উপন্যাস- ধূসর আয়না ( চোদ্দ পর্ব ) মল্লিকা রায়
উপন্যাস- ধূসর আয়না ( চোদ্দ পর্ব )
মল্লিকা রায়
তিনবার ভেদবমি আর পাঁচবার নির্গমনের পর পেছন বাড়ীর শিউ ডোমের শিশুটিকে নিয়ে ওরা ছুটছে গ্রামের তান্ত্রিক জাগ্রত মাতা গোমতেশ্বরীর মন্দিরে তার শিষ্যটি সদ্য ছোবড়ায় ধূনো দিয়ে ভক্তি সহকারে ধুনুচি জ্বেলেছেন । কালেকশন বাক্সটি তার দখলে,সমুখে মায়ের বিগ্রহের সমুখে ষষ্ঠ উপাচারের আয়োজনে বাজারের প্রায় সবকটি গোমস্তার দানসামগ্রীর যৌতুকে ফল,মূল যেমন আছে তেমনই ষোলোকলার চৌষট্টি মন্ত্রের পাবন।ওম ,হুম,ক্রিং,মন্ত্রে কেঁপে উঠছে সবেকী আমলের মন্দির।পেছনে অপরিষ্কার পুষ্করিণীর জলে ভাসানো হয় ভক্তের প্রাদুর্ভাব। ভনভনে মাছি আর কুকুরের উৎপাতে নিত্য কামড়াকামড়ি চলে ভোগে আর ভাগে। গ্রামের গোমস্তার ভাগে চলে যায় প্রায় কালেকশনের অর্ধাংশটা ঘর ভাড়া আর নমষ্কারী বাবদ বাকীটায় গেরস্থালীর তিনমুষ্ঠি চাল আর শিষ্যটির দয়ায় গোটা আষ্টেক পদের বাহার। সপ্তাহে দু'দিন গোমতী মাতায় ভর পরেন তিনি ,কথিত আছে সেসময় বিগ্রহের পূর্ণ তিথীর দর্শণ পান ভক্তরা।সন্ধ্যরতির অন্তিম পর্বে ধীরে ধীরে মায়ের শরীরে প্রথম কম্পন অনুভূত হয় ক্রমশ: চুল,পোষাক,শরীর বেসামাল হয়ে মায়ের ওপর স্বয়ং গোমতেশ্বরীর আত্মা ভর করে। মায়ের মুখে তখন দোআঁসলা স্বর শোনা যায়। উঠে দাঁড়িয়ে পরেন মা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে লুটিয়ে পরেন বিগ্রহের পাশে ।উত্তর দেন একে একে , ভক্তেরা আানন্দে আত্মহারা হয়ে কেউ হাতের,গলার,কানের স্বর্ণলংকার পর্যন্ত দান করেন অতি ভক্তির আতিশয্যে।ঢাক,ঢোল,ঘন্টা বেজে ওঠে পূজার সমারোহে ভক্তেরা শিরায় রক্ত স্রোতের তরঙ্গে টের পান ভগবানের আবির্ভাব । সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পরেন পুরুষ,নারী নির্বিশেষে মায়ের চরণতলে।গায়ের এই মন্দিরে তান্ত্র্রিক মায়ের নামে সর্বধর্ম সমন্ময়ের এক আশ্চর্য মেলবন্ধণ রয়েছে যেখনে ধর্মের অর্থ বিচ্ছিন্নতা নয়,একত্রিত হওয়া ।আচ্ছন্ন ময়ের সমুখে কর জোড়ে ভক্তবৃন্দের সমগম কেবল বাঁচার আর্তি। পাশের শিষ্যটির ওষুধ তৈরীর সময় পর্যন্ত নির্ধারিত ভক্তের সময়সীমা।ওষুধ অর্থে কিছু মিক্সার ,পুরিয়ার মিশ্রণের এক অভিনব পদ্ধতি যা হয়তো কোন সময় অলৌকিক ক্ষমতায় সুস্থ করে তোলে রোগীর জটিলতাকে কখনো হয়তো বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় রুগী মৃত্যুপথে গমন করলে তাকে ভাগ্য,কর্মফল ইত্যাদির ভয়ানক আরোপে বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার কৌশল পর্যন্ত নিঁখুত পারঙ্গম প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়।পর পর সন্তান বলি দেওরার পর বৃদ্ধের পুত্রলাভ খুব চাতুরির সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়,কাপালিকও মন্ত্র তন্ত্রে,মাদক সেবনে প্রায় অচেতন অবস্থায় নিধন কার্য সম্পন্ন করেন এক একটি শিশুর,গোপনে এবং কুঠুরীতে।এমনই এক পরিস্থিতি আজ অতসীর সমুখে ,কাছে থেকেও যখন কিছুই প্রায় করার থকে না তারই আরেক নাম অসহায়তা । গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের কথা জানা যায় কবির কবিতা,গল্প থেকে কিন্তু খুব কাছের অন্ধকারটা প্রায়ই অজানা রয়ে যায় যেহেতু ব্যাবস্থার মিশ্র প্রক্রিয়া সেহেতু প্রতিরোধের নির্বাক পরিস্থিতি অতসীকে আহত করে তোলে।অনেক্ষণ অপেক্ষায় ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা এই অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একক শক্তি থেকেও কোথায় যেন এক ভীতির উদ্রেক হয়। গ্রাম্য মহিলা পুরুষ প্রায় সকলেই যখন একপ্রকার অবেগের উদ্দীপনায় মত্ত তখন হুট করে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো কিছুটা ভীতিপ্রদ বটেই।ঊঠোন কোনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে শিউ ডোম, পেছনে এসে দাঁড়ায় অতসী। "দ্যখ শিউ , অন্য কারু কথা নয় তোর কথা বলি, যা বৌটাকে টেনে নিয়ে আয় গ্রামের শেষ প্রান্তে হাসপাতাল হলেও সব খরচ আমার একটা রিক্স ডাক্ ,তুলে নিয়ে আয় বৌটাকে", তুমি যাও না কেনে দিদি মু ভয়ে ডরাইচে", পেছন থেকে হেঁচকা টানে বৌটার হাত ধরে দাঁড় করায় ।,"চল্ তোর মেয়ে মরে যাবে,আর সময় নেই আমরা হাসপাতালে যাব" রে রে করে ওঠে মনিষ্যিদের চেলা চামুন্ডা" তুমি কেমন মানুষ হে,ভয় ডর কিছু নাই,এইটুকুন মেয়েটারে কোথায় সাহস দেবা তা না হাসপতাল দেখাও। কোন কথায় কান না দিয়ে হাত ধরে টেনে হনহন করে অতসী বেরিয়ে আসে রাস্তায়। সাহসে ভর করে পাশের একটি অল্প বয়সী মেয়ে ঊঠে রূখে দাঁড়ায়," মু মানবো নাই, মুর ঐটুকুন দুধ শিশুর শরীলট্য কেট্যে ভাসয়ে দিলে ছেলে হবেক মানবো লাই,ও দিদি তুমার পায়ে পরি মুর ছুট শিশুটার জান্ বাঁচয়ে দাও গো", অন্ধকার যে এত জমাট এবং ঘোর কালো হতে পারে অতসীর জানা ছিল না। গ্রাম শুদ্ধ লোক ভয়ে মুখে রা টি কাটে না নি:শব্দে পিলপিল করে আদেশ পালন করে চলেছে আদিম দাসেদের মত । নিজস্ব ভাবনা চিন্তা এসেছে অনেক পরে,এখনে ধর্ম গুরু ছড়ি নেড়ে হুকুম দেন," উও বজ্জাত মেয়েছিলায় ডায়েন ভর পরিছে, উর ধারেকাছে কেউ যবেক নাই,উয়ারে ঝাড়াইতে হবে ,উয়ার ছায়ায় ক্ষেতি হয়" । অবাক অতসী দেখে অণ্ধকার ভর করে আছে গোটা মানুষগুলোর উপর তার বিহিত সম্ভব কিসে? ঝাটা ও মন্ত্রের দবায় ভুত ছড়নো যেখানে অতি প্রচলিত ধারণা সেখানে এবং ভুতে ধরা বিশেষত ভুতেরাও বোধহয় খুব রোমান্টিক, দেখে দেখে মেয়েদের ঘাড়েই ভর পরে আর মন্ত্রের দাপট ,ঝাঁটার গুনে মোড়লের বত্রিশ পাটি দাঁতে বেড়িয়ে পরে মানুষ মারার বিশেষত অসহায় মহিলা মারার সুখে।সাদাসিধা মানুষগুলোকে বোঝানো কোন ব্যাপার নয়,কিন্তু সমাজের ধম্মগুরুদের দাপটের সমুখে আর যাই হোক নিদেনপক্ষে কোন মেয়েছেলের মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ জানানো কোনদিনই সম্ভব নয় তা গ্রামশুদ্ধ লোক জানে। ভয় ঐ গুরুদের নিয়ে, ভয় ওদের না বোঝা ভানটা নিয়ে ।অতসী জানে এই পাষাণে কোনদিন ফুল ফোটানো সম্ভব নয়,সম্ভব নয় সুস্থতা ফিরিয়ে আনা।একটি অশিক্ষিত ক্ষেতমজুর চেঁচিয়ে বলেছিল", লজ্জা করে না, পরের ঘরে বৌ বিটিগুলার সব্বোনাশ করতিছ, পারো তো উকে কাম কাজে জোগান দেও না কেনে , গেরামে কেউ কি মরদ নাই রে, উর গতি করে" ? শোনা যায় পরেরদিন ওর লাশ পাশের পুকুরে ভেসে উঠেছিল।গ্রামশুদ্ধ লোক মানে ওকে ব্রেম্মদত্যি ভর করেছিল ।নির্ভয়া তবু বন্ধুর দ্বারা হাসপাতাল অবধি পৌঁছতে পেরেছিল,আশা করেছিল হয়তো বেঁচে যাবে কিন্তু মৃত্যুর নির্মমতা ওকে লক্ষ্যে পৌঁছতে বাঁধা দিয়েছিল। কে বা কারা আছেন শিক্ষিত, মূল্যবোধ থাকা সত্ত্বেও এমন প্রগতি অস্বীকার করতে পারেন ? ধরতে পরেন কলমের তীব্রতা? মুহূর্তে পরিবর্তণ সম্ভব নয় জানি কিন্তু মানুষ কিভবে ভেবে নিচ্ছে যে আমরা বিংশ শতকের দোরগোড়ায় এসে গেছি ঝলমল করছে প্রগতির আলো ? যেথানে নিথর হয়ে পরে আছে অভয়া আর ছোট্ট শিশুটার শবদেহে মানবপশুর উন্মত্ততা!সেখানে গো গ্রাসে গেলানো চলছে পাঁচন তন্ত্রের লাশ। আর তার যজ্ঞের বলি হতে হচ্ছে কিছু অসহায় মেয়েদের। তবু তীব্রতা কমে না,কমে না স্ফুর্তি,তৃপ্তির অবাধ সঙ্গম,অবর্জণা গ্রহন আর বর্জণেই আটকে গেল প্রকৃত মূল্যবোধ।দু:খ এখানে নয় দু:খ আগামীকালের,দু:খ আমাদের ঘর,সংসারের ,দু:খ গোটা ব্যাবস্থাপনায়।যখন টেনে নামানো হয় হেড মাস্টার মশায়ের মত নিরীহ মানুষটার অস্তিত্ব তখন সমাজ নয় জঙ্গল আর উন্মাদের রাজত্বকে মনে করিয়ে দেয়।আসলে একদল ব্রেম্মদত্যি সমাব্যবস্থর মূলে বসে চালাচ্ছে স্বেচ্ছাচার,তাদের কৌশল ছাড়িয়ে যাচ্ছে সভ্যতা,সৌজন্য,গোটা শিক্ষা ব্যাাবস্থাকে, বই আছে পড়বে কে ? সময় কই ? তার চেয়ে বিনোদন ভালো। বই পড়লে আলো আসবে অবধারিত ভাবেই,আলো আসলে সবাই চাইবে প্ল্যাটফর্ম,কাজ,চাকরী অত ব্যাবস্থার সময়,সুযোগ কোথায় ? অতএব ছড়িয়ে দাও বীজমন্ত্র ,আচ্ছন্নতা দাও যত পারো। ছেলে,বুড়ো নির্বিশেষে ভুলে যাক স্থাণ,কাল্,পাত্র নেশার তোষণ জুড়ে শুধু দলে দলে মানুষ।আজও নিষ্ঠাবান মানুষ আছেন যিনি মৃত্যুর পরেও লিখে যান তার ভ্রান্তির কথা,লিখে যান পাঁচ টাকা আট পয়সা পায় তারই পরের সহোদর। তারা আজ অগোচরে,জনসমক্ষের আড়ালে ভয়ে দিনযাপন করছেন কোনমতে ,হঠাৎ কখন তাকে নিচে নামার রোলকল শুরু হয়ে যায়,কান পেতে থাকতে হয় সেই শব্দের দিকেও ।মানুষের বড় রোগ সে একা কখনোও মরবে না, দু'চারজন সঙ্গে নিয়ে মরবেই,যোগ্যতার চাইতে খাই বেশী,শরীর পারমিট করুক বা না করুক বর্ণ.গন্ধ নিতে যাবেই যাবে শখের বাজারে।তারপর ছড়িয়ে,ছিটিয়ে অর্ধ ভোজন,অভোজনে পশ্চাৎপসরণ। তারপর মৃত্যু অবধারিত। সঙ্গে তার বৌ ছেলে পিলে । আফষোস এ যুগের হরিশচন্দ্ররা পশ্চাদপসরণ পন্থী তাই তাদের মৃত্যু নেই,জন্ম নেই ,ইহ,পর কিছুই নেই অজস্র ব্যাবধানের আড়ালে অতীত হয়ে জেগে আছেন কাগজে,ক্যালেন্ডারের তুলি,কলমে।এইসব ছাইপাশ ভাবতে ছিল অতসী,আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মেয়েটি ততক্ষণ ওর হাত,পা ধরে টানাটানি। ঘোর কাটল যখন সব শেষ,কাড়াকারি,পর্যায়ে জুড়ে দেওয়া চলছে অন্তিম লাশ গোটা গয়নার বাক্স জুড়ে হরিশচন্দ্র তখন যমুনা কিনারে দ্যান ধ্যানে ব্যস্ত। যুবসমাজে ছড়াচ্ছেন ," হেই ফলো মি"।আচ্ছন্নের মত ওরা জাগরণে মত্ত, মেয়েকূলের নাভিশ্বাস অবস্থা কাটাবেন কি করে বাপ,মায়েরা খতম করা হল কিছু পুরুষ প্রজাতি। মহা মন্ত্রে জাগিয়ে তোলা হল হরিশচন্দ্রের স্তব,স্তূতি। সঙ্গে দিগবিদিক কাঁপানো মন্ত্র," জয় বাবা হরিশচন্দ্রের জয় "। দেড়হাজার কালো কোটের সৈনিক ঘাঁড় ধাক্কা খেয়ে বেড়িয়ে গেলেন মহা নিষ্ক্রমণের পথে।অতসী তখন আকাশ দেখছে।
ক্রমশঃ
ধূসর আয়না / উপন্যাস (পর্ব পনেরো )
মল্লিকা রায়
রমেন আজ দুই বার এসেছে,খবর নিয়েছে।খুব সকালে অবাক করে দিয়ে বাড়ির এক বিশাল লাউ নিয়ে হাজির। বিকেলে টেনে বার করে নন্দন সিনেমা হলে। কতকাল পর বোধহয় একযুগেরও বেশি একসঙ্গে বেড়াতে বেড়োনো।কবে শেষবারে বেড়িয়েছিল আজ আর মনেও পরে না। একজনই আছে কোনকিছুই যাকে মনে করাতে হয় না।সন্ধের মনোরম পরিবেশে অনেকটা সময়ে পাশাপাশি বসেছিল,খোপায় গুজে দিয়েছিল গন্ধরাজ,অনেক কথা হয়েছে অনেক পরিকল্পনা। রমেনকে হিংসে করে দলের কিছু লোকজন বিশেষত গোকূল মিত্তিরের। মাঝে মধ্যেই সময়ে অসময়ে বাড়িতে ঢুকে চা খেতে চাওয়ার আবদার, যে টাকাটা দেনা রয়েছে তার সুদ বাবদ পরিমাণটা মনে করিয়ে দেওয়া। চড়া সুদ নেন ভদ্রলোক। যদিও চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি স্বয়ং ঋষিকেশ তুল্য সেটাও মনে করাতে ভোলেন না। আড়াল আবডালের খবর কে রাখে ? কানে তো আসে অনেক কথাই বাস্তবের সাথে তার মিল কতটুকু তা অবশ্য বোঝা গেলেও অধরাই থেকে যায়। যদিও অতসীর তেমন বাস্তব কোন অভিজ্ঞতা নেই,নীল শাড়িতে দারুন মানিয়েছে ওকে আজই পাট ভাঙা হালকা তাত। সঙ্গে সাদা ব্লাউস,এক ঝলক দেখে নিয়ে গোকূল মিত্তির মুখে অদ্ভুত এক আওয়াজ করেন ," বড় টিপে কি সুন্দর মানিয়েছে গো দিদিমনি , এই আমার গিন্নীর বুঝলে কিছূতেই মন পাওয়া যায়না সাজগোজ তো দূরের কথা বলে কি না আ মরণ,তিন কাল গিয়ে এককাল হল ছেলে পুলের বে হয়ে গেল একন আবার সাজ কিসের বোঝ ঠ্যালা",। এটা কিন্তু বৌদির ভারি অন্যায় ঠিক আছে আমি বলে দিয়ে আসবো একটু যেন সাজ গোজ করে পাশের ঘরের জানলা দিয়ে চোখ চলে যায় বহুদূর যেখানে কোন এক কোনে অপেক্ষারত ওর মনের মানুষ। রমেন ওর কোন অভাব যদিও বুঝতেই দেয়নি তথাপি একান্ত নিবিড় কারো সঙ্গ।খুব আপনার, যখন তখন ধরে বেধে,জাপটে,আটকে হাল্কা হওয়া যায়,আরও কত অধিকার আছে যেটা প্রয়োগ করলে এক হয়ে যায় দুটি মন।থেমে যায় ঝড়,ঝঞ্ঝা,তুফান। মৃগাঙ্কের অস্তিত্ব মুছে গেছে তবুও কখনো দু'জনের পাগলামো,একত্রের সেই খুনসুটিগুলো তোলপাড় করে মনের ভেতরটা সেটা কি দেখতে বা বুঝতে পারে রমেন ? পেট পুরে যেন তেনভাবে খাওয়া জুটে যায় কোনমতো কিন্তু মনের খোরাক ? যেখানে জমে আছে আজন্ম হাহাকার তার নিবৃত্তি হবে কিসে? বিশেষত মানবকূলে মানুষ তার বিশেষ কিছু নৈবেদ্য তুলে দিতে চায় তার মনের মানুষকে,সমস্ত প্রাণীকূলেই এ প্রভাব অব্যাহত। এই প্রাকৃতিক রীতি অগ্রাহ্য করার কোন অধিকার মানুষের নেই। জোর করে দমিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব হয় কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় মনের আবেগ,স্ফূর্তি,সৃজনশীলতা। সেও একপ্রকার মৃত্যুর নামান্তর। বেচে বর্তে থাকবে,হাটবে,চলবে,বলবে ,করবে,করাবে কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যের কোন অধ্যায় থাকবে না তাতে। তাই ঘর বাধে প্রাণী। ভালোবাসবে বলে। টিকে থাকার এ সংগ্রামে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নানাভাবে এ চাওয়ার মধ্যেও আছে প্রেম,ভালোবাসা আগ্রহ,টান, চাওয়া,পাওয়ার বিভিন্ন কলা কৌশল। মোট কথা তুমি আমায় ভালোবাসলে আমিও তোমায় ভালোবাসব যদি সেটা বুঝতে পারি। অসুবিধা হত না যদি ওর ফ্যক্টরিটা হুট্ করে বন্ধ হয়ে না যেত এমনিতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মৃগাঙ্কের সাথে কেটেছিলও বেশ সেই আবেগের দিনগুলো,তারপর সংসার জুড়ে নেমে এল বৈরাগ্য। কাজটা গেল ধরা পরল মারাত্মক মারণ ব্যাধি। মা জমিয়ে গল্প জুড়েছে মিত্তিরের সাথে ,শীতের শুরুর অগ্রাহনেই ঠান্ডার প্রকোপে সব বাড়ির জানালা,দরজা বন্ধ প্রায় অতসীও একে একে বন্ধ করে অনেকটা। উঠলেন মিত্তির মশায় রাত অষ্ট প্রহরের বেশি । মায়ের রুটি তরকারি পর্ব শেষ। পেটে ছুচো ডাকছে , কাপড় পাল্টে হাত,মুখ ধুয়ে বসে পড়ে মায়ের পাশে," উফ্ মা বড্ড ঠান্ডা লাগছে গো,আচলটা টেনে গায়ে,মাথায় জড়াতে থাকে অতসী। এই অতু যা চাদর গায় দে,আরে আমার শাড়ি খুলে যাবে.....এই শয়তান ছাড় শাড়ি। মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে ," তুমি তো আমার অতু ,উমমমা্ ",। দিলি তো গালে খানিক থুতু লাগিয়ে নে এবারে খেয়ে আমায় উদ্ধার কর। জানো মা আজ আমার কেন জানি খুব আনন্দ হচ্ছে, আজ চুটিয়ে আনন্দ করেছি,ঘুড়েছি। "বেশতো আমার শুনে খুব ভালো লাগছে রে,তুই এমনি থাক্ হাসি,খুশি আমার ভালো লাগবে"। "আচ্ছা মা তোমার বাবুনকে দেখতে ইচ্ছে করে মা ? আজকাল ওর কথা আর ভাবতেই ইচ্ছে করে না ,কি ছেলে বলোতো মায়ের কথা একবারের জন্যও মনে হয় না,দেখতে ইচ্ছে করে না" ? কি জানি বাপু বুঝিনে। মানুষ কি শুধুই অস্তিত্ব কিংবা মাথা সর্বস্ব যৌনসর্বস্ব এক কিংবদন্তি? এর বাইরে কোন পর্যায় নেই? খাবো,শোব,নেব এই ক'টি ব্যসার্ধের সমষ্টিমাত্র ? তোমার পঞ্চেন্দ্রিয় শোনে,বলে,দেখে,আরো কত কি এছাড়া একটা সম্পূর্ণ অস্তিত্বের সাথে জড়িত এই ইহ জগতের প্রতিটি ওজনস্তর। সেখানে তার বর্হিপ্রকাশ, যে ব্যক্তি যত নিজেকে ছড়াতে পারে সে তত সমৃদ্ধ তত উন্নত। ক্ষুদ্রতা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হয় বৃহত্তর উত্তরণের দিকে তবেই আত্মতৃপ্তি,আত্মন্মোচন। সময় এসে কড়া নাড়বে ",ওঠ জাগো, ওং মন্ত্র শুরু," এর এক একটি উচ্চারণ এক একটি শব্দ মন্ত্রের মত জাগিয়ে তুলবে তোমার রক্ত,মজ্জা,ঘিলুর প্রাণশক্তিকে বলবে উৎসারিত হও,উচ্চারিত হও। ঘরের এক একটি প্রাণীর মধ্যের দেওয়াল হল একটি বন্ধণ , একের থেকে পৃথকীকরণ,তেমনি ভাবনায়, ধারণায়,ধরণে আমাদের কার্যেরও প্রভাব পড়ে ভিন্নধরণের।বাধারূপ সংস্কারকে ঠেলে বেড়িয়ে আসতে পারলেও মনরূপ সংস্কারের কাছে প্রতিহত হতে হয় বেশির ভাগ সময়েই। এতসব বিপন্মুক্ত হয়ে যখন এগিয়ে এলাম আলোর দিকে তখন সচ্চিদানন্দ জগৎ এসে রূখে দিল যাবৎ ফলরূপ প্রকাশকে। হাড়ি,কুড়ি,হেসেলের সব্জী ঝুড়ি বাবদ শালার বৌভাতের কদমচূড়,তেতলার হাইব্রীড ছাতে নধর চাপার কলি। খাবি খেতে খেতে একবার ঠাকুর ঘর একবার ইহজগৎ আমার মস্তিষ্কের কোষে শুরু করেছে প্রপঞ্চের বায়প্সি চাষ। তখন তনুময়ের সুশ্রী শরীরে বিছিয়ে দিচ্ছে আমার তাবৎ পৃথিবী। রমেনের মুখে জন্মাচ্ছে পেত্রাকের ছত্রছায়ার গোটা আফ্রিকা আমি আবিষ্কারে ব্যস্ত সেই বিশল্যকরণীর। যা থেকে মানুষের বোধ নামক একপ্রকার কোষ সৃষ্টি হবে এবং মানুষ অপরকে দেখতে বুঝতে চিনতে পারবে সহযেই। অযাচিত চিন্তা ভাবনায় ঘুমটা গাঢ় হচ্ছে না কিছুতেই। বাইরে সেই একঘেয়ে চতুষ্পদের সশব্দ সঙ্গম। ঘুম না আসা কিছু মানুষের চলাফেরা ,গুঞ্জন,ফিসফাস যেন দরজা,জানালার ওপর আছড়ে পরা মুদ্রাদোষ। কেবলই বিভ্রান্তি, ভয়,আচ্ছন্নতা। মোজ্ মস্তি করে আধা রাতে দলবল নিয়ে ঘরে ফেরার সশব্দ আওয়াজ,ভারী বুটের,পলকা চটির,সাইকেলের আবার ওর বাড়ির কাছে তিন চার বার রিং বাজানো,সিটি মারার ঔদ্ধত্ত্যের প্রায় সবটাই যে প্রকৃতিগত নয় বেশিরভাগটাই স্বেচ্ছাকৃত তা খুব ভালোভাবেই জানে অতসী। চোখ জড়িয়ে আসছে। গোকূল মিত্তির ইয়া মোটা বড় খাতা নিয়ে হিসেব কষছেন।মাসে একশ টাকায় পনের টাকা সুদ হলে তিন বচরে তিরিশ হাজারের সুদে আসলে হল গিয়ে..........মা...............আ ধরমর করে উঠে বসে বিছানায়।কারেন্ট অফ্ ঘেমে নেয়ে একশা মা হাত পাখা চালাচ্ছে। দরজা খুলে বেড়িয়ে এল দাওয়ায়। দুটি প্রাণী অন্ধকারের আচ্ছন্নতায় নিমজ্জমান,ভোরের আলো অর্থাৎ জাগরণ সে কি আদৌ ঘটে ? কে জাগে ? সমাজ না মানুষ ? না কি মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে জাগতে গিয়ে খেই হারিয়ে যায় শৃঙ্খলার ? জাগতিক বিপত্তি,তাড়ণার আচ্ছন্নতা কুয়াশা চাদর পরিয়ে নারীকূলকে পাঠায় ছায়াবৃতার আতুরকক্ষে। যে কারণে একে অপরকে দেখতে গিয়ে ভাবতে গিয়ে মধ্যবর্তীর লাভাস্রোতে আটকে পরে সৃষ্টি হয় বিবর্তনবাদের। সেখানে কোন সামাজিক প্রেক্ষাপট কাজ করে না,শুধু প্রাণীজগৎ আর ভোগজগৎ। কাজেই এক্ষেত্রে অতসীর মা মেয়ে সম্পর্কের মধ্যেও এ বৃহত্তর সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই কোনমতে। এক ঘর,এক ছাদ এক জীবন হলেও দু'জনের মধ্যে বিস্তর ফারাক একে অপরকে মানসিক ব্যবধানে বাধ্য করে। বেচে থাকার জন্য একহাত জমিসহ খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থাণ ছাড়াও প্রত্যেকের জীবনে একজন বিপরীত লিঙ্গ প্রয়োজন এটাই সত্য। সেটা অবধারিত ভাবে হলে চিন্তা নেই কিন্তু সমাজ মানুষের ভাগ বাটোয়ারা করতে গিয়ে পুরুষের ঘাড়েই দিল একান্নবর্তীর একাধিক আপেলের সাথে লোলুপ পার্শ্বচারিতা।ফলে কাড়াকাড়ি,মারামারি।পৃথিবীতে যত হিংস্র কার্যকলাপ ঘটেছে তার এক তৃতীয়াংশই এই কেচ্ছাজনিত। আর বিপত্তির উদ্ভব এই আপেল কেন্দ্রিক অমিতব্যায়িতার ফল। সৃষ্টিকর্তা সবটাই দিলেন অথচ বাদ সাধলেন এই যৌন নামক কেলেঙ্কারীর অধ্যায়ে। আজও যে কারণে যোগ্য পুরুষের যোগ্য নারী যোটে না , যোগ্য নারীর যোটেনা যোগ্য পুরুষ। আর জাগতিক খেলার যোগে সিল্ মেরে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা চরম হাসি হাসলেন বললেন," এক যায়গায় মেরে দিলাম",। কারেন্ট এল প্রায় শেষ ভোরে। মা বারান্দায় ঘুমিয়ে পরেছে। সুন্দর কামিনী ফুলের মিষ্টি গন্ধে ম' ম' করছে চতুর্দিক অতসী গেট খুলে হাটতে শুরু করে আপনমনে । এক বাউল স্ত্রী বাউলাঙ্গের গান গাইতে গাইতে এর ওর বাড়ির ফুল সাবারে ব্যস্ত। চমৎকার সুরে হৃদয় মনে ব্যথিত ক্রন্দন । কষ্টে কাদছে মানুষ , কে যেন চরম ব্যাথা দিচ্ছে মানুষকে । গানের কথায় এমনই অর্থ । কষ্ট দেবার যারা তারা তা যেন তেন প্রকারেই দেবে,ভালো যে বাসবার সে যেনতেন প্রকারেই ভালো বাসবে কারণ সে ভালোবাসতে জানে,এর মধ্যের চরম প্রশান্তির খবর তার জানা। সে জানে জগৎ সত্য মানুষ মিথ্যা। ভালোবাসাই টিকে থাকে টিকিয়ে রাখে। এটাই অবধারিত সত্য। অনেকটা চলে এসেছে পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটাও পাশে হাতে ফুলের প্যাকেট," দিদি তোমার বাড়ির কামিনী ফুল দেবে আমার খুব ভালো লাগে", ও তাই বুঝি আমার পেছন পেছন চলেছিস , বললেই পারতি , চল্ ",। রাস্তায় ও পাড়ার মিঃ রাজেনের সঙ্গে দেখা ,গুড মর্নিং ম্যম কতদিন পরে দেখা হল বলুন তো , বেড়োবেন তো ? ওকে দেখা হবে",। বেশ করিৎকর্মা ভদ্রলোক প্রায়ই একসাথে দেখা হয় পথে,ঘাটে,বাসে,ট্রেনে বেশ আলাপী,মিষ্টভাষী। ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করেন অফিসটা একটু খারাপ জায়গায় রেড এলাকায় বলে আফসোস্ করেন প্রায়ই। কাছে আসার প্রবল আসক্তি অথচ পায়ে,মুখে আচ্ছন্নতার বেড়ি। হাসি পায় অতসীর বিশেষত পুং জাতির এই অভব্যতায়। ভোগ,ত্যাগ মানুষের জন্মগত প্রক্রিয়া কারো পুরুষোচিত কারোর কাপুরুষোচিত। এদিক সেদিক সামনে পেছনে দেখে তবে তার প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির প্রয়োগ। স্বচ্ছতার বাতাবরণটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। সভ্যতার খাজে খাজে খুজে চলেছি সেই প্রগলভ্ সাহচর্য। সময়ের সাইরেন জানান দেয় ওঠ,জাগো,চলো। চৌর্যবৃত্তি সর্বত্র। দোকান,বাজার, লোকালয়,বেশ্যালয়,আপন,পর,অফিস, কাছারি,মাঠে,ময়দানে সর্বত্র চৌর্যবৃত্তির এক প্রতিযোগিতা চলেছে যেন। মুছে গেছে স্বচ্ছতার মুখ বিনিময় লুকোচুরি,ফিসফিস,হেয়ালী,অসংযত কথার ম্লেচ্ছ যুগ চলছে যেন। শান্তি নেই অফিসেও হাত মুখে মেরে সরিয়ে দেওয়া চলছে অস্তিত্ব।বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা,বিভেদ,আক্রোশ। এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে ,বেচে থাকতে হবে।হাটতে হবে,ছুটতে হবে,হাসতে হবে,কাদতে হবে। বাথরূমে ঢুকে স্নানটা সেরে নেয় অতসী।সামনে পিঠে পুলির মহাযোগ চতুর্দিক আমোদে মাতোয়ারা। মা ও মন প্রাণ ভরে সাজাবে প্রাণের ঠাকুরঘরের নৈবেদ্য। চলছে তারই প্রস্তুতি।
( ক্রমশঃ)
উপন্যাস / ধূসর আয়না ( পর্ব ষোলো )
মল্লিকা রায়
গতকাল রাত দশটার পর এসেছিলেন মিত্তির মশায় লম্বা লিস্ট নিয়ে,মাথায় বাজ পরেছিল অতসীর,সারারাত মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করেছে মা,মেয়ে দু'জনেই তারপর ধুম জ্বর মায়ের। দু'জনে দু'জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করেছে শুধু। শতকরা দশ টাকা হিসেবে সুদ হলে সাত বছরে এত টাকা কিভাবে হয়? দশ লাখ ? একমাত্র বাসস্থাণ হারাবার ভয়ে হাতে পায়ে ধরেও ফল হয় নি অতসীর। পা৺কা লোক মিত্তির নধর টুসটুসে কচি ডগায় ওর নজর। ছুচো মেরে হাত গন্ধ করার বদলে উঞ্ছবৃত্তির মোটা থলি বগলে গুজে তৃপ্তির পান গোজেন চোখ,মুখ বুজে। তাতে কার কি এল গেল খুব একটা তোয়াক্কা করেন না উনি। একমাত্র ঠাকুর ঘরের ওই মাটি,পাথরের ঢেলায় যখন প্রাণ জেগে ওঠে ওর দুই চোখ চিক চিক করে ওঠে,দেখতে পান পাথুরে গোপাল কটকট করে চেয়ে আছে,মাটির কালির অশ্রুতে পাপ দেখে সটান শুয়ে বসে পাচশো বার প্রায়শ্চিত্য করেন তারপর অবশ্য দরজা বন্ধ হলেই আবার যে কে সেই। খাতা খুলে বসে পরেন কার কত ধার দেনা বাকি পরেছে । সুদে মূলে প্রায় মাথায় চোট দেওয়া যাবে কি না এইসমস্ত। এমনিতে ভদ্রলোক প্রতি অমাবস্যা,পূর্ণিমায় দান,ধ্যান করেন হাত খুলে। অবশ্যই হিসেব বহির্ভূত বাড়তি পয়সায়। রেগে মেগেই অতসী বলে ফেলেছিল ," ছিঃ আপনি এত নীচ বুঝতে পারিনি বিশ্বাস করুন , ভেবেছিলাম অন্ততপক্ষে আপনি বোধয় সৎ ও নির্ভেজাল ", "এই রেখে গেলাম কাগজপত্র",উঠে দাড়ায় মিত্তির কাল বারোটায় আসব", ঘর থেকে বেড়িয়ে যান গোকূল মিত্তির। মাঝ রাত থেকে তুমুল জ্বরে প্রলাপ বকছে মা। সকালে অচেতন পরে আছে, রমেনকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না বাইরে আছে। মাথায় জল দিয়ে কোনরকম জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু দেহ অসার,প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরেছে মা। এছাড়া অতসীকে বরখাস্ত করা হয়েছে কমিটির পদ থেকেও। চুপটি করে বসে মায়ের পাশে সারারাত কাটিয়ে দেয় অতসী। মা ধীরে ধীরে বলছেন," কিছুই হয় নি,কিছু লাগবে না শুধু মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে মা "।তারাহুড়ো করে সেদ্ধ ভাত করে কোনরকম স্নান সেরে ," আমি তারাতারি ফিরে আসছি মা তোমার ওষুধগুলো আনতে হবে তাই তারাতারি চলে আসব তুমি একটু বাইরে এসে বরং বোস।মা তাকান মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে,মনে মনে বলেন,ঠাকুর যা করেন ভালোর জন্যই করেন , বুকের ভেতরের শ্বাসটা আর থাকতে চাইছে না বেড়িয়ে আসতে চাইছে খা৺চা ভেদ করে,দেওয়ালে মলিণ ফ্রেমের ছবিতে বাবার পাশে দিদির কোলে কেমন মিটিমিটি হাসছে শয়তানটা। সুন্দর কোমল মুখখানি ঘিরে কেমন একটা সহজাত সরলতা ঘিরে রয়েছে আজও। পরম শান্তির ঘুমে তলিয়ে যান ছন্দা দেবী। আলতো করে কে৺পে ওঠে ঠোট ",অতু এলি "। দু ঘন্টা পর অফিস থেকে বেড়িয়ে ওষুধ গুলো কিনে হনহন করে পা চালায় অতসী। বাড়ির সামনে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে চলছে গুঞ্জন।