অনুতে ভালবাসার পৃথিবী
আমার ভালবাসাটা গল্পে যেতে পারেনি । এর আগেই শিশিরের মতন ফুরিয়ে গেছে রোদের ছোঁয়ায় ! হারিয়ে গেছে দূর অজানায় । হয়ে গেছি বড় অচেনা । পূর্ণতা পাওয়ার আগেই শুন্যতায় ঢেকে গেল যার ফলে আমার প্রেমকে প্রেম বা ভালবাসা বলতে পারি না । আমার ভালবাসাকে গল্পে রুপ দেওয়ার মত এতদূর যায়নি । তবুও আমার কাছে আমার জীবনের সবচাইতে সুখকর,কষ্টকর,বেদনাদায়ক, আনন্দদায়ক ক্ষণ আমার ভালবাসার সময়টূকু । আমার ভালবাসার মুহুর্তগুলোই আমার জীবনের প্রিয়গল্প । ডিসেম্বর ২০০৮ এর শেষ এর দিকে আমার রোমাঞ্চকর মুহুর্তের সূচনা হয়েছিল খুব গভীর ভাবে স্ব-ইচ্ছাতেই । ‘অনু’ – আমার ভালবাসা । আমার সুখ, আমার খোলা আকাশ । আমার কপোলের অশ্রুরেখা । পুরো নাম অনন্যা, অনন্যা নামে ডাকি আমি । সে যে সত্যিই অনন্যা, কিসে তুলনা তার সাথে , পাইনি আজও । অনু আমার হৃদয়ের প্রতিটা অনুতে ইন্রিয়তে বিরাজমান !
ডিসেম্বর ২০০৮ । জীবনে সহজে কোন মেয়ে দর্শন আমার জন্য সহজ হয়ে উঠতো না সাহস বা যোগ্যতার অভাবেই হয়তো । বন্ধুদের কতজনের ভালবাসার কল্প কাহিনী শুনি । হাসিকান্নায় মিশ্রিত তাদের ভালবাসার গল্প । কখনও রাগারাগি-চুলটানি চুল ছিড়ি , আবার আদর করি বুকটার মাঝে জড়াইয়া । এরুপ কত সুখের গল্প বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে শুনতে নিজের অজান্তের একটা ভালবাসা পাবার প্রতি অধীর আগ্রহে দিন গুনছিলাম । আশা ছিল কোন এক অপরুপ রমনী স্বপ্রণধিত হয়ে আমার হাতে একটা লাল গোলাপ বা প্রজাপতি আঁকা হলুদ খামে চিঠি ধরিয়ে দেবে । ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে অনার্স ১ম বর্ষে এ্যডমিশন নেওয়ার পরও সেরুপ কোন রমনীর দেখা পাচ্ছিলাম না । জীবন আমার একাকিত্বের বিষাদতায় ছেয়ে যাচ্ছিল । তাই অপেক্ষা না করে নিজেই কারো হাতে গোলাপ ধরিয়ে দেবার একটা শক্তিশালী প্রতিজ্ঞা করে রমনী খুজছিলাম যাকে মনের গভীরে ঠাঁই দিতে পারবো । কত রমনীই চোখের কোণে রঙ মেখে যায়, ঠোটের কোনে বাঁকা হাসি দিয়ে বুকের ভেতর ধাকধাক করিয়ে চলে যায় । কিন্তু সাহস আমার এতই প্রকট কারো হাতে গোলাপ ধরিয়ে দেব দুরের কথা হাতের দিকে তাকানোতেই আমার শরীরের রক্ত হীম হয়ে আসতো । ভাবার আগেই খুব শীতেও শরীরি আমার জৈষ্টের প্রখর রোদের ন্যায় ঘাম জরিয়ে যেত !
রমনী দেখতে দেখতে আমিও ক্লান্ত তবুও খ্যান্ত দিচ্ছিলাম না । পণ প্রেম আমি করবোই । গান গাই তুমি খাঁচা হলে আমি হবো পাখি/মন কিযে চায় বলো যারে দেখি লাগে ভাল এরুপ কতরুপ । মনে মনে ভাবি আমার যেসব মেয়ে মনে ধরে সেসব মেয়েদের মনে/ঘরে/বারান্দা বা এলাকার চৌসীমানাতেও আমার ঠাঁই হবে না । ব্যার্থতা নিয়েই দিনাতিপাত করছিলাম । বন্ধুদের অনেকের ধারণা এই আমি নাকি প্রেমের সংখ্যায় শত না হলেও ফিফটি ছুই ছুই । কিন্তু আমি জানি মনের কথা ফিফটি তো নয় শুন্য রানে যে আমার যৌবন আউট হচ্ছে সেই দুঃখে আমি ওদের কথার উত্তরে শুধু একটা হাসি দিয়ে শান্ত হতাম !
এভাবেই আমার টিনএইজটা পার করে দিতে পারতাম প্রেমের দিকে শুন্য রানে আউট হয়েই । কিন্তু শুন্য রানে আউট হতে দিল না আমার ওয়েলউইশার প্রিয় বন্ধু রাজা (ছন্দনাম) । রাজা সহযোগী আমার আরেক প্রিয় বন্ধু নূর ( ছন্দনাম) । কত মেয়েই তো দেখলাম জীবনে । কত জনকে মনের কথা বলবো বলবো বলে মনে প্রেম জাগালাম । কিন্তু সেই ভয় আর প্রত্যাখিত হবার আগাম বার্তা আমাকে সাবধান করে দিত । তাই আবার নিশ্চুপ হয়ে যেতাম । অনেক মেয়েদের মধ্যে ‘অনু’ (যে একদিন অনু থেকে আমার পৃথিবীতে রুপান্তরিত হয়ে গেল) সেও একজন । অনু আমার প্রতিবেশি । একই এলাকায় আমাদের বসবাস । ওকে খুব কাছে থেকেই দেখতাম । দেখতাম মানে চোখে তাকাতাম না তবে আরচোখ ফেরাতাম না । ভাবছিলাম কি করে ওকে আমার মনে ঢুকানো যায় । ফন্দি আর যুক্তি সেই সাথে মনোযুদ্ধ । যুদ্ধে আমি পরাজিত হচ্ছিলাম বারবার । মন আমার আগাম বার্তা দিয়ে যেত যে, অনু কখনই আমার মনের আঙ্গিনায় আসতে পারেনা , আমি আনলেও সে আসবে কি করে । এ ‘যে খোকার হাতে চাঁদ পাওয়ার মিছে কল্পনা আর দুরাশা !
প্রাইমারির ‘তমা’ বিথি – হাইস্কুলের ,মুন,তানি,দোলা,সেতু এলাকার মৌ,লিথি, সহ কতজনকেই এইভাবে মনে আনতে চেয়েছি । কিন্তু ব্যার্থ হবার আগামবার্তা নিয়ে মনোযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আর পেছন ফিরে চাইনি । নিজেকে নিজেই মুক্ত করে দিয়েছি ওদের কাছ থেকে । অনু’র ব্যাপারটাও এরুপ হতে পারতো । একা একাই আমি থেমে যেতে পারতাম অনু’র প্রতি আমার প্রেম প্রেম ভাব থেকে । কিন্তু সেই রাজা-ই যত কাল হয়ে দাড়ালো । ভুলটা যে আমারই ছিল । আমার মন থেকে রাজার কান পর্যন্ত আমিই যে পৌঁছে দিয়েছিলাম আমার মনের কথা । আর সেটা রাজার কানের বারান্দায় পৌছানোর আগেই সে জ্যোতিষীর মত বলে দিল অনু’র সৃষ্টিই যেন আমার জন্যে । দুজনা’কে এতই মানাবে যেন সুন্দর এক ফুলদানীতে ম্যাচিং করা একটি ফুল । শুনে তো আমি এতটায় ফুরফুরে যে আর কোন মেয়েকে পাত্তা দেবার সময়টুকু পেলাম না, যেন অনন্যা-ই আমার জন্য তৈরি আমি তার । নিজেকে অনেক ভাবিস্ট শ্রেনীর যুবকে রুপান্তরিত করে অনন্যার কানে আমার প্রেম কথা পৌঁছে দেবার পথ খুঁজে বের করতে লাগলাম রাজা আর আমি, সহযোগী নূর ।
অনুরা আমাদের ফ্ল্যাটে প্রায়’শ আসতো ছাদে খেলা করতো আমিও ছাদে যেতাম । আর সে থেকেই তাঁকে দেখা । তাঁর প্রতি আমার প্রেম জন্মানো আর ভালবাসার সৃষ্টি । আমরা যে বাসায় থাকি একই বাসায় অনু’দের চাচা-চাচীরা থাকতেন । সেই সূত্রেই আমাদের ফ্ল্যাটে অনু’র আনাগোনা আর আমার মন রাঙ্গানো । যাক, বলছিলাম কি করে অনু’র কানে আমার প্রেম বার্তা পৌঁছানো যায় । সেই ফন্দি আঁটছিলাম রাজা আর আমি । রাজার কনফিডেন্ট এতই যে অনু কোনভাবেই নাকি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারে না । কিন্তু আমার মোটেও সেরুপ কোন কনফিডেন্ট বা আশা ছিলনা । তাই প্রস্তাব দেবার আগেই প্রত্যাখিত হবার প্রস্তুতি ও তার যন্ত্রণা সইবার শক্তি বুকে জমিয়ে রেখেছিলাম । অনু’র এক কাজিন রুপা ( ছন্দনাম) । সৌভাগ্য ক্রমে রুপা আর আমি একই কলেজে অনার্স ভর্তি হয়েছিলাম । রুপার সাথে আগে থেকেই আমার সম্পর্ক ছিল মোটামোটি । সম্পর্ক ছিল হাই/হেলো আর সালাম বিনিময়ের । রাজা আমাকে পরামর্শ দিল রুপার সহযোগীতা চাইতে । ভয়ে আমার শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে গেল । কি করে বোনের কাছে বোনের প্রতি প্রেম প্রস্তাব দেয়া যায় ! তাই অজানা ভয়েই পিছিয়ে পরতে চাইলাম । প্রেম নামক শব্দটা জীবন থেকে মুছে দিতে চাইলাম । কিন্তু সেই রাজার জুড়ে প্রেম মুছে দেয়া থেকে ব্যার্থ হয়ে বাধ্য হলাম রুপাকে ফোন দেবার । একই বাসায় যেহেতু থাকতাম তাই রুপার নাম্বার সংগ্রহ করা খুব কঠিন কিছু ছিল না । নাম্বার সংগ্রহ করে আনুমানিক রাত ৯ টার দিকে ফোন দিলাম রুপাকে । শীতের রাত ছিল সেদিন । রাজাকে সাথে নিয়ে সাহস জমিয়ে বুকে...কলিং ...
-হ্যালো আসলামু আলাইকুম, কে বলছেন ?
-ওয়ালাইকুম সালাম, সিস্টার আমি মামুন ।
- কোন মামুন ?
- আপনাদের ফ্ল্যাট এর ৪ তলার
- ও , কেমন আছেন ভাই, কেন ফোন দিলেন ?
- সিস্টার, আপনার সাথে একটু কথা ছিল, কাল কি কলেজে যাবেন ? গেলে আমাকে একটা ফোন দিবেন কি ? একটূ ইম্পোর্টেন্ট আলাপ ছিল ।
- ওকে কাল সকালে কলেজে যাব, আমি আপনাকে ফোন দিব ।
- থ্যাঙ্ক ইউ সিস্টার, আমি অপেক্ষায় থাকবো কলেজে ।
- ওকে আল্লাহ হাফেজ
- জ্বি আল্লাহ হাফেজ ।
ফোন রেখে রাজা আর আমি সফলতা হাসি হাসলাম কিছুক্ষণ । রাজার কাছ থেকে কিছুটা সাহস আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিচ্ছিলাম কি করে অনু’র প্রতি আমার প্রেম প্রস্তাবটা তার বোনের কাছে জানানো যায় ! রাতটা কাটালাম অনেক উৎকন্ঠা আর উৎফুল্লতায় । ২০০৯ এর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় । সকালে তৈরি হয়ে কলেজে পৌঁছার অর্ধেক রাস্তা আগেই রুপার ফোন পেলাম ।
-হ্যালো, মামুন ভাই কোথায় আপনি
-জ্বি সিস্টার আমি গুলশান ১ পর্যন্ত আসছি । আর ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো ।
_ওকে, তারাতারি আসেন
- ওকে আসছি ,
ফোন রেখে কলেজে ঢুকেই রুপাকে ফোন দিলাম । রুপা ছিল তিতুমীর কলেজের মানবিক ভবনের তিন তলায় । সে ইসলামিক হিস্ট্রি এন্ড কালচারের ছাত্রী ছিল । আমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের । তিন তলার বারান্দায় সে অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে । আমি পৌছলাম সেখানে । রুপার কয়েকজন বান্দবী সাথে ছিল । ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুপা আমার কাছে আসলো । জিজ্ঞাসা করলো
-কেমন আছেন, হঠাৎ করে এইভাবে ফোন দিলেন , ডাকলেন কেন ? রাতে যখন ফোন যখন দিয়েছিলেন মা এর সাথে ছিলাম । আম্মু একটু সন্ধেহ করেছেন, কেন ফোন দিলেন , জিজ্ঞাসা করলো মামুন কেন ফোন দিল, বললাম কলেজের কোন কাজে দিয়েছে হয়তো । গরগর করে অনেক কিছু এক সাথে বললো রুপা ।
বললাম
- চলেন কলেজের মাঠে যাই
- না এখানে বলেন,
- তাহলে একটু নিরব যায়গায় চলেন
- ঠিক আছে
দুজনেই কোলাহল মুক্ত একটা যায়গায় গিয়ে দাড়ালাম ।
- কি বলবেন বলেন ( রুপার চোখে মুখে ভাবনা আর উৎকণ্ঠার ছাপ লক্ষ্য করলাম)
- ভয় পাচ্ছেন সিস্টার ? ভয় পাবার কোন কারন নেই, আমি আপনার বোন অনন্যার ব্যাপারে জানতে চাই ।
সজোরে হাসলো রুপা । যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ সরিয়ে আনন্দের রেখা দেখতে পেলাম । রুপা ভাবছিল আমি তাকে প্রেম প্রপোজ করি কিনা ! তার কথাতে পরে জানতে পারলাম । এতে ভয় এর বড় কারন ছিল , রুপা একজনকে ভালবাসতো । সেদিকে যাবো না । হাসি সমেত সে জিজ্ঞাসা করলো
- অনু’র ব্যাপারে কি জানতে চান
- জানতে চাই অনু’র ব্যাক্তিগত সম্পর্কের কথা
কথাগুলো এত সহজেই বলে ফেলছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন আমি এই লাইনে খবুই অভিজ্ঞ একজন লোক । রুপা বললো,
- ব্যক্তিগত সম্পর্ক মানে ?
- মানে অনন্যা কারো সাথে প্রেম বা এরুপ কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কাউকে ভালবাসে কিনা, আর সে কিরুপ শ্রেণীর মেয়ে ?
রুপার ঠোটের কোণে এক মধুর হাসি এনে , টানা সুরে বললো
- কি ব্যাপার ভাই, সামথিং ইজ রং মনে হচ্ছে
বললাম
- আরে বলেন না অনন্যার কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কোন ক্লাসে পড়ে ( লাজুক মুখে)
- না নেই , ও খুব ভাল মেয়ে, একটু চঞ্চল, অনেক ভাল আর কিউট, ক্লাস এইটে এইবার ( বলে হাসলো)
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে হচ্ছে । রুপার ভালবাসা ছিল আমারই এক ভাই এর সাথে । আমি সেটা কিছুটা বুঝতে পারছিলাম আগে থেকেই । আর তাই রুপা অনু’র ব্যাপারে আমার প্রস্তাবটা খুব সহজে হাসিমুখে নিয়েছে বলে বুঝতে পারলাম । আমার সন্ধেহ ছিল আমার ভাইটির সাথে হয়তো রুপার নয়, অনু’র সম্পর্ক রয়েছে । এ ব্যাপারে আগে কিছুটা আঁছ পেয়েছিলাম । তাই এ ব্যাপারটি নিশ্চিত হবার জন্যে রুপাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে অনু’র সাথে আমার ভাই এর কোনরুপ সম্পর্ক আছে কিনা । আর তখনই জানতে পারলাম যে অনু’র সাথে নয় রুপার সাথে আমার ভাই এর সম্পর্কের ব্যাপারটা । তবে অনু অনেক সুন্দরী ছিল বলে ভাইটি রুপার এর চেয়ে অনু’র প্রতি দুর্বল ছিল এ ব্যাপারে জানতে পারলাম পরবর্তীতে । অনুর সাথে কথাও হতো তার । যাক এগুলো অপ্রয়োজনীয় কথা ।
বুকে সাহস নিয়ে রুপাকে বললাম
-আমি অনন্যাকে পছন্দ করি, ওর সাথে প্রেম করতে চাই, করতে চাই বলে কথা নয়, ওকে আমি ভালবাসি ।
রুপার মুখে আনন্দের হাসি
- হমমম, এই কাহিনী,
- জ্বী, সিস্টার , আমি এখন কি করবো, আপনি ছাড়া আমাকে হেল্প করার আর কেউ নেই, প্লিজ আমাকে হেল্প করুন , অনন্যাকে জানান ।
- ঠিক আছে ভাই, অস্থির হবার দরকার নেই, আমি অনুকে বলবো আপনার প্রস্তাব এর কথা ( বলে হাসলো)
- কখন জানাবেন
- দেখি অনু’র সাথে আজ কখন দেখা হয়, বিকেলে হয়তো বাসায় আসবে , তখনই বলবো আপনার কথা
- ঠিক আছে সিস্টার আমি অপেক্ষায় রইলাম , বলে দুজনেই বিদায় নিলাম কলেজ থেকে ।
জেনেছি মেয়েদের কাছে অতি উৎফুল্লতার অনেক কিছু অস্তিরতা ডেকে আনে । রুপার কাছেও ব্যাপারটা সেরুপ ছিল । তাই সেদিন কলেজ থেকে নিজের বাসায় না ফিরে সরাসরি অনন্যাদের বাসায় চলে যায় সে । রুপার কাছ থেকেই পড়ে জানতে পেরেছি । অনন্যা সেদিন ঘুমিয়ে ছিল । ধপাস করে অনু’র বিছানায় শুয়ে থাকা অনুর উপর পরলো রুপা । অনু আধো-ঘুমে ছিল । চমকে উঠলো ।
-কি ব্যাপার বুবু, এত খুশি কেন, আর এইভাবে হাঁপাচ্ছো কেন ? এইভাবে হামাগুরি দিয়েই বা পড়লে কেন আমার উপর
- ইন্টারেসটিং সংবাদ আছে অনু , তাই বাসায় না গিয়ে সরাসরি তোর কাছে চলে আসলাম ।
- কি ইন্টারেসটিং সংবাদ ?
- মামুন ভাই কে চিনিস না ? আমাদের বাসার ৪ তলায় যে থাকেন, উনি নাকি তোকে পছন্দ করেন, তোকে ভালবাসেন !
- কি বলছো ! (অনু বিস্ময়ে, অবাক চোখে মুখে)
- হ্যাঁ ঠিকই বলছি ! দেখ আমার কাছে নাম্বার আছে, কথা বললেই বুঝতে পারবি, কথা বল
আমি তখন অনুদের বাসার পথের এক গলি দিয়েই ব্যাংক এর কাজে যাচ্ছিলাম বসুন্দরায় । যখনই অনন্যাদের বাসা ক্রস করলাম, রুপার নাম্বার থেকে মিসকল পেলাম । মিসকল পেয়েই বুকের ভেতরটা মুছর দিয়ে উঠল ! ফোন ব্যাক করলাম সাথে সাথে ।
- হ্যালো, মামুন ভাই,
- জ্বী সিস্টার,
- আপনি কি সত্যি সত্যিই অনুকে ভালবাসেন ?
- মিথ্যে বা মজা করার জন্যে তো বলিনি সিস্টার !
- তাহলে এই নেন অনুর সাথে কথা বলেন ( বলেই অনুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিল)
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল ঠিক সে মুহুর্তে । রাস্তায় ছিলাম পানি খাওয়ার ব্যাবস্থাও ছিল না ! অপার থেকে কন্ঠ ভেসে আসলো -
- হ্যালো
- হ্যালো ( কাঁপা কণ্ঠে আমি)
- বুবুকে আপনি কি বলেছেন
- কি বলেছি তোমাকে বলেনি তোমার বুবু
- না বলেনি, আপনি বলেন
- যা বলেছি তোমার বুবুকেই তো বলেছি, সেই বিষয়ে আমি তোমার মন্তব্য চাই , প্লিজ জানাও ।
- ঠিক আছে আমি ভেবে আপনাকে জানাবো ।
- ওকে
- বাই...
অনন্যার সাথে এই প্রথম আমার কথা বলা । এখানে যত সহজে লিখে ফেললাম ঠিক ততটা সহজ ছিলনা যখন অনন্যার সাথে ফোনে কথাগুলো বলছিলাম । মনে আছে সেদিনের কথা । সমগ্র শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল অনুর কণ্ঠ শুনে । আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিল সেদিন । কন্ঠ আমার কয়েক শ মন ওজনে পরিণত হয়েছিল সেই মুহুর্তটাতে ।
কথা বলার পর একদিন দুদিন তিন দিন পার হয়ে গেল । অনন্যার ভেবে বলার সময়টা এখনও কেন আসছে সেই অস্থিরতায় আমার প্রতিটা ক্ষণ এক বিষাদতার মধ্যে পার হচ্ছিল । তিনদিনের দিনে রুপার মোবাইল থেকে মেসেজ আসলো আমি যেন কাল কলেজে দেখা করি , কথা আছে । উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা নিয়ে কলেজে গেলাম সেদিন । রুপার ঠোটে বাঁকা হাসি লক্ষ্য করলাম ।
-আপনার জন্যে সুখবর আছে ( হেসে হেসে সে বলল)
- কি সুখবর সিস্টার বলেন প্লিজ, অনন্যা কিছু জানিয়েছে ? ( উৎকণ্ঠা আমার)
- জ্বী, অনু বলেছে পজিটিভ ( বলে রুপা হাসলো)
মনে পরে সেদিনের কথা । জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ হবে । আমি আর সিস্টার কলেজের স্মৃতিসৌধের সিঁড়িতে বসে ছিলাম । এক লাফ দিয়ে আমি সিঁড়ি থেকে নেমে মাঠে একটা দৌড় দিলাম । যেন হাতে স্বর্গ পেলাম ।
উচ্ছ্বাস নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম সেদিন । রুপার কাছ থেকে পজিটিভ সংবাদ পাওয়ার পর আশা করছিলাম সেদিনই হয়তো অনন্যার মোবাইল থেকে ফোন আসবে । রুপা কলেজে অনু যে নাম্বারে আমাকে ফোন দিবে সেটি দিয়ে গিয়েছিল । সারাক্ষণ আমি ফোন হাতে ফোনের দিকে থাকিয়ে । কখন অনু ফোন দিবে আমাকে । অপেক্ষায় এইভাবে আরও তিনটে দিন পেরিয়ে গেল । অসহ্য এক অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম কখন অনুর ফোন পাবো । যেই নাম্বারটা রুপা দিয়েছিল আমাকে সেটা ছিল অনুর আম্মুর নাম্বার । সাবধান বানী ছিল যে আমি যেন কোন দিন ফোন না দিই যদি অনু কোনও মিসকল বা কল করার এলার্ট না দেয় । তাই আমার পক্ষ থেকে আগে ফোন দেবার কোন সুযোগ ছিলনা । হঠাৎ এক সন্ধায় আমার মোবাইলে ফোন বেজে উঠলো । সেই ফোনটিই ছিল যেন আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সুখকর ফোন ।
অপার থেকে -
- হ্যালো (অনুর কণ্ঠ)
- হ্যালো অনন্যা
- হম, কেমন আছেন ?
- ভাল , তবে তুমি এত পরে ফোন দিলে কেন, কবে সিস্টার আমাকে পজিটিভ সংবাদ শোনালো , তিন দিন পেরিয়ে গেল তোমার ফোন পাচ্ছিনা , এত ধৈর্য ধরার শক্তি কই আমার !
- আরে, আমি সুযোগ পেলে তো ফোন দিব , আম্মু বাহিরে যায় না, বাহিরে না গেলে ফোন দিব কি করে ।
অনুর মা-বাবা প্রতি সন্ধ্যায় অনুকে রেখে বাহিরে হাঁটতে যেত । অনুরা ছিল তিন বোন । আর একটা কাজের মেয়ে । প্রতি সন্ধ্যায় অনুর বাবা-মা বাহিরে চলে গেলেই অনু আমাকে ফোন দিত । অনুর সাথে আমার সবসময় সন্ধাতে কথা হত । কথা হত সেটূকু সময়, যেটুকু সময় অনন্যার বাবা-মা বাসায় না ফিরতো । যাক কথা হচ্ছিল দুজনে -
- অনন্যা, আমি কিন্তু তোমাকে ভালবাসি, কোনরুপ মজ-মস্তি করা আমার উদ্দেশ্য নয় । আমি চাই তুমি আমার হও । সুতরাং আমার আর কিছুই ভাবনার নাই । আমি তোমাকে ভালবাসি ।
অনু চুপ করে রইল ,
- কিছু বলছ নাযে,
- কি বলবো
- এই যে, আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু তুমি
- ধরে নিন আমিও এরকম কিছু একটায় ,
-সত্যি অনু,
-হুমম
অনেক খুশি আর আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেল হৃদয়ে । সেদিন প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বললাম দুজনে । এইভাবে কাটছিল দিন । রাজার দেয়া সাহস আর রুপার সহযোগীতা নিয়ে অনু আর আমার প্রেম হয়ে গেল কত সহজেই । প্রতি সন্ধ্যায় আমরা দুজন কথা বলতাম যতক্ষণ না অনুর বাবা-মা ওয়াকিং করে বাসায় ফিরে না আসতো ।
কিছু দিনের জন্য
সন্ধ্যার কয়েকটি মুহুর্ত ছিল আমার জন্য কত উচ্ছাসময়
এখন সেই আনন্দ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তোলে
এখন সেই সন্ধ্যাটা কান্নার ঢেউ তোলে
এখন সন্ধ্যাগুলো কাটে প্রতিক্ষায় ।
প্রতি বৃহস্পতি বার ও স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অনন্যা ওর আম্মুর সাথে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতো । রুপাকে নিয়ে আমাদের কলিং বেলে বেল বাজাতো । অনু এসেছে এটা আমাকে জানাবার ছলে আমার ছোট বোনকে খুজতে আসতো । ইশারায় বুঝিয়ে দিত যে ছাদে যেতে । আমি তৎক্ষণাৎ ছাদে চলে যেতাম । দুজনে ছাদের উপরে একে অন্যকে দেখতাম আর মোবাইলে কথা বলতাম । কথা বলতাম রুপার মোবাইল ফোন দিয়ে । অনুর ব্যাক্তিগত কোন নাম্বার ছিলনা । ফোন ছাড়া সামনা সামনি দুজনে কথা বলার কোন সুযোগ ছিলনা কারন ছাদে আমাদের দুইপরিবারের লোক ছাড়াও অনেক ভাড়াটে বিকেলে আকাশ দেখতে উঠতো। তাই ফোনেই কথা বলতাম দুজনে । অনু আর আমার প্রেমকালীন সময়ে কোন একটি দিনও দুজনে দুই চার মিনিটের মত সামনা সামনি কথা বলি নাই । একবিকেলে অনন্যাকে ছাদে একটা সুর্যমুখী ফুল দিয়েছিলাম । অনু সেটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকেছিল আর ফুলে চুমো খেয়েছিল । ছাদে আরো অনেকেই ছিল তাই অত্যন্ত কৌশলে আমি ফুলটি দিয়েছিলাম আর অনুও সেটি সেভাবেই নিয়েছিল আর তাতে চুমো খেয়েছিল । সেদিনটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক ।
এর মাঝে আমার বিদেশ যাওয়ার কথা উঠলো পরিবার থেকে । পাসপোর্ট করা হয়ে গেছে । যেকোন দিন চলে যেতে পারি মধ্যে প্রাচ্যের দেশ ওমানে । অনুর কানে সেটা পৌছতেই বাঁধা দিল আমি যেন কোনভাবেই বিদেশ না যাই , ফোনে কথা হচ্ছিল-
- আপনি নাকি বিদেশ চলে যাবেন ?
- হ্যা, যেতে হবে
- কেন যাবেন ?
- ফ্যামিলি পাঠাচ্ছে
- ফ্যামিলি কেন পাঠাচ্ছে আপনাকে ?
- জানিনা
- প্লিজ যাবেন না আপনি, আপনি গেলে আমি থাকবো কি করে
আমার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো । চোখ দুটি ছলছল হয়ে গেল । অনু কোন কথা বলছে না । বললাম অনু, যেতে হবে আমাকে , না গেলে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসবে কি করে । অনু কথা বলছে না । বললাম তুমি কথা না বললে যে আমার আকাশ ব্যাথায় ভারি হয়ে ওঠে ।
অনু বলে-
- আমার আকাশ ব্যাথায় ভারি হয়েই আছে , প্লিজ আপনি যাবেন না !
সৃষ্টিকর্তার কাছে সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম , বিধাতা যেকোন মূল্যের বিনিময়ে আপনি আমার বিদেশ যাত্রাটা বন্ধ করে দিন । বিধাতা আমার সেদিনের প্রার্থনা শুনেওছিলেন । আমার বিদেশ যাওয়া হয়নি ।
একদিন অনুর কাছ থেকে একটা মেসেজ এসছিল আমার ফোনে
“ আই লাভ ইউ , এন্ড মিস ইউ”
আজও চোখে ভাসে সেই মেসেজটা । যদিও অনেক আগেই মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার সাথে সেই মেসেজটাও হারিয়ে গেছে ।
একদিন অনুকে বলছিলাম , অনু একবার বল আই লাভ ইউ , প্রথমে না করে পরক্ষণেই মধু মিশ্রিত কন্ঠে বলল আই... লাভ... ইউ , আমি তখন এক চিৎকার দিয়েছিলাম আনন্দের । সেই চিৎকার আজও কানে ভাসে আমার ।
একদিন ইজতেমায় গিয়েছিলাম মোনাজাতে । সুদুর টঙ্গী থেকে হেটে আসতে হয়েছিল সেদিন । সন্ধায় বাসায় পৌছে বাথরুমে গেলাম ফ্রেস হতে । কাপর ধুয়েছিলাম বলে বাথরুমে একটু দেরি হল । বাহির হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি অনন্যার ২৬ মিসকল । এটায় ছিল অনুর সবচাইতে বেশি মিস করা আমার জন্যে । এরুপ মিসকল আমার জীবন অক্ষয় হয়ে থাক ।
একদিন অনুকে বললাম তোমার হাতে হাত রাখতে চাই অল্পক্ষনের জন্যে । অনু বললো ঠিক আছে , যেদিন আপনাদের ফ্ল্যাটে যাব সেদিন আমি আগে থেকেই আপনাকে জানিয়ে রাখবো , আপনি সিঁড়িতে থাকিয়েন, হাতে হাত রাখবো । সেদিন সন্ধ্যায় অনু আমাকে জানিয়ে রেখেছিল , আমি সিঁড়িতে অপেক্ষমান ছিলাম । হাত রেখেছিলাম অনুর হাতে । অল্পক্ষন ৩০ সেকেন্ড হবে সময় । অনুর হাতের স্পর্শ পাওয়া সেই হাত অনেকদিন কাউকে ধরতে দেইনি আমি । সেই ক্ষণটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক !
একদিন ছাদে কথা বলছিলাম দুজনে । সন্ধ্যার পরমুহুর্ত । আকাশে চাঁদ জেগেছিল তখন । অনুকে বললাম , অনু দেখ ওই চাঁদ । অনু চাঁদের দিকে থাকিয়ে হাসলো । বললাম তোমার সাথে ওই চাঁদেরও কোন তুলনা হয় না । তুমি চাঁদের চেয়েও অপরুপ । অনু হেঁসে বললো – আপনার জন্যে তো আমি এরকমই । সেই সন্ধেটা আমার জীবনে অক্ষয় থাক ।
এইভাবে বেশ চলছিল দুজনের স্বাভাবিক প্রেম । আমার চাওয়া গভীর । এরুপ যে অনন্যা ছাড়া আর কোন মেয়ে যেন আমার জীবনের জন্য অসহ্য । তাই অনুকেই কামনা করছিলাম গভীর ভাবেই । সৃষ্টি কর্তার কাছেও প্রার্থনা ছিল যেন, অনুই আমার জীবন সঙ্গিনী হয় । চলছিল দুজনের প্রেম । কিছুদিন পর অনুর ফোন পাচ্ছিলাম না বেশ কয়েকদিন । এক দুই দিন করে ১ মাস পেরিয়ে গেল । অনু আসে না আমাদের ফ্ল্যাটে আর ফোনও দেয় না । আগেই মানা ছিল আমি যেন ফোন না দেই, তাই আমার পক্ষ থেকে ফোন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না । রুপার কাছে জানতে চাইলাম , কি সমস্যা কেন ফোন দিচ্ছে না । জানতে পারলাম অনুর ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা তাই আমাকে ফোন দিতে পারছেনা । পরীক্ষা শেষ হলেও প্রায় ২ মাস পেরিয়ে গেল অনু আমাকে ফোন দিচ্ছে না । রুপার কাছ থেকেও কোন তথ্য পাচ্ছিলাম না ।
একদিন সন্ধ্যায় এলাকার এক হোটেল থেকে চা-নাস্তা খেয়ে অনুর বাসার নিচের গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । অনুদের বারান্দায় থাকালাম । দেখলাম অনু কার সাথে যেন কথা বলছে । ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না যে, এটা অনু নাকি অন্য কেউ । মোবাইলে হাতে নিয়ে আমি অনুর সেই নাম্বারটিতে ফোন দিলাম , দেখলাম ওয়েটিং । বারান্দা থেকে অনু ভেতরে চলে গেল । আমি আবার ফোন দিলাম , ফোন কেটে দিল । মনে এক আতঙ্ক শুরু হয়ে গেল । আবার ফোন দিলাম ফোন রিসিভ করে ২ সেকেন্ড এক মধ্যেই কেটে দিল । এইভাবে প্রায় ২০-২৫ বার আমার ফোন রিসিভ আর কাট করলো । সহ্য করতে না পেরে আমি মেসেজ দিলাম “ অনন্যা তুমি এমন করছো কেন , আমার ফোন কেটে দিচ্ছ , অথচ তুমি তো কার সাথে কথা বলছিলে । প্লিজ ফোন রিসিভ করো , নাহয় আমি তোমার আব্বুকে সব বলে দেব , আমার কাছে ডকোমেন্ট আছে” । মেসেজ দিয়ে আবার ফোন দিলাম । এইবার ফোন রিসিব করলো অনু-
- হ্যালো, কে, আপনার কি সমস্যা, ডিস্টার্ব করছেন কেন এরুপ ? ( বিরক্ত সুরে অনু)
- কি বলছো এসব অনন্যা ? আমি মামুন , ফোন ধরছ না কেন ? ( কাঁপা সুরে আমি)
- মামুন ? কোন মামুন ? আমি কোন মামুনকে চিনিনা , আর আমি অনন্যাও না ! ( রাগ স্বরে অনু)
- কি আবোলতাবোল বলচ্ছ অনন্যা !
- ওই ব্যাটা, কখন থেকে তুই আমাকে ডিস্টার্ব করছিস, আমি বলছিনা আমি মামুনকে চিনিনা, আর আমি অনন্যা না, বুঝস না, ব্যাটা ফোন রাখ ! ( বলে অনু ফোন কেটে দিল)
বোঝার আর কিছুই বাকি রইলনা যে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টটা আমি পেতে যাচ্ছি । হাত – পা বেহুস হয়ে গেল আমার । তারাতারি রাজাকে ফোন দিলাম । রাজা এলাকার বাজারেই ছিল । আমি বাজারে ছুটে গেলাম । রাজাকে জরিয়ে ধরে আমি চিৎকার করে কেঁদে দিলাম । রাজা লজ্জ্বা আর ভয়ে আমাকে তারাতারি নিরব জায়গায় নিয়ে গেল । অবাক ছিল যে আমি বাজারের ভেতরে এত কোলাহলে এইভাবে কাঁদতে পারলাম কি করে । পুরো কাহিনী রাজাকে খুলে বললাম । রাজা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো । শক্তিহীন অঙ্গ নিয়ে কোনরুপ আমি বাসার ছাদের গিয়ে উঠলাম । সেদিন রাতে কখন ছাদ থেকে রুমে ফিরেছি কি করে ফিরেছি সেগুলো মনে নেই আমার !
পরবর্তীতে অনুকে কিছু ভয় দেখালাম আর বললাম তোমার শাস্থি স্বরূপ সবকিছু তোমার আব্বু-আম্মুকে দেখিয়ে দেব বলে হুমকির বার্তা পাঠালাম । যাক অনু এতে মোটেও ভয়ার্ত ছিলনা । রুপার হস্তক্ষেপে অনু ঘটনার ৭ দিন পর আবার আমাকে ফোন দিল । ফোন দিয়ে কাহিনী বলল যে, সেদিন সে ইচ্ছে করে এমন করেনি , ওর ফুফু ছিল বাসায়, ফুফুর সামনে আমার ফোন যাওয়াতে সে ধরা খেয়ে গিয়েছিল, তাই আমার সাথে এরুপ আচরণ করতে হয়েছে । সে জন্য সে সরি । তার জীবনে ভালবাসা ফেবার করবে না, তাই সে আমার কাছে থেকে আজ থেকে মুক্ত । সুখে থাকার আশির্বাদ জানিয়ে আমার কাছে থেকে বিদায় নিল অনু ! আমি কিছুই বলতে পারিনি সেদিন । নির্বাক হয়ে শুনেছি আর কেঁদেছি । সেই কান্না বর্ষার অঝোর ধারার চাইতেও কত বেশি ছিল, আর সেই সন্ধ্যেটা অমবস্যার চাইতেও কত অন্ধকার ছিল তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই ।
বিরহ সাথে নিয়ে খুব হীন ক্ষীণ মনে হচ্ছিল নিজেকে । অনন্যা আর আমার সম্পর্কের ক্ষণটা ছিল শীতের লগ্নে । -
এখনও আমি প্রতিটি নির্জন রাত থাকি প্রতীক্ষায়
ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সাথে হয় আলাপন
শীত রাতের কুয়াশা ঝাপটে ধরে আমাকে
এসবের মাঝে তোমাকে ভেবে ভেবে
লগ্নগুলো পার করি এক অজানা রোমাঞ্চকতায়
শীতের সকাল সন্ধ্যা আর রাত আমার অতি চেনা আপন
মনে পড়ে কোন এক শীতের সন্ধ্যায় শপথ নিয়েছিলাম
তোমাতে আমাতে আমরা শুধুই আমাদের
রোমাঞ্চকর সেই মুহুর্তগুলো
এখনও রঙ্গিন আজ বহু বছর পরও
এখনও কল্পনার সমুদ্রে কখনো লেপের ছলে
বুকে জড়িয়ে ধরি তোমায়, লজ্জ্বায় রাঙা হই আমি
মনে কি উৎফুল্লতা জাগে তখন !
জানি তুমি জানবে না এখনও তোমার সব স্মৃতি
আছে আমার কাছে অক্ষত ভালবাসায়
কখনও তোমাকে পাই কুয়াশার চাদরে
কখনও অন্ধকার আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলোতে
কখনও শিশির ভেজা ঘাসে কখনও জোনাকির মিটিমিটি আলোয়
কখনও হলদে পাখির রোমাঞ্চকর ডাকে
তখন আমি নির্জন হই আবার তোমাতে
থাকি তোমাতে ভাবি আছি তোমার অস্তিত্বে
প্রতি যামিনীতে শীতের রজনীতে । ...৭ পৌষ, ১৪২০...।
খুব আশা ছিল মনে ২০০৯ এর ১৪ ফেব্রুয়ারীই বোধ হয় আমার জীবনের প্রথম ভালবাসা দিবসে পরিণত হলো । কিন্তু এর আগেই অনু আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গেল । এইভাবে অনেক দিন পার হয়ে গেল । প্রায় ৬ মাস । সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর অনুর চোখের সামনে পরি না । অনুও আমাকে আর ফোন/মিস কল দেয় না । একদিন সন্ধ্যায় বারান্দা দিয়ে দেখলাম অনু আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছে । দূর থেকে দেখে খুব মিস করছিলাম তাকে । তাই খুব ইচ্ছে হল একটা মেসেজ দেই । বুকে সাহস জমিয়ে বিধাতার কাছে অনুর কোনরুপ ক্ষতি না হওয়ার কামনা করে একটা মেসেজ দিয়েই দিলাম । বিধাতাকে বললাম ‘বিধাতা মেসেজটা যেন অনু পায়, ওর বাবা-মা র কাছে ধরা না পড়ে । তাহলে যে অনুর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে । বিধাতা কবুল করেছিলেন আমার সেদিনের আকুতি ।
সেদিন রাতে আনুমানিক সাড়ে ১১ টার দিকে আমি ইন্টারনেটে কাজ করছিলাম । আকস্মিক অনুর আম্মুর মোবাইল থেকে ফোন বেজে উঠলো । অজানা ভয়ে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেল । ফোন রিসিভ করেই অনুর কন্ঠ –
- ফোনটা ব্যাক করা যাবে ?
- নিশ্চয় ( বলে ফোন কেটে আমি ব্যাক করলাম)
- কেমন আছেন ?
- ভাল, তুমি কেমন আছ ?
- ভাল, হঠাৎ করে মেসেজ দিলেন যে
- হঠাৎ করে নয় অনু, আমি প্রতিদিনই তোমাকে খুব খুব মিস করি কিন্তু সাহস পাইনা তোমাকে মেসেজ দেওয়ার, পাছে তোমার আব্বু-আম্মুর কাছে ধরা খেয়ে তোমার কোনরুপ ক্ষতি হয় ।
- ও , তো আর কি খবর আপনার ?
- কি খবর জানতে চাও অনন্যা ? কেন তুমি এইভাবে চলে গেলে ? কেন আমাকে এত কষ্ট দিলে ? আমি তোমাকে ছাড়া কোনভাবেই ভাল নেই অনু !
- তো আপনি কি চান , আবার আমার সাথে সম্পর্ক করতে চান ?
- আমি তো সম্পর্ক শেষ করি নি অনু , আবার কি গড়বো
- দেখুন, আবার যদি আমার সাথে সম্পর্ক করতে চান তাহলে বুবুকে( রুপা) জানান , উনি যদি রাজি হোন তাহলে আবার আপনার সাথে সম্পর্ক হবে ।
যেভাবেই হোক অনুর বুবুকে রাজি করিয়ে আমি আবার অনুর কাছে ছুটে গেলাম সকল অতীত ভুলে । অতীতে কৃত এর জন্য অনুও ক্ষমা চেয়ে নিল আমার কাছে । প্রতিজ্ঞা করলো আর আমাকে কষ্ট দিবে না । আবার শুরু দুজনের পথ চলা । আবার প্রেম । এইযাত্রা একবার রুপার সাথে অনুর স্কুলে গিয়েছিলাম অনুকে আনার জন্যে । অনুর বাবা-মা কেউ ছিলনা, তাই রুপা-ই স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল অনুকে । আমিও সে সুযোগে রুপার সাথে গেলাম অনুর স্কুলে । দুজনে একসাথে এসেছিলাম স্কুলের পথ টুকু । অনু তার স্কুল ব্যাগটি আমার হাতে দিয়েছিল । বলেছিলাম অনু শুধু ব্যাগ কেন, তোমাকে সহ আমার কাঁদে জরিয়ে নেব । অনু হেসেছিল আমি ভেসেছিলাম সুখ সাগরে । সেদিনটি এখনও আমার জীবনে শ্রেষ্টদিন ।
একদিন অনুদের বাসায় কেউ ছিলনা । ১৯ জুন ২০০৯ এর দিকে । দুপুর থেকেই আমরা কথা বলছিলাম দুজনে । দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত , রাত থেকে মধ্য রাত । মনে আছে সেই রাতের কথা ! কতই না সুখকথন । সেইদিন রাত ৩ টা অবধি চলেছিল দুজনের আলাপনি । সেই রাতটি অক্ষত থাক আমার জীবনে ।
তারপর আর ২ মাস ঠিকেছিল আমার প্রতি অনুর মন । কোন এক অজানা কারনে অনু আর আমাকে ফোন দেয় না ।
একদিন ফোন দিয়ে বলেছিল ওর আম্মু নাকি জেনেছে আমি অনুকে ভালবাসি । ওর আম্মুর নাকি আমাকে পছন্দ নয় । তাই সে আর আমার সাথে সম্পর্ক করতে চাইলেও ঠিকতে পারবে না বলে ফোন রেখেছিল । সেইযে রেখেছিল ফোন সেই রাখার মধ্যেই এখনও রয়েছে আমার প্রেম । তারপর থেকে আর কোনদিন অনুর ফোন বাজে নি আমার ফোনে । কোন মিসকল মেসেজ আসে নি আমার ফোনে । এখনও আমি প্রতিটি সন্ধ্যা অপেক্ষায় থাকি । অনু এখন আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে গেছে । অনুর কাজিনরা ও আমাদের এলাকায় থাকে না এখন । কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কতভাবে । কোন এক অজানা কারনে অনুর কাছ থেকে আমি প্রত্যাখিত ।
আজ প্রায় ৫টি বছর পর এখনও আমি অনুর চলে যাওয়ার কারন খুজি, অনুকে খুঁজি । শুনেছি এখন একটি ছেলের সাথে গভীর প্রেমে মগ্ন সে । এই ছেলের আগেও আরেকটি ছেলের সাথে প্রেম ছিল অনুর । ভাগ্যক্রমে দুজন ছেলেই আমাকে চিনে । আমার জন্য তারা আফসোস করে । কিন্তু অনু নাকি আমার কথা শুনলেই বিরক্তিতে চোখ বোজে । বর্তমান প্রেমিকরা আমাকে বলেছিল আমরা একসাথে অনুর সামনে গিয়ে পরি । দেখবো তখন অনু কি করে ! আমার এতে রাজি নয় । কেনই বার করবো এরুপ তার কোন কারনও খুঁজে পাইনা । সেদিন রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ করেই অনুর সাথে আমার দেখা আমাদেরই এলাকায়, কবিতাটি লিখেছিলাম সে ক্ষনের অনুভুতি নিয়ে-
বছরের শেষ দিনের সন্ধ্যা এখন
জীবনের নয়
মাঝে মাঝে মনে হয় হোক এটাই জীবনের অন্তিম ক্ষন
কি হবে অমন অবজ্ঞা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা জীবন ।
তবুও বহমান নদীর মত জীবন চলছে ছুটে
থেমে নেই শত ঝড়ের মাঝেও
চলছে প্রাত্যহিক সব কাজ
তুমি হীন হয়েও ।
সন্ধ্যায় আজ হঠাৎ দেখা তোমার সাথে
প্রত্যাশা ছিল না এমন
মনে ভাবিলাম এটাই বোধহয় ২০১৩ এর
সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার
পরম সুখ বা চরম দুঃখ !
হঠাৎ দেখায় অনেকটা অপ্রকৃতস্ত আমি
অঙ্গের সমস্ত ইন্দ্রিয়ই যেন হচ্ছে বিকল
অস্থির আমি,
নিজেকে স্থির করে যখন দেখেছি তোমাকে
বোঝলাম তুমি অতি স্বাভাবিক
প্রথম চাওয়ার পর দ্বিতীয় চোখটি ফেললে না আর
বুঝিলাম হয়তো চেননি আমায়
বা চিনলেও অনুভূতির ভিন্নতা ।
তোমার ইন্দ্রিয়তে প্রভাব ফেলানোর কারন আমি নই
সেটা বোঝলাম খুব সহজেই
রিক্সা বাহনে তোমার প্রস্থান ।
মন আমার বিষন্ন অস্তির প্রায়
কতবার চেয়েছি কতভাবে চেয়েছি তোমায়
তুমি নও সৃষ্টিকর্তা জানেন তিনিই বোঝেন আমায়
আমাকে তোমার যোগ্য বা তোমাকে আমার মত করে
আমার জীবনসঙ্গী রুপে পাই
ছিল প্রার্থনা আমার ।
আবার হয়তো পাবো কোন সন্ধ্যায় অচেনা মানুষের মত
বা চেনা অতি আপন করে
সেই প্রতিক্ষায় আছি সন্ধ্যা প্রদ্বীপ জ্বেলে
তোমার আশায়
আশায় আশায়
আশায় আশায় ।
অনন্যা আমাকে সেদিন চিনতে পেরেছিল কিনা জানিনা । আমি তাকে দেখার পর থেকে হৃদয়ের পুরোনো হাহাকার কান্নাটা আবার বেড়ে গিয়েছে । প্রথমবার আমার দিকে তাঁকালেও দ্বিতীয় বার আর চোখটি ফেলেনি । ভেবেছি হয়তো চিনেনি আমায় ।
রুপার সাথেও সম্পর্ক নেই এখন । জানিনা সে কোথায় আছে । কোন অজানা কারনে সেও এখন আমাকে পাত্তা দেয় না হয়তো । দিলে তো ফোন দিত, পুরোনো নাম্বার বন্ধ , সেদিন দেখা হয়েছিল কলেজে, নাম্বার চেয়েছিলাম, দেয় নি, না দেবার কারন জানাতে চাওয়ার চাইতে নির্বাক হয়ে থাকার কারন বেশি ! তাই আমি নির্বাক হয়েছিলাম, রুপা আমার বাক ফিরিয়ে আনার কোরুপ চেষ্টা না করেই আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ! । রুপাদের প্রেম সম্পর্কটাও ভেঙ্গে গেছে আরও অনেক আগেই । সেটায় কারন কিনা আমাকে পাশ কাটানোর জানিনা ।
এখানেই আমার ভালবাসার পাঁচটি বছর । আমার অনুতে অনুতে ছড়িয়ে আছে অনন্যা । অনুতে আমার ভালবাসার পৃথিবী । এখানে আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারিনা এখন । অনুতে আমার প্রেমের সমাধি । আমার ভালবাসার প্রথম ও শেষ রমণী । তবুও এখানে ভালবাসা নেই । লাল টুকটুকে গোলাপ ফুটে নি এই ভালবাসায় । একতরফা প্রেম । আমি আজও ভাবি যদি একতরফা প্রেমই হবে তাহলে অনু কেন আমাকে সমর্থিত করেছিল সেদিন , কেন মেসেজ বার্তায় I love you & miss you লিখে পাঠিয়েছিল । এগুলোর উওর আর একতরফা প্রেম এর সংজ্ঞা খুজি এখন । জানিনা আর কতদিন খুজতে হবে আমাকে ।
ডিসেম্বর ২০০৮ । জীবনে সহজে কোন মেয়ে দর্শন আমার জন্য সহজ হয়ে উঠতো না সাহস বা যোগ্যতার অভাবেই হয়তো । বন্ধুদের কতজনের ভালবাসার কল্প কাহিনী শুনি । হাসিকান্নায় মিশ্রিত তাদের ভালবাসার গল্প । কখনও রাগারাগি-চুলটানি চুল ছিড়ি , আবার আদর করি বুকটার মাঝে জড়াইয়া । এরুপ কত সুখের গল্প বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে শুনতে নিজের অজান্তের একটা ভালবাসা পাবার প্রতি অধীর আগ্রহে দিন গুনছিলাম । আশা ছিল কোন এক অপরুপ রমনী স্বপ্রণধিত হয়ে আমার হাতে একটা লাল গোলাপ বা প্রজাপতি আঁকা হলুদ খামে চিঠি ধরিয়ে দেবে । ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে অনার্স ১ম বর্ষে এ্যডমিশন নেওয়ার পরও সেরুপ কোন রমনীর দেখা পাচ্ছিলাম না । জীবন আমার একাকিত্বের বিষাদতায় ছেয়ে যাচ্ছিল । তাই অপেক্ষা না করে নিজেই কারো হাতে গোলাপ ধরিয়ে দেবার একটা শক্তিশালী প্রতিজ্ঞা করে রমনী খুজছিলাম যাকে মনের গভীরে ঠাঁই দিতে পারবো । কত রমনীই চোখের কোণে রঙ মেখে যায়, ঠোটের কোনে বাঁকা হাসি দিয়ে বুকের ভেতর ধাকধাক করিয়ে চলে যায় । কিন্তু সাহস আমার এতই প্রকট কারো হাতে গোলাপ ধরিয়ে দেব দুরের কথা হাতের দিকে তাকানোতেই আমার শরীরের রক্ত হীম হয়ে আসতো । ভাবার আগেই খুব শীতেও শরীরি আমার জৈষ্টের প্রখর রোদের ন্যায় ঘাম জরিয়ে যেত !
রমনী দেখতে দেখতে আমিও ক্লান্ত তবুও খ্যান্ত দিচ্ছিলাম না । পণ প্রেম আমি করবোই । গান গাই তুমি খাঁচা হলে আমি হবো পাখি/মন কিযে চায় বলো যারে দেখি লাগে ভাল এরুপ কতরুপ । মনে মনে ভাবি আমার যেসব মেয়ে মনে ধরে সেসব মেয়েদের মনে/ঘরে/বারান্দা বা এলাকার চৌসীমানাতেও আমার ঠাঁই হবে না । ব্যার্থতা নিয়েই দিনাতিপাত করছিলাম । বন্ধুদের অনেকের ধারণা এই আমি নাকি প্রেমের সংখ্যায় শত না হলেও ফিফটি ছুই ছুই । কিন্তু আমি জানি মনের কথা ফিফটি তো নয় শুন্য রানে যে আমার যৌবন আউট হচ্ছে সেই দুঃখে আমি ওদের কথার উত্তরে শুধু একটা হাসি দিয়ে শান্ত হতাম !
এভাবেই আমার টিনএইজটা পার করে দিতে পারতাম প্রেমের দিকে শুন্য রানে আউট হয়েই । কিন্তু শুন্য রানে আউট হতে দিল না আমার ওয়েলউইশার প্রিয় বন্ধু রাজা (ছন্দনাম) । রাজা সহযোগী আমার আরেক প্রিয় বন্ধু নূর ( ছন্দনাম) । কত মেয়েই তো দেখলাম জীবনে । কত জনকে মনের কথা বলবো বলবো বলে মনে প্রেম জাগালাম । কিন্তু সেই ভয় আর প্রত্যাখিত হবার আগাম বার্তা আমাকে সাবধান করে দিত । তাই আবার নিশ্চুপ হয়ে যেতাম । অনেক মেয়েদের মধ্যে ‘অনু’ (যে একদিন অনু থেকে আমার পৃথিবীতে রুপান্তরিত হয়ে গেল) সেও একজন । অনু আমার প্রতিবেশি । একই এলাকায় আমাদের বসবাস । ওকে খুব কাছে থেকেই দেখতাম । দেখতাম মানে চোখে তাকাতাম না তবে আরচোখ ফেরাতাম না । ভাবছিলাম কি করে ওকে আমার মনে ঢুকানো যায় । ফন্দি আর যুক্তি সেই সাথে মনোযুদ্ধ । যুদ্ধে আমি পরাজিত হচ্ছিলাম বারবার । মন আমার আগাম বার্তা দিয়ে যেত যে, অনু কখনই আমার মনের আঙ্গিনায় আসতে পারেনা , আমি আনলেও সে আসবে কি করে । এ ‘যে খোকার হাতে চাঁদ পাওয়ার মিছে কল্পনা আর দুরাশা !
প্রাইমারির ‘তমা’ বিথি – হাইস্কুলের ,মুন,তানি,দোলা,সেতু এলাকার মৌ,লিথি, সহ কতজনকেই এইভাবে মনে আনতে চেয়েছি । কিন্তু ব্যার্থ হবার আগামবার্তা নিয়ে মনোযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আর পেছন ফিরে চাইনি । নিজেকে নিজেই মুক্ত করে দিয়েছি ওদের কাছ থেকে । অনু’র ব্যাপারটাও এরুপ হতে পারতো । একা একাই আমি থেমে যেতে পারতাম অনু’র প্রতি আমার প্রেম প্রেম ভাব থেকে । কিন্তু সেই রাজা-ই যত কাল হয়ে দাড়ালো । ভুলটা যে আমারই ছিল । আমার মন থেকে রাজার কান পর্যন্ত আমিই যে পৌঁছে দিয়েছিলাম আমার মনের কথা । আর সেটা রাজার কানের বারান্দায় পৌছানোর আগেই সে জ্যোতিষীর মত বলে দিল অনু’র সৃষ্টিই যেন আমার জন্যে । দুজনা’কে এতই মানাবে যেন সুন্দর এক ফুলদানীতে ম্যাচিং করা একটি ফুল । শুনে তো আমি এতটায় ফুরফুরে যে আর কোন মেয়েকে পাত্তা দেবার সময়টুকু পেলাম না, যেন অনন্যা-ই আমার জন্য তৈরি আমি তার । নিজেকে অনেক ভাবিস্ট শ্রেনীর যুবকে রুপান্তরিত করে অনন্যার কানে আমার প্রেম কথা পৌঁছে দেবার পথ খুঁজে বের করতে লাগলাম রাজা আর আমি, সহযোগী নূর ।
অনুরা আমাদের ফ্ল্যাটে প্রায়’শ আসতো ছাদে খেলা করতো আমিও ছাদে যেতাম । আর সে থেকেই তাঁকে দেখা । তাঁর প্রতি আমার প্রেম জন্মানো আর ভালবাসার সৃষ্টি । আমরা যে বাসায় থাকি একই বাসায় অনু’দের চাচা-চাচীরা থাকতেন । সেই সূত্রেই আমাদের ফ্ল্যাটে অনু’র আনাগোনা আর আমার মন রাঙ্গানো । যাক, বলছিলাম কি করে অনু’র কানে আমার প্রেম বার্তা পৌঁছানো যায় । সেই ফন্দি আঁটছিলাম রাজা আর আমি । রাজার কনফিডেন্ট এতই যে অনু কোনভাবেই নাকি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারে না । কিন্তু আমার মোটেও সেরুপ কোন কনফিডেন্ট বা আশা ছিলনা । তাই প্রস্তাব দেবার আগেই প্রত্যাখিত হবার প্রস্তুতি ও তার যন্ত্রণা সইবার শক্তি বুকে জমিয়ে রেখেছিলাম । অনু’র এক কাজিন রুপা ( ছন্দনাম) । সৌভাগ্য ক্রমে রুপা আর আমি একই কলেজে অনার্স ভর্তি হয়েছিলাম । রুপার সাথে আগে থেকেই আমার সম্পর্ক ছিল মোটামোটি । সম্পর্ক ছিল হাই/হেলো আর সালাম বিনিময়ের । রাজা আমাকে পরামর্শ দিল রুপার সহযোগীতা চাইতে । ভয়ে আমার শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে গেল । কি করে বোনের কাছে বোনের প্রতি প্রেম প্রস্তাব দেয়া যায় ! তাই অজানা ভয়েই পিছিয়ে পরতে চাইলাম । প্রেম নামক শব্দটা জীবন থেকে মুছে দিতে চাইলাম । কিন্তু সেই রাজার জুড়ে প্রেম মুছে দেয়া থেকে ব্যার্থ হয়ে বাধ্য হলাম রুপাকে ফোন দেবার । একই বাসায় যেহেতু থাকতাম তাই রুপার নাম্বার সংগ্রহ করা খুব কঠিন কিছু ছিল না । নাম্বার সংগ্রহ করে আনুমানিক রাত ৯ টার দিকে ফোন দিলাম রুপাকে । শীতের রাত ছিল সেদিন । রাজাকে সাথে নিয়ে সাহস জমিয়ে বুকে...কলিং ...
-হ্যালো আসলামু আলাইকুম, কে বলছেন ?
-ওয়ালাইকুম সালাম, সিস্টার আমি মামুন ।
- কোন মামুন ?
- আপনাদের ফ্ল্যাট এর ৪ তলার
- ও , কেমন আছেন ভাই, কেন ফোন দিলেন ?
- সিস্টার, আপনার সাথে একটু কথা ছিল, কাল কি কলেজে যাবেন ? গেলে আমাকে একটা ফোন দিবেন কি ? একটূ ইম্পোর্টেন্ট আলাপ ছিল ।
- ওকে কাল সকালে কলেজে যাব, আমি আপনাকে ফোন দিব ।
- থ্যাঙ্ক ইউ সিস্টার, আমি অপেক্ষায় থাকবো কলেজে ।
- ওকে আল্লাহ হাফেজ
- জ্বি আল্লাহ হাফেজ ।
ফোন রেখে রাজা আর আমি সফলতা হাসি হাসলাম কিছুক্ষণ । রাজার কাছ থেকে কিছুটা সাহস আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিচ্ছিলাম কি করে অনু’র প্রতি আমার প্রেম প্রস্তাবটা তার বোনের কাছে জানানো যায় ! রাতটা কাটালাম অনেক উৎকন্ঠা আর উৎফুল্লতায় । ২০০৯ এর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় । সকালে তৈরি হয়ে কলেজে পৌঁছার অর্ধেক রাস্তা আগেই রুপার ফোন পেলাম ।
-হ্যালো, মামুন ভাই কোথায় আপনি
-জ্বি সিস্টার আমি গুলশান ১ পর্যন্ত আসছি । আর ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো ।
_ওকে, তারাতারি আসেন
- ওকে আসছি ,
ফোন রেখে কলেজে ঢুকেই রুপাকে ফোন দিলাম । রুপা ছিল তিতুমীর কলেজের মানবিক ভবনের তিন তলায় । সে ইসলামিক হিস্ট্রি এন্ড কালচারের ছাত্রী ছিল । আমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের । তিন তলার বারান্দায় সে অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে । আমি পৌছলাম সেখানে । রুপার কয়েকজন বান্দবী সাথে ছিল । ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুপা আমার কাছে আসলো । জিজ্ঞাসা করলো
-কেমন আছেন, হঠাৎ করে এইভাবে ফোন দিলেন , ডাকলেন কেন ? রাতে যখন ফোন যখন দিয়েছিলেন মা এর সাথে ছিলাম । আম্মু একটু সন্ধেহ করেছেন, কেন ফোন দিলেন , জিজ্ঞাসা করলো মামুন কেন ফোন দিল, বললাম কলেজের কোন কাজে দিয়েছে হয়তো । গরগর করে অনেক কিছু এক সাথে বললো রুপা ।
বললাম
- চলেন কলেজের মাঠে যাই
- না এখানে বলেন,
- তাহলে একটু নিরব যায়গায় চলেন
- ঠিক আছে
দুজনেই কোলাহল মুক্ত একটা যায়গায় গিয়ে দাড়ালাম ।
- কি বলবেন বলেন ( রুপার চোখে মুখে ভাবনা আর উৎকণ্ঠার ছাপ লক্ষ্য করলাম)
- ভয় পাচ্ছেন সিস্টার ? ভয় পাবার কোন কারন নেই, আমি আপনার বোন অনন্যার ব্যাপারে জানতে চাই ।
সজোরে হাসলো রুপা । যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ সরিয়ে আনন্দের রেখা দেখতে পেলাম । রুপা ভাবছিল আমি তাকে প্রেম প্রপোজ করি কিনা ! তার কথাতে পরে জানতে পারলাম । এতে ভয় এর বড় কারন ছিল , রুপা একজনকে ভালবাসতো । সেদিকে যাবো না । হাসি সমেত সে জিজ্ঞাসা করলো
- অনু’র ব্যাপারে কি জানতে চান
- জানতে চাই অনু’র ব্যাক্তিগত সম্পর্কের কথা
কথাগুলো এত সহজেই বলে ফেলছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন আমি এই লাইনে খবুই অভিজ্ঞ একজন লোক । রুপা বললো,
- ব্যক্তিগত সম্পর্ক মানে ?
- মানে অনন্যা কারো সাথে প্রেম বা এরুপ কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কাউকে ভালবাসে কিনা, আর সে কিরুপ শ্রেণীর মেয়ে ?
রুপার ঠোটের কোণে এক মধুর হাসি এনে , টানা সুরে বললো
- কি ব্যাপার ভাই, সামথিং ইজ রং মনে হচ্ছে
বললাম
- আরে বলেন না অনন্যার কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কোন ক্লাসে পড়ে ( লাজুক মুখে)
- না নেই , ও খুব ভাল মেয়ে, একটু চঞ্চল, অনেক ভাল আর কিউট, ক্লাস এইটে এইবার ( বলে হাসলো)
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে হচ্ছে । রুপার ভালবাসা ছিল আমারই এক ভাই এর সাথে । আমি সেটা কিছুটা বুঝতে পারছিলাম আগে থেকেই । আর তাই রুপা অনু’র ব্যাপারে আমার প্রস্তাবটা খুব সহজে হাসিমুখে নিয়েছে বলে বুঝতে পারলাম । আমার সন্ধেহ ছিল আমার ভাইটির সাথে হয়তো রুপার নয়, অনু’র সম্পর্ক রয়েছে । এ ব্যাপারে আগে কিছুটা আঁছ পেয়েছিলাম । তাই এ ব্যাপারটি নিশ্চিত হবার জন্যে রুপাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে অনু’র সাথে আমার ভাই এর কোনরুপ সম্পর্ক আছে কিনা । আর তখনই জানতে পারলাম যে অনু’র সাথে নয় রুপার সাথে আমার ভাই এর সম্পর্কের ব্যাপারটা । তবে অনু অনেক সুন্দরী ছিল বলে ভাইটি রুপার এর চেয়ে অনু’র প্রতি দুর্বল ছিল এ ব্যাপারে জানতে পারলাম পরবর্তীতে । অনুর সাথে কথাও হতো তার । যাক এগুলো অপ্রয়োজনীয় কথা ।
বুকে সাহস নিয়ে রুপাকে বললাম
-আমি অনন্যাকে পছন্দ করি, ওর সাথে প্রেম করতে চাই, করতে চাই বলে কথা নয়, ওকে আমি ভালবাসি ।
রুপার মুখে আনন্দের হাসি
- হমমম, এই কাহিনী,
- জ্বী, সিস্টার , আমি এখন কি করবো, আপনি ছাড়া আমাকে হেল্প করার আর কেউ নেই, প্লিজ আমাকে হেল্প করুন , অনন্যাকে জানান ।
- ঠিক আছে ভাই, অস্থির হবার দরকার নেই, আমি অনুকে বলবো আপনার প্রস্তাব এর কথা ( বলে হাসলো)
- কখন জানাবেন
- দেখি অনু’র সাথে আজ কখন দেখা হয়, বিকেলে হয়তো বাসায় আসবে , তখনই বলবো আপনার কথা
- ঠিক আছে সিস্টার আমি অপেক্ষায় রইলাম , বলে দুজনেই বিদায় নিলাম কলেজ থেকে ।
জেনেছি মেয়েদের কাছে অতি উৎফুল্লতার অনেক কিছু অস্তিরতা ডেকে আনে । রুপার কাছেও ব্যাপারটা সেরুপ ছিল । তাই সেদিন কলেজ থেকে নিজের বাসায় না ফিরে সরাসরি অনন্যাদের বাসায় চলে যায় সে । রুপার কাছ থেকেই পড়ে জানতে পেরেছি । অনন্যা সেদিন ঘুমিয়ে ছিল । ধপাস করে অনু’র বিছানায় শুয়ে থাকা অনুর উপর পরলো রুপা । অনু আধো-ঘুমে ছিল । চমকে উঠলো ।
-কি ব্যাপার বুবু, এত খুশি কেন, আর এইভাবে হাঁপাচ্ছো কেন ? এইভাবে হামাগুরি দিয়েই বা পড়লে কেন আমার উপর
- ইন্টারেসটিং সংবাদ আছে অনু , তাই বাসায় না গিয়ে সরাসরি তোর কাছে চলে আসলাম ।
- কি ইন্টারেসটিং সংবাদ ?
- মামুন ভাই কে চিনিস না ? আমাদের বাসার ৪ তলায় যে থাকেন, উনি নাকি তোকে পছন্দ করেন, তোকে ভালবাসেন !
- কি বলছো ! (অনু বিস্ময়ে, অবাক চোখে মুখে)
- হ্যাঁ ঠিকই বলছি ! দেখ আমার কাছে নাম্বার আছে, কথা বললেই বুঝতে পারবি, কথা বল
আমি তখন অনুদের বাসার পথের এক গলি দিয়েই ব্যাংক এর কাজে যাচ্ছিলাম বসুন্দরায় । যখনই অনন্যাদের বাসা ক্রস করলাম, রুপার নাম্বার থেকে মিসকল পেলাম । মিসকল পেয়েই বুকের ভেতরটা মুছর দিয়ে উঠল ! ফোন ব্যাক করলাম সাথে সাথে ।
- হ্যালো, মামুন ভাই,
- জ্বী সিস্টার,
- আপনি কি সত্যি সত্যিই অনুকে ভালবাসেন ?
- মিথ্যে বা মজা করার জন্যে তো বলিনি সিস্টার !
- তাহলে এই নেন অনুর সাথে কথা বলেন ( বলেই অনুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিল)
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল ঠিক সে মুহুর্তে । রাস্তায় ছিলাম পানি খাওয়ার ব্যাবস্থাও ছিল না ! অপার থেকে কন্ঠ ভেসে আসলো -
- হ্যালো
- হ্যালো ( কাঁপা কণ্ঠে আমি)
- বুবুকে আপনি কি বলেছেন
- কি বলেছি তোমাকে বলেনি তোমার বুবু
- না বলেনি, আপনি বলেন
- যা বলেছি তোমার বুবুকেই তো বলেছি, সেই বিষয়ে আমি তোমার মন্তব্য চাই , প্লিজ জানাও ।
- ঠিক আছে আমি ভেবে আপনাকে জানাবো ।
- ওকে
- বাই...
অনন্যার সাথে এই প্রথম আমার কথা বলা । এখানে যত সহজে লিখে ফেললাম ঠিক ততটা সহজ ছিলনা যখন অনন্যার সাথে ফোনে কথাগুলো বলছিলাম । মনে আছে সেদিনের কথা । সমগ্র শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল অনুর কণ্ঠ শুনে । আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিল সেদিন । কন্ঠ আমার কয়েক শ মন ওজনে পরিণত হয়েছিল সেই মুহুর্তটাতে ।
কথা বলার পর একদিন দুদিন তিন দিন পার হয়ে গেল । অনন্যার ভেবে বলার সময়টা এখনও কেন আসছে সেই অস্থিরতায় আমার প্রতিটা ক্ষণ এক বিষাদতার মধ্যে পার হচ্ছিল । তিনদিনের দিনে রুপার মোবাইল থেকে মেসেজ আসলো আমি যেন কাল কলেজে দেখা করি , কথা আছে । উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা নিয়ে কলেজে গেলাম সেদিন । রুপার ঠোটে বাঁকা হাসি লক্ষ্য করলাম ।
-আপনার জন্যে সুখবর আছে ( হেসে হেসে সে বলল)
- কি সুখবর সিস্টার বলেন প্লিজ, অনন্যা কিছু জানিয়েছে ? ( উৎকণ্ঠা আমার)
- জ্বী, অনু বলেছে পজিটিভ ( বলে রুপা হাসলো)
মনে পরে সেদিনের কথা । জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ হবে । আমি আর সিস্টার কলেজের স্মৃতিসৌধের সিঁড়িতে বসে ছিলাম । এক লাফ দিয়ে আমি সিঁড়ি থেকে নেমে মাঠে একটা দৌড় দিলাম । যেন হাতে স্বর্গ পেলাম ।
উচ্ছ্বাস নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম সেদিন । রুপার কাছ থেকে পজিটিভ সংবাদ পাওয়ার পর আশা করছিলাম সেদিনই হয়তো অনন্যার মোবাইল থেকে ফোন আসবে । রুপা কলেজে অনু যে নাম্বারে আমাকে ফোন দিবে সেটি দিয়ে গিয়েছিল । সারাক্ষণ আমি ফোন হাতে ফোনের দিকে থাকিয়ে । কখন অনু ফোন দিবে আমাকে । অপেক্ষায় এইভাবে আরও তিনটে দিন পেরিয়ে গেল । অসহ্য এক অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম কখন অনুর ফোন পাবো । যেই নাম্বারটা রুপা দিয়েছিল আমাকে সেটা ছিল অনুর আম্মুর নাম্বার । সাবধান বানী ছিল যে আমি যেন কোন দিন ফোন না দিই যদি অনু কোনও মিসকল বা কল করার এলার্ট না দেয় । তাই আমার পক্ষ থেকে আগে ফোন দেবার কোন সুযোগ ছিলনা । হঠাৎ এক সন্ধায় আমার মোবাইলে ফোন বেজে উঠলো । সেই ফোনটিই ছিল যেন আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সুখকর ফোন ।
অপার থেকে -
- হ্যালো (অনুর কণ্ঠ)
- হ্যালো অনন্যা
- হম, কেমন আছেন ?
- ভাল , তবে তুমি এত পরে ফোন দিলে কেন, কবে সিস্টার আমাকে পজিটিভ সংবাদ শোনালো , তিন দিন পেরিয়ে গেল তোমার ফোন পাচ্ছিনা , এত ধৈর্য ধরার শক্তি কই আমার !
