মাদারিপুর ইতিবৃত্ত
প্রাচীনকালে মাদারিপুরের পূর্বাংশ ইদিলপুর এবং পশ্চিমাংশ কোটালীপাড়া নামে পরিচিত ছিল। যা অতিপ্রাচীনকালে চন্দ্রদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের ঘন জঙ্গলপূর্ন অঞ্চল ছিল। এ অঞ্চলের আবাসযোগ্য ভূ-গঠন এবং জনবসতি খুব প্রাচীন নয়। নদীগুলির ব্যাপক ভাঙ্গা-গড়ার কারণে একাধিকবার পুনঃগঠিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। পশ্চিম ও পশ্চিম-দক্ষীণ ভাগ অনেকটা প্রাচীন ও স্থিতিশীল। এ প্রাচীন ভূ-ভাগ এক সময় গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। বাঘ, ভল্লুক, চিতাবাঘ, মহিষ, শুকর, বানর প্রবৃতি বন্য প্রানীর অভয়ারন্য ছিল। প্রাচীন এ জনপদটি বালেশ্বর নদী ও মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদী সপ্তশাখায় বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে পাবণী , হলদিনী, নলিনী ছিল পূর্বগামী শাখা এবং পূর্বগামী ত্রিধারার মিলিত স্থানকে সুগন্ধা বলা হতো। কালিকা পুরাণে সুগন্ধার উল্লেখ আছে- “সুগন্ধায়াং নাসিকা মেদেব স্ত্র্যম্বক ভৈরব।/ সুন্দরীসা মহাদেবী সুনন্দাতত্রৎ দেবতা”। এই সুগন্ধা নদীর মোহনায় গঙ্গার পলিমাটি অসংখ্য দ্বীপ সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে ইন্দ্রদ্বীপ, শঙ্খকোট, স্ত্রীকর, জম্বু দ্বীপ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে শাখা নদীগুলো বিলিন হয়ে এক দ্বীপের সাথে আর এক দ্বীপের স্থলভাগ মিশে সম্মিলিত নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। এডুমিশ্রের কারিকা কুলজিগ্রন্থে চন্দ্রদ্বীপের সীমানা সম্পর্কে বর্ণনা আছে, “মেঘনাদ পূর্বভাগে পশ্চিমে চ বলেশ্বরী।/ ইন্দিলপুরী যক্ষ সীমা দক্ষিণে সুন্দর বনম্”। চন্দ্রদ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চলেই প্রাচীন বঙ্গ জনপদ গড়ে উঠেছিল। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে সর্বপ্রথম বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে বঙ্গের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। মহাভারত অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় বঙ্গে রাজা ছিলেন সমুদ্রসেন । মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে ভাগীরথী ও পদ্মার শ্রোত অন্তর্বর্তী এলাকাকে বঙ্গ জনপদের অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাচীন বঙ্গে দুটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। একটি বিক্রমপুর আর অন্যটি নাব্য। ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিচু জলাভূমি এ নাব্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এছাড়া চন্দ্রদ্বীপ (বর্তমান বরিশাল জেলার অন্তর্গত) ও বঙ্গাল (বাকেরগঞ্জ ও খুলনা জেলার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল) উল্লেখযোগ্য। সমতটের অন্তর্গত ছিল বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালি অঞ্চল। বিভিন্ন শাসকদের আমলে বঙ্গের রাজনৈতিক সীমা বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। গঙ্গার দুই প্রধান স্রোতোধারা ভাগীরথীর পূর্বে এবং পদ্মার দক্ষিণের মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতির অর্থাৎ বৃহত্তর ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদিয়া অঞ্চল নিয়েই প্রাচীন বঙ্গ। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন ক্ল্যাসিক্যাল লেখকগণ এই অঞ্চলকেই গঙ্গারিডি (গঙ্গাঋদ্ধি) বলে আখ্যা দিয়েছেন। মি. ওয়াটার্স ও জেমস ওয়াইজ এর মতে কুমারতালক তথা কোটালীপাড়া ছিল গ্রিক বিবরণীর গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী। কোটালীপাড়া ছিল বাংলার সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র। ঐতিহাসিকদের মতে নন্দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দ আদতে ছিলেন গঙ্গারিডিদের রাজা, সেখান থেকেই পাটলিপুত্রে গিয়ে শিশুনাগ রাজবংশের শেষ রাজা মহানন্দিনকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন অধিকার করে নন্দ সাম্রাজ্য (৩৪৫-৩২১ খ্রি.পূ.) স্থাপন করেছিলেন। গঙ্গারিডি ও প্রাচ্য রাষ্ট্র ছিল ঔগ্রসৈন্য (উগ্রসেনের পুত্র) নামক রাজার অধীনে, যাকে মহাপদ্মনন্দের সঙ্গে অভিন্ন ভাবেন অনেক ইতিহাসবিদ। গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কোটালীপাড়া অঞ্চলে গঙ্গারিডি জাতি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করত। এ জাতির ছিল ৬ হাজার রণহস্তী এবং জাতিটি ছিল পরাক্রমশালী। আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ ত্যাগের কয়েক বছর পর ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধ দখল করে ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের উপর মৌর্য সম্রাজ্য (৩২১-১৮৫ খ্রি.পূ.) প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রি.পূ.) এ অঞ্চল মৌর্য শাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়। ঐ সময় মগধ (রাজধানী: পাটলিপুত্র) এবং গঙ্গারিডি মিলে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত গঙ্গারিডি রাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
৩১৫ খ্রিস্টাব্দে পুষ্করণ (বাঁকুড়া) রাজা সিংহবর্মণের পূত্র চন্দ্রবর্মণ বঙ্গ-সংলগ্ন জনপদের সংযুক্ত বঙ্গসেনার সাথে যুদ্ধে প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের সামুদ্রিক বন্দর ও শাসন কেন্দ্র নব্যাবকাশিকার এ অঞ্চল জয় করে ৩০ ফুট উঁচু একটি দুর্গ বা কোট নির্মাণ করেন। এ প্রাচীরের পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ছিল ৪.৪৫ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিনে দৈর্ঘ্য ছিল ৩.০০ কিলোমিটার। এ মাটির দূর্গটিকে ‘চন্দ্রবর্মণ কোট’ বলা হতো। এ প্রাচীরের রক্ষক বা কর্মকর্তাকে বলা হতো ‘কোটপাল’। এ থেকে কোটালীপাড়া নামের উৎপত্তি। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে কোটালীপাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৭৫ খ্রি.) চন্দ্রবর্মণকে পরাজিত করে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (রাজধানী: মগধ, পাটলিপুত্র-পাটনা, বিহার) অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বংশের দ্বাদশাদিত্য-মহারাজাধিরাজ বৈন্যগুপ্ত (৫০৫-৫২৫ খ্রি.) গুপ্তসাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমতটে স্বাধীন রাজত্ব স্থাপন করেন। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর এই রাজা চন্দ্রদ্বীপ দখল করে নেন এবংব দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য গঠন করেন। ৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মাদিত্য (৫৩৫–৫৪০ খ্রি.), গোপচন্দ্র (৫৪০–৫৮০ খ্রি.), নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদেব (৫৮০–৬০০ খ্রি.) চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। তাঁদের উপাধি ছিল 'মহারাজাধিরাজ'। কোটালীপাড়ায় মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্রের শাসনকেন্দ্র অবস্থিত ছিল। দাক্ষিণাত্যের (রাজধানী: বাদামী -কর্ণাটক) চালুক্য রাজবংশের রাজা কীর্তিবর্মণের (৫৬৬-৫৯৭ খ্রি.) হাতে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটে। পরবর্তীতে গৌড় (রাজধানী: কর্ণসুবর্ণ-মুর্শিদাবাদ) নৃপতি শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক (৫৯০–৬২৫ খ্রি.) এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার সন্তান মানব আট মাস ধরে গৌড় শাসন করেন। সে সময় সমতটের এক ব্রাহ্মণবংশীয় জৈষ্ঠভদ্র নামে একজন সামন্তরাজা বঙ্গে রাজত্ব করতেন। এরপর খড়গ রাজবংশের (রাজধানী: কর্মান্ত বসাক -কুমিল্লা বড় কামতা) খড়্গদ্যোম (৬২৫-৬৪০ খ্রি.), জাতখড়্গ (৬৪০-৬৫৮ খ্রি.), দেবখড়্গ (৬৫৮-৬৭৩ খ্রি.), রাজভট্ট (৬৭৩-৬৯০ খ্রি.) ও বলভট্ট (৬৯০-৭০৫ খ্রি.) বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল শাসন করে। বলভট্টের পরে শাসনক্ষমতা রাত রাজবংশের (রাজধানী: দেবপর্বত -কুমিল্লা ময়নামতি) জীবনধারণ রাত, শ্রীধারণ রাত, বলধারণ রাত নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর দেব রাজবংশের (রাজধানী: দেবপর্বত) শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ভবদেব ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। পাল রাজবংশের (৭৫০-১১৬২ খ্রি.) রাজা ধর্মপালের শাসনামলে (৭৮১-৮২১ খ্রি.) এ আঞ্চল পাল সম্রাজ্যের (গৌড়) অন্তর্ভূক্ত হয় এবং প্রথম বিগ্রহপালের রাজত্বকালে (৮৬১-৮৬৬ খ্রি.) হরিকেলের ধনদত্তের পুত্র কান্তিদেব ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করে একটি পৃথক রাজ্য (রাজধানী: বর্ধমানপুর -বড়উঠান, চট্টগ্রাম) স্থাপন করেন এবং এই অঞ্চল শাসন করেন। এরপর চন্দ্ররাজবংশের রোহিতগিরির (লালমাই-কুমিল্লা) সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র মহারাজাধিরাজ ত্রৈলোক্যচন্দ্র (৯০০-৯৩০ খ্রি.) চন্দ্র রাজ্য (রাজধানী: দেবপর্বত) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্র (৯৩০-৯৭৫ খ্রি.) ‘পরমসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করেন এবং বিক্রমপুরে তিনি তাঁর রাজধানী গড়ে তোলেন। মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্রের পর কল্যাণচন্দ্র (৯৭৫-১০০০ খ্রি.), লহড়চন্দ্র (১০০০-২০ খ্রি.), গোবিন্দচন্দ্র (১০২০-৫০ খ্রি.) এই অঞ্চল শাসন করেন। দক্ষিণ ভারতের (তামিল) চোল রাজবংশের (৩০০ খ্রি.পূ.–১২৭৯ খ্রি.) তিরুমুলাই লিপিতে ‘বঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র’-এর উল্লেখ পাওয় যায়। চন্দ্ররাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্রের শাসনামলে কৈবর্ত্য (বরেন্দ্র) বিদ্রোহের সময় সিংহপুরের (উত্তর উড়িষ্যা) বজ্রবর্মণের পুত্র জাতবর্মণ (১০৫০-৭৩ খ্রি.) তার শ্বশুর কলচুরি (রাজধানী: ত্রিপুরী -জব্বলপুর, মধ্যপ্রদেশ) রাজা কর্ণের (১০৪১-৭২ খ্রি.) সাহায্য ও সমর্থনে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজ্য (রাজধানী: বিক্রমপুর) প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্বাঞ্চলের বর্মণরাজ হরিবর্মণ রামপালকে (১০৮২-১১২৪ খ্রি.) রথ ও হাতি উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে প্রশমিত ও স্বীয় নিরাপত্তা বিধান করেন। ভোজবর্মণ ছিলেন বর্মণ রাজবংশের শেষ রাজা। এরপর কর্ণাটকের সেনরাজবংশীয় হেমন্তসেনের (কর্ণসুবর্ণ-বর্ধমান) পুত্র বিজয় সেন (১০৯৮-১১৬০ খ্রি.) বর্মণ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সেন বংশের শাসনের সূচনা করেন। শেষ পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন মদনপালকে পরাজিত করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা হতে পালদের বিতাড়িত করে নিজ রাজত্ব বিস্তার করেন। হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত বিজয়পুর ছিল বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী। দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করা হয় বিক্রমপুরে। বিজয় সেন পরম মাহেশ্বর, পরমেশ্বর, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ, অরিরাজ-বৃষভ-শঙ্কর প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন। সেন রাজবংশের অধীনেই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলা দীর্ঘকালব্যাপী একক রাজার অধীনে ছিল। তখন এই অঞ্চলের প্রশাসনিক নাম ছিল নাব্যমন্ডল। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণ সেন গৌড় হারিয়ে বিক্রমপুরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র মাধব সেন, বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন ১২০৬ খ্রি. হতে ১২২৫ খ্রি. পর্যন্ত এবং বিশ্বরূপ সেনের পূত্র সূর্য সেন ও পরবর্তী বংশধর ১২৪৫ খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেন। হরিকেল রাজ্যের দেব রাজবংশের রাজা বাসুদেব পুত্র দামোদরদেব (১২৩১-৪৩ খ্রি.) অরিরাজ চানূর মাধব সকল ভূপতি চক্রবর্তী উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে অরিরাজ-দনুজ-মাধব দশরথদেব নামে এক রাজা এই রাজ্যকে সেন শাসনের কেন্দ্রস্থল বিক্রমপুর পর্যন্ত প্রসারিত করে এবং বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিনি ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের (১২৬৬-৮৭ খ্রি.) সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। যদিও জেমস ওয়াইজ এর মতে ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বল্লালসেন বিক্রমপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। প্রখ্যাত সুফি সাধক কুতুব-ই-জাহান হযরত বদিউদ্দীন আহমেদ জিন্দা শাহ মাদার (র.) (৮৫৭-১৪৩৪ খ্রি.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালিন শাম রাজ্য (বর্তমান সিরিয়া) হতে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.) ভারতে পরে বঙ্গের বিভিন্ন স্থান ভ্রমনের এক পর্যায়ে তৎকালিন চন্দ্রদ্বীপের উত্তর সিমান্তে গভীর অরন্যে শাহ মাদার (র.) ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সহযাত্রীদের নিয়ে যে স্থানটিতে যাত্রা বিরতি বা বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন সে স্থানটিতে তার নামানুসারে পরবর্তীতে হযরত শাহ মাদার (র.) এর দরগাহ শরীফ নামকরণ করে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মীত হয়েছে। সেন রাজবংশের পতনের পর মহারাজা দনুজমর্দন দেব চন্দ্রদ্বীপে পুনরায় এক স্বাধীন রাজ্য (রাজধানী: বাঙ্গালা -কচুয়া, বাউফল) প্রতিষ্ঠা করেন। সাতক্ষীরার বাসুদেবপুরে প্রাপ্ত মুদ্রায় দেখা যায় একদিকে ‘শ্রী শ্রী দনুজমর্দনদেব’, অপরদিকে ‘শ্রী শ্রী চন্ডীচরণ পরায়ণ সম্বৎ ১৩৩৯’ এবং চারদিকে ‘চন্ডদ্বীপ’ কথাগুলি লেখা রয়েছে। দনুজমর্দনের উত্তরাধিকারীরা ছিলেন রমাবল্লভ। রমাবল্লভের পুত্র রাজা কৃষ্ণবল্লভ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হরিবল্লভের সময় (১৪৮৭ খ্রি.) পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য স্বাধীন ছিল।
সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৫ খ্রি.) ফরিদপুর ও চন্দ্রদ্বীপের একাংশ দখল করে ফতেহাবাদ পরগনা গঠন করেন। সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) ফতেহাবাদের জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ১৫৩৮-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শেরশাহ (রাজধানী: সাসারাম-বিহার) ও তার বংশধরগণ বাংলা শাসন করেন। ১৫৬৪-৭৬ খ্রি. পর্যন্ত কররানী রাজবংশ (রাজধানী: তান্ডা ) বাংলার রাজত্ব করে। তারপর ১৫৭৬-১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বারোভূঁইয়ার অধীনে ছিল বাংলা। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ছিল বিক্রমপুর-শ্রীপুরের নিম রায়ের অধঃস্তন চাঁদ রায়, কেদার রায় এবং বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দন দেবের অধঃস্তন কন্দর্পনারায়ণ রায়, রামচন্দ্র রায়। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রাণী প্রথম এলিজাবেথের দূত রাল্ফ ফিচ শ্রীপুরে (কেদারপুর -নড়িয়া) কেদার রায়কে সাক্ষাত করেন এবং চন্দ্রদ্বীপ পরিদর্শন করে একটি বিবরনীতে উল্লেখ করেন, শ্রীপুরের রূপিয়া খাঁ কর্তৃক নির্মিত এবং কন্দর্পনারায়ণের নামাঙ্কিত কিঞ্চিদধিক পাঁচ হাত দীর্ঘ একটি পিতলের কামান দীর্ঘকাল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপের রাজধানীতে রক্ষিত ছিল। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় ও কেদার রায় আফগান নেতা খাজা সুলায়মান লোহানীর সহযোগিতায় মুগল অধিকৃত ভূষণা দুর্গ দখল করেন। ভূষণা দুর্গ অবরোধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় নিহত হন। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভূষণা দুর্গ কেদার রায়ের অধিকারে থাকে। মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ মুঘলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করলেও ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের শুরু পর্যন্ত বিক্রমপুরের কেদার রায় স্বাধীন নৃপতি হিসাবে মুঘলদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে কন্দর্পনারায়ণ রায় নিহত হলে, তাঁর পুত্র রামচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের সিংহাসনে বসেন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহের নেতৃত্বে মুঘলদের বিশাল বাহিনী বিক্রমপুর আক্রমণ করে, মুঘলদের মিত্র হিসেবে সুসঙ্গ রাজ্যের রাজা রঘুনাথ সিংহ অংশ গ্রহণ করে। তুমুল যুদ্ধে কেদার রায় কামানের গোলায় মারাত্মক আহত হন এবং মুমূর্ষু অবস্থায় পরে মৃত্যবরন করেন। যুদ্ধ শেষে রাজা রঘুনাথ সিংহ বিক্রমপুর থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যায় এবং সুসঙ্গ রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন, তখন থেকেই ঐ অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের হাতে চন্দ্রদ্বীপের স্বাধীন রাজা রামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরবর্তীতে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-২৭ খ্রি.) শাসনামলে সুবেদার-ই-নাজিম ইসলাম খাঁ’র নেতৃত্বে বাংলা চূড়ান্তভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সুবাহ বাংলা (রাজধানী: জাহঙ্গীরনগর-ঢাকা) প্রদেশে পরিণত হয়। কেদার রায়ের মৃত্যুর (১৬০৩ খ্রি.) পর তাঁর মন্ত্রী রঘুনন্দন দাস চৌধুরী মূল বিক্রমপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেন এবং সেনাপতি রঘুনন্দনগুহ চৌধুরী পান ইদিলপুর পরগণার জমিদারি। ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের এক ফরমান বলে শেখ কালু দক্ষিণ বিক্রমপুরের কার্তিকপুর পরগণার জমিদারি লাভ করেন। শেখ কালুর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র কন্যা নূরন্নেছার উপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে। নূরন্নেছার বিয়ে হয় মুঘল সেনাপতি ফতেহ মুহম্মদের সাথে। ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলা থেকে পর্তুগিজ দমনে ফতেহ মুহম্মদের কৃতিত্বের জন্য সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-৫৮ খ্রি.) তাঁকে কার্তিকপুরে স্বাধীন জমিদারি প্রদান করেন। মুঘল আমলে সুবা বাংলাকে ১৬টি সরকারে ভাগ করা হয়। ফতেহাবাদ সরকারের অধীনে ৩১টি মহাল বা পরগনার মধ্যে ১৯তম মহাল বা পরগনার নাম ছিল সাওয়াইল বা জালালপুর , যা বর্তমান মাদারিপুর। এবং সরকার বাকলার ৪টি মহাল বা পরগণার মধ্যে একটি পরগণার নাম ছিল ইদিলপুর (হিজলা, মুলাদী, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা)। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিক্রমপুরের জমিদার ভূমিহীন প্রজাদের পূনর্বাসনের লক্ষে হযরত শাহ মাদার (র.) এর স্মৃতিবিজড়িত চন্দ্রদ্বীপের ঐ স্থানটিকে কেন্দ্র করে সরকার মাদারণ বা মাদারণ অঞ্চল নামে আখ্যায়িত করে ফসলি জমি ও আবাসন গড়ে তুলেন। যা পরবর্তীতে নগরায়নে রুপ নিতে থাকে, নাম হয় মাদারণ গ্রাম-ইউনিয়ন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) আমলে বাংলার সুবেদার-ই-নাজিম শায়েস্তা খাঁর (১৬৬৪-৮৮ খ্রি.) নেতৃত্বে তার বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খাঁ মগ জলদস্যুদের বিতাড়িত করার জন্য ২৮৮টি নদীতে অভিযান পরিচালনা করেন। বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে মগ জলদস্যুদের বিতাড়িত করে তার সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে অভিযান চালায়। সেখান থেকে মগ সৈন্যদের বিতাড়িত করে ঢাকা যাওয়ার পথে বর্তমান মাদারিপুরের কালকিনি উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থান আমড়াতলা ও খাতিয়াল এলাকায় কিছুদিন অবস্থান করে। ওই সময় পানিও জলের অভাব মেটানোর জন্য বুজুর্গ উমেদ খাঁর সেনাপতি ইসলাম খাঁর সেনাবাহিনী ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে একটি দিঘি খনন করে যা বর্তমানে সেনাপতির দিঘি নামে পরিচিত। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার প্রথম (কার্যত) স্বাধীন নবাব মুর্শিদ কুলি খান নাসিরি রাজবংশ (রাজধানী: মুর্শিদাবাদ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২০ থেকে ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঝাউদি মৌজায় প্রায় ৬০ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভ (ঝাউদি গিরি) নির্মিত হয়। নবাব আলীওয়ার্দী খান ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে আগা বাকের কে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ পরাগণার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বুজুর্গ উমেদপুরে তিনি একটি ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে যার নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিপক্ষের হাতে আগা বাকের নিহত হন। এরপর তাঁর পুত্র আগা সাদেককে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মীরন ও রাজবল্লভ নির্মমভাবে হত্যা করে। আগা বাকেরের পর রাজবল্লভ ও তার বংশধরদের (রাজনগর ) হাতে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব চলে যায়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পতনের পর মীর জাফর কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত নবাব হন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাশিমের পতনের মধ্যদিয়ে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করে।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি কলকাতায় রাজধানী স্থাপন করে এবং প্রথম গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিযুক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাসহ বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালের কয়েকটি এলাকা নিয়ে ঢাকা-জালালপুর নামে একটি জেলা গঠন করা হয়, সে সময় নুসরাত জং ঢাকার নায়েব নাজিম (১৭৮৫-১৮২২ খ্রি.) ছিলেন। কথিত আছে, ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে বাঘ শিকারের জন্য মাদারিপুরে একজনকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করেন, এই চুক্তির আওতায় জমিদারগণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। ভারতের গভর্নর জেনারেল স্যার জন শোর ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-জালালপুরের দক্ষিণ ভাগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাকেরগঞ্জ জেলা ঘোষণা করেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ঠগি দমনের জন্য আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদার নিযুক্ত হয়। সে সময় ভুবনেশ্বর নদ থেকে একটি খাল খনন করে প্রাচীন পদ্মা নদীর দক্ষিণাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এই খালটিই কালক্রমে প্রবল রুপ ধারণ করে প্রাচীন পদ্মা ও ভুবনেশ্বরের কতকাংশ গ্রাস করে আড়িয়াল খাঁ নদে পরিনত হয়। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট অসওয়ালড এর সময় ঢাকা জেলা হতে গৌরনদী ও বুড়ীরহাট (মাদারিপুর) থানা বাকেরগঞ্জ জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-জালালপুরের হেড কোয়ার্টার ফরিদপুরে স্থানান্তর করা হয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. বেটির সময়ে কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া ও কালকিনি নিয়ে কোটালীপাড়া থানা সৃষ্টি হয়। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ইদিলপুর পরগণা কলকাতার মোহিনী মোহন ঠাকুর নিলামে ক্রয় করেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেজারের সময়ে ঢাকা থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় মুলাদী ও হিজলা থানার উত্তরে অবস্থিত ইদিলপুর পরগণার একাংশ বাকেরগঞ্জ জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ব্রিটিশ শাসন, নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং একই সাথে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সুত্রপাত করেন যা ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২ খ্রি.) ফরায়েজি আন্দোনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাজা রাম মন্দিরটি তৎকালীন জমিদার রাজা রামরায় নির্মাণ করেন। রাজা রামরায় উজানীর জমিদারের নিকট হতে ফতেজঙ্গপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেন। রাজা রামরায়ের রাজ কর্মচারীরা ঐতি মোহনায় তাদের আস্তানা গড়ে তোলে। এখানেই এ অঞ্চলের পূর্বাপর রাজাদের বিশ্রাম এর স্থান হিসাবে ঐ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় রাজৈর। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরের বুড়িরহাট থানা ঘোষেরহাটে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. গ্যারেটের সুপারিশে গৌরনদী থানা পালরদী বন্দরে স্থাপিত হয়। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. শ’ মাদারিপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড র্যা মসে ডালহৌসির সময় ঢাকা-জালালপুর ভেঙ্গে ফরিদপুর জেলা গঠিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ২ নভেম্বর বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডারের সময় গৌরনদী (আগৈলঝাড়া সহ), ঘোষেরহাট (পালং), মাদারিপুর ও কোটালীপাড়া নিয়ে মাদারিপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর চৌকিতে মুন্সেফ ছিলেন বাবু বিশ্বেশ্বর সেন।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭) পর ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর ডিসপেনসারি (হাসপাতাল) প্রতিষ্ঠা করা হয়, সে সময় জনগনের চাঁদার এ ডিসপেনসারি চালানো হতো। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পদ্মার গতি পরিবর্তনে রাজাবাড়ী ও মুলফতগঞ্জ থানা ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমা (১৮৪৫ খ্রি.) হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাখেরগঞ্জ জেলার মাদারিপুর মহকুমায় অন্তর্ভূক্ত হয়। এ সময় বৃহত্তর মাদারিপুর মহকুমা সর্বোচ্চ বিস্তৃতি অর্থাৎ বর্তমানের মাদারীপুর জেলা, শরিয়তপুর জেলা, গোপালগঞ্জ জেলার গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া উপজেলা এবং বরিশাল জেলার গৌরনদী-আগৈলঝারা উপজেলার ১৬টি থানা নিয়ে গঠিত ছিল। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমায় গোপালগঞ্জ থানা গঠিত হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমাকে ফরিদপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করা হয় (১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলাকে পূর্ণঙ্গ জেলায় রুপান্তরিত করা হয়)। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শীত মৌসুমে প্রচুর মহিষের সমাগম ছিল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডামুড্যা ও গোসাইরহাট থানা গঠিত হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জুন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জে.বি. স্টুয়ার্ড এর সভাপতিত্বে মাদারিপুর মিউনিসিপালিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় (১৮৬৯ খ্রি. ফরিদপুর মিউনিসিপালিটি প্রতিষ্ঠিত হয়)। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ পালং থানার সীমানা নির্ধারণির গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে রাজৈরের সেনদিয়া গ্রামের অম্বিকাচরণ মজুমদার ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশন নামে পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শীতল চন্দ্র বেদান্ত ভূষণ এর সম্পাদনায় ধর্ম জীবন নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমায় একটি আরব্যান ব্যাংক (মাদারিপুর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক) ও ৩৭টি রুরাল সোসাইটি কাজ শুরু করে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর লোন অফিস লি. প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং এর সূত্রপাত হয়। পঞ্চাশের দশকে ৫টি অ-তপসিলী ব্যাংক বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় কর্মকান্ড শুরু করে, এর দুটোই ছিল মাদারিপুর শহরে - মাদারিপুর কমার্সিয়াল ব্যাংক লি. এবং মাদারিপুর পপুলার ব্যাংকিং এন্ড লোন কো. লি.। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমা থেকে আলাদা করে গোপালগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হলে কোটালীপাড়া থানা গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত হয় এবং কালকিনিকে কোটালীপাড়া থেকে পৃথক করে করিমগঞ্জ নামে থানা প্রতিষ্ঠা করে মাদারিপুর মহকুমাধীন রাখা হয়, যা পরবর্তীতে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালিন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মি. কালকিনির নাম অনুসারে কালকিনি নাম করণ করা হয়। পূর্ণচন্দ্র দাস ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী গুপ্ত সংগঠন মাদারিপুর সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বালেশ্বর যুদ্ধে সমিতির অন্যতম সদস্য চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে মৃত্যুবরণ করেন এবং নীরেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্চন সেনগুপ্ত বন্দী হন। বালেশ্বর জেলে তাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী পূর্ণদাসকে তার সন্ধ্যা কাব্য গ্রন্থটি (১৯২৯ খ্রি. প্রকাশিত) উৎসর্গ করেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া হাই স্কুল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মি. ডনোভান মাদারিপুরে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। তার নামেই ডনোভান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজৈর পুলিশ ফাড়িকে থানায় রুপান্তরিত করা হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর ডিসপেনসারিকে ৮ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে রুপান্তরিত করা হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বরহামগঞ্জ থানা গঠন করা হয় যা পরবর্তীতে শিবচর নামে পরিবর্তিত হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী পর্বত দেশ-বিদেশি প্রায় ৫০০ জাতের ফল ও ফুলের চারা সংগ্রহ করে প্রায় ২০ একর জমির ওপর একটি বাগান গড়ে তোলেন, তার নামানুসারে এ বাগানটি পর্বত বাগান নামে পরিচিত পায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শিবচরে বাহাদুরপুর শরিয়াতীয়া আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসা ও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর শহরে আহমদীয়া আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় যখন মাদারিপুর শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে তখনই ঐতিহাসিক এ শহরকে তৃতীয়বারের মতো রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২০ একর জমির উপর লেক (শকুনী লেক) খনন করা হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাসপাতালটিকে ২২ শয্যায় উন্নীত করে সরকারিকরণ করা হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত থেকে পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান অধিরাজ্য (১৯৪৭-৫৬) গঠিত হলে এ অঞ্চল পূর্ব বাংলা নামে অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৯৫৫ খ্রি. পূর্ব পাকিস্তান নামে ১৯৭১ খ্রি. পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত থাকে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীনের নাম অনুসারে নাজিমউদ্দিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাই স্কুল (১৮৮৫) ও ইসলামিয়া হাই স্কুল (১৯১৩) এর সমন্বয়ে গঠিত হয় ইউনাইটেড ইসলামিয়া মাদারিপুর হাই স্কুল, যার বর্তমান নাম ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে টাউন ক্লাবে মাদারিপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে তৎকালীন মাদারিপুর মহকুমা প্রশাসক এম.এম. হাফিজ (১৯৬৭-৬৮) এর স্মৃতি স্মরণে নামকরণ করা হয় এম.এম. হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১ ফেব্রুয়ারি চরমুগরিয়ায় সোনালী ব্যাংকের (ভূতপূর্ব ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) শাখা খোলা হয়, যা বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার প্রথম তফসিলী ব্যাংক। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে মাদারিপুর শহরে এ ব্যাংকের আরো একটি শাখা চালু হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একই সাথে মাদারিপুর ও ফরিদপুর শহরে শাখা খোলা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে বৃহত্তর মাদারিপুর মহকুমায় শহরাঞ্চল বেশী ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দুটি প্রধান ডাকঘর ছিল, একটি ফরিদপুর শহরে ও অন্যটি মাদারিপুর শহরে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ১১ ডিসেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে মাদারিপুর শহরে অগ্রণী ব্যাংকের (ভূতপূর্ব হাবিব ব্যাংক লি.) প্রথম শাখা খোলা হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর টিবি (বক্ষব্যাধি) ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৩৫.২৫ মাইল ভাঙ্গা-মাদারিপুর রাস্তা সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যামে সড়কপথে প্রথম যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে টেকেরহাট-মস্তফাপুর-মাদারিপুর রুট ও মাদারিপুর-ভুরঘাটা রুটে প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর স্টেডিয়াম নির্মীত হয়, যা পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় আছমত আলী খান স্টেডিয়াম। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে এ.আর. হাওলাদার জুট মিলস্ তৎকালীন ই.পি.আই.ডি.