মুক্তি (বিজয় দিবসের গল্প) - ১ম পর্ব
পশর নদী থেকে উঠে আসা চাঁদতলা খালের পাশের দোতলা বাড়ীটি দখল করে স্থাপিত হয়েছে রাজাকারদের ক্যাম্প। এখানেই একটা ছোট্ট কামরায় বন্দী হয়ে আছে কুসুম আর তারই মত আরো কতকগুলি মেয়ে। চারিদিকে অন্ধকার, বিভীষিকা, পৈশাচিকতা ও বীভৎস নারকীয়তা। সময়ের হিসাব নেই তাদের কাছে।
কুসুমের মনে পড়ে দাদী তার নাম রেখেছিল ফারিহা – যে সব সময় সুখে থাকবে। আম্মা তাকে ডাকত কুসুম বলে। সেই থেকে তার নাম ফারিহা কুসুম। সবাই ডাকে কুসুম বলে। এতদিন তো সুখেই ছিল। কিন্তু সে সুখের বদলে জীবনে এমনভাবে গ্লানি আর লাঞ্ছনা উপস্থিত হবে কেউ কি তা জানতো কখনো?
মাত্র কয়েকমাস আগের কথা। ২৬শে মার্চ। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে শহর-নগর-গ্রাম-বন্দরে প্রতিরোধ শুরু হয়েছে পাকিস্তানী প্রশাসনের বিরূদ্ধে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কুসুম তখন খুলনার মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের ছাত্রী। অন্য সবার মত সেও দিশেহারা। কয়েকজন বান্ধবীর সাথে লঞ্চ যোগে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
সর্বত্র চোখে পড়ছে স্বাধীনতার জোয়ার। সবখানে সবুজের মাঝে নতুন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল সূর্য পতাকা পতপত করে উড়ছে। সবার চোখমুখে ভয়ের ছায়া, অনিশ্চিত ভবিষৎ। তবু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সারা দেশের মানুষ, ভয়কে তুচ্ছ করে গর্ব ভরা বুকে স্বাধীনতার সংগ্রামে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার মনেও দেশপ্রেমের জোয়ার!
গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেখে সেখানে সবার একই অবস্থা। এখানে তেমন সংবাদ পাওয়া যায় না। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক আর ভীতির চাপ। সবার ভিতরে দেশপ্রেমের ঢেউ অন্তরের অন্তস্থল হতে উৎসরিত হয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। অজানা-অনিশ্চিত ভবিষৎ - তবু বঙ্গবন্ধুর আহবান সবাইকে উদ্বোধিত করেছে। সবার হৃদয় জুড়ে আছে স্বাধীন একটি দেশ – বাংলাদেশ!
কুসুম রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতো না কখনো। এখনও এ সব নিয়ে ভাবে তাও নয়। সেই স্কুল জীবন থেকে জীবনের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে বড় হবে। কিন্তু প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু ঘটনা এসে উপস্থিত হয় যা সবাইকে নাড়া দেয় – সচেতন করে তোলে জাতিকে স্বাভাবিক নিয়মে। এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা সহজে প্রভাবিত করে সবাইকে। এও তেমনি একটা ঘটনা। স্কুল-কলেজ বন্ধ – কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। বাড়িতে এসে এমন সময়ে দিশেহারা হওয়া ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে?
