www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

“ প্রতিবিম্ব “ (ছোট গল্প)

মল্লিকা রায়
(ছোট গল্প)

রাত বারোটা , আরামের ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল প্রণবের, দুম্ দাম্ দরজা ঠেলার আওয়াজে ধরমর করে উঠে বসলেন বিছানায় ;চোখ মুখে আতঙ্কের রেশ, কে ? যেন ভেঙে চূড়মার হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। অস্তিত্ব, অনস্তিত্বের মাঝে কে যেন টেনে দিচ্ছে বিরাট যবনিকা, তার অবস্থাণকে অত্যন্ত ঠুনকো করে দিয়ে কে যেন অট্টহাস হেসেই চলেছে ক্রমাগত । প্রখর শীতের রাতেও সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে একসা, ভয়ার্ত এক অতীত তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে,সমস্ত মাথার ভেতরটা যন্ত্রণায় দপদপ্ করছে, যেন শরীর আর মাথার সংযোগস্থলে বিরাট এক প্রশ্নচিহ্নের শূণ্যতা ছড়িয়ে পরছে সমস্ত দেহের শিরা উপশিরায়, কি যেন ভাবলেন, সামনে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ভয়টা আরো জেঁকে বসল ,এই ঝড় জলের গভীর রাত্রে কে হতে পারে ? আর কলিং বেল্ থাকতে কেনই বা দরজা ধাক্কা দিচ্ছে ? সামনের টেবিলে অতসী আর ওর জয়েন্ট ফটোটা যেন জীবন্ত, ঐ তো কেমন হাসছে অতসী মাঝে ছোট্ট অর্ণব । ওঃ কতকাল হয়ে গেল অর্ণবকে দেখে নি প্রণব, কালই হ্যাঁ কালই যাবে টিকিট বুকিংএ দার্জিলিং হস্টেলে ,গত দুদিন আগে কথা হয়েছে ওয়টস্ অ্যপে কিন্তু মাত্র পনের মিনিট ,ভিষণ কড়া নিয়ম বোর্ডিংয়ের । অতসী.......বুকের মাঝে অথৈ তোলপাড় আজও, ....একটা দীর্ঘশ্বাস ! দুচোখের পাতা ঘন হয়ে আসে । কেমন অদ্ভুতভাবে পরিবর্তন হয় মানুষের চাওয়া পাওয়ার পরিসর । আবার দমকা হাওয়া ।

মনটা খারাপ হয়ে গেল , ফোনটা তুলে অর্ণবকে ," হ্যালো বাবান্ কেমন আছো তুমি '' ?
খুব আস্তে আস্তে ঘুমন্ত ছেলের উত্তর ," না বাপি ভালো নেই , ডান পায়ের ক্র্যাচটা ঢিলে হয়ে গেছে ,হাতেও ফোস্কা পড়েছে, তারপর অান্টি বলেছে," একটা কিডনী'তো...... তোমার খুব সাবধানে থাকতে হবে , বাপী তুমি অামায় তোমার কাছে নিয়ে চল না ,আমার দম্ বন্ধ হয়ে আসছে এখানে ,প্লিজ" ...........হঠাৎ ডিসকানেক্ট , বুঝলেন গার্ড ধরে ফেলেছে,ছেলের প্রতি একটু বেশীই দুর্বল তিনি, জন্ম থেকেই ডান্ কিডনীটা খারাপ ,বিষন্ন প্রণবের সম্পূর্ণ জগৎটা আদরের অর্ণবকে নিয়ে ।

