রক্তপিপাসা
একটা সাঁকো দিয়ে নদী পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।এপারের মানুষ ওপারে যায় বেশী।কারণ, ওপারে বড় একটা বাজার ''উদলাশাহ বাজার''। ওখানে যাবতীয় সব ধরনের মালামাল পাওয়া যায় । গাঙটা অনেক বড় । বর্ষার সময় দানবের মতো ফুঁসলে উঠে। স্রোতের চাওয়া দেখলে মনে হবে এক্ষুণি খেয়ে ফেলবে।নৌকা দৌড় হয় মাঝে মাঝে । এপারের লোকজনের টাকাকড়ি বেশী নেই । একটা বাজারও ঠিকমত বসাতে পারেনি । ওপারের লোকজন মানে হলো সভ্য জগত । ওরা থাবড়িয়ে মানুষের তথা নিম্নশ্রেণীর মানুষের কান লাল করে। ওরা প্রভূত সম্পত্তির অধীকারী।
সগীর মিয়ার ছেলে জাহাংগীর । তাদের ঘর মাখনে ভরপুর নেই । তথা কিছুটা অভাবগ্রস্ত।সগীর মিয়ার শ্বশুরবাড়ী ঐপারে।ওখানে জাহাংগীর একটা স্কুলে পড়ে।
যেদিন বাড়ীতে আসে সেদিন সগীর মিয়া তাড়াতাড়ি কাজ সারে । পুত্রকে নিয়ে বসে পাটি বিছিয়ে । তারপর কত গল্প শোনাতে থাকে। কত নীতিকথা আর সত্যাদেশ। সগীর মিয়া জিগ্যেস করেন ,''তরে কই জানস এই গাঙ তৈয়ার হইছে কিভাবে। জাহাংগীর মাথা নাড়ায় ,'না বাবা মুই জানমু কি কইরে?''এই তো তোর সমস্যা , যেকোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে । গাছের পাতা থেইক্যা শুরু করে বনের বাঘ পর্যন্ত তোর ধারণা রাখতে অইব। এহন শোন,এই গাঙ সেই গাঙ ছিলনা । এইডা একটা ছোট খাল ছিল ,এখানে এক বড় রুইমাছ ছিল । ওই রুইমাছ আসলে রুইমাছ না । তেনারা এসে ভর করেছিলেন তার উপর। সেইকালে তেনাদের আকার আসমানে মাথা আর জমিনে পাও ছিলো । আইচ্ছা , ধীরে ধীরে রুইমাছ বড় হইতে থাকে । বড় অইতাছে , অইতাছে। এই গাঙ ছিলনা বলেই একটা গ্রাম ছিলো ।এখন গাটা দুইভাগে বিভক্ত । সেখানে ধনী গরীব মিলায়ে ছিলো। তারপর ঐ রুই না পাংগাস আকারে ঐ পুরো খালের সমান হলো। সেইদিন কি ভুমিকম্প আর তুফান ।তারপর আস্তে আস্তে এই বিরাট গাঙটির পয়দা হয়।জাহাংগীর শুনে হাসতে থাকে খিলখিল করে । তারপর বলে,'না বাবা গাঙ সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিকভাবে,পৃথিবীর জন্মের সময়।
''চুপ মার গরু কোথাকার । আমি নিজের কানে মুর দাদার কানে শুনছি ।''একটু সময় চুপ থেকে ভয়ে ভয়ে জাহাংগীর জিগ্যেস করে '' আইচ্ছা আব্বা আপনি কি আপনার দাদারে জিগাইছিলেন যে ,উনি ওইখানে ছিলেন কী না ?'' 'হ হ জিগাইছি । তয় তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , নারে সগীর আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি ।আমার বড়দাদা দেখেছিলেন খোদার কসম।
তারপর শোন , আবার আরম্ভ করলেন সগীর মিয়া । ''আমাদের এই গ্রাম গরীব কেন জানিস ? গাঙ জন্মাইবার পর সেখানে জুতাপেটা খাওয়া সব দৈত্য-দানব দখল নিল। তারা দুইপারের লোকজনদের বলল,সোনাদানা, গহনাপাতি দিতে। নাহলে আস্তে আস্তে পাড় ভেঙে সারা ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেবে। গাঙ পয়দা হওয়ার সময় ধাক্কামাক্কা খেয়ে এলাকার খানসাহেব ঐপারে ছিটকে পড়লেন।ফলে ঐপারের লোকজন সোনাদানা দিল । আমাদের এখান থেকে কেউ দিতে পারলনা । ফলে ওরা ধনী হইয়া গেল। আর আমরা হইলাম ফকিরের পুত ।
একটা কালো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সগীর মিয়া ।এহন ওই পারের মানুষের সামনে থুথু ফেললে পরনের লুংগি খুইল্যা মাথায় পাগড়ী বান্দায়।কত জঘন্য কামটা।জাহাংগীর বলে,' বাবা তুমি লেহাপড়া কর নাই , লেহাপড়া করতে মন চাইতনা?'
