ তোর পরীক্ষা। ধান না হইলে খাবি কী?’
জব্বার চুপসে যায়। বাজানের শরীর আরো খারাপ হয়। কোনমতে চার ক্লাশ পার করে আর এগুতে পারে না। সবার বড় জব্বার, তাই সংসারের দায়িত্ব চলে আসে আপনাআপনি। স্কুলে যাওয়া আর হয় না। কিশোর বয়সেই ক্ষেতখামারীর দিকে নজর দিতে হয়। বছর কয়েক কেটেও যায়, এভাবে।
ক্ষেতের আইলে বসে ঘাসের ডগা দিয়ে দাঁত খিলায় জব্বার, একমনে। উদাস ভাবনা ওর, ’এক্কেরে ভাল্লাগে না। এই কইরা সারাজীবন থাকবার লাগব? উড়তে মন চায়, কত কিছু দেখবার চায়। না, এমনে থাকন যাইব না। কিছু একখান করনই লাগব।’
কিশোর জব্বার দিনরাত ভাবে। কোন কূলকিনারা পায় না তবুও। ক্ষেতের কাজ মোটেও করতে ইচ্ছে করে না। বাজানরে বলেছেও কয়েকবার। বাজান উল্টা ধমক দিছে, ’যা, কামে যা। কাম না করলে খাবি ক?’ শেষে একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে জব্বার, ’না, এমনে আর না। ক্ষেতের কাম করুম না আর। অন্য কিছু করবার লাগব।’
গফরগাঁও রেলস্টেশন মাইল কয়েক মাত্র। জব্বার গেছে মাঝেমধ্যে ওখানে। শেষবার গিয়েছিল কালামের বাবা যখন ঢাকা থেকে এসেছিল। স্টেশনের বেঞ্চিতে বসেছিল ওরা। বড় ভাল লাগে জব্বারের - কত ট্রেন আসে আর যায়! যাত্রীরা উঠছে-নামছে, কোলাহল-হট্টগোলে সয়লাব। সব ট্রেন নাকি নারায়নগঞ্জ থেকে ছাড়ে। জানে না, কোথায় ঐ শহর, কেমন দেখতে।
একদিন খুব রাতে আঁধার থাকতে থাকতে চোখ মেলে জব্বার। ভোর হতে তখনো ঢের বাকী আছে। ছোট ভাইবোন, মা-বাজান ঘুমিয়ে। বাঁশের গিরা উল্টিয়ে এতদিনের জমানো টাকাগুলো পকেটে রাখে। দরজা খুলে পা টিপে টিপে উঠোনে নামে। কাঁপছে একটু, বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটার আওয়াজ। অন্ধকারেই পিছন ফিরে চায় একটু। কষ্ট লাগে বুকে, চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়তে শুরু করে। মাত্র বছর পনের বয়স, কাঁদবে না!