ও যাবার সময় পাশের বাড়ির বৌদিকে বলে গিয়েছিল," আমি তারাতারি ফিরে আসবো "। রাস্তায় বেশ উত্তেজিত লোকজনের আক্রোশের নানান মন্তব্যে বিদ্ধ অতসী স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি এই কি সেই আপনার পড়শী ,স্বজন ? যখন তকন ঘরে ফেরা,বিচার আচার,জাত ধম্ম কিছুই নেয় গো,ওসব দেবতার পাপ নাগে গো,মানো আর নাই মানো। ওপাশ থেকে একজনের টিপ্পনী ", কি ? খোব তো শালিস দিদি করতেছিলে,একন চুপ মেরে গেলে যে,বলি অমন ধম্ম জেবনে দেকিনি ম্যাগো,মা মরে পরে আচে মেয়ের যেন বে লাগিচে মরণ দশা,থু, মে নাকি শত্তু্র গো "।। ঘরে ঢুকে আর মাকে পেলনা অতসী ," আমার অন্যায় হয়ে গেছে মাগো ক্ষমা করে দাও,আমি বুঝতে পারি নি মা তুমি এত তারাতারি চলে যাবে তোমার অতুকে ছেড়ে" পাশের বাড়ির নতূন বৌ পিঠে হাত রাখে," তোমার বেড়োনো উচিৎ হয় নি ঠাকুর ঝি,মায়ের পাশে থাকা উচিৎ ছিল",। বাইরে কোলাহলের আওয়াজ শোনা যায়, পাশের বৌটি উকি দিয়ে অতসীর কানে বলে", মিত্তির মশায় এয়েচেন গো ঠাকুরঝি দলবল নে"। অতসী নিথর হয়ে পরে থাকে মায়ের পাশে। ওরে বলে দাও গে ওনার যা কর্তব্য উনি তাই করুন ,আমি আগামী কালই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। বৌটি উঠে তাই ঘটা করে শোনায় মিত্তিরকে। কেউ না জানলেও অতসী জানে এ ঘোর বিপদের দিনে মিথ্যে প্রতিদ্বন্ধীতায় গিয়ে লাভ নেই, তথাপি মিথ্যে মেনে নেওয়ার আগে চোখের জল মুছে এসে দা৺ড়ায় বারান্দায় ", মিত্তির বাবু, শুনছেন আপনাকে বলছি ,ঘরে আমার মায়ের মৃতদেহ আর এই সময় মিথ্যে সই নকল করে আপনি এসেছেন আমার ভিটে দখল করতে? মানছি ত্রিশ হাজার আপনার শোধ দিতে পারিনি তাই বলে নকল সই দেখিয়ে আপনি গৃহচ্যুত করতে চাইছেন আমাকে ? আপনি জানেন আইনের কাছে গেলে আপনি পালাবার পথ পাবেন না। তাছাড়া দেশের সমস্ত গুন্ডা,মাস্তান জড়ো করে আপনি এই সময়টা বেছে নিলেন আমার ক্ষতি করতে । আর এইজন্যই কি এতকালের ধর্ম,শিক্ষা, চিন্তা,ভাবনা দিয়ে আমরা গড়ে তুলেছিলাম এই স্বচ্ছ ধারার প্ল্যটফর্ম যেখান থেকে আজ আমায়ই বাদ দেওয়া হল ।চমৎকার গোকূল মিত্তির। ধন্য বটে আপনি"চোখ মুছে ঘরে ঢোকে।ওবাড়ি থেকে দিদিরা এসে পরেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে বাইরে রমেনকে দেখা গেল মিত্তিরের সাথে আড়ালে বেশ মশগুল আলোচনারত। যদিও একবার উঁকি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে গেছে আসতে না পারার কারণে। মায়ের শেষ যাত্রা হয়ে গিয়েছে।এ জীবন আপাতত তাকে মুক্তি দিয়েছে। ছুটি নিয়েছেন সমস্ত কর্মজগৎ থেকে।আজ ঘরের সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন ,আলো জ্বলছে না রান্নাঘর,ঠাকুরঘরের , কোন কোলাহল নেই আর.........."ওরে জলটা খেয়ে নে অতু,দ্যাখ দেকিনি মাত্র একটা রুটিতে পেট ভরে অতবড় মেয়েটার,একটু শরীরের দিকে নজর দে অতু দিনকে দিন কি ছিরি হচ্ছে তোর। আমারও তো বয়স হলো এবারে একটু নিজেরটা ভাব..........."! নাহ্ শেষ পর্যন্ত নিজেরটাই আর ভাবা হলো না মা।তুমি ঠিকই বলেছিলে ,তুমি না থাকলে সবটাই অন্ধকার মাগো একরাশ কান্না জড়ো হয় দুটো চোখ জুড়ে। এবারে বোধহয় সেই কঠিন,কঠোর দিনের সূত্রপাত যেখানে কেউ কারোর নয় শুধুই স্বার্থ আর নিষ্ঠুরতা। দিদি ওঘরে বিছানায় বাকীরা শ্মশানে,একা অতসী ভাবতে গিয়ে বিমর্ষ হয়ে পরে ,যেখানে আরেকজনের আসন পাতা ছিল এতদিন আজ হঠাৎ করে সেখানে কেমন করে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করবে ভাবতে গিয়ে অথৈ চিন্তা গ্রাস করে ওকে। ভাবনা থেমে যায় মাঝ রাতে। শ্মশাণযাত্রী সব ফিরে যায় একে একে আলো আঁধারের মধ্যবর্তী জুড়ে আরেক জন্মক্ষণ লুকিয়ে থাকা খোলস ভেদ করে প্রকাশের তাড়ণা চলছে, সেখানে হয়তো দুর্ভেদ্য আঁধার ডানা ঝাপটাচ্ছে আর ও কৈশোর, যৌবনোত্তীর্ণ করে উত্তরণের আহত অধ্যায়ে উঠে দাঁড়াবার প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছে কিংবা প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছুই চলবে তবে পদ্ধতির মৃত্যু ঘটবে। একের সুখে অন্যের বলি এ তো স্বতঃসিদ্ধ প্রবচন। এ ধারায় ধুয়ে মুছে যাবে প্রচলিত , লৌকিক ভাবধারা সৃষ্টি হবে নূতন মূর্ছণার কেউ তলিয়ে যাবে কেউ তলানি ধরে এগিয়ে আসবে ফোকাসে। যেখানে জ্ঞান মিথ্যা, শিক্ষা অন্ধ, মূর্খতার ঢাকঢোলে সভ্যতার বিসর্জন। মেয়ে মেয়ে বলে চিৎকার সার ফিরে আসে মেয়ের বাসন্তিকা সাজ। আজ এ বাড়ির শোকস্তূপে যাদের ভগ্নাবশেষ মিশে গেল তার বীজে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে আগামীর দিনক্ষণ। যারা জাগবেন তাদের অস্থি সন্ধি জুড়ে পূননির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে শুধু প্রযত্নের কিছু মূর্তি প্রয়োজন তা না হলে আমরা উঁচু হচ্ছি কথাটায় গলদ থেকে যাবে। আদতে যে নিচু হচ্ছি এ ব্যাপারটা বরং চিন্তা করুক সমাজ দপ্তর। এতেই শেষ নয় আরো কিছু বাকি ছিল এবং আছে। আদতে এইসব কর্তব্যের পেছনে অনেকেই বেশ তৎপর , দুর্বলের কাঁধ চেপে,চুলের মুঠি ধরে টেনে,হিঁচড়ে ভূত ভবিষ্যৎ খেয়ে তবেই না শান্তি। ছত্রিশ ইঞ্চি ছাতি আর বত্রিশ পাটি দাঁত এ অত্যন্ত দুর্লভ জিনিস মানুষের সাম্রাজ্য জয়ের উন্মত্তে বিভোর হয়ে চিহ্নিত করবেই করবে। ক্ষমতা ভোগের নেশা কার নেই যে যেমনভাবে যতটুক পারে। শিক্ষা, সংস্কার, রুচি মানুষ মনে রাখে না ঐ ছত্রছায়ায় ভোগ চাই মূলত ব্যবস্থার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা ব্যবস্থারই পূর্ননিয়োগ করি অজান্তে,আড়ালে সেক্ষেত্রে ঠাঁই পায় না ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া অতসীও পড়ে থাকে ঐ বন্দোবস্তের তালিকা নাম্বারে। প্রাধান্য পায় দেহবিভঙ্গে প্রত্যঙ্গের কারুকাজ। লাস্যের মোহন রুপে আবাহন বিসর্জনে নিমজ্জনের প্রাদুর্ভাব। স্বজন খুঁইয়ে এখনও স্বাভাবিক হতে পারে নি অতসী অথচ চারপাশ টা কেমন নিশ্ছিদ্র,নিরেট,তটস্থ। চেনাজানা মুখগুলোয় স্বাতন্ত্রের দাগ ছোপ,কাল যা সহজ ছিল এ মুহূর্তে সবটাই দুর্লভ। নিয়তি টেনে ভেতরে পুরছেন ত্রিজাম সমাজ বোঝাচ্ছেন এটা আমার ঘর ওটা তোমার। এটা আমার সুখ ওটা তোমার। আমরা সমাজের তোমরা দলের। যার কারণে খোওয়া যাওয়ার এক সংজ্ঞা,অভাবের এক সংজ্ঞা বিচ্ছেদের আরেক। আসলে সৃষ্টিকর্তা কখনও মহিলাদের ছাড় দেননি সুতোটা সেটে দিয়েছেন চারদেওয়ালের কাঁধে তারা শিরা হয়ে,ক্লেদ হয়ে,সিঁথী হয়ে,লেপ্টে থাকেন সমাজের ঘাড়ে,ছাড় জোটেনা মড়কেও।মাঝরাত্রের পর আঘাত হয়ে নেমে এল অতসীর কাছে পারিপার্শ্বিক জোটবদ্ধ ভাবধারা সেই প্রথম পরিচিত রমেন আর ধূরন্ধর গোকূল মিত্তিরের অজ্ঞাত রুপ। রমেনের স্বভাব সিদ্ধ তাড়ণায় অতসীকে কাছে টেনে নেওয়া তারপর ভাঙা শরীর মনে কি কি ভাবে আবর্তনের প্রলেপ বুলিয়ে দখল করে নিতে হয় স্ব ইচ্ছের চাবিকাঠি তার প্রায় সবটাই আজ অত্যন্ত স্পষ্ট। অজানা ইঙ্গিতের প্রায় সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছে রমেন।আগামী কাল তার অন্তিম স্থায়িত্বের ইতি টানা হবে। মনে মনে হাসে অতসী," রমেন আমায় এতটা বোকা ভাবলে তুমি,এতটা অবিশ্বাস ? সেদিন অবশ্য আড়ালে মিত্তিরের সাথে তোমাকে দেখেই আমি আঁচ করেছিলাম ,যাক ভালোই করলে, তোমরা কখনও খারাপ কিছু করতেই পারো না"। "অতসী তুমি ভুল বুঝছ আমায়"। "মোটেই না বরং আজই আমি একদম ঠিক বুঝেছি তোমায় । সেই অষ্টাশির চোঁয়াল ভাঙা রমেন দা আমায় টপকে গিয়ে বান্ধবীর মদমত্তে উদভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ করে যেমনটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ঠিক, অবিকল সেই রমেন দা বিশ্বাস করো আমিও আজ মুহূর্ত পরিবর্তন করে নিয়ে কেমন অষ্টাশির অতসী বিশ্বাস হয়ে গেলাম ,বিশ্বাসই হয়না"। শালিস গ্রুপের হেড চেয়ারম্যান, পাড়ার সত্যি দিদি। প্রতি বছর ক্লাশে রাঙ্ক করা অতসীর আজ অস্তিত্ব সংকটের দিন।মুছে যাবার দিন। ফুরিয়ে যাবার দিন। ক্রমশঃ ভোর হয় সেই ফুল চোর মাসির উদাত্ত গানে,"কান্দো কেনে মন...........। ভোরের আলো এসে পরেছে উঠোনে,বাগানে ,ভারাক্রান্ত শরীর, মনে ধীরে এগিয়ে আসে আয়নার খুব কাছাকাছি, অস্পষ্ট,আবছা কাচে বিস্মৃত আবছায়া।মুহূর্তে ধূসর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় ওর সর্বাঙ্গ,ঠেলা মেরে ফিরিয়ে দেয় পিছু।
( সমাপ্ত )
মল্লিকা রায়
তিনবার ভেদবমি আর পাঁচবার নির্গমনের পর পেছন বাড়ীর শিউ ডোমের শিশুটিকে নিয়ে ওরা ছুটছে গ্রামের তান্ত্রিক জাগ্রত মাতা গোমতেশ্বরীর মন্দিরে তার শিষ্যটি সদ্য ছোবড়ায় ধূনো দিয়ে ভক্তি সহকারে ধুনুচি জ্বেলেছেন । কালেকশন বাক্সটি তার দখলে,সমুখে মায়ের বিগ্রহের সমুখে ষষ্ঠ উপাচারের আয়োজনে বাজারের প্রায় সবকটি গোমস্তার দানসামগ্রীর যৌতুকে ফল,মূল যেমন আছে তেমনই ষোলোকলার চৌষট্টি মন্ত্রের পাবন।ওম ,হুম,ক্রিং,মন্ত্রে কেঁপে উঠছে সবেকী আমলের মন্দির।পেছনে অপরিষ্কার পুষ্করিণীর জলে ভাসানো হয় ভক্তের প্রাদুর্ভাব। ভনভনে মাছি আর কুকুরের উৎপাতে নিত্য কামড়াকামড়ি চলে ভোগে আর ভাগে। গ্রামের গোমস্তার ভাগে চলে যায় প্রায় কালেকশনের অর্ধাংশটা ঘর ভাড়া আর নমষ্কারী বাবদ বাকীটায় গেরস্থালীর তিনমুষ্ঠি চাল আর শিষ্যটির দয়ায় গোটা আষ্টেক পদের বাহার। সপ্তাহে দু'দিন গোমতী মাতায় ভর পরেন তিনি ,কথিত আছে সেসময় বিগ্রহের পূর্ণ তিথীর দর্শণ পান ভক্তরা।সন্ধ্যরতির অন্তিম পর্বে ধীরে ধীরে মায়ের শরীরে প্রথম কম্পন অনুভূত হয় ক্রমশ: চুল,পোষাক,শরীর বেসামাল হয়ে মায়ের ওপর স্বয়ং গোমতেশ্বরীর আত্মা ভর করে। মায়ের মুখে তখন দোআঁসলা স্বর শোনা যায়। উঠে দাঁড়িয়ে পরেন মা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে লুটিয়ে পরেন বিগ্রহের পাশে ।উত্তর দেন একে একে , ভক্তেরা আানন্দে আত্মহারা হয়ে কেউ হাতের,গলার,কানের স্বর্ণলংকার পর্যন্ত দান করেন অতি ভক্তির আতিশয্যে।ঢাক,ঢোল,ঘন্টা বেজে ওঠে পূজার সমারোহে ভক্তেরা শিরায় রক্ত স্রোতের তরঙ্গে টের পান ভগবানের আবির্ভাব । সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পরেন পুরুষ,নারী নির্বিশেষে মায়ের চরণতলে।গায়ের এই মন্দিরে তান্ত্র্রিক মায়ের নামে সর্বধর্ম সমন্ময়ের এক আশ্চর্য মেলবন্ধণ রয়েছে যেখনে ধর্মের অর্থ বিচ্ছিন্নতা নয়,একত্রিত হওয়া ।আচ্ছন্ন ময়ের সমুখে কর জোড়ে ভক্তবৃন্দের সমগম কেবল বাঁচার আর্তি। পাশের শিষ্যটির ওষুধ তৈরীর সময় পর্যন্ত নির্ধারিত ভক্তের সময়সীমা।ওষুধ অর্থে কিছু মিক্সার ,পুরিয়ার মিশ্রণের এক অভিনব পদ্ধতি যা হয়তো কোন সময় অলৌকিক ক্ষমতায় সুস্থ করে তোলে রোগীর জটিলতাকে কখনো হয়তো বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় রুগী মৃত্যুপথে গমন করলে তাকে ভাগ্য,কর্মফল ইত্যাদির ভয়ানক আরোপে বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার কৌশল পর্যন্ত নিঁখুত পারঙ্গম প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়।পর পর সন্তান বলি দেওরার পর বৃদ্ধের পুত্রলাভ খুব চাতুরির সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়,কাপালিকও মন্ত্র তন্ত্রে,মাদক সেবনে প্রায় অচেতন অবস্থায় নিধন কার্য সম্পন্ন করেন এক একটি শিশুর,গোপনে এবং কুঠুরীতে।এমনই এক পরিস্থিতি আজ অতসীর সমুখে ,কাছে থেকেও যখন কিছুই প্রায় করার থকে না তারই আরেক নাম অসহায়তা । গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের কথা জানা যায় কবির কবিতা,গল্প থেকে কিন্তু খুব কাছের অন্ধকারটা প্রায়ই অজানা রয়ে যায় যেহেতু ব্যাবস্থার মিশ্র প্রক্রিয়া সেহেতু প্রতিরোধের নির্বাক পরিস্থিতি অতসীকে আহত করে তোলে।অনেক্ষণ অপেক্ষায় ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা এই অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একক শক্তি থেকেও কোথায় যেন এক ভীতির উদ্রেক হয়। গ্রাম্য মহিলা পুরুষ প্রায় সকলেই যখন একপ্রকার অবেগের উদ্দীপনায় মত্ত তখন হুট করে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো কিছুটা ভীতিপ্রদ বটেই।ঊঠোন কোনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে শিউ ডোম, পেছনে এসে দাঁড়ায় অতসী। "দ্যখ শিউ , অন্য কারু কথা নয় তোর কথা বলি, যা বৌটাকে টেনে নিয়ে আয় গ্রামের শেষ প্রান্তে হাসপাতাল হলেও সব খরচ আমার একটা রিক্স ডাক্ ,তুলে নিয়ে আয় বৌটাকে", তুমি যাও না কেনে দিদি মু ভয়ে ডরাইচে", পেছন থেকে হেঁচকা টানে বৌটার হাত ধরে দাঁড় করায় ।,"চল্ তোর মেয়ে মরে যাবে,আর সময় নেই আমরা হাসপাতালে যাব" রে রে করে ওঠে মনিষ্যিদের চেলা চামুন্ডা" তুমি কেমন মানুষ হে,ভয় ডর কিছু নাই,এইটুকুন মেয়েটারে কোথায় সাহস দেবা তা না হাসপতাল দেখাও। কোন কথায় কান না দিয়ে হাত ধরে টেনে হনহন করে অতসী বেরিয়ে আসে রাস্তায়। সাহসে ভর করে পাশের একটি অল্প বয়সী মেয়ে ঊঠে রূখে দাঁড়ায়," মু মানবো নাই, মুর ঐটুকুন দুধ শিশুর শরীলট্য কেট্যে ভাসয়ে দিলে ছেলে হবেক মানবো লাই,ও দিদি তুমার পায়ে পরি মুর ছুট শিশুটার জান্ বাঁচয়ে দাও গো", অন্ধকার যে এত জমাট এবং ঘোর কালো হতে পারে অতসীর জানা ছিল না। গ্রাম শুদ্ধ লোক ভয়ে মুখে রা টি কাটে না নি:শব্দে পিলপিল করে আদেশ পালন করে চলেছে আদিম দাসেদের মত । নিজস্ব ভাবনা চিন্তা এসেছে অনেক পরে,এখনে ধর্ম গুরু ছড়ি নেড়ে হুকুম দেন," উও বজ্জাত মেয়েছিলায় ডায়েন ভর পরিছে, উর ধারেকাছে কেউ যবেক নাই,উয়ারে ঝাড়াইতে হবে ,উয়ার ছায়ায় ক্ষেতি হয়" । অবাক অতসী দেখে অণ্ধকার ভর করে আছে গোটা মানুষগুলোর উপর তার বিহিত সম্ভব কিসে? ঝাটা ও মন্ত্রের দবায় ভুত ছড়নো যেখানে অতি প্রচলিত ধারণা সেখানে এবং ভুতে ধরা বিশেষত ভুতেরাও বোধহয় খুব রোমান্টিক, দেখে দেখে মেয়েদের ঘাড়েই ভর পরে আর মন্ত্রের দাপট ,ঝাঁটার গুনে মোড়লের বত্রিশ পাটি দাঁতে বেড়িয়ে পরে মানুষ মারার বিশেষত অসহায় মহিলা মারার সুখে।সাদাসিধা মানুষগুলোকে বোঝানো কোন ব্যাপার নয়,কিন্তু সমাজের ধম্মগুরুদের দাপটের সমুখে আর যাই হোক নিদেনপক্ষে কোন মেয়েছেলের মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ জানানো কোনদিনই সম্ভব নয় তা গ্রামশুদ্ধ লোক জানে। ভয় ঐ গুরুদের নিয়ে, ভয় ওদের না বোঝা ভানটা নিয়ে ।অতসী জানে এই পাষাণে কোনদিন ফুল ফোটানো সম্ভব নয়,সম্ভব নয় সুস্থতা ফিরিয়ে আনা।একটি অশিক্ষিত ক্ষেতমজুর চেঁচিয়ে বলেছিল", লজ্জা করে না, পরের ঘরে বৌ বিটিগুলার সব্বোনাশ করতিছ, পারো তো উকে কাম কাজে জোগান দেও না কেনে , গেরামে কেউ কি মরদ নাই রে, উর গতি করে" ? শোনা যায় পরেরদিন ওর লাশ পাশের পুকুরে ভেসে উঠেছিল।গ্রামশুদ্ধ লোক মানে ওকে ব্রেম্মদত্যি ভর করেছিল ।নির্ভয়া তবু বন্ধুর দ্বারা হাসপাতাল অবধি পৌঁছতে পেরেছিল,আশা করেছিল হয়তো বেঁচে যাবে কিন্তু মৃত্যুর নির্মমতা ওকে লক্ষ্যে পৌঁছতে বাঁধা দিয়েছিল। কে বা কারা আছেন শিক্ষিত, মূল্যবোধ থাকা সত্ত্বেও এমন প্রগতি অস্বীকার করতে পারেন ? ধরতে পরেন কলমের তীব্রতা? মুহূর্তে পরিবর্তণ সম্ভব নয় জানি কিন্তু মানুষ কিভবে ভেবে নিচ্ছে যে আমরা বিংশ শতকের দোরগোড়ায় এসে গেছি ঝলমল করছে প্রগতির আলো ? যেথানে নিথর হয়ে পরে আছে অভয়া আর ছোট্ট শিশুটার শবদেহে মানবপশুর উন্মত্ততা!সেখানে গো গ্রাসে গেলানো চলছে পাঁচন তন্ত্রের লাশ। আর তার যজ্ঞের বলি হতে হচ্ছে কিছু অসহায় মেয়েদের। তবু তীব্রতা কমে না,কমে না স্ফুর্তি,তৃপ্তির অবাধ সঙ্গম,অবর্জণা গ্রহন আর বর্জণেই আটকে গেল প্রকৃত মূল্যবোধ।দু:খ এখানে নয় দু:খ আগামীকালের,দু:খ আমাদের ঘর,সংসারের ,দু:খ গোটা ব্যাবস্থাপনায়।যখন টেনে নামানো হয় হেড মাস্টার মশায়ের মত নিরীহ মানুষটার অস্তিত্ব তখন সমাজ নয় জঙ্গল আর উন্মাদের রাজত্বকে মনে করিয়ে দেয়।আসলে একদল ব্রেম্মদত্যি সমাব্যবস্থর মূলে বসে চালাচ্ছে স্বেচ্ছাচার,তাদের কৌশল ছাড়িয়ে যাচ্ছে সভ্যতা,সৌজন্য,গোটা শিক্ষা ব্যাাবস্থাকে, বই আছে পড়বে কে ? সময় কই ? তার চেয়ে বিনোদন ভালো। বই পড়লে আলো আসবে অবধারিত ভাবেই,আলো আসলে সবাই চাইবে প্ল্যাটফর্ম,কাজ,চাকরী অত ব্যাবস্থার সময়,সুযোগ কোথায় ? অতএব ছড়িয়ে দাও বীজমন্ত্র ,আচ্ছন্নতা দাও যত পারো। ছেলে,বুড়ো নির্বিশেষে ভুলে যাক স্থাণ,কাল্,পাত্র নেশার তোষণ জুড়ে শুধু দলে দলে মানুষ।আজও নিষ্ঠাবান মানুষ আছেন যিনি মৃত্যুর পরেও লিখে যান তার ভ্রান্তির কথা,লিখে যান পাঁচ টাকা আট পয়সা পায় তারই পরের সহোদর। তারা আজ অগোচরে,জনসমক্ষের আড়ালে ভয়ে দিনযাপন করছেন কোনমতে ,হঠাৎ কখন তাকে নিচে নামার রোলকল শুরু হয়ে যায়,কান পেতে থাকতে হয় সেই শব্দের দিকেও ।মানুষের বড় রোগ সে একা কখনোও মরবে না, দু'চারজন সঙ্গে নিয়ে মরবেই,যোগ্যতার চাইতে খাই বেশী,শরীর পারমিট করুক বা না করুক বর্ণ.গন্ধ নিতে যাবেই যাবে শখের বাজারে।তারপর ছড়িয়ে,ছিটিয়ে অর্ধ ভোজন,অভোজনে পশ্চাৎপসরণ। তারপর মৃত্যু অবধারিত। সঙ্গে তার বৌ ছেলে পিলে । আফষোস এ যুগের হরিশচন্দ্ররা পশ্চাদপসরণ পন্থী তাই তাদের মৃত্যু নেই,জন্ম নেই ,ইহ,পর কিছুই নেই অজস্র ব্যাবধানের আড়ালে অতীত হয়ে জেগে আছেন কাগজে,ক্যালেন্ডারের তুলি,কলমে।এইসব ছাইপাশ ভাবতে ছিল অতসী,আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মেয়েটি ততক্ষণ ওর হাত,পা ধরে টানাটানি। ঘোর কাটল যখন সব শেষ,কাড়াকারি,পর্যায়ে জুড়ে দেওয়া চলছে অন্তিম লাশ গোটা গয়নার বাক্স জুড়ে হরিশচন্দ্র তখন যমুনা কিনারে দ্যান ধ্যানে ব্যস্ত। যুবসমাজে ছড়াচ্ছেন ," হেই ফলো মি"।আচ্ছন্নের মত ওরা জাগরণে মত্ত, মেয়েকূলের নাভিশ্বাস অবস্থা কাটাবেন কি করে বাপ,মায়েরা খতম করা হল কিছু পুরুষ প্রজাতি। মহা মন্ত্রে জাগিয়ে তোলা হল হরিশচন্দ্রের স্তব,স্তূতি। সঙ্গে দিগবিদিক কাঁপানো মন্ত্র," জয় বাবা হরিশচন্দ্রের জয় "। দেড়হাজার কালো কোটের সৈনিক ঘাঁড় ধাক্কা খেয়ে বেড়িয়ে গেলেন মহা নিষ্ক্রমণের পথে।অতসী তখন আকাশ দেখছে।
