www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মুক্তি (বিজয় দিবসের গল্প) - ২য় পর্ব

১ম পর্বের পর ...

সেদিনই রাজীবের সাথে কুসুমের অনেক বিতর্ক হয়েছিল। রাজীব কুসুমের এই সচেতনাকে অহমিকা আর দম্ভ ভেবে খুব ক্ষেপে গেল। মেয়ে মানুষের এত ভাবনাচিন্তা কেন? ওদের স্থান তো ঘরের মধ্যে। রাজীব প্রতিজ্ঞা করে কুসুমের এই ঔদ্ধত্যের চরম শাস্তি তাকে দিতে হবে। এতদিন সে ভেবে এসেছে কুসুম রাজীবের যা মত তাই নির্বিচারে মেনে নেবে। মেয়ে মানুষের আলাদা আবার মত কি? কুসুমকে বোঝাতে না পেরে রাজীব হিংসাপরায়ন হয়ে ওঠে। প্রতিহিংসায় সে ভালোবাসার কথা ভুলে যায়। কুসুমের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, সে রাস্ট্রবিরোধী, পাকিস্তান বিরোধী।

একদিন পরিকল্পনা করে রাজীব তার রাজাকার সহযোগীদের দিয়ে অপারেশন চালায় কুসুমদের বাড়ী। কুসুমকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকারদের ক্যাম্পে। কুসুমদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। বাধা দিতে এলে ওর আব্বাকে এমন মারধর করে যে তিনি মারা যান। ঘটনার আকস্মিকতায় ও কুসুমকে হারিয় মুর্চ্ছিত হয়ে ওর আম্মাও মারা যান। কুসুম কিছুই জানতে পারে না।

এবার ক্যাম্পে আবার রাজীবের মুখোমুখী। প্রথমে তার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করে রাজীব। বলে উপরের নির্দেশে ওর বাহিনীর লোকেরা ওদের বাড়ীতে অপারেশন চালিয়েছে – রাজীব নিজে কিছু জানত না। কুসুমের পাকিস্তান বিরোধিতার কথা উপরের লোকেরা জেনেছে। তবে কুসুম পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেই সব মিটিয়ে ফেলতে পারবে। সে দিন যা হয়েছে সব ভুলে নিরাপত্তার জন্য এখন থেকে সে এই ক্যাম্পেই রাজীবের সা্থেই থাকবে।

ভয় পেলেও কুসুম ভেঙে পড়ে না। রাজীবের কথায় ওদের কাজকর্মের প্রতি ঘৃণা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। আবারও একই বিতর্ক! এবার রাজীবের ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে যায়, খুব জোরে চড় মারে কুসুমকে। কুসুম বুঝতে পারে যে রাজীব তার ভালোবাসার অন্তর অধিকার করে ছিল সে রাজীব আর বেঁচে নেই। পাশবিক নির্যাতনে রাজীব ঝাপিয়ে পড়ে কুসুমের উপর। আর্তচিৎকারেও কেউ আসে না রক্ষা করতে।

সেই থেকে কুসুমের জায়গা হয় একটি বদ্ধঘরে, আরো কয়েকটি মেয়েদের সাথে – যাদের এ ক্যাম্পের রাজাকারেরা ধরে এনেছে। প্রত্যেকেরই একটি ইতিহাস আছে, ভয়াবহ সে ইতিহাস কোনদিন বাইরে আসবে না, কেউ জানতেও পারবে না এই নির্মমতা ও পাশবিকতার কথা। মেয়েগুলি এখানে রাজীব আর তার রজাকার সহযোগীদের বিনোদনের পাত্রী, অসহায় কতকগুলি মেয়েরা দিনরাত্রির হিসেব ভুলে বন্দী হয় আছে অন্ধকার ভয়ংকর নৃশংস এই দোজখে। মুক্তির স্বপ্ন? হয়ত অলীক আশা।

কুসুমেরা এখন সব সময় আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে, যেন মুক্তিযোদ্ধারা একদিন সফল হয়ে দেশকে ও তাদেরকে উদ্ধার করে। হয়ত এই মোনাজাত ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই মুক্তির। কিন্তু এ মোনাজাত কি কারো অন্তরে প্রবেশ করে? যারা দেশের বিরুদ্ধে বিদেশীদের সেবা করে তারা যে দেশের কুলঙ্গার সন্তান সে কথা কি তারা বোঝে?

একদিন রাজীব আর ক্যাম্পে ফিরে এল না। জানা গেল কোন এক এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা সংগঠিত হচ্ছে সে খবর পেয়ে নিজেই এক দল রাজাকার নিয়ে সেখানে যায়। প্রবল সে যুদ্ধে সঙ্গীসহ সবাই মারা পড়ে – কেউ ফিরে আসতে পারেনি।

কয়েকদিন পর খবরটা জানতে পেরে কুসুমের খুব কান্না এল। রাজীব নিজের ভুল বুঝে একদিন পথে ফিরবে - এত পাশবিক অত্যাচার সত্ত্বেও সেই স্বপ্ন সে দেখত। তার সে শেষ ক্ষীণ আশাটুকুও আজ স্তিমিত হয়ে গেল, কিছুই অবশেষ রইল না আর। যারা পাপের পথে পা বাড়ায় তাদের সমাপ্তি হয়ত আল্লাহ এভাবেই নির্ধারিত করে রাখেন, নিজেকে সান্ত্বনা দেয় কুসুম।

এদিকে ক্যাম্পের রাজাকারগুলো আরো জানোয়ার ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেছে। একদিন সবাই মাতাল হয়ে একটা মেয়ের উপর এমন অত্যাচার করল যে সে রক্তাক্ত অবস্থায় সেই যে অজ্ঞান হল, আর তার প্রাণ ফিরল না। তারপরও হুড়মুড় করে সে মেয়েটার উপর আরো বেশ কয়কজন একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে ছিল কোন এক আওয়ামীলীগ নেতার মেয়ে। তাই তারা তাকে নিয়ে বেশী উন্মত্ত হয়ে উঠত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায়। রাজাকারেরা তার নাম দিয়েছিল – জয় বাংলা। শেষ পর্যন্ত যখন বুঝলো মেয়েটি মারা গিয়েছে তখন রাজাকারগুলো ধরাধরি করে তাকে পাশের খালে ফেলে দিল। খাল তার শীতল পানি দিয়ে তাকে ধুয়ে পবিত্র করেছিল, তারপর সে নদী হয়ে ভেসে গিয়েছিল সাগরে, সাগর তার সব লাঞ্ছনা ধুয়ে মুছে তাকে পুণ্যবতী করে তুলেছে – কল্পনায় কুসুম সেদিন এমনই ভেবেছিল।

আর কোনদিন কি তার মুক্তি মিলবে? নাকি, এমনিভাবে নির্যাতিত হতে হতে একদিন তারও একই দশা হবে? বিশ্বাস নেই, তবু কেমন যেন একটা আশা উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। এতদিন আল্লা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিশ্চয় একটা কিছু হবে, কবে হবে, সত্যি কিছু হবে কি? নানা প্রশ্ন জাগে তার মনে। উত্তর খুঁজে পায় না।

এদিকে যেমন ভেবেছিল পাকিস্তানী শাসকেরা ঠিক তেমন ভাবে সব কিছু হল না। সমুলে ধ্বংস হবার পরিবর্তে মুক্তিকামী মানুষদের সংগ্রাম আরো বেগবান হল। মুক্তিযুদ্ধ এখন একটা বিশেষ পর্যায় পৌঁচেছে। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকারেরা দিশেহারা। মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অঞ্চলে শক্তি বাড়াবার জন্য এই রাজাকার ক্যাম্পে বিহারীরা ও পাকিস্তানী সেনারা আসতে শুরু করল। কুসুমেরা এবার এই সব বিহারী ও পাকসেনাদের চিত্তবিনোদন এবং নারকীয় বিভীষিকা ও ব্যভিচারের শিকার হতে লাগলো খুব বেশী।

এরই মাঝে একদিন এক পাকিস্তানী মেজর এল ক্যম্প পরিদর্শনে। রাতে সে সেখানেই থাকবে। তার চিত্ত বিনোদনের জন্য কুসুমকেই উপহার হিসাবে মেজরের ঘরে রেখে এল রাজাকারেরা। ভয়ে-ভাবনায়-ঘৃণায় কুসুমের সমস্ত মনপ্রাণ বিষাদময় হয়ে উঠল। কুসুম জড়সড় হয়ে পড়েছিল ঘরের এক কোণায়। কারো দিকে বা কোনকিছুতে তার মন থাকে না এখন। প্রতিদিনই নিজেকে সে মনে করে অপমানিত এক মানবাত্মা, নিঃসহায়, বিড়িম্বিত হতভাগী। মরতে চায়, তবু মৃত্যুও তার আসে না। আবার বাঁচতেও চায় - একদিন মুক্তি আসবে সেই আশায় বুক বেঁধে থাকে, মনের কোণে আশার ক্ষীণ একটা আলো দেখতে পায় মাঝে মাঝে।