আবার সেই ভয়ংকর শব্দটা সঙ্গে তীব্র সোঁ সোঁ আর্তনাদ । দুরুদুরু বুকে ঘরের সমস্ত আলো জ্বেলে দিলেন প্রণব, জানালার কাঁচ সামান্য ফাঁক করে চোখ রাখলেন , নিরেট অন্ধকার কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না তবে দমকা বাতাস সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি । ঠান্ডায় ও দরদর ঘামছেন তিনি ,পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগোলেন ,কান পাতলেন, নাহ্ কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না , আবার বেডরুমে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন , ঠিক্ তখনি আবার ধাক্কা...........
আতংকে নির্জীব হয়ে পড়লেন বেচারা, বৃষ্টি হয়ে চলেছে মুষলধারে , তবে কেউ কি আশ্রয়ের জন্য দরজা ধাক্কাচ্ছে , হয়তো জীবনে কলিংবেল দেখেনি , কিন্তু চোর,ডকাত,খুনিওতো হতে পারে,আজকাল কাগজ খুললে প্রায় রোজই কত ভয়ংকর সব ঘটনা চোখে পড়ে । তেমন কিছু নয়তো? নাহ্ সহযে খোলা যাবে না,যতই তুমি ধাক্কা মারো বাছাধন।
এবার কিন্তু ধাক্কার ধরণটা আরো তীব্র ও বেপরোয়া । নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপটি করে পড়ে রইলেন প্রণব দরজার পাশে।
অতসীর মুখটা টেবিল ছেড়ে চলে এসেছে তার নিঃশ্বাসের কাছে , খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে ওকে , মানসীর অসাধারণ সৌন্দর্য্যের কাছে ম্লান চরিত্র, ধ্যুৎ !! দুচোখ চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকেন কিছুক্ষণ , এবারে অতসী আর আসবে না জানি, আসলে ওর ঘন কালো রংটা যত নষ্টের গোঁড়া ,কিছুতেই মানাতে পারেন না কি করবেন..............
মানসী ! স্বপ্নের রানী ! ওর প্রাক্তণ প্রেমিকা ! সব ঠিক্ হতে হতে বেঁকে বসল বাবা , ব্যাস কেলো ! ভালো ছেলে হয়ে বসে গেলেন বিয়ের পিঁড়িতে । ওদিকে সদ্য অন্তঃস্বত্তা মানসী শোকে,দুঃখে,রাগে বিয়ে করে বসল এক অর্ধ নিম্নবিত্ত চাকুরীজিবীকে ।
বাপের কথামতো চললেন ঠিকই প্রণব তলে তলে ঘোর সম্পর্ক গড়ে তুললেন মানসীর সাথে । তখন ভরপুর মানসীর বন্ধণে অাবদ্ধ , গভীরতা নেমে যাচ্ছে সংসারের প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি পাঁজরের আলিঙ্গনে............
পরস্পরের সান্নিধ্যে উষ্ণতায় মোহাচ্ছন্ন .................।

