www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর এবং আমি

পটভূমি:
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তার ১১জন ছাত্র সাথে নিয়ে “সাহিত্যের ওয়ার্কশপ” নামের পুস্তক আলোচনার বৈঠকী কার্যক্রম শুরু করেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন সায়ীদ স্যার এর ছাত্র, মাদারিপুর অধ্যাপক মিঞা আব্দুল হালিম। বর্তমান নায়েমের তিন নম্বর কক্ষে প্রতি শুক্রবার কয়েক ঘন্টা করে চলত সাহিত্য আলোচনা, আর আলোচনার জন্য প্রথম নির্ধারিত বইটি ছিল পূর্নেন্দ দস্তিদার এর “মোপাসার গল্প”।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৩৩নং ইন্দিরা রোডের ভাড়া বাড়িতে “সাহিত্যের ওয়ার্কশপ” থেকে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যার বর্তমান নিজস্ব ঠিকানা ১৪ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ ঢাকা।
কয়েক বছরের মধ্যে দেশব্যাপী শুরু হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জাতীয় ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম (জাভিক)। এর অংশ হিসেবে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তৎকালীন মাদারিপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (পরে ঢাকায় বদলি হয়) জনাব নাসিরুদ্দীন চিশতির পরামর্শক্রমে এ.টি.এম. কামালুজ্জামানের নিকট মাদারিপুর জেলায় কর্মসূচী পরিচালনার প্রস্তাব করেন।
এরপর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের উপস্থিতিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর শাখা যাত্রা শুরু করে, এ.টি.এম. কামালুজ্জন হন মাদারিপুর শাখা সংগঠক এবং সে সময় প্রথম স্বেচ্ছাসেবক কর্মী ছিলেন মুরাদ হাসান (বর্তমানে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের ক্রিরা শিক্ষক)। কর্মসূচী পরিচালনার জন্য তৎকালীন মাদারিপুর জেলা প্রশাসক জনাব কাজী নাসিরুল ইসলাম একটি আলমারি প্রদান করেন, যা এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। তার এই সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আরো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অধ্যাপক আব্দুল জব্বার মিয়া, সাংবাদিক শাহজাহান খান, অধ্যাপক বীরেন্দ্রনাথ মন্ডল, অধ্যাপক এস.এম. ওয়াহিদুজ্জামান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ, যাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সফলভাবে যাত্রা শুরু করে বিসাকে মাদারিপুর শাখার কার্যক্রম।
কার্যক্রম চলতে থাকে প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এম.এম. হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। প্রতি সপ্তাহে বই দেয়া-নেয়া কার্যক্রমের পাশাপাশি চলত বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বছরে একদিন আয়োজন করা হত ‘আজ সারাদিন উৎসব’। বছর শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা হয়। সর্বোচ্চ পুরস্কার সনদপত্র সহ ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পুরস্কার’। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ১০ বছর পূর্তি উৎযাপনের পাশাপাশি ‘দিপ্ত’ নামের স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। সুনীল সাহিত্য ট্রাস্টের পক্ষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর সৃজনশীল গল্পের ওপর স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে। সদস্য ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে লেখা-লেখীর অভ্যাস ও উৎসাহ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২০০৭ খ্রি. থেকে প্রকাশিত হয় বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘ঊষা’।
আমৃত্যু সংগঠকের দায়িত্বে থাকা এ.টি.এম. কামালুজ্জামান ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ৯ নভেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। এর পর লিখন মাহমুদেকে সংগঠকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সজীব আহমেদ হন সমন্বয়ক। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ০৩ জুন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুরে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি কর্যক্রম চালু করে (১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রথমে চালু হয় দেশের চারটি বড় শহরে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে), প্রথম লাইব্রেরি কর্মকর্তা ছিলেন ত্রিদীপ অধিকারী দ্বীপ এবং ঐ বছর থেকে প্রতি মাসে অনুষ্ঠিত হয় পাঠচক্র - পাঠক আড্ডা। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে চলচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ২৬ মার্চ আয়োজিত হয় তিনদিন ব্যাপি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমান বই মেলা। এছাড়াও এখন নিয়োমিতভাবে প্রতি মাসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগীতা ও পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আমি এবং আমরা:
