৭০ এর দশকের একটি দিন
সে বাহাত্তর সালের কথা। মানে আর কি উনিশশো-বাহাত্তরের কথাই বলছি। আমি তখন খুব ছোট…. মাত্রই তিন বছর পেরিয়ে চারে পড়েছি। থাকতাম বরানগর অঞ্চলের ময়রাডাঙ্গা রোডে। আমি তখন এতটাই ছোট, কেউ বোঝেনি যে আমারও সেই ছোট্ট জীবনে এখন বিশ্ব-খ্যাত নকসাল আন্দোলনের কিছু ঘটনার খন্ড-বিখন্ড ছবি কতটা.. আর কেমন করে ফালা ফালা হয়ে মনের কোন গহনে চাপ চাপ অন্ধকার হয়ে বসে গিয়েছে ।
দোল উৎসবের আগের দিন ন্যাড়া-পোড়ার জন্য আগুন জ্বালিয়ে শুধু পোড়াবার আনন্দ-উৎসবে যেমন ন্যাতা-কানি-বাঁশ এবং আরও কত আবর্জনা দিয়ে বিশাল বড় বড় স্তুপ বানানো হয়, ঠিক যেন তেমনই বরানগর, কাশীপুর, আলমবাজার এই সব অঞ্চলে তখন মানুষের লাশের স্তুপ রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে, এখানে-সেখানে হরদম পড়ে থাকতে দেখা যেত। বাবা, মা, মেম্মা আর ঠাকুমাকে কত বার নীচু গলায় কোথায় কার বাড়ির ছেলে সেই সব দিনের সকাল-সন্ধ্যেতে কিভাবে ‘লাশ’ হয়ে যেত তার কথা আলোচনা করতে শুনেছি। দেখেছি আমার চেয়ে বেশ অনেক বড় তখনই ১৮-২০ বছরের দাদামণি, মেজদার মত দাদাদের বিস্কুটের টিনের পিছনে ছুরি দিয়ে ফালা করে কার যেন মুখ আঁকার অভ্যাস করতে। ছোট্ট আমি, আর আমার নতুন কিছু জানা-বোঝার চিরকালের বদ-স্বভাবের দোষে দুই-একবার উঁকি-ঝুঁকি মারার চেষ্টায় খেয়েছি চোখ-রাঙ্গানি তার সাথে কড়া ধমক। আর পরের দিন সকালে দেখেছি, লুকিয়ে রাখা জায়গায় পুরু করে তখনো চ্যাটচ্যাটে আলকাতরা মাখানো টিনের পিছনে কার যেন মুখের আভাস! অনেক বড় হয়ে জেনেছি অমন করে ছুরি দিয়ে কেটে লেলিনের মুখ বের করা হত তারপর তাকে আলকাতরায় ডুবিয়ে স্টেনসিল প্রিন্টের মতো ছাপ মারা হত দেওয়ালে দেওয়ালে, রাতের গভীর অন্ধকারে, আর সেই ছবির তলায় থাকত কত সব ঝোড়ো শ্লোগান।
এই ভাবেই কাটছিল সেই সব অশান্ত দিন আর রাতগুলো। কিন্তু একদিন, হঠাৎ রাত দশটা বেজে গেল, দেখলাম, বাবা বাড়ি এল না... মা, মেম্মা, ঠাকুমা কেমন থম মেরে বসে আছে, কেউ কোন কথা বলছে না। সন্ধ্যেবেলা উনুনে আঁচ পড়ল না, রাত্তিরের রুটি হল না, মা সেদিন আমাকে ভাতের গরাস খাওয়াবার রোজকার যুদ্ধে সামিল হল না.. শুধু দিল এক গ্লাস দুধ। ভোর রাতে নাকি আর একটু পরে, এখন আর ঠিক মনে নেই, ঘুম ভেঙ্গে শুনি কেদারজেঠু আমার মেম্মা আর ঠাকুমাকে কিছু একটা বলছে, আর খানিক পরেই দেখলাম বাবার বেশ কিছু বই দড়ি বেঁধে ওপরে দোতলায় তুলে দেওয়া হল। বাড়িতে আমি তখন একমাত্র বাচ্চা, একান্নবর্তী