দাঁড়াও সুবর্ণা ।। ছোটগল্প
অলি এলেই তাকে সঙ্গী করে মহিম কলবা রওয়ানা দেবে । পরিকল্পনাটা এরকমই করা ছিল । কলবা শারজাহর পূর্বপ্রান্তে উপকূলীয় ছোট্ট শহর । লেক আর সমুদ্র একসাথে মিশে আছে সেখানে ।
মহিম সৌখিন মৎস শিকারী । উইক এন্ডে লংড্রাইভে যেতে পছন্দ করে । কোন কোন উইক এন্ডে সে যায় আজমান অথবা রাস আল খাইমা । আবার কখনও ফুজিরা অথবা কলবা । সঙ্গে থাকে অলি ও বড়শীর ছিপ । কিন্তু আজকের পরিকল্পনা বাতিল করতে হল বলে তার মনে একটা যন্ত্রণার কাঁটা বিদে রইল । তার যত রাগ মেরুন কালারের কেমরি গাড়িটার উপর । ওটাই আজ তার বাড়া ভাতে ছাই দিল । গাড়ির এয়ারকুলার কাজ করছে না । জুলাই মাসের গরমে দেহে প্রাণ থাকতে চায় না । সুযোগ পেলেই খাঁচা ছেড়ে যায় যায় অবস্থা ।
মহিম চিন্তা করে আগে গাড়িটা সারানো দরকার । তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে। কিন্তু তারও আগে অলিকে জানাতে হয় প্রোগ্রাম বাতিলের কথা ।
হ্যালো, অলি আজ আর যাচ্ছিনা কলবা ।
অন্য কোথাও যাচ্ছেন নাকি মহিম ভাই ?
আরে না না, গাড়ির ট্রাবল । তোমার কী মনে হয় না আগে গাড়িটা সারানো উচিৎ?
অবশ্যই ! তো তুমি কার গ্যারেজ প্রেফার কর বেশি ?
নূরালীর ।
আমিও নূরালীর কথাই ভাবছিলাম । ঠিক আছে নেক্সট উইক এন্ডের জন্য তৈরি থেক।
মহিম মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গাড়ির ইগ্নিশন সুইচে চাবি ঘুরিয়ে দিল । কুড়ি মিনিট গাড়ি চালিয়ে সে পৌঁছে গেল নূরালীর গ্যারেজে । শারজাহর শহরতলীতে এখানকার গ্যারেজগুলো গড়ে ওঠেছে । নূরালীর গ্যারেজ সানাইয়া আরবা । সানাইয়া আরবা-র বাংলা করলে দাঁড়ায় শিল্প এলাকা চার ।
নূরালী এগিয়ে এল । আরে মহিম ভাই যে ! কি মনে করে গরীবখানায় ?
এটিই নূরালীর স্টাইল । সব কাস্টমারকে সে এভাবে রিসেপ্সন দেয় । স্বভাবে হাড়কিপ্টে হলেও দিল খুলে কখা বলে সে । দেশের বড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে । বাইশ বছর ধরে আমিরাতে আছে । এসেছিল নাকি আঠার বছর বয়সে । অর্থ-বিত্ত বানিয়েছ প্রচুর। এ লাইনের ধান্দা সে ভাল বুঝে, আবার কাজও ভাল জানে ।
এয়ারকুলার কাজ করছেনা । মোটেও কুল হচ্ছেনা । চালু করলে গোঁ গোঁ শব্দ করে।
মহিম ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল ।
আপনি বসেন । নূরালী মেটালের টুল এগিয়ে দিল । আমি দেখতাছি সমস্যাটা কোথায় । আমি হলাম গিয়া গাড়ির ডাক্তার । গাড়ির রোগ-বালা সারানো আমার কাম । কী বলেন মহিম ভাই ?
সমর্থনের আশায় নূরালী ঘাড় বাঁকা করে মহিমের দিকে তাকাল । সে এয়ারকুলার চালু করলে ওটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে ।
খুব ভাল বলেছ । মহিম হাসে । তার চোখের ভ্রূ কুচকে যায় । সেখানে শিশিরের মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে । মহিম রুমালে ঘাম মুছে নিল । এর মধ্যে দেশে গিয়াছিলে নাকি ?
নূরালী কম্প্রেসারের নাট খুলতে খুলতে ডাক দিল, গফুর ছয় নম্বর রেঞ্চটা দিয়ে যা। নুরালী আবার নাট খুলতে মনোযোগ দিল । তার ডান হাতের পেশী টানটান হয়ে ফুলে ওঠল । গতমাসেই আসলাম দেশ থেইক্যা ।
তো দেশ গেরামের খবর কী ? মহিম প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারে এটি একটি গতানুগতিক প্রশ্ন । দেশ থেকে কেউ ঘুরে আসলে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় । সে যখন গত জানুয়ারির দিকে দেশ থেকে ঘুরে আসল, যার সাথে দেখা হয় সবাই দেশের খবর জানতে চাইত । বোধহয় দেশ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারনে প্রবাসী হৃদয়ে নিরন্তর দেশ প্রীতির অনুভূতিগুলো তুষারের মত স্তূপ হয়ে থাকে ।
হঠাৎ একটা গরম হাওয়া আসে । সঙ্গে নিয়ে আসে প্রচুর ধূলোবালি । মহিম দু’হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল ঝাড়ে ।
কোন পরিবর্তন নাই । মারামারি, কাটাকাটি, জ্বালাও,পড়াও, হরতাল এসবের বন্ধ নাই । এবার গিয়া মনে হইল, দেশটা বুঝি অহনো বৃটিশের দখলে । নূরালী হাতের উল্টা পিঠে কপালের ঘাম মুছে । মহিম ভাই কম্প্রেসার নষ্ট । বদলাতে হবে ।
রিপেয়ার করে চালানো যাবে না ? মহিম বসা থেকে ওঠে গাড়ির খোলা বনেটের উপর ঝুঁকে পড়ে ।
রিপেয়ার করা যবে । কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারবনা । নূরালি ছয় নম্বর রেঞ্চ দিয়ে পিঠ চুলকায় ।
তাহলে নতুন লাগিয়ে দাও । কতক্ষণ লাগবে ? মহিম হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে ।
একঘণ্টা টাইম তো দিতে হবে । নূরালী আবার ডাক দেয়, গফুর !
ওকে । তুমি কাজ কর । আমি একঘন্টার মধ্যেই ফিরব ।
নূরালী মাথা নাড়ে ।
মহিম নূরালীর গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসে । এদিকের বাইলেনগুলো কাঁচা । পাকা হওয়ার কোন আলামত চোখে পড়েনা । ধুলোর ভেতর গাড়িগুলো ছুটে গেলে বাতাসে কুন্ডলী পাকিয়ে ধুলো ওঠে । এদিকে গ্যারেজ ও স্পেয়ার পার্টসের দোকান ছাড়া অন্যকোন স্থাপনা নেই । নেই আকাশ ছোঁয়া ভবন । মানুষের ঘরবাড়ি বেশ দূরে । পুরো এলাকা ফাঁকা ফাঁকা লাগে মহিমের । কিছুদূর হাঁটতেই সে একটা গ্রোসারী সপ পেয়ে গেল । ইতিমধ্যে তেজীরোঁদ তার বুকের কলস শুকিয়ে ফেলেছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল গরুর মত জিব চাটতে । সে গ্রোসারী সপে ঢুকে পড়ল।
দোকানি ইন্ডিয়ান মালোয়াড়ি । হাল্কাপাতলা গড়ন । গায়ের রঙ শ্যামলা । অনেকটা বাঙালিদের মত । নাকের নিচে ঘন ঘোফ । মহিম হিন্দীতে বলল, কোল্ড ড্রিংকস মিলেগি ?
