শূন্যদিদি
সময় খুব কম।হাটতে হাটতে বারবার ঘড়িটা দেখে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কী একটা জরুরি কাজে বড়কর্তা তলব করেছে।সাতটা বাজবার পূর্বেই আমাকে স্টেশনে পৌছাতে হবে।টিকেট কেনাই ছিল।তাই পৌছে আর কাউন্টার হাতরাবার প্রয়োজন হলো না।গাড়ি প্লাটফর্মেই ছিল।আমাদের দেশে যাবার গাড়িটা দেখলেই চেনা যায়। ব্রডগেজ গাড়ি।অথচ ঐ সময়ে অন্য যে গাড়িগুলো ছাড়ে তার সবই মিটারগেজ।টিকিটখানা বের করে একবার দেখে নিলাম।আমাদের ওয়াগনটা গাড়ির মাঝামাঝি ছিল।গাড়িতে উঠে দেখলাম আমার সিটটায় অন্য একজন বসে আছে।আমি ছোটবেলা থেকেই একটু শান্ত বলে সবাই বেশ খাতির করে।স্কুলের মাষ্টারমশাই আমাকে চাঁদের সাথে তুলনা করতেন।কেউ হয়তো খানিকটা ঠাট্টাও করতো।সেই শান্ত স্বভাবটা এখনও রয়ে গেছে।আসনের ভরসা ছেড়ে যুতসই একটা আসন খুজে নিয়ে জানালার ধারে বসে পরলাম।পাশের আসনগুলোতে যারা ছিল তাদের সাথে মনে হলো আলাপ তেমন জমবে না। তাই জানালা দিয়ে প্রকৃতির সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছিলাম।খানিকপর একটা চেনা প্রশ্ন এল 'কোন স্টেশন'। বললাম,'আব্দুলপুর'।
গাড়ি এক ধাক্কায় ঈশ্বরদী এসে তবেই থামলো।সেখানে বোধ হয় গাড়ির ইঞ্জিনটা বদল করা হলো।আমি দেরী দেখে কিছু চানাচুর কিনে চিবালাম।পাকশী এলেই হার্ডিঞ্জটা দেখা যায়।খাটি মাল বটে।বেটা ইংরেজরা যে এত লোহালস্কর নিয়ে পানির মধ্যে এ ব্রিজটা সেকেলে কীভাবে বানিয়েছিল তা ঈশ্বর আর তারা জানে।সেতুটার উপর বেশ উপভোগ হলো।ফটো তুলবার ক্যামেরাটা বাড়িয়ে কয়েকটা ফটো তুলে নিলাম।এক হকার বই বিক্রি করছিল।ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার প্রতি খুব ঝোঁক।সে ঝোঁকটা কখনো কাউকে দেখাতে পারি নি বলে নিজেকে বেজায় ভীতু মনে হয়।সে ঝোকে আসল যে বাধাটা ছিল সে হলো বড়কর্তা।মা অতসব বুঝতেন না।তার মতে বই পড়লেই হলো।কিন্তু সেটা যে গল্প,নাটক কিংবা উপন্যাসর বই তা চিনিয়ে দিত বড়কর্তা।আর বলতো,'ওসব বই কোন কাজের নয়,পার তো কাজে যাও,নয়তো চোখের আড়াল হও'।আমি চোখের আড়াল হতাম তবে বইটা নিয়ে।বাড়িতে আমার প্রতিপত্তি কম বলে ওসব বই বেশি পড়া হয় না।তবু ছোট বেলায় তেপ্পান্নটা গল্পের বই যোগাড় করেছিলাম।পরে বকুনি খেয়ে তাও দোকানে বেচে দিই।তবে এবারে দুটো বই খুব পছন্দ হলো।দামও ভালো।কিনে নিলাম।এরপর গাড়ি থামল ভেড়ামারা। সেখানে পাশের সিটের মানুষগুলো বদল হলো।এবারের সঙ্গী গুলো কিছুটা হলেও শিক্ষিত।তাই আলাপ জমতে লাগল।ঠিক বিপরীতে যে ছেলেটি বসেছে সে বিএ ক্লাসে সবে প্রবেশ করেছে।পাশের সিটে যে মহিলাটি বসেছে সে হয়তো মেট্রিক বা ইন্টার পাশ করে বিয়েটা চুকিয়েছে। দুই ছেলের জননী।দেখতে সে একজন সাধারন বাঙালী নারীই।সেই এ পাঠের আসল চরিত্র।সামনের ছেলেটি আমাকে অনেক প্রশ্ন করে শেষে বলল,'নাম কী তোমার?'