পরিবারে বাকিরা সব বড় বড় দাদা-দিদি আর কাকু। আমাকে পরদিন দুপুর নাগাদ বলা হল, যতক্ষণ না বড়রা বেরিয়ে আসতে বলছে ততক্ষণ যেন ঠাকুমার খাটের তলায় একদম চুপ করে বসে থাকতে। বেশ অনেকক্ষণ পরে শুনলাম অনেকগুলো গট গট ভারী জুতোর আওয়াজ, আর তারপর শুধু দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি পা ঠাকুমার ঘরে ঘোরাঘুরি করছে, যাদের জুতোয় অনেকগুলো এদিকে-ওদিকে বকলেস দেওয়া আর বেল্ট বাঁধা, আর মোজার ভিতরে প্যান্ট গোঁজা...।
অনেক দিন পর মাকে যখন জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছি, সেদিন অমন করে কারা এসেছিল, কেন এসেছিল.. প্রথমে মা অত ছোট বয়সে সেই দিনের কথা মনে আছে দেখে খুব অবাক হলেও বলেছিল, যে সেদিন কেদারজেঠু না থাকলে বাবা... হয়ত... পুলিশদের..! তিনিই ঠাকুমাকে বলেছিলেন, “বৌদিকে বলুন শান্ত থাকতে, কোন কথা না বলতে, আর বইগুলো এই আমি দড়ি এনেছি, এই দড়ি দিয়ে বেঁধে দিন, আমি রান্নাঘরে পিছনদিকের জানলা দিয়ে লম্বা দড়ি ঝুলিয়ে ওগুলো দোতলায় টেনে তুলে নিচ্ছি, আমি তো কংগ্রেস করি, আপনারা চিন্তা করবেন না, আমি জানি আমার ঘরে সার্চ হবে না।”
আপনাদের আজ বলছি, সেই বইএর পাঁজার দুটি বই আজও আমার কাছে আছে, একটা হল ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ আর একটা হল ‘অশান্ত কাম্বোডিয়া’।
দোল উৎসবের আগের দিন ন্যাড়া-পোড়ার জন্য আগুন জ্বালিয়ে শুধু পোড়াবার আনন্দ-উৎসবে যেমন ন্যাতা-কানি-বাঁশ এবং আরও কত আবর্জনা দিয়ে বিশাল বড় বড় স্তুপ বানানো হয়, ঠিক যেন তেমনই বরানগর, কাশীপুর, আলমবাজার এই সব অঞ্চলে তখন মানুষের লাশের স্তুপ রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে, এখানে-সেখানে হরদম পড়ে থাকতে দেখা যেত। বাবা, মা, মেম্মা আর ঠাকুমাকে কত বার নীচু গলায় কোথায় কার বাড়ির ছেলে সেই সব দিনের সকাল-সন্ধ্যেতে কিভাবে ‘লাশ’ হয়ে যেত তার কথা আলোচনা করতে শুনেছি। দেখেছি আমার চেয়ে বেশ অনেক বড় তখনই ১৮-২০ বছরের দাদামণি, মেজদার মত দাদাদের বিস্কুটের টিনের পিছনে ছুরি দিয়ে ফালা করে কার যেন মুখ আঁকার অভ্যাস করতে। ছোট্ট আমি, আর আমার নতুন কিছু জানা-বোঝার চিরকালের বদ-স্বভাবের দোষে দুই-একবার উঁকি-ঝুঁকি মারার চেষ্টায় খেয়েছি চোখ-রাঙ্গানি তার সাথে কড়া ধমক। আর পরের দিন সকালে দেখেছি, লুকিয়ে রাখা জায়গায় পুরু করে তখনো চ্যাটচ্যাটে আলকাতরা মাখানো টিনের পিছনে কার যেন মুখের আভাস! অনেক বড় হয়ে জেনেছি অমন করে ছুরি দিয়ে কেটে লেলিনের মুখ বের করা হত তারপর তাকে আলকাতরায় ডুবিয়ে স্টেনসিল প্রিন্টের মতো ছাপ মারা হত দেওয়ালে দেওয়ালে, রাতের গভীর অন্ধকারে, আর সেই ছবির তলায় থাকত কত সব ঝোড়ো শ্লোগান।