আবার শব্দটা , চমকে উঠলেন প্রণব,ভাবলেন থানায় খবর দেবেন কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল ঝড়ের ঝাপটা হবে । কিন্তু না , কোন মানুষের কারসাজি, হঠাৎ দরজার আই হোলে চোখ রেখে ভয়ে শিউরে ওঠেন অর্ণব । শাড়ীর আঁচল , অবশ্যই মহিলা , উফ্ এই দুর্যোগের রাত্রে আটকে পড়েছে বোধয়, সামনে টেবল থেকে বোতল নিয়ে ঢক্ ঢক্ করে জল খেলেন , ধীরে দরজার কাছে গেলেন আবার পিছোলেন .....যদি কুমতলবী হয় ? যদি অঘটন ঘটে ? আবার এগোন আর পিছোন । সমুখে অতসী ক্রুর হাসি হাসছে ,মুখের কালশিটেগুলো প্রকট হয়ে উঠছে ক্রমাগত , শেষের দিনের চরম মারের খবরটা কাক পক্ষীও টের পায় নি, যাক্ আপদ বিদেয় হয়েছে, নাহ্ দরজা খুলতেই হবে আবার এগিয়ে গেলেন লকে হাত দিয়ে টান দিলেন................হুড়মুড় করে ঢুকে এল একরাশ ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির দমক্ ......হালকা আলোয় কে ? কার ছায়ামূর্তি ? আপাদমস্তক কাপড়ে ঢাকা হাতে ক্র্যাচ্ চেনার কোন উপায় নেই, মহিলা ইশারা করে যেন কি বলতে চাইছেন , অতঃপর বসে পড়লেন মেঝেয় , প্রণব অনেক কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন সোফায় বসার জন্য মহিলা নারাজ , দু'একটি কথায় জানালেন বৃষ্টি কমলেই ফিরে যাবেন কোন আতিথেয়তার প্রয়োজন নেই।
খুব অস্বস্তি হচ্ছে প্রণবের কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না, ফ্রিজ থেকে খাবার ? গরম কফি ? চা ? কিচ্ছু না ।
নীরবতা ভঙ্গ করে মহিলা মৃদু স্বরে জানালেন ভিজে গিয়েছি একদম, ওহ্ ঠিক ঠিক্। ডেক্স থেকে তোয়ালে অতসীর ব্যাবহৃত শাড়ী ,সায়া,ব্লাউজ বার করে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন । বাথরুমে ঢুকলেন মহিলা । কেমন একটা ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল মনটা, গুনগুন গেয়ে উঠলেন মনে মনে, কতকাল এঘরে নারীর পদার্পণ ঘটেনি । অাকালের সময় কুৎসিত নারীও সুন্দরী মনে হয় । টুক করে আয়নায় দেখে নিলেন নিজেকে, নাহ্ বেশ সতেজ সৌন্দর্য্য রয়েছে আজও অন্তত মানসী তাই বলে ।
টয়লেটের দরজার শব্দে সচকিত প্রণব হঠাৎ আৎকে উঠলেন , কে ?
" অতসী গো ,তোমার অতসী !! কি, চিনতে কষ্ট হচ্ছে? যদিও আজ আমার একটাই পা , দুটি চোখ নষ্ট, কিডনী নেই, পিঠের শিড়দাঁরা ভাঙা, পায়ের হাঁটুতে ভাঙণ, হাতের আঙুলে কুষ্ট, আজ আমি শুধু জড়বস্তু প্রণব,শুদ্ধু একটা জড়বস্তু , মনে পড়ে ......মনে পড়ে প্রণব পাহাড় থেকে ধাক্কা দেবার সময় তুমি কি নৃশংস হয়ে উঠেছিলে ? প্রতিদিন অামার সামনে সমস্ত সুখটুকু উজার করে দিতে মানসীকে, হায় ! আমি তখন কত্ত অসহায় মেয়ে মানুষ, একটু একটু করে প্রতিদিন খুন করছ আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আর আমি কি নিদারুন বিশ্বাসে পাশে বসিয়ে তোমায় মুড়ে রাখছি যত্নের প্রলেপে ? ছেলেটি চেষ্টা করছিল বাঁচাবার প্রাণে বাঁচল ঠিকই, ওকেও হারাতে হল একটি পা , হায় প্রণব !! মেয়েরা কি নিদারুন মূর্খ " ! খল্ খল্ হাসিতে ফেটে পড়ছে দালান কোঠা,কেঁপে উঠছে প্রণবের অন্তরের পাপাত্মা ।
হঠাৎ দপ্ করে নিভে গেল সমস্ত বাতিরা শট্ সার্কিট্ মনে হয়, হাওয়ার ঝটকায় ঠিকরে পড়ল প্রণব, কিছুক্ষণ পরে আলো জ্বলল । কিন্তু কোথায় অতসী ? নাহ্ কোথাও কোন চিহ্ন নেই ওর ,তবে কি ভ্রম ? ধীরে টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলেন প্রণব , ভেতরে প্রবেশ করলেন , দেরাজের শাড়ী,সায়া, ব্লাউজ রেকে ঝুলছে।মৃদু একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে ,এ তেল অতসী মাখত , কতদিন এই বিদেশী তেল আনতে বাড়ী ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত । হ্যাঁ ঐ তো লাল্ মেঝেয় কি সুন্দর দুটি পায়ের ছাপ । ততক্ষণে ভোর হয়েছে , কাগজের ছেলেটি কাগজ সেঁটে দিয়ে গেল দরজার লকের আংটায়।
বেসিনে দু'হাতে জলের ঝাপটায় কেটে গেল অনেকটা দুঃস্বপ্নের ঘোর । সমুখে বত্রিশ পাটি দাঁতে ঝুমটি'র প্রশ্ন," আরে রেতে কি সারা ঘরে ফুটবল খেলিছ না কি গো দাদাবাবু " ? ছড়ানো,ছিটোনো জামা,কাপড়, বিছনা,বালিশ
কি হল দাদাবাবু বলি মুখে রা' শব্দটি নেই কেনে " ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮১৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast