প্রেতাত্মা
সেদিন রাতেও বৃষ্টি ছিল!!
অন্ধকার ভরা রাত। মাঝে মধ্যে দু’একটা অদ্ভুত শব্দ ‘সঙ্গে আলোকিত ঝিলিক। আমার রুমটা একেবারে পূর্ব দিকে খালি বাগানের সারির দিকটায়। তখন বিদ্যুৎ ছিলনা। তাই বিজলীর চমকাণীতে রুমে জানালা ভেয়ে কিছুটা অস্পষ্ট আলো আসে-‘নয়তো সারা ঘর ঘোড় অন্ধকার। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল একটা, আমি যে রুমটায় আছি সে রুমটা অনবরত ‘হাসনা-হেনা’ ফুলের ঘ্রাণ আসে। আর রাত্রিবেলা একটু ফুলের ঘ্রাণটা বেশীই আসে!
বৃষ্টির শব্দ আমার ভাল লাগে ‘কিন্তু, তার সাথে যে থপাশ থপাশ বিকট শব্দ ‘এটা শুনলে আমার বিষণ ভয় লাগে। এমনিতে আমার আবার ঘুম কম। আজ রাতে কেন জানি ভয়-ভয় লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি না। নিজেকে খুব চেষ্টায় প্রায় ঘুম পাড়িয়ে নিয়েছিলাম ‘ঠিক অই সময় দরজা ‘ওপেনের শব্দ!
বালিশ থেকে মাথাটা কিছুটা উচু করে কানটা দরজার দিকে দিলাম, আর কোন শব্দ হল না। সামান্য কিছুক্ষণ পর আমার নাকে ভেসে এল কোন মেয়ে মানুষের শরীরের গন্ধ! ঠিক বুঝতে পারলাম না; আমরা যে বাড়ীটায় আছি সেখানে আমরা পাঁচ বন্ধু বাদে কেউ নেই! কিন্তু এখানে মেয়ে মানুষ আসবে কোত্থেকে?
আমরা যে বাড়ীটায় আছি সেটা একটা বাংলো। পরিবারের সবাই লন্ডনে থাকে। পুরোটা বাড়ী জুড়ে একজন মাত্র পাহাড়াদার। আমরা এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। জায়গাটার নাম ঠিক খেয়াল হচ্ছে না। কিন্তু জায়গাটা সিলেট জেলারই অন্তর্ভুক্ত। আমরা হোটেলে থাকার সিদ্ধান্তেই এখানে ঘুরতে আসি। এই বাড়ীর কেয়ার টেকারের সাথে পরিচয় ঘটলে তিনি আমাদের এখানে থাকার কথা বলেন। আমরা রাজি হলাম এই জন্যে যে হোটেলের তুলনায় একটা বাংলোতে কয়েকটা রাত কাটানো খুবই ন্যাচারাল।
এই বাড়ীটা বাংলো হলেও বিশাল বড়। বাড়ীটায় কয়টা রুম আছে ঠিক জানি না; তবে, অনেকগুলো রুম আছে দেখেই বুঝা যায় ,আর সে জন্যেই আমরা পাঁচ বন্ধু যার যার রুমে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ততক্ষণে আমি শুয়া থেকে উঠে দরজার কাছে গেলাম। দেখি দরজা খোলা। ভাবলাম দরজা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম; আর সে জন্যে বাতাসের আঘাতে হয়তো দরজায় শব্দ হয়েছে। দরজাটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
নিজের ভয়কে সামলিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার শুয়ে থাকা খাট‘টা কেঁপে উঠল! আমি তৎক্ষনাৎ শুয়া থেকে উঠে খাটের একপাশে বসে পড়লাম আর প্রচন্ড ভয়ের স্বরে গলা কেঁপে কেঁপে বললাম,কে?
অপর পাশ থেকে কোন সারাশব্দ পেলাম না। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এল। বাম বুকের বিতরটা ধুপ ধুপ করে কাঁপতে শুরু করল। চোখগুলো ইঁদুরের ছানার মত দৌড়াতে লাগল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এখন কি করব! টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ হল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। মনে-মনে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বন্ধুদের চেচিয়ে ডাকি; কিন্তু আমার মুখ দিয়ে ভয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে যাব ঠিক অই অবস্থায় কোন মেয়ে মানুষের নরম কোমল হাত আমার ডান হাতে চেঁপে ধড়েছে বলে মনে হলে ‘আমি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ি!!