''তেনাদের ভয়ে লেখাপড়া করতে পারি নাই''
''বাবা তেনারা কারা?''
ফিসফিসিয়ে সগীর মিয়া বললেন ,' ভূত-দেউ ,দানব '' ওরা খুব ভয়ংকর ছিলো ।রাইতের বেলা আমরা দু-একজন লন্ঠন জ্বালাইয়া গুটিশুটি মেরে মক্তবে যাইতাম। কখনো কারো পায়খানায় ধরছে , তেনাদের উপর সারলেতো আসমান জমিন সাদা অইয়া যায়।আসতাগফিরুল্লা । থাবড়া খাইয়া বেহুশ। পরদিন আবার সেই পায়খানায় গিয়ে আছাড়।কারণ,লন্ঠনের আলোয় বুঝতে পারিনি গতকাল কামটা কোথায় সারছি।এসব শয়তানী আর ইজ্জতের ভয়ে লেহাপড়া করতে পারি নাই। তুমি পড় বাজান । তুমি পড়তে থাক বাবা ইজ্জতের ভয় কি!
'' ওরা রক্তের সাথে মিশ্যা গেলে , মানুষ পাগল হইয়া যায় । মানে ছাগলের মতো আচরণ করে বুঝছ। তারপর সেই পাগল কখনো খিলখিল করে হাসে ,কখনো চিৎপটাং হয়ে শুয়ে সূর্যের দিকে চাইয়া থাহে।কখনো মহিলা দেখলে নাচ শুরু করে দেয়,হাত ধরার চেষ্টা করে।
সব চাইতে জঘন্য যে ব্যাফারটা হেইডা অইলো মাথা কামাইয়া রাখে। তারপর সেখানে বাগানের তাজা সরিষার তেল দেয় । রাস্তায় বার হইলে রইদের আলোয় চিকচিক করতে থাকে । কেউ মুখ দিলে আয়নার মতো নিজের চেরা দেখতে পারবে।
জাহাংগীরের ছুটির সময় শেষ হয়ে যায়।বেশিদিন বাড়ীতে থাকেনি । এবার সে সমাপনী পরীক্ষা দিবে।ক্লাস ফাইভে। তাই স্কুল গ্রীষ্মের ছুটির পর খুলতেই চলে যায় ।আর কোনদিন আসবে কে জানে।বাপ সগীর মিয়া ছেলেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । অনেক বড় অইবা পুত।
ছেলেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলে । একমাত্র ছেলে , তাও আবার নিজের কাছে নেই।পরের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করে । নিজের দুইটাকা রুজি যা হয় তা দিয়ে মায়ের হাতে রাঁধা শুটকিও উপাদেয়।আরেক বাড়িতে কি ভক্ষণ করে খোদাই জানেন।
সে যায় । মন দিয়ে পড়াশোনা করে। তার কোনো চিন্তা নাই। শুধু একটা চিন্তা । চিন্তাটা হলো তার মাছ মারাটা নিয়ে । মামার সাথে গাঙে বিকেলে অনেক সময় যায় মাছ ধরতে। অনেকসময় বড় মাছ ধরা পড়ে । তার মামা একটু পাগলা টাইপের। বড় কোনো মাছ ধরা পড়লে কতক্ষণ এক নিমেষে তাকিয়ে থাকেন।মাঝে মাঝে চোখ বড় হয় । মাঝে মাঝে চোখ সরু হয়।তিনি দেখেন কোনটার মাঝে দানব আত্না লুকিয়ে আছে।