আবার খনিকটা নষ্ট্যালজিক হয়ে
সেবার অনেকদিন পর দৈনন্দিন ব্যস্ততার মেঘ সরে একটুকরো মিঠে রোদ্দুর গায়ে মাখার বড় লোভ হয়েছিল। লোকে হয়তো বলবে-“ও মা লোভ বলিস কিরে? বল সাধ হয়েছিল।” আমি বলব-“তাতে কি! ওটার মধ্যে কেমন একটা আচার ছুরি করে খাওয়ার দুষ্টুমি আছে।” তখন হয়তো তারা আবার বলবে,“নিজের জিনিসে আবার লোভ করতে আছে?বাপের জম্মে শুনিনি তো...!!” নাহ্,এদের কারুর মাথায় আমার কথা ঢুকবে না। তাই মিছে তর্ক না বারিয়ে আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। তার চেয়ে বলি, দমফাটা মজার রঙ-এ গা ভেজাতে ইচ্ছে হয়েছিল।
ঠিক বোঝা গেলনা না? এতক্ষণের বিষয়বস্তুটার মূলচরিত্রটা কে? কাকে নিয়ে এতসব কল্পনা-যল্পনা? আরে বাবা সে তেমন অপরিচিত কেউ না, সে আমার-তোমার-সবার খুব কাছের একজন, আমাদের “সময়” বাবাজীবন। এবার সে হিরো না ভিলেন- সেটা অবশ্য তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ব্যক্ত করবে। যদিও কিছুদিন ধরে আমার জীবনের রঙ্গমঞ্চে সে দ্বিতীয় চরিত্রে অভিনয় করছিল অর্থাৎ রীতিমত মোচা গোঁফ পাকানো, সন্ডামার্কা ‘ভিলেন’-এর মতো নঙ্গর্থক ভূমিকায়। আরে মশাই কয়েকদিন ধরে আমাদের ফাইনাল exam চলছিল না? তা সে যেমন মাপের ছাত্র-ছাত্রীই হোক না কেন; পরীক্ষা, আবার সেটা যদি হয় ফাইনাল,তবে কার সাধ্য যে “সময়”-বাবাজীবনকে ‘হিরো’ চরিত্রে অভিনয় করায়! আমারও হয়েছিল একই হাল। পরীক্ষার tension-এ প্রায় নাওয়া-খাওয়ার chapter টা delete করার জোগাড়। আর ‘হিরো’র বেশধারী বেচারা আমার ‘সুসময়’ ঘরের কোনে বসে ধুঁকছিল, তারদিকে খেয়াল রাখারই সময় ছিল না।সে বছরই আমরা বন্ধুরা সবাই উচ্চমাধ্যমিকের জন্য যেযার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্কুলের সব পাঠ চুকিয়ে কলেজে ঢোকার তাড়াহুড়োটা তখন আসতে আসতে যেন কোন এক অদৃশ্য ইন্জেক্সানের মারফত আমাদের শিরায়-শিরায় মিশছিল, সেটা যথারীতি পরীক্ষা চলাকালীন ঠিক টের পাইনি। তখন যেন রুদ্ধশ্বাসে পরীক্ষার দিনগুলোর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে জীবনের এই অধ্যায়টির যথাযথ উপসংহারের জন্য মন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু শরীর তখন পরীক্ষার ব্যস্ততায় ছিল ‘ব্যস্ত’।
সেই ব্যস্ততায় ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে আমরা চারবন্ধু-আমি, মিনি, অঙ্গনা আর মাহালি সেদিনটার Planning-টা একদম পাক্কা করে নিয়েছিলাম। পরীক্ষার পর হাল্কা মেজাজে এটাই ছিল আমাদের প্রথম ‘মুলাকাত’। যদিও আয়োজনটা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই করা হয়েছিল, মাঝে পরীক্ষা পড়ে যাওয়ায় তোড়জোড়ে একটু ভাঁটা পড়েছিল, এই যা। দিনটা বেশ ভালোই কাটবে আশা করেছিলাম আগে থেকেই, কিন্তু এত্তটা হৈহল্লার মধ্যে দিয়ে, দমফাটা মজার ফুরফুরে মেজাজে কেটে যাবে যে, মন তখন সময়ের হিসাব রাখার গতানুগতিকতা ছেড়ে একটু বেহিসেবী হতে চাইবে…সেটা বোধহয় একদমই অনুমান করতে পারিনি। যাইহোক, সেদিনটার পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি তো রয়ে গেল মনের মাঝে, তবুও সময়ের প্রবাহে সে যদি কখনো ঝাপসা হয়ে যায় তাই এই লাইনগুলোর উপর সেদিনের মুহূর্তগুলোর সাক্ষি থাকার ভার দিলাম। তবে এর পিছনে আরেকটা ইচ্ছাও ছিল বৈকি, এইভাবে লেখার মধ্য দিয়ে হয়তো আবার আর একবার সেদিনের মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করা যাবে।
সেদিনের সূচনা হয়তো সকলের কাছে হয়েছিল সূয্যিমামার বাতি দেওয়ার সাথে,কিন্তু আগেরদিন রাতেই ‘সে’ এসে শুয়েছিল আমার পাশে…বেটা কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছিলনা! এপ্রসঙ্গে বলেনি, সেদিন আমি আমার ‘প্রতিদিনকার শয়নকক্ষে উপবিষ্ট হই নাই’।অঙ্গনা আর মাহালির বাড়ি যাব বলে আগের দিন বিকেলবেলাতেই দিদুনবাড়ি চলে এসেছিলাম। তাই বুঝি প্রতিদিনকার অলিখিত নিয়মকানুন গুলো অনেকটাই বেনিয়মে চলতে থাকায় ভিতরে-ভিতরে চরম অস্বস্তি এসে কানে, পিঠে, এমনকি পায়ের নিচে অবধি,‘ স্বস্তি’র ছিটে ফোঁটা অবশিষ্ট না রেখে ‘সুড়সুড়ি’ দেওয়ার বদমায়সি মতলবখানা এঁটেছিল। একে তো দিদুনবাড়ির অন্য বিছানার একটা অনভ্যস্ত অনুভূতি, তারউপর পাশে বুবু(দিদি) শুয়ে নেই যে, তাকে প্রতিদিনকার মতো বলব-“আমার দিকে ফিরে শো না plz, আমার ভয় করছে”...তার বদলে দিদুন আজ পাশে শুয়ে ‘ভোঁস-ভোঁস করে রাতের ঘুম দিচ্ছে’, স্বভাবত বলে দিতে হবে না যে, সে ঘুমের গাঢ়ত্ব ছিল কতখানি আর আমার ঘুমের বারোটা বেজেছিল কতখানি। আমার যদিও দিদুনের দিকে খেয়াল ছিলনা। চিন্তা হচ্ছিল অন্য অনেক কিছু নিয়ে.....দিদুন কাল সক্কালবেলা ডাকতে ভুলে যাবে না তো! আচ্ছা, alarm-টা ঠিক সময়ে বাজবে তো! alarm-এ am-pm টা ঠিকমতো দেখে set করেছি তো! এইসব আপদ-বিপদ গুলো আমার সেদিন রাতের ঘুমখানাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে অনেকক্ষন আমার সাথে ‘আড়ি’ করিয়ে রেখেছিল। প্রায় দু-বার বাথরুমে উঠেছিলাম আর তিন-চারবার জল খেতে, কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছিলামনা তো! তাই এটা-ওটা করে দেখছিলাম সময়ের গতি বাড়াতে পারি কিনা। ওদিকে পাজি ‘উদ্বিগ্নতা’টা দু’চোখের পাতা এক করে দেওয়ার বদলে উল্টোদিক থেকে যেন টেনে ধরেছিল। অগত্যা মাঝরাতে যা কখনোই করতে হয়নি এর আগে, সেই অপরাধটাই করতে হল। আহা, অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই, মোবাইল-এর রেডিওটা on করেনিলাম....ওফ। এখনই একটু melodramatic tone-এ কথা বলবার খামখেয়ালটা চাগাড় দিয়ে উঠল। একটু মার্জনা করে শুনেও না শোণা থুড়ি পড়েও না পড়ার ভান করে নেবেন নাহয়। ধুউ-উ-উৎ বাবা! এক্কে তো অর্ধেকের বেশি সেন্টার-এ টাওয়ার ছিল না, তারউপর যেটাতেও বা টাওয়ার ছিল সেটাতে ভাল গান দিচ্ছিলনা। এবার তখনকার মুড-টা পছন্দের গান গুলোকে অপছন্দদের বানাচ্ছিল কিনা ভগাই জানে। দু-তিনবার ঘুরিয়ে-টুরিয়ে শেষে মোবাইলটাই off করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।তারপর কখন জানিনা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,ঘুম ভেঙেছিল সকাল ‘সাড়ে পাঁচটায়’। অবাক লাগল তাইনা? আরে সকালবেলা প্রথমবার ঘড়িতে বড়কাঁটাটাকে পাঁচের ঘরে দেখে আমি একবার চোখটাকে ভাল করে কচলে পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম। আসলে তখন আমার সকালবেলাটা ন’টা-সাড়ে ন’টা হত কি না...তাই আরকি নিজের চোখকেই অবিশ্বাস হচ্ছিল। তাও সেবার আবার alam ছাড়াই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম। প্রকাশ করলে হয়তো আমার বীরত্ব আমায় নোবেল পুরষ্কারও এনে দিত পারত। ঘুম ভাঙলেও বিছানাটা ছাড়লামনা, বরং alarm টাকে আরও একবার check করে শুলাম প্রায় ঘণ্টা খানেকের জন্য। তখন সকাল সাতটা, দ্বিতীয়বারের মত ঘুমের বাক্যে দাঁড়ি টেনে, পৌনে আটটার মধ্যে সকালের যাবতীয় কাজ সেরে বসে পড়লাম টিভির সামনে। তবে মন তো তখন আর সেখানে ছিলনা? মন তখন সতর্ক কানদুটোর সাথে জোট বেঁধে মিনির একটা হাল্কা ডাকের আশায় চোখদুটোকে যেন কিছুক্ষন টিভি দেখবার নাটক করতে বলেছিল।
“কোয়েল...!!এই কোয়েল...”
হ্যাঁ,মিনির ডাকে পাশে রাখা ব্যাগটার প্রায় ড্যানা ধরে হুড়মুড় করে বেড়িয়ে দেখি সেও যথেষ্ট excited। তবে ও তো আর আমার মতো ‘ভুলক্কড়’ নয়, তাই এসেই বলে মাহালিকে মিসডকল দিতে। হ্যাঁ, তখন আবার বন্ধুদের ভিতর ‘missedcall’ দেওয়ার একটা মজার রীতি ছিল, যেটা কিনা তখনকার স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে নির্বাক সংযোগ স্থাপনে অনুগত ভূমিকা পালন করত, আর তার ইঙ্গিতের একটা আলাদা মাহাত্বও ছিল। একটার আলাদা মানে ছিল, আবার দুটোর আলাদা, আবার মিসডকল-এর রিপ্লাই-ও দেওয়া হত মিসডকল-এই। মিনি বলতে মনে পড়ল, সত্যিই তো মাহালিকে মিসডকল দেওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে এক্কেবারে উড়ে গেছিল। এরপর দিদুনবাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় ব্যাগ-বাগিচা সব সামলে প্রায় হোঁচট খেতে খেতে মাহালির ফোনে ‘ক্রিং ক্রিং’ বাজিয়ে উফ্ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ডায়মন্ড হারবারের রাস্তা বরাবর হেঁটে অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে, একটা ফাঁকা অটোর সামনের সিট দখল করে নিতে খুব একটা অসুবিধার হলনা। আর মিনি বসল পিছনের দিকে কোন-একটা সিটে। আসার পথে একজনের একটা কথা কানে এল-“বাবাআআআ! এরা সব কোথ্থেকে এ্যায়চে বল দিনি?” প্রথমে বিরক্তিকর লাগলেও পরে আশপাশের লোকজনদের দিকে তাকিয়ে আর তারপর নিজেকে দেখে বুঝতে পারলাম, এই উক্তিটাই হয়তো স্বাভাবিক। কারণ, সকলের মাঝে নিজেকে কিছুটা হলেও বেমানান ঠেকছিল।
তারপর ফলতাগামী অটোটাকে মিনিট পনেরোর সঙ্গী করে নামলাম বালিরমোড়, আমাদের গন্তব্যস্থল। দেখি মাহালি সাদার উপর নীল ফুলফুল করা একটা ফ্রকে দাঁড়িয়ে আছে স্টপেজে, বেচারীকে অনেকক্ষন দাঁড়াতে হয়েছিল, তাই তার চোখে-মুখে বেশ খানিকটা অপেক্ষা আর ক্লান্তি মিশ্রিত ভঙ্গি। তবে আমাদের দেখে যেন সেটা নিমেশের মধ্যে করপুরের মতো উবে গেল। এরপরের পথটার গাইড হল মাহালি। অবশ্য সেটা শুধু আমার কাছে কারণ মিনি এখানে আগেও এসেছিল। মাহালিটা খুব পাজি, আমার এই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ভুল-ভাল বাড়িকে দেখিয়ে বলছিল সেটা ওদের বাড়ি, ভুল-ভাল পথকে দেখিয়ে বলছে,“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওখান দিয়ে যা।” আবার এও বলছিল,“প্রচুর রাস্তা রে কোয়েল,একটু কষ্ট হবে তোর।” এই কথা শুনে সবেই একটা ভ্যান ভাড়া করতে যাব আর পাজিটা বলে উঠল,“ব্যাস্,এটাই আমাদের বাড়ি।”
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কারণ রোদ্দুরে ওভাবে হাঁটতে আমার মোটেও ভাল্লাগছিল না। আবার ওর আগের কিত্তি কলাপ থেকে ওর কথা ঠিক বিশ্বাসও হচ্ছিলনা। কিন্তু যখন দেখলাম ও সটান ঘরের ভিতর ঢুক যাচ্ছে তখন ওর পিছু নিলাম। ওদের বাড়ির পরিবেশ শান্ত নিরিবিলি প্রকৃতির,মানে লোকজনের গ্যাঞ্জাম নেই। ওদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, তাই ভেবেছিলাম কিছু জ্ঞাতি-গুষ্ঠির কটাক্ষ হয়তো অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু আমার সে অনুমানের কোনকিছুরই বাস্তবায়ণ হলনা, ওদের বাড়ির পরিবেশ আদৌ তেমন ছিল না। দেখি মেইন দরজায় মাহালির বাবা বসে পেপার পড়ছেন। ওনাকে প্রনাম করে, যাবতীয় সৌজন্য বিনিময়ের পর মাহালির ঘরে ঢুকে...উফ্!কি শান্তি।
গরমে এতটা হাঁটার পর,‘ছায়াঘন শান্তির নীড়ে পদার্পণ’ যেন সর্বকালের কল্পনীয় সেই সুধাপাত্রে সাঁতার দেওয়া অথবা সর্বাকাক্ষিত ‘স্বর্গসুখ’য়ের পরিতৃপ্তি দেওয়ার সমান। তুলনাটা একটু অতিরঞ্জিত হলে কিছু করার নেই,হ্যাঁ ?আমি সত্যিই সেদিন এতটাই খুশি হয়েছিলাম। শব্দগুলো একটু গুরুগম্ভীর ব্যবহার করায় আমার সাদাসিদে আবেগটিও ‘গুরুগম্ভীরতা’র কাগজে মোড়া হয়ে গেছে। মাহালি আমাদের জন্য ঘরোয়া মানে বাজারের কৃত্রিমতাহীন, নুন-লেবুর সরবৎ দিল। ঠিক তারপরই সিঙাড়া আর রসগোল্লারা হাজির। সকালে খেয়ে গেছিলাম,তারউপর সিঙাড়া আর মিষ্টি যে বিরাট স্থান দখল করেছিল জানতাম সে অধিকার তারা সহজে ছাড়তে চাইবেনা। এরপরই পেটপূজো সেরে মিনির আবদার-ও,খেঁজুর খাবে। মাহালি বলল-“ওরে খেঁজুর গাছ থেকে সদ্য পেড়ে খেঁজুর খাওয়ার মজাই আলাদা। তোরা যদি খুব ক্লান্ত না হয়ে থাকিস,তবে তোদের একটা জায়গায় নিয়ে যাব,যাবি?” আমি বললাম-“আর অঙ্গনা?” ও বলল-“ওর আসতে আসতে আমাদের ফিরে আসা হয়ে যাবে। ও বেরোনোর আগে missdcl দেবে বলেছে।”
মাহালির কথায় বাইরের ড্রেসটা পাল্টে দুটো ছাতা নিয়ে ওকে অনুসরণ করে হেঁটে চললাম। ধীরে ধীরে পথের আসেপাশের বাড়ির সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হল,শুরু হল মাঠ আর তার সাথে অসম্ভব নিচু নিচু খেঁজুর গাছের সারি। এরপর যত হাঁটতে লাগলাম তত বাতাসের প্রবাহ বাড়তে লাগল, ছাতা গুলো বন্ধ করতে হল, ওদিকে গায়ের ঘাম যেন কোথায় হল অদৃশ্য।হঠাৎই একটা ঝড়ের আওয়াজ কানে এলো। ভাবলাম...‘বাবা রে বাবা,এত খটখটে রোদে ঝড়ের আওয়াজ আসে কোথ্থেকে!!’ জিজ্ঞেস করতে জানলাম কাছেই ঝাউগাছের সারি ,বুঝলাম তারাই এই দৃশ্যে background music সংযোজনে কোনো খামতি রাখেনি। পথের মাঝে একটা ছোট্ট বটগাছকে দেখিয়ে মাহালি বলল, ওখানে নাকি অনেকে এসে পালিয়ে বিয়ে করেছে। আমি আর মিনি চোখ চাওয়াচায়ি করে মুচকি হাঁসলাম। হ্যাঁ,সেখানে একটু হলুদ-একটু সিঁদুর-একটু ফুল পাতা লতা পড়ে থাকতে দেখলাম। তারপরই শুধুমাত্র আমাদের ‘কর্ণেন্দ্রিয়ে’র সাহায্যে নয়, তার সাথে ‘দর্শণেন্দ্রিয়ে’র সাহায্যে ঝাউগাছের সারি প্রত্যক্ষ করলাম। আরে বাবা পাতি বাংলায় যাকে বলে, ঝাউগাছের সারি দেখতে পেলাম। আর দূর থেকে ঠিক করে নিলাম যে কোন দুটো গাছের মাঝখানে আমাদের এই ক্ষনিকের আড্ডাটা সারব। তবে জানিনা কাছে যেতে আমার বাছাই করা সাধের জায়গাটাকে আর চিনতে পারলামনা, সব জায়গা একই রকম লাগতে লাগল।
চারপাশের পরিবেশে একটা অসম্ভব সারল্য মিশে ছিল যেটা মনকে যেন কেমন একটা শান্ত মাদকতায় ভরিয়ে রেখেছিল। অন্যরা সেটার আঁচও পাচ্ছিল কিনা জানিনা...হয়তো পেতে চাইছিলনা। যদিও যেকোনো ভাললাগা,যেকোনো আবেগ,যেকোনো খামখেয়াল বড় বেশি আপেক্ষিক,যা আমার কাছে বড় আপন, বড় আদরের ;তা অন্যের কাছে ততটা কাছের নাও হতে পারে; সেটাই স্বাভাবিক। আর তাই তখনকার মতো মুখে তালাটি আটকে চাবিটাকে পকেটস্থ করাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল। এমনই এই প্রাকৃতিক মাদকতার যে আমি শিকার হয়েছিলাম পুরোদস্তুর, যার প্রমান রাখতে মোবাইল বের করে ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ এদিক-ওদিক নানা দিকের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে স্মৃতিটাকে মোবাইল বন্দি করতে চাইলাম, অবশ্য কিছুটা বাধ্য হয়েই ছবিগুলোর মধ্যে এর xerox copy-র মতো কিছু একটাকে রেখে দিয়ে আসল স্মৃতি গুলোকে সেদিনের আকাশে, সেদিনের বাতাসে, সেদিনের ঝাউগাছের পাতার ফাঁকে, মাটির রাস্তার বাঁকে ছড়িয়ে দিয়ে এলাম। সেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আসার সাধ হলেও ক্ষমতা ছিল না বোধহয়।