রাজীব যদি এখন এখানে থাকত! মনে মনে ভাবে। রাজীব পাশের গ্রামের ছেলে – ওকে ভালোবাসে। যখন নবম শ্রেনীতে পড়ে তখন থেকেই রাজীবের সাথে কুসুমের পরিচয় ও পরে ভালোবাসা। কিভাবে যেন রাজীব তার ভাবনার একটা অংশ হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে রাজীব গিয়েছিল রাজশাহীতে। তবু চিঠির মাধ্যমে বিনিময় হত পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। সবসময় অনুভবে কুসুম খুঁজে পেত রাজীবের ছোঁয়া। কিন্তু রাজীবতো এখন আসতে পারবে না। মার্চমাসের প্রথম দিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল কি একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকবে কয়েকটা মাস। পরে বাড়িতে এসে দেখা করবে কুসুমের সাথে।
ইতিমধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে গেল মোংলা-পশর নদী দিয়ে। এই এলাকার মুক্তিকামী মানুষদের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে একদিন পাকিস্তানি নৌবাহিনী পাশের শহর মোংলা পুড়িয়ে দিল নদী হতে গানবোট থেকে শেল নিক্ষেপ করে। আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলিতে ইতিমধ্যে লুটপাট ও মানুষজন হত্যা চলছে – দলে দলে গ্রামের পর গ্রাম থেকে প্রায় সব হিন্দুরা ভারতে চলে গিয়েছে সব ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে। আর যারা মুসলমান হয়েও আওয়ামী লীগ করত তাদেরও একই অবস্থা। এরই মধ্যে একদিন খবর এল – পাশের গ্রামে ওর বান্ধবী সুপর্ণাকে ও আরো কয়েকটি হিন্দু মেয়েকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং পরের দিন তাদের বিবস্ত্র-ধর্ষিত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে খালের পাড়ে একটি ঝোঁপের পাশে। মনটা ওর ভারী হয়ে এল। এইতো সেদিন সুপর্ণা আর কুসুম একসাথে একই লঞ্চে কলেজ থেকে বাড়ী এসেছে। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক, যেই হোক, এ দেশ কি কখনো বিশেষ কোন ধর্মের মানুষের জন্য হতে পারে? এই দেশে সকলে মিলে বসবাস করে আসছে কতকাল থেকে। সে ভাবতেই পারে না সুপর্ণার মত মেয়ে ও মা-বোনদের কি দোষ। জন্মটাও তো কারো ইচ্ছামত নয় - সেও যদি আজ মুসলমান না হয়ে হিন্দুর ঘরে জন্ম নিত, তাহলে তারও একই অবস্থা হত। আর ভাবতে পারে না। শুধু যারা এইসব বর্বরতা ও পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে নিরাপরাধদের উপর, তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ঘৃনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে তার মন। কেন আল্লাহ এদের সুমতি দেয় না, কেন এরা ইসলামের আদর্শ শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত?
অবশেষে কয়েক মাস পর একদিন রাজীব এল। কুসুম খুব খুশী।
নানা কথার পর রাজীব জানালো, এতদিন সে অস্ত্রচালনা ও সংগঠন গড়ে তোলার ট্রেনিং নিচ্ছিল। তার উপর দায়িত্ব পড়েছে এই এলাকার রাজকারদের সংগঠিত করে এই ইউনিয়নে একটা রাজাকার ক্যাম্প গড়ে তোলার। পশর থেকে উঠে আসা খালের পাড়ে কার্ত্তিক মন্ডলদের ফেলে যাওয়া দোতলা বিল্ডিংটাই হবে ওদের হেডকোয়ার্টার।
কুসুমের খুশী যেন কোথায় হাওয়া হলে গেল। ওটাই তো সুপর্ণাদেরই বাড়ী! সুপর্ণাদের ঐ পরিনতির পর যারা বেঁচে ছিল তারা সবাই ভারতে চলে গিয়েছে। শুনেছে শুধু বাড়ীটা এখন খালের পাশে দাড়িয়ে আছে – কেউ সেখানে থাকে না। রাজীব তাহলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে? ও রাজাকার? আর ভাবতেই পারে না কুসুম। একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে কুসুম বলল, তুমি কেন রাজাকার হতে যাবে? রাজাকাররা, রাজাকাররাই তো আমার বান্ধবী সুপর্ণাকে ...