মেজর মনে হয় জানতো না কুসুমকে রাজাকারেরা ওর ঘরে রেখে গিয়েছে। হঠাৎ এককোণে কুসুমের দিকে চোখ যেতেই মেজর কি যেন ভাবল। কুসুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে ভাল করে দেখল। কুসুম বসে আছে আনত হয়ে। মেজর পশ্চিম পাকিস্তানী হলেও কিছু বাংলা শিখেছিল – সেই ভাঙা ভাঙা ভাষায় সে বলে উঠল – বোন, তুমি এখানে এলে কেমন করে? কুসুম উত্তর দেয় না। মেজর জানত না এই সব মেয়েরা এখানে আছে। তাকে ‘সারপ্রাইজ’ দিয়ে খুশী করবার জন্য রাজাকারেরা এই বিষয়ে মেজরকে কখনও কিছু জানায়ও নি।

মেজর সব বুঝতে পারে। অভয় দিয়ে কুসুমকে নাম জিজ্ঞাসা করে, বলে, তোমার কোন ভয় নেই। আমার একটি বোন আছে, দেখতে ঠিক তোমার মত। তুমি আমারই বোন।

কুসুম ভাবে এও কি সম্ভব? এই পাপপুরীতে কেউ এমন কথা ভাবতে বা বলতে পারে? সে ভাবে এসব লোকটার একটা ছলনা। কিন্তু ধীরে ধীরে নিশ্চিত হয়, বুঝতে পারে অন্তর থেকেই বলছে কথাগুলো এই মানুষটি।

কেমন যেন সাহস ফিরে পায় কুসুম। বলে, তুমি যদি সত্যি আমাকে বোনের মত মনে কর তবে ঐ মেয়েগুলি সহ আমাকে মুক্ত কর।

মেজর বলে, বোন, সে কি আমি পারব? আমার একার কতই বা ক্ষমতা। আমি উপলব্ধি করছি সেই শুরু থেকেই একটা জাতির উপর আমাদের সেনাবাহিনী কি অত্যাচারই না করে আসছে। আমি বেতনভুক্ত এক সৈনিক। আমাকে নিরুপায় হয়ে উপরের সব নির্দেশ মেনে চলতে হচ্ছে। আমিও কাপুরুষ। আমার সংসার-ছেলে-বৌ ওদের কথা ভেবে আমি বাধ্য হচ্ছি এই সব পাপ নির্দেশ মেনে চলতে। কি অধিকার আমাদের আছে তোমদের উপর এমন অন্যায় চাপিয়ে দেয়ার? সঙ্গদোষেও আমিও দোষী, তুমি আমাকে ক্ষমা করো বোন। তুমি আমার হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো যেন তোমাদের মুক্তি বাহিনীর হাতে একদিন আমার মৃত্যু হয়, সেদিন আমি কলঙ্কমুক্ত হব।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে কুসুম। অনেকদিন পর নিজেকে মানুষ মনে হয়, আপন নারীত্বের মর্যাদা সে খুঁজে পায়। বুঝতে পারে এই অন্ধকারেও দু-এক কনা স্ফুলিংগ এখনও এখানে-ওখানে আলো জ্বালে। নিজের মনে প্রশ্ন করে, সেই আলো কেন ব্যাপ্ত হয়ে এদের সবার মাঝে চেতনাদীপ্ত উজ্জ্বল কিরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে না?

কুসুমের মনে প্রশ্ন - তার এই পশ্চিমী বিদেশী ভাইটি যা বোঝে, দেশী যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারা কেন সেই সত্যটা বোঝে না? এ একটা অন্যায় যুদ্ধ, তারা কেন নিজেদের দেশের ভাষা-ইতিহাস-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতা বিসর্জণ দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে পরদেশী প্রভূদের সেবায় নিয়োজিত?

চলবে ... ২/৩

গল্পটি জোনাকি ই-পত্রিকার বিজয় দিব্স ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত...
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৯৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/১২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আবু সাইদ লিপু ১৩/১২/২০১৭
    রাজাকার নিপাত যাক
 
Quantcast