তাদের পাশের ঘরের মোল্লা মিয়া রাত দেড়টার সময় গাঙ থেকে প্রকান্ড এক বোয়াল মাছ ধরে এনেছিল । খুব ভালো করে ভূনা করে সবাই বোয়াল মাছের তরকারী খেল।পরে দুই ঘন্টার মধ্যে সব কটা মরে সাফ । ভাগ্যিস মতিন মিয়া ঘরে ছিলেন না( জাহাংগীরের মামা) । কি একটা কাজের জন্য বাইরে গেছিলেন । পাশের ঘরের ওরা এক পেয়ালা তরকারী দিয়েছিলো মতিন মিয়াকে । উনার বউ যত্ন করে স্বামীর জন্য ঢেকে রেখে দিয়েছিলো ।
তারপর মরণের সংবাদ শুনে মতিন মিয়া তরকারী খান নাই । তাই মাছ পরীক্ষা করেন , দেখে ভয়ানক মনে না হলে সেই মাছ বাড়ীতে এনে ভাজি করে মামু-ভাগনা মিলে খান । দিন গড়িয়ে যায় এভাবেই । কোনো বাধা-ক্ষেপণাস্ত্র নাই ।
গাঙের উপর সাঁকোটা পাকা করে নির্মাণের জন্য সরকার বরাবর আবেদন করা হয়েছে । শেষ পর্যন্ত পাকা হয় । পাকা হওয়ার পর লোকজনের সুবিধা আরও বেড়ে যায় । কিন্তু পাকা করার আগে গাঙ দানবেরা ৫০ টা মানুষের কল্লা মানে মাথা চেয়েছে ।
তখন দিকে দিকে বেরিয়ে পড়ল আপহরণকারী । ৫০ টা কল্লা যোগাড় হয়ে যায় । মতিন মিয়া তার ভাগ্নেকে নিরাপদে থাকতে বলেন । অবশেষে পরিপূর্ণ হয় ব্রীজটি । নতুন ব্রিজ নতুন যাত্রা । গাড়ী- ঘোড়াও চলতে থাকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ।
বর্ষার সময় নদী ফুলে ফেঁপে উঠে । খরস্রোতা হয়,দানবের মতো হয়ে উঠে । ক্ষুরধার তেজে মাহফিল গড়ে বন্যার ।
এইসময় সর্বপ্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান হবে । এই ব্রীজ দিয়েই তারা যাবে । নতুন ব্রীজের উপর দিয়ে এই প্রথম বরযাত্রী যাবে। সমুদ্রদানবদের উৎসাহ বাড়তে থাকে ।
সগীর মিয়ার আত্নীয় হলো বরপক্ষ।জাহাংগীরকে তাড়াতাড়ি আনায় বাড়ীতে।অনেকদিন পরে গিয়ে ভাত-মাংস খাওয়া যাবে।
বিয়ের দিন সগীর আর তার পুত্র দুজনেই সেজেগুজে তৈরী হয় ।
গাড়ী যখন ব্রীজের উপর আসে তখন সমুদ্রদানবেরা ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকে খরস্রোতা গাঙের মাঝে। এত সুন্দর হয়ে মানুষ সেজেগুজে কোথায় যায়। এরা এত সুন্দর কেন? এদের স্থান পৃথিবীতে নয় । এরা আমাদের এখানে , এই বিশাল জলরাশির মধ্যে আসেনা কেন ? এই নির্জীব মানুষেরা হৈ-হুল্লোড় করছে আর আমাদের মাঝে স্রোতের তান্ডবলীলা।
বরযাত্রী কনে নিয়ে আসার সময় দানবদের তো আরো মাথা খারাপ । ভুঁরু কুঁচকে তাকায়, এত সুন্দর কনে!
গাড়ীগুলো ব্রীজের মাঝখানে এসে পড়েছে । ফুঁসে উঠছে জলরাশি।হঠাৎ হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ে । প্রচন্ড শক্তিতে টেনে নিয়ে আসছে সমুদ্রদানবেরা মানুষগুলোকে। পশুর মতো শব্দ আর বিকট চিৎকার । জলের গতি যেন বেড়ে যায়। শানানো তলোয়ারের মতো গাড়ী আর মানুষগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিল। সবাই জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। গাড়ীতে সগীর আর জাহাংগীরও ছিল । তারা বিকট চিৎকার করছে। বর কনেসহ সবাই মারা যায় । কিন্তু বেঁচে যায় সগীর আর তার ছেলে জাহাংগীর। সংবাদকর্মীরা এসে সংবাদ লিখতে থাকেন । এত মানুষ জলের গভীরে তলিয়ে গেল । যারা সাঁতার জানে তারাও । এই দুইজন বাঁচল কীভাবে!
এরপর থেকে ব্রীজটির নাম হয় '' বরযাত্রীর ব্রীজ''
তো যে কথা বলছিলাম , তারপরে শুরু হয় তদন্ত। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় সগীর এবং তার ছেলে জাহাংগীর । ওরা বেঁচে ফিরল কিভাবে। সগীরকে জিগ্যেস করা হলো।
সগীর প্রথমে কিছু বললনা । পরে জাহাংগীরকে জিগ্যেস করা হলো । জাহাংগীর বলল, ''বাজানের জন্যই মুই বাঁচিছি।''
বাজানকে জিগ্যেস করা হলো আবার। দুইহাত একসাথে করে , আস্তে আস্তে বললেন সগীর মিয়া, '' আজ্ঞে সমুদ্রদানব-দৈত্যের বরকতে বাঁচিছি। আল্লাহ সহায় । কল্লা সংগ্রহ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হইছিলো। অনেক কষ্টে কল্লা সংগ্রহ করিয়া কর্তৃপক্ষকে খুশি করছি এর লগে সমুদ্রবাসীরাও আমার উপর খুশি । তাদের খোরাক যুগাইছি। তাই নেক নজর দিছে , আমার আর আমার বাইচচার উপর। সবই পরিশ্রমের ফল । পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি , আমার জাহাংগীর আমারে এইডা শিখাইছে। সংসারের টানাপোড়েনে টাকার লোভে অনেক মাইনষের কল্লা সংগ্রহ করি ।এই জন্যি বাঁইচা আছি। বাকি আল্লাহ ভরসা , কি কস জাহাংগীর ?
'' হ বাজান , ঠিক কইছেন '' ।
সগীর মিয়ার ছেলে জাহাংগীর । তাদের ঘর মাখনে ভরপুর নেই । তথা কিছুটা অভাবগ্রস্ত।সগীর মিয়ার শ্বশুরবাড়ী ঐপারে।ওখানে জাহাংগীর একটা স্কুলে পড়ে।
যেদিন বাড়ীতে আসে সেদিন সগীর মিয়া তাড়াতাড়ি কাজ সারে । পুত্রকে নিয়ে বসে পাটি বিছিয়ে । তারপর কত গল্প শোনাতে থাকে। কত নীতিকথা আর সত্যাদেশ। সগীর মিয়া জিগ্যেস করেন ,''তরে কই জানস এই গাঙ তৈয়ার হইছে কিভাবে। জাহাংগীর মাথা নাড়ায় ,'না বাবা মুই জানমু কি কইরে?''এই তো তোর সমস্যা , যেকোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে । গাছের পাতা থেইক্যা শুরু করে বনের বাঘ পর্যন্ত তোর ধারণা রাখতে অইব। এহন শোন,এই গাঙ সেই গাঙ ছিলনা । এইডা একটা ছোট খাল ছিল ,এখানে এক বড় রুইমাছ ছিল । ওই রুইমাছ আসলে রুইমাছ না । তেনারা এসে ভর করেছিলেন তার উপর। সেইকালে তেনাদের আকার আসমানে মাথা আর জমিনে পাও ছিলো । আইচ্ছা , ধীরে ধীরে রুইমাছ বড় হইতে থাকে । বড় অইতাছে , অইতাছে। এই গাঙ ছিলনা বলেই একটা গ্রাম ছিলো ।এখন গাটা দুইভাগে বিভক্ত । সেখানে ধনী গরীব মিলায়ে ছিলো। তারপর ঐ রুই না পাংগাস আকারে ঐ পুরো খালের সমান হলো। সেইদিন কি ভুমিকম্প আর তুফান ।তারপর আস্তে আস্তে এই বিরাট গাঙটির পয়দা হয়।জাহাংগীর শুনে হাসতে থাকে খিলখিল করে । তারপর বলে,'না বাবা গাঙ সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিকভাবে,পৃথিবীর জন্মের সময়।
''চুপ মার গরু কোথাকার । আমি নিজের কানে মুর দাদার কানে শুনছি ।''একটু সময় চুপ থেকে ভয়ে ভয়ে জাহাংগীর জিগ্যেস করে '' আইচ্ছা আব্বা আপনি কি আপনার দাদারে জিগাইছিলেন যে ,উনি ওইখানে ছিলেন কী না ?'' 'হ হ জিগাইছি । তয় তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , নারে সগীর আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি ।আমার বড়দাদা দেখেছিলেন খোদার কসম।
তারপর শোন , আবার আরম্ভ করলেন সগীর মিয়া । ''আমাদের এই গ্রাম গরীব কেন জানিস ? গাঙ জন্মাইবার পর সেখানে জুতাপেটা খাওয়া সব দৈত্য-দানব দখল নিল। তারা দুইপারের লোকজনদের বলল,সোনাদানা, গহনাপাতি দিতে। নাহলে আস্তে আস্তে পাড় ভেঙে সারা ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেবে। গাঙ পয়দা হওয়ার সময় ধাক্কামাক্কা খেয়ে এলাকার খানসাহেব ঐপারে ছিটকে পড়লেন।ফলে ঐপারের লোকজন সোনাদানা দিল । আমাদের এখান থেকে কেউ দিতে পারলনা । ফলে ওরা ধনী হইয়া গেল। আর আমরা হইলাম ফকিরের পুত ।
একটা কালো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সগীর মিয়া ।এহন ওই পারের মানুষের সামনে থুথু ফেললে পরনের লুংগি খুইল্যা মাথায় পাগড়ী বান্দায়।কত জঘন্য কামটা।জাহাংগীর বলে,' বাবা তুমি লেহাপড়া কর নাই , লেহাপড়া করতে মন চাইতনা?'
''তেনাদের ভয়ে লেখাপড়া করতে পারি নাই''
''বাবা তেনারা কারা?''
ফিসফিসিয়ে সগীর মিয়া বললেন ,' ভূত-দেউ ,দানব '' ওরা খুব ভয়ংকর ছিলো ।রাইতের বেলা আমরা দু-একজন লন্ঠন জ্বালাইয়া গুটিশুটি মেরে মক্তবে যাইতাম। কখনো কারো পায়খানায় ধরছে , তেনাদের উপর সারলেতো আসমান জমিন সাদা অইয়া যায়।আসতাগফিরুল্লা । থাবড়া খাইয়া বেহুশ। পরদিন আবার সেই পায়খানায় গিয়ে আছাড়।কারণ,লন্ঠনের আলোয় বুঝতে পারিনি গতকাল কামটা কোথায় সারছি।এসব শয়তানী আর ইজ্জতের ভয়ে লেহাপড়া করতে পারি নাই। তুমি পড় বাজান । তুমি পড়তে থাক বাবা ইজ্জতের ভয় কি!
'' ওরা রক্তের সাথে মিশ্যা গেলে , মানুষ পাগল হইয়া যায় । মানে ছাগলের মতো আচরণ করে বুঝছ। তারপর সেই পাগল কখনো খিলখিল করে হাসে ,কখনো চিৎপটাং হয়ে শুয়ে সূর্যের দিকে চাইয়া থাহে।কখনো মহিলা দেখলে নাচ শুরু করে দেয়,হাত ধরার চেষ্টা করে।
সব চাইতে জঘন্য যে ব্যাফারটা হেইডা অইলো মাথা কামাইয়া রাখে। তারপর সেখানে বাগানের তাজা সরিষার তেল দেয় । রাস্তায় বার হইলে রইদের আলোয় চিকচিক করতে থাকে । কেউ মুখ দিলে আয়নার মতো নিজের চেরা দেখতে পারবে।
জাহাংগীরের ছুটির সময় শেষ হয়ে যায়।বেশিদিন বাড়ীতে থাকেনি । এবার সে সমাপনী পরীক্ষা দিবে।ক্লাস ফাইভে। তাই স্কুল গ্রীষ্মের ছুটির পর খুলতেই চলে যায় ।আর কোনদিন আসবে কে জানে।বাপ সগীর মিয়া ছেলেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । অনেক বড় অইবা পুত।
ছেলেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলে । একমাত্র ছেলে , তাও আবার নিজের কাছে নেই।পরের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করে । নিজের দুইটাকা রুজি যা হয় তা দিয়ে মায়ের হাতে রাঁধা শুটকিও উপাদেয়।আরেক বাড়িতে কি ভক্ষণ করে খোদাই জানেন।
সে যায় । মন দিয়ে পড়াশোনা করে। তার কোনো চিন্তা নাই। শুধু একটা চিন্তা । চিন্তাটা হলো তার মাছ মারাটা নিয়ে । মামার সাথে গাঙে বিকেলে অনেক সময় যায় মাছ ধরতে। অনেকসময় বড় মাছ ধরা পড়ে । তার মামা একটু পাগলা টাইপের। বড় কোনো মাছ ধরা পড়লে কতক্ষণ এক নিমেষে তাকিয়ে থাকেন।মাঝে মাঝে চোখ বড় হয় । মাঝে মাঝে চোখ সরু হয়।তিনি দেখেন কোনটার মাঝে দানব আত্না লুকিয়ে আছে।তাদের পাশের ঘরের মোল্লা মিয়া রাত দেড়টার সময় গাঙ থেকে প্রকান্ড এক বোয়াল মাছ ধরে এনেছিল । খুব ভালো করে ভূনা করে সবাই বোয়াল মাছের তরকারী খেল।পরে দুই ঘন্টার মধ্যে সব কটা মরে সাফ । ভাগ্যিস মতিন মিয়া ঘরে ছিলেন না( জাহাংগীরের মামা) । কি একটা কাজের জন্য বাইরে গেছিলেন । পাশের ঘরের ওরা এক পেয়ালা তরকারী দিয়েছিলো মতিন মিয়াকে । উনার বউ যত্ন করে স্বামীর জন্য ঢেকে রেখে দিয়েছিলো ।
তারপর মরণের সংবাদ শুনে মতিন মিয়া তরকারী খান নাই । তাই মাছ পরীক্ষা করেন , দেখে ভয়ানক মনে না হলে সেই মাছ বাড়ীতে এনে ভাজি করে মামু-ভাগনা মিলে খান । দিন গড়িয়ে যায় এভাবেই । কোনো বাধা-ক্ষেপণাস্ত্র নাই ।
গাঙের উপর সাঁকোটা পাকা করে নির্মাণের জন্য সরকার বরাবর আবেদন করা হয়েছে । শেষ পর্যন্ত পাকা হয় । পাকা হওয়ার পর লোকজনের সুবিধা আরও বেড়ে যায় । কিন্তু পাকা করার আগে গাঙ দানবেরা ৫০ টা মানুষের কল্লা মানে মাথা চেয়েছে ।
তখন দিকে দিকে বেরিয়ে পড়ল আপহরণকারী । ৫০ টা কল্লা যোগাড় হয়ে যায় । মতিন মিয়া তার ভাগ্নেকে নিরাপদে থাকতে বলেন । অবশেষে পরিপূর্ণ হয় ব্রীজটি । নতুন ব্রিজ নতুন যাত্রা । গাড়ী- ঘোড়াও চলতে থাকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ।
বর্ষার সময় নদী ফুলে ফেঁপে উঠে । খরস্রোতা হয়,দানবের মতো হয়ে উঠে । ক্ষুরধার তেজে মাহফিল গড়ে বন্যার ।