কোন চা ওয়ালা ? দোকানি জবাবের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে মহিমের দিকে ।
মহিম ইতস্তত করল । সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কোন ড্রিংকটা নিবে । একটু ভেবে বলল, সেভেন আপ ।
অর কুচ চাইয়ে ? দোকানি আগ্রহ নিয়ে তাকাল মহিমের দিকে ।
এক প্যাকেট সিগারেট । মহিম সেভেন আপের ক্যানে চুমুক দিল ।
কোন চা ব্র্যান্ড? দোকানি তার ঘোফের উপর একবার হাত বুলাল ।
বেনসন এন্ড হেজেস ।
ক্যানের গায়ে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমলে মহিমের হাত ভিজে গেল । সে রুমাল বের করে হাত মুছে নিল । বেনসন এন্ড হেজেসের প্যাকেট বুক পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করল, বিল কিতনা হোগি ?
দশ দিরহাম । দোকানি বারকোড মেসিন চালু করে বিল মিটিয়ে নিল।
গ্রোসারি সপ থেকে বেরিয়ে মহিম হাঁটছিল আর মাঝে মাঝে কোল্ড ড্রিংকসে হাল্কা হাল্কা চুমুক দিচ্ছে । কিছুদূর এগোতেই রাস্তাটা ইংরেজি টি অক্ষরের মত ডান ও বাম দিকে মোড় নিয়েছে। সে মোড় পর্যন্ত এসে থামল । এদিকে রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুর গাছ । সে একটা খেজুর গাছের ছায়াতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিল ।
মহিম দেখল, বাম দিকের রাস্তাতে বেশকিছু ঘরবাড়ি আছে । ডানের দিকের রাস্তাতে খেজুর বাগান ছাড়া আর কিছু নেই । সে বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে একটা বড়ির সামনে দাঁড়াল । না, এই বাড়িটা নয় । স্বগতোক্তি করল । সুবর্ণা সেন বলেছিল, তাদের গেটের রঙ নীল । মহিম আরও তিনটি বাড়ি পার হয়ে নীল গেট পেয়ে গেল । সে গেটের সামনে দাড়িয়ে ভাবছিল, ভেতরে যবে কিনা । কোথা থেকে একটা ইতস্তত ভাবনা এসে তাকে থামিয়ে দিল ।
সুবর্ণার সঙ্গে পরিচয় খুব বেশি দিনের নয় । মাস দুয়েক আগের কথা । আল আইন গিয়েছিল বেড়াতে । অলি জোর করেছিল বেশি । চলেন মহিম ভাই, আদিযুগের পুরাকীর্তি দেখে আসি । এসব জিনিসের প্রতি মহিমের আগ্রহ ও কম নয় । মহিম না করেনি ।
অলি ছেলেটা বেশ চটপটে । মহিমের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি । হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলে কলেজে আর ভর্তি হতে পারেনি। ধার দেনা করে আমিরাতে চলে আসে । মহিমের অফিসের সাথে লাগোইয়া সাফির শপিং মলে সিকিউরিটির কাজ করে । বাড়ি ঢাকার মিরপুরে । মহিমদের একই মহল্লা। মহিম ছোটবেলা থেকেই অলিকে চিনত ।
পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সমাধি সৌধ দেখে মহিম অলিকে বলেছিল, অলি তোমাকে ধন্যবাদ । অ্যায় এম ভেরি এক্সাইটেড !
এই সৌধগুলো রোঁদে শুকানো ইট দিয়ে বানানো । দেখতে ডিম্বাকৃতির । স্থানীয়রা এটাকে বলে হাফিতের সমাধি। নির্মাণকাল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ।
মহিম বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসব সৌধের ছবি তুলছিল । হঠাৎ দেখে ডিজিটাল ক্যামারার ফ্রেমে ভেসে ওঠেছে একটি নারীমুখ । চেহারা মিষ্টি । ঘন কালো চুল ওড়ছিল বাতাসে । পাখির ওড়ালের মত ভ্রূ ভঙ্গির নিচে চোখ দুটিকে মনে হল, পাহাড়ের পদতলে শান্ত হয়ে বসে থাকা কাপ্তাই হ্রদ । নারীমুখ বন্দী হয়ে গেল ক্যামেরায় ।
মেয়েটির নাম সুবর্ণা । এসেছে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে । পরিচয় পর্বের শেষে সুবর্ণার মা দিয়েছিল বাসার ঠিকানা । মহিলার চেহারা ছিল দয়ালু দয়ালু । বলেছিলেন-বাসায় এসো । এখানে দেশের লোকজন দেখলে বড় মায়া লাগে । মহিম অনেকবার ভেবেছে, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে । কিন্তু ঐ ভাবনা পর্যন্ত । সংকোচ আর কাটিয়ে ওঠতে পারেনা । আজ যখন এদিকে আসা হল, ভাবল এক ঢিলে দুই পাখি মারবে ।
সুবর্ণাদের দেশের বাড়ি নেত্রকোণায় । বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । অনেক বছর ধরে আমিরাতে আছেন । সুবর্ণার জন্মও এখানে । নেত্রকোণাতে আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই । সবাই নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি । সুবর্ণার বাবা জয়ন্ত সেনদের পরিবার দেশ ছেড়ে যায়নি । জয়ন্ত তখন বিশ বছরের যুবক । নাম লেখাল মুক্তিবাহিনীতে । সসস্ত্র যুদ্ধ করল পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে। আত্মীয়-স্বজন অনেকে পীড়াপিড়ি করেছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য । জয়ন্তর সে এক কথা । মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব ।
মহিম ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া বেশ গৌরবের ব্যাপার । মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল শিশু । নইলে সেও দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ত । নীল গেটের সামনে এসব ভাবতে ভাবতে মহিম বুঝতে পারে তার দ্বিধা এখনও কাটেনি । সে গেটের উপর বাগানবিলাস ঝাড়টির দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে । উজ্জ্বল রোঁদে সাদা ফুলগুলো বেশ সুন্দর লাগছিল তার । না, আজ নয় । আর একদিন আসা যাবে।
মহিম ফিরে আসল গ্যারেজে । নূরালী দুহাতের তালু ঘষতে লাগল । মহিম বুঝল এটার অর্থ এবার মালপানি ছাড় ।
মহিম যখন ঘরে ফিরে আসল তখন দুপুর বারটা বাজে । গোসল করা দরকার । বাথরুমে ঢুকে দেখল, টেপের পানি প্রচন্ড গরম । বুঝল এই পানিতে গোসল সম্ভব না । গোসলের জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । এখন মহিমের হাতে কোন কাজ নেই । অবসরে সে বই পড়ে । টেবিল থেকে বই নিতে গিয়ে সুবর্ণার ছবির দিকে তার দৃষ্টি চলে যায় । সে এখনও বুঝতে পারেনা কেন সে সুবর্ণার ছবিটি বাঁধিয়ে টেবিলে রেখেছে । তবে সুবর্ণার ছবির দিকে তাকালে সে তার হৃদয়ের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে । মনে হয় তা হৃদয়ে, নদীতে জোয়ার আসার মত ঝড় আনে । আর সেখানে গজিয়ে ওঠে উচ্ছ্বস, আবেগ, ভাললাগা এসব অনুভুতির চারাগাছ । কিন্তু ঝড় সেগুলো উপড়ে ফেলে । আবার তারা গজিয়ে ওঠে । মহিম বুঝতে পারে দিন দিন তার এসব অনুভুতিগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
মহিম মনের অজান্তেই সুবর্ণার ছবি হাতে তুলে নেয় । দৃষ্টিকে আরও গভীর করল সে । ঠোঁটের কোণে সুবর্ণার হাসিকে বুঝতে চেষ্টা করে । মনে হল অবিকল মোনালিসার মত হাসি । তার উড়ন্ত চুল ঠিক বনলতা সেনের মত । এ চুল তাকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে । ধীরে ধীরে মহিম কী দিশা হারিয়ে ফেলছে ? মহিম বিড় বিড় করে ছবির সাথে কথা বলা শুরু করল ।
এই মেয়ে কী দেখ অমন করে ?
তোমাকে ।
মহিম এদিক ওদিক তাকাল । বুঝতে পারল ছবিও কথা বলে । তার কথা বলার আগ্রহ আর একটু বাড়ল । তুমি দেখতে বনলতা সেনের মত । সেই চুল, সেই মুখের আদল ...
তুমি বনলতা সেনকে দেখেছ ?
মহিম অপ্রস্তুত হল । চিন্তাও করেনি সুবর্ণার কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন আসবে । এখন কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনা । মহিম উত্তর দিল, না দেখিনি । তবে যতবার বনলতা পড়েছি, মনে হত আমিই বুঝি জীবনানন্দ ।
কবিতা লিখ নাকি ?
মহিম ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে, কখনও লিখিনি । তবে লিখব ভাবছি ।
কবি হতে চাও নাকি ?
আমি বনলতার দেখা পেয়েছি । এখন কবি না হয়ে আমার উপায় নেই ।
কোথায় তোমার বনলতা ?
তুমি আমার বনলতা ।
আমি সুবর্ণা । বনলতা নই ।
মহিম বুঝতে পারেনা আর কী বলা যায় । সে একটুখানি ভেবে বলল, তোমার স্মৃতি কাজ করছে না ।
মানে ?
স্মরণ করার চেষ্টা কর । বহুবছর আগের কথা । তোমার জন্ম হয়েছিল নাটোরে।
আমার কিছু মনে নেই ।
তোমাকে দেখে জীবনানন্দ বনলতা সেন লিখেছিল । তাও ভুলে গেছ ?
আমার কিছু মনে নেই ।
এটা স্বাভাবিক । দ্বিতীয় জন্মে প্রথম জীবনের অনেককিছু মনে থাকে না। কিন্তু আমার সমস্যাটা গুরুতর ।
যেমন ?
তোমাকে নিয়ে যত কবিতা লিখছি, সব বনলতা সেন হয়ে যায় । কিছুতাই সুবর্ণা সেন কবিতা লিখতে পারছিনা ।
বিষয়টা তেমন জটিল নয় ।
কী রকম ?
এটা তোমারও দ্বিতীয় জন্ম । প্রথম জন্মে হয়ত জীবনানন্দ ছিলে ।
যদি জীবনানন্দ হতাম, কচি নরম ঘাসের বুকে শুয়ে সোনালী ডানার চিলের উড়া দেখতাম কিংবা ধানসিঁড়ি নদীর তীরে শালিক হয়ে ঘুরে বেড়াতাম । এখানে ধানসিঁড়ি নদীও নেই, সোনালী ডানার চিলও কোথায় ? তবে পার্কের নিমগাছে শালিক দেখেছি প্রচুর ।
ঐ তো, শালিক মানেই তো জীবনানন্দের ফিরে আসা ।
মহিম হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল । এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সঙ্গে কথা বলেছে বুঝতে পেরে দ্বিতীয়বার হাসল ।
সুবর্ণার কথা ভাবতে ভাবতে জুলাই মাস কেটে গেল । ধীরে ধীরে মহিমের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন হতে লাগল । মাঝে মাঝে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পায়না সে । আবার কখনও গাড়ির চাবি, কলম খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায় । একবার তো ট্রাউজারের জিপার লাগাতে ভুলে গিয়েছিল । লংড্রাইভ, মৎস শিকার সব অনিয়মিত হয়ে গেল ।
উইক এন্ডে অলি আসে । কিন্তু লংড্রাইভে যাওয়া হয়না আর । দুজনে ঘরে বসে সময় কাটায় । মহিম বলে, লংড্রাইভ ভাল লাগছে না অলি । মহিমের পরিবর্তন অলির দৃষ্টিতে আটকে থাকে । অলি বুঝতে পারেনা হঠাৎ মহিম ভাইয়ের কী হল । এমন একটা প্রাণবন্ত মানুষ দিন দিন শামুকের মত গোটিয়ে যাচ্ছে । অলির মস্তিষ্কে একসাথে অনেক ভাবনা এসে ভীড় করে । সবগুলোই দুর্ভাবনা । অলি একটা একটা দুর্ভাবনা বাছাই করে । নাহ, কোনটাই মহিম ভাইয়ের সাথে মিলানো যায়না ।
আপনার কী শরীর খারাপ ?
অলির প্রশ্নে মহিম ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে ।
না তো । মহিম আবার ম্যাগাজিনে ডুবে যায় ।
আপনাকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগছে । কোন সমস্যায় পড়েছেন নাকি ?
মহিম ম্যাগাজিন বন্ধ করে টেবিলে পা তুলে দেয় । সোফায় হেলান দিয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে বলল, না, তেমন কিছু নয় । শরীর ঠিক আছে, ভাবছি মন নিয়ে। মানুষের মন বড় পাগল । এই যে আমার মন আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না। মনের বিদ্রোহ থামানোর চেষ্টা করতেছি ।
আপনার কথা বুঝলাম না ? অলি সরাসরি মহিমের মুখের দিকে তাকায় ।
অলি সবকথা সবাই বুঝতে পারেনা । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল মহিম ।
তা ঠিক । খুলে বলুন ?
ব্যাপারটা ব্যাক্তিগত । আমি এখন শেয়ার করতে চাচ্ছিনা । সময় হলে জানতে পারবে ।
অলি আরকিছু জানতে চায়নি । সে যাওয়ার পর মহিম আরও বেশি একা হয়ে গেল। কোনকিছুতেই তার মনে স্বস্তি ফিরে আসেনা । তবে কী শান্তি তার জীবন থেকে চিরতরে উদাও হয়ে গেল ? এসব ভাবতে ভাবতে তার জীবনানন্দের কথা মনে আসে, মনে আসে বনলতা সেন । সে বুঝতে পারেনা কীভাবে বনলতা জীবনানন্দকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল । মহিম আবার সিদ্ধান্ত নেয়, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে এবং তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে আসবে ।
কিন্তু মহিম দেখে তার সামনে হিমালয় পর্বত সমান এক বাঁধা । সুবর্ণা হিন্দু, মহিম মুসলিম । দুই জাতি দুই ধর্ম । পরক্ষণে মহিম ভুল শুধরে নেয় । না, না, একজাতি ধর্ম ভিন্ন । তারা উভয়ে বাঙালি একথা ভেবে সে কিছুটা স্বস্তি পেল । তারপর ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালোবাসার কাছে ধর্ম সবসময় পরাজিত হয়েছে ।
মহিম গাড়িটা এমনভাবে পার্ক করল, যাতে সুবর্ণাদের ঘর থেকে দেখা না যায় । সে হেঁটে সুবর্ণাদের নীল গেটের সামনে এসে দাঁড়াল । এদিকের এলাকাটা বেশ নির্জন। রাস্তায় লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে । হঠাৎ দ্বিধা ফিরে এল তার মনে । মহিম আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে । তার কেবল মনে হতে লাগল, তার সামনে বিশাল খরস্রোতা নদী । পারাপারের নেই খেয়া । তাকে সাঁতরেই নদী পার হতে হবে । কিন্তু এদিকে তার পা দুটিও যেন মাটিতে গেঁথে আছে । নাড়ানোর বিন্দু পরিমাণ ক্ষমতাও তার নেই । মহিম কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা ।এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানেনা । সিদ্ধান্ত নিল ফিরে যাবে । তখন আবার জীবনানন্দে ফিরে গেল সে । তার মনে পড়ল, “আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে”। মহিম বুঝতে পারলনা হঠাৎ এই লাইনটা মনে আসল কেন? তবে কী সে আবার আসবে এখানে ? সে কি ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠছে ? কেন মহিমের বলতে ইচ্ছে করছে- ‘আবার আসিব ফিরে সুবর্ণাদের নীল দরজার ধারে’।
এখন রাত । অন্ধকার ঘরে মহিম একা বসে আছে । সে আজ রাতে বাতি জ্বালাবে না । কারণ অন্ধকারে সে বুঝতে চায় সুবর্ণার চুলের রূপ । জীবনানন্দ কী এরকম অন্ধকারের কথাই বলেছিলেন ? তাহলে বনলতা সেন ও সুবর্ণা সেনের মধ্যে পার্থক্য কই ? কেবল সময়ের ব্যবধান দুজনকে আলাদা করেছে । কিন্তু মহিম তো অন্ধকার চায় না । তবুও সে দেখে তার চারদিকে গাঢ় অন্ধকার ঝুলে আছে । মহিম বুঝতে পারে এই অন্ধকার আছে বলেই তার হৃদয়ে আলোর জন্য আকুলতা বেশি ।
কী ভাবছো ? অন্ধকারে কে যেন কথা বলে উঠল । মহিম অবাক হল । ঘরে তো সুবর্ণার ছবি ছাড়া অন্য কেউ নেই । ছবি যে কথা বলে কথাটা আবার মনে পড়ল তার ।
ভাবছি সুবর্ণা সেনের কথা । মহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । কবে যে আমার জাহাজ তার বন্দরে নোঙর ফেলবে জানিনা ।
আলো জ্বালাও । নচেৎ অন্ধকারে তুমি দিক হারাবে ।
না । অন্ধকারে আমাকে বুঝতে দাও কেন মানুষ আলোর প্রত্যাশা করে ।
কী বুঝলে ?
এখনও অন্ধকারের ঘোর কাটেনি ।
বলেছিলাম না তুমি জীবনানন্দ । কবিতার কী হল ?
যা কিছু লিখি সব এলোমেলো পঙতি । গতরাতে লিখলাম, ‘হাজার বছর ধরে খুঁজিতেছি সুবর্ণা সেন, বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে ধূসর মরু নগরে’ । পছন্দ মত আর লাইন পাচ্ছিনা ।
এতো জীবনানন্দ হয়ে গেল ।
যতদিন বনলতা থাকবে, ততদিন জীবনানন্দও থাকবে ।
তাহলে সুবর্ণা সেনের কী হবে ?
হঠাৎ মহিমের ঘোর কাটে গেল । সে বুঝতে পারল, এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সামনে বিড়বিড় করছে । নির্ঘাত পাগল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ । মহিম এখন কী করবে । অলির সাহায্য চাইবে ? কিন্তু মনের সায় মিলছেনা । সে আবার নিজেকে তৈরি করে । মনকে আরও দৃঢ় করে । এবার তাকে সফল হতেই হবে । সে সুবর্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে, আমিই তোমার জীবনানন্দ ।
আজ মহিমের মনে হল হঠাৎ তাপমাত্রা কমেছে । বিকেলের সূর্য যেন আরও নরম হয়ে এল । খেজুরের মওসুম । গাছে গাছে কাঁচাপাকা খেজুর দেখে তার পোয়াতি নারীদের কথাই মনে আসে । সে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করল গাছে গাছে পাখিদের আগ্রাসন। পাখিরা যতটা না খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি । মহিমের মনে হল পাখি জীবন বড় আনন্দের । যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে । ভিসা, পাসপোর্ট কিছুই লাগেনা। এমন কি ইমিগ্রেশনের ঝামেলাও পোহাতে হয়না । জীবনানন্দ কেন দ্বিতীয় জন্মে পাখি হতে চেয়েছিলেন, সে কথা ভাবতে ভাবতে মহিম অনেক পথ পার হয়ে এল । পথ যেন আর ফুরাতে চায় না । মনে হচ্ছে সে হাজার বছর ধরে হাঁটছে । আজ তার ক্লান্তিও লাগছেনা । অনেকদিন পর আজ আকাশে মেঘও দেখল সে । আরবসাগর থেকে একখণ্ড মেঘ ওড়ে এসে জমাট বেঁধে আছে । সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে । দিবসের বিদায়ের বিষণ্ণ সুর তুলে আরব উপসাগরের পানি ছুঁই ছুঁই করছে । বাতাসও যেন গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে ডেকে আনছে সন্ধ্যার অন্ধকার । ঠিক এরকম মুহূর্তে মহিম পৌঁছে গেল সুবর্ণাদের নীল গেটের সামনে । হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেল পাশের খেজুর বাগানের দিকে । দেখল, সুবর্ণা এক যুবকের হাত ধরে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে ।
মহিম হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল । বুঝতে পারল সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার আবার জীবনানন্দের কথা মনে পড়ল । চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, দাঁড়াও সুবর্ণা, তুমি যেয়ো নাকো অই যুবকের সাথে ।
মহিম সৌখিন মৎস শিকারী । উইক এন্ডে লংড্রাইভে যেতে পছন্দ করে । কোন কোন উইক এন্ডে সে যায় আজমান অথবা রাস আল খাইমা । আবার কখনও ফুজিরা অথবা কলবা । সঙ্গে থাকে অলি ও বড়শীর ছিপ । কিন্তু আজকের পরিকল্পনা বাতিল করতে হল বলে তার মনে একটা যন্ত্রণার কাঁটা বিদে রইল । তার যত রাগ মেরুন কালারের কেমরি গাড়িটার উপর । ওটাই আজ তার বাড়া ভাতে ছাই দিল । গাড়ির এয়ারকুলার কাজ করছে না । জুলাই মাসের গরমে দেহে প্রাণ থাকতে চায় না । সুযোগ পেলেই খাঁচা ছেড়ে যায় যায় অবস্থা ।
মহিম চিন্তা করে আগে গাড়িটা সারানো দরকার । তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে। কিন্তু তারও আগে অলিকে জানাতে হয় প্রোগ্রাম বাতিলের কথা ।
হ্যালো, অলি আজ আর যাচ্ছিনা কলবা ।
অন্য কোথাও যাচ্ছেন নাকি মহিম ভাই ?