রাজীব বলে, ওরা হিন্দু, তাই পাকিস্তানের শত্রু, আর যারা আওয়ামী লীগ করে বা মুক্তিযুদ্ধের নামে পাকিস্তানের বিরোধিতা করছে এরা সবাই আমাদের শত্রু। এদেরকে ধংস করে ও তাড়িয়ে দিয়ে ওদের জায়গাজমি আমাদের দখলে এনে সত্যিকারের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই দেশে। এদেশ হবে পাক-পুণ্যভূমি।
রাজীব কুসুমকে বোঝাবার চেষ্টা করে। এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ভবিষৎ নেই। বিপুল ক্ষমতাবান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। এ দেশের একমাত্র ভবিষৎ পাকিস্তান! আর কয়েকটা মাস পরে সব ঠিক হয়ে আসবে এবং সকল বিরোধী শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ দেশে তখন যারা থাকবে সবাই খাঁটি পাকিস্তানী হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের পতাকা আমাদের পতাকা। “পরচমে ই সিতারা ও হিলাল/রাহবার ই তাররাক্কি ও কামাল/ তারজুমানে ই মাজি, শান এ হাল/ জান ই ইস্তিকবাল!” (চাঁদ-তারায় শোভিত এই পতাকা সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার পথ উন্মোচিত করবে, এ পতাকা অতীতের ব্যাখ্যাতা, বর্তমানের গরিমা, ও ভবিষতের অনুপ্রেরণা।)
কুসুম রাজীবকে বলে, তুমি ভুল বুঝেছ। সুন্দর সুন্দর কথা বলেই পাকভূমি বানানো যায় না। যারা আমাদের ভাষা অস্বীকার করে, আমদের শোষণ করে, অধিকার দিতে চায় না, নষ্ট করে চিরকালের সম্প্রীতি, ঘরবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়, মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে, মানুষ মারে, তুমি কেমন করে তাদের দলে যোগ দিতে পারো? আমাদের ইতিহাস তো হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সকলে মিলেমিশে থাকার ইতিহাস, আমাদের ভাষা বাংলাভাষা, আমাদের সংস্কৃতি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ময়নামতী-কপোতাক্ষ - তুমি কেমন করে তা অস্বীকার করতে পারো? যে রাষ্ট্রযন্ত্র হিংসা শিক্ষা দেয়, বর্বর নৃশংস হয়ে নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করে, কেমন করে বলতে পারো তার গরিমা আছে? যে পাকিস্তান বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় তার বর্তমান-ভবিষৎ তো কলঙ্কিত – সে কখনো আমাদের দেশ হতে পারে না, পাকিস্তান আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ বাংলাদেশ! তুমি ওপথ ত্যাগ করে সবুজের মাঝে লাল সূর্য আঁকা এই পতাকা হাতে আমাদের মাতৃভূমির জন্য সংগ্রাম কর। আমি তোমার পাশে থাকব।
কি সাহসিকতা নিয়ে কুসুম সেদিন এসব বলেছে কুসুম নিজেই জানে না। কেমন যেন একটা সাহসী স্বতঃস্ফুর্ততা তেজদীপ্ত নির্ভীক চেতনা হয়ে তার মধ্য দিয়ে তখন প্রকাশিত হয়েছে। কাকে কোন সময়ে কি সব কথা সে বলেছে সে সব দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশপ্রেমের মহিমায় জাগ্রত এক নারী, গর্বিত দেশমাতার এক গৌরবান্বিত কন্যা উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে তার প্রিয়তমকে, ভুল পথ ছেড়ে সত্যের পথে ফিরে এসে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করতে চাইছে তাকে।
কুসুম রাজীবকে ভালোবাসে। কিন্তু একজন মানুষ যে নিজের দেশকে ভালো না বেসে অন্তঃসারশূন্য ভিনদেশী কাগুজে বুলি আঁকড়ে ধরে শান্তিপ্রিয় নির্দোষ নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন চালায়, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় তাকে সে হৃদয়ে স্থান দেবে কেমন করে?
চলবে... (১/৩)
গল্পটি জোনাকি ই-পত্রিকার বিজয় দিব্স ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত...
কুসুমের মনে পড়ে দাদী তার নাম রেখেছিল ফারিহা – যে সব সময় সুখে থাকবে। আম্মা তাকে ডাকত কুসুম বলে। সেই থেকে তার নাম ফারিহা কুসুম। সবাই ডাকে কুসুম বলে। এতদিন তো সুখেই ছিল। কিন্তু সে সুখের বদলে জীবনে এমনভাবে গ্লানি আর লাঞ্ছনা উপস্থিত হবে কেউ কি তা জানতো কখনো?
মাত্র কয়েকমাস আগের কথা। ২৬শে মার্চ। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে শহর-নগর-গ্রাম-বন্দরে প্রতিরোধ শুরু হয়েছে পাকিস্তানী প্রশাসনের বিরূদ্ধে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কুসুম তখন খুলনার মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের ছাত্রী। অন্য সবার মত সেও দিশেহারা। কয়েকজন বান্ধবীর সাথে লঞ্চ যোগে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
সর্বত্র চোখে পড়ছে স্বাধীনতার জোয়ার। সবখানে সবুজের মাঝে নতুন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল সূর্য পতাকা পতপত করে উড়ছে। সবার চোখমুখে ভয়ের ছায়া, অনিশ্চিত ভবিষৎ। তবু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সারা দেশের মানুষ, ভয়কে তুচ্ছ করে গর্ব ভরা বুকে স্বাধীনতার সংগ্রামে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার মনেও দেশপ্রেমের জোয়ার!
গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেখে সেখানে সবার একই অবস্থা। এখানে তেমন সংবাদ পাওয়া যায় না। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক আর ভীতির চাপ। সবার ভিতরে দেশপ্রেমের ঢেউ অন্তরের অন্তস্থল হতে উৎসরিত হয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। অজানা-অনিশ্চিত ভবিষৎ - তবু বঙ্গবন্ধুর আহবান সবাইকে উদ্বোধিত করেছে। সবার হৃদয় জুড়ে আছে স্বাধীন একটি দেশ – বাংলাদেশ!
কুসুম রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতো না কখনো। এখনও এ সব নিয়ে ভাবে তাও নয়। সেই স্কুল জীবন থেকে জীবনের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে বড় হবে। কিন্তু প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু ঘটনা এসে উপস্থিত হয় যা সবাইকে নাড়া দেয় – সচেতন করে তোলে জাতিকে স্বাভাবিক নিয়মে। এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা সহজে প্রভাবিত করে সবাইকে। এও তেমনি একটা ঘটনা। স্কুল-কলেজ বন্ধ – কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। বাড়িতে এসে এমন সময়ে দিশেহারা হওয়া ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে?
রাজীব যদি এখন এখানে থাকত! মনে মনে ভাবে। রাজীব পাশের গ্রামের ছেলে – ওকে ভালোবাসে। যখন নবম শ্রেনীতে পড়ে তখন থেকেই রাজীবের সাথে কুসুমের পরিচয় ও পরে ভালোবাসা। কিভাবে যেন রাজীব তার ভাবনার একটা অংশ হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে রাজীব গিয়েছিল রাজশাহীতে। তবু চিঠির মাধ্যমে বিনিময় হত পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। সবসময় অনুভবে কুসুম খুঁজে পেত রাজীবের ছোঁয়া। কিন্তু রাজীবতো এখন আসতে পারবে না। মার্চমাসের প্রথম দিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল কি একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকবে কয়েকটা মাস। পরে বাড়িতে এসে দেখা করবে কুসুমের সাথে।
ইতিমধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে গেল মোংলা-পশর নদী দিয়ে। এই এলাকার মুক্তিকামী মানুষদের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে একদিন পাকিস্তানি নৌবাহিনী পাশের শহর মোংলা পুড়িয়ে দিল নদী হতে গানবোট থেকে শেল নিক্ষেপ করে। আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলিতে ইতিমধ্যে লুটপাট ও মানুষজন হত্যা চলছে – দলে দলে গ্রামের পর গ্রাম থেকে প্রায় সব হিন্দুরা ভারতে চলে গিয়েছে সব ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে। আর যারা মুসলমান হয়েও আওয়ামী লীগ করত তাদেরও একই অবস্থা। এরই মধ্যে একদিন খবর এল – পাশের গ্রামে ওর বান্ধবী সুপর্ণাকে ও আরো কয়েকটি হিন্দু মেয়েকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং পরের দিন তাদের বিবস্ত্র-ধর্ষিত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে খালের পাড়ে একটি ঝোঁপের পাশে। মনটা ওর ভারী হয়ে এল। এইতো সেদিন সুপর্ণা আর কুসুম একসাথে একই লঞ্চে কলেজ থেকে বাড়ী এসেছে। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক, যেই হোক, এ দেশ কি কখনো বিশেষ কোন ধর্মের মানুষের জন্য হতে পারে? এই দেশে সকলে মিলে বসবাস করে আসছে কতকাল থেকে। সে ভাবতেই পারে না সুপর্ণার মত মেয়ে ও মা-বোনদের কি দোষ। জন্মটাও তো কারো ইচ্ছামত নয় - সেও যদি আজ মুসলমান না হয়ে হিন্দুর ঘরে জন্ম নিত, তাহলে তারও একই অবস্থা হত। আর ভাবতে পারে না। শুধু যারা এইসব বর্বরতা ও পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে নিরাপরাধদের উপর, তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ঘৃনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে তার মন। কেন আল্লাহ এদের সুমতি দেয় না, কেন এরা ইসলামের আদর্শ শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত?
অবশেষে কয়েক মাস পর একদিন রাজীব এল। কুসুম খুব খুশী।
নানা কথার পর রাজীব জানালো, এতদিন সে অস্ত্রচালনা ও সংগঠন গড়ে তোলার ট্রেনিং নিচ্ছিল। তার উপর দায়িত্ব পড়েছে এই এলাকার রাজকারদের সংগঠিত করে এই ইউনিয়নে একটা রাজাকার ক্যাম্প গড়ে তোলার। পশর থেকে উঠে আসা খালের পাড়ে কার্ত্তিক মন্ডলদের ফেলে যাওয়া দোতলা বিল্ডিংটাই হবে ওদের হেডকোয়ার্টার।
কুসুমের খুশী যেন কোথায় হাওয়া হলে গেল। ওটাই তো সুপর্ণাদেরই বাড়ী! সুপর্ণাদের ঐ পরিনতির পর যারা বেঁচে ছিল তারা সবাই ভারতে চলে গিয়েছে। শুনেছে শুধু বাড়ীটা এখন খালের পাশে দাড়িয়ে আছে – কেউ সেখানে থাকে না। রাজীব তাহলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে? ও রাজাকার? আর ভাবতেই পারে না কুসুম। একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে কুসুম বলল, তুমি কেন রাজাকার হতে যাবে? রাজাকাররা, রাজাকাররাই তো আমার বান্ধবী সুপর্ণাকে ...
রাজীব বলে, ওরা হিন্দু, তাই পাকিস্তানের শত্রু, আর যারা আওয়ামী লীগ করে বা মুক্তিযুদ্ধের নামে পাকিস্তানের বিরোধিতা করছে এরা সবাই আমাদের শত্রু। এদেরকে ধংস করে ও তাড়িয়ে দিয়ে ওদের জায়গাজমি আমাদের দখলে এনে সত্যিকারের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই দেশে। এদেশ হবে পাক-পুণ্যভূমি।
রাজীব কুসুমকে বোঝাবার চেষ্টা করে। এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ভবিষৎ নেই। বিপুল ক্ষমতাবান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। এ দেশের একমাত্র ভবিষৎ পাকিস্তান! আর কয়েকটা মাস পরে সব ঠিক হয়ে আসবে এবং সকল বিরোধী শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ দেশে তখন যারা থাকবে সবাই খাঁটি পাকিস্তানী হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের পতাকা আমাদের পতাকা। “পরচমে ই সিতারা ও হিলাল/রাহবার ই তাররাক্কি ও কামাল/ তারজুমানে ই মাজি, শান এ হাল/ জান ই ইস্তিকবাল!” (চাঁদ-তারায় শোভিত এই পতাকা সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার পথ উন্মোচিত করবে, এ পতাকা অতীতের ব্যাখ্যাতা, বর্তমানের গরিমা, ও ভবিষতের অনুপ্রেরণা।)
কুসুম রাজীবকে বলে, তুমি ভুল বুঝেছ। সুন্দর সুন্দর কথা বলেই পাকভূমি বানানো যায় না। যারা আমাদের ভাষা অস্বীকার করে, আমদের শোষণ করে, অধিকার দিতে চায় না, নষ্ট করে চিরকালের সম্প্রীতি, ঘরবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়, মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে, মানুষ মারে, তুমি কেমন করে তাদের দলে যোগ দিতে পারো? আমাদের ইতিহাস তো হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সকলে মিলেমিশে থাকার ইতিহাস, আমাদের ভাষা বাংলাভাষা, আমাদের সংস্কৃতি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ময়নামতী-কপোতাক্ষ - তুমি কেমন করে তা অস্বীকার করতে পারো? যে রাষ্ট্রযন্ত্র হিংসা শিক্ষা দেয়, বর্বর নৃশংস হয়ে নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করে, কেমন করে বলতে পারো তার গরিমা আছে? যে পাকিস্তান বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় তার বর্তমান-ভবিষৎ তো কলঙ্কিত – সে কখনো আমাদের দেশ হতে পারে না, পাকিস্তান আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ বাংলাদেশ! তুমি ওপথ ত্যাগ করে সবুজের মাঝে লাল সূর্য আঁকা এই পতাকা হাতে আমাদের মাতৃভূমির জন্য সংগ্রাম কর। আমি তোমার পাশে থাকব।
কি সাহসিকতা নিয়ে কুসুম সেদিন এসব বলেছে কুসুম নিজেই জানে না। কেমন যেন একটা সাহসী স্বতঃস্ফুর্ততা তেজদীপ্ত নির্ভীক চেতনা হয়ে তার মধ্য দিয়ে তখন প্রকাশিত হয়েছে। কাকে কোন সময়ে কি সব কথা সে বলেছে সে সব দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশপ্রেমের মহিমায় জাগ্রত এক নারী, গর্বিত দেশমাতার এক গৌরবান্বিত কন্যা উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে তার প্রিয়তমকে, ভুল পথ ছেড়ে সত্যের পথে ফিরে এসে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করতে চাইছে তাকে।
কুসুম রাজীবকে ভালোবাসে। কিন্তু একজন মানুষ যে নিজের দেশকে ভালো না বেসে অন্তঃসারশূন্য ভিনদেশী কাগুজে বুলি আঁকড়ে ধরে শান্তিপ্রিয় নির্দোষ নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন চালায়, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় তাকে সে হৃদয়ে স্থান দেবে কেমন করে?
চলবে... (১/৩)
গল্পটি জোনাকি ই-পত্রিকার বিজয় দিব্স ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত...
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শিবশঙ্কর ০৬/০১/২০১৮ভাল লাগলো । শুভেচ্ছা রইল ।
-
কামরুজ্জামান সাদ ১৩/১২/২০১৭মুক্তিযুদ্ধের গল্পতো মনের পুঁজি..চলতে থাকুক।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৩/১২/২০১৭পড়ছি।