পরদিন সকাল দশটার দিকে বন্ধুরা আমার রুমে এসে দেখে আমি প্রায় নগ্ন অবস্থায় ফ্লুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি। তারা প্রথমে বিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল বলে জানাল। কিন্তু আমি কয়েকটি ডাক দেয়ার সাথে সাথেই উঠে পড়ায় তাদের ভয় কিছুটা কমে এল। কিন্তু আমার এ অস্থার কথা তারা জানতে চাইলে আমি এর কিছুই জানি না বলে জানালাম। তারা কয়েকবার এক অপরের মুখ দেখা-দেখি করল!
আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম আমার দরজাটা তো বন্ধ ছিল ‘তোরা ভিতরে এলি কিভাবে?
তারা বলল,‘দরজা খোলায় ছিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে যে,‘আমি দ্বিতীয়বার দরজাটা নিজ হাতেই দিয়েছিলাম। তাদের কাছে এ কথাও প্রকাশ করলাম না!
একসময় আমার কাছে এ বাংলো বাড়ীটা রহস্যময় হয়ে উঠল। এ রহস্যের রহস্য উৎঘাটন না করে আমি এ বাড়ী ছাড়ছিনা বলে পণও করলাম!
পরদিন রাতটাকে আমার বিষণ ভয়ের রাত বলে মনে হল। কিন্তু এই রাতে কোন বৃষ্টি ছিল না। সম্ভবত এ রাতটি ছিল চৌদ্দ তারিখের পূর্ণিমার চাঁদের রাত্রি। বাড়ীটি যদিও ঝুপ-ঝাপে ভড়া বাগানী বাড়ী । কিন্তু আজ এ রাতটি বাড়ীটার চার পাশকে প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত করে তোলেছে। কোথাও খোলা জানালা, কোথাও দরজার ফাক দিয়ে পূর্ণিমার আলো ঘরে আসছে। এই আলোয় কার ছায়া যেন আমার চোখে ভাসছে বার-বার! মাঝে মধ্যে আমার কানে খুব ‘সতর্ক হাটা পায়ের শব্দ আসছে। আমি লক্ষ্য করে শুনছি আর সেই ছায়াটার সন্ধানে কখনো বারান্দায়, কখনো কোন রুমে, কখনো বাড়ীর বাহির দিকটায় ঘুড়ে-ঘুড়ে খুঁজছি।
আমি যখন বাড়ীর পূর্ব পাশে আমার থাকার রুমটার পেছন দিকে হাটছিলাম,‘ঠিক তখন জানালার গ্লাস দিয়ে আমার থাকা রুমের ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে সরু লম্বা একটা ছায়া দেখতে পেলাম। ছায়াটা কোন মেয়ে মানুষের মনে হল। মনে হওয়ার কারণ হল একটায়, ছায়ার এক পাশে আমি চুলের ছায়াও স্পষ্ট দেখতে পেলাম! আমি তৎক্ষনাৎ আমার রুমের দিকে দ্রুত ছোটে গেলাম। রুমের ভিতর প্রবেশ করলাম। রুমে দাড়িয়ে চারপাশ ঘুড়ে-ঘুড়ে তাকালাম; কৈই, কিছুই দেখতে পেলাম না।
একসময় চিৎকার শুনতে পেলাম। চিৎকার শুনে রুম থেকে বের হয়ে আমার বন্ধুদের এক এক করে যে যার রুম থেকে বের হতে দেখলাম। এতো বিকট শব্দে চিৎকার হয়েছে, যার কারণে সবাই শুনতে পেল। কিন্তু সবাই রুম থেকে বের হলেও আমাদের বন্ধু রাজীব বের হলনা। আমরা এক অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলাম। কেউ কোন কথা না বলে রাজীবের রুমের দিকে ছোটে গেলাম।
ও যে রুমটায় থাকে সে রুমটার দরজার সামনে উপড়ে সোনালী অক্ষরে লেখা আছে ‘শাপলা’। প্রত্যেকটা দরজার সামনেই এক একটা ফুলের নাম লেখা আছে। আর রাজীব শাপলা নামের রুমটায় থাকে। আমরা শাপলা নামের রুমটার দিকে ছোটে গেলাম। ওর রুমটা একটু ভিতরের দিকে। ও নিজেই ঐ রুমটা বেছে নিয়েছে। বেছে নেয়ার কারণ একটায়; ও সারা রাত মোবাইলে মেয়েদের সাথে কথা বলে।