আরে না না, গাড়ির ট্রাবল । তোমার কী মনে হয় না আগে গাড়িটা সারানো উচিৎ?
অবশ্যই ! তো তুমি কার গ্যারেজ প্রেফার কর বেশি ?
নূরালীর ।
আমিও নূরালীর কথাই ভাবছিলাম । ঠিক আছে নেক্সট উইক এন্ডের জন্য তৈরি থেক।
মহিম মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গাড়ির ইগ্নিশন সুইচে চাবি ঘুরিয়ে দিল । কুড়ি মিনিট গাড়ি চালিয়ে সে পৌঁছে গেল নূরালীর গ্যারেজে । শারজাহর শহরতলীতে এখানকার গ্যারেজগুলো গড়ে ওঠেছে । নূরালীর গ্যারেজ সানাইয়া আরবা । সানাইয়া আরবা-র বাংলা করলে দাঁড়ায় শিল্প এলাকা চার ।
নূরালী এগিয়ে এল । আরে মহিম ভাই যে ! কি মনে করে গরীবখানায় ?
এটিই নূরালীর স্টাইল । সব কাস্টমারকে সে এভাবে রিসেপ্সন দেয় । স্বভাবে হাড়কিপ্টে হলেও দিল খুলে কখা বলে সে । দেশের বড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে । বাইশ বছর ধরে আমিরাতে আছে । এসেছিল নাকি আঠার বছর বয়সে । অর্থ-বিত্ত বানিয়েছ প্রচুর। এ লাইনের ধান্দা সে ভাল বুঝে, আবার কাজও ভাল জানে ।
এয়ারকুলার কাজ করছেনা । মোটেও কুল হচ্ছেনা । চালু করলে গোঁ গোঁ শব্দ করে।
মহিম ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল ।
আপনি বসেন । নূরালী মেটালের টুল এগিয়ে দিল । আমি দেখতাছি সমস্যাটা কোথায় । আমি হলাম গিয়া গাড়ির ডাক্তার । গাড়ির রোগ-বালা সারানো আমার কাম । কী বলেন মহিম ভাই ?
সমর্থনের আশায় নূরালী ঘাড় বাঁকা করে মহিমের দিকে তাকাল । সে এয়ারকুলার চালু করলে ওটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে ।
খুব ভাল বলেছ । মহিম হাসে । তার চোখের ভ্রূ কুচকে যায় । সেখানে শিশিরের মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে । মহিম রুমালে ঘাম মুছে নিল । এর মধ্যে দেশে গিয়াছিলে নাকি ?
নূরালী কম্প্রেসারের নাট খুলতে খুলতে ডাক দিল, গফুর ছয় নম্বর রেঞ্চটা দিয়ে যা। নুরালী আবার নাট খুলতে মনোযোগ দিল । তার ডান হাতের পেশী টানটান হয়ে ফুলে ওঠল । গতমাসেই আসলাম দেশ থেইক্যা ।
তো দেশ গেরামের খবর কী ? মহিম প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারে এটি একটি গতানুগতিক প্রশ্ন । দেশ থেকে কেউ ঘুরে আসলে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় । সে যখন গত জানুয়ারির দিকে দেশ থেকে ঘুরে আসল, যার সাথে দেখা হয় সবাই দেশের খবর জানতে চাইত । বোধহয় দেশ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারনে প্রবাসী হৃদয়ে নিরন্তর দেশ প্রীতির অনুভূতিগুলো তুষারের মত স্তূপ হয়ে থাকে ।
হঠাৎ একটা গরম হাওয়া আসে । সঙ্গে নিয়ে আসে প্রচুর ধূলোবালি । মহিম দু’হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল ঝাড়ে ।
কোন পরিবর্তন নাই । মারামারি, কাটাকাটি, জ্বালাও,পড়াও, হরতাল এসবের বন্ধ নাই । এবার গিয়া মনে হইল, দেশটা বুঝি অহনো বৃটিশের দখলে । নূরালী হাতের উল্টা পিঠে কপালের ঘাম মুছে । মহিম ভাই কম্প্রেসার নষ্ট । বদলাতে হবে ।
রিপেয়ার করে চালানো যাবে না ? মহিম বসা থেকে ওঠে গাড়ির খোলা বনেটের উপর ঝুঁকে পড়ে ।
রিপেয়ার করা যবে । কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারবনা । নূরালি ছয় নম্বর রেঞ্চ দিয়ে পিঠ চুলকায় ।
তাহলে নতুন লাগিয়ে দাও । কতক্ষণ লাগবে ? মহিম হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে ।
একঘণ্টা টাইম তো দিতে হবে । নূরালী আবার ডাক দেয়, গফুর !
ওকে । তুমি কাজ কর । আমি একঘন্টার মধ্যেই ফিরব ।
নূরালী মাথা নাড়ে ।
মহিম নূরালীর গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসে । এদিকের বাইলেনগুলো কাঁচা । পাকা হওয়ার কোন আলামত চোখে পড়েনা । ধুলোর ভেতর গাড়িগুলো ছুটে গেলে বাতাসে কুন্ডলী পাকিয়ে ধুলো ওঠে । এদিকে গ্যারেজ ও স্পেয়ার পার্টসের দোকান ছাড়া অন্যকোন স্থাপনা নেই । নেই আকাশ ছোঁয়া ভবন । মানুষের ঘরবাড়ি বেশ দূরে । পুরো এলাকা ফাঁকা ফাঁকা লাগে মহিমের । কিছুদূর হাঁটতেই সে একটা গ্রোসারী সপ পেয়ে গেল । ইতিমধ্যে তেজীরোঁদ তার বুকের কলস শুকিয়ে ফেলেছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল গরুর মত জিব চাটতে । সে গ্রোসারী সপে ঢুকে পড়ল।
দোকানি ইন্ডিয়ান মালোয়াড়ি । হাল্কাপাতলা গড়ন । গায়ের রঙ শ্যামলা । অনেকটা বাঙালিদের মত । নাকের নিচে ঘন ঘোফ । মহিম হিন্দীতে বলল, কোল্ড ড্রিংকস মিলেগি ?
কোন চা ওয়ালা ? দোকানি জবাবের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে মহিমের দিকে ।
মহিম ইতস্তত করল । সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কোন ড্রিংকটা নিবে । একটু ভেবে বলল, সেভেন আপ ।
অর কুচ চাইয়ে ? দোকানি আগ্রহ নিয়ে তাকাল মহিমের দিকে ।
এক প্যাকেট সিগারেট । মহিম সেভেন আপের ক্যানে চুমুক দিল ।
কোন চা ব্র্যান্ড? দোকানি তার ঘোফের উপর একবার হাত বুলাল ।
বেনসন এন্ড হেজেস ।
ক্যানের গায়ে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমলে মহিমের হাত ভিজে গেল । সে রুমাল বের করে হাত মুছে নিল । বেনসন এন্ড হেজেসের প্যাকেট বুক পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করল, বিল কিতনা হোগি ?
দশ দিরহাম । দোকানি বারকোড মেসিন চালু করে বিল মিটিয়ে নিল।
গ্রোসারি সপ থেকে বেরিয়ে মহিম হাঁটছিল আর মাঝে মাঝে কোল্ড ড্রিংকসে হাল্কা হাল্কা চুমুক দিচ্ছে । কিছুদূর এগোতেই রাস্তাটা ইংরেজি টি অক্ষরের মত ডান ও বাম দিকে মোড় নিয়েছে। সে মোড় পর্যন্ত এসে থামল । এদিকে রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুর গাছ । সে একটা খেজুর গাছের ছায়াতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিল ।
মহিম দেখল, বাম দিকের রাস্তাতে বেশকিছু ঘরবাড়ি আছে । ডানের দিকের রাস্তাতে খেজুর বাগান ছাড়া আর কিছু নেই । সে বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে একটা বড়ির সামনে দাঁড়াল । না, এই বাড়িটা নয় । স্বগতোক্তি করল । সুবর্ণা সেন বলেছিল, তাদের গেটের রঙ নীল । মহিম আরও তিনটি বাড়ি পার হয়ে নীল গেট পেয়ে গেল । সে গেটের সামনে দাড়িয়ে ভাবছিল, ভেতরে যবে কিনা । কোথা থেকে একটা ইতস্তত ভাবনা এসে তাকে থামিয়ে দিল ।
সুবর্ণার সঙ্গে পরিচয় খুব বেশি দিনের নয় । মাস দুয়েক আগের কথা । আল আইন গিয়েছিল বেড়াতে । অলি জোর করেছিল বেশি । চলেন মহিম ভাই, আদিযুগের পুরাকীর্তি দেখে আসি । এসব জিনিসের প্রতি মহিমের আগ্রহ ও কম নয় । মহিম না করেনি ।
অলি ছেলেটা বেশ চটপটে । মহিমের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি । হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলে কলেজে আর ভর্তি হতে পারেনি। ধার দেনা করে আমিরাতে চলে আসে । মহিমের অফিসের সাথে লাগোইয়া সাফির শপিং মলে সিকিউরিটির কাজ করে । বাড়ি ঢাকার মিরপুরে । মহিমদের একই মহল্লা। মহিম ছোটবেলা থেকেই অলিকে চিনত ।
পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সমাধি সৌধ দেখে মহিম অলিকে বলেছিল, অলি তোমাকে ধন্যবাদ । অ্যায় এম ভেরি এক্সাইটেড !
এই সৌধগুলো রোঁদে শুকানো ইট দিয়ে বানানো । দেখতে ডিম্বাকৃতির । স্থানীয়রা এটাকে বলে হাফিতের সমাধি। নির্মাণকাল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ।
মহিম বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসব সৌধের ছবি তুলছিল । হঠাৎ দেখে ডিজিটাল ক্যামারার ফ্রেমে ভেসে ওঠেছে একটি নারীমুখ । চেহারা মিষ্টি । ঘন কালো চুল ওড়ছিল বাতাসে । পাখির ওড়ালের মত ভ্রূ ভঙ্গির নিচে চোখ দুটিকে মনে হল, পাহাড়ের পদতলে শান্ত হয়ে বসে থাকা কাপ্তাই হ্রদ । নারীমুখ বন্দী হয়ে গেল ক্যামেরায় ।
মেয়েটির নাম সুবর্ণা । এসেছে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে । পরিচয় পর্বের শেষে সুবর্ণার মা দিয়েছিল বাসার ঠিকানা । মহিলার চেহারা ছিল দয়ালু দয়ালু । বলেছিলেন-বাসায় এসো । এখানে দেশের লোকজন দেখলে বড় মায়া লাগে । মহিম অনেকবার ভেবেছে, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে । কিন্তু ঐ ভাবনা পর্যন্ত । সংকোচ আর কাটিয়ে ওঠতে পারেনা । আজ যখন এদিকে আসা হল, ভাবল এক ঢিলে দুই পাখি মারবে ।
সুবর্ণাদের দেশের বাড়ি নেত্রকোণায় । বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । অনেক বছর ধরে আমিরাতে আছেন । সুবর্ণার জন্মও এখানে । নেত্রকোণাতে আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই । সবাই নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি । সুবর্ণার বাবা জয়ন্ত সেনদের পরিবার দেশ ছেড়ে যায়নি । জয়ন্ত তখন বিশ বছরের যুবক । নাম লেখাল মুক্তিবাহিনীতে । সসস্ত্র যুদ্ধ করল পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে। আত্মীয়-স্বজন অনেকে পীড়াপিড়ি করেছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য । জয়ন্তর সে এক কথা । মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব ।
মহিম ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া বেশ গৌরবের ব্যাপার । মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল শিশু । নইলে সেও দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ত । নীল গেটের সামনে এসব ভাবতে ভাবতে মহিম বুঝতে পারে তার দ্বিধা এখনও কাটেনি । সে গেটের উপর বাগানবিলাস ঝাড়টির দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে । উজ্জ্বল রোঁদে সাদা ফুলগুলো বেশ সুন্দর লাগছিল তার । না, আজ নয় । আর একদিন আসা যাবে।
মহিম ফিরে আসল গ্যারেজে । নূরালী দুহাতের তালু ঘষতে লাগল । মহিম বুঝল এটার অর্থ এবার মালপানি ছাড় ।
মহিম যখন ঘরে ফিরে আসল তখন দুপুর বারটা বাজে । গোসল করা দরকার । বাথরুমে ঢুকে দেখল, টেপের পানি প্রচন্ড গরম । বুঝল এই পানিতে গোসল সম্ভব না । গোসলের জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । এখন মহিমের হাতে কোন কাজ নেই । অবসরে সে বই পড়ে । টেবিল থেকে বই নিতে গিয়ে সুবর্ণার ছবির দিকে তার দৃষ্টি চলে যায় । সে এখনও বুঝতে পারেনা কেন সে সুবর্ণার ছবিটি বাঁধিয়ে টেবিলে রেখেছে । তবে সুবর্ণার ছবির দিকে তাকালে সে তার হৃদয়ের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে । মনে হয় তা হৃদয়ে, নদীতে জোয়ার আসার মত ঝড় আনে । আর সেখানে গজিয়ে ওঠে উচ্ছ্বস, আবেগ, ভাললাগা এসব অনুভুতির চারাগাছ । কিন্তু ঝড় সেগুলো উপড়ে ফেলে । আবার তারা গজিয়ে ওঠে । মহিম বুঝতে পারে দিন দিন তার এসব অনুভুতিগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
মহিম মনের অজান্তেই সুবর্ণার ছবি হাতে তুলে নেয় । দৃষ্টিকে আরও গভীর করল সে । ঠোঁটের কোণে সুবর্ণার হাসিকে বুঝতে চেষ্টা করে । মনে হল অবিকল মোনালিসার মত হাসি । তার উড়ন্ত চুল ঠিক বনলতা সেনের মত । এ চুল তাকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে । ধীরে ধীরে মহিম কী দিশা হারিয়ে ফেলছে ? মহিম বিড় বিড় করে ছবির সাথে কথা বলা শুরু করল ।
এই মেয়ে কী দেখ অমন করে ?
তোমাকে ।
মহিম এদিক ওদিক তাকাল । বুঝতে পারল ছবিও কথা বলে । তার কথা বলার আগ্রহ আর একটু বাড়ল । তুমি দেখতে বনলতা সেনের মত । সেই চুল, সেই মুখের আদল ...
তুমি বনলতা সেনকে দেখেছ ?
মহিম অপ্রস্তুত হল । চিন্তাও করেনি সুবর্ণার কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন আসবে । এখন কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনা । মহিম উত্তর দিল, না দেখিনি । তবে যতবার বনলতা পড়েছি, মনে হত আমিই বুঝি জীবনানন্দ ।
কবিতা লিখ নাকি ?
মহিম ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে, কখনও লিখিনি । তবে লিখব ভাবছি ।
কবি হতে চাও নাকি ?
আমি বনলতার দেখা পেয়েছি । এখন কবি না হয়ে আমার উপায় নেই ।
কোথায় তোমার বনলতা ?
তুমি আমার বনলতা ।
আমি সুবর্ণা । বনলতা নই ।
মহিম বুঝতে পারেনা আর কী বলা যায় । সে একটুখানি ভেবে বলল, তোমার স্মৃতি কাজ করছে না ।
মানে ?
স্মরণ করার চেষ্টা কর । বহুবছর আগের কথা । তোমার জন্ম হয়েছিল নাটোরে।
আমার কিছু মনে নেই ।
তোমাকে দেখে জীবনানন্দ বনলতা সেন লিখেছিল । তাও ভুলে গেছ ?
আমার কিছু মনে নেই ।
এটা স্বাভাবিক । দ্বিতীয় জন্মে প্রথম জীবনের অনেককিছু মনে থাকে না। কিন্তু আমার সমস্যাটা গুরুতর ।
যেমন ?
তোমাকে নিয়ে যত কবিতা লিখছি, সব বনলতা সেন হয়ে যায় । কিছুতাই সুবর্ণা সেন কবিতা লিখতে পারছিনা ।
বিষয়টা তেমন জটিল নয় ।
কী রকম ?
এটা তোমারও দ্বিতীয় জন্ম । প্রথম জন্মে হয়ত জীবনানন্দ ছিলে ।
যদি জীবনানন্দ হতাম, কচি নরম ঘাসের বুকে শুয়ে সোনালী ডানার চিলের উড়া দেখতাম কিংবা ধানসিঁড়ি নদীর তীরে শালিক হয়ে ঘুরে বেড়াতাম । এখানে ধানসিঁড়ি নদীও নেই, সোনালী ডানার চিলও কোথায় ? তবে পার্কের নিমগাছে শালিক দেখেছি প্রচুর ।
ঐ তো, শালিক মানেই তো জীবনানন্দের ফিরে আসা ।
মহিম হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল । এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সঙ্গে কথা বলেছে বুঝতে পেরে দ্বিতীয়বার হাসল ।
সুবর্ণার কথা ভাবতে ভাবতে জুলাই মাস কেটে গেল । ধীরে ধীরে মহিমের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন হতে লাগল । মাঝে মাঝে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পায়না সে । আবার কখনও গাড়ির চাবি, কলম খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায় । একবার তো ট্রাউজারের জিপার লাগাতে ভুলে গিয়েছিল । লংড্রাইভ, মৎস শিকার সব অনিয়মিত হয়ে গেল ।
উইক এন্ডে অলি আসে । কিন্তু লংড্রাইভে যাওয়া হয়না আর । দুজনে ঘরে বসে সময় কাটায় । মহিম বলে, লংড্রাইভ ভাল লাগছে না অলি । মহিমের পরিবর্তন অলির দৃষ্টিতে আটকে থাকে । অলি বুঝতে পারেনা হঠাৎ মহিম ভাইয়ের কী হল । এমন একটা প্রাণবন্ত মানুষ দিন দিন শামুকের মত গোটিয়ে যাচ্ছে । অলির মস্তিষ্কে একসাথে অনেক ভাবনা এসে ভীড় করে । সবগুলোই দুর্ভাবনা । অলি একটা একটা দুর্ভাবনা বাছাই করে । নাহ, কোনটাই মহিম ভাইয়ের সাথে মিলানো যায়না ।
আপনার কী শরীর খারাপ ?
অলির প্রশ্নে মহিম ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে ।
না তো । মহিম আবার ম্যাগাজিনে ডুবে যায় ।
আপনাকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগছে । কোন সমস্যায় পড়েছেন নাকি ?
মহিম ম্যাগাজিন বন্ধ করে টেবিলে পা তুলে দেয় । সোফায় হেলান দিয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে বলল, না, তেমন কিছু নয় । শরীর ঠিক আছে, ভাবছি মন নিয়ে। মানুষের মন বড় পাগল । এই যে আমার মন আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না। মনের বিদ্রোহ থামানোর চেষ্টা করতেছি ।
আপনার কথা বুঝলাম না ? অলি সরাসরি মহিমের মুখের দিকে তাকায় ।
অলি সবকথা সবাই বুঝতে পারেনা । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল মহিম ।
তা ঠিক । খুলে বলুন ?
ব্যাপারটা ব্যাক্তিগত । আমি এখন শেয়ার করতে চাচ্ছিনা । সময় হলে জানতে পারবে ।
অলি আরকিছু জানতে চায়নি । সে যাওয়ার পর মহিম আরও বেশি একা হয়ে গেল। কোনকিছুতেই তার মনে স্বস্তি ফিরে আসেনা । তবে কী শান্তি তার জীবন থেকে চিরতরে উদাও হয়ে গেল ? এসব ভাবতে ভাবতে তার জীবনানন্দের কথা মনে আসে, মনে আসে বনলতা সেন । সে বুঝতে পারেনা কীভাবে বনলতা জীবনানন্দকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল । মহিম আবার সিদ্ধান্ত নেয়, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে এবং তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে আসবে ।
কিন্তু মহিম দেখে তার সামনে হিমালয় পর্বত সমান এক বাঁধা । সুবর্ণা হিন্দু, মহিম মুসলিম । দুই জাতি দুই ধর্ম । পরক্ষণে মহিম ভুল শুধরে নেয় । না, না, একজাতি ধর্ম ভিন্ন । তারা উভয়ে বাঙালি একথা ভেবে সে কিছুটা স্বস্তি পেল । তারপর ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালোবাসার কাছে ধর্ম সবসময় পরাজিত হয়েছে ।
মহিম গাড়িটা এমনভাবে পার্ক করল, যাতে সুবর্ণাদের ঘর থেকে দেখা না যায় । সে হেঁটে সুবর্ণাদের নীল গেটের সামনে এসে দাঁড়াল । এদিকের এলাকাটা বেশ নির্জন। রাস্তায় লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে । হঠাৎ দ্বিধা ফিরে এল তার মনে । মহিম আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে । তার কেবল মনে হতে লাগল, তার সামনে বিশাল খরস্রোতা নদী । পারাপারের নেই খেয়া । তাকে সাঁতরেই নদী পার হতে হবে । কিন্তু এদিকে তার পা দুটিও যেন মাটিতে গেঁথে আছে । নাড়ানোর বিন্দু পরিমাণ ক্ষমতাও তার নেই । মহিম কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা ।এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানেনা । সিদ্ধান্ত নিল ফিরে যাবে । তখন আবার জীবনানন্দে ফিরে গেল সে । তার মনে পড়ল, “আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে”। মহিম বুঝতে পারলনা হঠাৎ এই লাইনটা মনে আসল কেন? তবে কী সে আবার আসবে এখানে ? সে কি ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠছে ? কেন মহিমের বলতে ইচ্ছে করছে- ‘আবার আসিব ফিরে সুবর্ণাদের নীল দরজার ধারে’।
এখন রাত । অন্ধকার ঘরে মহিম একা বসে আছে । সে আজ রাতে বাতি জ্বালাবে না । কারণ অন্ধকারে সে বুঝতে চায় সুবর্ণার চুলের রূপ । জীবনানন্দ কী এরকম অন্ধকারের কথাই বলেছিলেন ? তাহলে বনলতা সেন ও সুবর্ণা সেনের মধ্যে পার্থক্য কই ? কেবল সময়ের ব্যবধান দুজনকে আলাদা করেছে । কিন্তু মহিম তো অন্ধকার চায় না । তবুও সে দেখে তার চারদিকে গাঢ় অন্ধকার ঝুলে আছে । মহিম বুঝতে পারে এই অন্ধকার আছে বলেই তার হৃদয়ে আলোর জন্য আকুলতা বেশি ।
কী ভাবছো ? অন্ধকারে কে যেন কথা বলে উঠল । মহিম অবাক হল । ঘরে তো সুবর্ণার ছবি ছাড়া অন্য কেউ নেই । ছবি যে কথা বলে কথাটা আবার মনে পড়ল তার ।
ভাবছি সুবর্ণা সেনের কথা । মহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । কবে যে আমার জাহাজ তার বন্দরে নোঙর ফেলবে জানিনা ।
আলো জ্বালাও । নচেৎ অন্ধকারে তুমি দিক হারাবে ।
না । অন্ধকারে আমাকে বুঝতে দাও কেন মানুষ আলোর প্রত্যাশা করে ।
কী বুঝলে ?
এখনও অন্ধকারের ঘোর কাটেনি ।
বলেছিলাম না তুমি জীবনানন্দ । কবিতার কী হল ?
যা কিছু লিখি সব এলোমেলো পঙতি । গতরাতে লিখলাম, ‘হাজার বছর ধরে খুঁজিতেছি সুবর্ণা সেন, বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে ধূসর মরু নগরে’ । পছন্দ মত আর লাইন পাচ্ছিনা ।
এতো জীবনানন্দ হয়ে গেল ।
যতদিন বনলতা থাকবে, ততদিন জীবনানন্দও থাকবে ।
তাহলে সুবর্ণা সেনের কী হবে ?
হঠাৎ মহিমের ঘোর কাটে গেল । সে বুঝতে পারল, এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সামনে বিড়বিড় করছে । নির্ঘাত পাগল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ । মহিম এখন কী করবে । অলির সাহায্য চাইবে ? কিন্তু মনের সায় মিলছেনা । সে আবার নিজেকে তৈরি করে । মনকে আরও দৃঢ় করে । এবার তাকে সফল হতেই হবে । সে সুবর্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে, আমিই তোমার জীবনানন্দ ।
আজ মহিমের মনে হল হঠাৎ তাপমাত্রা কমেছে । বিকেলের সূর্য যেন আরও নরম হয়ে এল । খেজুরের মওসুম । গাছে গাছে কাঁচাপাকা খেজুর দেখে তার পোয়াতি নারীদের কথাই মনে আসে । সে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করল গাছে গাছে পাখিদের আগ্রাসন। পাখিরা যতটা না খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি । মহিমের মনে হল পাখি জীবন বড় আনন্দের । যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে । ভিসা, পাসপোর্ট কিছুই লাগেনা। এমন কি ইমিগ্রেশনের ঝামেলাও পোহাতে হয়না । জীবনানন্দ কেন দ্বিতীয় জন্মে পাখি হতে চেয়েছিলেন, সে কথা ভাবতে ভাবতে মহিম অনেক পথ পার হয়ে এল । পথ যেন আর ফুরাতে চায় না । মনে হচ্ছে সে হাজার বছর ধরে হাঁটছে । আজ তার ক্লান্তিও লাগছেনা । অনেকদিন পর আজ আকাশে মেঘও দেখল সে । আরবসাগর থেকে একখণ্ড মেঘ ওড়ে এসে জমাট বেঁধে আছে । সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে । দিবসের বিদায়ের বিষণ্ণ সুর তুলে আরব উপসাগরের পানি ছুঁই ছুঁই করছে । বাতাসও যেন গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে ডেকে আনছে সন্ধ্যার অন্ধকার । ঠিক এরকম মুহূর্তে মহিম পৌঁছে গেল সুবর্ণাদের নীল গেটের সামনে । হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেল পাশের খেজুর বাগানের দিকে । দেখল, সুবর্ণা এক যুবকের হাত ধরে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে ।
মহিম হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল । বুঝতে পারল সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার আবার জীবনানন্দের কথা মনে পড়ল । চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, দাঁড়াও সুবর্ণা, তুমি যেয়ো নাকো অই যুবকের সাথে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
উদ্বাস্তু নিশাচর ৩১/০৮/২০১৪খুব ভাল
-
বিজয় রায় (গাইঘাটা) ২০/০৮/২০১৪ভাল লাগল
-
রায়হান রহমান ১২/০৮/২০১৪ভা েলা িলখু িন
-
Shopnil Shishir(MD.Shariful Hasan) ১১/০৮/২০১৪khub valo laglo
-
কবি মোঃ ইকবাল ১১/০৮/২০১৪খুব ভালো লাগলো ভাই।