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে, ধীরে ধীরে। জব্বার পা চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে। স্টেশনে পৌছাতে হবে, অন্ধকার থাকতেই। সারা মুখ ভর্তি নাকের-চোখের লোনা পানি। দু’চোখ ভয়ার্ত। এদিক-ওদিক চায়, কেউ যদি দেখে ফেলে। সরকার বাড়ির মোরগের ডাক শুনে, রহমত কাকার একটানা খক খক কাশি কানে আসে। দূরে ইয়াসিন ইমাম সাবের চেহারা দেখা যায়, মসজিদের দিকে আসছে। চকিতে গাছের আবডালে লুকিয়ে পড়ে জব্বার। রেলস্টেশনে আসতে আসতে ভয়ে-কষ্টে-উত্তেজনায় একেবারে বিধ্বস্ত ও।
কোথায় যেতে হবে? কিছুই জানেনা জব্বার। শুধুমাত্র নারায়নগঞ্জ নামটাই জানে সে। প্লাটফর্মে গাঁ এলিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ, জিরিয়ে নেয় একটু। চারিদিকে তাকায় - স্টেশনে কোন ট্রেন নেই এখন, যাত্রীদের কোলাহলও নেই। পাশের টং ঘরের দিকে চোখ পরতেই ক্ষিধাটা টের পায়। বনরুটি আর কলা শেষ করে পেট ভরে পানি খায়। বসে বসে ঝিমাতে থাকে, কতক্ষণ জানে না ও। হুইসেল বাজিয়ে একটা ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকে এসময়। চারিদিকে চিৎকার-হট্টগোল। কিছু না ভেবেই ঐটাতে উঠে পড়ে জব্বার। ও জানে সব ট্রেনই নারায়নগঞ্জ যাবে। ট্রেনের দুলুনী আর একটানা ঝক্কর ঝক্কর শব্দে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে, গভীর সে ঘুম।
’টিকেট, টিকেট’ টিটির হাঁক।
ঘুমিয়েই থাকে জব্বার।
’এই ছেলে, তোমার টিকেট কই?’ টিটি ঠেলা দেয় ঘুমন্ত জব্বারকে।
জব্বার ধরফর করে উঠে বসে। শূন্য দৃষ্টিতে চারিদিকে চায়। ভয়ে সেঁধিয়ে যায় অনেকখানি - সাদা ইউনিফর্ম পড়া টিটিকে দেখে।
’টিকেট কই?’ টিটি আবার তাড়া দেয়।
’টিকেটতো নাই।’ জব্বার ঢোক গিলে।
’কোথায় যাবা তুমি?’
’নারায়নগঞ্জ।’
’ঠিক আছে, এই ট্রেন নারায়ণগঞ্জ যাবে। ভাড়া দেও।’
পকেট হাতড়ে ভাড়া দেয় জব্বার। আবার ঘুমিয়ে পরে।
ট্রেনের হুইসেল আর যাত্রীদের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে জব্বারের। থেমে পড়েছে ট্রেন। চোখ ডলতে ডলতে প্লাটফর্মে নামে ও। বানান করে পড়ে স্টেশনের নাম - নারায়ণগঞ্জ। সাদা দেয়ালের উপর কালো হরফে লেখা। বিশাল স্টেশন, চারিদিকে তাকায় বিষ্ময়ে! যতদূর চোখ যায় খালি ট্রেন আর মানুষ। দেখে দেখে মুগ্ধ জব্বার। এদিক-ওদিক হাঁটতে থাকে, উদ্দেশ্যহীন। কৌতুহলী চোখ থেমে যায় এক জায়গায়, আচমকাই। অবাক হয়ে দেখতে থাকে পলকহীন। ধবধবে সাদা গায়ের রং, সোনালী চুল, পড়নে সাহেবদের পোষাক, চোখে সোনালী চশমা। এমন মানুষ আগে দেখেনি ও। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায়। লোকটা যেদিকে যায়, জব্বারও সেদিকে যায়। যেন চুম্বকের টানে চলে পিছু পিছু।
একসময় টের পায় লোকটা। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলে, ’টুমি আমার পিছু নিয়েছ কেন?’
জব্বার কিছু বলে না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু।
লোকটা আবারো বলে, ’টুমি কে? টোমার নাম কী?’
জব্বার এবারো চুপ। লোকটা কী বলছে ঠিক ঠাওর করতে পারে না।
কী যেন চিন্তা করে লোকটি। বলে, ’হামার সাথে আস।’
ওরা হেঁটে স্টেশনের কাছেই একটা খাওয়ার হোটেলে ঢোকে। অর্ডার দেয় লোকটা - পরাটা-ভাজি-হালুয়া। জব্বার সহজ হয়। সাদা লোকটা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক প্রশ্ন করে জেনে নেয় সব। বলে, ’হামি এখান থেকে জাহাজে করে রেঙ্গুন যাচ্ছি, বার্মাদেশে। টুমি যাবে হামার সাথে?’
জব্বার হ্যা-সূচক মাথা নাড়ে।
ত্রস্ত পায়ে বিদেশী লোকটার সাথে স্টিমার ঘাটের দিকে হাঁটে জব্বার। উড়ুক্কু মন ছলাৎ-ছলাৎ করে। রক্তে রোমাঞ্চনেশার বাণ ডাকে যেন। এমন কিছুইতো চেয়েছিল ও। ছোট ছোট পা ফেলে জাহাজময় ঘুরে বেড়ায়। যা দেখে তাই ভাল লাগে। কত্ত বড়! আর কী পরিস্কার সবকিছু! সাদা লোকটা জাহাজের ক্যাপ্টেন, সবচেয়ে বড়। ক্যাপ্টেনের এটা-ওটা ফরমায়েশ খাটে জব্বার। জাহাজ চলছে রেঙ্গুনের পথে। ও জানেনা এ শহর কোথায়। নামই শোনেনি কোনদিন!
মাঝে মাঝেই কেমন উদাস হয়ে যায় কিশোর মন। আনমনে তাকিয়ে থাকে বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির দিকে। বাবা-মা, ছোট ভাই-বোনের কথা মনে পরে। ডাঙ্গুলী খেলত যে জয়নাল আর কাশেম সেকথাও ভুলতে পারে না। অবুঝ মন, কাঁদার আর সময়জ্ঞান নাই যেন। ডুকরে ডুকরে কাঁদে, যখন-তখন। সময় গড়িয়ে যায়। এক সময় ঠিকই রেঙ্গুন চলে আসে জাহাজ।
ক্যাপ্টেন ওর কাজে বেজায় খুশি হয়। জাহাজ থেকে নামার আগেই চাকরির প্রস্তাব দেয়, ’টোমাকে জাহাজের নাবিকের কাজ দিব, করবে?’
জব্বার যেন এটাই চেয়েছিল। তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ’আমি করব।’
এরপর কেটে যায় দিন-মাস-বছর, অনেকগুলো । ব্রিটিশ শিপ বার্মা থেকে নোঙ্গর তুলে বন্দরে বন্দরে ঘুরতে থাকে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ঘুরে জাহাজ আফ্রিকা উপকূলের দিকে যায়। সোমালিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া আরো কত কত দেশ! মনেও করতে পারে না অনেক নাম। নতুন নতুন ঘটনাবলী-দৃশ্যাবলী মুগ্ধ করে ওকে। অত্যধিক কাজের চাপ আর ভ্রমণ-রোমাঞ্চ বাড়ির কথা, গ্রামের কথা ভুলিয়ে দেয়; মনে পড়ে না তেমন। বছরের পর বছর পার করে দেয় সাগরে ভাসতে ভাসতে, বার বছর হবে বোধ করি।
ইদানিং নাড়ীর টান টের পায় ও, এত বছর পর। মন একলা লাগে যখন-তখন, কাজে-কর্মে ভুলভাল। জাহাজের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে বিশাল সমুদ্রের দিকে, শূন্য দৃষ্টিতে। অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস, নিত্য ঘটতে থাকে। ক্যাপ্টেন টেরও পায় বিষয়টা। বলে, ’টুমি ছুটি নেও। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসো ক’দিন।’
জব্বার লাফিয়ে উঠে যেন। কতদিন দেখেনা ওদের! মারে, বাজানরে, ভাই-বোন, গ্রামের মানুষ। সবার কথা মনে পড়ছে, দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এবার ও যাবে, দেশে যাবে। গফরগাঁয়ের পাঁচুয়া গ্রামে।
পালিয়ে যাওয়া সেই কিশোরটি দীর্ঘ বার বছর পর পূর্ণ যুবক হয়ে গর্বিত পায়ে গ্রামে ফিরে - সাহেবী পোষাক পরে, চুলে টেরী কেটে। মুখে গাম্ভীর্য ধরে রাখবে বলে পণ করেছিল। গ্রামের সীমানায় এসে এর লেশমাত্রও থাকে না। ছোট্ট কিশোরটি হয়েই সে গ্রামের আঙিনায় ঢুকে পড়ে। মারে, বাজানরে বলে চিৎকার করতে করতে বাড়ির সীমানায় এসেও পড়ে। মাটির সেই ঘরের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে বিবর্ণ-রোগাক্লিস্ট মা-বাজান দুজনেই।
বাঁধভাঙ্গা কান্না ছেড়ে দেয় মা। সজোড়ে জাপটে ধরে, ’জব্বাররে! কই আছিলি এতদিন মারে থুইয়া?’