তার রুমে প্রবেশ করে তাকে দেখতে পেলাম না। রুমের চার পাশে তাকালাম। একজন বাথরুমের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দেখল তা ভিতর দিক থেকে বন্ধ করা। দরজায় অনেক্ষণ ঠক ঠক শব্দ করলাম; কোন সারাশব্দ পেলাম না। সবার দিকে এক একবার করে তাকালাম। ভয়ে সবার শরীর আর কপাল থেকে ঘাম ঝড়ছে। একসময় দরজা ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। দরজা ভেঙ্গে যে প্রথমে ভিতরে ঢুকল সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ফিরে এল; পরে আমরা ভিতরে গেলাম; দেখলা,‘সারা বাথরুমে রক্তের সিটকা পড়ে আছে। রাজীব নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। একেবারে নিকট থেকে দেখলাম ওর ঠোঁট দুটি এখনো কাঁপছে আর চোখের পাতাগুলো ঝিম ঝিম করছে। বুঝা গেল তার জ্ঞান এখনো আছে। তাকে দ্রুত স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে বাড়ীর কেয়ার-টেকারের সাথে কথা বললাম। তাকে আমার ভয় পাওয়ার ঘঠনা সহ সব কিছু খোলে বললাম; সে কোন কিছুই বলতে চাইছিল না। আমি তাকে পুলিশের ভয় দেখালাম। শেষমেসে তার মুখ থেকে যা বেরুল তার মূল কথা নিচে দেয়া হলঃ
“আমি এই বাড়ীতে আছি প্রায় বিশ বছর যাবৎ। আমার বাড়ী এই এলাকাতেই। পড়াশোনাও আছে বেশ। সংসার জীবনে আমি বিশ্বাসী নয়, তাই জীবনে বিয়ে করিনি। বাড়ীর মালিক আমায় খুব বিশ্বাস আর অনেক ভালবাসেন। সেই জন্যে তিনি আমাকে এই বাড়ীর দায়িত্ব্য দিয়ে রেখেছেন। আমি এই বাড়ীতে একা থাকি। মাঝে মধ্যে খুব খারাপ লাগে।
এই আশপাশের জায়গাটা দেখতে খুব সুন্দর বলে দূর থেকে অনেক লোক এখানে ঘুরতে আসে। তাদের সাথে আমার প্রায়ই পরিচয় ঘটে, যেমনি আপনাদের সাথে ঘটেছে। এই বাড়ীর সাহেবরা অনেকদিন পর পর আসেন। অনেককেই আমি এই বাংলোতে থাকতে দেয়। থাকতে দেয়াটা কোন টাকা পাওয়ার জন্যে নয় বরং এই বাড়ীটা যেন মানুষের আবাদ থাকে সেই জন্যে। ঠিক সে আশায় এক তরুণ তরূনীকে প্রায় দুই বছর আগে থাকতে দিয়েছিলাম। তারা ছিল স্বামী-স্ত্রী। অবশ্য পড়ে জানতে পারলাম তারা স্বামী-স্ত্রী নয়। এক অপরকে ভালবেসে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে। আমি তাদের সব কথা জানতে পেড়েও তাদেরকে থাকতে দিয়েছিলাম ‘তাদের ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারা বেশ কিছুদিনই এখানে ছিল। প্রায়ই তাদের মাঝে ঝগড়া হত। আবার কিছুক্ষণ পরেই মিলে মিশে যেত। হঠাৎ দু ‘তিন দিন ধরে তাদের সাড়াশব্দ না পেয়ে তাদের রুমে গেলাম। তারা থাকত ‘হাসনা হেনা’ নামের রুমটায়; যে রুমটায় স্যার আপনি আছেন। সে রুমটায় গিয়ে আমি এতো ভয় পেলাম যা জন্মের পর আর এতো ভয় পায়নি। আমি দেখলাম তরুনী ওলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে বিছানার উপড়। তার মুখে আর কানের মধ্যে রক্ত লেগে আছে। বিছানার উপরও খানিকটা রক্ত জমে ছিল। আশপাশে বড় বড় মাছি ব্যান ব্যান করতেছিল; মনে হল তাকে গলা চেপে মারা হয়েছে। সেই যুবককে অনেক খুজলাম; কিন্তু সেই যুবককে আর পেলাম না। আমার খুব ভয় আর টেনশন হল, এখন আমি এই যুবতীর লাশ নিয়ে কি করব! আরও দুই তিনদিন এই রুমটা তালা মেরে রেখেছিলাম। আশপাশের জায়গাতে বেশ গন্ধ ছুটে গিয়েছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করব! একবার ভাবলাম পুলিশকে জানায়। আবার ভাবলাম পুলিশ তো সুবিধার লোক না! আমার বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। শেষে আমার না জানি ফাসি হয়ে যায়!
অবশেষে এক সময় ভাবলাম ভয় পেয়ে আর কি হবে? নিজেই অই তরনীর লাশ গোপনে কোথাও নিয়ে কবর দিয়ে ফেলি, খেল খতম; ঠিক অই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলোর রুমে গিয়ে দেখি সেই যুবতীর লাশ নেই। তখন আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। আশপাশের কোথাও এক ফোটা রক্তের দাগও নেই; যেখানে দূর্গন্ধ থাকার কথা সেখানে ‘হাসনা হেনা’ ফুলের ঘ্রাণ বেরুতে লাগল। সারাঘর ঘ্রাণে মুহিত হয়ে গেল। অথচ এই বাংলো বাগান বাড়ীর দশ কিলোমিটার অবদি কোন ‘হাসনা হেনা’ ফুলের গাছ নেই! আমি অভাক হলাম এই ফুলের ঘ্রাণ কোত্থেকে আসছে ‘আর তার কারণই বা কি?
আমি আরও অভাক হলাম সেই যুবতীর লাশ কি হল? কে অই যুবতীর লাশ সরিয়ে নিল? অই যুবক-কি তাহলে আবার এসেছিল? কিন্তু রুমতো তালা মারানো ছিল। তিনদিন পর তালা মারা অবস্থায় পেলাম। এর রহস্যটা কি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আজও এই রহস্যের দ্বার খোঁজে পেলাম না।।
অন্ধকার ভরা রাত। মাঝে মধ্যে দু’একটা অদ্ভুত শব্দ ‘সঙ্গে আলোকিত ঝিলিক। আমার রুমটা একেবারে পূর্ব দিকে খালি বাগানের সারির দিকটায়। তখন বিদ্যুৎ ছিলনা। তাই বিজলীর চমকাণীতে রুমে জানালা ভেয়ে কিছুটা অস্পষ্ট আলো আসে-‘নয়তো সারা ঘর ঘোড় অন্ধকার। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল একটা, আমি যে রুমটায় আছি সে রুমটা অনবরত ‘হাসনা-হেনা’ ফুলের ঘ্রাণ আসে। আর রাত্রিবেলা একটু ফুলের ঘ্রাণটা বেশীই আসে!
বৃষ্টির শব্দ আমার ভাল লাগে ‘কিন্তু, তার সাথে যে থপাশ থপাশ বিকট শব্দ ‘এটা শুনলে আমার বিষণ ভয় লাগে। এমনিতে আমার আবার ঘুম কম। আজ রাতে কেন জানি ভয়-ভয় লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি না। নিজেকে খুব চেষ্টায় প্রায় ঘুম পাড়িয়ে নিয়েছিলাম ‘ঠিক অই সময় দরজা ‘ওপেনের শব্দ!
বালিশ থেকে মাথাটা কিছুটা উচু করে কানটা দরজার দিকে দিলাম, আর কোন শব্দ হল না। সামান্য কিছুক্ষণ পর আমার নাকে ভেসে এল কোন মেয়ে মানুষের শরীরের গন্ধ! ঠিক বুঝতে পারলাম না; আমরা যে বাড়ীটায় আছি সেখানে আমরা পাঁচ বন্ধু বাদে কেউ নেই! কিন্তু এখানে মেয়ে মানুষ আসবে কোত্থেকে?