তারপর মনের আস মিটিয়ে শরীর ও মনে খানিকটা ক্লান্তি অনুভূত হতে গাছের নীচে একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম আর স্কুল জীবনের স্মৃতি, বর্তমানের নানা ভালোলাগা-মন্দলাগা, একটু-আদটু PNPC চলতে লাগল। তখনই মাহালির সেলে অঙ্গনার mmsdcl, বুঝলাম ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে; অন্তত পূর্বনির্ধারিত হিসেব তো তাই বলে। এবার তবে ১৫মিনিট পর বাসস্টপে দাঁড়ালেই হবে। তাই নিশ্চিন্ত আমরা আরও মিনিট খানেকের জন্য আড্ডাটা চালু রাখলাম। যদিও আড্ডার চাকা বেশি পথ গড়াতে পারল না , কারণ এক-দু’মিনিট পরই মাহালির সেলে অঙ্গনার ফোন। জানতে পারলাম ও বেচারি কাজটাজ সেরে হন্তদন্ত হয়ে মাহালির বাড়ি পৌঁছে কাউকে দেখতে না ঠোঁটের গোড়ায় বেশ খানিকটা অভিমান জমিয়েছে। সেটা যদিও মাহালিকে repeat করতে হল না। কারণ ফোনের ওদিকে আসা অভিমানী আঙ্গনার উচ্চইস্বরে বাক্যালাপ কানে রিতিমত ‘চড়থাপ্পড়’ মাড়ছিল, ফোন loudspeaker-এ রাখার দরকারই পড়েনি। কিন্তু গোটা ব্যাপার কিকরে সম্ভব হল সেটা বুঝে উঠতে পারলামনা...সবেমাত্র গাড়িতে উঠে ১৫মিনিটের রাস্তা ৩/৪মিনিটে শেষ করে কিভাবে মাহালিদের বাড়ি পৌঁছাল সেটাই রহস্যের। যদিও ওদের বাড়ি গিয়ে প্রথমে অঙ্গনার অভিমান মিশ্রিত রাগ ভাঙাতে লাগলাম, গিয়েই প্রথমে প্রশ্নের পসরা খোলা যায়? তাতে তো অভিমান ভাঙার বদলে সে বেটা জমপেস করে ঘাঁটি গেড়ে বসত আর আমাদের সেদিনের মজা এক্কেবারে ডকে। ওকে জিজ্ঞেস করে একটা ছোট্ট missuderstanding-এর ঘটনা-বিভ্রাট এর পিছনে থাকার সাক্ষপ্রমান পেলাম। missdcl টা ও স্টপেজে নেমেই দিয়েছিল যেটা কিনা নির্বাক missdcl আমাদের বলে উঠতে পারেনি। তাই এটা জানামাত্র তৎখনাৎই আমাদের কুন্ঠাবোধ আর অঙ্গনার অভিমান হল ‘ছু মনতর’।
তারপরই অঙ্গনা আসার উপলক্ষে আমাদের, মানে আমার আর মিনির দ্বিতীয় দফার ভোজন পর্ব শুরু হল। খাওয়া-দাওয়া সেরে অঙ্গনা বাইরের জামা বদলে আমার দলে যোগ দিল। হ্যাঁ এটা ঠিক চার বন্ধুর মাঝখানে ড্রেসভিত্তিক একটা বিভাজন চোখে পড়ল, কেবল আমার চোখেই কিনা জানিনা অবশ্য। সেটা হল এই যে, আমি-অঙ্গনা টপ আর টাইটস, ওদিকে মাহালি-মিনি একই স্টাইলের ফ্রক। স্বভাবতই ড্রেস বিভাজনের সাথে কাদের-কাদের মনের মিল বেশি সেটা পরিষ্কার হল, আবার যদিও একইভাবে আমার ক্যামেরার ফোকাসে। এরপর আমরা সবাই আবার সেই ঝাউবনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। স্বভাবত এবারের রাস্তাটা আগের থেকে ছোট বলে মনে হল। প্রাণ ভরে আড্ডা দিলাম, যাকে বলে ‘চুটিয়ে আড্ডা’। সব গল্প সেরে সকলের মনের আশ মিটতে মিটতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। ঘড়ির দিকে দেখে মন ততটা তাড়া না দিলেও পেটের ছুঁচোগুলো লম্ফঝম্ফ করে অপ্রকাশ্যে সাইরেন বাজিয়ে দিল। আমি কোনদিনই তেমন পেটুক ছিলাম না, তবু তো পুরদস্তুর খাদ্যরশিক ছিলাম নাকি...এমনকি এখনও আছি। তারউপর মাঝখানে একমনে চলতে থাকা জমাটি আড্ডার সময়ের দিকে খেয়াল রাখার সুযোগই দেয়নি, আর নিজেদের অজান্তে শরীরের ক্লান্তি পেটের ভিতর আনেকখানি ফাঁকা জায়গা করে ফেলেছিলাম, তাই সেখানে শুধু ডাল-ভাত খেলেই ব্যাপারটা খাসা হয়ে যেত। এই রকম মানসিক ও শারীরিক পরিস্থিতিতে মাহালির বাড়ি এসে দেখি বাবারে বাবা...সে তো যেন বিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছি। কিচ্ছু বাদ নেই...নিরামিশ তরি- তরকারি,ডাল,মাছ,মাংস,দই-মিষ্টি। আমি বাবা যতটা পারলাম ততটা পেটে পুরে ধূপধুনো ছাড়াই ‘পুজো’ শেষ করলাম। তারপর মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়-প্রথমে আমি, তারপর অঙ্গনা, মিনি আর শেষে মাহালি। অঙ্গনা তখন নিজের ডাইরিটা খুলে আমাদের স্কুল থেকে সুন্দরবন বেরানোর গল্পটা বলছিল, মাহালি মাঝেমাঝে ফোড়ন কাটছিল আর মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আমার চোখ ছিল ওর ডাইরির লাইন গুলর উপর।
হঠৎই ঘড়িতে চোখ পরল, দেখি সাড়ে তিনটে; প্রায় পৌনে চারটে বেজে গেছে। মিনি বলল, এবার তৈরি হয়ে নিতে হবে। কারন ও জানত, মাহালির সাজতে কত সময় নেবে। প্রথমটা আমরা আর দু’জন বুঝতে পারলাম না, তাই আরও খানিকটা শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হল। ওদিকে মাহালি cold-drinks আনল, আমার খেয়ে কিছুটা বেশি হল। যেটা বোধহয় মিনি খেয়েনিল। যদিও এই দৃশ্যটা এখন ভাবাই যায়না, বরং এর উল্টোটা হলে অর্থাৎ মিনির cold-drinks বেশি হচ্ছে আর আমি সেটা ঢকঢক করে সাবাড় করছি; সেটাই আমার পরিচিত মহলে বিশ্বাসযোগ্য হবে। এবার শুরু হল মিনির সতর্ক করে দেওয়ার অধ্যায়...অর্থাৎ মাহালির সাজাগোজার সময়ব্যাপ্তির সাথে আমাদের পরিচিতি-পর্ব। হম্, মিনি ভুল কিছু বলেনি-মাহালি সাজতে ভালই সময় নেয়। এই সাজাগোজার প্রসঙ্গে আমার সমর্থন সবার আগে। শুধু বিষয়টা হল, মাহালির মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের কাছে এতটা সাজগোজ আশা করিনি, তাই আমার সাজা শেষ করে ওকেই দেখছিলাম। ও দেখি চোখের উপরে-নিচে শৌখিন ভাবে eyeliner-টা পড়ল, চুলটাকে একটু উঁচু করে horse-tail করল,কানে matching দুল পরে; শেষে মিনির আনা lipstick টা লাগিয়ে তবে হল ওর সাজাগোজায় ইতি। lipstick-টায় যদিও আমরা সবাই ভাগ বসালাম। বেরনোর আগে ভালো করে একবার দেখে নিলাম; কিছু ফেলে যাচ্ছি না তো আবার! না না, আমার এই ভাব-গতিক দেখে আময় খুবই একটা সাবধানি মেয়ে ভাবার কোন কারণ নেই। কেননা সেটা আমি মোটেই সেটা নই, বরং সেদিনের সেই সাবধানতাটা আগে থাকলে প্রতিবার বন্ধু বা আত্মীয়দের বাড়িতে কিছু-না-কিছু ফেলে আসার বদভ্যেসটা থাকতনা। আজ্ঞে হ্যা, আমি বরাবর নিজের নিন্দেটা নিজেই করতে ভালবাসি; যাতে অন্যরা বেশি করার সুযোগ না পায়। যাইহোক, দেখে তো তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তাই বেশি দেরি না করে, দুটো ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। এবার mission অঙ্গনাদের বাড়ি আক্রমণ; তাও আবার বাড়ির মেয়েকে সাথে নিয়ে, বাড়ির লোককে জানিয়ে। কেউ ভেবেছে কখনো? এ তো দিন-দুপুরে ডাকাতি! বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ কালো করে ঘোর হয়ে এসেছে। ভাবলাম নিরঘাত আজকের বেরানোটা ভণ্ডুল হল বলে। যা ভেবেছি তাই; বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি-মহাশয়ের নাচাগানা শুরু, এক্কেবারে উচ্চই স্বরে গান আর ধেইধেই করে নেত্ত। না না কেলেঙ্কারি টা হয়নি, বড়বড় ফোঁটা শুরু হাওয়ার আগেই আমরা ভিতরে ঢুকে গেছিলাম। তাই জামা কাপড়ে একটু খানি জলের ফোঁটা মিশলেও ভিজে কাকচান করিনি সেটাই রক্ষে। আগত্যা কিছুক্ষনের আপেক্ষাটা মেনে নিতে হল, তবে এই হাতপা বাঁধা আবস্থা কিন্তু মোটেও শুধু বৃষ্টির কারণে ছিলনা। বাসস্ট্যণ্ডে বোধহয় মানুষ বাসের জন্যেও অপেক্ষা করে, সেটা ভুলে গেলে চলবে? যদি ভুল না হই তবে ওটা বাসের জন্য আপেক্ষা করার কারণেই বানানো। সেবার যদিও সেই অপেক্ষায় ‘বৃষ্টি থামার’ অপেক্ষাও মিশে গেছিল; সেটাই হয়ত জায়গাটাকে সাময়িক ভাবে ‘বৃষ্টি-স্ট্যাণ্ড’ করে দিয়েছিল।
এর ঠিক খানিক পরই এল অপেক্ষায় পূর্ণচ্ছেদ টানার পালা। যদিও সেটা আংশিক...কারণ খানিক বাদে শুধু বাস এলো; কিন্তু বৃষ্টি থামার লক্ষণই দেখছিলাম না। তাই বাসের জন্য অপেক্ষাকে বিদায় জানিয়ে, বৃষ্টি থামার অপেক্ষার ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। ওদিকে বৃষ্টি থামার তো নাম- গন্ধ তো নেই উপরন্তু বাসে ওঠার পর যেন মনে হল জলের বেগ আর বাড়ল। তবে ঠিক সময়ে বাসে যখন উঠে পড়েছিলাম তখন নিশ্চিন্ত, চিন্তাটা নাহয় নামবার সময় করার জন্য ছেড়েদিলাম। তারপরের দশ-পনেরো মিনিটটা যেন কয়েক সেকেন্ডের মতো কেটে গেল; বন্ধুরা একসাথে যা হয় আরকি...নতুন জায়গা, চারপাশে নতুন সব দৃশ্য; বন্ধুদের আড্ডার গল্প কমতে লাগল আর ওদিকে চারপাশে কলকারখানার সংখ্যা লাগল বাড়তে, তারসঙ্গে বাতাসে chemical-এর দমবন্ধ করা গন্ধ। আমার আর মিনির সাথে আঙ্গনারাও তাদের প্রতিদিনের চেনা আশপাশটাকে যেন আবার করে দেখতে লাগল। তাদের কাছে হয়তো বাস থেকে দেখা প্রতিদিনের ছবি গুলো আগের মতোই ছিল কিন্তু আমাদের সঙ্গ যে সেগুলোকে নতুনত্ব মাখিয়েছিল, সেটা তাদের চোখের দৃষ্টিই স্পস্তভাবে বুঝিয়েছিল। সে চাওনি তো প্রতিদিন কার গড়পরতা চাওনি নয়। এরপর এক জায়গায় বাস থামল। একটু হেঁটেই চোখে পড়ল ১নং সেক্টারের গেট। ওখানের গার্ড প্রথমে আমদের তিনজনকে নতুন দেখে,“আপনারা কোথ্থেকে আসছেন?”,“কোথায় যাবেন?”...এই সব official প্রশ্ন করতে লাগলেন। হয়তো তিনি তখনও আঙ্গনাকে দেখেননি। শেষে বেপারটা আঙ্গনা সামলে নিয়ে বলল, “ওরা আমার সাথে।” গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আঙ্গনাকে আনুসরণ করে হেঁটে চললাম। চারদিকে দেখতে দেখতে চলতে লাগলেও কম-বেশি সকলের মন ছিল একই দিকে-কখন, কোথায় আঙ্গনাদের বাড়ি আসবে। শেষমেশ দেখলাম গেট থেকে বেশ অনেকটা ভিতরেই ওদের কোয়ার্টার, সব বাড়িগুলো একই ধাঁচের, official কোয়ার্টার যেমন হয়। তাও সব বাড়ির মধ্যে কোনটা ওদের বাড়ি; সেটা বোঝা তেমন একটা কঠিন কাজ ছিলনা। কারণ একটা বাড়ির সামনে অঙ্গনার মা চেয়ারে বসে ছিলেন। ওদের বাড়ির দুটো কামরা; একটা ঘরে টিভি যেটা দেখলে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, ওটা আঙ্গনার পড়ার ঘর হতে পারে না। তাও কোন কথা খুঁজে না পেয়ে প্রশ্নটা করেই বসলাম যে ওটা কার ঘর এবং যথারীতি জানা উত্তরটাই পেলাম। তার কিছু পরই ওর দিদির মারফৎ শরবতের গ্লাসেরা এসে হাজির, যেগুলো আনার সঙ্গে সঙ্গেই সকলের হাতে উঠে গেল। সবেমাত্র “cheers” করতে যাব ওমনি মিনির মুচকি হাঁসিতে ওর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাটা আনামাত্রই প্রায় অর্ধেক গ্লাস ফাঁকা করে দিয়েছে। তাও এই নিয়মভঙ্গের ত্রুটিতে ‘মার্জনা’ টেনে cheers করার বাসনায় ছন্দপতন করলাম না। নিমেশে খালি গ্লাসও ফেরত দেওয়া হল। এরপরই একটা ট্রে-তে এল দই আর তার সাথে পাঁচ-ছ’জন ‘মিষ্টি’ নামক সাঙ্গপাঙ্গ। সেগুলো থেকে আমরা যে যার পছন্দ মতো, কেউ শুধু দই, কেউ শুধু মিষ্টি,কেউ দুটোই...আবার কেউ দুটো থেকে একটু-একটু করে দই- মিষ্টি তুলে নিলাম। এরই মাঝে হঠাৎ কোন কুক্ষণে আমি বলে ফেললাম যে আমি দই খেতে ভালবাসি! ওমনি ব্যাস, আমার আর রক্ষে থাকে? আন্টি তখন মাহালির না খাওয়া দইয়ের বাটি থেকে কিছুতা দই আমার ট্রে-তে তুলে দিল। ইচ্ছে আর অনিচ্ছের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় দইটা খেয়েনিলাম। তাতেও শেষ হল না, আন্টি-র কথাতেই আর একটা কাঁচাগোল্লা খেতে হল। পেট পুজোর পর্ব শেষ, তারপরই আঙ্গনার দিদি আমাদের চারজন বন্ধুর একটা ছবি তুলল। আলাদা করে আমার ছবিটা তেমন ভালো এলোনা। কিন্তু আর সকলের ভালো আসায় আমি আর এতে negative কিছু বললাম না। এর ঠিক পরের ঘটনাগুলো যেন ঘটেছিল বইয়ের সেসব পাতাগুলোর মতো, যাদের থাকাটা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয় বরং অনেকটাই যুক্তিসঙ্গত, তবে ওই আরকি বইয়ের আর-সকল পাতাগুলো মারফৎ আসল ‘রসস্বাদন’ পর্বের সমাপ্তির পরেও বাকি পরে থাকা পাতাগুলোর রং কেমন অনিচ্ছাকৃতভাবে ফিকে হয়ে যায়, তেমনই একটা ভাব। মানেটা খুবই সরল, এরপরে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা সেদিনের সকাল হাওয়ার সাথেসাথে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর অভিনবত্বের সাথে মোটেও পাল্লা দিতে পারেনি, আগের মুহূর্তগুলোর সাথে তালে তাল মেলানো ঘটনারাশি শুধু পেরেছিল সেদিনের খোলা বইয়ের গড়-পড়তা সাধারণ পাতার মাঝে হারিয়ে যেতে, সাধারণের মাঝে আসাধারণ হয়ে ওঠার ক্ষমতা কিছুজনেরই থাকে। যথারীতি আড়ম্বরে কোনরকম ত্রুটি না রেখে, আমরা চার বন্ধু অঙ্গনার মা আর দিদির সাথে ভ্যানে করে সারা জায়গাটা ঘুরলাম, দারুণ সব অভিজ্ঞতা হল। সময়টা সত্যিই যেন কেটে গেল একনিমেষে। এই সময় কাটার ধরণ থেকে বোঝাযায় শেষেরগুলো কতটা উপভোগ্য ছিল, অন্যথায় শেষের ওই ক’ঘণ্টাকে মনে হত র্দীঘায়তনের এক মন খারাপকরা বিকেল, যেটা যেন কাটতেই চায়না। এরপরই কখন যেন সূয্যিমামা পশ্চিম আকাশে ‘কালো’ জলে ডুব-সাঁতার দিল, ঘড়িতে ৬টা বাজিয়ে; আর আমরা সেই নীরব র্দশকের আসনে চুপটি করে বসে রইলাম। না না এমন কিছু ভাবার কারণ নেই যে বোধহয় “সুয্যি গেল পাটে, তো সেদিনের পরিকল্পনা সব উঠল লাটে”...সত্যিই তেমন কিছু হয়নি সেদিন। সন্ধ্যে হওয়ার বেশ কিছু সময় আগেই আমরা সবাই অঙ্গনাদের বাড়ি চলে গেছিলাম। বাইরের আলো নেভাটা বরং মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, এবার আমাদের বাড়ির জন্য বেরোতে হবে। তখনই একে একে সকলকে বিদায় জানিয়ে আমরা তিনজন যেযার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরলাম, নাহ্ গুনতিতে একদম ভুল হয়নি আমার,কারণ অঙ্গনা বাস অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিল মাত্র। শেষের পথটুকু যে যতটা পারলাম মন ভোরে গল্প করেনিলাম, কিন্তু সে গপ্লের ঝুড়ি যেন খালি হওয়ারই নয়। আসতে আসতে পথ শেষ হয়ে আমাদের তিনজনকে লাল বাসগুলোর কাছে পৌঁছে দিল। বাসে উঠে দেখি বেশিরভাগ সিট রিজার্ভড, তখন চটপট তিনটে খালি সিটকে রিজার্ভ করে ফেললাম। অঙ্গনা শেষের কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গ দিল, তারপর যখন বাস ছাড়ার তোড়জোড় করতে লাগল ও তখন নেমে গেল, আর বলল, “সাবধানে যাস।” আমরাও মাথা নাড়লাম আর ও নেমেগেল। ও ব্যাটা এমন গাধা, কথাটা বলেই আমাদের দিকে পিছন ঘুরে বাস থেকে নেমে পড়ল। ওর গাধামির জন্য শেষবারের মতো ওকে দেখতেও পেলামনা। তখন বুঝিনি এখন অনুতাপ হয়, তখন কি আর জানতাম যে বেশ কয়েক বছর পরে মুখখানা দেখতে পাব! তখন ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে আমদের স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেছে, মনে হয়েছিল কালই তো স্কুলে ওর সাথে দেখা হবে। বাকি রাস্তাটা অর্থাৎ বালিরমোড় অবধি তিনজন একনাগাড়ে বিজ্ঞের মতো বকবক করে কাটালাম। মাঝে মাহালি নেমে গেল। তখন বাসে একরাশ অচেনা মুখের ভিড়ে আমার একটাই চেনা মুখ- মৃন্ময়ী। অফ্! এতক্ষন পর ওর ভালো নাম ধরে ডাকলাম, আসলে বন্ধুমহলে ওর সাথে ওর ডাকনামটা এত সতঃস্ফূর্তভাবে যায় যে, ‘ভাল’ নামটা যাবতীয় official কাজকর্মের জন্য তোলা থাকে। গাড়ির স্পীড একই থাকলেও স্বভাববসত পরের রাস্তাটা তাড়াতাড়িই শেষ হয়েগেল। আমরা দু’জন একসাথে নামলাম ২৪৬ মোড়।