- আরে, আমি সুযোগ পেলে তো ফোন দিব , আম্মু বাহিরে যায় না, বাহিরে না গেলে ফোন দিব কি করে ।
অনুর মা-বাবা প্রতি সন্ধ্যায় অনুকে রেখে বাহিরে হাঁটতে যেত । অনুরা ছিল তিন বোন । আর একটা কাজের মেয়ে । প্রতি সন্ধ্যায় অনুর বাবা-মা বাহিরে চলে গেলেই অনু আমাকে ফোন দিত । অনুর সাথে আমার সবসময় সন্ধাতে কথা হত । কথা হত সেটূকু সময়, যেটুকু সময় অনন্যার বাবা-মা বাসায় না ফিরতো । যাক কথা হচ্ছিল দুজনে -
- অনন্যা, আমি কিন্তু তোমাকে ভালবাসি, কোনরুপ মজ-মস্তি করা আমার উদ্দেশ্য নয় । আমি চাই তুমি আমার হও । সুতরাং আমার আর কিছুই ভাবনার নাই । আমি তোমাকে ভালবাসি ।
অনু চুপ করে রইল ,
- কিছু বলছ নাযে,
- কি বলবো
- এই যে, আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু তুমি
- ধরে নিন আমিও এরকম কিছু একটায় ,
-সত্যি অনু,
-হুমম
অনেক খুশি আর আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেল হৃদয়ে । সেদিন প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বললাম দুজনে । এইভাবে কাটছিল দিন । রাজার দেয়া সাহস আর রুপার সহযোগীতা নিয়ে অনু আর আমার প্রেম হয়ে গেল কত সহজেই । প্রতি সন্ধ্যায় আমরা দুজন কথা বলতাম যতক্ষণ না অনুর বাবা-মা ওয়াকিং করে বাসায় ফিরে না আসতো ।
কিছু দিনের জন্য
সন্ধ্যার কয়েকটি মুহুর্ত ছিল আমার জন্য কত উচ্ছাসময়
এখন সেই আনন্দ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তোলে
এখন সেই সন্ধ্যাটা কান্নার ঢেউ তোলে
এখন সন্ধ্যাগুলো কাটে প্রতিক্ষায় ।
প্রতি বৃহস্পতি বার ও স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অনন্যা ওর আম্মুর সাথে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতো । রুপাকে নিয়ে আমাদের কলিং বেলে বেল বাজাতো । অনু এসেছে এটা আমাকে জানাবার ছলে আমার ছোট বোনকে খুজতে আসতো । ইশারায় বুঝিয়ে দিত যে ছাদে যেতে । আমি তৎক্ষণাৎ ছাদে চলে যেতাম । দুজনে ছাদের উপরে একে অন্যকে দেখতাম আর মোবাইলে কথা বলতাম । কথা বলতাম রুপার মোবাইল ফোন দিয়ে । অনুর ব্যাক্তিগত কোন নাম্বার ছিলনা । ফোন ছাড়া সামনা সামনি দুজনে কথা বলার কোন সুযোগ ছিলনা কারন ছাদে আমাদের দুইপরিবারের লোক ছাড়াও অনেক ভাড়াটে বিকেলে আকাশ দেখতে উঠতো। তাই ফোনেই কথা বলতাম দুজনে । অনু আর আমার প্রেমকালীন সময়ে কোন একটি দিনও দুজনে দুই চার মিনিটের মত সামনা সামনি কথা বলি নাই । একবিকেলে অনন্যাকে ছাদে একটা সুর্যমুখী ফুল দিয়েছিলাম । অনু সেটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকেছিল আর ফুলে চুমো খেয়েছিল । ছাদে আরো অনেকেই ছিল তাই অত্যন্ত কৌশলে আমি ফুলটি দিয়েছিলাম আর অনুও সেটি সেভাবেই নিয়েছিল আর তাতে চুমো খেয়েছিল । সেদিনটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক ।
এর মাঝে আমার বিদেশ যাওয়ার কথা উঠলো পরিবার থেকে । পাসপোর্ট করা হয়ে গেছে । যেকোন দিন চলে যেতে পারি মধ্যে প্রাচ্যের দেশ ওমানে । অনুর কানে সেটা পৌছতেই বাঁধা দিল আমি যেন কোনভাবেই বিদেশ না যাই , ফোনে কথা হচ্ছিল-
- আপনি নাকি বিদেশ চলে যাবেন ?
- হ্যা, যেতে হবে
- কেন যাবেন ?
- ফ্যামিলি পাঠাচ্ছে
- ফ্যামিলি কেন পাঠাচ্ছে আপনাকে ?
- জানিনা
- প্লিজ যাবেন না আপনি, আপনি গেলে আমি থাকবো কি করে
আমার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো । চোখ দুটি ছলছল হয়ে গেল । অনু কোন কথা বলছে না । বললাম অনু, যেতে হবে আমাকে , না গেলে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসবে কি করে । অনু কথা বলছে না । বললাম তুমি কথা না বললে যে আমার আকাশ ব্যাথায় ভারি হয়ে ওঠে ।
অনু বলে-
- আমার আকাশ ব্যাথায় ভারি হয়েই আছে , প্লিজ আপনি যাবেন না !
সৃষ্টিকর্তার কাছে সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম , বিধাতা যেকোন মূল্যের বিনিময়ে আপনি আমার বিদেশ যাত্রাটা বন্ধ করে দিন । বিধাতা আমার সেদিনের প্রার্থনা শুনেওছিলেন । আমার বিদেশ যাওয়া হয়নি ।
একদিন অনুর কাছ থেকে একটা মেসেজ এসছিল আমার ফোনে
“ আই লাভ ইউ , এন্ড মিস ইউ”
আজও চোখে ভাসে সেই মেসেজটা । যদিও অনেক আগেই মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার সাথে সেই মেসেজটাও হারিয়ে গেছে ।
একদিন অনুকে বলছিলাম , অনু একবার বল আই লাভ ইউ , প্রথমে না করে পরক্ষণেই মধু মিশ্রিত কন্ঠে বলল আই... লাভ... ইউ , আমি তখন এক চিৎকার দিয়েছিলাম আনন্দের । সেই চিৎকার আজও কানে ভাসে আমার ।
একদিন ইজতেমায় গিয়েছিলাম মোনাজাতে । সুদুর টঙ্গী থেকে হেটে আসতে হয়েছিল সেদিন । সন্ধায় বাসায় পৌছে বাথরুমে গেলাম ফ্রেস হতে । কাপর ধুয়েছিলাম বলে বাথরুমে একটু দেরি হল । বাহির হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি অনন্যার ২৬ মিসকল । এটায় ছিল অনুর সবচাইতে বেশি মিস করা আমার জন্যে । এরুপ মিসকল আমার জীবন অক্ষয় হয়ে থাক ।
একদিন অনুকে বললাম তোমার হাতে হাত রাখতে চাই অল্পক্ষনের জন্যে । অনু বললো ঠিক আছে , যেদিন আপনাদের ফ্ল্যাটে যাব সেদিন আমি আগে থেকেই আপনাকে জানিয়ে রাখবো , আপনি সিঁড়িতে থাকিয়েন, হাতে হাত রাখবো । সেদিন সন্ধ্যায় অনু আমাকে জানিয়ে রেখেছিল , আমি সিঁড়িতে অপেক্ষমান ছিলাম । হাত রেখেছিলাম অনুর হাতে । অল্পক্ষন ৩০ সেকেন্ড হবে সময় । অনুর হাতের স্পর্শ পাওয়া সেই হাত অনেকদিন কাউকে ধরতে দেইনি আমি । সেই ক্ষণটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক !
একদিন ছাদে কথা বলছিলাম দুজনে । সন্ধ্যার পরমুহুর্ত । আকাশে চাঁদ জেগেছিল তখন । অনুকে বললাম , অনু দেখ ওই চাঁদ । অনু চাঁদের দিকে থাকিয়ে হাসলো । বললাম তোমার সাথে ওই চাঁদেরও কোন তুলনা হয় না । তুমি চাঁদের চেয়েও অপরুপ । অনু হেঁসে বললো – আপনার জন্যে তো আমি এরকমই । সেই সন্ধেটা আমার জীবনে অক্ষয় থাক ।
এইভাবে বেশ চলছিল দুজনের স্বাভাবিক প্রেম । আমার চাওয়া গভীর । এরুপ যে অনন্যা ছাড়া আর কোন মেয়ে যেন আমার জীবনের জন্য অসহ্য । তাই অনুকেই কামনা করছিলাম গভীর ভাবেই । সৃষ্টি কর্তার কাছেও প্রার্থনা ছিল যেন, অনুই আমার জীবন সঙ্গিনী হয় । চলছিল দুজনের প্রেম । কিছুদিন পর অনুর ফোন পাচ্ছিলাম না বেশ কয়েকদিন । এক দুই দিন করে ১ মাস পেরিয়ে গেল । অনু আসে না আমাদের ফ্ল্যাটে আর ফোনও দেয় না । আগেই মানা ছিল আমি যেন ফোন না দেই, তাই আমার পক্ষ থেকে ফোন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না । রুপার কাছে জানতে চাইলাম , কি সমস্যা কেন ফোন দিচ্ছে না । জানতে পারলাম অনুর ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা তাই আমাকে ফোন দিতে পারছেনা । পরীক্ষা শেষ হলেও প্রায় ২ মাস পেরিয়ে গেল অনু আমাকে ফোন দিচ্ছে না । রুপার কাছ থেকেও কোন তথ্য পাচ্ছিলাম না ।
একদিন সন্ধ্যায় এলাকার এক হোটেল থেকে চা-নাস্তা খেয়ে অনুর বাসার নিচের গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । অনুদের বারান্দায় থাকালাম । দেখলাম অনু কার সাথে যেন কথা বলছে । ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না যে, এটা অনু নাকি অন্য কেউ । মোবাইলে হাতে নিয়ে আমি অনুর সেই নাম্বারটিতে ফোন দিলাম , দেখলাম ওয়েটিং । বারান্দা থেকে অনু ভেতরে চলে গেল । আমি আবার ফোন দিলাম , ফোন কেটে দিল । মনে এক আতঙ্ক শুরু হয়ে গেল । আবার ফোন দিলাম ফোন রিসিভ করে ২ সেকেন্ড এক মধ্যেই কেটে দিল । এইভাবে প্রায় ২০-২৫ বার আমার ফোন রিসিভ আর কাট করলো । সহ্য করতে না পেরে আমি মেসেজ দিলাম “ অনন্যা তুমি এমন করছো কেন , আমার ফোন কেটে দিচ্ছ , অথচ তুমি তো কার সাথে কথা বলছিলে । প্লিজ ফোন রিসিভ করো , নাহয় আমি তোমার আব্বুকে সব বলে দেব , আমার কাছে ডকোমেন্ট আছে” । মেসেজ দিয়ে আবার ফোন দিলাম । এইবার ফোন রিসিব করলো অনু-
- হ্যালো, কে, আপনার কি সমস্যা, ডিস্টার্ব করছেন কেন এরুপ ? ( বিরক্ত সুরে অনু)
- কি বলছো এসব অনন্যা ? আমি মামুন , ফোন ধরছ না কেন ? ( কাঁপা সুরে আমি)
- মামুন ? কোন মামুন ? আমি কোন মামুনকে চিনিনা , আর আমি অনন্যাও না ! ( রাগ স্বরে অনু)
- কি আবোলতাবোল বলচ্ছ অনন্যা !
- ওই ব্যাটা, কখন থেকে তুই আমাকে ডিস্টার্ব করছিস, আমি বলছিনা আমি মামুনকে চিনিনা, আর আমি অনন্যা না, বুঝস না, ব্যাটা ফোন রাখ ! ( বলে অনু ফোন কেটে দিল)
বোঝার আর কিছুই বাকি রইলনা যে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টটা আমি পেতে যাচ্ছি । হাত – পা বেহুস হয়ে গেল আমার । তারাতারি রাজাকে ফোন দিলাম । রাজা এলাকার বাজারেই ছিল । আমি বাজারে ছুটে গেলাম । রাজাকে জরিয়ে ধরে আমি চিৎকার করে কেঁদে দিলাম । রাজা লজ্জ্বা আর ভয়ে আমাকে তারাতারি নিরব জায়গায় নিয়ে গেল । অবাক ছিল যে আমি বাজারের ভেতরে এত কোলাহলে এইভাবে কাঁদতে পারলাম কি করে । পুরো কাহিনী রাজাকে খুলে বললাম । রাজা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো । শক্তিহীন অঙ্গ নিয়ে কোনরুপ আমি বাসার ছাদের গিয়ে উঠলাম । সেদিন রাতে কখন ছাদ থেকে রুমে ফিরেছি কি করে ফিরেছি সেগুলো মনে নেই আমার !
পরবর্তীতে অনুকে কিছু ভয় দেখালাম আর বললাম তোমার শাস্থি স্বরূপ সবকিছু তোমার আব্বু-আম্মুকে দেখিয়ে দেব বলে হুমকির বার্তা পাঠালাম । যাক অনু এতে মোটেও ভয়ার্ত ছিলনা । রুপার হস্তক্ষেপে অনু ঘটনার ৭ দিন পর আবার আমাকে ফোন দিল । ফোন দিয়ে কাহিনী বলল যে, সেদিন সে ইচ্ছে করে এমন করেনি , ওর ফুফু ছিল বাসায়, ফুফুর সামনে আমার ফোন যাওয়াতে সে ধরা খেয়ে গিয়েছিল, তাই আমার সাথে এরুপ আচরণ করতে হয়েছে । সে জন্য সে সরি । তার জীবনে ভালবাসা ফেবার করবে না, তাই সে আমার কাছে থেকে আজ থেকে মুক্ত । সুখে থাকার আশির্বাদ জানিয়ে আমার কাছে থেকে বিদায় নিল অনু ! আমি কিছুই বলতে পারিনি সেদিন । নির্বাক হয়ে শুনেছি আর কেঁদেছি । সেই কান্না বর্ষার অঝোর ধারার চাইতেও কত বেশি ছিল, আর সেই সন্ধ্যেটা অমবস্যার চাইতেও কত অন্ধকার ছিল তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই ।
বিরহ সাথে নিয়ে খুব হীন ক্ষীণ মনে হচ্ছিল নিজেকে । অনন্যা আর আমার সম্পর্কের ক্ষণটা ছিল শীতের লগ্নে । -
এখনও আমি প্রতিটি নির্জন রাত থাকি প্রতীক্ষায়
ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সাথে হয় আলাপন
শীত রাতের কুয়াশা ঝাপটে ধরে আমাকে
এসবের মাঝে তোমাকে ভেবে ভেবে
লগ্নগুলো পার করি এক অজানা রোমাঞ্চকতায়
শীতের সকাল সন্ধ্যা আর রাত আমার অতি চেনা আপন
মনে পড়ে কোন এক শীতের সন্ধ্যায় শপথ নিয়েছিলাম
তোমাতে আমাতে আমরা শুধুই আমাদের
রোমাঞ্চকর সেই মুহুর্তগুলো
এখনও রঙ্গিন আজ বহু বছর পরও
এখনও কল্পনার সমুদ্রে কখনো লেপের ছলে
বুকে জড়িয়ে ধরি তোমায়, লজ্জ্বায় রাঙা হই আমি
মনে কি উৎফুল্লতা জাগে তখন !