এইসময় সর্বপ্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান হবে । এই ব্রীজ দিয়েই তারা যাবে । নতুন ব্রীজের উপর দিয়ে এই প্রথম বরযাত্রী যাবে। সমুদ্রদানবদের উৎসাহ বাড়তে থাকে ।
সগীর মিয়ার আত্নীয় হলো বরপক্ষ।জাহাংগীরকে তাড়াতাড়ি আনায় বাড়ীতে।অনেকদিন পরে গিয়ে ভাত-মাংস খাওয়া যাবে।
বিয়ের দিন সগীর আর তার পুত্র দুজনেই সেজেগুজে তৈরী হয় ।
গাড়ী যখন ব্রীজের উপর আসে তখন সমুদ্রদানবেরা ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকে খরস্রোতা গাঙের মাঝে। এত সুন্দর হয়ে মানুষ সেজেগুজে কোথায় যায়। এরা এত সুন্দর কেন? এদের স্থান পৃথিবীতে নয় । এরা আমাদের এখানে , এই বিশাল জলরাশির মধ্যে আসেনা কেন ? এই নির্জীব মানুষেরা হৈ-হুল্লোড় করছে আর আমাদের মাঝে স্রোতের তান্ডবলীলা।
বরযাত্রী কনে নিয়ে আসার সময় দানবদের তো আরো মাথা খারাপ । ভুঁরু কুঁচকে তাকায়, এত সুন্দর কনে!
গাড়ীগুলো ব্রীজের মাঝখানে এসে পড়েছে । ফুঁসে উঠছে জলরাশি।হঠাৎ হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ে । প্রচন্ড শক্তিতে টেনে নিয়ে আসছে সমুদ্রদানবেরা মানুষগুলোকে। পশুর মতো শব্দ আর বিকট চিৎকার । জলের গতি যেন বেড়ে যায়। শানানো তলোয়ারের মতো গাড়ী আর মানুষগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিল। সবাই জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। গাড়ীতে সগীর আর জাহাংগীরও ছিল । তারা বিকট চিৎকার করছে। বর কনেসহ সবাই মারা যায় । কিন্তু বেঁচে যায় সগীর আর তার ছেলে জাহাংগীর। সংবাদকর্মীরা এসে সংবাদ লিখতে থাকেন । এত মানুষ জলের গভীরে তলিয়ে গেল । যারা সাঁতার জানে তারাও । এই দুইজন বাঁচল কীভাবে!
এরপর থেকে ব্রীজটির নাম হয় '' বরযাত্রীর ব্রীজ''
তো যে কথা বলছিলাম , তারপরে শুরু হয় তদন্ত। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় সগীর এবং তার ছেলে জাহাংগীর । ওরা বেঁচে ফিরল কিভাবে। সগীরকে জিগ্যেস করা হলো।
সগীর প্রথমে কিছু বললনা । পরে জাহাংগীরকে জিগ্যেস করা হলো । জাহাংগীর বলল, ''বাজানের জন্যই মুই বাঁচিছি।''
বাজানকে জিগ্যেস করা হলো আবার। দুইহাত একসাথে করে , আস্তে আস্তে বললেন সগীর মিয়া, '' আজ্ঞে সমুদ্রদানব-দৈত্যের বরকতে বাঁচিছি। আল্লাহ সহায় । কল্লা সংগ্রহ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হইছিলো। অনেক কষ্টে কল্লা সংগ্রহ করিয়া কর্তৃপক্ষকে খুশি করছি এর লগে সমুদ্রবাসীরাও আমার উপর খুশি । তাদের খোরাক যুগাইছি। তাই নেক নজর দিছে , আমার আর আমার বাইচচার উপর। সবই পরিশ্রমের ফল । পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি , আমার জাহাংগীর আমারে এইডা শিখাইছে। সংসারের টানাপোড়েনে টাকার লোভে অনেক মাইনষের কল্লা সংগ্রহ করি ।এই জন্যি বাঁইচা আছি। বাকি আল্লাহ ভরসা , কি কস জাহাংগীর ?
'' হ বাজান , ঠিক কইছেন '' ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোহন দাস (বিষাক্ত কবি) ২৮/০১/২০২০সুন্দর
-
ফয়জুল মহী ২৬/০১/২০২০মনোরম লেখা।