ঠিক বোঝা গেলনা না? এতক্ষণের বিষয়বস্তুটার মূলচরিত্রটা কে? কাকে নিয়ে এতসব কল্পনা-যল্পনা? আরে বাবা সে তেমন অপরিচিত কেউ না, সে আমার-তোমার-সবার খুব কাছের একজন, আমাদের “সময়” বাবাজীবন। এবার সে হিরো না ভিলেন- সেটা অবশ্য তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ব্যক্ত করবে। যদিও কিছুদিন ধরে আমার জীবনের রঙ্গমঞ্চে সে দ্বিতীয় চরিত্রে অভিনয় করছিল অর্থাৎ রীতিমত মোচা গোঁফ পাকানো, সন্ডামার্কা ‘ভিলেন’-এর মতো নঙ্গর্থক ভূমিকায়। আরে মশাই কয়েকদিন ধরে আমাদের ফাইনাল exam চলছিল না? তা সে যেমন মাপের ছাত্র-ছাত্রীই হোক না কেন; পরীক্ষা, আবার সেটা যদি হয় ফাইনাল,তবে কার সাধ্য যে “সময়”-বাবাজীবনকে ‘হিরো’ চরিত্রে অভিনয় করায়! আমারও হয়েছিল একই হাল। পরীক্ষার tension-এ প্রায় নাওয়া-খাওয়ার chapter টা delete করার জোগাড়। আর ‘হিরো’র বেশধারী বেচারা আমার ‘সুসময়’ ঘরের কোনে বসে ধুঁকছিল, তারদিকে খেয়াল রাখারই সময় ছিল না।সে বছরই আমরা বন্ধুরা সবাই উচ্চমাধ্যমিকের জন্য যেযার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্কুলের সব পাঠ চুকিয়ে কলেজে ঢোকার তাড়াহুড়োটা তখন আসতে আসতে যেন কোন এক অদৃশ্য ইন্জেক্সানের মারফত আমাদের শিরায়-শিরায় মিশছিল, সেটা যথারীতি পরীক্ষা চলাকালীন ঠিক টের পাইনি। তখন যেন রুদ্ধশ্বাসে পরীক্ষার দিনগুলোর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে জীবনের এই অধ্যায়টির যথাযথ উপসংহারের জন্য মন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু শরীর তখন পরীক্ষার ব্যস্ততায় ছিল ‘ব্যস্ত’।
সেই ব্যস্ততায় ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে আমরা চারবন্ধু-আমি, মিনি, অঙ্গনা আর মাহালি সেদিনটার Planning-টা একদম পাক্কা করে নিয়েছিলাম। পরীক্ষার পর হাল্কা মেজাজে এটাই ছিল আমাদের প্রথম ‘মুলাকাত’। যদিও আয়োজনটা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই করা হয়েছিল, মাঝে পরীক্ষা পড়ে যাওয়ায় তোড়জোড়ে একটু ভাঁটা পড়েছিল, এই যা। দিনটা বেশ ভালোই কাটবে আশা করেছিলাম আগে থেকেই, কিন্তু এত্তটা হৈহল্লার মধ্যে দিয়ে, দমফাটা মজার ফুরফুরে মেজাজে কেটে যাবে যে, মন তখন সময়ের হিসাব রাখার গতানুগতিকতা ছেড়ে একটু বেহিসেবী হতে চাইবে…সেটা বোধহয় একদমই অনুমান করতে পারিনি। যাইহোক, সেদিনটার পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি তো রয়ে গেল মনের মাঝে, তবুও সময়ের প্রবাহে সে যদি কখনো ঝাপসা হয়ে যায় তাই এই লাইনগুলোর উপর সেদিনের মুহূর্তগুলোর সাক্ষি থাকার ভার দিলাম। তবে এর পিছনে আরেকটা ইচ্ছাও ছিল বৈকি, এইভাবে লেখার মধ্য দিয়ে হয়তো আবার আর একবার সেদিনের মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করা যাবে।
সেদিনের সূচনা হয়তো সকলের কাছে হয়েছিল সূয্যিমামার বাতি দেওয়ার সাথে,কিন্তু আগেরদিন রাতেই ‘সে’ এসে শুয়েছিল আমার পাশে…বেটা কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছিলনা! এপ্রসঙ্গে বলেনি, সেদিন আমি আমার ‘প্রতিদিনকার শয়নকক্ষে উপবিষ্ট হই নাই’।অঙ্গনা আর মাহালির বাড়ি যাব বলে আগের দিন বিকেলবেলাতেই দিদুনবাড়ি চলে এসেছিলাম। তাই বুঝি প্রতিদিনকার অলিখিত নিয়মকানুন গুলো অনেকটাই বেনিয়মে চলতে থাকায় ভিতরে-ভিতরে চরম অস্বস্তি এসে কানে, পিঠে, এমনকি পায়ের নিচে অবধি,‘ স্বস্তি’র ছিটে ফোঁটা অবশিষ্ট না রেখে ‘সুড়সুড়ি’ দেওয়ার বদমায়সি মতলবখানা এঁটেছিল। একে তো দিদুনবাড়ির অন্য বিছানার একটা অনভ্যস্ত অনুভূতি, তারউপর পাশে বুবু(দিদি) শুয়ে নেই যে, তাকে প্রতিদিনকার মতো বলব-“আমার দিকে ফিরে শো না plz, আমার ভয় করছে”...তার বদলে দিদুন আজ পাশে শুয়ে ‘ভোঁস-ভোঁস করে রাতের ঘুম দিচ্ছে’, স্বভাবত বলে দিতে হবে না যে, সে ঘুমের গাঢ়ত্ব ছিল কতখানি আর আমার ঘুমের বারোটা বেজেছিল কতখানি। আমার যদিও দিদুনের দিকে খেয়াল ছিলনা। চিন্তা হচ্ছিল অন্য অনেক কিছু নিয়ে.....দিদুন কাল সক্কালবেলা ডাকতে ভুলে যাবে না তো! আচ্ছা, alarm-টা ঠিক সময়ে বাজবে তো! alarm-এ am-pm টা ঠিকমতো দেখে set করেছি তো! এইসব আপদ-বিপদ গুলো আমার সেদিন রাতের ঘুমখানাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে অনেকক্ষন আমার সাথে ‘আড়ি’ করিয়ে রেখেছিল। প্রায় দু-বার বাথরুমে উঠেছিলাম আর তিন-চারবার জল খেতে, কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছিলামনা তো! তাই এটা-ওটা করে দেখছিলাম সময়ের গতি বাড়াতে পারি কিনা। ওদিকে পাজি ‘উদ্বিগ্নতা’টা দু’চোখের পাতা এক করে দেওয়ার বদলে উল্টোদিক থেকে যেন টেনে ধরেছিল। অগত্যা মাঝরাতে যা কখনোই করতে হয়নি এর আগে, সেই অপরাধটাই করতে হল। আহা, অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই, মোবাইল-এর রেডিওটা on করেনিলাম....ওফ। এখনই একটু melodramatic tone-এ কথা বলবার খামখেয়ালটা চাগাড় দিয়ে উঠল। একটু মার্জনা করে শুনেও না শোণা থুড়ি পড়েও না পড়ার ভান করে নেবেন নাহয়। ধুউ-উ-উৎ বাবা! এক্কে তো অর্ধেকের বেশি সেন্টার-এ টাওয়ার ছিল না, তারউপর যেটাতেও বা টাওয়ার ছিল সেটাতে ভাল গান দিচ্ছিলনা। এবার তখনকার মুড-টা পছন্দের গান গুলোকে অপছন্দদের বানাচ্ছিল কিনা ভগাই জানে। দু-তিনবার ঘুরিয়ে-টুরিয়ে শেষে মোবাইলটাই off করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।তারপর কখন জানিনা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,ঘুম ভেঙেছিল সকাল ‘সাড়ে পাঁচটায়’। অবাক লাগল তাইনা? আরে সকালবেলা প্রথমবার ঘড়িতে বড়কাঁটাটাকে পাঁচের ঘরে দেখে আমি একবার চোখটাকে ভাল করে কচলে পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম। আসলে তখন আমার সকালবেলাটা ন’টা-সাড়ে ন’টা হত কি না...তাই আরকি নিজের চোখকেই অবিশ্বাস হচ্ছিল। তাও সেবার আবার alam ছাড়াই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম। প্রকাশ করলে হয়তো আমার বীরত্ব আমায় নোবেল পুরষ্কারও এনে দিত পারত। ঘুম ভাঙলেও বিছানাটা ছাড়লামনা, বরং alarm টাকে আরও একবার check করে শুলাম প্রায় ঘণ্টা খানেকের জন্য। তখন সকাল সাতটা, দ্বিতীয়বারের মত ঘুমের বাক্যে দাঁড়ি টেনে, পৌনে আটটার মধ্যে সকালের যাবতীয় কাজ সেরে বসে পড়লাম টিভির সামনে। তবে মন তো তখন আর সেখানে ছিলনা? মন তখন সতর্ক কানদুটোর সাথে জোট বেঁধে মিনির একটা হাল্কা ডাকের আশায় চোখদুটোকে যেন কিছুক্ষন টিভি দেখবার নাটক করতে বলেছিল।
“কোয়েল...!!এই কোয়েল...”
হ্যাঁ,মিনির ডাকে পাশে রাখা ব্যাগটার প্রায় ড্যানা ধরে হুড়মুড় করে বেড়িয়ে দেখি সেও যথেষ্ট excited। তবে ও তো আর আমার মতো ‘ভুলক্কড়’ নয়, তাই এসেই বলে মাহালিকে মিসডকল দিতে। হ্যাঁ, তখন আবার বন্ধুদের ভিতর ‘missedcall’ দেওয়ার একটা মজার রীতি ছিল, যেটা কিনা তখনকার স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে নির্বাক সংযোগ স্থাপনে অনুগত ভূমিকা পালন করত, আর তার ইঙ্গিতের একটা আলাদা মাহাত্বও ছিল। একটার আলাদা মানে ছিল, আবার দুটোর আলাদা, আবার মিসডকল-এর রিপ্লাই-ও দেওয়া হত মিসডকল-এই। মিনি বলতে মনে পড়ল, সত্যিই তো মাহালিকে মিসডকল দেওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে এক্কেবারে উড়ে গেছিল। এরপর দিদুনবাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় ব্যাগ-বাগিচা সব সামলে প্রায় হোঁচট খেতে খেতে মাহালির ফোনে ‘ক্রিং ক্রিং’ বাজিয়ে উফ্ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ডায়মন্ড হারবারের রাস্তা বরাবর হেঁটে অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে, একটা ফাঁকা অটোর সামনের সিট দখল করে নিতে খুব একটা অসুবিধার হলনা। আর মিনি বসল পিছনের দিকে কোন-একটা সিটে। আসার পথে একজনের একটা কথা কানে এল-“বাবাআআআ! এরা সব কোথ্থেকে এ্যায়চে বল দিনি?” প্রথমে বিরক্তিকর লাগলেও পরে আশপাশের লোকজনদের দিকে তাকিয়ে আর তারপর নিজেকে দেখে বুঝতে পারলাম, এই উক্তিটাই হয়তো স্বাভাবিক। কারণ, সকলের মাঝে নিজেকে কিছুটা হলেও বেমানান ঠেকছিল।
তারপর ফলতাগামী অটোটাকে মিনিট পনেরোর সঙ্গী করে নামলাম বালিরমোড়, আমাদের গন্তব্যস্থল। দেখি মাহালি সাদার উপর নীল ফুলফুল করা একটা ফ্রকে দাঁড়িয়ে আছে স্টপেজে, বেচারীকে অনেকক্ষন দাঁড়াতে হয়েছিল, তাই তার চোখে-মুখে বেশ খানিকটা অপেক্ষা আর ক্লান্তি মিশ্রিত ভঙ্গি। তবে আমাদের দেখে যেন সেটা নিমেশের মধ্যে করপুরের মতো উবে গেল। এরপরের পথটার গাইড হল মাহালি। অবশ্য সেটা শুধু আমার কাছে কারণ মিনি এখানে আগেও এসেছিল। মাহালিটা খুব পাজি, আমার এই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ভুল-ভাল বাড়িকে দেখিয়ে বলছিল সেটা ওদের বাড়ি, ভুল-ভাল পথকে দেখিয়ে বলছে,“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওখান দিয়ে যা।” আবার এও বলছিল,“প্রচুর রাস্তা রে কোয়েল,একটু কষ্ট হবে তোর।” এই কথা শুনে সবেই একটা ভ্যান ভাড়া করতে যাব আর পাজিটা বলে উঠল,“ব্যাস্,এটাই আমাদের বাড়ি।”
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কারণ রোদ্দুরে ওভাবে হাঁটতে আমার মোটেও ভাল্লাগছিল না। আবার ওর আগের কিত্তি কলাপ থেকে ওর কথা ঠিক বিশ্বাসও হচ্ছিলনা। কিন্তু যখন দেখলাম ও সটান ঘরের ভিতর ঢুক যাচ্ছে তখন ওর পিছু নিলাম। ওদের বাড়ির পরিবেশ শান্ত নিরিবিলি প্রকৃতির,মানে লোকজনের গ্যাঞ্জাম নেই। ওদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, তাই ভেবেছিলাম কিছু জ্ঞাতি-গুষ্ঠির কটাক্ষ হয়তো অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু আমার সে অনুমানের কোনকিছুরই বাস্তবায়ণ হলনা, ওদের বাড়ির পরিবেশ আদৌ তেমন ছিল না। দেখি মেইন দরজায় মাহালির বাবা বসে পেপার পড়ছেন। ওনাকে প্রনাম করে, যাবতীয় সৌজন্য বিনিময়ের পর মাহালির ঘরে ঢুকে...উফ্!কি শান্তি।
গরমে এতটা হাঁটার পর,‘ছায়াঘন শান্তির নীড়ে পদার্পণ’ যেন সর্বকালের কল্পনীয় সেই সুধাপাত্রে সাঁতার দেওয়া অথবা সর্বাকাক্ষিত ‘স্বর্গসুখ’য়ের পরিতৃপ্তি দেওয়ার সমান। তুলনাটা একটু অতিরঞ্জিত হলে কিছু করার নেই,হ্যাঁ ?আমি সত্যিই সেদিন এতটাই খুশি হয়েছিলাম। শব্দগুলো একটু গুরুগম্ভীর ব্যবহার করায় আমার সাদাসিদে আবেগটিও ‘গুরুগম্ভীরতা’র কাগজে মোড়া হয়ে গেছে। মাহালি আমাদের জন্য ঘরোয়া মানে বাজারের কৃত্রিমতাহীন, নুন-লেবুর সরবৎ দিল। ঠিক তারপরই সিঙাড়া আর রসগোল্লারা হাজির। সকালে খেয়ে গেছিলাম,তারউপর সিঙাড়া আর মিষ্টি যে বিরাট স্থান দখল করেছিল জানতাম সে অধিকার তারা সহজে ছাড়তে চাইবেনা। এরপরই পেটপূজো সেরে মিনির আবদার-ও,খেঁজুর খাবে। মাহালি বলল-“ওরে খেঁজুর গাছ থেকে সদ্য পেড়ে খেঁজুর খাওয়ার মজাই আলাদা। তোরা যদি খুব ক্লান্ত না হয়ে থাকিস,তবে তোদের একটা জায়গায় নিয়ে যাব,যাবি?” আমি বললাম-“আর অঙ্গনা?” ও বলল-“ওর আসতে আসতে আমাদের ফিরে আসা হয়ে যাবে। ও বেরোনোর আগে missdcl দেবে বলেছে।”
মাহালির কথায় বাইরের ড্রেসটা পাল্টে দুটো ছাতা নিয়ে ওকে অনুসরণ করে হেঁটে চললাম। ধীরে ধীরে পথের আসেপাশের বাড়ির সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হল,শুরু হল মাঠ আর তার সাথে অসম্ভব নিচু নিচু খেঁজুর গাছের সারি। এরপর যত হাঁটতে লাগলাম তত বাতাসের প্রবাহ বাড়তে লাগল, ছাতা গুলো বন্ধ করতে হল, ওদিকে গায়ের ঘাম যেন কোথায় হল অদৃশ্য।হঠাৎই একটা ঝড়ের আওয়াজ কানে এলো। ভাবলাম...‘বাবা রে বাবা,এত খটখটে রোদে ঝড়ের আওয়াজ আসে কোথ্থেকে!!’ জিজ্ঞেস করতে জানলাম কাছেই ঝাউগাছের সারি ,বুঝলাম তারাই এই দৃশ্যে background music সংযোজনে কোনো খামতি রাখেনি। পথের মাঝে একটা ছোট্ট বটগাছকে দেখিয়ে মাহালি বলল, ওখানে নাকি অনেকে এসে পালিয়ে বিয়ে করেছে। আমি আর মিনি চোখ চাওয়াচায়ি করে মুচকি হাঁসলাম। হ্যাঁ,সেখানে একটু হলুদ-একটু সিঁদুর-একটু ফুল পাতা লতা পড়ে থাকতে দেখলাম। তারপরই শুধুমাত্র আমাদের ‘কর্ণেন্দ্রিয়ে’র সাহায্যে নয়, তার সাথে ‘দর্শণেন্দ্রিয়ে’র সাহায্যে ঝাউগাছের সারি প্রত্যক্ষ করলাম। আরে বাবা পাতি বাংলায় যাকে বলে, ঝাউগাছের সারি দেখতে পেলাম। আর দূর থেকে ঠিক করে নিলাম যে কোন দুটো গাছের মাঝখানে আমাদের এই ক্ষনিকের আড্ডাটা সারব। তবে জানিনা কাছে যেতে আমার বাছাই করা সাধের জায়গাটাকে আর চিনতে পারলামনা, সব জায়গা একই রকম লাগতে লাগল।
চারপাশের পরিবেশে একটা অসম্ভব সারল্য মিশে ছিল যেটা মনকে যেন কেমন একটা শান্ত মাদকতায় ভরিয়ে রেখেছিল। অন্যরা সেটার আঁচও পাচ্ছিল কিনা জানিনা...হয়তো পেতে চাইছিলনা। যদিও যেকোনো ভাললাগা,যেকোনো আবেগ,যেকোনো খামখেয়াল বড় বেশি আপেক্ষিক,যা আমার কাছে বড় আপন, বড় আদরের ;তা অন্যের কাছে ততটা কাছের নাও হতে পারে; সেটাই স্বাভাবিক। আর তাই তখনকার মতো মুখে তালাটি আটকে চাবিটাকে পকেটস্থ করাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল। এমনই এই প্রাকৃতিক মাদকতার যে আমি শিকার হয়েছিলাম পুরোদস্তুর, যার প্রমান রাখতে মোবাইল বের করে ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ এদিক-ওদিক নানা দিকের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে স্মৃতিটাকে মোবাইল বন্দি করতে চাইলাম, অবশ্য কিছুটা বাধ্য হয়েই ছবিগুলোর মধ্যে এর xerox copy-র মতো কিছু একটাকে রেখে দিয়ে আসল স্মৃতি গুলোকে সেদিনের আকাশে, সেদিনের বাতাসে, সেদিনের ঝাউগাছের পাতার ফাঁকে, মাটির রাস্তার বাঁকে ছড়িয়ে দিয়ে এলাম। সেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আসার সাধ হলেও ক্ষমতা ছিল না বোধহয়।
তারপর মনের আস মিটিয়ে শরীর ও মনে খানিকটা ক্লান্তি অনুভূত হতে গাছের নীচে একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম আর স্কুল জীবনের স্মৃতি, বর্তমানের নানা ভালোলাগা-মন্দলাগা, একটু-আদটু PNPC চলতে লাগল। তখনই মাহালির সেলে অঙ্গনার mmsdcl, বুঝলাম ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে; অন্তত পূর্বনির্ধারিত হিসেব তো তাই বলে। এবার তবে ১৫মিনিট পর বাসস্টপে দাঁড়ালেই হবে। তাই নিশ্চিন্ত আমরা আরও মিনিট খানেকের জন্য আড্ডাটা চালু রাখলাম। যদিও আড্ডার চাকা বেশি পথ গড়াতে পারল না , কারণ এক-দু’মিনিট পরই মাহালির সেলে অঙ্গনার ফোন। জানতে পারলাম ও বেচারি কাজটাজ সেরে হন্তদন্ত হয়ে মাহালির বাড়ি পৌঁছে কাউকে দেখতে না ঠোঁটের গোড়ায় বেশ খানিকটা অভিমান জমিয়েছে। সেটা যদিও মাহালিকে repeat করতে হল না। কারণ ফোনের ওদিকে আসা অভিমানী আঙ্গনার উচ্চইস্বরে বাক্যালাপ কানে রিতিমত ‘চড়থাপ্পড়’ মাড়ছিল, ফোন loudspeaker-এ রাখার দরকারই পড়েনি। কিন্তু গোটা ব্যাপার কিকরে সম্ভব হল সেটা বুঝে উঠতে পারলামনা...সবেমাত্র গাড়িতে উঠে ১৫মিনিটের রাস্তা ৩/৪মিনিটে শেষ করে কিভাবে মাহালিদের বাড়ি পৌঁছাল সেটাই রহস্যের। যদিও ওদের বাড়ি গিয়ে প্রথমে অঙ্গনার অভিমান মিশ্রিত রাগ ভাঙাতে লাগলাম, গিয়েই প্রথমে প্রশ্নের পসরা খোলা যায়? তাতে তো অভিমান ভাঙার বদলে সে বেটা জমপেস করে ঘাঁটি গেড়ে বসত আর আমাদের সেদিনের মজা এক্কেবারে ডকে। ওকে জিজ্ঞেস করে একটা ছোট্ট missuderstanding-এর ঘটনা-বিভ্রাট এর পিছনে থাকার সাক্ষপ্রমান পেলাম। missdcl টা ও স্টপেজে নেমেই দিয়েছিল যেটা কিনা নির্বাক missdcl আমাদের বলে উঠতে পারেনি। তাই এটা জানামাত্র তৎখনাৎই আমাদের কুন্ঠাবোধ আর অঙ্গনার অভিমান হল ‘ছু মনতর’।
তারপরই অঙ্গনা আসার উপলক্ষে আমাদের, মানে আমার আর মিনির দ্বিতীয় দফার ভোজন পর্ব শুরু হল। খাওয়া-দাওয়া সেরে অঙ্গনা বাইরের জামা বদলে আমার দলে যোগ দিল। হ্যাঁ এটা ঠিক চার বন্ধুর মাঝখানে ড্রেসভিত্তিক একটা বিভাজন চোখে পড়ল, কেবল আমার চোখেই কিনা জানিনা অবশ্য। সেটা হল এই যে, আমি-অঙ্গনা টপ আর টাইটস, ওদিকে মাহালি-মিনি একই স্টাইলের ফ্রক। স্বভাবতই ড্রেস বিভাজনের সাথে কাদের-কাদের মনের মিল বেশি সেটা পরিষ্কার হল, আবার যদিও একইভাবে আমার ক্যামেরার ফোকাসে। এরপর আমরা সবাই আবার সেই ঝাউবনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। স্বভাবত এবারের রাস্তাটা আগের থেকে ছোট বলে মনে হল। প্রাণ ভরে আড্ডা দিলাম, যাকে বলে ‘চুটিয়ে আড্ডা’। সব গল্প সেরে সকলের মনের আশ মিটতে মিটতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। ঘড়ির দিকে দেখে মন ততটা তাড়া না দিলেও পেটের ছুঁচোগুলো লম্ফঝম্ফ করে অপ্রকাশ্যে সাইরেন বাজিয়ে দিল। আমি কোনদিনই তেমন পেটুক ছিলাম না, তবু তো পুরদস্তুর খাদ্যরশিক ছিলাম নাকি...এমনকি এখনও আছি। তারউপর মাঝখানে একমনে চলতে থাকা জমাটি আড্ডার সময়ের দিকে খেয়াল রাখার সুযোগই দেয়নি, আর নিজেদের অজান্তে শরীরের ক্লান্তি পেটের ভিতর আনেকখানি ফাঁকা জায়গা করে ফেলেছিলাম, তাই সেখানে শুধু ডাল-ভাত খেলেই ব্যাপারটা খাসা হয়ে যেত। এই রকম মানসিক ও শারীরিক পরিস্থিতিতে মাহালির বাড়ি এসে দেখি বাবারে বাবা...সে তো যেন বিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছি। কিচ্ছু বাদ নেই...নিরামিশ তরি- তরকারি,ডাল,মাছ,মাংস,দই-মিষ্টি। আমি বাবা যতটা পারলাম ততটা পেটে পুরে ধূপধুনো ছাড়াই ‘পুজো’ শেষ করলাম। তারপর মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়-প্রথমে আমি, তারপর অঙ্গনা, মিনি আর শেষে মাহালি। অঙ্গনা তখন নিজের ডাইরিটা খুলে আমাদের স্কুল থেকে সুন্দরবন বেরানোর গল্পটা বলছিল, মাহালি মাঝেমাঝে ফোড়ন কাটছিল আর মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আমার চোখ ছিল ওর ডাইরির লাইন গুলর উপর।
হঠৎই ঘড়িতে চোখ পরল, দেখি সাড়ে তিনটে; প্রায় পৌনে চারটে বেজে গেছে। মিনি বলল, এবার তৈরি হয়ে নিতে হবে। কারন ও জানত, মাহালির সাজতে কত সময় নেবে। প্রথমটা আমরা আর দু’জন বুঝতে পারলাম না, তাই আরও খানিকটা শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হল। ওদিকে মাহালি cold-drinks আনল, আমার খেয়ে কিছুটা বেশি হল। যেটা বোধহয় মিনি খেয়েনিল। যদিও এই দৃশ্যটা এখন ভাবাই যায়না, বরং এর উল্টোটা হলে অর্থাৎ মিনির cold-drinks বেশি হচ্ছে আর আমি সেটা ঢকঢক করে সাবাড় করছি; সেটাই আমার পরিচিত মহলে বিশ্বাসযোগ্য হবে। এবার শুরু হল মিনির সতর্ক করে দেওয়ার অধ্যায়...অর্থাৎ মাহালির সাজাগোজার সময়ব্যাপ্তির সাথে আমাদের পরিচিতি-পর্ব। হম্, মিনি ভুল কিছু বলেনি-মাহালি সাজতে ভালই সময় নেয়। এই সাজাগোজার প্রসঙ্গে আমার সমর্থন সবার আগে। শুধু বিষয়টা হল, মাহালির মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের কাছে এতটা সাজগোজ আশা করিনি, তাই আমার সাজা শেষ করে ওকেই দেখছিলাম। ও দেখি চোখের উপরে-নিচে শৌখিন ভাবে eyeliner-টা পড়ল, চুলটাকে একটু উঁচু করে horse-tail করল,কানে matching দুল পরে; শেষে মিনির আনা lipstick টা লাগিয়ে তবে হল ওর সাজাগোজায় ইতি। lipstick-টায় যদিও আমরা সবাই ভাগ বসালাম। বেরনোর আগে ভালো করে একবার দেখে নিলাম; কিছু ফেলে যাচ্ছি না তো আবার! না না, আমার এই ভাব-গতিক দেখে আময় খুবই একটা সাবধানি মেয়ে ভাবার কোন কারণ নেই। কেননা সেটা আমি মোটেই সেটা নই, বরং সেদিনের সেই সাবধানতাটা আগে থাকলে প্রতিবার বন্ধু বা আত্মীয়দের বাড়িতে কিছু-না-কিছু ফেলে আসার বদভ্যেসটা থাকতনা। আজ্ঞে হ্যা, আমি বরাবর নিজের নিন্দেটা নিজেই করতে ভালবাসি; যাতে অন্যরা বেশি করার সুযোগ না পায়। যাইহোক, দেখে তো তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তাই বেশি দেরি না করে, দুটো ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। এবার mission অঙ্গনাদের বাড়ি আক্রমণ; তাও আবার বাড়ির মেয়েকে সাথে নিয়ে, বাড়ির লোককে জানিয়ে। কেউ ভেবেছে কখনো? এ তো দিন-দুপুরে ডাকাতি! বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ কালো করে ঘোর হয়ে এসেছে। ভাবলাম নিরঘাত আজকের বেরানোটা ভণ্ডুল হল বলে। যা ভেবেছি তাই; বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি-মহাশয়ের নাচাগানা শুরু, এক্কেবারে উচ্চই স্বরে গান আর ধেইধেই করে নেত্ত। না না কেলেঙ্কারি টা হয়নি, বড়বড় ফোঁটা শুরু হাওয়ার আগেই আমরা ভিতরে ঢুকে গেছিলাম। তাই জামা কাপড়ে একটু খানি জলের ফোঁটা মিশলেও ভিজে কাকচান করিনি সেটাই রক্ষে। আগত্যা কিছুক্ষনের আপেক্ষাটা মেনে নিতে হল, তবে এই হাতপা বাঁধা আবস্থা কিন্তু মোটেও শুধু বৃষ্টির কারণে ছিলনা। বাসস্ট্যণ্ডে বোধহয় মানুষ বাসের জন্যেও অপেক্ষা করে, সেটা ভুলে গেলে চলবে? যদি ভুল না হই তবে ওটা বাসের জন্য আপেক্ষা করার কারণেই বানানো। সেবার যদিও সেই অপেক্ষায় ‘বৃষ্টি থামার’ অপেক্ষাও মিশে গেছিল; সেটাই হয়ত জায়গাটাকে সাময়িক ভাবে ‘বৃষ্টি-স্ট্যাণ্ড’ করে দিয়েছিল।
এর ঠিক খানিক পরই এল অপেক্ষায় পূর্ণচ্ছেদ টানার পালা। যদিও সেটা আংশিক...কারণ খানিক বাদে শুধু বাস এলো; কিন্তু বৃষ্টি থামার লক্ষণই দেখছিলাম না। তাই বাসের জন্য অপেক্ষাকে বিদায় জানিয়ে, বৃষ্টি থামার অপেক্ষার ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। ওদিকে বৃষ্টি থামার তো নাম- গন্ধ তো নেই উপরন্তু বাসে ওঠার পর যেন মনে হল জলের বেগ আর বাড়ল। তবে ঠিক সময়ে বাসে যখন উঠে পড়েছিলাম তখন নিশ্চিন্ত, চিন্তাটা নাহয় নামবার সময় করার জন্য ছেড়েদিলাম। তারপরের দশ-পনেরো মিনিটটা যেন কয়েক সেকেন্ডের মতো কেটে গেল; বন্ধুরা একসাথে যা হয় আরকি...নতুন জায়গা, চারপাশে নতুন সব দৃশ্য; বন্ধুদের আড্ডার গল্প কমতে লাগল আর ওদিকে চারপাশে কলকারখানার সংখ্যা লাগল বাড়তে, তারসঙ্গে বাতাসে chemical-এর দমবন্ধ করা গন্ধ। আমার আর মিনির সাথে আঙ্গনারাও তাদের প্রতিদিনের চেনা আশপাশটাকে যেন আবার করে দেখতে লাগল। তাদের কাছে হয়তো বাস থেকে দেখা প্রতিদিনের ছবি গুলো আগের মতোই ছিল কিন্তু আমাদের সঙ্গ যে সেগুলোকে নতুনত্ব মাখিয়েছিল, সেটা তাদের চোখের দৃষ্টিই স্পস্তভাবে বুঝিয়েছিল। সে চাওনি তো প্রতিদিন কার গড়পরতা চাওনি নয়। এরপর এক জায়গায় বাস থামল। একটু হেঁটেই চোখে পড়ল ১নং সেক্টারের গেট। ওখানের গার্ড প্রথমে আমদের তিনজনকে নতুন দেখে,“আপনারা কোথ্থেকে আসছেন?”,“কোথায় যাবেন?”...এই সব official প্রশ্ন করতে লাগলেন। হয়তো তিনি তখনও আঙ্গনাকে দেখেননি। শেষে বেপারটা আঙ্গনা সামলে নিয়ে বলল, “ওরা আমার সাথে।” গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আঙ্গনাকে আনুসরণ করে হেঁটে চললাম। চারদিকে দেখতে দেখতে চলতে লাগলেও কম-বেশি সকলের মন ছিল একই দিকে-কখন, কোথায় আঙ্গনাদের বাড়ি আসবে। শেষমেশ দেখলাম গেট থেকে বেশ অনেকটা ভিতরেই ওদের কোয়ার্টার, সব বাড়িগুলো একই ধাঁচের, official কোয়ার্টার যেমন হয়। তাও সব বাড়ির মধ্যে কোনটা ওদের বাড়ি; সেটা বোঝা তেমন একটা কঠিন কাজ ছিলনা। কারণ একটা বাড়ির সামনে অঙ্গনার মা চেয়ারে বসে ছিলেন। ওদের বাড়ির দুটো কামরা; একটা ঘরে টিভি যেটা দেখলে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, ওটা আঙ্গনার পড়ার ঘর হতে পারে না। তাও কোন কথা খুঁজে না পেয়ে প্রশ্নটা করেই বসলাম যে ওটা কার ঘর এবং যথারীতি জানা উত্তরটাই পেলাম। তার কিছু পরই ওর দিদির মারফৎ শরবতের গ্লাসেরা এসে হাজির, যেগুলো আনার সঙ্গে সঙ্গেই সকলের হাতে উঠে গেল। সবেমাত্র “cheers” করতে যাব ওমনি মিনির মুচকি হাঁসিতে ওর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাটা আনামাত্রই প্রায় অর্ধেক গ্লাস ফাঁকা করে দিয়েছে। তাও এই নিয়মভঙ্গের ত্রুটিতে ‘মার্জনা’ টেনে cheers করার বাসনায় ছন্দপতন করলাম না। নিমেশে খালি গ্লাসও ফেরত দেওয়া হল। এরপরই একটা ট্রে-তে এল দই আর তার সাথে পাঁচ-ছ’জন ‘মিষ্টি’ নামক সাঙ্গপাঙ্গ। সেগুলো থেকে আমরা যে যার পছন্দ মতো, কেউ শুধু দই, কেউ শুধু মিষ্টি,কেউ দুটোই...আবার কেউ দুটো থেকে একটু-একটু করে দই- মিষ্টি তুলে নিলাম। এরই মাঝে হঠাৎ কোন কুক্ষণে আমি বলে ফেললাম যে আমি দই খেতে ভালবাসি! ওমনি ব্যাস, আমার আর রক্ষে থাকে? আন্টি তখন মাহালির না খাওয়া দইয়ের বাটি থেকে কিছুতা দই আমার ট্রে-তে তুলে দিল। ইচ্ছে আর অনিচ্ছের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় দইটা খেয়েনিলাম। তাতেও শেষ হল না, আন্টি-র কথাতেই আর একটা কাঁচাগোল্লা খেতে হল। পেট পুজোর পর্ব শেষ, তারপরই আঙ্গনার দিদি আমাদের চারজন বন্ধুর একটা ছবি তুলল। আলাদা করে আমার ছবিটা তেমন ভালো এলোনা। কিন্তু আর সকলের ভালো আসায় আমি আর এতে negative কিছু বললাম না। এর ঠিক পরের ঘটনাগুলো যেন ঘটেছিল বইয়ের সেসব পাতাগুলোর মতো, যাদের থাকাটা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয় বরং অনেকটাই যুক্তিসঙ্গত, তবে ওই আরকি বইয়ের আর-সকল পাতাগুলো মারফৎ আসল ‘রসস্বাদন’ পর্বের সমাপ্তির পরেও বাকি পরে থাকা পাতাগুলোর রং কেমন অনিচ্ছাকৃতভাবে ফিকে হয়ে যায়, তেমনই একটা ভাব। মানেটা খুবই সরল, এরপরে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা সেদিনের সকাল হাওয়ার সাথেসাথে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর অভিনবত্বের সাথে মোটেও পাল্লা দিতে পারেনি, আগের মুহূর্তগুলোর সাথে তালে তাল মেলানো ঘটনারাশি শুধু পেরেছিল সেদিনের খোলা বইয়ের গড়-পড়তা সাধারণ পাতার মাঝে হারিয়ে যেতে, সাধারণের মাঝে আসাধারণ হয়ে ওঠার ক্ষমতা কিছুজনেরই থাকে। যথারীতি আড়ম্বরে কোনরকম ত্রুটি না রেখে, আমরা চার বন্ধু অঙ্গনার মা আর দিদির সাথে ভ্যানে করে সারা জায়গাটা ঘুরলাম, দারুণ সব অভিজ্ঞতা হল। সময়টা সত্যিই যেন কেটে গেল একনিমেষে। এই সময় কাটার ধরণ থেকে বোঝাযায় শেষেরগুলো কতটা উপভোগ্য ছিল, অন্যথায় শেষের ওই ক’ঘণ্টাকে মনে হত র্দীঘায়তনের এক মন খারাপকরা বিকেল, যেটা যেন কাটতেই চায়না। এরপরই কখন যেন সূয্যিমামা পশ্চিম আকাশে ‘কালো’ জলে ডুব-সাঁতার দিল, ঘড়িতে ৬টা বাজিয়ে; আর আমরা সেই নীরব র্দশকের আসনে চুপটি করে বসে রইলাম। না না এমন কিছু ভাবার কারণ নেই যে বোধহয় “সুয্যি গেল পাটে, তো সেদিনের পরিকল্পনা সব উঠল লাটে”...সত্যিই তেমন কিছু হয়নি সেদিন। সন্ধ্যে হওয়ার বেশ কিছু সময় আগেই আমরা সবাই অঙ্গনাদের বাড়ি চলে গেছিলাম। বাইরের আলো নেভাটা বরং মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, এবার আমাদের বাড়ির জন্য বেরোতে হবে। তখনই একে একে সকলকে বিদায় জানিয়ে আমরা তিনজন যেযার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরলাম, নাহ্ গুনতিতে একদম ভুল হয়নি আমার,কারণ অঙ্গনা বাস অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিল মাত্র। শেষের পথটুকু যে যতটা পারলাম মন ভোরে গল্প করেনিলাম, কিন্তু সে গপ্লের ঝুড়ি যেন খালি হওয়ারই নয়। আসতে আসতে পথ শেষ হয়ে আমাদের তিনজনকে লাল বাসগুলোর কাছে পৌঁছে দিল। বাসে উঠে দেখি বেশিরভাগ সিট রিজার্ভড, তখন চটপট তিনটে খালি সিটকে রিজার্ভ করে ফেললাম। অঙ্গনা শেষের কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গ দিল, তারপর যখন বাস ছাড়ার তোড়জোড় করতে লাগল ও তখন নেমে গেল, আর বলল, “সাবধানে যাস।” আমরাও মাথা নাড়লাম আর ও নেমেগেল। ও ব্যাটা এমন গাধা, কথাটা বলেই আমাদের দিকে পিছন ঘুরে বাস থেকে নেমে পড়ল। ওর গাধামির জন্য শেষবারের মতো ওকে দেখতেও পেলামনা। তখন বুঝিনি এখন অনুতাপ হয়, তখন কি আর জানতাম যে বেশ কয়েক বছর পরে মুখখানা দেখতে পাব! তখন ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে আমদের স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেছে, মনে হয়েছিল কালই তো স্কুলে ওর সাথে দেখা হবে। বাকি রাস্তাটা অর্থাৎ বালিরমোড় অবধি তিনজন একনাগাড়ে বিজ্ঞের মতো বকবক করে কাটালাম। মাঝে মাহালি নেমে গেল। তখন বাসে একরাশ অচেনা মুখের ভিড়ে আমার একটাই চেনা মুখ- মৃন্ময়ী। অফ্! এতক্ষন পর ওর ভালো নাম ধরে ডাকলাম, আসলে বন্ধুমহলে ওর সাথে ওর ডাকনামটা এত সতঃস্ফূর্তভাবে যায় যে, ‘ভাল’ নামটা যাবতীয় official কাজকর্মের জন্য তোলা থাকে। গাড়ির স্পীড একই থাকলেও স্বভাববসত পরের রাস্তাটা তাড়াতাড়িই শেষ হয়েগেল। আমরা দু’জন একসাথে নামলাম ২৪৬ মোড়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আবু সঈদ আহমেদ ০৬/০৮/২০১৪বড় তবুও ভাল লাগল।
-
Shopnil Shishir(MD.Shariful Hasan) ০২/০৮/২০১৪osadaron
-
ইসমাইল জসীম ০১/০৮/২০১৪লেখাটা পড়লাম মুগ্ধ হলাম
-
আবু আফজাল মোহাঃ সালেহ ০১/০৮/২০১৪বেশ ভাল লাগলো পড়তে।