'সূর্যকেশর।'
একটু নিস্তব্দ হয়ে রইলাম সকলে।যদিও সবার নিস্তব্দতার কারণ ভিন্ন। খুলেই বলছি।যে দিদিটি পাশে বসে ছিল তার ভাই ট্রাকে এক্সিডেন্ট করে গুরুতর আহত।কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে।একমাত্র ভাই।খুব কান্না পাচ্ছে এটা তার কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল।লোকটিরও দুটি সন্তান আছে।এক ছেলে এক মেয়ে।আমি সবই শুনছিলাম আর প্রকৃতিকে দেখছিলাম।মনে মনে প্রকৃতিকে বলছিলাম,'ঈশ্বর তোমারে গড়েছে সুন্দর,আমারে নিয়ে যত খেলা।'
মহিলার বয়স পচিশের কাছাকাছি।বয়সের কারনেই সে হয়তো একটু বেশী ভেঙ্গে পড়েছে।তাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে।
সামনে কালুখালী।সেখানে গেলে আমাদের আর এ গাড়িতে যাওয়া হবে না।দিদির আর আমার গন্তব্য একই।সামনের ছেলেটাই কেবল নামবে না।সে আর এক স্টেশন পরে নামবে। তাই আমাদের চুক্তি হলো যে,ঐ ছেলেটা দিদির ব্যাগগুলো জানালা দিয়ে দিবে আর আমি সেগুলো নিচ থেকে নামাবো।দেখলাম দিদিই আগে গিয়ে ব্যাগ নামাচ্ছে।তা আর দিলাম না। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্য গাড়িতে উঠলাম।তাদের পাশেই একটা আসনে বসলাম।সেখানে আগে থেকেই দুটো ছেলে বসে ছিল।একজনের কাছে মনে হলো গিটার।গান না পারুক হাল ফ্যাশান তো বটে।অনবরত হকারেরা ডেকে চলেছে,
'কমলা,মিষ্টি কমলা'
বেদানা,ভাল বেদানা আছে'
চার বাটি বিশ টাকা'
'কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা'
আরো কতো কী!
দিদির ছোট ছেলে হঠাৎ কমলা খাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠল।এক কেজি কমলা কেনা হল। একটু লোভের সাথেই অস্বাভাবিক ভেবে বসলাম,বুঝি সবাইকে একটা করে দেবে। তা না হয়ে স্বাভাবিকটাই হলো।একটু পরই তার স্বামী ফোন করল।তখন সে বলল,'দুটি ছেলে ছিল খুব ভালো তারাই এগিয়ে দিয়েছে,একজন আমাদের সাথেই মধুখালী যাবে'।'খুব ভালো'।কথাটি নতুন মনে হলো। মনে হলো নিজের সম্পর্কে এই প্রথম শুনলাম।গর্বে বুকটা ভরে উঠল।তবু তো কেউ আমাকে ভালো বলে মন্তব্য করেছে।শেষে স্টেশনে তার মালপত্র নামিয়ে দিয়ে তবেই আমি বিদায় নিলাম।গল্পটা এখানেই শেষ। তার আগে দিদির পরিচয়টা দেই।ঠিকানাটা কী যেন বলেছিল মনে নেই। আর নাম?সে তো শোনাই হয় নি।তাই নামের খাতাটা শূন্য।তবুও খুব ভালো।
গাড়ি এক ধাক্কায় ঈশ্বরদী এসে তবেই থামলো।সেখানে বোধ হয় গাড়ির ইঞ্জিনটা বদল করা হলো।আমি দেরী দেখে কিছু চানাচুর কিনে চিবালাম।পাকশী এলেই হার্ডিঞ্জটা দেখা যায়।খাটি মাল বটে।বেটা ইংরেজরা যে এত লোহালস্কর নিয়ে পানির মধ্যে এ ব্রিজটা সেকেলে কীভাবে বানিয়েছিল তা ঈশ্বর আর তারা জানে।সেতুটার উপর বেশ উপভোগ হলো।ফটো তুলবার ক্যামেরাটা বাড়িয়ে কয়েকটা ফটো তুলে নিলাম।এক হকার বই বিক্রি করছিল।ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার প্রতি খুব ঝোঁক।সে ঝোঁকটা কখনো কাউকে দেখাতে পারি নি বলে নিজেকে বেজায় ভীতু মনে হয়।সে ঝোকে আসল যে বাধাটা ছিল সে হলো বড়কর্তা।মা অতসব বুঝতেন না।তার মতে বই পড়লেই হলো।কিন্তু সেটা যে গল্প,নাটক কিংবা উপন্যাসর বই তা চিনিয়ে দিত বড়কর্তা।আর বলতো,'ওসব বই কোন কাজের নয়,পার তো কাজে যাও,নয়তো চোখের আড়াল হও'।আমি চোখের আড়াল হতাম তবে বইটা নিয়ে।বাড়িতে আমার প্রতিপত্তি কম বলে ওসব বই বেশি পড়া হয় না।তবু ছোট বেলায় তেপ্পান্নটা গল্পের বই যোগাড় করেছিলাম।পরে বকুনি খেয়ে তাও দোকানে বেচে দিই।তবে এবারে দুটো বই খুব পছন্দ হলো।দামও ভালো।কিনে নিলাম।এরপর গাড়ি থামল ভেড়ামারা। সেখানে পাশের সিটের মানুষগুলো বদল হলো।এবারের সঙ্গী গুলো কিছুটা হলেও শিক্ষিত।তাই আলাপ জমতে লাগল।ঠিক বিপরীতে যে ছেলেটি বসেছে সে বিএ ক্লাসে সবে প্রবেশ করেছে।পাশের সিটে যে মহিলাটি বসেছে সে হয়তো মেট্রিক বা ইন্টার পাশ করে বিয়েটা চুকিয়েছে। দুই ছেলের জননী।দেখতে সে একজন সাধারন বাঙালী নারীই।সেই এ পাঠের আসল চরিত্র।সামনের ছেলেটি আমাকে অনেক প্রশ্ন করে শেষে বলল,'নাম কী তোমার?'
'সূর্যকেশর।'
একটু নিস্তব্দ হয়ে রইলাম সকলে।যদিও সবার নিস্তব্দতার কারণ ভিন্ন। খুলেই বলছি।যে দিদিটি পাশে বসে ছিল তার ভাই ট্রাকে এক্সিডেন্ট করে গুরুতর আহত।কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে।একমাত্র ভাই।খুব কান্না পাচ্ছে এটা তার কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল।লোকটিরও দুটি সন্তান আছে।এক ছেলে এক মেয়ে।আমি সবই শুনছিলাম আর প্রকৃতিকে দেখছিলাম।মনে মনে প্রকৃতিকে বলছিলাম,'ঈশ্বর তোমারে গড়েছে সুন্দর,আমারে নিয়ে যত খেলা।'
মহিলার বয়স পচিশের কাছাকাছি।বয়সের কারনেই সে হয়তো একটু বেশী ভেঙ্গে পড়েছে।তাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে।
সামনে কালুখালী।সেখানে গেলে আমাদের আর এ গাড়িতে যাওয়া হবে না।দিদির আর আমার গন্তব্য একই।সামনের ছেলেটাই কেবল নামবে না।সে আর এক স্টেশন পরে নামবে। তাই আমাদের চুক্তি হলো যে,ঐ ছেলেটা দিদির ব্যাগগুলো জানালা দিয়ে দিবে আর আমি সেগুলো নিচ থেকে নামাবো।দেখলাম দিদিই আগে গিয়ে ব্যাগ নামাচ্ছে।তা আর দিলাম না। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্য গাড়িতে উঠলাম।তাদের পাশেই একটা আসনে বসলাম।সেখানে আগে থেকেই দুটো ছেলে বসে ছিল।একজনের কাছে মনে হলো গিটার।গান না পারুক হাল ফ্যাশান তো বটে।অনবরত হকারেরা ডেকে চলেছে,
'কমলা,মিষ্টি কমলা'
বেদানা,ভাল বেদানা আছে'
চার বাটি বিশ টাকা'
'কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা'
আরো কতো কী!
দিদির ছোট ছেলে হঠাৎ কমলা খাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠল।এক কেজি কমলা কেনা হল। একটু লোভের সাথেই অস্বাভাবিক ভেবে বসলাম,বুঝি সবাইকে একটা করে দেবে। তা না হয়ে স্বাভাবিকটাই হলো।একটু পরই তার স্বামী ফোন করল।তখন সে বলল,'দুটি ছেলে ছিল খুব ভালো তারাই এগিয়ে দিয়েছে,একজন আমাদের সাথেই মধুখালী যাবে'।'খুব ভালো'।কথাটি নতুন মনে হলো। মনে হলো নিজের সম্পর্কে এই প্রথম শুনলাম।গর্বে বুকটা ভরে উঠল।তবু তো কেউ আমাকে ভালো বলে মন্তব্য করেছে।শেষে স্টেশনে তার মালপত্র নামিয়ে দিয়ে তবেই আমি বিদায় নিলাম।গল্পটা এখানেই শেষ। তার আগে দিদির পরিচয়টা দেই।ঠিকানাটা কী যেন বলেছিল মনে নেই। আর নাম?সে তো শোনাই হয় নি।তাই নামের খাতাটা শূন্য।তবুও খুব ভালো।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
তরিকুল ইসলাম ২৯/০৩/২০১৮সুন্দর
-
বিশ্বামিত্র ২৭/০৩/২০১৮গল্পটা শেষ হোলে ভাল লাগত।
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৭/০৩/২০১৮আমারতো ভাল লেগেছে লেখাটি।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২৬/০৩/২০১৮আরো ভালো হতে পারতো
-
এম এম হোসেন ২৫/০৩/২০১৮চমৎকার লেখনী।যদিও গল্পের শেষটায় বিশেষ কিছু পাবো বলে ভেবেছিলাম।