জানি তুমি জানবে না এখনও তোমার সব স্মৃতি
আছে আমার কাছে অক্ষত ভালবাসায়
কখনও তোমাকে পাই কুয়াশার চাদরে
কখনও অন্ধকার আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলোতে
কখনও শিশির ভেজা ঘাসে কখনও জোনাকির মিটিমিটি আলোয়
কখনও হলদে পাখির রোমাঞ্চকর ডাকে
তখন আমি নির্জন হই আবার তোমাতে
থাকি তোমাতে ভাবি আছি তোমার অস্তিত্বে
প্রতি যামিনীতে শীতের রজনীতে । ...৭ পৌষ, ১৪২০...।
খুব আশা ছিল মনে ২০০৯ এর ১৪ ফেব্রুয়ারীই বোধ হয় আমার জীবনের প্রথম ভালবাসা দিবসে পরিণত হলো । কিন্তু এর আগেই অনু আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গেল । এইভাবে অনেক দিন পার হয়ে গেল । প্রায় ৬ মাস । সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর অনুর চোখের সামনে পরি না । অনুও আমাকে আর ফোন/মিস কল দেয় না । একদিন সন্ধ্যায় বারান্দা দিয়ে দেখলাম অনু আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছে । দূর থেকে দেখে খুব মিস করছিলাম তাকে । তাই খুব ইচ্ছে হল একটা মেসেজ দেই । বুকে সাহস জমিয়ে বিধাতার কাছে অনুর কোনরুপ ক্ষতি না হওয়ার কামনা করে একটা মেসেজ দিয়েই দিলাম । বিধাতাকে বললাম ‘বিধাতা মেসেজটা যেন অনু পায়, ওর বাবা-মা র কাছে ধরা না পড়ে । তাহলে যে অনুর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে । বিধাতা কবুল করেছিলেন আমার সেদিনের আকুতি ।
সেদিন রাতে আনুমানিক সাড়ে ১১ টার দিকে আমি ইন্টারনেটে কাজ করছিলাম । আকস্মিক অনুর আম্মুর মোবাইল থেকে ফোন বেজে উঠলো । অজানা ভয়ে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেল । ফোন রিসিভ করেই অনুর কন্ঠ –
- ফোনটা ব্যাক করা যাবে ?
- নিশ্চয় ( বলে ফোন কেটে আমি ব্যাক করলাম)
- কেমন আছেন ?
- ভাল, তুমি কেমন আছ ?
- ভাল, হঠাৎ করে মেসেজ দিলেন যে
- হঠাৎ করে নয় অনু, আমি প্রতিদিনই তোমাকে খুব খুব মিস করি কিন্তু সাহস পাইনা তোমাকে মেসেজ দেওয়ার, পাছে তোমার আব্বু-আম্মুর কাছে ধরা খেয়ে তোমার কোনরুপ ক্ষতি হয় ।
- ও , তো আর কি খবর আপনার ?
- কি খবর জানতে চাও অনন্যা ? কেন তুমি এইভাবে চলে গেলে ? কেন আমাকে এত কষ্ট দিলে ? আমি তোমাকে ছাড়া কোনভাবেই ভাল নেই অনু !
- তো আপনি কি চান , আবার আমার সাথে সম্পর্ক করতে চান ?
- আমি তো সম্পর্ক শেষ করি নি অনু , আবার কি গড়বো
- দেখুন, আবার যদি আমার সাথে সম্পর্ক করতে চান তাহলে বুবুকে( রুপা) জানান , উনি যদি রাজি হোন তাহলে আবার আপনার সাথে সম্পর্ক হবে ।
যেভাবেই হোক অনুর বুবুকে রাজি করিয়ে আমি আবার অনুর কাছে ছুটে গেলাম সকল অতীত ভুলে । অতীতে কৃত এর জন্য অনুও ক্ষমা চেয়ে নিল আমার কাছে । প্রতিজ্ঞা করলো আর আমাকে কষ্ট দিবে না । আবার শুরু দুজনের পথ চলা । আবার প্রেম । এইযাত্রা একবার রুপার সাথে অনুর স্কুলে গিয়েছিলাম অনুকে আনার জন্যে । অনুর বাবা-মা কেউ ছিলনা, তাই রুপা-ই স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল অনুকে । আমিও সে সুযোগে রুপার সাথে গেলাম অনুর স্কুলে । দুজনে একসাথে এসেছিলাম স্কুলের পথ টুকু । অনু তার স্কুল ব্যাগটি আমার হাতে দিয়েছিল । বলেছিলাম অনু শুধু ব্যাগ কেন, তোমাকে সহ আমার কাঁদে জরিয়ে নেব । অনু হেসেছিল আমি ভেসেছিলাম সুখ সাগরে । সেদিনটি এখনও আমার জীবনে শ্রেষ্টদিন ।
একদিন অনুদের বাসায় কেউ ছিলনা । ১৯ জুন ২০০৯ এর দিকে । দুপুর থেকেই আমরা কথা বলছিলাম দুজনে । দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত , রাত থেকে মধ্য রাত । মনে আছে সেই রাতের কথা ! কতই না সুখকথন । সেইদিন রাত ৩ টা অবধি চলেছিল দুজনের আলাপনি । সেই রাতটি অক্ষত থাক আমার জীবনে ।
তারপর আর ২ মাস ঠিকেছিল আমার প্রতি অনুর মন । কোন এক অজানা কারনে অনু আর আমাকে ফোন দেয় না ।
একদিন ফোন দিয়ে বলেছিল ওর আম্মু নাকি জেনেছে আমি অনুকে ভালবাসি । ওর আম্মুর নাকি আমাকে পছন্দ নয় । তাই সে আর আমার সাথে সম্পর্ক করতে চাইলেও ঠিকতে পারবে না বলে ফোন রেখেছিল । সেইযে রেখেছিল ফোন সেই রাখার মধ্যেই এখনও রয়েছে আমার প্রেম । তারপর থেকে আর কোনদিন অনুর ফোন বাজে নি আমার ফোনে । কোন মিসকল মেসেজ আসে নি আমার ফোনে । এখনও আমি প্রতিটি সন্ধ্যা অপেক্ষায় থাকি । অনু এখন আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে গেছে । অনুর কাজিনরা ও আমাদের এলাকায় থাকে না এখন । কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কতভাবে । কোন এক অজানা কারনে অনুর কাছ থেকে আমি প্রত্যাখিত ।
আজ প্রায় ৫টি বছর পর এখনও আমি অনুর চলে যাওয়ার কারন খুজি, অনুকে খুঁজি । শুনেছি এখন একটি ছেলের সাথে গভীর প্রেমে মগ্ন সে । এই ছেলের আগেও আরেকটি ছেলের সাথে প্রেম ছিল অনুর । ভাগ্যক্রমে দুজন ছেলেই আমাকে চিনে । আমার জন্য তারা আফসোস করে । কিন্তু অনু নাকি আমার কথা শুনলেই বিরক্তিতে চোখ বোজে । বর্তমান প্রেমিকরা আমাকে বলেছিল আমরা একসাথে অনুর সামনে গিয়ে পরি । দেখবো তখন অনু কি করে ! আমার এতে রাজি নয় । কেনই বার করবো এরুপ তার কোন কারনও খুঁজে পাইনা । সেদিন রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ করেই অনুর সাথে আমার দেখা আমাদেরই এলাকায়, কবিতাটি লিখেছিলাম সে ক্ষনের অনুভুতি নিয়ে-
বছরের শেষ দিনের সন্ধ্যা এখন
জীবনের নয়
মাঝে মাঝে মনে হয় হোক এটাই জীবনের অন্তিম ক্ষন
কি হবে অমন অবজ্ঞা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা জীবন ।
তবুও বহমান নদীর মত জীবন চলছে ছুটে
থেমে নেই শত ঝড়ের মাঝেও
চলছে প্রাত্যহিক সব কাজ
তুমি হীন হয়েও ।
সন্ধ্যায় আজ হঠাৎ দেখা তোমার সাথে
প্রত্যাশা ছিল না এমন
মনে ভাবিলাম এটাই বোধহয় ২০১৩ এর
সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার
পরম সুখ বা চরম দুঃখ !
হঠাৎ দেখায় অনেকটা অপ্রকৃতস্ত আমি
অঙ্গের সমস্ত ইন্দ্রিয়ই যেন হচ্ছে বিকল
অস্থির আমি,
নিজেকে স্থির করে যখন দেখেছি তোমাকে
বোঝলাম তুমি অতি স্বাভাবিক
প্রথম চাওয়ার পর দ্বিতীয় চোখটি ফেললে না আর
বুঝিলাম হয়তো চেননি আমায়
বা চিনলেও অনুভূতির ভিন্নতা ।
তোমার ইন্দ্রিয়তে প্রভাব ফেলানোর কারন আমি নই
সেটা বোঝলাম খুব সহজেই
রিক্সা বাহনে তোমার প্রস্থান ।
মন আমার বিষন্ন অস্তির প্রায়
কতবার চেয়েছি কতভাবে চেয়েছি তোমায়
তুমি নও সৃষ্টিকর্তা জানেন তিনিই বোঝেন আমায়
আমাকে তোমার যোগ্য বা তোমাকে আমার মত করে
আমার জীবনসঙ্গী রুপে পাই
ছিল প্রার্থনা আমার ।
আবার হয়তো পাবো কোন সন্ধ্যায় অচেনা মানুষের মত
বা চেনা অতি আপন করে
সেই প্রতিক্ষায় আছি সন্ধ্যা প্রদ্বীপ জ্বেলে
তোমার আশায়
আশায় আশায়
আশায় আশায় ।
অনন্যা আমাকে সেদিন চিনতে পেরেছিল কিনা জানিনা । আমি তাকে দেখার পর থেকে হৃদয়ের পুরোনো হাহাকার কান্নাটা আবার বেড়ে গিয়েছে । প্রথমবার আমার দিকে তাঁকালেও দ্বিতীয় বার আর চোখটি ফেলেনি । ভেবেছি হয়তো চিনেনি আমায় ।
রুপার সাথেও সম্পর্ক নেই এখন । জানিনা সে কোথায় আছে । কোন অজানা কারনে সেও এখন আমাকে পাত্তা দেয় না হয়তো । দিলে তো ফোন দিত, পুরোনো নাম্বার বন্ধ , সেদিন দেখা হয়েছিল কলেজে, নাম্বার চেয়েছিলাম, দেয় নি, না দেবার কারন জানাতে চাওয়ার চাইতে নির্বাক হয়ে থাকার কারন বেশি ! তাই আমি নির্বাক হয়েছিলাম, রুপা আমার বাক ফিরিয়ে আনার কোরুপ চেষ্টা না করেই আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ! । রুপাদের প্রেম সম্পর্কটাও ভেঙ্গে গেছে আরও অনেক আগেই । সেটায় কারন কিনা আমাকে পাশ কাটানোর জানিনা ।
এখানেই আমার ভালবাসার পাঁচটি বছর । আমার অনুতে অনুতে ছড়িয়ে আছে অনন্যা । অনুতে আমার ভালবাসার পৃথিবী । এখানে আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারিনা এখন । অনুতে আমার প্রেমের সমাধি । আমার ভালবাসার প্রথম ও শেষ রমণী । তবুও এখানে ভালবাসা নেই । লাল টুকটুকে গোলাপ ফুটে নি এই ভালবাসায় । একতরফা প্রেম । আমি আজও ভাবি যদি একতরফা প্রেমই হবে তাহলে অনু কেন আমাকে সমর্থিত করেছিল সেদিন , কেন মেসেজ বার্তায় I love you & miss you লিখে পাঠিয়েছিল । এগুলোর উওর আর একতরফা প্রেম এর সংজ্ঞা খুজি এখন । জানিনা আর কতদিন খুজতে হবে আমাকে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মল্লিকা রায় ১৭/০৬/২০১৪হৃদয়ের কলজেটা উপরে দেখিয়ে দিয়েছেন কবি।শুভেচ্ছা রইলো।
-
আবু সাহেদ সরকার ১১/০৬/২০১৪অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম। বেশ লাগলো।
-
কবি মোঃ ইকবাল ০৮/০৬/২০১৪সময় নিয়ে পড়লাম।
খুব ভালো লাগলো।