www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শামসুর রাহমানের সমকাল চেতনা

পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে বেড়ে উঠা শামসুর রাহমান কবিতার ভুবনে নিভৃতচারী রোমান্টিক কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন । সময় পরিক্রমায় তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় সমকাল চেতনা, নগর মনস্কতা, রাজনৈতিক চেতনা । এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন দেশের প্রধান কবি, গণ মানুষের হৃদয়ের কবি, জাতির বিবেকের কন্ঠস্বর । অনেক সমালোচক তাঁকে ত্রিশ দশকের পঞ্চপান্ডব কবির পর বাংলাভাষার সবচে গুরুত্বপূর্ণ কবির স্বীকৃতি দিয়েছেন ।

সাধারণত জীবদ্দশায় কবিরা ততবেশি সম্মানিত হন না । দু একটা ব্যতিক্রম হয়ত আছে । এই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ ভেঙে দিল পুরানো আচার । শামসুর রাহমান জীবদ্দশায় অভাবনীয় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, যা বাংলা সাহিত্যে একটি দৃষ্টান্ত । কবি প্রতিভা, কর্ম ও খ্যাতি তাঁকে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল । জাতির সংকটে মানুষ তাঁকে একান্ত সুহৃদের মত পাশে পেয়েছিল সবসময় ।

আধুনিক মানুষের ভাষাকে তিনি কাব্যভাষায় রূপ দিয়েছেন । তাঁর কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছে মানুষের মুখের ভাষা । জটিলতা বর্জিত, সরল অকপট সেই ভাষা । এভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন পাঠকের কাব্যরুচি । আর তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ও সমকালের উজ্জ্বল দলিল । বহু বছর ধরে তিনি সমকালের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন । এক সময় সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও তুলেছিল যে তিনি পুনরাবৃত্তির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন । এই সময়ে তাঁর কবিতায় প্রথম দিকের শুদ্ধতা, সৌন্দর্যবাদীতা ছিল মলিন চাদরে ঢাকা । সমকালীন ধুলোর আগ্রাসন থেকে রেহায় মিলেনি তাঁর আত্মজীবনী, ডায়েরি, স্মৃতিকথা প্রভৃতি রচনা । ‘কালের ধুলায় লেখা’ গ্রন্থটি নিছক আত্মজীবনী নয়, এটি সমকালেরই আরেক ইতিহাস । আবার এই সমকালীনতা তাঁকে নিয়ে এসেছে পাঠকের হৃদয় মন্দিরে ।
মনিষী হুমায়ুন আজাদ ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ নামে কবির জীবদ্দশাতেই তাঁর উপর একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ লিখলেন । এই গ্রন্থে কবির প্রথম চারটি গ্রন্থকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন হুমায়ুন আজাদ । কিন্তু এটি দুঃখজনক হলেও সত্য কবি শেষের দিকে এসে পুনরাবৃত্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। সমকাল মনস্কতার কারণে কখনও কখনও বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তিনি ভুলে যাননি শিল্পের দাবী ও কবির কর্তব্য । কবি রাজনীতির শিকার হয়ে কবিতার সর্বনাশ করেছেন, এমন সমালোচনার জবাব দিয়েছেন ‘কালের ধুলায় লেখা’ তাঁর আত্মজীবনীতে । তিনি বলেন-
“কবিতার সর্বনাশ ঘটানোর মত ক্ষমতা আমার ঝুলিতে গরহাজির । আমাদের জাতীয় জীবনের বেশ কিছু ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করেছে, আমি কিছু কিছু কবিতায় সেসব স্পন্দনকে রূপায়িত করতে অনুপ্রাণিত হয়েছি, একাত্মবোধ করেছি উৎপীড়িত, দুঃখী আমজনগণের সঙ্গে । আমি তাদের দুঃখকষ্ট মোচনের ক্ষমতা ধারণ করি না- এ ক্ষেত্রে আমি অসহায়, নাচার । কিন্তু সমাজের অনাচার, অবিচার, শাসকের অপশাসন এবং বেয়ারা লুণ্ঠনের কথা তো আকারে ইঙ্গিতে হলেও প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখি । সেটুকু কাজ করার জন্য লেখনীকে ব্যবহার তো করতেই পারি । তবে সেসব কথা লিখতে গিয়ে প্রপাগান্ডার কাঁধে সওয়ার হয়নি সিন্দাবাদের নাছোর বুড়োর মতো । কবিতাকে যথাসাধ্য কবিতাই রাখতে চেয়েছি।”
‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে । এটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থে সমাজ ও রাজনৈতিক সংকটের কোন চিত্র আমরা দেখতে পাই না । অন্তরলোকের এক রোম্যান্টিক কবির সাক্ষাৎ পাই, যিনি বিচরণ করেন ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতার ভেতর বিবর্ণ এক জগতে । প্রথম দিককার কবিতাতে তিনি এলিয়ট, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন । জীবনানন্দের কাব্যের ধূসর ছায়া ও এলিয়টের পোড়াভূমির ধ্বংসস্তূপের ছায়া দেখা যায় এই সময়ের কবিতাতে । তৃতীয় গ্রন্থ ‘বিধ্বস্থ নিলীমা’তে কবি হয়ে উঠেন সময় সচেতন । কবি মনের জানালা খুলে দেখতে পান সমকালীন সমাজ বাস্তবতা । নষ্ট সময়ের আগ্রাসনের শিকার কবি নিজে, এমন কি পশু-পাখি, প্রকৃতিও । এমন প্রতিকূল বাস্তবতাকে এড়িয়ে না গিয়ে কবিকে দেখি অত্যন্ত দৃঢভাবে সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে ।

“সময় ক্ষুধার্ত বাঘ। পশু, পাখি, উদ্ভিদ, মানুষ,
গ্রাম আর জনপদ যা পায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে
এবং প্রত্যহ খোজে নতুন শিকার। চোখ মেলে
চেয়ে থাকে রাত্রিদিন, সিংস্রতার প্রখর, বেহুশ।
অশেষ ধ্বংসের কালি মুখে তার মেখেছে কলুষ
যুগে যুগে। জঠরে কি দাঁতে অবাস্তব ক্ষুধা জ্বেলে
ছুটে যায় লোকালয়ে সভ্যতায়, গেলে অবহেলে
সব কিছু, মহানন্দে ওড়ায় সে জয়ের ফানুষ ।”
(সময় / বিধ্বস্থ নিলীমা )
এক সময় যার কবিতা সমকালে ঝড় তুলেছিল, পথসভা, মঞ্চে, শহীদ মিনারে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হত, সেই তিনি জীবনের শেষ দিকে এসে নিজের কবিতা নিয়ে হয়ে পড়লেন সন্দিহান । একবার তো তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন- ‘আমার কবিতা কি কিছু হয় আজকাল’ ? ‘ কখনো যদি এমন হয় আমার লেখা কেউ ছাপতে চায় না। তাহলে যেচে কাউকে কবিতা দেব না। বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখব’। শামসুর রাহমান মানুষ হিসেবে যেমন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন, তেমনি কবি হিসেবে তাঁর বিনয়ী স্বভাবের পরিচয়ও আমরা পাই । কবি নিজের সম্পর্কে যেমনটি ভেবেছিলেন, জীবনানন্দের মত অনুরূপ কোন অবাঞ্ছিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে । তিনি জীবদ্দশায় যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, আজো তেমনি আছেন । তবে কবিরা যে বড্ড অভিমানী । আর অভিমান বুকে পুষে জীবনানন্দ তাঁর ‘রূপসী বাংলা’র পান্ডুলিপি চাটাইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পর সেটি প্রকাশিত হয়েছিল । সেদিক দিয়ে শামসুর রাহমান অনেক বেশি ভাগ্যবান ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল ইউরোপের কবিদের উপর । তেমনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি আন্দোলন সম্পূর্ণ বদলে দিল শামসুর রাহমানকে । তিনি আর ফিরে গেলেন না রোম্যান্টিক কাব্য ভুবনে । তখন থেকে তাঁর কবিতা হয়ে উঠল মুক্তিকামী মানুষের চেতনার উজ্জ্বল মশাল । বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, পক্ষপাত, এ লাশ রাখবো কোথায়, পুলিশ রিপোর্ট, আমি কথা বলতে চাই, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, হরতাল ইত্যাদি কবিতার নামকরণের মাঝে তিনি সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রকে চিত্রিত করলেন বলিস্টভাবে । (সংক্ষেপিত)
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৪০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/১২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আবিদ আল আহসান ১২/১২/২০১৪
    হ্যাঁ.ফাটাফাটি
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ১১/১২/২০১৪
    কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখাটি বেশ ভাল লাগল।
    কথায় আছে - 'প্রচারেই প্রসার'। কবি শামসুর রাহমানের ওই ক্ষেত্রে বিষয়টিই বেশী কাজ করেছে। কারণ তৎকালীন একটা বৃহত্তর দৈনিকে কাজ করার সুবাদে তাঁর প্রসারটা আরো বেড়ে গিয়েছিল যা - কবি শামসুর রহমানের জন্য ছিল বিরাট আশির্বাদ। দৈনিক বাংলার কল্যাণে তিনি অতি দ্রুত সে প্রচার ও প্রসার পেয়েছিলেন। আসলেই কবিদের মাঝে তিনি ভাগ্যবান। সচরাচর দেখতে পাই কবিরা অভাবী হন সেদিক থেকেও তিনি ছিলেন মহা ভাগ্যবান। রবীন্দ্র নাথের পর (মধুসূদনের বিষয়টা ছিল অন্য রকম) সম্ভবতঃ কবি শামসুর রহমানকেই কখনো আর্থিক দৈন্যতার শিকার হতে হয় নি।

    ধন্যবাদ কবি। শুভেচ্ছা নিন।
  • আমার অন্যতম একজন ভালো লাগার কবি তিনি। তার কবিতা আবৃত্তি করে বহুবার স্কুলে এবং কি আমাদের আন্তঃস্কুল প্রতিযোগীতায় অনেকবার প্রথম এবং ২য় পুরস্কার পেয়েছি। তাকে নিয়ে আপনার লেখাটি পড়ে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভালো লাগলো।
  • আবিদ আল আহসান ১০/১২/২০১৪
    no comments
 
Quantcast