আমরা যে বাড়ীটায় আছি সেটা একটা বাংলো। পরিবারের সবাই লন্ডনে থাকে। পুরোটা বাড়ী জুড়ে একজন মাত্র পাহাড়াদার। আমরা এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। জায়গাটার নাম ঠিক খেয়াল হচ্ছে না। কিন্তু জায়গাটা সিলেট জেলারই অন্তর্ভুক্ত। আমরা হোটেলে থাকার সিদ্ধান্তেই এখানে ঘুরতে আসি। এই বাড়ীর কেয়ার টেকারের সাথে পরিচয় ঘটলে তিনি আমাদের এখানে থাকার কথা বলেন। আমরা রাজি হলাম এই জন্যে যে হোটেলের তুলনায় একটা বাংলোতে কয়েকটা রাত কাটানো খুবই ন্যাচারাল।
এই বাড়ীটা বাংলো হলেও বিশাল বড়। বাড়ীটায় কয়টা রুম আছে ঠিক জানি না; তবে, অনেকগুলো রুম আছে দেখেই বুঝা যায় ,আর সে জন্যেই আমরা পাঁচ বন্ধু যার যার রুমে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ততক্ষণে আমি শুয়া থেকে উঠে দরজার কাছে গেলাম। দেখি দরজা খোলা। ভাবলাম দরজা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম; আর সে জন্যে বাতাসের আঘাতে হয়তো দরজায় শব্দ হয়েছে। দরজাটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
নিজের ভয়কে সামলিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার শুয়ে থাকা খাট‘টা কেঁপে উঠল! আমি তৎক্ষনাৎ শুয়া থেকে উঠে খাটের একপাশে বসে পড়লাম আর প্রচন্ড ভয়ের স্বরে গলা কেঁপে কেঁপে বললাম,কে?
অপর পাশ থেকে কোন সারাশব্দ পেলাম না। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এল। বাম বুকের বিতরটা ধুপ ধুপ করে কাঁপতে শুরু করল। চোখগুলো ইঁদুরের ছানার মত দৌড়াতে লাগল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এখন কি করব! টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ হল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। মনে-মনে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বন্ধুদের চেচিয়ে ডাকি; কিন্তু আমার মুখ দিয়ে ভয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে যাব ঠিক অই অবস্থায় কোন মেয়ে মানুষের নরম কোমল হাত আমার ডান হাতে চেঁপে ধড়েছে বলে মনে হলে ‘আমি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ি!!
পরদিন সকাল দশটার দিকে বন্ধুরা আমার রুমে এসে দেখে আমি প্রায় নগ্ন অবস্থায় ফ্লুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি। তারা প্রথমে বিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল বলে জানাল। কিন্তু আমি কয়েকটি ডাক দেয়ার সাথে সাথেই উঠে পড়ায় তাদের ভয় কিছুটা কমে এল। কিন্তু আমার এ অস্থার কথা তারা জানতে চাইলে আমি এর কিছুই জানি না বলে জানালাম। তারা কয়েকবার এক অপরের মুখ দেখা-দেখি করল!
আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম আমার দরজাটা তো বন্ধ ছিল ‘তোরা ভিতরে এলি কিভাবে?
তারা বলল,‘দরজা খোলায় ছিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে যে,‘আমি দ্বিতীয়বার দরজাটা নিজ হাতেই দিয়েছিলাম। তাদের কাছে এ কথাও প্রকাশ করলাম না!
একসময় আমার কাছে এ বাংলো বাড়ীটা রহস্যময় হয়ে উঠল। এ রহস্যের রহস্য উৎঘাটন না করে আমি এ বাড়ী ছাড়ছিনা বলে পণও করলাম!
পরদিন রাতটাকে আমার বিষণ ভয়ের রাত বলে মনে হল। কিন্তু এই রাতে কোন বৃষ্টি ছিল না। সম্ভবত এ রাতটি ছিল চৌদ্দ তারিখের পূর্ণিমার চাঁদের রাত্রি। বাড়ীটি যদিও ঝুপ-ঝাপে ভড়া বাগানী বাড়ী । কিন্তু আজ এ রাতটি বাড়ীটার চার পাশকে প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত করে তোলেছে। কোথাও খোলা জানালা, কোথাও দরজার ফাক দিয়ে পূর্ণিমার আলো ঘরে আসছে। এই আলোয় কার ছায়া যেন আমার চোখে ভাসছে বার-বার! মাঝে মধ্যে আমার কানে খুব ‘সতর্ক হাটা পায়ের শব্দ আসছে। আমি লক্ষ্য করে শুনছি আর সেই ছায়াটার সন্ধানে কখনো বারান্দায়, কখনো কোন রুমে, কখনো বাড়ীর বাহির দিকটায় ঘুড়ে-ঘুড়ে খুঁজছি।
আমি যখন বাড়ীর পূর্ব পাশে আমার থাকার রুমটার পেছন দিকে হাটছিলাম,‘ঠিক তখন জানালার গ্লাস দিয়ে আমার থাকা রুমের ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে সরু লম্বা একটা ছায়া দেখতে পেলাম। ছায়াটা কোন মেয়ে মানুষের মনে হল। মনে হওয়ার কারণ হল একটায়, ছায়ার এক পাশে আমি চুলের ছায়াও স্পষ্ট দেখতে পেলাম! আমি তৎক্ষনাৎ আমার রুমের দিকে দ্রুত ছোটে গেলাম। রুমের ভিতর প্রবেশ করলাম। রুমে দাড়িয়ে চারপাশ ঘুড়ে-ঘুড়ে তাকালাম; কৈই, কিছুই দেখতে পেলাম না।
একসময় চিৎকার শুনতে পেলাম। চিৎকার শুনে রুম থেকে বের হয়ে আমার বন্ধুদের এক এক করে যে যার রুম থেকে বের হতে দেখলাম। এতো বিকট শব্দে চিৎকার হয়েছে, যার কারণে সবাই শুনতে পেল। কিন্তু সবাই রুম থেকে বের হলেও আমাদের বন্ধু রাজীব বের হলনা। আমরা এক অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলাম। কেউ কোন কথা না বলে রাজীবের রুমের দিকে ছোটে গেলাম।
ও যে রুমটায় থাকে সে রুমটার দরজার সামনে উপড়ে সোনালী অক্ষরে লেখা আছে ‘শাপলা’। প্রত্যেকটা দরজার সামনেই এক একটা ফুলের নাম লেখা আছে। আর রাজীব শাপলা নামের রুমটায় থাকে। আমরা শাপলা নামের রুমটার দিকে ছোটে গেলাম। ওর রুমটা একটু ভিতরের দিকে। ও নিজেই ঐ রুমটা বেছে নিয়েছে। বেছে নেয়ার কারণ একটায়; ও সারা রাত মোবাইলে মেয়েদের সাথে কথা বলে।
তার রুমে প্রবেশ করে তাকে দেখতে পেলাম না। রুমের চার পাশে তাকালাম। একজন বাথরুমের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দেখল তা ভিতর দিক থেকে বন্ধ করা। দরজায় অনেক্ষণ ঠক ঠক শব্দ করলাম; কোন সারাশব্দ পেলাম না। সবার দিকে এক একবার করে তাকালাম। ভয়ে সবার শরীর আর কপাল থেকে ঘাম ঝড়ছে। একসময় দরজা ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। দরজা ভেঙ্গে যে প্রথমে ভিতরে ঢুকল সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ফিরে এল; পরে আমরা ভিতরে গেলাম; দেখলা,‘সারা বাথরুমে রক্তের সিটকা পড়ে আছে। রাজীব নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। একেবারে নিকট থেকে দেখলাম ওর ঠোঁট দুটি এখনো কাঁপছে আর চোখের পাতাগুলো ঝিম ঝিম করছে। বুঝা গেল তার জ্ঞান এখনো আছে। তাকে দ্রুত স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে বাড়ীর কেয়ার-টেকারের সাথে কথা বললাম। তাকে আমার ভয় পাওয়ার ঘঠনা সহ সব কিছু খোলে বললাম; সে কোন কিছুই বলতে চাইছিল না। আমি তাকে পুলিশের ভয় দেখালাম। শেষমেসে তার মুখ থেকে যা বেরুল তার মূল কথা নিচে দেয়া হলঃ
“আমি এই বাড়ীতে আছি প্রায় বিশ বছর যাবৎ। আমার বাড়ী এই এলাকাতেই। পড়াশোনাও আছে বেশ। সংসার জীবনে আমি বিশ্বাসী নয়, তাই জীবনে বিয়ে করিনি। বাড়ীর মালিক আমায় খুব বিশ্বাস আর অনেক ভালবাসেন। সেই জন্যে তিনি আমাকে এই বাড়ীর দায়িত্ব্য দিয়ে রেখেছেন। আমি এই বাড়ীতে একা থাকি। মাঝে মধ্যে খুব খারাপ লাগে।