হাছেন আলি ঠিক কাঁদে না, বরঞ্চ রাগ-দুঃখ-অভিমানের মিশেলে কম্পমান স্বরে বলে, ’এতদিন পর বাজানরে মনে পরল? আয় ভিতরে আয়। জব্বারের মা, খালি কানবা না ওরে কিছু খাইতে দিবা।’
ছোট ভাই-বোনরা ঘিরে ধরে। সাহেবদের সাথে অনেকদিন থেকে ইংরেজী ভাষা কিছুটা শিখে নিয়েছে জব্বার। টুকটাক বলে ওদের সাথে, ’হাউ আর ইউ? আই এম ফাইন’ জাতীয়। ওরা অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে থাকে। অনেক উপহার সাথে নিয়ে এসেছে জব্বার। অনিচ্ছাকৃত গর্বভরে সেগুলো বিলাতেও থাকে।
ছোঠ ভাই কাদের অনুনয় করে, ’ভাইজান, এইটা কিস্তু আমার।’ বইলাই নিয়া দে ছুট।
রাশিদা একটু অভিমানী, ’এইটা না দিলে আমি কিস্তু অন্যকিছু নিমু না।’
জব্বারের গর্বের হাসি দু’কান অব্দি ছুঁেয়ে যায়। ছোটবেলার বন্ধুরা আসে - জব্বারের প্রতিপত্তি, পোশাক-আশাক, ইংরেজী ভাষায় কথাবলা দেখে রীতিমত হকচকিয়ে যায়। এক কথায় ওস্তাদ করে ফেলে ওকে। কাছাকাছি বয়সের বেশ কিছু বন্ধুদের নিয়ে বসে একদিন। অনেক আলোচনা করে। শেষমেষ একটা দল করে ফেলে। লক্ষ্য - গ্রামের সকলের বিপদে-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা করা। অল্প দিনেই জব্বারের নেতৃত্বে গড়া দলটি এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
’কালাম, কালাম বাড়িতে আছিস?’ হন্তদন্ত জব্বার কালামের বাড়ির উঠানে ঢুকে পড়ে, একদিন। কালাম জব্বারের দলেরই একজন - একনিষ্ঠ কর্মী। ওকে নিয়ে দক্ষিণ পাড়ায় যাবে, শালিস আছে। সূর্য্য তখন দুপুর গড়িয়ে বিকালের দিকে। গোবর দিয়ে যতœ করে লেপা পুরো উঠোন জুড়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোছায়ার খেলা। একপাশে ধুন্দুলের মাঁচা, কচি কচি ধুন্দুল ঝুলছে। তারই নিকটে পলো দিয়ে ঢাকা কতকগুলি মুরগির বাচ্চা। একটি মেয়ে মুঠোভর্তি খুঁদ ছুড়ে দিচ্ছে। আওয়াজে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটি,
’আপনি, ভাইজানরে খুঁজতাছেন? উনিতো বাড়িত নাই।’
এতটু থতমত খায় জব্বার। আমতা আমতা করে বলে, ’আমি জব্বার।’
মেয়েটি সপ্রতিভ। সাথে সাথে বলে, ’আমি আপনারে চিনি, ভাইজানের দোস্ত। আমার নাম আমেনা। আমি উনার ছোট বইন।’
’ঠিক আছে, আমি পরে আসুমনে। কালামরে কইবেন আমি আইছেলাম।’
’জি আচ্ছা।’
কালামের বাড়ি থেকে বের হয়ে জব্বারের কেমন কেমন লাগে। মনে হয় আবার যায়। মেয়েটিকে ভাল লেগে যায় নিজের অজান্তেই। প্রায়ই যায় ঐ বাড়িতে। বাজানের সাথে কথা বলে একসময়, বিয়ের ব্যাপারে। জব্বারের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব যায় এবং অতিদ্রুত আমেনার সাথে জব্বারের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বড় আনন্দময় জীবন কাঁটে এরপর। নতুন বউরে লইয়া সারাক্ষণ ঘুটুর ঘুটুর জব্বারের।
এরই মাঝে আমেনার কোলজুড়ে সন্তান আসে। গালভরা নামও রাখে, ’নুরুল ইসলাম বাদল’। কোলে-পিঠে করে কাটে শিশু বাদলের দিন। দেখতে দেখতে পনের মাস হয়ে যায় বাদলের। হামাগুড়ি দিয়ে হাটে, পিট পিট করে তাকায়, খল খল করে হাসে আর সারা ঘরময় ছুটে বেড়ায়। সুখের আবেশে জব্বারের শরীর ধরে আসে। ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না।
বউ উদ্বিগ্ন একদিন, ’দেখেন না, মার য্যান কী হইছে। বুকের কাছটা ব্যাথা। ডাক্তারের কাছে নেওন লাগব।’
’ঠিক আছে, কাইল যামুনে।’
ময়মনসিংহ সদর হাসপাতাল বলে দেয় অবস্থা বিশেষ ভাল না। ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। অগত্যা শাশুড়ীরে নিয়ে ঢাকা রওনা দেয় জব্বার। ভাগ্যক্রমে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে ফেলতে পারে। বিভিন্ন চেকআপ, টেস্ট চলতে থাকে। ডাক্তাররা আসে ভিজিটে, চলেও যায়। জব্বার লক্ষ্য করে ডাক্তারদের মধ্যে কেমন চাপা উত্তেজনা। পরস্পর নিচু স্বরে কথা বলে, কোথাও যেন কিছু হচ্ছে টের পায় ও। দুই ডাক্তারের কথায় কান খাড়া করে একসময়।
’দেখলেন ভাই, এই বায়ান্নর জানুয়ারির শেষেও খাজা নাজিমুদ্দিন একই কাজ করল। আটচল্লিশের জিন্নার পুরনো কথাই রাখল, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এখন লোকজন মিছিল-মিটিং করবে, ক্ষেপে উঠা ছাত্ররা কী করবে কে জানে?’
’তাইত দেখলাম, খাঁজা সাহেবের কারণেই ৩০ জানুয়ারি হরতাল করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ভাগ্যিস খুনখারাবি হয় নাই সেদিন!’
’সেদিন হয় নাই বলে কি এখন হবে না? পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই তো অগণিত সভা-সমাবেশ হচ্ছে। কিন্তু আমি খুবই উদ্বিগ্ন কালকের সমাবেশ নিয়ে।’
’কেন ভাই? কালকে সমস্যা কী?’
’কাল একুশে ফেব্রয়ারি সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি আবার সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রীতিমত ফুঁসে আছে - হয় এসপার, নয় ওসপার। জান দিবে তবু মায়ের ভাষা ছাড়বে না। এদিকে খাঁজা সাহেবতো ১৪৪ ধারা দিয়ে ফেলেছে কাল। মিছিল করলেই গুলি।’
’তাই নাকি? তবেতো দু’পক্ষ একেবারে মুখোমুখি। আপনার কী মনে হয়, ছাত্ররা নামবে রাস্তায়?’
’অবশ্যই নামবে। বাঙ্গালীর রক্ত আপনি চিনেন না? এমনিতে বিড়াল স্বভাব, কিন্তু ক্ষেপে গেলে কেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ে যায়। কাল রাস্তায় নামতেই হবে - আমার, আমাদের।’
’ঠিক তাই। নামবই আমরা।’ বজ্রমুষ্ঠিতে অন্য ডাক্তার বলে।
জব্বার মনযোগ দিয়ে শুনে এসব কথা। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা অনুভব করে। কিছু একটা করতে চায় মন, কিন্তু জানে না কী করতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে যথারীতি হাসপাতালে শাশুড়ীর বেডে আসে। নার্সের কথামত ফল কিনতে বাইরে যায়। তখনই চোখ ছানাবড়া! বিরাট মিছিল এগিয়ে আসছে, হাসপাতালের গেটের সামনের রাস্তা ধরে। বিভিন্ন বয়সী লোকজন। যুবক বয়সী ছাত্ররাই বেশী। হাত উঁচু করতে করতে গর্বিত পা ফেলছে, বজ্রকণ্ঠে।
মুহূর্তে সব ভুলে যায় জব্বার। হাসপাতালের নার্স-রোগী, অসুস্থ শাশুড়ী, ফল কেনা সব, সব ভুলে যায় নিমিষেই। পার্থিব চিন্তা সব লোপ পায়। চোখে পড়ে শুধু ব্যানার আর ব্যানার। বানান করে পড়ে ও - বড় হরফে লেখা, ’রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঝট করে গায়ের সব লোম দাড়িয়ে যায়। উত্তেজনার তীব্র ¯্রােত শিরদাড়া বেয়ে উঠে আর নামে। হাত-পা মৃদু কাঁপে। কোত্থেকে অজানা শক্তি শরীরে ভর করতে থাকে। মুষ্ঠি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। সাহসী পায়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায় ও, মিছিলের দিকে। বজ্রমুষ্ঠিতে একটা ব্যানার ধরে বলে, ’আমার কাছে এইডা দেন’।
শরীরের সমস্ত শক্তি গলার কাছে এনে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার দেয় জব্বার, ’রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই’। দিতেই থাকে সেই চিৎকার, যত দেয় আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মিছিলের একেবারে সম্মুখে ও - পিছনে কারো আড়ালে থাকতে চায় না, বুক চিতিয়ে সামনে হাটবে বলে।
বেশীদুর যেতে পারে না, এভাবে। হঠাৎ গুলির শব্দ হয়। চারিদিকে ছুটাছুটি, গগনবিদারী চিৎকার। পাশের জনকে পড়ে যেতে দেখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে মাথার কাছ থেকে। জব্বার আরো ফুঁসে উঠে, কণ্ঠের নিনাদ আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশ ছোঁয় যেন। আবার গুলির শব্দ। বাবারে! মারে! বলে বসে পড়ে জব্বার। বা পায়ের হাটুর কাছে কী যেন হয়েছে - কোন বোধশক্তি নেই। চোখের কোনে রক্তের ধারা দেখতে পায়, বা পা বেয়ে। পরবর্তী গুলিটা ঠিক মাজার কাছে লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জব্বার। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা তড়িৎ অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেয়।
মানসপটে মায়ের মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠে জব্বারের। বউটা কাইন্দাকাইট্টা কইছিল, সাবধানে থাকতে। কী যে ভালবাসত ওরে! বাদলটা যে কী করছে আল্লাহই জানে। পনের মাসের পোলাডা ওর মারে কেমনে মাও মাও করে ডাকত। আহারে! ধীরে ধীরে চোখ আঁধার হয়ে আসে জব্বারের। কিছুই দেখে না আর।
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় শহীদ অকুতোভয় আব্দুল জব্বার। আমার মা আর আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি - ঐ মানুষটা সেদিন ব্যানার হাতে তুলেছিল বলেই। অচেনা পাঁচুয়া গ্রামের ছোট্ট ছেলেটি আজ বিশ্বব্যাপী বীরত্বের প্রতীক, গণমানুষের প্রেরণা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৫৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৬/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এম এম হোসেন ১১/০৮/২০১৭
    ভাল
  • অনেক কিছু জানান গেল।
  • সাঁঝের তারা ০৬/০৮/২০১৭
    খুব ভালো
 
Quantcast