ক্রমশঃ
ধূসর আয়না / উপন্যাস (পর্ব পনেরো )
মল্লিকা রায়
রমেন আজ দুই বার এসেছে,খবর নিয়েছে।খুব সকালে অবাক করে দিয়ে বাড়ির এক বিশাল লাউ নিয়ে হাজির। বিকেলে টেনে বার করে নন্দন সিনেমা হলে। কতকাল পর বোধহয় একযুগেরও বেশি একসঙ্গে বেড়াতে বেড়োনো।কবে শেষবারে বেড়িয়েছিল আজ আর মনেও পরে না। একজনই আছে কোনকিছুই যাকে মনে করাতে হয় না।সন্ধের মনোরম পরিবেশে অনেকটা সময়ে পাশাপাশি বসেছিল,খোপায় গুজে দিয়েছিল গন্ধরাজ,অনেক কথা হয়েছে অনেক পরিকল্পনা। রমেনকে হিংসে করে দলের কিছু লোকজন বিশেষত গোকূল মিত্তিরের। মাঝে মধ্যেই সময়ে অসময়ে বাড়িতে ঢুকে চা খেতে চাওয়ার আবদার, যে টাকাটা দেনা রয়েছে তার সুদ বাবদ পরিমাণটা মনে করিয়ে দেওয়া। চড়া সুদ নেন ভদ্রলোক। যদিও চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি স্বয়ং ঋষিকেশ তুল্য সেটাও মনে করাতে ভোলেন না। আড়াল আবডালের খবর কে রাখে ? কানে তো আসে অনেক কথাই বাস্তবের সাথে তার মিল কতটুকু তা অবশ্য বোঝা গেলেও অধরাই থেকে যায়। যদিও অতসীর তেমন বাস্তব কোন অভিজ্ঞতা নেই,নীল শাড়িতে দারুন মানিয়েছে ওকে আজই পাট ভাঙা হালকা তাত। সঙ্গে সাদা ব্লাউস,এক ঝলক দেখে নিয়ে গোকূল মিত্তির মুখে অদ্ভুত এক আওয়াজ করেন ," বড় টিপে কি সুন্দর মানিয়েছে গো দিদিমনি , এই আমার গিন্নীর বুঝলে কিছূতেই মন পাওয়া যায়না সাজগোজ তো দূরের কথা বলে কি না আ মরণ,তিন কাল গিয়ে এককাল হল ছেলে পুলের বে হয়ে গেল একন আবার সাজ কিসের বোঝ ঠ্যালা",। এটা কিন্তু বৌদির ভারি অন্যায় ঠিক আছে আমি বলে দিয়ে আসবো একটু যেন সাজ গোজ করে পাশের ঘরের জানলা দিয়ে চোখ চলে যায় বহুদূর যেখানে কোন এক কোনে অপেক্ষারত ওর মনের মানুষ। রমেন ওর কোন অভাব যদিও বুঝতেই দেয়নি তথাপি একান্ত নিবিড় কারো সঙ্গ।খুব আপনার, যখন তখন ধরে বেধে,জাপটে,আটকে হাল্কা হওয়া যায়,আরও কত অধিকার আছে যেটা প্রয়োগ করলে এক হয়ে যায় দুটি মন।থেমে যায় ঝড়,ঝঞ্ঝা,তুফান। মৃগাঙ্কের অস্তিত্ব মুছে গেছে তবুও কখনো দু'জনের পাগলামো,একত্রের সেই খুনসুটিগুলো তোলপাড় করে মনের ভেতরটা সেটা কি দেখতে বা বুঝতে পারে রমেন ? পেট পুরে যেন তেনভাবে খাওয়া জুটে যায় কোনমতো কিন্তু মনের খোরাক ? যেখানে জমে আছে আজন্ম হাহাকার তার নিবৃত্তি হবে কিসে? বিশেষত মানবকূলে মানুষ তার বিশেষ কিছু নৈবেদ্য তুলে দিতে চায় তার মনের মানুষকে,সমস্ত প্রাণীকূলেই এ প্রভাব অব্যাহত। এই প্রাকৃতিক রীতি অগ্রাহ্য করার কোন অধিকার মানুষের নেই। জোর করে দমিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব হয় কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় মনের আবেগ,স্ফূর্তি,সৃজনশীলতা। সেও একপ্রকার মৃত্যুর নামান্তর। বেচে বর্তে থাকবে,হাটবে,চলবে,বলবে ,করবে,করাবে কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যের কোন অধ্যায় থাকবে না তাতে। তাই ঘর বাধে প্রাণী। ভালোবাসবে বলে। টিকে থাকার এ সংগ্রামে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নানাভাবে এ চাওয়ার মধ্যেও আছে প্রেম,ভালোবাসা আগ্রহ,টান, চাওয়া,পাওয়ার বিভিন্ন কলা কৌশল। মোট কথা তুমি আমায় ভালোবাসলে আমিও তোমায় ভালোবাসব যদি সেটা বুঝতে পারি। অসুবিধা হত না যদি ওর ফ্যক্টরিটা হুট্ করে বন্ধ হয়ে না যেত এমনিতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মৃগাঙ্কের সাথে কেটেছিলও বেশ সেই আবেগের দিনগুলো,তারপর সংসার জুড়ে নেমে এল বৈরাগ্য। কাজটা গেল ধরা পরল মারাত্মক মারণ ব্যাধি। মা জমিয়ে গল্প জুড়েছে মিত্তিরের সাথে ,শীতের শুরুর অগ্রাহনেই ঠান্ডার প্রকোপে সব বাড়ির জানালা,দরজা বন্ধ প্রায় অতসীও একে একে বন্ধ করে অনেকটা। উঠলেন মিত্তির মশায় রাত অষ্ট প্রহরের বেশি । মায়ের রুটি তরকারি পর্ব শেষ। পেটে ছুচো ডাকছে , কাপড় পাল্টে হাত,মুখ ধুয়ে বসে পড়ে মায়ের পাশে," উফ্ মা বড্ড ঠান্ডা লাগছে গো,আচলটা টেনে গায়ে,মাথায় জড়াতে থাকে অতসী। এই অতু যা চাদর গায় দে,আরে আমার শাড়ি খুলে যাবে.....এই শয়তান ছাড় শাড়ি। মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে ," তুমি তো আমার অতু ,উমমমা্ ",। দিলি তো গালে খানিক থুতু লাগিয়ে নে এবারে খেয়ে আমায় উদ্ধার কর। জানো মা আজ আমার কেন জানি খুব আনন্দ হচ্ছে, আজ চুটিয়ে আনন্দ করেছি,ঘুড়েছি। "বেশতো আমার শুনে খুব ভালো লাগছে রে,তুই এমনি থাক্ হাসি,খুশি আমার ভালো লাগবে"। "আচ্ছা মা তোমার বাবুনকে দেখতে ইচ্ছে করে মা ? আজকাল ওর কথা আর ভাবতেই ইচ্ছে করে না ,কি ছেলে বলোতো মায়ের কথা একবারের জন্যও মনে হয় না,দেখতে ইচ্ছে করে না" ? কি জানি বাপু বুঝিনে। মানুষ কি শুধুই অস্তিত্ব কিংবা মাথা সর্বস্ব যৌনসর্বস্ব এক কিংবদন্তি? এর বাইরে কোন পর্যায় নেই? খাবো,শোব,নেব এই ক'টি ব্যসার্ধের সমষ্টিমাত্র ? তোমার পঞ্চেন্দ্রিয় শোনে,বলে,দেখে,আরো কত কি এছাড়া একটা সম্পূর্ণ অস্তিত্বের সাথে জড়িত এই ইহ জগতের প্রতিটি ওজনস্তর। সেখানে তার বর্হিপ্রকাশ, যে ব্যক্তি যত নিজেকে ছড়াতে পারে সে তত সমৃদ্ধ তত উন্নত। ক্ষুদ্রতা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হয় বৃহত্তর উত্তরণের দিকে তবেই আত্মতৃপ্তি,আত্মন্মোচন। সময় এসে কড়া নাড়বে ",ওঠ জাগো, ওং মন্ত্র শুরু," এর এক একটি উচ্চারণ এক একটি শব্দ মন্ত্রের মত জাগিয়ে তুলবে তোমার রক্ত,মজ্জা,ঘিলুর প্রাণশক্তিকে বলবে উৎসারিত হও,উচ্চারিত হও। ঘরের এক একটি প্রাণীর মধ্যের দেওয়াল হল একটি বন্ধণ , একের থেকে পৃথকীকরণ,তেমনি ভাবনায়, ধারণায়,ধরণে আমাদের কার্যেরও প্রভাব পড়ে ভিন্নধরণের।বাধারূপ সংস্কারকে ঠেলে বেড়িয়ে আসতে পারলেও মনরূপ সংস্কারের কাছে প্রতিহত হতে হয় বেশির ভাগ সময়েই। এতসব বিপন্মুক্ত হয়ে যখন এগিয়ে এলাম আলোর দিকে তখন সচ্চিদানন্দ জগৎ এসে রূখে দিল যাবৎ ফলরূপ প্রকাশকে। হাড়ি,কুড়ি,হেসেলের সব্জী ঝুড়ি বাবদ শালার বৌভাতের কদমচূড়,তেতলার হাইব্রীড ছাতে নধর চাপার কলি। খাবি খেতে খেতে একবার ঠাকুর ঘর একবার ইহজগৎ আমার মস্তিষ্কের কোষে শুরু করেছে প্রপঞ্চের বায়প্সি চাষ। তখন তনুময়ের সুশ্রী শরীরে বিছিয়ে দিচ্ছে আমার তাবৎ পৃথিবী। রমেনের মুখে জন্মাচ্ছে পেত্রাকের ছত্রছায়ার গোটা আফ্রিকা আমি আবিষ্কারে ব্যস্ত সেই বিশল্যকরণীর। যা থেকে মানুষের বোধ নামক একপ্রকার কোষ সৃষ্টি হবে এবং মানুষ অপরকে দেখতে বুঝতে চিনতে পারবে সহযেই। অযাচিত চিন্তা ভাবনায় ঘুমটা গাঢ় হচ্ছে না কিছুতেই। বাইরে সেই একঘেয়ে চতুষ্পদের সশব্দ সঙ্গম। ঘুম না আসা কিছু মানুষের চলাফেরা ,গুঞ্জন,ফিসফাস যেন দরজা,জানালার ওপর আছড়ে পরা মুদ্রাদোষ। কেবলই বিভ্রান্তি, ভয়,আচ্ছন্নতা। মোজ্ মস্তি করে আধা রাতে দলবল নিয়ে ঘরে ফেরার সশব্দ আওয়াজ,ভারী বুটের,পলকা চটির,সাইকেলের আবার ওর বাড়ির কাছে তিন চার বার রিং বাজানো,সিটি মারার ঔদ্ধত্ত্যের প্রায় সবটাই যে প্রকৃতিগত নয় বেশিরভাগটাই স্বেচ্ছাকৃত তা খুব ভালোভাবেই জানে অতসী। চোখ জড়িয়ে আসছে। গোকূল মিত্তির ইয়া মোটা বড় খাতা নিয়ে হিসেব কষছেন।মাসে একশ টাকায় পনের টাকা সুদ হলে তিন বচরে তিরিশ হাজারের সুদে আসলে হল গিয়ে..........মা...............আ ধরমর করে উঠে বসে বিছানায়।কারেন্ট অফ্ ঘেমে নেয়ে একশা মা হাত পাখা চালাচ্ছে। দরজা খুলে বেড়িয়ে এল দাওয়ায়। দুটি প্রাণী অন্ধকারের আচ্ছন্নতায় নিমজ্জমান,ভোরের আলো অর্থাৎ জাগরণ সে কি আদৌ ঘটে ? কে জাগে ? সমাজ না মানুষ ? না কি মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে জাগতে গিয়ে খেই হারিয়ে যায় শৃঙ্খলার ? জাগতিক বিপত্তি,তাড়ণার আচ্ছন্নতা কুয়াশা চাদর পরিয়ে নারীকূলকে পাঠায় ছায়াবৃতার আতুরকক্ষে। যে কারণে একে অপরকে দেখতে গিয়ে ভাবতে গিয়ে মধ্যবর্তীর লাভাস্রোতে আটকে পরে সৃষ্টি হয় বিবর্তনবাদের। সেখানে কোন সামাজিক প্রেক্ষাপট কাজ করে না,শুধু প্রাণীজগৎ আর ভোগজগৎ। কাজেই এক্ষেত্রে অতসীর মা মেয়ে সম্পর্কের মধ্যেও এ বৃহত্তর সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই কোনমতে। এক ঘর,এক ছাদ এক জীবন হলেও দু'জনের মধ্যে বিস্তর ফারাক একে অপরকে মানসিক ব্যবধানে বাধ্য করে। বেচে থাকার জন্য একহাত জমিসহ খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থাণ ছাড়াও প্রত্যেকের জীবনে একজন বিপরীত লিঙ্গ প্রয়োজন এটাই সত্য। সেটা অবধারিত ভাবে হলে চিন্তা নেই কিন্তু সমাজ মানুষের ভাগ বাটোয়ারা করতে গিয়ে পুরুষের ঘাড়েই দিল একান্নবর্তীর একাধিক আপেলের সাথে লোলুপ পার্শ্বচারিতা।ফলে কাড়াকাড়ি,মারামারি।পৃথিবীতে যত হিংস্র কার্যকলাপ ঘটেছে তার এক তৃতীয়াংশই এই কেচ্ছাজনিত। আর বিপত্তির উদ্ভব এই আপেল কেন্দ্রিক অমিতব্যায়িতার ফল। সৃষ্টিকর্তা সবটাই দিলেন অথচ বাদ সাধলেন এই যৌন নামক কেলেঙ্কারীর অধ্যায়ে। আজও যে কারণে যোগ্য পুরুষের যোগ্য নারী যোটে না , যোগ্য নারীর যোটেনা যোগ্য পুরুষ। আর জাগতিক খেলার যোগে সিল্ মেরে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা চরম হাসি হাসলেন বললেন," এক যায়গায় মেরে দিলাম",। কারেন্ট এল প্রায় শেষ ভোরে। মা বারান্দায় ঘুমিয়ে পরেছে। সুন্দর কামিনী ফুলের মিষ্টি গন্ধে ম' ম' করছে চতুর্দিক অতসী গেট খুলে হাটতে শুরু করে আপনমনে । এক বাউল স্ত্রী বাউলাঙ্গের গান গাইতে গাইতে এর ওর বাড়ির ফুল সাবারে ব্যস্ত। চমৎকার সুরে হৃদয় মনে ব্যথিত ক্রন্দন । কষ্টে কাদছে মানুষ , কে যেন চরম ব্যাথা দিচ্ছে মানুষকে । গানের কথায় এমনই অর্থ । কষ্ট দেবার যারা তারা তা যেন তেন প্রকারেই দেবে,ভালো যে বাসবার সে যেনতেন প্রকারেই ভালো বাসবে কারণ সে ভালোবাসতে জানে,এর মধ্যের চরম প্রশান্তির খবর তার জানা। সে জানে জগৎ সত্য মানুষ মিথ্যা। ভালোবাসাই টিকে থাকে টিকিয়ে রাখে। এটাই অবধারিত সত্য। অনেকটা চলে এসেছে পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটাও পাশে হাতে ফুলের প্যাকেট," দিদি তোমার বাড়ির কামিনী ফুল দেবে আমার খুব ভালো লাগে", ও তাই বুঝি আমার পেছন পেছন চলেছিস , বললেই পারতি , চল্ ",। রাস্তায় ও পাড়ার মিঃ রাজেনের সঙ্গে দেখা ,গুড মর্নিং ম্যম কতদিন পরে দেখা হল বলুন তো , বেড়োবেন তো ? ওকে দেখা হবে",। বেশ করিৎকর্মা ভদ্রলোক প্রায়ই একসাথে দেখা হয় পথে,ঘাটে,বাসে,ট্রেনে বেশ আলাপী,মিষ্টভাষী। ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করেন অফিসটা একটু খারাপ জায়গায় রেড এলাকায় বলে আফসোস্ করেন প্রায়ই। কাছে আসার প্রবল আসক্তি অথচ পায়ে,মুখে আচ্ছন্নতার বেড়ি। হাসি পায় অতসীর বিশেষত পুং জাতির এই অভব্যতায়। ভোগ,ত্যাগ মানুষের জন্মগত প্রক্রিয়া কারো পুরুষোচিত কারোর কাপুরুষোচিত। এদিক সেদিক সামনে পেছনে দেখে তবে তার প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির প্রয়োগ। স্বচ্ছতার বাতাবরণটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। সভ্যতার খাজে খাজে খুজে চলেছি সেই প্রগলভ্ সাহচর্য। সময়ের সাইরেন জানান দেয় ওঠ,জাগো,চলো। চৌর্যবৃত্তি সর্বত্র। দোকান,বাজার, লোকালয়,বেশ্যালয়,আপন,পর,অফিস, কাছারি,মাঠে,ময়দানে সর্বত্র চৌর্যবৃত্তির এক প্রতিযোগিতা চলেছে যেন। মুছে গেছে স্বচ্ছতার মুখ বিনিময় লুকোচুরি,ফিসফিস,হেয়ালী,অসংযত কথার ম্লেচ্ছ যুগ চলছে যেন। শান্তি নেই অফিসেও হাত মুখে মেরে সরিয়ে দেওয়া চলছে অস্তিত্ব।বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা,বিভেদ,আক্রোশ। এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে ,বেচে থাকতে হবে।হাটতে হবে,ছুটতে হবে,হাসতে হবে,কাদতে হবে। বাথরূমে ঢুকে স্নানটা সেরে নেয় অতসী।সামনে পিঠে পুলির মহাযোগ চতুর্দিক আমোদে মাতোয়ারা। মা ও মন প্রাণ ভরে সাজাবে প্রাণের ঠাকুরঘরের নৈবেদ্য। চলছে তারই প্রস্তুতি।
( ক্রমশঃ)
উপন্যাস / ধূসর আয়না ( পর্ব ষোলো )
মল্লিকা রায়
গতকাল রাত দশটার পর এসেছিলেন মিত্তির মশায় লম্বা লিস্ট নিয়ে,মাথায় বাজ পরেছিল অতসীর,সারারাত মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করেছে মা,মেয়ে দু'জনেই তারপর ধুম জ্বর মায়ের। দু'জনে দু'জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করেছে শুধু। শতকরা দশ টাকা হিসেবে সুদ হলে সাত বছরে এত টাকা কিভাবে হয়? দশ লাখ ? একমাত্র বাসস্থাণ হারাবার ভয়ে হাতে পায়ে ধরেও ফল হয় নি অতসীর। পা৺কা লোক মিত্তির নধর টুসটুসে কচি ডগায় ওর নজর। ছুচো মেরে হাত গন্ধ করার বদলে উঞ্ছবৃত্তির মোটা থলি বগলে গুজে তৃপ্তির পান গোজেন চোখ,মুখ বুজে। তাতে কার কি এল গেল খুব একটা তোয়াক্কা করেন না উনি। একমাত্র ঠাকুর ঘরের ওই মাটি,পাথরের ঢেলায় যখন প্রাণ জেগে ওঠে ওর দুই চোখ চিক চিক করে ওঠে,দেখতে পান পাথুরে গোপাল কটকট করে চেয়ে আছে,মাটির কালির অশ্রুতে পাপ দেখে সটান শুয়ে বসে পাচশো বার প্রায়শ্চিত্য করেন তারপর অবশ্য দরজা বন্ধ হলেই আবার যে কে সেই। খাতা খুলে বসে পরেন কার কত ধার দেনা বাকি পরেছে । সুদে মূলে প্রায় মাথায় চোট দেওয়া যাবে কি না এইসমস্ত। এমনিতে ভদ্রলোক প্রতি অমাবস্যা,পূর্ণিমায় দান,ধ্যান করেন হাত খুলে। অবশ্যই হিসেব বহির্ভূত বাড়তি পয়সায়। রেগে মেগেই অতসী বলে ফেলেছিল ," ছিঃ আপনি এত নীচ বুঝতে পারিনি বিশ্বাস করুন , ভেবেছিলাম অন্ততপক্ষে আপনি বোধয় সৎ ও নির্ভেজাল ", "এই রেখে গেলাম কাগজপত্র",উঠে দাড়ায় মিত্তির কাল বারোটায় আসব", ঘর থেকে বেড়িয়ে যান গোকূল মিত্তির। মাঝ রাত থেকে তুমুল জ্বরে প্রলাপ বকছে মা। সকালে অচেতন পরে আছে, রমেনকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না বাইরে আছে। মাথায় জল দিয়ে কোনরকম জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু দেহ অসার,প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরেছে মা। এছাড়া অতসীকে বরখাস্ত করা হয়েছে কমিটির পদ থেকেও। চুপটি করে বসে মায়ের পাশে সারারাত কাটিয়ে দেয় অতসী। মা ধীরে ধীরে বলছেন," কিছুই হয় নি,কিছু লাগবে না শুধু মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে মা "।তারাহুড়ো করে সেদ্ধ ভাত করে কোনরকম স্নান সেরে ," আমি তারাতারি ফিরে আসছি মা তোমার ওষুধগুলো আনতে হবে তাই তারাতারি চলে আসব তুমি একটু বাইরে এসে বরং বোস।মা তাকান মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে,মনে মনে বলেন,ঠাকুর যা করেন ভালোর জন্যই করেন , বুকের ভেতরের শ্বাসটা আর থাকতে চাইছে না বেড়িয়ে আসতে চাইছে খা৺চা ভেদ করে,দেওয়ালে মলিণ ফ্রেমের ছবিতে বাবার পাশে দিদির কোলে কেমন মিটিমিটি হাসছে শয়তানটা। সুন্দর কোমল মুখখানি ঘিরে কেমন একটা সহজাত সরলতা ঘিরে রয়েছে আজও। পরম শান্তির ঘুমে তলিয়ে যান ছন্দা দেবী। আলতো করে কে৺পে ওঠে ঠোট ",অতু এলি "। দু ঘন্টা পর অফিস থেকে বেড়িয়ে ওষুধ গুলো কিনে হনহন করে পা চালায় অতসী। বাড়ির সামনে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে চলছে গুঞ্জন।ও যাবার সময় পাশের বাড়ির বৌদিকে বলে গিয়েছিল," আমি তারাতারি ফিরে আসবো "। রাস্তায় বেশ উত্তেজিত লোকজনের আক্রোশের নানান মন্তব্যে বিদ্ধ অতসী স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি এই কি সেই আপনার পড়শী ,স্বজন ? যখন তকন ঘরে ফেরা,বিচার আচার,জাত ধম্ম কিছুই নেয় গো,ওসব দেবতার পাপ নাগে গো,মানো আর নাই মানো। ওপাশ থেকে একজনের টিপ্পনী ", কি ? খোব তো শালিস দিদি করতেছিলে,একন চুপ মেরে গেলে যে,বলি অমন ধম্ম জেবনে দেকিনি ম্যাগো,মা মরে পরে আচে মেয়ের যেন বে লাগিচে মরণ দশা,থু, মে নাকি শত্তু্র গো "।। ঘরে ঢুকে আর মাকে পেলনা অতসী ," আমার অন্যায় হয়ে গেছে মাগো ক্ষমা করে দাও,আমি বুঝতে পারি নি মা তুমি এত তারাতারি চলে যাবে তোমার অতুকে ছেড়ে" পাশের বাড়ির নতূন বৌ পিঠে হাত রাখে," তোমার বেড়োনো উচিৎ হয় নি ঠাকুর ঝি,মায়ের পাশে থাকা উচিৎ ছিল",। বাইরে কোলাহলের আওয়াজ শোনা যায়, পাশের বৌটি উকি দিয়ে অতসীর কানে বলে", মিত্তির মশায় এয়েচেন গো ঠাকুরঝি দলবল নে"। অতসী নিথর হয়ে পরে থাকে মায়ের পাশে। ওরে বলে দাও গে ওনার যা কর্তব্য উনি তাই করুন ,আমি আগামী কালই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। বৌটি উঠে তাই ঘটা করে শোনায় মিত্তিরকে। কেউ না জানলেও অতসী জানে এ ঘোর বিপদের দিনে মিথ্যে প্রতিদ্বন্ধীতায় গিয়ে লাভ নেই, তথাপি মিথ্যে মেনে নেওয়ার আগে চোখের জল মুছে এসে দা৺ড়ায় বারান্দায় ", মিত্তির বাবু, শুনছেন আপনাকে বলছি ,ঘরে আমার মায়ের মৃতদেহ আর এই সময় মিথ্যে সই নকল করে আপনি এসেছেন আমার ভিটে দখল করতে? মানছি ত্রিশ হাজার আপনার শোধ দিতে পারিনি তাই বলে নকল সই দেখিয়ে আপনি গৃহচ্যুত করতে চাইছেন আমাকে ? আপনি জানেন আইনের কাছে গেলে আপনি পালাবার পথ পাবেন না। তাছাড়া দেশের সমস্ত গুন্ডা,মাস্তান জড়ো করে আপনি এই সময়টা বেছে নিলেন আমার ক্ষতি করতে । আর এইজন্যই কি এতকালের ধর্ম,শিক্ষা, চিন্তা,ভাবনা দিয়ে আমরা গড়ে তুলেছিলাম এই স্বচ্ছ ধারার প্ল্যটফর্ম যেখান থেকে আজ আমায়ই বাদ দেওয়া হল ।চমৎকার গোকূল মিত্তির। ধন্য বটে আপনি"চোখ মুছে ঘরে ঢোকে।ওবাড়ি থেকে দিদিরা এসে পরেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে বাইরে রমেনকে দেখা গেল মিত্তিরের সাথে আড়ালে বেশ মশগুল আলোচনারত। যদিও একবার উঁকি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে গেছে আসতে না পারার কারণে। মায়ের শেষ যাত্রা হয়ে গিয়েছে।এ জীবন আপাতত তাকে মুক্তি দিয়েছে। ছুটি নিয়েছেন সমস্ত কর্মজগৎ থেকে।আজ ঘরের সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন ,আলো জ্বলছে না রান্নাঘর,ঠাকুরঘরের , কোন কোলাহল নেই আর.........."ওরে জলটা খেয়ে নে অতু,দ্যাখ দেকিনি মাত্র একটা রুটিতে পেট ভরে অতবড় মেয়েটার,একটু শরীরের দিকে নজর দে অতু দিনকে দিন কি ছিরি হচ্ছে তোর। আমারও তো বয়স হলো এবারে একটু নিজেরটা ভাব..........."! নাহ্ শেষ পর্যন্ত নিজেরটাই আর ভাবা হলো না মা।তুমি ঠিকই বলেছিলে ,তুমি না থাকলে সবটাই অন্ধকার মাগো একরাশ কান্না জড়ো হয় দুটো চোখ জুড়ে। এবারে বোধহয় সেই কঠিন,কঠোর দিনের সূত্রপাত যেখানে কেউ কারোর নয় শুধুই স্বার্থ আর নিষ্ঠুরতা। দিদি ওঘরে বিছানায় বাকীরা শ্মশানে,একা অতসী ভাবতে গিয়ে বিমর্ষ হয়ে পরে ,যেখানে আরেকজনের আসন পাতা ছিল এতদিন আজ হঠাৎ করে সেখানে কেমন করে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করবে ভাবতে গিয়ে অথৈ চিন্তা গ্রাস করে ওকে। ভাবনা থেমে যায় মাঝ রাতে। শ্মশাণযাত্রী সব ফিরে যায় একে একে আলো আঁধারের মধ্যবর্তী জুড়ে আরেক জন্মক্ষণ লুকিয়ে থাকা খোলস ভেদ করে প্রকাশের তাড়ণা চলছে, সেখানে হয়তো দুর্ভেদ্য আঁধার ডানা ঝাপটাচ্ছে আর ও কৈশোর, যৌবনোত্তীর্ণ করে উত্তরণের আহত অধ্যায়ে উঠে দাঁড়াবার প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছে কিংবা প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছুই চলবে তবে পদ্ধতির মৃত্যু ঘটবে। একের সুখে অন্যের বলি এ তো স্বতঃসিদ্ধ প্রবচন। এ ধারায় ধুয়ে মুছে যাবে প্রচলিত , লৌকিক ভাবধারা সৃষ্টি হবে নূতন মূর্ছণার কেউ তলিয়ে যাবে কেউ তলানি ধরে এগিয়ে আসবে ফোকাসে। যেখানে জ্ঞান মিথ্যা, শিক্ষা অন্ধ, মূর্খতার ঢাকঢোলে সভ্যতার বিসর্জন। মেয়ে মেয়ে বলে চিৎকার সার ফিরে আসে মেয়ের বাসন্তিকা সাজ। আজ এ বাড়ির শোকস্তূপে যাদের ভগ্নাবশেষ মিশে গেল তার বীজে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে আগামীর দিনক্ষণ। যারা জাগবেন তাদের অস্থি সন্ধি জুড়ে পূননির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে শুধু প্রযত্নের কিছু মূর্তি প্রয়োজন তা না হলে আমরা উঁচু হচ্ছি কথাটায় গলদ থেকে যাবে। আদতে যে নিচু হচ্ছি এ ব্যাপারটা বরং চিন্তা করুক সমাজ দপ্তর। এতেই শেষ নয় আরো কিছু বাকি ছিল এবং আছে। আদতে এইসব কর্তব্যের পেছনে অনেকেই বেশ তৎপর , দুর্বলের কাঁধ চেপে,চুলের মুঠি ধরে টেনে,হিঁচড়ে ভূত ভবিষ্যৎ খেয়ে তবেই না শান্তি। ছত্রিশ ইঞ্চি ছাতি আর বত্রিশ পাটি দাঁত এ অত্যন্ত দুর্লভ জিনিস মানুষের সাম্রাজ্য জয়ের উন্মত্তে বিভোর হয়ে চিহ্নিত করবেই করবে। ক্ষমতা ভোগের নেশা কার নেই যে যেমনভাবে যতটুক পারে। শিক্ষা, সংস্কার, রুচি মানুষ মনে রাখে না ঐ ছত্রছায়ায় ভোগ চাই মূলত ব্যবস্থার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা ব্যবস্থারই পূর্ননিয়োগ করি অজান্তে,আড়ালে সেক্ষেত্রে ঠাঁই পায় না ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া অতসীও পড়ে থাকে ঐ বন্দোবস্তের তালিকা নাম্বারে। প্রাধান্য পায় দেহবিভঙ্গে প্রত্যঙ্গের কারুকাজ। লাস্যের মোহন রুপে আবাহন বিসর্জনে নিমজ্জনের প্রাদুর্ভাব। স্বজন খুঁইয়ে এখনও স্বাভাবিক হতে পারে নি অতসী অথচ চারপাশ টা কেমন নিশ্ছিদ্র,নিরেট,তটস্থ। চেনাজানা মুখগুলোয় স্বাতন্ত্রের দাগ ছোপ,কাল যা সহজ ছিল এ মুহূর্তে সবটাই দুর্লভ। নিয়তি টেনে ভেতরে পুরছেন ত্রিজাম সমাজ বোঝাচ্ছেন এটা আমার ঘর ওটা তোমার। এটা আমার সুখ ওটা তোমার। আমরা সমাজের তোমরা দলের। যার কারণে খোওয়া যাওয়ার এক সংজ্ঞা,অভাবের এক সংজ্ঞা বিচ্ছেদের আরেক। আসলে সৃষ্টিকর্তা কখনও মহিলাদের ছাড় দেননি সুতোটা সেটে দিয়েছেন চারদেওয়ালের কাঁধে তারা শিরা হয়ে,ক্লেদ হয়ে,সিঁথী হয়ে,লেপ্টে থাকেন সমাজের ঘাড়ে,ছাড় জোটেনা মড়কেও।মাঝরাত্রের পর আঘাত হয়ে নেমে এল অতসীর কাছে পারিপার্শ্বিক জোটবদ্ধ ভাবধারা সেই প্রথম পরিচিত রমেন আর ধূরন্ধর গোকূল মিত্তিরের অজ্ঞাত রুপ। রমেনের স্বভাব সিদ্ধ তাড়ণায় অতসীকে কাছে টেনে নেওয়া তারপর ভাঙা শরীর মনে কি কি ভাবে আবর্তনের প্রলেপ বুলিয়ে দখল করে নিতে হয় স্ব ইচ্ছের চাবিকাঠি তার প্রায় সবটাই আজ অত্যন্ত স্পষ্ট। অজানা ইঙ্গিতের প্রায় সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছে রমেন।আগামী কাল তার অন্তিম স্থায়িত্বের ইতি টানা হবে। মনে মনে হাসে অতসী," রমেন আমায় এতটা বোকা ভাবলে তুমি,এতটা অবিশ্বাস ? সেদিন অবশ্য আড়ালে মিত্তিরের সাথে তোমাকে দেখেই আমি আঁচ করেছিলাম ,যাক ভালোই করলে, তোমরা কখনও খারাপ কিছু করতেই পারো না"। "অতসী তুমি ভুল বুঝছ আমায়"। "মোটেই না বরং আজই আমি একদম ঠিক বুঝেছি তোমায় । সেই অষ্টাশির চোঁয়াল ভাঙা রমেন দা আমায় টপকে গিয়ে বান্ধবীর মদমত্তে উদভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ করে যেমনটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ঠিক, অবিকল সেই রমেন দা বিশ্বাস করো আমিও আজ মুহূর্ত পরিবর্তন করে নিয়ে কেমন অষ্টাশির অতসী বিশ্বাস হয়ে গেলাম ,বিশ্বাসই হয়না"। শালিস গ্রুপের হেড চেয়ারম্যান, পাড়ার সত্যি দিদি। প্রতি বছর ক্লাশে রাঙ্ক করা অতসীর আজ অস্তিত্ব সংকটের দিন।মুছে যাবার দিন। ফুরিয়ে যাবার দিন। ক্রমশঃ ভোর হয় সেই ফুল চোর মাসির উদাত্ত গানে,"কান্দো কেনে মন...........। ভোরের আলো এসে পরেছে উঠোনে,বাগানে ,ভারাক্রান্ত শরীর, মনে ধীরে এগিয়ে আসে আয়নার খুব কাছাকাছি, অস্পষ্ট,আবছা কাচে বিস্মৃত আবছায়া।মুহূর্তে ধূসর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় ওর সর্বাঙ্গ,ঠেলা মেরে ফিরিয়ে দেয় পিছু।
( সমাপ্ত )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৯/০১/২০১৯Nice...
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৯/০১/২০১৯প্রতিদিন এক পর্ব করে দিলে ভালো হবে। আর প্যারা (অনুচ্ছেদ) থাকলে তা রক্ষা করবেন।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৯/০১/২০১৯Nice.