সি. এর সহায়তায় উৎপাদন শুরু করে, মাদারিপুরের এ মিলটি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার ভিতর প্রথম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল মাদারিপুরের প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৬৫ জন ছাত্র-যুবককে সঙ্গে নিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তিন(৩) নম্বর আসামী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক) মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। ভারতে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যায় তাদের মধ্যে মাদারিপুরের যুবকরা সর্বাগ্রে গমন করেন। ১০ ডিসেম্বর মাদারিপুরে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে মুক্ত হয়। সম্ভবত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র মাদারিপুরেই হয়েছে। তবে হানাদারমুক্ত হবার আগ মুহুর্তে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড হামলা করতে গিয়ে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ১৪ বছর বয়সী সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্থান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের চুরান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা নভেম্বর পালং, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরঞ্জ, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা থানা নিয়ে শরিয়তপুর মহকুমা গঠন করা হয়। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে নাজিমুদ্দিন কলেজটিকে জাতীয়করণ করা হয়, পরবর্তীতে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে (২০১৯খ্রি.) মাদারীপুর সরকারি কলেজ করা হয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ১৬.১৭ একর জমির উপর বিসিক শিল্প নগরী নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরে এন.ডাব্লিউ.ডি. চালু হয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর জেলা হিসেবে ঘোসিত হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরে জি.ই.পি. (গ্যারান্টিড এক্সপ্রেস পোস্ট) চালু হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ কালকিনি থানার আংশিক এলাকা নিয়ে ডাসার থানা গঠন করা হয়। এরপর ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই নিকারের ১১৭তম সভায় ডাসারকে পরিপূর্ণ উপজেলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বর্তমানে মাদারিপুর জেলায় ৩ টি সংসদীয় আসন, ৫ টি উপজেলা, ৫ টি থানা, ৪ টি পৌরসভা, ৫৯ টি ইউনিয়ন, ১০৬২ টি গ্রাম, ৪৭৯ টি মৌজা রয়েছে।
৩১৫ খ্রিস্টাব্দে পুষ্করণ (বাঁকুড়া) রাজা সিংহবর্মণের পূত্র চন্দ্রবর্মণ বঙ্গ-সংলগ্ন জনপদের সংযুক্ত বঙ্গসেনার সাথে যুদ্ধে প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের সামুদ্রিক বন্দর ও শাসন কেন্দ্র নব্যাবকাশিকার এ অঞ্চল জয় করে ৩০ ফুট উঁচু একটি দুর্গ বা কোট নির্মাণ করেন। এ প্রাচীরের পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ছিল ৪.৪৫ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিনে দৈর্ঘ্য ছিল ৩.০০ কিলোমিটার। এ মাটির দূর্গটিকে ‘চন্দ্রবর্মণ কোট’ বলা হতো। এ প্রাচীরের রক্ষক বা কর্মকর্তাকে বলা হতো ‘কোটপাল’। এ থেকে কোটালীপাড়া নামের উৎপত্তি। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে কোটালীপাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৭৫ খ্রি.) চন্দ্রবর্মণকে পরাজিত করে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (রাজধানী: মগধ, পাটলিপুত্র-পাটনা, বিহার) অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বংশের দ্বাদশাদিত্য-মহারাজাধিরাজ বৈন্যগুপ্ত (৫০৫-৫২৫ খ্রি.) গুপ্তসাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমতটে স্বাধীন রাজত্ব স্থাপন করেন। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর এই রাজা চন্দ্রদ্বীপ দখল করে নেন এবংব দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য গঠন করেন। ৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মাদিত্য (৫৩৫–৫৪০ খ্রি.), গোপচন্দ্র (৫৪০–৫৮০ খ্রি.), নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদেব (৫৮০–৬০০ খ্রি.) চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। তাঁদের উপাধি ছিল 'মহারাজাধিরাজ'। কোটালীপাড়ায় মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্রের শাসনকেন্দ্র অবস্থিত ছিল। দাক্ষিণাত্যের (রাজধানী: বাদামী -কর্ণাটক) চালুক্য রাজবংশের রাজা কীর্তিবর্মণের (৫৬৬-৫৯৭ খ্রি.) হাতে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটে। পরবর্তীতে গৌড় (রাজধানী: কর্ণসুবর্ণ-মুর্শিদাবাদ) নৃপতি শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক (৫৯০–৬২৫ খ্রি.) এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার সন্তান মানব আট মাস ধরে গৌড় শাসন করেন। সে সময় সমতটের এক ব্রাহ্মণবংশীয় জৈষ্ঠভদ্র নামে একজন সামন্তরাজা বঙ্গে রাজত্ব করতেন। এরপর খড়গ রাজবংশের (রাজধানী: কর্মান্ত বসাক -কুমিল্লা বড় কামতা) খড়্গদ্যোম (৬২৫-৬৪০ খ্রি.), জাতখড়্গ (৬৪০-৬৫৮ খ্রি.), দেবখড়্গ (৬৫৮-৬৭৩ খ্রি.), রাজভট্ট (৬৭৩-৬৯০ খ্রি.) ও বলভট্ট (৬৯০-৭০৫ খ্রি.) বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল শাসন করে। বলভট্টের পরে শাসনক্ষমতা রাত রাজবংশের (রাজধানী: দেবপর্বত -কুমিল্লা ময়নামতি) জীবনধারণ রাত, শ্রীধারণ রাত, বলধারণ রাত নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর দেব রাজবংশের (রাজধানী: দেবপর্বত) শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ভবদেব ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। পাল রাজবংশের (৭৫০-১১৬২ খ্রি.) রাজা ধর্মপালের শাসনামলে (৭৮১-৮২১ খ্রি.) এ আঞ্চল পাল সম্রাজ্যের (গৌড়) অন্তর্ভূক্ত হয় এবং প্রথম বিগ্রহপালের রাজত্বকালে (৮৬১-৮৬৬ খ্রি.) হরিকেলের ধনদত্তের পুত্র কান্তিদেব ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করে একটি পৃথক রাজ্য (রাজধানী: বর্ধমানপুর -বড়উঠান, চট্টগ্রাম) স্থাপন করেন এবং এই অঞ্চল শাসন করেন। এরপর চন্দ্ররাজবংশের রোহিতগিরির (লালমাই-কুমিল্লা) সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র মহারাজাধিরাজ ত্রৈলোক্যচন্দ্র (৯০০-৯৩০ খ্রি.) চন্দ্র রাজ্য (রাজধানী: দেবপর্বত) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্র (৯৩০-৯৭৫ খ্রি.) ‘পরমসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করেন এবং বিক্রমপুরে তিনি তাঁর রাজধানী গড়ে তোলেন। মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্রের পর কল্যাণচন্দ্র (৯৭৫-১০০০ খ্রি.), লহড়চন্দ্র (১০০০-২০ খ্রি.), গোবিন্দচন্দ্র (১০২০-৫০ খ্রি.) এই অঞ্চল শাসন করেন। দক্ষিণ ভারতের (তামিল) চোল রাজবংশের (৩০০ খ্রি.পূ.–১২৭৯ খ্রি.) তিরুমুলাই লিপিতে ‘বঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র’-এর উল্লেখ পাওয় যায়। চন্দ্ররাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্রের শাসনামলে কৈবর্ত্য (বরেন্দ্র) বিদ্রোহের সময় সিংহপুরের (উত্তর উড়িষ্যা) বজ্রবর্মণের পুত্র জাতবর্মণ (১০৫০-৭৩ খ্রি.) তার শ্বশুর কলচুরি (রাজধানী: ত্রিপুরী -জব্বলপুর, মধ্যপ্রদেশ) রাজা কর্ণের (১০৪১-৭২ খ্রি.) সাহায্য ও সমর্থনে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজ্য (রাজধানী: বিক্রমপুর) প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্বাঞ্চলের বর্মণরাজ হরিবর্মণ রামপালকে (১০৮২-১১২৪ খ্রি.) রথ ও হাতি উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে প্রশমিত ও স্বীয় নিরাপত্তা বিধান করেন। ভোজবর্মণ ছিলেন বর্মণ রাজবংশের শেষ রাজা। এরপর কর্ণাটকের সেনরাজবংশীয় হেমন্তসেনের (কর্ণসুবর্ণ-বর্ধমান) পুত্র বিজয় সেন (১০৯৮-১১৬০ খ্রি.) বর্মণ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সেন বংশের শাসনের সূচনা করেন। শেষ পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন মদনপালকে পরাজিত করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা হতে পালদের বিতাড়িত করে নিজ রাজত্ব বিস্তার করেন। হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত বিজয়পুর ছিল বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী। দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করা হয় বিক্রমপুরে। বিজয় সেন পরম মাহেশ্বর, পরমেশ্বর, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ, অরিরাজ-বৃষভ-শঙ্কর প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন। সেন রাজবংশের অধীনেই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলা দীর্ঘকালব্যাপী একক রাজার অধীনে ছিল। তখন এই অঞ্চলের প্রশাসনিক নাম ছিল নাব্যমন্ডল। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণ সেন গৌড় হারিয়ে বিক্রমপুরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র মাধব সেন, বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন ১২০৬ খ্রি. হতে ১২২৫ খ্রি. পর্যন্ত এবং বিশ্বরূপ সেনের পূত্র সূর্য সেন ও পরবর্তী বংশধর ১২৪৫ খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেন। হরিকেল রাজ্যের দেব রাজবংশের রাজা বাসুদেব পুত্র দামোদরদেব (১২৩১-৪৩ খ্রি.) অরিরাজ চানূর মাধব সকল ভূপতি চক্রবর্তী উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে অরিরাজ-দনুজ-মাধব দশরথদেব নামে এক রাজা এই রাজ্যকে সেন শাসনের কেন্দ্রস্থল বিক্রমপুর পর্যন্ত প্রসারিত করে এবং বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিনি ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের (১২৬৬-৮৭ খ্রি.) সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। যদিও জেমস ওয়াইজ এর মতে ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বল্লালসেন বিক্রমপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। প্রখ্যাত সুফি সাধক কুতুব-ই-জাহান হযরত বদিউদ্দীন আহমেদ জিন্দা শাহ মাদার (র.) (৮৫৭-১৪৩৪ খ্রি.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালিন শাম রাজ্য (বর্তমান সিরিয়া) হতে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.) ভারতে পরে বঙ্গের বিভিন্ন স্থান ভ্রমনের এক পর্যায়ে তৎকালিন চন্দ্রদ্বীপের উত্তর সিমান্তে গভীর অরন্যে শাহ মাদার (র.) ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সহযাত্রীদের নিয়ে যে স্থানটিতে যাত্রা বিরতি বা বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন সে স্থানটিতে তার নামানুসারে পরবর্তীতে হযরত শাহ মাদার (র.) এর দরগাহ শরীফ নামকরণ করে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মীত হয়েছে। সেন রাজবংশের পতনের পর মহারাজা দনুজমর্দন দেব চন্দ্রদ্বীপে পুনরায় এক স্বাধীন রাজ্য (রাজধানী: বাঙ্গালা -কচুয়া, বাউফল) প্রতিষ্ঠা করেন। সাতক্ষীরার বাসুদেবপুরে প্রাপ্ত মুদ্রায় দেখা যায় একদিকে ‘শ্রী শ্রী দনুজমর্দনদেব’, অপরদিকে ‘শ্রী শ্রী চন্ডীচরণ পরায়ণ সম্বৎ ১৩৩৯’ এবং চারদিকে ‘চন্ডদ্বীপ’ কথাগুলি লেখা রয়েছে। দনুজমর্দনের উত্তরাধিকারীরা ছিলেন রমাবল্লভ। রমাবল্লভের পুত্র রাজা কৃষ্ণবল্লভ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হরিবল্লভের সময় (১৪৮৭ খ্রি.) পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য স্বাধীন ছিল।
সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৫ খ্রি.) ফরিদপুর ও চন্দ্রদ্বীপের একাংশ দখল করে ফতেহাবাদ পরগনা গঠন করেন। সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) ফতেহাবাদের জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ১৫৩৮-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শেরশাহ (রাজধানী: সাসারাম-বিহার) ও তার বংশধরগণ বাংলা শাসন করেন। ১৫৬৪-৭৬ খ্রি. পর্যন্ত কররানী রাজবংশ (রাজধানী: তান্ডা ) বাংলার রাজত্ব করে। তারপর ১৫৭৬-১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বারোভূঁইয়ার অধীনে ছিল বাংলা। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ছিল বিক্রমপুর-শ্রীপুরের নিম রায়ের অধঃস্তন চাঁদ রায়, কেদার রায় এবং বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দন দেবের অধঃস্তন কন্দর্পনারায়ণ রায়, রামচন্দ্র রায়। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রাণী প্রথম এলিজাবেথের দূত রাল্ফ ফিচ শ্রীপুরে (কেদারপুর -নড়িয়া) কেদার রায়কে সাক্ষাত করেন এবং চন্দ্রদ্বীপ পরিদর্শন করে একটি বিবরনীতে উল্লেখ করেন, শ্রীপুরের রূপিয়া খাঁ কর্তৃক নির্মিত এবং কন্দর্পনারায়ণের নামাঙ্কিত কিঞ্চিদধিক পাঁচ হাত দীর্ঘ একটি পিতলের কামান দীর্ঘকাল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপের রাজধানীতে রক্ষিত ছিল। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় ও কেদার রায় আফগান নেতা খাজা সুলায়মান লোহানীর সহযোগিতায় মুগল অধিকৃত ভূষণা দুর্গ দখল করেন। ভূষণা দুর্গ অবরোধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় নিহত হন। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভূষণা দুর্গ কেদার রায়ের অধিকারে থাকে। মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ মুঘলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করলেও ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের শুরু পর্যন্ত বিক্রমপুরের কেদার রায় স্বাধীন নৃপতি হিসাবে মুঘলদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে কন্দর্পনারায়ণ রায় নিহত হলে, তাঁর পুত্র রামচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের সিংহাসনে বসেন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহের নেতৃত্বে মুঘলদের বিশাল বাহিনী বিক্রমপুর আক্রমণ করে, মুঘলদের মিত্র হিসেবে সুসঙ্গ রাজ্যের রাজা রঘুনাথ সিংহ অংশ গ্রহণ করে। তুমুল যুদ্ধে কেদার রায় কামানের গোলায় মারাত্মক আহত হন এবং মুমূর্ষু অবস্থায় পরে মৃত্যবরন করেন। যুদ্ধ শেষে রাজা রঘুনাথ সিংহ বিক্রমপুর থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যায় এবং সুসঙ্গ রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন, তখন থেকেই ঐ অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের হাতে চন্দ্রদ্বীপের স্বাধীন রাজা রামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরবর্তীতে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-২৭ খ্রি.) শাসনামলে সুবেদার-ই-নাজিম ইসলাম খাঁ’র নেতৃত্বে বাংলা চূড়ান্তভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সুবাহ বাংলা (রাজধানী: জাহঙ্গীরনগর-ঢাকা) প্রদেশে পরিণত হয়। কেদার রায়ের মৃত্যুর (১৬০৩ খ্রি.) পর তাঁর মন্ত্রী রঘুনন্দন দাস চৌধুরী মূল বিক্রমপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেন এবং সেনাপতি রঘুনন্দনগুহ চৌধুরী পান ইদিলপুর পরগণার জমিদারি। ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের এক ফরমান বলে শেখ কালু দক্ষিণ বিক্রমপুরের কার্তিকপুর পরগণার জমিদারি লাভ করেন। শেখ কালুর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র কন্যা নূরন্নেছার উপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে। নূরন্নেছার বিয়ে হয় মুঘল সেনাপতি ফতেহ মুহম্মদের সাথে। ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলা থেকে পর্তুগিজ দমনে ফতেহ মুহম্মদের কৃতিত্বের জন্য সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-৫৮ খ্রি.) তাঁকে কার্তিকপুরে স্বাধীন জমিদারি প্রদান করেন। মুঘল আমলে সুবা বাংলাকে ১৬টি সরকারে ভাগ করা হয়। ফতেহাবাদ সরকারের অধীনে ৩১টি মহাল বা পরগনার মধ্যে ১৯তম মহাল বা পরগনার নাম ছিল সাওয়াইল বা জালালপুর , যা বর্তমান মাদারিপুর। এবং সরকার বাকলার ৪টি মহাল বা পরগণার মধ্যে একটি পরগণার নাম ছিল ইদিলপুর (হিজলা, মুলাদী, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা)। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিক্রমপুরের জমিদার ভূমিহীন প্রজাদের পূনর্বাসনের লক্ষে হযরত শাহ মাদার (র.) এর স্মৃতিবিজড়িত চন্দ্রদ্বীপের ঐ স্থানটিকে কেন্দ্র করে সরকার মাদারণ বা মাদারণ অঞ্চল নামে আখ্যায়িত করে ফসলি জমি ও আবাসন গড়ে তুলেন। যা পরবর্তীতে নগরায়নে রুপ নিতে থাকে, নাম হয় মাদারণ গ্রাম-ইউনিয়ন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) আমলে বাংলার সুবেদার-ই-নাজিম শায়েস্তা খাঁর (১৬৬৪-৮৮ খ্রি.) নেতৃত্বে তার বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খাঁ মগ জলদস্যুদের বিতাড়িত করার জন্য ২৮৮টি নদীতে অভিযান পরিচালনা করেন। বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে মগ জলদস্যুদের বিতাড়িত করে তার সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে অভিযান চালায়। সেখান থেকে মগ সৈন্যদের বিতাড়িত করে ঢাকা যাওয়ার পথে বর্তমান মাদারিপুরের কালকিনি উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থান আমড়াতলা ও খাতিয়াল এলাকায় কিছুদিন অবস্থান করে। ওই সময় পানিও জলের অভাব মেটানোর জন্য বুজুর্গ উমেদ খাঁর সেনাপতি ইসলাম খাঁর সেনাবাহিনী ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে একটি দিঘি খনন করে যা বর্তমানে সেনাপতির দিঘি নামে পরিচিত। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার প্রথম (কার্যত) স্বাধীন নবাব মুর্শিদ কুলি খান নাসিরি রাজবংশ (রাজধানী: মুর্শিদাবাদ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২০ থেকে ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঝাউদি মৌজায় প্রায় ৬০ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভ (ঝাউদি গিরি) নির্মিত হয়। নবাব আলীওয়ার্দী খান ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে আগা বাকের কে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ পরাগণার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বুজুর্গ উমেদপুরে তিনি একটি ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে যার নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিপক্ষের হাতে আগা বাকের নিহত হন। এরপর তাঁর পুত্র আগা সাদেককে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মীরন ও রাজবল্লভ নির্মমভাবে হত্যা করে। আগা বাকেরের পর রাজবল্লভ ও তার বংশধরদের (রাজনগর ) হাতে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব চলে যায়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পতনের পর মীর জাফর কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত নবাব হন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাশিমের পতনের মধ্যদিয়ে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করে।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি কলকাতায় রাজধানী স্থাপন করে এবং প্রথম গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিযুক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাসহ বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালের কয়েকটি এলাকা নিয়ে ঢাকা-জালালপুর নামে একটি জেলা গঠন করা হয়, সে সময় নুসরাত জং ঢাকার নায়েব নাজিম (১৭৮৫-১৮২২ খ্রি.) ছিলেন। কথিত আছে, ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে বাঘ শিকারের জন্য মাদারিপুরে একজনকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করেন, এই চুক্তির আওতায় জমিদারগণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। ভারতের গভর্নর জেনারেল স্যার জন শোর ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-জালালপুরের দক্ষিণ ভাগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাকেরগঞ্জ জেলা ঘোষণা করেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ঠগি দমনের জন্য আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদার নিযুক্ত হয়। সে সময় ভুবনেশ্বর নদ থেকে একটি খাল খনন করে প্রাচীন পদ্মা নদীর দক্ষিণাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এই খালটিই কালক্রমে প্রবল রুপ ধারণ করে প্রাচীন পদ্মা ও ভুবনেশ্বরের কতকাংশ গ্রাস করে আড়িয়াল খাঁ নদে পরিনত হয়। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট অসওয়ালড এর সময় ঢাকা জেলা হতে গৌরনদী ও বুড়ীরহাট (মাদারিপুর) থানা বাকেরগঞ্জ জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-জালালপুরের হেড কোয়ার্টার ফরিদপুরে স্থানান্তর করা হয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. বেটির সময়ে কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া ও কালকিনি নিয়ে কোটালীপাড়া থানা সৃষ্টি হয়। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ইদিলপুর পরগণা কলকাতার মোহিনী মোহন ঠাকুর নিলামে ক্রয় করেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেজারের সময়ে ঢাকা থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় মুলাদী ও হিজলা থানার উত্তরে অবস্থিত ইদিলপুর পরগণার একাংশ বাকেরগঞ্জ জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ব্রিটিশ শাসন, নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং একই সাথে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সুত্রপাত করেন যা ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২ খ্রি.) ফরায়েজি আন্দোনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাজা রাম মন্দিরটি তৎকালীন জমিদার রাজা রামরায় নির্মাণ করেন। রাজা রামরায় উজানীর জমিদারের নিকট হতে ফতেজঙ্গপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেন। রাজা রামরায়ের রাজ কর্মচারীরা ঐতি মোহনায় তাদের আস্তানা গড়ে তোলে। এখানেই এ অঞ্চলের পূর্বাপর রাজাদের বিশ্রাম এর স্থান হিসাবে ঐ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় রাজৈর। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরের বুড়িরহাট থানা ঘোষেরহাটে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. গ্যারেটের সুপারিশে গৌরনদী থানা পালরদী বন্দরে স্থাপিত হয়। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. শ’ মাদারিপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড র্যা মসে ডালহৌসির সময় ঢাকা-জালালপুর ভেঙ্গে ফরিদপুর জেলা গঠিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ২ নভেম্বর বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডারের সময় গৌরনদী (আগৈলঝাড়া সহ), ঘোষেরহাট (পালং), মাদারিপুর ও কোটালীপাড়া নিয়ে মাদারিপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর চৌকিতে মুন্সেফ ছিলেন বাবু বিশ্বেশ্বর সেন।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭) পর ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর ডিসপেনসারি (হাসপাতাল) প্রতিষ্ঠা করা হয়, সে সময় জনগনের চাঁদার এ ডিসপেনসারি চালানো হতো। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পদ্মার গতি পরিবর্তনে রাজাবাড়ী ও মুলফতগঞ্জ থানা ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমা (১৮৪৫ খ্রি.) হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাখেরগঞ্জ জেলার মাদারিপুর মহকুমায় অন্তর্ভূক্ত হয়। এ সময় বৃহত্তর মাদারিপুর মহকুমা সর্বোচ্চ বিস্তৃতি অর্থাৎ বর্তমানের মাদারীপুর জেলা, শরিয়তপুর জেলা, গোপালগঞ্জ জেলার গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া উপজেলা এবং বরিশাল জেলার গৌরনদী-আগৈলঝারা উপজেলার ১৬টি থানা নিয়ে গঠিত ছিল। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমায় গোপালগঞ্জ থানা গঠিত হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমাকে ফরিদপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করা হয় (১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলাকে পূর্ণঙ্গ জেলায় রুপান্তরিত করা হয়)। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শীত মৌসুমে প্রচুর মহিষের সমাগম ছিল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডামুড্যা ও গোসাইরহাট থানা গঠিত হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জুন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জে.বি. স্টুয়ার্ড এর সভাপতিত্বে মাদারিপুর মিউনিসিপালিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় (১৮৬৯ খ্রি. ফরিদপুর মিউনিসিপালিটি প্রতিষ্ঠিত হয়)। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ পালং থানার সীমানা নির্ধারণির গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে রাজৈরের সেনদিয়া গ্রামের অম্বিকাচরণ মজুমদার ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশন নামে পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শীতল চন্দ্র বেদান্ত ভূষণ এর সম্পাদনায় ধর্ম জীবন নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমায় একটি আরব্যান ব্যাংক (মাদারিপুর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক) ও ৩৭টি রুরাল সোসাইটি কাজ শুরু করে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর লোন অফিস লি. প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং এর সূত্রপাত হয়। পঞ্চাশের দশকে ৫টি অ-তপসিলী ব্যাংক বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় কর্মকান্ড শুরু করে, এর দুটোই ছিল মাদারিপুর শহরে - মাদারিপুর কমার্সিয়াল ব্যাংক লি. এবং মাদারিপুর পপুলার ব্যাংকিং এন্ড লোন কো. লি.। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর মহকুমা থেকে আলাদা করে গোপালগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হলে কোটালীপাড়া থানা গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত হয় এবং কালকিনিকে কোটালীপাড়া থেকে পৃথক করে করিমগঞ্জ নামে থানা প্রতিষ্ঠা করে মাদারিপুর মহকুমাধীন রাখা হয়, যা পরবর্তীতে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালিন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মি. কালকিনির নাম অনুসারে কালকিনি নাম করণ করা হয়। পূর্ণচন্দ্র দাস ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী গুপ্ত সংগঠন মাদারিপুর সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বালেশ্বর যুদ্ধে সমিতির অন্যতম সদস্য চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে মৃত্যুবরণ করেন এবং নীরেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্চন সেনগুপ্ত বন্দী হন। বালেশ্বর জেলে তাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী পূর্ণদাসকে তার সন্ধ্যা কাব্য গ্রন্থটি (১৯২৯ খ্রি. প্রকাশিত) উৎসর্গ করেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া হাই স্কুল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মি. ডনোভান মাদারিপুরে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। তার নামেই ডনোভান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজৈর পুলিশ ফাড়িকে থানায় রুপান্তরিত করা হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর ডিসপেনসারিকে ৮ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে রুপান্তরিত করা হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বরহামগঞ্জ থানা গঠন করা হয় যা পরবর্তীতে শিবচর নামে পরিবর্তিত হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী পর্বত দেশ-বিদেশি প্রায় ৫০০ জাতের ফল ও ফুলের চারা সংগ্রহ করে প্রায় ২০ একর জমির ওপর একটি বাগান গড়ে তোলেন, তার নামানুসারে এ বাগানটি পর্বত বাগান নামে পরিচিত পায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শিবচরে বাহাদুরপুর শরিয়াতীয়া আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসা ও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর শহরে আহমদীয়া আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় যখন মাদারিপুর শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে তখনই ঐতিহাসিক এ শহরকে তৃতীয়বারের মতো রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২০ একর জমির উপর লেক (শকুনী লেক) খনন করা হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাসপাতালটিকে ২২ শয্যায় উন্নীত করে সরকারিকরণ করা হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত থেকে পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান অধিরাজ্য (১৯৪৭-৫৬) গঠিত হলে এ অঞ্চল পূর্ব বাংলা নামে অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৯৫৫ খ্রি. পূর্ব পাকিস্তান নামে ১৯৭১ খ্রি. পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত থাকে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীনের নাম অনুসারে নাজিমউদ্দিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর হাই স্কুল (১৮৮৫) ও ইসলামিয়া হাই স্কুল (১৯১৩) এর সমন্বয়ে গঠিত হয় ইউনাইটেড ইসলামিয়া মাদারিপুর হাই স্কুল, যার বর্তমান নাম ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে টাউন ক্লাবে মাদারিপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে তৎকালীন মাদারিপুর মহকুমা প্রশাসক এম.এম. হাফিজ (১৯৬৭-৬৮) এর স্মৃতি স্মরণে নামকরণ করা হয় এম.এম. হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১ ফেব্রুয়ারি চরমুগরিয়ায় সোনালী ব্যাংকের (ভূতপূর্ব ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) শাখা খোলা হয়, যা বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার প্রথম তফসিলী ব্যাংক। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে মাদারিপুর শহরে এ ব্যাংকের আরো একটি শাখা চালু হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একই সাথে মাদারিপুর ও ফরিদপুর শহরে শাখা খোলা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে বৃহত্তর মাদারিপুর মহকুমায় শহরাঞ্চল বেশী ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দুটি প্রধান ডাকঘর ছিল, একটি ফরিদপুর শহরে ও অন্যটি মাদারিপুর শহরে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ১১ ডিসেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে মাদারিপুর শহরে অগ্রণী ব্যাংকের (ভূতপূর্ব হাবিব ব্যাংক লি.) প্রথম শাখা খোলা হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর টিবি (বক্ষব্যাধি) ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৩৫.২৫ মাইল ভাঙ্গা-মাদারিপুর রাস্তা সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যামে সড়কপথে প্রথম যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে টেকেরহাট-মস্তফাপুর-মাদারিপুর রুট ও মাদারিপুর-ভুরঘাটা রুটে প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর স্টেডিয়াম নির্মীত হয়, যা পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় আছমত আলী খান স্টেডিয়াম। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে এ.আর. হাওলাদার জুট মিলস্ তৎকালীন ই.পি.আই.ডি.সি. এর সহায়তায় উৎপাদন শুরু করে, মাদারিপুরের এ মিলটি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার ভিতর প্রথম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল মাদারিপুরের প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৬৫ জন ছাত্র-যুবককে সঙ্গে নিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তিন(৩) নম্বর আসামী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক) মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। ভারতে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যায় তাদের মধ্যে মাদারিপুরের যুবকরা সর্বাগ্রে গমন করেন। ১০ ডিসেম্বর মাদারিপুরে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে মুক্ত হয়। সম্ভবত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র মাদারিপুরেই হয়েছে। তবে হানাদারমুক্ত হবার আগ মুহুর্তে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড হামলা করতে গিয়ে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ১৪ বছর বয়সী সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্থান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের চুরান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা নভেম্বর পালং, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরঞ্জ, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা থানা নিয়ে শরিয়তপুর মহকুমা গঠন করা হয়। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে নাজিমুদ্দিন কলেজটিকে জাতীয়করণ করা হয়, পরবর্তীতে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে (২০১৯খ্রি.) মাদারীপুর সরকারি কলেজ করা হয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ১৬.১৭ একর জমির উপর বিসিক শিল্প নগরী নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরে এন.ডাব্লিউ.ডি. চালু হয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুর জেলা হিসেবে ঘোসিত হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাদারিপুরে জি.ই.পি. (গ্যারান্টিড এক্সপ্রেস পোস্ট) চালু হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ কালকিনি থানার আংশিক এলাকা নিয়ে ডাসার থানা গঠন করা হয়। এরপর ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই নিকারের ১১৭তম সভায় ডাসারকে পরিপূর্ণ উপজেলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বর্তমানে মাদারিপুর জেলায় ৩ টি সংসদীয় আসন, ৫ টি উপজেলা, ৫ টি থানা, ৪ টি পৌরসভা, ৫৯ টি ইউনিয়ন, ১০৬২ টি গ্রাম, ৪৭৯ টি মৌজা রয়েছে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী ২৮/০৫/২০২৩দারুন
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ৩১/০৩/২০২৩ভাল লেখা। সময় করে মন দিয়ে আবার পড়তে হবে।