এই আশপাশের জায়গাটা দেখতে খুব সুন্দর বলে দূর থেকে অনেক লোক এখানে ঘুরতে আসে। তাদের সাথে আমার প্রায়ই পরিচয় ঘটে, যেমনি আপনাদের সাথে ঘটেছে। এই বাড়ীর সাহেবরা অনেকদিন পর পর আসেন। অনেককেই আমি এই বাংলোতে থাকতে দেয়। থাকতে দেয়াটা কোন টাকা পাওয়ার জন্যে নয় বরং এই বাড়ীটা যেন মানুষের আবাদ থাকে সেই জন্যে। ঠিক সে আশায় এক তরুণ তরূনীকে প্রায় দুই বছর আগে থাকতে দিয়েছিলাম। তারা ছিল স্বামী-স্ত্রী। অবশ্য পড়ে জানতে পারলাম তারা স্বামী-স্ত্রী নয়। এক অপরকে ভালবেসে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে। আমি তাদের সব কথা জানতে পেড়েও তাদেরকে থাকতে দিয়েছিলাম ‘তাদের ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারা বেশ কিছুদিনই এখানে ছিল। প্রায়ই তাদের মাঝে ঝগড়া হত। আবার কিছুক্ষণ পরেই মিলে মিশে যেত। হঠাৎ দু ‘তিন দিন ধরে তাদের সাড়াশব্দ না পেয়ে তাদের রুমে গেলাম। তারা থাকত ‘হাসনা হেনা’ নামের রুমটায়; যে রুমটায় স্যার আপনি আছেন। সে রুমটায় গিয়ে আমি এতো ভয় পেলাম যা জন্মের পর আর এতো ভয় পায়নি। আমি দেখলাম তরুনী ওলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে বিছানার উপড়। তার মুখে আর কানের মধ্যে রক্ত লেগে আছে। বিছানার উপরও খানিকটা রক্ত জমে ছিল। আশপাশে বড় বড় মাছি ব্যান ব্যান করতেছিল; মনে হল তাকে গলা চেপে মারা হয়েছে। সেই যুবককে অনেক খুজলাম; কিন্তু সেই যুবককে আর পেলাম না। আমার খুব ভয় আর টেনশন হল, এখন আমি এই যুবতীর লাশ নিয়ে কি করব! আরও দুই তিনদিন এই রুমটা তালা মেরে রেখেছিলাম। আশপাশের জায়গাতে বেশ গন্ধ ছুটে গিয়েছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করব! একবার ভাবলাম পুলিশকে জানায়। আবার ভাবলাম পুলিশ তো সুবিধার লোক না! আমার বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। শেষে আমার না জানি ফাসি হয়ে যায়!
অবশেষে এক সময় ভাবলাম ভয় পেয়ে আর কি হবে? নিজেই অই তরনীর লাশ গোপনে কোথাও নিয়ে কবর দিয়ে ফেলি, খেল খতম; ঠিক অই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলোর রুমে গিয়ে দেখি সেই যুবতীর লাশ নেই। তখন আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। আশপাশের কোথাও এক ফোটা রক্তের দাগও নেই; যেখানে দূর্গন্ধ থাকার কথা সেখানে ‘হাসনা হেনা’ ফুলের ঘ্রাণ বেরুতে লাগল। সারাঘর ঘ্রাণে মুহিত হয়ে গেল। অথচ এই বাংলো বাগান বাড়ীর দশ কিলোমিটার অবদি কোন ‘হাসনা হেনা’ ফুলের গাছ নেই! আমি অভাক হলাম এই ফুলের ঘ্রাণ কোত্থেকে আসছে ‘আর তার কারণই বা কি?
আমি আরও অভাক হলাম সেই যুবতীর লাশ কি হল? কে অই যুবতীর লাশ সরিয়ে নিল? অই যুবক-কি তাহলে আবার এসেছিল? কিন্তু রুমতো তালা মারানো ছিল। তিনদিন পর তালা মারা অবস্থায় পেলাম। এর রহস্যটা কি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আজও এই রহস্যের দ্বার খোঁজে পেলাম না।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০৪/১১/২০১৪ভাই ভুত পেত্নিরে সবাই ভয় পায়। আর আমি তো ভিতুর ডিম নামেই পরিচিত। লেখাটা ভালো বাট আই কান্ট...............।
-
রেনেসাঁ সাহা ০৩/১১/২০১৪সত্যি ভয় লাগছে। এইজন্য রাত্রিবেলায় ভুতের গল্প পড়ি না। তবু কেন যে পড়তে গেলাম রাত্রে। কাল সকালে পড়তেও পারতাম।
........................লেখা খুব ভালো হয়েছে।