এই ভাবেই কাটছিল সেই সব অশান্ত দিন আর রাতগুলো। কিন্তু একদিন, হঠাৎ রাত দশটা বেজে গেল, দেখলাম, বাবা বাড়ি এল না... মা, মেম্মা, ঠাকুমা কেমন থম মেরে বসে আছে, কেউ কোন কথা বলছে না। সন্ধ্যেবেলা উনুনে আঁচ পড়ল না, রাত্তিরের রুটি হল না, মা সেদিন আমাকে ভাতের গরাস খাওয়াবার রোজকার যুদ্ধে সামিল হল না.. শুধু দিল এক গ্লাস দুধ। ভোর রাতে নাকি আর একটু পরে, এখন আর ঠিক মনে নেই, ঘুম ভেঙ্গে শুনি কেদারজেঠু আমার মেম্মা আর ঠাকুমাকে কিছু একটা বলছে, আর খানিক পরেই দেখলাম বাবার বেশ কিছু বই দড়ি বেঁধে ওপরে দোতলায় তুলে দেওয়া হল। বাড়িতে আমি তখন একমাত্র বাচ্চা, একান্নবর্তী পরিবারে বাকিরা সব বড় বড় দাদা-দিদি আর কাকু। আমাকে পরদিন দুপুর নাগাদ বলা হল, যতক্ষণ না বড়রা বেরিয়ে আসতে বলছে ততক্ষণ যেন ঠাকুমার খাটের তলায় একদম চুপ করে বসে থাকতে। বেশ অনেকক্ষণ পরে শুনলাম অনেকগুলো গট গট ভারী জুতোর আওয়াজ, আর তারপর শুধু দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি পা ঠাকুমার ঘরে ঘোরাঘুরি করছে, যাদের জুতোয় অনেকগুলো এদিকে-ওদিকে বকলেস দেওয়া আর বেল্ট বাঁধা, আর মোজার ভিতরে প্যান্ট গোঁজা...।
অনেক দিন পর মাকে যখন জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছি, সেদিন অমন করে কারা এসেছিল, কেন এসেছিল.. প্রথমে মা অত ছোট বয়সে সেই দিনের কথা মনে আছে দেখে খুব অবাক হলেও বলেছিল, যে সেদিন কেদারজেঠু না থাকলে বাবা... হয়ত... পুলিশদের..! তিনিই ঠাকুমাকে বলেছিলেন, “বৌদিকে বলুন শান্ত থাকতে, কোন কথা না বলতে, আর বইগুলো এই আমি দড়ি এনেছি, এই দড়ি দিয়ে বেঁধে দিন, আমি রান্নাঘরে পিছনদিকের জানলা দিয়ে লম্বা দড়ি ঝুলিয়ে ওগুলো দোতলায় টেনে তুলে নিচ্ছি, আমি তো কংগ্রেস করি, আপনারা চিন্তা করবেন না, আমি জানি আমার ঘরে সার্চ হবে না।”
আপনাদের আজ বলছি, সেই বইএর পাঁজার দুটি বই আজও আমার কাছে আছে, একটা হল ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ আর একটা হল ‘অশান্ত কাম্বোডিয়া’।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
চিরন্তন ০৫/০২/২০২১বাঃ
-
মুহাম্মাদ রাসেল উদ্দীন ০৫/০৯/২০১৬বাহ্
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১০/০৭/২০১৬ভালো লাগলো দি।