২০০০ খ্রিস্টাব্দে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর শাখার সদস্য হই। ২০০৫ - ০৬ খ্রিস্টাব্দে কর্মী, বই এবং কর্মসূচি সুষ্ঠভাবে পরিচালনার অভাবে কার্যক্রম স্থগিত ছিল। ২০০৬ খ্রি. কর্মী হিসেবে যুক্ত হয়েই বুঝতে পারি সবচেয়ে বড় সংকট ৮০% বই নাই অর্থাৎ হারিয়ে গেছে বা উদ্ধার হয়নি, বিগত তিন বছরের বইয়ের হিসাবসহ কোনো হিসাব-ই নেই। নতুন করে কার্যক্রম চালু করলে বই দরকার, ঢাকা কেন্দ্র থেকে হিসাব ছাড়া বই দিবে না, সংগঠকও বল্লেন কিছুই করার নেই। কর্মী ছিলাম আমি আর সজীব। আমাদের সাথে সাপোর্ট হিসেবে রাজিব ভাই ছিলেন, যদিও তিনি ২০০১ খ্রি. থেকেই কর্মী তবে হিসাব-নিকাশের কথা বলতে পরলো না। শেষে পরিত্যাক্ত ফাইল-কাগজপত্র খুঁজতে খুঁজতে ২০০১-০৫ পর্যন্ত অনুদ্ধারকৃত বই এর কিছু কার্ড পেলাম। আলমারি সংস্কার করে রেজিস্টার খাতায় সজীব সব হিসাব সংরক্ষন করে। পুরোনো বই উদ্ধারের পরিকল্পনা করি। এ পর্যায় কর্মী হয় হাসান ও কামরুল। এর মাঝে সপ্ন সোহাগ ভাই, রুদ্র সাইফুল সহ তাদের সাথে কয়েক জনের বেশ আনাগোনা দেখা গিয়েছিল, যদিও কয়েক সপ্তাহেই আবার হারিয়ে যায়। তবে সপ্ন সোহাগ ভাই বই উদ্ধারের প্রক্রিয়া আরো গতিশীল করেন। হঠাৎ অজানা করনে সজীব কাজ করবে না বলে জানায়। তবে আমি, হাসান ও কামরুল দৈনিক রুটিন করে মাদারিপুর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পায়ে হেটে বা কখনো রিকসায় বই উদ্ধারে ছুটে বেড়িয়েছি। হজিরহাওলা এলাকায় বই উদ্ধারে মিলনের সহযোগীতা চাইলে সে কর্মী হিসেবে যুক্ত হয়। ইতিমধ্যে সজীব পূনরায় সক্রিয় হয়। আমি, সজীব, হাসান, কামরুল ও মিলন সম্মিলিতভাবে দুই মাসের পরিশ্রমে প্রায় ১০০ বই (৫০%) উদ্ধারে সফল হই। আর ৩০% বই আমরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগত ভাবে সংগ্রহ করে বই এর পরিমান স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। এবার পুরোনো বইয়ের পরিবর্তে নতুন বই দেয় ঢাকা কেন্দ্র। এরপর নতুন কিছু সংস্কার করি যেমন: রাবার স্ট্যাম্প-প্যাড, ফাইল-পত্র, বইয়ের হিসাব, আয়-ব্যয়েরআয়-ব্যায়ের হিসাবসহ রেজিস্টার খাতার ব্যবহার। কর্মীদের জন্যও নতুন কিছু নিয়ম-কানুন, সুযোগ-সুবিধাসহ কর্মী অন্তর্ভূক্তি ফর্ম, আইডি কার্ড, সদস্য অন্তর্ভূক্তি ফর্ম ইত্যাদি ব্যবস্থা সম্পন্ন করি।
২০০৭ খ্রিস্টাব্দে নতুন রুপে কর্মসূচী শুরু করি। এপর্যায়ে রাজিব ভাই পুরোপুরি সক্রিয় হয়, কর্মী হয় তামিম ও রবিন ভাই। জেলা প্রশাসকের সহযোগীতা চাইলে তৎকালীন মাদারিপুর জেলা প্রশাসক জনাব নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়া অন্তর্ভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের সাথে স্বতঃসস্ফূরর্তভাবে আলোচনায় বসেন এবং কর্মসূচী সফল করতে নির্দেশনা প্রদান করেন। আমরা স্কুলে স্কুলে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাই। এ বছর শতাধিক শিক্ষার্থী বই পড়া প্রতিযোগীতায় সদস্য হয়। সদস্য শিক্ষার্থীদের মাঝে লেখা-লেখীর অভ্যাস সৃষ্টি ও উৎসাহ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘ঊষা’। বছর শেষে প্রায় ৬০ জন সদস্য মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। কর্মীদের উৎসাহ বৃদ্ধিতে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদপত্র এবং মূল্যায়ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫০ জন সদস্যদের মাঝে বই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আমরা ঐ বছরের জন্য কাঙ্খিত লক্ষ্য ও সফলাতা অর্জন করি। আর ঐ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পৌরসভা মেয়র সহ মাদারিপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন, যেখানে সংগঠক কামাল আঙ্কেল কর্মসূচী ও অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য আমাকে কৃতিত্ব প্রদান করেন ও পরিচয় করিয়ে দেন, যা ছিল আমার জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও ভালো অনুভূতি।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩৫৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৩/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast